Ad Code

চারুলতা পর্ব - ১

লেখিকাঃ সাবিহা জান্নাত

গোলাপ হাতে, সাথে একটা চিঠি নিয়ে কাব্যের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁটু গেড়ে প্রপোজ করতেই কাব্য তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তার সামনে থাকা অপরুপা মেয়েটির দিকে। কাব্য ফুল টা হাতে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয় মাটিতে। আর চিঠিটা ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে ।

পরপর মসৃণ গালে দুইটা থাপ্পড় পড়তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে চারুলতা। ইতোমধ্যেই তার চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। চোখের কোণে জমে থাকা পানি নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা বলিষ্ঠের দেহের মানবের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারে কাব্য প্রচন্ড রেগে গেছে।
কাব্য চারুকে মাটি থেকে সজোরে তুলে এক হাত ওর কোমড়ে অন্য হাত দিয়ে চারুর দুই গাল চেপে ধরতেই ব্যাথায় আর্তনাদ করে ওঠে চারু।
বিপরীতে থাকা মানবের তীক্ষ্ণ মেজাজের রাগী কন্ঠ শুনে চারুর চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে অবিরাম।
_ তোর সাহস কি করে হয় এই ভরা ক্যাম্পাসে আমাকে প্রপোজ করার। আমার বাসায় খাচ্ছিস, থাকছিস আবার আমাকেই প্রপোজাল দিস। তুই ভাবলি কি করে তোর একটা মেয়ের প্রপোজ আমি একসেপ্ট করবো। আমার বাড়ির আশ্রিতা হয়ে... বাকী কথা বলার আগেই চারু অস্ফুট শব্দ করে উঠে।
কাব্যের রাগ তার চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে চারুর এরকম একটা কাজে। সবেমাত্র সে ক্লাস রুম থেকে ক্লাস নিয়ে বেরিয়েছে ক্যাম্পাসে। ক্যাম্পাসে এসে চারুর এরকম কাজে কাব্যের চোখ রাগে রক্তিম বর্ন ধারন করেছে। যার নিদারুণ ফল চারুর গালে পরপর দুই দুইটা থাপ্পড় ‌।
ক্যাম্পাসের আশেপাশের সবাই তাদের দেখছে । অনেকেই হাসাহাসি করছে বিষয় টা নিয়ে। আশেপাশের পরিস্থিতি দেখে নিয়ে কাব্য চারুকে ছেড়ে দিয়ে অফিস কক্ষের দিকে ছুটে চলে। চারু সেখানে ই নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকে।
সময়টা বর্ষাকালের মাঝামাঝি...
সকালের আবহাওয়া কিছুটা শুষ্ক হলেও এখন বৃষ্টি পড়ছে অবিরাম ধারায়। চারু বৃষ্টিতে ভিজে একাকার। শরীরে ওড়নাটা ভালোভাবে পেঁচিয়ে একটা রিক্সায় করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
কাব্য গাড়িতে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ে গাড়ি ড্রাইভিং করছে। দৃষ্টি তার সামনের দিকে। পাশের সিটে বসে আছে ওর ছোট বোন কেয়া । কেয়া ভার্সিটি ২য় বর্ষের ছাত্রী। কেয়া কলেজে এমন দৃশ্য দেখে চারুর প্রতি খুবই বিরক্ত হয় এবং তার রাগ চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
ভাইয়া তুমি ওকে এমনি এমনি ছেড়ে দিলে কেন। ওর সাহস দেখেছো পুরো ক্যাম্পাসে কিভাবে প্রপোজ করলো । তবুও আবার আমাদের বাসার আশ্রিতা হয়ে। আমাদের মা সম্মান শেষ করে দিবে একেবারে ওই থার্ড ক্লাস মেয়েটা। আব্বু আম্মু কে বলে ওকে বাসা থেকেই বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
কেয়া কাব্যের দিকে তাকিয়ে কথা গুলো বলতে বলতেই কাব্যের ইশারা পেয়ে চুপ হয়ে যায়। ও আর কোনো কথা বাড়ায় না।
