লেখিকাঃ সাবিহা জান্নাত
পর্বঃ ১২
~ পুচির আম্মু প্লিজ।
বিভোরের কথায় শ্রুতি না জবাব দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। তার স্ট্রেট জবাব সে বিভোরের সঙ্গে ঘুমাবে না। বিভোর সেটা মানুতে বাধ্য। তাই সে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে বাধ্য ছেলের মতো সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ে।
বিভোর ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠে। তার ঘুম ভাঙতেই চোখ যায় বিছানার দিকে। তাকিয়ে দেখে শ্রুতি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সে প্রতিদিনের তুলনায় ঘুম থেকে উঠতে অনেক দেরি।
শ্রুতি তার আগেই ঘুম থেকে জেগে গেছে। শ্রুতি শাওয়ার নিয়ে ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে নিচে গেছে অনেকক্ষণ আগে।
বিভোর তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। সেও শাওয়ার নিয়ে কোমড়ে তোয়ালে পেঁচিয়ে বেরিয়ে আসে। বিভোর সবেমাত্র ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে ঘরের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান করেছে,
তখনই শ্রুতি কফির মগ হাতে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেছে। বিভোরকে এমন অবস্থায় দেখে লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,,,
~ আপনি কি সব লজ্জা সরমের মাথা খেয়ে বসে আছেন। এভাবে কোমড়ে তোয়ালে পেঁচিয়ে রুমের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন হ্যাঁ।
বিভোর শ্রুতির কথায় চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। কপালে কিঞ্চিত ভাঁজ পড়ে তার। সে শ্রুতিকে দেখছে , মুখে তার হাঁসি। শ্রুতিকে লজ্জায় ফেলে তার মুখে একরাশ হাসি ফুটে ওঠে। সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে উঠে,,
~ না তো , লজ্জা সরমের মাথা বিক্রি করে খাবো কেন? আর তোয়ালে পরে আমার রুমের ভিতরে ঘুরবো না তো বাহিরে গিয়ে ঘুরবো। আর বাহিরের মানুষ আমাকে এমন অবস্থায় দেখলে কি ভাববে বলো তো।
শ্রুতি বিভোরের কথায় আবারো দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,,,,
~ হ্যা সেটাই। আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন যে, এখন এই রুমটা শুধু আপনার একার না, আমার ও। তাই রুমে যেটা খুশি সেটা করতে পারবেন না। এটা বুঝতে পারলে আপনি এভাবে তোয়ালে পেঁচিয়ে ঘুরে বেড়াতেন না।
~ হ্যা বুঝতে পারলাম রুমটা শুধু আমার একার না । কিন্তু বউটা তো শুধু আমার একার ই। তাই এই ঘরে তোয়ালে পড়ে ঘুরি আর অন্য কিছু করি তাতে তো কোনো সমস্যা সবার কথা না। সবকিছুই তো এডজাস্ট করতে হবে তোমাকে।
বিভোরের কথা শুনে শ্রুতি রাগান্বিত স্বরে বলে উঠে,,,
~ একদম বাজে কথা বলবেন না ।নাহলে এই কফি টা আপনার মাথায় ঢালবো আমি।
শ্রুতির রাগান্বিত স্বর শুনে বিভোরের চোখে মুখে একরাশ হাসি ফুটে উঠে। ও আস্তে আস্তে শ্রুতির দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর হাত থেকে কফির মগ টা নিজের হাতে নেয়। কফির মগে একবার চুমুক দিয়ে আবারও শ্রুতির উদ্দেশ্যে বলে উঠে,,,
~ ছিঃ বউ এমন কথা বলে না। মাথা ঠান্ডা করার জন্য কফি খেতে হয়। আর কফি মাথায় ঢেলে ফেললে তো মাথা আরো গরম হয়ে যাবে। এই টুকুও বোঝে না আমার পিচ্চি বউটা।
বিভোরের হাঁসি মুখে বলা কথায় শ্রুতি রাগে কটমট করে উঠে। সে বিভোরকে রাগ দেখাচ্ছে সেই রাগ বিভোর গা না মাখিয়ে তাকে আরো জ্বালিয়ে মারছে।শ্রুতি বিভোরের সামনে থেকে চলে যায় রাগান্বিত হয়ে।
