লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা


কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।


*
*
শত সহস্র কষ্টের ভারে নুয়ে পড়েছেন হীরণের পিতা-মাতা, আর একমাত্র বোন হিরা! সেই হাসপাতালের করিডোর যেন নিঃশব্দ কান্নার প্রতিধ্বনি বহন করছে। বিগত রাতের গভীর অন্ধকারে, হীরণকে নিঃপ্রাণ অবস্থায় পথের মাঝে পড়ে থাকতে দেখে কিছু মানুষ তাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিল। চিকিৎসকরা বলেন, হীরণের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নৃ'শংসতার শিকার; হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে এমন নির্ম'মভাবে যে পঙ্গুত্বের ছায়া অনিবার্য হয়ে উঠেছে। তার শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি দেখে তাকে ঢাকা প্রেরণ করা হয়েছে।
হীরণের মা বিষয়টি গোপন রাখতে চেয়েছেন, কেবলমাত্র হাবিবুর রহমানকে অবহিত করেছেন। তিনি চাননি মিলির বিয়ের দিনে এমন বেদনাবিধুর সংবাদ ছড়িয়ে বিয়ের আনন্দময় পরিবেশে কোনো ছায়া পড়ুক। বিয়ের অনুষ্ঠানটি নির্বিঘ্নে শেষ হবার পরেই এই দুঃসংবাদ প্রকাশ করা হবে, যেন আনন্দের আবহে কোনো ঝঞ্ঝা সৃষ্টি না হয়। তবে হঠাৎ করেই বিয়ের দিনটি সমাগত হওয়ায় নানা প্রতিকূলতা আর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে সবাইকে। সমাজের প্রচলিত নিয়ম-নীতির বাইরে গিয়ে এমন ঘটনার জন্য জবেদা বেগম ক্রুদ্ধ হয়ে আছেন। মেয়ের বিয়ের পূর্ণতা পাওয়ার পূর্বেই তার ফুফুর প্রস্থান, যা এক অস্বাভাবিক ঘটনা এবং তা মায়ের রাগের কারণ হওয়াই স্বাভাবিক।
তবু হীরণের মা দৃঢ় মনোভাব নিয়ে পরিস্থিতি সামলেছেন। তিনি স্বামীর নামে একটি 'জরুরি কাজ'কে কারণ হিসেবে তুলে ধরলেন এবং তারই ছত্রছায়ায় মিথ্যা বাস্তবতার আড়ালে থেকে তিনজন দ্রুত চলে আসার উপায় খুঁজে পেলেন। বিয়ের অনুষ্ঠানের স্রোতে কেউই তখন এতটুকু সন্দেহ করতে পারল না, যেন সবই ঘটে যাচ্ছে পূর্বপরিকল্পিতভাবে।তারপরও বিয়ের বিশাল কর্মযজ্ঞের মাঝে, কোনো কিছু খতিয়ে দেখার সুযোগ কারো ছিল না। বিয়ের মতো উৎসবের ক্ষেত্রে তো কর্মের অন্ত নেই—অতিথি আপ্যায়ন, সাজসজ্জা, রান্নাবান্নার প্রস্তুতি, শত রকমের আয়োজন। প্রতিটি কাজ যেন একে অপরের সাথে বেঁধে আছে, সময় যেন হাতের মুঠোয় ধরা দিচ্ছে না।
এই ব্যস্ততার আবরণে, হীরণের মা-র দ্রুত প্রস্থানের কারণ নিয়ে কেউ আর বিশেষ মাথা ঘামানোর অবকাশ পেল না। বিয়ের আনন্দে ডুবে থাকা মানুষেরা, বরপক্ষ থেকে কন্যাপক্ষ, সবাই আপন দায়িত্বে ব্যস্ত। যেন ঘটনার ধূসর সত্য ঢেকে গেলো সাজসজ্জার ঝলমলে আবহে।
_________________
বিকেলের কোমল আলো ঝাপসা হয়ে সন্ধ্যার আবরণে ঢেকে গিয়েছে, আর সেই সন্ধ্যা ক্রমশ গড়িয়ে পরিণত হয়েছে রাত্রিতে। এদিকে প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী রাতেই বড়পক্ষের আগমন ঘটে, আর এই মুহূর্তে তারা আসন্ন পথেই রয়েছে। বিয়ের বাড়িতে আনন্দের ধারা প্রবাহিত হলেও, সেই উচ্ছ্বলতার মাঝে পূর্বিকার অন্তরে যেন বিষণ্নতার ছায়া নেমে এসেছে। বর্ণিল আলোয় ঝলমলে এ বাড়ির এক কোণে, একাকী মলিন মুখে বসে রয়েছে সে, চিন্তায় নিমগ্ন। সারাদিনের কথা ভাবতে ভাবতে মন যেন এক বিপুল ভারে নত হয়েছে।
সকালের সেই তীব্র বাক-বিতণ্ডা! আফ্রিদির সাথে কিছুটা তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল বটে—ছেলেটি বরাবরই এমন রাগী, বিনা কারণে তর্কে জড়ায়। কিন্তু পূর্বিকা যখন নিজের ভুলটি অনুভব করল, তখনই আফ্রিদির কাছে গিয়েছিল, কিন্তু তার বিনিময়ে যা পেল, তা ছিল নিদারুণ অপমান। আর সেই অপমানের আগুনে আরও জ্বালানি যোগ করল পূর্বিকার ভাই, যেন পরিস্থিতির জটিলতা আরও বাড়িয়ে তুলল।
এখন কীভাবে এই অস্থির হৃদয়কে শান্ত করবে? যে আফ্রিদি চলে গেল, সে তো আর ফিরে এল না। কোথায় সে? তার মনের অশান্তি যেন দম বন্ধ করা এক বোঝার মতো ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে। পূর্বিকার মনে হঠাৎ করেই বিদ্যুৎ চমকের মতো এক ভাবনা এসে ভর করল—তাহলে কি আফ্রিদি দেখে ফেলেছে?
