লেখিকাঃ তাবাসসুম কথা
তুর্যর ফোন অনবরত বেজে চলছে। দুই বার ইগনোর করলেও তৃতীয় বার ফোনটা হাতেই নিতেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠে আমার। স্ক্রিনে ইংরেজি অক্ষরে জেসিকার নাম টা ভেসে উঠছে। হঠাত্ করেই আমার হাত দুটো কাঁপতে থাকে। এতোদিন পরে আবার জেসিকা তুর্য কে কন্টাক্ট করেছে। তার মানে তুর্য আর জেসিকার মধ্যকার সম্পর্ক এখনও চলছে! এতোদিন আমার যেটা মনে হতো তাহলে সেটাই সঠিক। তুর্য এখনও জেসিকাকেই ভালোবাসেন। মোবাইল টা আগের স্থানেই রেখে দিলাম। বুকের বা পাশে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব হচ্ছে। যাকে আমি ভালোবাসি সে কেনো অন্য কাউকে ভালোবাসে?সে আমার জীবনসঙ্গী অথচ তার মনের আসনে অন্য কারো অধিকার। কিভাবে মানবো আমি এসব!
তাফসিকে সবাই হলুদ ছোঁয়াচ্ছে। রায়ানদের বাড়ি থেকে হলুদ এসেছে। কিন্তু তাফসি বলেছিল রায়ানের বাবা মা বিয়েতে রাজি না তাহলে হলুদ কিভাবে এলো! তবে কি এই বাড়িতে থাকার জন্য এটা রায়ানের নতুন প্ল্যান? অবশ্য এটা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না।
তাফসিকে হলুদ ছোঁয়াতে গেলে তমা বেগম হীর কে বাঁধা দেয়।
-- তুই আমার মেয়ের হলুদে হাত দিস না।
-- কেনো বড় আম্মু? তুমিই তো আমাকে আসতে বলেছিলে।
তমা বেগম দাঁতে দাঁত চেপে নিচু স্বরে বলেন,
-- তোকে আসতে বলেছিলাম শুধু মেহমানদের দেখানোর জন্য। পারলে তোকে আমি আমার বাড়ির ত্রিসীমানায়ও সহ্য করতাম না। দায়ে পরেই আনতে হয়েছে। একবার আমার মেয়ের সব সুখ খেয়েছিস। দ্বিতীয় বার তাফসির ওপর তোর ছায়াও পরতে দেবো না আমি।
-- আমি তাফসির খারাপ চাই না বড় আম্মু।
-- সেটা তো শুরু থেকেই দেখে আসছি। এখন যা তো এখান থেকে। তোর প্রয়োজন শেষ এখানে। আমার তাফসি আজ অনেক খুশি। তোকে দেখলে আবার ওর মন খারাপ হবে।
মাথা নিচু করে ছাঁদ থেকে নেমে এলাম। জানি না এই বাড়ির মানুষগুলো কখন আমাকে বিশ্বাস করবে। প্রথম প্রথম ভীষণ কষ্ট হতো এসব শুনে কিন্তু এখন সব সয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তাফসির বিয়ের জন্য হাফসা ফুপি আম্মু আর কিয়ারাও এসেছেন।
নিচে কোনো কাজ না থাকায় রুমে চলে গেলাম।
রুমে বিভীষিকাময় অন্ধকার।কেনো যেনো মিনিট দশেক আগেও ঘরটা আলোকিত ছিল। কিছুদিন ধরে অন্ধকার দেখলেই ভয় ভয় করে। তুর্যর অন্ধকার ভীষণ পছন্দ। বিয়ের আগে যতোবার তার রুমে আসতাম রুম অন্ধকার করাই পেতাম। কিন্তু এতোদিন পর আবার কেনো! তবে কি তুর্য তার অতীতে ফিরে যেতে চাইছেন? না এই সামান্য ব্যাপার টা কে এতো বড় করা আমার ঠিক হচ্ছে না।
