লেখিকাঃ সাবিহা জান্নাত
খাবার টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছে সবাই। কেয়া কাব্যের কথায় চুপ করে আছে। কলেজের ঘটনাটি বাসায় জানায় নি সে । খাবার খেয়ে কাব্য, কেয়া এবং কাব্যের বাবা চলে গেছে। অবশিষ্ট খাবার গুলো সেলফে তুলে ঢেকে রাখছে চারু। সব কাজ শেষ করে চারুলতা সিঁড়ি বেয়ে গুটিগুটি পায়ে হাঁটা ধরে নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য। ওর ঘরের সামনে যেতেই দেখে সেখানে কাব্য দাঁড়িয়ে আছে। কাব্য কে দেখে কোনো ভ্রূক্ষেপ না করে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই কাব্য চারুর হাত ধরে টেনে তার ঘরে নিয়ে যায়। দরজা টা লাগিয়ে দিয়ে রক্তিম চোখে চারুলতার দিকে তাকাতেই চারু ভয় পেয়ে যায়।
গুটিগুটি পায়ে কাব্য চারুর দিকে এগোতেই থাকে। ক্রমশ এগিয়ে যেতেই চারু ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। ভয়ে চারুলতার চোখ মুখ চুপসে গেছে । সকালের ঘটনা গুলো বার বার চারুর মস্তিষ্কে আতংকের সৃষ্টি করছে। কাব্য গিয়ে আচমকা চারুর কোমড়ে হাত দিয়ে অন্য হাত দিয়ে চারুর দুই গাল চেপে ধরতেই চারু অস্ফুট ব্যাথায় আর্তনাদ করে ওঠে।
~ তোর সাহস কি করে হয় আমাকে ইগনোর করার । আমাকেই এড়িয়ে চলছিস। আমাকে কি তোর মানুষ মনে হয় না। আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে আমাকে এড়িয়ে চলছিস । ভরা ক্যাম্পাসে তো খুব সাহস করে আমাকে প্রপোজ করেছিলি ।
এতোক্ষণ সবটা সহ্য করলেও চারুলতার গাল চেপে ধরতেই সে ব্যথায় কঁকিয়ে বলে উঠে,
~ছাড়ুন, আমার লাগছে। কাব্য এতো রাগী মনোভাবে ছিল যে চারুর ঠোঁটের কোণে কেটে যাওয়া স্থানে নজর পড়ে নি । কেটে যাওয়া স্থানে নজর পড়তেই কাব্য গাল থেকে হাত সরিয়ে নেয়। কিন্তু চারুর কোমড় জড়িয়ে নিজের সাথে চেপে রেখেছে এখনো তাকে।
চারুলতা কিছু সময় চুপ থেকে বলে উঠে, বিশ্বাস করুন, আমি ইচ্ছে করে আপনাকে প্রপোজ করি নি । ওই মেয়েগুলো আমাকে জোর করে ফুল আর চিঠি হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল । ওরা আমার অ্যাসাইনমেন্ট আটকে রেখে আমাকে জোর করে আপনাকে প্রপোজ করতে পাঠিয়েছিল । কথাগুলো বলতে বলতে চারুর চোখে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু চারুলতার কথা শুনেও পাথর মনের কাব্যেকে তার কান্না স্পর্শ করতে পারেনা । চারু লতার কথা শুনে কাব্য তাচ্ছিল্যের সুরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,
~তোর কথা আমার বিশ্বাস করতে হবে। সারাদিন কি করে বেড়াস আমার জানা নেই । ওই তো সব সময় ছেলেদের সাথে ঘোরাঘুরি করিস । কয়টা বয়ফ্রেন্ড জুটিয়েছিস কে জানে। আবার কয়জনের সাথে রুম ডেট করেছিস তুই ছাড়া আর কে ভালো বলতে পারবে। যা খুশি করিস না কেন, যদি তোর কারনে আমাদের সবার সম্মান নষ্ট হয়েছে তাহলে তোকে গলা ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিবো ।
কাব্যের কথা শুনে চারুলতা মুখ ফিরিয়ে ঘৃণার সহিত বলে উঠে,
~ছিঃ আপনি এতোটা নোংরা মনের মানুষ আমি কখনো ভাবতে পারি নি । বলেই দুই হাত দিয়ে সজোরে ধাক্কা দিয়ে কাব্যকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দেয় চারু । চারুলতার আচমকা এমন ধাক্কায় কাব্য তাল সামলাতে না পেরে কিছুটা ছিটকে দূরে সরে যায়। পরক্ষনেই রাগান্বিত হয়ে চারু কে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে..