সে আতঙ্কিত কণ্ঠে ফিসফিস করে নিজেকে বলে উঠল,
——— "আমি যে মুগ্ধর সাথে কথা বলেছি, আফ্রিদি কোনোভাবে তা দেখে ফেলেনি তো?"
এ এক গভীর সন্দেহের বৃত্তে আটকে পড়েছে পূর্বিকা, যার মধ্যে দিয়ে তার চিন্তাপ্রবাহ এখন অন্ধকারের মাঝে পথ খুঁজছে।
যদি এমনটা সত্যিই ঘটে থাকে, তবে নিঃসন্দেহে পূর্বিকার চিন্তার আকাশে ঝড়ের ঘনঘটা তৈরি হবে। কারণ, সে তো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আফ্রিদিকে; মুগ্ধর নাম কখনোই জড়াবে না, তার সাথে আর কোনো সম্পর্কেও কথা বলবে না। কিন্তু আফ্রিদি! সে তো এক অদম্য চরিত্র, প্রতিশ্রুতির প্রতি তার এক কঠোর ভক্তি। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের চিন্তা তার অন্তরে তীব্র বিরোধ এনে দেয়। তবু পূর্বিকা হতভাগ্য সে বাধ্য হয়েই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে হয়েছে। কারণ, নিয়তির কাছে মানুষের প্রতিজ্ঞা কখনো কখনো নত হতে বাধ্য।
স্মৃতির স্রোতে পূর্বিকার চোখে ভাসে গতকাল, যখন ইকরাম আলী আর মোশারফ সাহেব গভীর আলাপ করছিলেন। তাদের সেই মৌন আলোচনার মধ্যেই যেন ঝলসানো বজ্রপাতের মতো একটি কথা কানে আসে পূর্বিকার বান্ধবীর। সে শুনেছে—পূর্বিকা আর মুগ্ধর বিয়ের তোড়জোড় চলছে! সেই দুঃসংবাদ যেন এক হিং'স্র অগ্নি হয়ে পূর্বিকার অন্তরে এসে প্রবেশ করল। কীভাবে সে এই কথা বিশ্বাস করবে? নিজের হৃদয়ের অগ্নিকুণ্ড তখনই যেন জ্বলে ওঠে! তার আত্মার মধ্যে বিরূপ সুর বাজতে থাকে; তাহলে কি সে এই বিয়ে মেনে নেবে? যে হৃদয় সম্পূর্ণভাবে আফ্রিদির জন্য নিবেদিত, তাকে কি অন্য কারো হাতে তুলে দিতে হবে?
কিন্তু পূর্বিকার ভয় আরও গভীরে প্রোথিত; যদি এই সংবাদ এখন আফ্রিদির কানে পৌঁছায়? সে যে হিমালয়ের মতো দুঃসাহসিক এক চরিত্র, একবার উত্তেজিত হলে প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তা কে জানে! আফ্রিদির পাগলামি আবার তার ভালোবাসাকেই যেন ধ্বং'সের মুখে ঠেলে দেবে। সে জানে, ইকরাম আলী কখনোই তার কন্যাকে এমন এক মধ্যবিত্ত বেকার যুবকের হাতে সমর্পণ করবেন না । পূর্বিকার অন্তর তাই ক্রমাগত দ্বিধার বেড়াজালে আটকা পড়ে।
অনেক গভীর চিন্তাভাবনার পর পূর্বিকা কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিল। মুগ্ধর কাছে গিয়ে নিজেই এই রহস্য উদ্ঘাটন করা উচিত; সে আসলেই কি চায়? মুগ্ধ কি সত্যিই তার জীবনসঙ্গী হতে চায়, নাকি এর পেছনে আরও কোনো অন্তরালে লুকিয়ে আছে শীতল কোনো ষড়যন্ত্র? পূর্বিকার মনে হলো, মুগ্ধর সাথে সরাসরি কথা বলে বিয়েটা বন্ধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
অবশেষে পূর্বিকা সেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেই মুগ্ধর কাছে গিয়েছিল। এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের মধ্য দিয়ে তার আত্মার ভিতর এক গভীর দহন শুরু হয়, যেন নিজের সত্যকে বিসর্জন দিতে হয়েছে জীবনের প্রয়োজনেই।
পূর্বিকা যখন মুগ্ধকে তার তীক্ষ্ণ প্রশ্নে বিদ্ধ করলো, তীব্র উত্তেজনায় গুঞ্জরিত কণ্ঠে, যেন আকাশে ঝড়ে হঠাৎ ছন্দপতন,
——— "তুমি কি সত্যিই চাও আমাকে পত্নীরূপে বরণ করতে? জানো না কি, আফ্রিদি আর আমি সেই প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ, যা হৃদয়ের গভীরতম অঙ্গনে নির্মিত! আমাদের ভালোবাসা দৃঢ়, অপরিসীম। তোমার হৃদয়ে আমার জন্য সেই ভালোবাসার আভাস আছে কি আদৌ? যদি নেই, তবে কেন এই বিহ্বলতা, কেন এই অপ্রতিরোধ্য আকাঙ্ক্ষা, কেন বিয়ের জন্য এমন অস্থিরতা তোমার? কিসের প্রয়োজন আমার???
মুগ্ধর তলোয়ারের ঝলক দিয়ে গম্ভীর তাচ্ছিল্য স্বরে বলল,
——— "তোমাকে প্রয়োজন? না, তোমার ছায়াটুকুর ছিটেফোঁটারও নয়। আমি চাই সেই প্রাণ, যা তোমাদের ওই প্রতারণাময় বাড়ির গভীরে লুকিয়ে আছে। সেই প্রাণই আমার প্রয়োজন, যার জন্য এই বিষা'ক্ত পথে হাঁটাও বাঞ্ছনীয়। আর তুমি? তুমি সেই পথেরই প্রহরী, পূর্বিকা। তবে জেনে রাখো, নিজের আত্মাকে পুড়িয়ে ভ'স্ম করে দিব তবু অন্য নারী, হ্যাঁ, তোমাকে বিয়ে করছি না। এ এক চোখে ধুলো দেওয়া কৌশল মাত্র।
তোমাদের বাড়িতে যে কা'লসাপ লুকিয়ে আছে, তাকে চাই আমি! পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে আর শুধুমাত্র বিয়ের মতো তুচ্ছ ছলনায় জয়ী হওয়া যাবে না।"
মুগ্ধ থেমে গগনবিদারী হুংকার তুলে যেন কথাতেই ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে সমস্ত সত্তা,
——— "আমি সেই বিষাক্ত সাপ চাই—জীবন্ত, দহনশীল, এবং আমার পুরো নিয়ন্ত্রণে। সেই সাপ আমার চাই, যে কোনো মূল্যে, তাকে চাই। সে আমার প্রাপ্য, সে আমার ব্যক্তিগত! আমার সম্পত্তি! যেকোনো মূল্যে সে আমার হতে হবে। আমি আবার বলছি, যেকোনো মূল্যে!"