অন্ধকারে একটু সামনে এগিয়ে যেতেই কিছু একটার সাথে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে নিলে কেউ আমার কোমর চেপে ধরে আমাকে বাঁচায়। নিজেকে সামলে স্বাভাবিক হতেই সেই চিরচেনা ঘ্রাণ আমার ইন্দ্রিয় কে সজাগ করে। এই ঘ্রাণ টা আমাকে প্রতিনিয়তই মাতাল করে তুলে। তুর্য তার হাত আমার কোমরে স্লাইড করছেন। না চাইতেও তার প্রতিটি স্পর্শ আমার শরীরে শিহরণ জাগায়। কি আছে এই মানুষটার মধ্যে! কেনো তার সামনে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। তাকে ভালোবাসার একটা কারণও নেই। অথচ তার থেকে দূরে থাকার হাজার টা কারণ আছে। তবুও নিজের সব আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে তার কাছেই ধরা দেই বারংবার।
তুর্য তার হাত স্লাইড করতে করতে আমার উন্মুক্ত পিঠে রাখেন। ব্যাকলেস ব্লাউজ হওয়ায় খুব সহজেই তার দুটো হাত পিঠে জায়গা করে নেয়। চোখ বন্ধ করে তার প্রতিটি স্পর্শ অনুভব করছি। মন বারবার বলছে তার ভালোবাসায় সাড়া দিয়ে তার মধ্যে মিশে যেতে। তুর্যর গরম নিশ্বাস আমার চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে। ক্রমশ নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাচ্ছে। তুর্য আমার মুখটা তার দু হাতের আজলে নিয়ে নেশা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তার চোখে এক সাগর ভালোবাসা জমাট বেঁধে রয়েছে। এই ভালোবাসার একমাত্র অধিকারী কি আমি? তুর্য পরম আবেশে আমাকে বুকে জরিয়ে নেয়। না আজ আর কোনো সংশয় নেই। তার ভালোবাসায় শুধু আমার অধিকার!
হঠাত্ সেন্টার টেবিলে রাখা তুর্যর মোবাইল টা বাজতে শুরু করে। অন্ধকার ঘরে মোবাইল স্ক্রিনে জেসিকার নাম টা জ্বলজ্বল করছে।
মনে পরে থাকা ভালোবাসার পর্দা টা ঝট করেই সরে যায়। তুর্য আমাকে ভালোবাসেন না। এতোক্ষণ যা ছিল সবই মায়া ছিল, ছলনা ছিল, মোহ ছিল!
তুর্য হীর এর মোহে এতোটাই ডুবে আছে যে দুইবার করে বেজে বন্ধ হয়ে যাওয়া মোবাইল এর রিংটোনের শব্দ তার কান অব্দি পৌঁছাতেই পারে নি।
অসহ্য লাগছে তুর্যর স্পর্শ। সে আমাকে ভালোবাসে না তবে কেনো এতো কাছে আমার? তার সব মোহ কি আমার শরীরের প্রতি? তুর্যর থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে বেশ জোরে তাকে ধাক্কা লেগে যায়। তুর্য টাল সামলাতে না পেরে নিচে পরে যান।
এই ঘটনায় তুর্য হতভম্ব হয়ে যায়। প্রতিবারের মতো এবারও হীর তাকে রিজেক্ট করেছে। কিন্তু তার সহ্যেরও একটা সীমা আছে যা আজ অতিক্রম হয়েছে।
তুর্য নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়িয়ে হীর হাত চেপে ধরে। মুহূর্তেই তার চেহারার রং পাল্টে যায়। রাগে তার ফর্সা মুখ টা সম্পূর্ণ লাল হয়ে গিয়েছে।
-- তোমার প্রব্লেম টা কি? কেনো তুমি আমাকে সহ্য করতে পারো না?
-- হাত ছাড়ুন তুর্য। আমি ব্যথা পাচ্ছি।
-- তোমার হাতের ব্যথা টা তুমি সহ্য করতে পারছো না কিন্তু কখনও ভেবেছো কি আমি কিভাবে এতো ব্যথা সহ্য করবো!