~তোর মুখে খুব বুলি ফুটেছে তাই না । আজকাল দেখি খুব কথাও বলতে পারিস ।তোর মতো মেয়েকে তো ডাস্টবিনে ফেলে রাখার মতো । কাব্যের কথায় চারুর খুব রাগ হয় , প্রতি উত্তরে বলে উঠে,,
~আমাকে না হয় ডাস্টবিনে রাখার মতো । আপনি তো খুব ভালো তাহলে এভাবে এতো রাতে একটা মেয়ের ঘরে এসে তাকে টরচার করাটা আপনার কোন ভদ্রতার মধ্যে পড়ছে।
চারুলতার কথাটা কানে আসতেই কাব্যের রাগ আরো বেড়ে যায়। অতিরিক্ত রাগে কাব্য নিজের নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে । কখন কি করে বসবে সে নিজেও জানে না। কাব্য চারুকে দেওয়ালের সাথে আরো চেপে ধরে রক্তিম চোখে চারুলতার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ঘৃণা ভরা দৃষ্টি নিয়ে চারু লতা কে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দরজা সজোরে ধাক্কা দিতে যাওয়ায় চারু অনেক টা চমকে যায়।
চারুলতা সেখানেই কিছুসময় থ-মেরে বসে থাকে। ক্লান্ত শরীরে সে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়ে।
কাব্য ওর রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে ঘরের জিনিসপত্র এদিক সেদিক ছুড়ে ফেলছে। রক্তিম বর্ন চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে তার । বিছানায় নিজের মাথা চেপে ধরে বসে থাকে কতক্ষন।
মাঝরাতে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছে কাব্য, এখন বৃষ্টি নেই। চারিদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। এই সময় কাব্যের নিজেকে খুব একা ফিল হচ্ছে। কিছু একটার অনুপস্থিতিতে তার হৃদয় পুড়ছে ।তার মন এক অজানা উদ্দেশ্যে সংকোচ বোধ করছে। বার বার ছুটে যেতে করছে সেই অজানা অচেনা গন্তব্যে।
চারদিকে নিরবতা, ঘুম নেই তার দু চোখে। সবকিছু ঝাপসা লাগছে তার রাতটা এভাবে কষ্ট করে কাটিয়ে দেয় সে । শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে রান্নাঘরে গিয়ে রুপন্তী রহমান নিজের শাশুড়ি কে রান্নাঘরে কাজ করতে দেখে বেশ চমকে যায়। পরক্ষনেই শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
~ আপনি রান্নাঘরে?
~আসলে হয়েছে কি বউমা , মেয়েটার শরীর খারাপ। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। চোখ মেলে তাকাতে পারছে না।বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারছে না , রান্না করবে কিভাবে তাই ভাবলাম আমি রান্না টা সেরে নেই ।
নিজের শাশুড়ির কথা শুনে রুপন্তী রহমানের নিজেকে অপরাধী মনে হয়। সে আর কিছু না বলে শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বলে উঠে,,,
~ আপনি গিয়ে বিশ্রাম নেন। আমি রান্না টা করে নিবো ।
বউমার জোরাজুরি তে চারুর নানুমনি রান্নাঘর ত্যাগ করে। তিনি দ্রুত পায়ে চারুর ঘরে চলে যায়। গিয়ে দেখে চারুর শরীরে অনেক জ্বর। যার জন্য তার হিতাহিত জ্ঞান নেই । তার নানুমনি ওয়াশ রুম থেকে একটা বালতিতে পানি নিয়ে তার মাথায় পানি দেওয়া শুরু করে । কিছু সময় পানি দেওয়ার পর চারুর শরীরের তাপমাত্রা কমতে থাকে।
খাবার টেবিলে বসে সকালের নাস্তা করছে সবাই । কাল রাতের ঘটনার পর চারুর মুখ দেখতেও ইচ্ছে করেনি কাব্যের। নাস্তা শেষ করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ।