পূর্বিকার মুখে হতবাক স্তব্ধতা নেমে এল। মুগ্ধ কি বলে গেলো; কালসাপ? কোন কা'লসাপ? ভেতরে এক অদ্ভুত উত্তেজনা, যেন বিভ্রান্তির মেঘ সরিয়ে ভেতরের অপ্রকাশিত আনন্দ উঁকি দেয়। মুগ্ধ তাকে ভালোবাসে না, বিয়ে করারও কোনো ইচ্ছে নেই; এ খবরে মনের গোপন কোণে যেন স্বস্তির আভাস ছড়িয়ে পড়ে। তবে কি নাটক? আর এই কালসাপ কে, যাকে নিয়ে এমন ছলনার কৌশল বুনেছে মুগ্ধ?
পূর্বিকা জিজ্ঞেস করল, কণ্ঠে স্পষ্ট সংশয়,
——— "এসব কিছুই কি নাটক ছিল? আর তুমি কোন কালসাপের কথা বলছ? আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না, মুগ্ধ।"
মুগ্ধের কণ্ঠে গভীরতম তাচ্ছিল্য, যেন অন্ধকারের ঘন ছায়া ছড়িয়ে পড়ল,
——— "আমি কারো কাছে কোনো জবাবদিহি করতে বাধ্য নই। মনে রেখো, তোমার আর আফ্রিদির মাঝে আমি কোনোদিনও বাধা হয়ে দাঁড়াইনি, আর ভবিষ্যতেও দাঁড়াবো না। তোমাকে বিয়ে করার কোনো প্রশ্নই আসে না। এ কথাটা স্পষ্ট করে তোমার আফ্রিদিকে জানাবে; তার জন্য আমি কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলাম না, আর কখনো হবোও না।"
পূর্বিকা অস্থির হয়ে আবারও প্রশ্ন করল,
——— "কাকে তুমি কালসাপ বললে? কার জন্য এই ষড়যন্ত্র?"
মুগ্ধের কণ্ঠে এবার কঠিন শিলাস্তরের গর্জন শোনা গেল,
——— "যতটুকু বলেছি, তাতেই সীমাবদ্ধ থাকো! এর চেয়ে অধিক জানার প্রয়াস করো না!"
পূর্বিকা ডেবডেব চোখে হতভম্ব হয়ে মুগ্ধের দিকে তাকিয়ে থাকল। মুগ্ধের ঠোঁটের কোণে এক চমৎকার বাঁকা হাসি ফুটে উঠল, মুখাবয়ব কঠিন, অথচ তাচ্ছিল্যের ছায়ায় ঢেকে গেল। সে ঠাণ্ডা গলায় বলল,
——— "সাপ আমার, বিষও আমার! কিন্তু যে আমার পথে বাধা সৃষ্টি করবে, তার জীবনও হবে আমার হাতে ।"
তারপর মুখ কঠোর হয়ে গেল, কণ্ঠে রাগের গুঞ্জন যেন শীতল আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল ফের আওড়াল,
——— "তবে মনে রেখো, আমার খেলা বিয়ের মতো তুচ্ছ নাটকে সীমাবদ্ধ নয়।
মুগ্ধর কথাগুলো যতই অদ্ভুত ঠেকুক, একদিকে যেন অন্তর শান্ত হলো; যাই ঘটুক না কেন, পূর্বিকাকে সে বিয়ে করবে না! কিন্তু কালসাপ? সে তো সর্বক্ষণ বিরাজমান, তারই গৃহের অঙ্গনে, বিষময় ছায়ার মতো। পূর্বিকার চেতনায় ভাসল কেবল তার ভাইয়ের মুখ; তার ভাই ব্যতীত আর কে হতে পারে সেই কালসাপ? গাঢ় দীর্ঘশ্বাস ফেলে পূর্বিকা। আফ্রিদিকে কখন পাবে, কখন তার কাছে খুলে বলবে মনের সমস্ত কথা; এই অপেক্ষার দাহ যেন অসীম।
_____________________
ঘরের অন্তঃপুরে মিলি বধূসাজে শোভিত অপসারী , যেন তার রূপের দ্যুতি দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে। মাশাল্লাহ! তার সৌন্দর্যের মাধুর্যে দৃষ্টির বন্ধন ছিন্ন করা দায়—যেন অপরূপ প্রতিমা এসে অধিষ্ঠিত এই ক্ষুদ্র গৃহে। প্রতীক্ষা, কেবল ফাহাদের আগমনের! রুমের কোণে দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আঁখি ; তার দূরত্বে আছিয়া, গোমড়া মুখে। মিলিও যেন মৌন বিষাদের মধ্যে নিমজ্জিত। দীর্ঘ আধাঘণ্টা তারা একে অপরের দিকে ফিরেও তাকায়নি, শুধু নিঃশব্দে মুখ ফিরিয়ে আছে তিনজন তিন দিকে। শোনা গেছে, মিলি কলেজে শুধুমাত্র পরীক্ষার দিন উপস্থিত হবে, আর ক্লাসে ফিরবে না। এই অস্বস্তির বাতাসে কারো দৃষ্টি আর সাহস জাগেনি মিলির দিকে তাকানোর। কিংবা দেখাতে চাচ্ছে না অশ্রুজল!