কাক ভেজা হয়ে চৌধুরী ভিলার ভিতরে প্রবেশ করে চারুলতা। চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। তার কান্নার প্রবনতা আর নেই। পুরো রাস্তা কান্না করতে করতে তার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। বৃষ্টিতে তার চোখের পানি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। চারুলতা শরীরে থাকা ভেজা কাপড় চেঞ্জ করে শুকনো কাপড় পরিধান করে ।
চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে ভাবনার জগতে চলে যায়। তার মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক ভর করছে। কলেজের খবর টা যদি মামা মামীর ( কাব্যের বাবা মা ) কানে পৌঁছায় তাহলে ঝামেলার শেষ থাকবে না। তার ফলস্বরূপ তাকে বাসা থেকে বের করেও দিতে পারে। চারুলতার ভাবনার ছেদ ঘটে দরজায় কারো নক করার শব্দে।
চারুলতা ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখলো ওর নানুমনি খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চারুলতা তার নানুমনিকে ভেতরে আসতে বলে এবং নিজে গিয়ে আবার বিছানায় বসে পড়ে। ওর নানুমনি খাবারের প্লেট টা পড়ার টেবিলে রেখে চারুর লম্বা ভেজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছে দিতে দিতে বললেন,,
কতবার বলি , এভাবে বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি না ফিরতে। জ্বর, ঠান্ডা লেগে যাবে। কে শুনে কার কথা । চারু লতা ওর নানুমনির কথায় কোনো ভ্রুক্ষেপ করে না। ও বিষয়টি নিয়ে খুবই চিন্তিত, বিধায় অন্য কোনো দিকে তার মন নেই।
চারুলতার লম্বা চুলগুলো মুছা শেষ হলে , চুলগুলো চিরনী করে দেয় তার নানুমনি। তারপর তার নানুমনি চলে যায়। তার নানুমনি চলে যেতেই চারুলতা দরজা লাগিয়ে দেয় আবার।
তার একটুও খাবার খেতে ইচ্ছে করছে না। কিছু সময় পর অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও খাবার খেতে শুরু করে চারু লতা। নয়তো তার মামী চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিবে তার সাথে। খাবার মুখে দিতেই হঠাৎ ঠোঁটের ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে ও । কষ্ট করে কিছুটা খাবার খেয়ে হাত ধুয়ে নেয়।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখছে চারুলতা। সজোরে গালে থাপ্পড় পড়াই গালগুলো লাল হয়ে আছে। ঠোঁটে কোণে কেটে যাওয়ার দাগ স্পষ্ট। সেখানে থেকে ফুটা ফুটা রক্ত ঝরছে কিছুটা। চারুলতা টিস্যু পেপার দিয়ে ঠোঁটের কোণে রক্ত টা মুছে সেখানে মলম লাগিয়ে নেয় । কিছু সময়ের মধ্যে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যায়।
ব্যথায় তার শরীর টনটন করছে। মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে তার । সে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। শরীর ক্লান্ত থাকায় সে কিছু সময়ের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ে । সন্ধার দিকে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম থেকে উঠেই ফ্রেশ হতে চলে যায় ওয়াশ রুমে।
চোখে মুখে পানি দিতেই তার ক্ষনে ক্ষনে কাব্যের করা অপমানের কথা মনে পড়তেই তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। কান্না গুলো তার গলায় আটকে আসছে বার বার। ও ফ্রেশ হয়ে ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে আসে। তোয়ালে দিয়ে হাত মুখ মুছে নেয়। মাথায় ওড়না দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে চলে যায় ।