-- ছাড়ুন তুর্য আমাকে। আপনি আমাকে ব্যথা দিচ্ছেন।
-- তোমার দেওয়া ব্যথার কাছে এটা কিছুই না। কেনো করো তুমি এসব? আমাকে কষ্ট দিয়ে অনেক শান্তি পাও তুমি তাই না!
-- আমি আপনার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই।
-- ইউ আর! তুমি আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য। কজ ইউ আর মাই ওয়াইফ ড্যাম ইট।
-- আমি আপনার ওয়াইফ! আমি আপনার ওয়াইফ নাকি আপনার রক্ষিতা? শুধু শারীরিক চাহিদা পূরণের জন্যেই আমার প্রয়োজন তাই না।
হীর এর কথায় তুর্য বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। হীর এর মুখ থেকে এই কথা শুনতে হবে, এটা তার কল্পনাতীত ছিল। তার ভালোবাসাকে হীর এতো সহজে চাহিদার নাম দিয়ে দেবে এটা সে তার কোনো দুঃস্বপ্নেও ভাবে নি।
-- আপনি আমাকে কি মনে করেন? যখন যেভাবে ইচ্ছা তখন সেভাবে ব্যবহার করবেন? আমি মানুষ নাকি কোনো বস্তু? আমার কোনো অনুভূতি নেই? আপনাকে শারীরিক সুখ দেওয়াই কি আমার একমাত্র কাজ? যখন আপনার ইচ্ছা হয় কাছে টেনে নেন!
-- জাস্ট শাট্ আপ হীর।
-- কেনো? আমি চুপ করবো না। আপনার কোনো চাহিদা মেটানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ভালোতোবাসেন না তবে কেনো কাছে আসেন? আমার শরীর টাই বুঝি আপনাকে টানে! আমার মন আমার অনুভূতি আমার ভালোবাসা এসবের কোনো মূল্য নেই তাই না!
-- তোমার মুখ থেকে আমি আর একটা কথাও শুনতে চাই না হীর।
-- আপনাকে শুনতে হবে। অন্য কাউকে ভালোবাসেন অথচ আমার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে চান লজ্জা করে না? ছিঃ কতোটা নোংরা আপনি আর কতোটা ঠুনকো আপনার ভালোবাসা!
আর কিছু বলার আগেই তুর্য হীরের গালে সজোরে একটা চড় বসিয়ে দেয়। এতোক্ষণ অনেক চেষ্টা করেও সে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। হীর কে সে ভালোবাসে, সেই হীর ই আজ তার ভালোবাসাকে অপমান করেছে।
তুর্যর চড়ের মাত্রাটা এতোটাই জোরালো ছিল যে হীর মেঝেতে ছিটকে পড়ে। হীর কে নিচে পরা দেখে তুর্য হন্তদন্ত হয়ে তাকে উঠায়। হীর এর ঠোঁট কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। তুর্য তার আঙুল দিয়ে কাঁটা জায়গা স্পর্শ করতে গেলে হীর তাকে বাঁধা দেয়।
-- ছোবেন না আপনি আমাকে। আপনার প্রতিটি স্পর্শ আমার শরীরে ঘৃণায় ভরা কাঁটা বিধিয়ে দেয়। আপনার প্রতিটা স্পর্শের উদ্দেশ্য একমাত্র আমাকে ব্যবহার করা।
হীর এর প্রতিটি কথা যেনো তুর্যর হৃদয়ে ধাঁরালো ছুরির মতো আঘাত করছে।
-- ভুলে যাবেন না তুর্য, আমি আপনার রক্ষিতা নই। যাকে আপনি যখন খুশি বিছানায় টেনে নেবেন।
তুর্য তার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে ক্রমশ। তার মাথায় ফুটন্ত আগ্নেয়গিরির লাভার মতো রাগ টগবগ করছে। সে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে হীর কে শান্ত করার। কিন্তু হীর যেনো কোনো কিছুই শোনার জন্য প্রস্তুত না। এক পর্যায়ে তুর্য এক হাতে হীর এর চুলের মুঠি চেপে ধরে। আরেক হাতে হীর এর চোয়াল চেপে ধরে হীর এর মুখ তার মুখ বরাবর এনে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