অবশেষে, মিলির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তার স্বর যেন বেদনামাখা নিঃশ্বাসে ভেসে এলো,
——— "বিয়ে এখনো হলো না, তার আগেই পর করে দিচ্ছিস?"
মলিন মুখে আছিয়া ও আঁখি একে অপরের দিকে দৃষ্টি বিনিময় করল, তারপর মিলির ছলছল নয়নের দিকে তাকালো। তাতে জমা ছিল এক অমোঘ প্রশ্ন, এক অসীম কষ্ট! আছিয়া তীব্র বিরক্তির ছাপে ছলছল চোখ মুছতে মুছতে বলল,
——— "চুপ কর, ফুটবল! তুই তো আমাদের মাঝ থেকে নিজেই সরে যাচ্ছিস। এখন আবার আবেগের ফাঁদ পেতে কী লাভ?"
আঁখি নির্বাক, যেন তার জিভে তালা ঝুলেছে। চারটি টুকরো হয়ে যাওয়া হৃদয়ের একখণ্ড তো আগেই অচেতন হয়ে পড়েছে, আরেকটি যেন বিয়ের পর বিদায় নিচ্ছে চিরতরে। এদিকে মিলির চোখে জমাট বাঁধা বেদনা, আর সেই বেদনামাখা কণ্ঠে ছলছল স্বরে বলে উঠল,
——— "বেশি কথা বলিস না! নইলে ঝালমুড়িতে মরিচ মিশিয়ে খেয়ে ফেলব, তখন দেখবি!"
আছিয়ার মুখে এক টুকরো হাসি ভেসে উঠল, তবে মিথ্যা রাগ দেখিয়ে ভাঙা কন্ঠে বলল,
——— "এহহহ! তুইই বেশি কথা বলিস না! নয়ত এমন এক শট মারব, ফুটবল; ফাঁকা মাঠেই গোল দিয়ে দিব!"
মিলির চোখ থেকে অশ্রুর ধারায় যেন বেদনার এক সুগভীর নদী বয়ে গেল, যার স্রোতে আছিয়ার হৃদয়ও ভিজে গেল, আর তার চোখেও ঝরে পড়ল চাপা কষ্টের অশ্রুবিন্দু। তখনি আঁখির ঠোঁট থেকে হঠাৎই যেন ঝরে পড়লো এক গভীর আক্ষেপের করুণ ধ্বনি,
——— "আজ যদি রূপা থাকতো!"
ব্যাস!! এ বাক্য যেন গুমরে থাকা বেদনার সমুদ্রকে ভেঙে দিলো। কারো অন্তর্গত শোক আর চাপা রইল না। মিলির হৃদয় বিদীর্ণ করা ক্রন্দন উঠে এলো, তার বিষণ্ন আত্মা যেন ভেঙে গেলো এক ঝড়ের বেগে। সে আছিয়ার ক্ষীণ দেহখানা বুকে আঁকড়ে ধরে বিলাপ করলো,
——— "রূপারে পটল রে! কেন এমন করলি! আমার বিয়েতে কেন থাকলি না?"
মিলির ভারী আবেগ আর অশ্রুজলের স্রোতে আছিয়ার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো। ছোট্ট দেহের উপর ভারি গয়নার চাপ, মিলির আবেগের প্রচণ্ডতায় তার বুক প্রায় চূর্ণবিচূর্ণ হলো, তবুও সে মিলির সাথে একসাথে কান্নার ঝর্ণাধারায় মিশে গেলো। আঁখি তখনও নীরবে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে, মস্তক নামিয়ে, অশ্রুর নীরব প্রবাহে যেন পৃথিবীর সমস্ত বেদনা ঢেলে দিচ্ছে। রূপার নি'র্ম'ম মৃ'ত্যু! কেউ তাকে কেড়ে নিয়েছে! অথচ পুলিশ, তাদের দৃষ্টি নিক্ষেপের শক্তি যেন নেই; তাদের চোখে অন্যমনস্কতা, দায়িত্ববোধের অভাব। তারা এখনও খু'নিকে শনাক্ত করতে ব্যর্থ! এই নিস্পৃহতার ভেতর আঁখির অন্তরে ক্ষো'ভের দাবানল ক্রমেই জ্বলে উঠলো।
মনে পড়ে গেলো কিছু অদ্ভুত ছবি, পুরোনো স্মৃতির কষ্টভরা এক ঝলক যেন তার মস্তিষ্কে তীব্র আলোড়ন তুললো। তার অশ্রুবিসিক্ত নয়ন হঠাৎই ভয়াল লা'লাভ রূপে পরিণত হলো। তার চেহারায় ছায়া পড়লো এক কঠোর অনমনীয়তার, তার দাঁতগুলি ক্রোধে কিড়মিড় করতে লাগলো; ক্রো'ধের তীব্র স্পৃহায় জ্বলে উঠলো তার অন্তর।
ঠিক এমন মুহূর্তে, মিলি আর আছিয়া আঁখির পেছন থেকে তাকে জাপ্টে ধরলো, তাদের আঁকড়ে ধরার শক্তিতে আঁখি প্রায় দমবন্ধ হয়ে এলো। তবুও সে স্থির, এক বিন্দুও নড়ল না। মিলির অনিবার্য বেদনায় তার ভয়ানক রূপ মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল, যেন আঁধারের মধ্য দিয়ে উদিত হলো এক শান্ত সন্ধ্যার আলো।
আঁখি দরজায় মাথা ঠেকিয়ে, কান্নায় ভেঙে পড়ল; চোখের জল যেন স্রোতের মতো ছুটে আসছে, পেছন থেকে আছিয়া ও মিলি তাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। মিলির মুখেও কান্নার মেঘ জমেছে—তার অবস্থা দেখলে যেন হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়। হঠাৎই বাহিরে শোরগোল শুনা গেল,
——— "এই বর এসেছে! বর এসেছে!"