শ্রুতি গজগজ করতে করতে নিচে রান্নাঘরে চলে যায়। বিভোর শ্রুতির চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়েছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। শ্রুতিকে জ্বালানোর মাঝে তার অন্য রকম শান্তি মেলে।
তার রাগান্বিত চেহারায় অন্য রকম সৌন্দর্য ফুটে ওঠে, আঙুল উঁচিয়ে কথা বলা, তাকে শাসন করা , সবটাই বিভোরের মাঝে পূর্ণতার স্বাদ মিলে। মানুষ খুব বেশি আপন না হলে এরকমটা কখনোই করতে পারে না।
তার রাগের পেছনে তাকে অদম্য ভালোবাসা, তার অভিমানের পেছনে লুকিয়ে তাকে অজস্র অভিযোগ।
সকালের নাস্তা সেরে শ্রুতি নিজের ঘরে বসে রয়েছে। সেই অনেক্ষণ যাবৎ ধরে বিভোরের ফোন স্ক্রোল করছে সে। তার ফোন বিভোরের কাছে বন্দি।
শ্রুতি অনেকক্ষণ যাবৎ একটা বিষয় লক্ষ্য করছে বিভোরের দেখা নেই। অথচ এই সময়টায় সে সারাক্ষণ শ্রুতির পিছনেই পড়ে থাকতো।
তাদের মাঝে এই সময়টায় খুব বেশি ভালো সম্পর্ক তৈরি না হলেও শ্রুতি আর বিভোর খুব বেশি শত্রুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই শত্রুর সাথেই সেই গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।
এক মুহুর্ত বিভোরকে চোখের সামনে না দেখলে শ্রুতির কেমন শুন্য শুন্য লাগছে অথচ সামনে সে বিভোরকে সহ্যই করতে পারে না। শ্রুতি বিরক্তি নিয়ে ঘরে বসে রয়েছে।
সময়টা দুপুরের আগ মুহূর্তে,সিফান ড্রয়িং রুমে এসেই কিছুটা অবাক হয়ে যায়। বিভোর সোফায় বসে রয়েছে । একমনে কি যেন ভাবছে। সিফান বিভোরকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে বলে উঠে,,,
~ আরে ভাইয়া যে, কখন এসেছো তুমি ?
~ সেই অনেক্ষণ আগেই এসেছি। কাউকে দেখতে পারছি না, ভাবলাম কাকী মুনি হয়তো রান্না করছে তাই আর বিরক্ত করলাম না ( বিভোর )
~ ওহ্। তুমি তাহলে বসো আমি আম্মুকে ডেকে দিচ্ছি। বলেই সিফান রান্নাঘরের দিকে ছোটে। রান্নাঘরে গিয়ে ওর আম্মু কে ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠে,,,
~ আম্মু বিভোর ভাইয়া এসেছে। অনেকক্ষন ধরেই ড্রয়িং রুমে অপেক্ষা করছে।
ছেলের কথা শুনে সোহানা কোনো রকম প্রতিক্রিয়া দেখায় না। বিভোর আর শ্রুতি যা করেছে তারপরও ওরা যে এই বাসায় আসবে সোহানা সেটা ভাবতে পারেনি । বিশেষ করে শ্রুতি সে ভয়ে কখনোই আসবে না।
~ ঠিক আছে । আর একটু রান্না আছে । আমি রান্না টা শেষ করে যাচ্ছি। তুমি খাবার গুলো টেবিলে সাজিয়ে রাখো।
মায়ের কথায় সিফান বাধ্য ছেলের মতো চলে যায়। সিফান বিভোরের সাথে জমিয়ে গল্প করছে। এতো দিন পর পেয়েছে ওকে। তাদের বিয়ের ঘটনার পর তার আম্মুর ভয়ে সে রাস্তায় মাথা নিচু হয়ে চলাফেরা করেছে।
যদি কখনো ওই বাড়ির কারো সাথে কথা বলি তাহলে আম্মু আপুর সাথে সাথে আমাকেও ত্যাজ্য করে দিবে।সেই ভয়েই সিফান তার আপুর সাথেও কথা বলে নি কখনো
সোহানা রান্না শেষ করে ড্রয়িংরুমে চলে আসে। বিভোর স্থীর হয়ে বসে আছে। বিভোর শুধু একাই এসছে শ্রুতি আসে নি ।
~ হঠাৎ এই সময় তুমি এখানে। কি প্রয়োজনে..... শ্রুতির আম্মুর কথায় বিভোর একটু নড়েচড়ে বসে। স্বাভাবিক জবাব দেয়,,
~ শ্রুতির বই আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতে এসেছি।
~ ওহ , তাই বলো। নাহলে তুমি তো এই সময় আসার কথা না। তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো দুপুরের খাবার টা এখানেই খেয়ে যাবে।
সোহানা কথাটা বলে টেবিলের দিকে আগাতেই বিভোরের কথায় থেমে যায়।
~ এই বাসার কিছুই খাবো না আমি। আমাদের যেদিন মন থেকে মেনে নিবে সেদিন খাবো, তার আগে নয়।
শ্রুতির আম্মু বিভোরের কথার প্রতি উত্তরে বলে উঠে,,,
~ তোমাকে তো আমি এমন কিছু বলিনি যার জন্য....