দুপুরের আগ মুহূর্তে চারুর জ্ঞান ফিরে আসে ।ওর নানুমনি ওকে খাবার খাইয়ে ঔষধ টা খাইয়ে দেয় । কাল কাব্যের দেওয়া থাপ্পড় আর বৃষ্টিতে ভেজার ফল তার এই জ্বর । কাব্যের দেওয়া থাপ্পড়ের জন্য চারুর গাল এখনো ব্যাথা করছে ।
চারু কিছুটা নিজেকে সুস্থ হয়ে উঠেছে তার নানুমনির সেবাযত্নে । সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে সে বিছানায় বসে জানালা দিয়ে বাহিরের আবহাওয়া দেখছে। গোধূলি আকাশ। আকাশে মেঘগুলো কেটে গিয়ে রংধনু আসর জমিয়েছে।
রাতে প্রচন্ড জ্বর আসে চারুর।জ্বরের ঘোরে আবোল তাবোল বকতে থাকে।তখনি তার মনে হয় কেউ একজন তার গালে আলতো হাতে ছুঁয়ে দিচ্ছে যেই জায়গায় কাব্য স্যার থাপ্পড় মেরেছিলো ।
কখনো নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দিচ্ছে। এভাবে কিছুক্ষণ লোকটার হাত আর ঠোঁট তার গালে বিচরণ করার পর গালে হালকা ঠান্ডা অনুভব করে চারু।মনে হয় যেন কেউ আঘাত লাগা স্থানে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে।আবার সেখানে যাতে জ্বালাপোড়া না করে সেজন্য ফুঁ দিয়ে দিচ্ছে। নানু মনি ছাড়া কখনো আর কারো থেকে এতো আদর যত্ম , ভালোবাসা পায় নি সে ।সে চোখ খুলে মানুষ টাকে একবার দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু সে চোখ খুলতে ব্যর্থ হয়।
তৎক্ষণাৎ লোকটা মুচকি হেসে ওয়াশরুমে গিয়ে বালতি তে পানি মগ নিয়ে এসে চারুকে কে নিজের হাঁটুর উপর মাথা রেখে শুইয়ে দেয়।এতে চারু একটু নড়ে চড়ে উঠে।যা দেখে লোকটা অতি সাবধানে পরম মমতায় তার মাথায় পানি দিয়ে ধুয়ে দেয়।টাওয়াল দিয়ে যত্ম সহকারে চুল মুছিয়ে ঔষধ খাইয়ে দেয়।
গালে ঔষধ যেতেই চারুর কপাল কুঁচকে আসে। ঔষধ খাওয়া শেষ হলে লোকটা বালিশে চারুর মাথা রেখে শুইয়ে দিয়ে গায়ে কাঁথা টেনে দিয়ে কপালে আলতো চুমু খেয়ে বেরিয়ে আসে।
চারু জ্বরের ঘোরে সবটা ঝাঁপসা দেখছিল। কিছুই তার স্পষ্ট বোধগম্য হয় নি।
ফজরের আযানের মিষ্টি ধ্বনি শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায় চারুর। চারু তড়িঘড়ি করে উঠে মাথায় হাত দিয়ে বুঝতে পারে তার চুল ভেজা রয়েছে।গায়ে জ্বর টাও নেই।বেশ ফুরফুরে লাগছে নিজেকে।
তৎক্ষণাৎ চারুর রাতের ঘটনা মনে পড়ে যায়। কিন্তু সে বুঝতে পারে না রাতে কে এসেছিলো তার ঘরে তার সেবা শুশ্রূষা করতে? চারু নখ কামড়ে বললো, এই বাড়িতে একমাত্র নানুমনি ছাড়া আর কেবা আছে আমার কথা ভাবার মতো?হয়তো নানুমনি এসেছিলো আমার ঘরে।
যাই তাড়াতাড়ি গিয়ে নামাজ পড়ে নি।নামাজ পড়ে সব কাজ শেষে সবার জন্য নাস্তা তৈরি করতে হবে বলে চারু ওয়াশরুমে চলে যায়। ওয়াশরুম থেকে অযু করে বেরিয়ে নামাজ পড়ে চারু সোজা তার নানুমনির রুমে চলে আসে।
তিনি সবেমাত্র নামাজ শেষ করে উঠেছেন। চারু কে দেখা মাত্রই তিনি চারুকে কে বিছানায় বসিয়ে চারুকে মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
তোর শরীর এখন কেমন । জ্বর কমেছে একটু।
গতরাতে আমার একটু শরীর খারাপ লাগছিলো।তাই তো তোর খোঁজ নিতে যেতে পারি নি। ভেবেছি নামাজ শেষ করে তোর কাছে যাবো।আমি তোর কাছে যাওয়ার আগেই তুই আমার রুমে চলে এলি।
0 Comments