তিনজনের বুকের ভেতর যেন ঝড় উঠল! বিশেষ করে মিলির মনে আতঙ্কের এক গভীর ঢেউ বয়ে গেল। এতদিন যেই বিয়ে নিয়ে তার এত উচ্ছ্বাস ছিল, এখন যেন সেসব নিভে যেতে শুরু করল। মিলির মন ছিঁড়ে যাচ্ছে; সে কীভাবে তাদের ছেড়ে যাবে? কীভাবে এই পরিচিত মুখগুলো না দেখে সে বাঁচবে? তার শ্বাসকষ্ট বাড়তে লাগল; মুহূর্তের মধ্যে তার নিঃশ্বাস থেমে থেমে আসা-যাওয়া করতে লাগল। আঁখি বুঝতে পেরে পাশেই রাখা ইনহেলার হাতে ধরিয়ে দিল। ইনহেলার গ্রহণ করার পর মিলির কিছুটা স্থিতি ফিরে এলো।
ঠিক তখনই দরজা খুলে গেলো, এবং কয়েকজন চাচি-দাদি-নানি এসে মিলিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। মিলির চোখের কোণে জল ঝিলিক দিয়ে উঠল, সেই করুণ দৃষ্টিতে যেন একটি নীরব আবেদন লুকিয়ে ছিল। তাদের কোনো প্রতিরোধ বা দেরি করার সুযোগ না দিয়ে তারা মিলিকে নিয়ে যেতে শুরু করল।
আছিয়া চোখের জল মুছে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল, যেন বিদ্যুৎপ্রবাহ বয়ে গেল তার শরীরের ভেতর দিয়ে। উচ্ছাসিত হয়ে বলল,
——— "এই এই, চল! গেট ধরতে হবে! কান্নাকাটি পরে হবে! "
একথা বলেই আছিয়া সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ল, ছুটে গেলো গেইট ধরতে!
________________________
বর আসার সমাচারে সবাই প্রবল উদ্দীপনায় গেইটের ধারে সমবেত হয়েছে। অথচ মুগ্ধ, নির্বিকারভাবে আসন গ্রহণ করে আছে চেয়ারে, তাঁর মুখমণ্ডল কঠোর শিলাখণ্ডের মতো স্থির। সদ্য ঘটে যাওয়া মারামারির পরে সোজা বাড়ি ফিরে গিয়ে এক ঘণ্টার গোসল সম্পন্ন করে, একরকম অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই কিছুক্ষণ আগে বিয়ের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেছে। আর তখন থেকেই রোহান তার প্রগলভতায় বিরতিহীন ছিদ্রান্বেষণ করে চলেছে। মুগ্ধের সহিষ্ণুতা অবশেষে নিঃশেষিত হলো; তাঁর কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হলো শীতল ও কঠিন সতর্কবার্তা,
——— "এবার মুখ বন্ধ না করলে..."
রোহান তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
——— "কি করবি?"
মুগ্ধ এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে নিজের ক্ষোভকে দমন করল। এই নির্বোধের সঙ্গে বাক্যালাপের কোনো অর্থ নেই; সে তা ভালোভাবেই জানে। মুগ্ধর ঠোঁটে ক্ষত দেখার পর থেকেই রোহান মিটিমিটি হাসছে, যেন তাকে নিদারুণ কোনো বিদ্রূপের শিকার করেছে। কথায় কথায় খোঁচা দেওয়াও যেন রোহানের খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবার রোহান ফের মুগ্ধর কাছে এসে, নিচু স্বরে তীব্র কটাক্ষের শাবল চালাল,
——— "দুষ্টু লু'চ্চা মধু! এতই জোরেই কামরে ছিল যে ঠোঁট কেটে ফেলেছিস?? ইশশ এখনি এগুলো? ইয়ে মানে বাচ্চা ভেবে ভুল করেছিস,,, হুহাহা!! টেস্ট কেমন??"
মুগ্ধ আর সহ্য করতে পারল না। তীব্র রাগে উঠে দাঁড়াল, এবং রোহানের গালে এমন একটা চড় বসাল যে ঢাম করে শব্দ হলো চারপাশে। রোহান যেন মুহূর্তেই বশীভূত হয়ে গেল, গালে হাত দিয়ে গোল গোল অসহায় চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল! কিন্তু দ্রুতই নিজেকে সামলে রাগে ফুঁসতে লাগল, চিৎকার করে বলল,
——— " ওহহ তুইইই চু'ম্মা চু'ম্মি করে ঠোঁট কেটে আসবি! আর আমি বললেই দোষ! শালা, থাক তুই! না, না, থাকবি কেন? যা যা, যাইয়া ঠোঁট...
কথার মাঝেই মুগ্ধ শিকারি বাঘের মতো রোহানের মুখ কঠোরভাবে চেপে ধরল, চোখের পাতা টানটান, রাগে গিজগিজ করতে করতে নিচু স্বরে শীতল হুমকি দিল,
——— " মুখে লাগাম দিবি! নয়ত জিভ কে'টে ছিঁ'ড়ে ফেলব!"
আসলে মুগ্ধ কখনোই রোহানকে আফ্রিদির সাথে ঘটে যাওয়া মা'রামা'রির কথা জানায়নি। কারণ, একবার রোহান তা জানতে পারলে সেও উগ্রমূর্তি নিয়ে ঝগড়া-বিবাদে জড়িয়ে পড়বে, যা মুগ্ধ কোনোভাবেই চাইছিল না। মুগ্ধর উদ্দেশ্য মা'রামা'রিতে লিপ্ত হওয়া নয়; বরং সে অন্য কোনো লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই গোপনীয়তার ফলেই রোহানের মধ্যে এমন ভুল ধারণা জন্মেছে। রোহান রাগে মুগ্ধর শক্ত হাত ছাড়িয়ে, গালে হাত দিয়ে ধীর পায়ে বরের গেইটের দিকে সরে যেতে থাকল। তবে, তবে, এটা রোহান, তার ভেতরের দুষ্টু শয়তান নিঃশেষ হয়নি। একটু দূরে গিয়ে, ফের চিৎকার করে বলল,
——— "মধু খাওয়ার সময় কিছু না, আর আমি কইলেই শরীর জ্বলে? শা'লা!"