~ আমাকে কিছু বলো নি কিন্তু শ্রুতি কে তো মেনে নাও নি এখনো।আমাকে না হয় ছোট থেকেই ছেলের মতো করে ভালোবাসতে সেই হিসেবে কিছু বলছো না কিন্তু শ্রুতির সাথে তো সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছো।
তাই যদি না হয় তাহলে সিফান কে কেন যেত দাও না আমাদের বাসায়। তুমি তো নিজেও যাচ্ছো না। শ্রুতি তো কখনো তোমাকে ছাড়া একটিদিন থাকতো না কিন্তু আজ দুইদিন হয়ে গেছে তার সাথে না দেখা না কথা হচ্ছে।
ফোন করলে ফোন উঠাচ্ছো না। শ্রুতি আসলেও এই বাসায় হয়তো প্রবেশ করতে দিবে না। আর প্রবেশ করতে দিলেও হয়তো ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে।
কাকিমুনি শ্রুতির এখানে কোনো দোষ নেই। আমি ওকে জোর করে বিয়ে করেছি। আর ঝামেলা টা আমার পরিবারের ছিল তোমাদের কিন্তু শ্রুতি আর আমি কি দোষ করছি।
~ দেখো বিভোর আমি এতো কথা শুনতে চাইছি না। তোমরা যা করেছো তোমাদের ভালো ভেবেই করেছো হয়তো। আমি তোমাদের কে জোড় করছি। তবে মেয়েটা যখন নিজের ইচ্ছায় সবকিছু করেছে তখন সে নিজের মতোই থাকুক।
আমি চাই না ওকে আর বাসায় নিয়ে আসতে। যে মেয়ে পরিবারের কথা ভাবে না সেই মেয়েকে আর কখনো আপন করতে চাই না। ও দূরেই থাক তাতে ওর ভালো হবে। অনেক ইচ্ছে নিয়ে বাবাহীন ছেলে মেয়ে গুলোকে মানুষ করেছিলাম কিন্তু শেষে মেয়েটা বুঝিয়ে দিলো সব শেষ।
আর ছেলেটা আছে ওর যা খুশি তাই করুক। ছেড়ে দিয়েছি আমি ওদের, নিজেদের ইচ্ছামত চলুক। আমি ওদের কে আর কোনো কিছুতেই জোড় করবো না।
শ্রুতির আম্মুর কথায় বিভোর স্বাভাবিক ভাবেই বলে উঠে,,,
~ যদি নিজেরা একা বিয়ে না করে তোমার কাছে শ্রুতিকে চাইতাম দিতে কি ?