-- তুমি আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিয়েছো হীর। অনেক বার ট্রাই করেছি তোমার সব অপমান ইগনোর করতে। বাট তুমি লিমিট ক্রস করে ফেলেছো। রক্ষিতার মানে জানো তুমি? ব্যবহার করা কাকে বলে ফিল করেছো কখনও? আমার স্পর্শে তোমার ঘৃণা হয় তাই না হীর। দেন এই ঘৃণা শুধু তোমার মনে কেনো থাকবে! এখন যেমন তুমি আমার স্পর্শ কে ঘৃণা করো আজকের পর থেকে তুমি নিজেকেও একইভাবে ঘৃণা করবে।
হীর কে বিছানায় ফেলে তার উপর নিজের সমস্ত ভার ছেড়ে দেয় তুর্য। তুর্যর এমন আকস্মিক হামলায় হতবাক হয়ে যায় হীর। হীর এর দুই হাত বিছানার সাথে চেপে ধরে আছে সে। তুর্য কে নিজের উপর থেকে সরানোর জন্য সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তাকে ঠেলছে হীর। কিন্তু তুর্যর শক্তির কাছে সে কিছুই না। চেষ্টা করতে করতে একটা সময় হীর ক্লান্ত হয়ে পরে। তু্র্য এখনও তার উপর আগের ভংগিতেই শুয়ে আছে।
-- আমাকে ছাড়ুন বলছি। এভাবে আমার সাথে জোর করতে পারেন না আপনি।
হির এর হাত দুটো আরও শক্ত চেপে ধরে তুর্য।
-- আমি কি পারি আর না পারি আজ সেটা তুমি খুব৷ ভালো করেই বুঝতে পারবে।
তুর্য এক হাতে হীর এর মুখ চেপে ধরে হির এর গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয়।
হীর এর দু চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরে যাচ্ছে। কিন্তু তুর্যর সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তার কাজে ব্যস্ত। প্রথম দিকে হীর বাধা দিলেও একটা সময় সে শান্ত হয়ে যায়। একটা জীবন্ত লাশ এর ন্যায় বিছানায় পরে থেকে একটা ভয়ংকর রাত এর স্বীকার হচ্ছে।
হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। অনুষ্ঠানে থাকা প্রতিটি ব্যক্তি আজ খুশি ছিল। সবচেয়ে বেশি তাফসি। অবশেষে তার স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে কাল। কালকের দিনের অপেক্ষায় যেনো তার সময় থমকে গিয়েছে। দুচোখের পাতা এক করতে পারছে না সে। উত্তেজনা আর আশংকায় তার ঘুম উবে গিয়েছে।
সবার আনন্দের ভিরেও একজন ভীষণ কষ্টে আছে। বিছানায় শুয়ে এক প্রকার ছটফট করছে কিয়ারা। এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। তার প্ল্যান অনুযায়ী তো হীর কে এ বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার কথা ছিলো। তবে হীর কি করে তুর্যর বউ হয়ে গেলো? সবাই তো! কেন হলো এমন?
বিছানা ছেড়ে উঠে যায় কিয়ারা। তাফসির বিয়ের দিন তুর্য কে ফাঁসানোর জন্য তার ড্রিংক স্পাইক করেছিল কিয়ারা। সেটা ভুলবশত হীর খেয়ে নেয়। তবে রায়ান আর হীর এক বিছানায় পৌঁছানোর পিছনে তার কোন হাত ছিল না। সে যাই করেছিল সবটা তুর্য কে পাওয়ার জন্য। কিন্তু হলো তার সম্পুর্ণ বিপরীত। তুর্য কে তো সে পেলোই না উল্টো হীর আর তুর্যর বিয়ে হয়ে গেলো। এখন তার কি হবে? তবে কি সে তার ভালোবাসা কে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে? না এতো সহজে নিজের ভালোবাসার দাবি ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে সে না। ছলে বলে কিংবা কৌশলে যে করেই হোক তুর্য কে সে হাসিল করবেই!
0 Comments