এ কথা বলেই সে দ্রুত পা চালিয়ে ভো দৌড় দিল, যেন উত্তপ্ত পরিবেশ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে। মুগ্ধ ফোস করে শ্বাস ফেলল! এই ছেলেটাও একদম লাগামহীন; কিছু বলতে আটকায় না। তবে মুগ্ধর মুখে একধরনের বাকা হাসি ফুটে উঠল, আর আনমনেই বলে উঠল,
——— "স্বাদ তো নেবই, তবে সেটা মধুর নয়, বি'ষের!"
নিস্তব্ধতায় একাকী আসনে উপবিষ্ট মুগ্ধ। তার মুখমণ্ডলে গাম্ভীর্যের ছায়া। করপুটে উদ্যত ধূমপান সামগ্রী সিগারেট, অগ্নিদায়ক যন্ত্রের স্ফুলিঙ্গে উজ্জ্বল। ওষ্ঠাধরে স্পর্শ করাতে যাবে সেই নিকোটিন-সমৃদ্ধ দণ্ডিকা, কিন্তু হঠাৎ...
বিচ্ছিন্ন হল সেই তৃষ্ণার্ত মুহূর্ত। এক অকস্মাৎ সবল হাত ঝাঁপিয়ে পড়ে কেড়ে নেয় সেই সিগারেট। মুগ্ধের চোখে তখনই জ্বলে উঠলো আগুন, চোয়াল শক্ত হলো ক্রোধে। কিন্তু যখন সে মাথা তুলে তাকালো, তখন সমস্ত রাগ মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেল। তার সমস্ত অস্তিত্ব যেন থেমে গেল।
সম্মুখে দণ্ডায়মান আঁখি। তার ডাগরডোগর নয়নযুগল রক্তিম আভায় দীপ্ত, ক্ষুদ্র বর্তুলাকার মুখমণ্ডল স্ফীত হয়ে উঠেছে অভিমানে। নাসিকার অগ্রভাগে মৃদু রক্তাভ বর্ণ! রক্তিমাভায় সমাচ্ছন্ন শ্যামলা তরুণী, যেন সন্ধ্যাকালীন আকাশের প্রতিচ্ছবি। তার পরিধেয় লেহেঙ্গাও রঞ্জিত সেই একই রক্তবর্ণে, যেন প্রকৃতির সাথে এক হয়ে গেছে তার অস্তিত্ব। লৌহিত্যের প্রতিমূর্তি হয়ে দণ্ডায়মান সে মুগ্ধের সম্মুখে, হাতে ধৃত সেই বিতর্কিত ধূমপান সামগ্রী।
রাতের নীরব অন্ধকারে, কৃত্রিম আলোর মৃদু কিরণে মুগ্ধের দৃষ্টির সীমায় আজকে সারাদিন পর এই এখন প্রথমবারের মতো ধরা পড়লো আঁখি।। রক্তিমাভ চাঁদের নিচে, তার লালিমায় আচ্ছন্ন হয়ে আঁখির মুখমণ্ডল এক অমোঘ দীপ্তিতে জ্বলজ্বল করছে—লালের গভীরে মিশে থাকা এক অশান্ত শ্যামলীর মায়াবী আভা।
আঁখি কঠোর পায়ের তলায় নিষ্ঠুরভাবে পিষে ফেললো সিগারেটটি, যেন তা কোনো মূল্যহীন ধূলিকণা। তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক তৃপ্তির হাসি। মুগ্ধ নির্বাক নিরীক্ষণ করল এই অভিনব দৃশ্য। কিছু বলল না! চুপটি করে দেখে গেলো! কোনো কথা বলার প্রয়োজন বোধ করল না!
তখন, বাতাসে ভেসে এল আঁখির কণ্ঠস্বর, যেন মৃদু বাশীর সুর,
——— “এবার বুঝলেন, রাগী ষাড় মশাই? যখন কারো মুখ থেকে কিছু কেড়ে নেওয়া হয়, তখন ঠিক কেমন অনুভূতি হয়?”
ইলিশ মাছের প্রতিশোধ নিলো সে! আঁখি যখনই চলে যেতে উদ্যত হলো, মুগ্ধ আকস্মিকভাবে আঁখির ওড়না ধরে ফেলল, পেছন থেকে! আঁখি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সহসাই, মুগ্ধর দিকে ফিরে তাকিয়ে রক্তাভ চোখে তার চোয়াল দৃঢ় হয়ে উঠল, যেন নিজের আবেগ সংবরণে প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে। আঁখি ক্ষুব্ধভাবে ঘুরে মুগ্ধর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
——— "ষাড়ের মতো ওড়না কেন ধরেছেন.? ছাড়ুন বলছি! "
মুগ্ধর দৃষ্টি তখনও ধীর অথচ গভীর, তার কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে উঠল,
——— "এই ষাড় কী করতে পারে, তা এখনই তুমি বুঝবে!"
মুগ্ধর ফের৷ কণ্ঠে ধ্বনিত হলো কঠোর অথচ সুপ্ত এক বিপুল অভিলাষ,
——— "যদি তুমি চাও না যে এটি তোমার দেহ থেকে খসে পড়ুক, তবে চুপচাপ দাঁড়াও!"