~ না। তোমার সাথে কখনোই মেয়ের মেয়ে দিতাম না। তোমাকে আদর যত্ন করেছি তাই বলে তোমাকে মেয়ের জামায় করতাম না। খুব ভালো করেই জানো কেন তোমাদের পরিবার থেকে আলাদা হয়ে ছিলাম।
আবার তিন বছর পর সেই পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করার কোনো ইচ্ছে ছিল না। তোমার মা আমাদের সাথে যে ব্যবহার গুলো করতো তাতে না আমাদের আলাদা হওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
আমি কখনোই তোমাদের কে মেনে নিবো না। আর যদি মেয়েটার তার মায়ের কাছে ফিরতেই হয় তাহলে তোমাকে ছেড়ে আসতে হবে।
কাকিমুনির কথায় বিভোরের হৃদস্পন্দন কেঁপে উঠে। শ্রুতির থেকে আলাদা হওয়ার কথা কখনো সে ভাবতে পারে না। আমার আম্মু আর শ্রুতির আম্মুর বিরোধীতার জন্য ই হয়তো কাকিমুনি কখনোই এই সম্পর্ক টা মেনে নিবে না।
ছোট কাকা মারার যাওয়ার পর আম্মু তাদের সাথে যে দূর ব্যবহার করেছিল তাতে কোনো মানুষ তাদের সাথে সম্পর্ক রাখবে না। সেখানে শ্রুতিকে ঘরের বউ করেছি। কে জানে কি আছে কপালে।
বিভোর শ্রুতির আম্মুর সাথে আর কথা বলে রাগি মনোভাব নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসে। শ্রুতির আম্মু বিভোরের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়েছেন। যত কিছুই হয়ে যাক তিনি তার কথা থেকে সরে দাঁড়াবেন না।
বিভোর রাগান্বিত অবস্থায় বাসার ভিতরে প্রবেশ করে। তার কাকি মুনির কথায় তার মাথায় রাগ চড়ে বসেছে। মনের ভিতরে উত্তাল ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
খুব কষ্টে শ্রুতির অমতে তাকে ব্লাক মেইল করে বিয়ে করেছে বিভোর। মেয়েটাও হয়েছে ঠিক মায়ের মতো জেদি। শ্রুতিও তার সাথে থাকতে নারাজ তার উপর যদি কখনো জানতে পারে তার আম্মু এই সম্পর্ক টা চায় না তাহলে নিশ্চিত দিভোর্স দিয়ে চলে যাবে।
বিভোর বাসার ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখে সবাই তার জন্য অপেক্ষা করছে। দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। বিভোর কারো দিকে না তাকিয়ে সোজা নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়।
~ খুব চিন্তিত লাগছে তোমাকে,কই গিয়েছিলে তুমি।
মায়ের কথায় বিভোর কোনো জবাব না দিয়ে এগোতে থাকে ।
~ কি হলো আমার কথার কোনো জবাব দিচ্ছো না কেন। সেই সকালে বেরিয়েছিলে তুমি ,এখন আসার সময় হলো তোমার। অনেকক্ষন যাবৎ তোমাকে ফোনে ট্রাই করছি সবাই মিলে কিন্তু কারো কল ই উঠাচ্ছিলে না। কি সমস্যা কি তোমার ?
ফের মায়ের কথা কর্নগোচর হতেই সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে পড়ে। বিভোর এখন প্রচন্ড রেগে আছে। তার চোখগুলো রক্তিম বর্ন ধারন করেছে। সে পিছনে ফিরে তাকিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,,,,
~ তোমাকে জবাব দেওয়ার কোনো প্রয়োজনবোধ করছি না আমি। এমনিতেও আমার পার্সোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার করার অধিকার তোমার নেই। আমি কখন কি করছি না করছি ।
কখন কি করবো না করবো সেই সব সম্পর্কে তোমাকে বলার প্রয়োজন নেই আমার। আমার প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট দেখানোর প্রয়োজন নেই তোমার ।তোমার জায়গায় তুমি সীমাবদ্ধ থাকো।
উপস্থিত সকলে বিভোরের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায়।সবার মুখে কোনো কথা নেই। সকালে বেরিয়ে যাওয়া শান্তশিষ্ট ছেলেটার এই সময়ের মধ্যে কি এমন হলো যে এখন সে প্রচুর রেগে আছে।
~ বিভোর ভদ্রভাবে কথা বলো। আম্মুর সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানো না ।
~ ব্যস! অনেক হয়েছে বাবা। এসব নোংরা টিকস্ খেলা বন্ধ করে। এসব ড্রামা আর দেখতে ইচ্ছে করে না ।এসব ড্রামা দেখতে দেখতে আমার বিরক্তি চলে এসেছে। আমাকে আমার মতো করে থাকতে দাও প্লিজ। বলেই বিভোর নিজের রুমের দিকে চলে যায়।
0 Comments