ও ভয়ে ভয়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করে । কিন্তু রান্নাঘরে গিয়ে মামীর সামনে পড়তেই মামী কলেজের বিষয়ে তাকে কিছু বললো না দেখে চারুলতা একটু অবাক হয়ে যায়।
নবাবের মেয়ের এতক্ষণে আসার সময় হলো। রান্না করবে কে শুনি । মামীর তেজী কন্ঠে চারুলতা নিম্ন সুরে জবাব দেয়,
সরি মামী মুনি। একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গেছে। আপনি চিন্তা করবেন না আমি সব রান্না তাড়াতাড়ি শেষ করছি ।
রূপন্তি রহমান চারুলতার মায়াবী চেহারা দেখে চাইলেও কঠোর হতে পারলেন না। চারুলতাকে তার ততোটাও খারাপ লাগে না যতটা সে সামনাসামনি প্রকাশ করে ।তার মায়াবি চেহারা দেখে সব রাগ ধুলিসাৎ হয়ে যায় ।
চারুলতাকে যখন ১৮ বছর বয়সে এতিমখানা থেকে এই বাসায় নিয়ে আসা হয় তখন প্রথম দেখাতেই সব কিছু ভুলে গিয়েছিল রুপন্তী রহমান।
৫ ফিট ২ ইঞ্চি লম্বা , ফর্সা মুখের গড়ন, লম্বা চুলগুলো, নজর কাড়া তার চেহারা সবকিছু দেখেই তাকে পছন্দ করেছিল রুপন্তী রহমান। কিন্তু স্বামী সন্তান সবার এই মেয়েকে অপছন্দের জন্য সেও অপছন্দ করতে শুরু করেছে ।
[ পরিবারের অমতে চারুলতার আম্মু তার বাবাকে বিয়ে করেছিল । কোনো পরিবার থেকে তাদের সম্পর্কটা মেনে নেওয়া হয়নি ।দুজনেই সংসার শুরু করে দিয়েছিল নিজের মতো করে। ভালোই চলছিল তাদের জীবন। ২ বছরের মাথায় কোল আলো করে এসেছিল চারুলতা। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে চারুলতার এক বছর পূর্ণ না হতেই অ্যাক্সিডেন্টে মা বা মারা যায় চারুলতার। বাচ্চা মেয়েটিকে কোনো পরিবার থেকেই সমর্থন করে নি। যার ফলে তাকে এতিমখানায় বড় হতে হয়েছিল ১৮ বছর পর্যন্ত ]
চারুলতা গিয়ে তাড়াতাড়ি করে তরকারি কাটতে শুরু করে দেয় । তার মামীকে সে সবজি কাটতে দেখে চারুলতা বলে উঠে,,
_ আপনি সবজি কাটছেন কেন। আপনি রাখুন আমি করে নিচ্ছি সব।
তোমাকে যে টুকু করতে দেওয়া হয়েছে সে টুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকো । সংসার টা আমার , তাই আমি কি করবো না করবো সেটা তোমাকে বলতে বলি নি ।
মামীর এরকম কথায় চারুলতা চুপ হয়ে যায়। আর কোনো কথা না বলে তরকারি কাটতে থাকে। আনমনে তরকারি কাটতে গিয়ে হঠাৎ ই ছুড়ির আঘাতে চারুলতার হাত কেটে যেতেই , চারুলতা অস্ফুট আহ্ আর্তনাদ করে ওঠে।
রুপন্তী রহমান এগিয়ে গিয়ে দেখে চারুলতার হাত কেটে রক্ত ঝরছে। হাত তো অনেক কেটে গেছে যাও গিয়ে ঔষধ লাগিয়ে নাও , মামীর মুখে কথাটা শুনে প্রতি উত্তরে চারুলতা বলে উঠে,,
_ কিছু হবে না । সামান্যই কেটেছে।আমি কাজ শেষ করে তারপর ঔষধ লাগিয়ে নিবো ।
তোমাকে যা বলছি তাই করো যাও । নিজের ঘরে যাও , আমি বাকী কাজ করছি । মামীর কথায় চারুলতা নিজের ঘরের জন্য পা বাড়াতেই সিঁড়িতে কাব্যের মুখোমুখি হয়। ও কিছু না বলে এক পলক কাব্যের দিকে তাকিয়ে আবার হাটা ধরে।
হাত কাটলো কি করে তোর ? হঠাৎ ই কাব্যের কথায় থেমে যায় চারুলতা। কোনো প্রকার জবাব না দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।


Post a Comment

0 Comments

Close Menu