মুগ্ধ, কণ্ঠে অবরুদ্ধ ক্রো'ধের ঝংকার, করতলে আঁখির লেহেঙ্গার ওড়নাটির কিছু অংশ দৃঢ়ভাবে ধারণ করল। এক নির্দয় ধ্বনি ভেসে এলো, পেচ! সেই মহামূল্যবান বস্ত্রের আভিজাত্য নিঃশেষ হলো, যেন কালের নির্মমতায় একটি অধ্যায়ের পতন। আঁখি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তাকিয়ে রইল। এই লেহেঙ্গাটি তো বড়মা আফিয়া বেগমের পছন্দ করা ছিল; কত বলে কয়ে অনুরোধের পর তিনি এইটা পছন্দ করে দিয়েছিলেন! কত আকাঙ্ক্ষা মিশ্রিত ছিল এতে, আর আজ সেই সুক্ষ্ম সুতায় গাঁথা ওর্না মুগ্ধের ক্রোধের পূর্ণ প্রক্ষেপে নিঃশেষ হলো! আঁখির অন্তরাত্মা বিদ্রোহে জ্বলে উঠল।
মুগ্ধ, করতলে এখনও ওড়নাটির ছেঁড়া অংশ ধারণ করে, চক্ষু বুজে নিলো । চোখ বুজেই হঠাৎই যেন ক্রোধের জলোচ্ছ্বাসে তার কণ্ঠ থেকে এক ভয়াবহ হুঙ্কার প্রতিধ্বনিত হলো,
——— "যদি চাও এই ষাড় দানবের অগ্নিমূর্তি থেকে বাঁচতে, তবে এক্ষুণি, এই ক্ষণে আমার দৃষ্টিসীমা ত্যাগ করো। অন্যথায়, আমার নির্দয় হাত তোমার অন্তিম পরিণতি লিখবে, আর বিশ্বও তোমার অস্তিত্বের স্মৃতি ভুলে যাবে।"
আঁখি রাগে উত্তাল হয়ে উঠল, ইশ ধমকি দেওয়া হচ্ছে তাকে.?? ভেংচি কেটে বুকে জমে থাকা ক্রো'ধের ঝাঁঝ নিয়ে হনহনিয়ে চলে গেল সে, তবে সরাসরি গেইটের দিকে নয়। রোকেয়া বেগম যে প্যান্ডেলের ডানপ্রান্তে আরও কিছু নারীর সঙ্গে আলাপ জমিয়েছেন, সেই দিকে পা বাড়াল আঁখি। মুগ্ধ তার গতিপথ নজরে রাখল, কিন্তু তার মুখে একরকম নি'ষ্ঠুর কঠোরতা চেপে, যেখানে আবেগ প্রবেশের কোনো অধিকারই রাখে না।
তারপর মুগ্ধ উঠে দাঁড়াল। হাতে ধরা আঁখির ওড়নার ছেড়া অংশটি নিঃশব্দে পকেটে রেখে, সে অন্যদিকে পা বাড়াল।
সাব্বিরের দৃষ্টির সম্মুখে যে দৃশ্য উদ্ভাসিত হলো, তা যেন অলৌকিকের পরিসীমায় অন্তর্ভুক্ত। বিস্ফারিত নয়নে, নির্বাক অধরে সে দাঁড়িয়ে রইলো, যেন তার চৈতন্যকে কোনো এক রহস্যময় জালে আবদ্ধ করা হয়েছে। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটি ঘটনা সে প্রত্যক্ষ করেছে, তবু মনকে সান্ত্বনা দিতে পারছে না, এ দৃশ্য তার স্বাভাবিক বোধের সীমানা পেরিয়ে গেছে। সমাগত বরকে ঘিরে সবাই যখন গেইটের কাছে কলরবে মগ্ন, সে নিস্তব্ধ কোনে এসে দাঁড়িয়েছিল শান্তির আশায়। অথচ এ দৃশ্য দেখে যেন ভাষাহীন হয়ে, তার মুখ থেকে শব্দের অবয়বও লুপ্ত হয়ে গেলো।
মুগ্ধর রাগ সম্পর্কে জনারণ্যে গল্প ছড়ায়—কী ভয়াল তার ক্রোধের প্রকৃতি! সাব্বির নিজেই একদিন সেই রাগের পরশ পেয়েছিল, নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছিল সেই বিভীষিকাময় দৃশ্য। ছোটবেলায় একবার দেখেছিল, মুগ্ধ এক ছেলেকে পিটিয়ে ছারখার করে দিয়েছিল। সেই মুহূর্তে মুগ্ধকে দেখেছিল যেন কোনো নি'কৃ'ষ্ট দানব, যার চোখে-মুখে হিং'স্রতা বিরাজমান। এমন তীব্র ক্রো'ধ, এমন নি'ষ্ঠুর রূপ, যা আজও সাব্বিরের শরীরকে শিরশির করে তোলে; যেন ভেতরে জমে থাকা ভয়ের কাঁটা বেঁধে গেছে। এমনকি সে ঘটনার পর দুর্বিসহ দুঃস্বপ্ন দেখে সে জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল।
আর আজ, সেই মুগ্ধের মুখ থেকে সিগারেট কেড়ে নিয়ে নিঃশব্দে পিষে দিলো এক মেয়ে—শত্রুপক্ষের মেয়ে! অথচ মুগ্ধ কিছুই বলল না, বরং অদ্ভুত এক শীতলতা নিয়ে তার ওড়না টেনে ছিড়ে চলে গেলো??
সাব্বিরের মনের কোণে আচমকা আরাফের কথা উঁকি দিল। শ্বাস কণ্ঠে আটকে ঢোক গিলল সে। এই মুগ্ধ আর আরাফ কি তবে এক ব্যক্তি? ভাবতে গিয়ে তার মনে আতঙ্কের ঝড় বয়ে গেল। আরাফ, যে সবসময় প্রাণবন্ত হাসিমুখে ঘুরে বেড়ায়, আর এই মুগ্ধ, যে সর্বক্ষণ রাগে অগ্নিশর্মা; আলাদা তবুও কীভাবে তারা একই মানুষ হতে পারে? কিন্তু সে ভুলে যায়নি সেই দিনটিকে, যখন আঁখির হাত টেনে ধরেছিল।
সেদিন আরাফ যেন অন্য এক অস্তিত্বে রূপ নিয়েছিল, হাসিখুশি মুখ মুহূর্তেই বিকৃত, পৈ'শাচিক এক রূপ ধারণ করেছিল। চোখে অমানবিক এক ক্ষি'প্রতা ফুটে উঠেছিল। সে দৃশ্য দেখে সাব্বির থমকে গিয়েছিল ভয়ে, তার সমস্ত শরীর শীতল হয়ে গিয়েছিল। পালাতে চাইলে আরাফ তাকে থামিয়ে দিয়েছিল, রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলেছিল,
——— “কোনোদিন আমি ওকে ছোঁয়ার সাহসও করিনি, আর তুই? তুই এত সহজে ওর হাত ধরে ফেললি? কোন হাত দিয়ে ধরেছিস, হ্যাঁ? বল, এই হাত দিয়েই ধরেছিস, তাই তো?”
আরাফ তখন সাব্বিরের হাত এমনভাবে মুচড়ে ধরল যে সাব্বিরের ভয়ে কাঁপা কণ্ঠ কেবল মিনতির শব্দে পরিণত হলো,"
——— "আ-আমার ভুল হয়ে গিয়েছে! আ-আর কখনো এ-এমন করব না! প্লিজ ছ-ছেড়ে দিন স-স্যার!"
কিন্তু আরাফের মুখে কোনো সহানুভূতির ছিটেফোঁটাও ছিল না। তার এক হাতে সাব্বিরের মুখ চেপে ধরে, আর অন্য হাতে এমন নির্মমভাবে সাব্বিরের হাত মুচড়ে ধরল, যেন কোনো শিকারি নি'ষ্ঠুর আনন্দে তার শিকারকে আ'ঘাত করছে। মুহূর্তের মধ্যে সাব্বিরের হাত ভেঙে গেল, সেই ভাঙনের শব্দ যেন বাতাসে প্রতিধ্বনি তুলে ভয়ের সুরে মিশে গেল।
আরাফের ঠোঁটে তখন ফুটে উঠল এক অদ্ভুত তৃপ্তির হাসি; যেন তার সহিংসতায় সে এক অচেনা আনন্দ খুঁজে পেয়েছে। সেই শীতল হাসি ছিল এতটাই নি'র্মম যে সাব্বিরের শরীর ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল, চোখে-মুখে আতঙ্কের ছায়া। কিন্তু পরক্ষণেই, আরাফ যেন ভিন্ন মানুষ হয়ে গেল, সবকিছু স্বাভাবিক করে নিজেই সাব্বিরকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। চিকিৎসার সমস্ত খরচ নির্বাকভাবে বহন করল, যেন এর মধ্যেই তার দায়িত্বের শেষ দিকটি পূর্ণ হলো।
আসল ঘটনা হচ্ছে সাব্বিরের অন্তর জুড়ে ছিল এক বিষণ্নতা, যা তাকে ক্রমাগত তাড়িত করছিল—আছিয়াকে নিয়ে তার অনুভূতি। সে প্রেমের কথা সরাসরি বলতে পারেনি কখনো, যেন কথাগুলো তার হৃদয়ের অতল গহনে লুকিয়ে রয়েছে, মুক্তির অপেক্ষায়। মিলির মতো স্বাস্থবতী কন্যার উপস্থিতিতে পড়লেই তার মনের মাঝে অজানা এক ভয় সৃষ্টি হত; মনে হত, যদি তার একটি থাবা হানে, তবে সাব্বিরের মতো দুর্বল আত্মা কিভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে? এদিকে শান্ত স্বভাবের মিষ্টি আঁখির দিকে সাহায্যের হাত বাড়ানোর আকাঙ্ক্ষা তাকে বিভ্রান্ত করেছিল, যেন হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা আবেগগুলি বেরিয়ে আসার জন্য এক দুর্ভিক্ষে প্রতীক্ষা করছিল।
এক মাস ধরে নিঃশব্দে ঘুরে বেড়ানো সেই চেষ্টা, আরাফের অব্যাহত বাধার কাছে সব সময়ই পরাজিত হয়েছে। সে যেন অবচেতনে প্রত্যেকটি সুযোগকে কেড়ে নিত। অবশেষে, সেদিন যখন সাব্বির আঁখিকে একা পেল, তার অনুভূতিগুলো এমনকি প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার হাত ধরতে বাধ্য হলো। কিন্তু সেই মুহূর্তের বিনিময়ে আজ তার হাত ভেঙে ব্যান্ডেজে আবদ্ধ।
এখন, আহত হয়ে সাব্বির কানে ধরেছে যে, প্রেমের চিন্তা আর কখনোই করবে না! বোনের বান্ধবীর হাত ধরার অপরাধে তার এই দশা, আর যদি বোনের দিকে কোনো কটাক্ষ চোখে পড়ে, তবে নিশ্চিত তাকে কঠোর পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে।
এতসব ভেবেই সাব্বির বুঝতে পারল, তার ভবিষ্যৎ যেন এক নিভৃতে আবদ্ধ হয়ে থাকতে হবে। এ জীবনে দু ভাইয়ের দর্শন পেয়ে তার জন্মের শিক্ষা হয়ে গিয়েছে! আছিয়া, আঁখি কিংবা অন্য নারী—এদের মুখদর্শন থেকে সে দূরে সরে যাবে, কারণ তার জীবনের মায়া রক্ষা করা সবচেয়ে জরুরি। একের পর এক চিন্তাভাবনার মাঝে, সে একাকী চলে গেল অন্যদিকে, যেন আত্মরক্ষার এক নতুন উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।
___________
মুগ্ধ নিস্তব্ধ আঁধারে দাঁড়িয়ে, বিয়ের বাড়ি থেকে দূরে, যেন এক নিঃসঙ্গ ছায়া। সিগারেটের ধোঁয়া ধীরে ধীরে উঠছে তার ব্রাউন ঠোঁটের ফাঁক থেকে, সময়ের ফুসফুসে জমে থাকা বিষের মতো। সে গভীর শ্বাসের সাথে ধোঁয়া উড়িয়ে দিচ্ছে, আর সেই ধোঁয়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে রাতের কালোতে, যেন তার মনের গোপন ক্ষত ধীরে ধীরে বিস্তৃত হচ্ছে শূন্যে।
অত:পর পকেট থেকে বের করল ওড়নার ছেঁড়া অংশ। মৃদু আলোয় আধারে সেটিকে নিজের মুখের সামনে তুলল, চোখে বন্য ক্রো'ধের ছায়া। সেই মুহূর্তে তার কণ্ঠস্বরে ভেসে উঠল,
——— "সে আমার বি'নাশের কারণ,
নিকোটিন ধোঁয়ার উড়ন্ত বারণ।
অন্তরে বিষের বিচরণ!"
কারণেই অকারণ"
0 Comments