Ad Code

চারুলতা পর্ব - ৩

লেখিকাঃ সাবিহা জান্নাত

কাল রাতে তুমি আমার ঘরে যাও নি তাহলে কে গিয়েছিল। চারু আনমনে খুব নিম্নসুরে কথাটা বলে , যেটা তার নানুমনির কানে স্পষ্ট বোধগম্য হয়না।

~কিছু বললে বুবু ?
~ না কিছু না , আমি আসছি বলেই চারু তার নানুমনির ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
যদি কাল রাতে নানুমনি আমার ঘরে না যায় তাহলে কে গিয়েছিল । তাহলে সবকিছুই কি আমার মনের ভুল। যদি মনের ভুল হয় তাহলে আমার চুলগুলো ভেজা ছিল কেন। নানুমনি ছাড়া এই বাড়িতে আমার আদর যত্ন নেওয়ার মতো তো আর কেউ নেই । চারু আর কিছুই ভাবতে পারছে না। সে কোনো মতেই রাতে কে এসেছিল তার ঘরে, তার জবাব খুঁজে পাচ্ছে না। চারুর সবকিছু কেমন ঘোলাটে লাগছে । চারু কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরে চলে যায়। ও রান্নাঘরে প্রবেশ করতেই তার মামী চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেয়।,,
~ এখন আসার সময় হলো নবাবের মেয়ের ‌। কত বেলা হয়েছে সেদিকে খেয়াল আছে । আমার ছেলে মেয়ে গুলো কি না খেয়ে কলেজে যাবে।
~ সরি মামীমুনি ।নামায পড়ে একটু নানুমনির রুমে গিয়েছিলাম। সেখানে কথা বলতে বলতেই দেরী হয়ে গেছে। আমি তারাতারি করে সব কাজ করতে দিচ্ছি। বলেই চারু তাড়াতাড়ি কাজে হাত লাগায় । চারু তার মামী কে ময়দা মাখতে দেখেই হাসি মুখ নিয়ে বলে উঠে,,
~ আপনি ময়দা মাখছেন কেন? আমাকে দিন আমি করে দিচ্ছি। চারুর কথা কানে আসতেই রুপন্তী রহমান বলে উঠে,,
~ তুমি এই বাড়ির আশ্রিতা। এই সংসারের কেউ না। আমার সংসারে কি করতে হবে না হবে আমি দেখবো সেটা । আশ্রিতা আশ্রিতার মতোই থাকো । ভুলেও ঘরের লোক হওয়ার চেষ্টা করো না । কড়া গলায় কথাগুলো বলেই আবার তিনি নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
মামীর কথা শুনে চারুর হাসিমাখা মুখখানি নিমিষেই মলিন হয়ে যায়। চোখের কোণে পানি জমে যায় মুহুর্তেই ।চোখের কোণে জমে থাকা পানি আড়াল করে সে । ডালা থেকে সবজি নিয়ে কাটা শুরু করে দেয়। প্রতি মূহুর্তে সে তার বাবা মায়ের অনুপস্থিতি অনুভব করে ।
[ তার জীবন দশায় বাবা মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার ভাগ্য হয়নি তার । বাবা মা চলে যাওয়ার পর দুই পরিবারে অর্থাৎ দাদুবাড়ি এবং নানু বাড়ির পূর্ণ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তার ঠাঁই হয়নি ছোট্ট চারুলতার , ঠাঁই হয়েছিল এতিমখানায় । তার সমস্ত খরচ বহন করা হয়েছিল তার দাদু বাড়ি অর্থাৎ তার দাদুমনি বহন করেছিল ‌ ।
১৮ বছর বয়সে যখন এতিমখানা থেকেও তার দায়িত্ব শেষ হয়েছিল তখন তার নানুমনি ছেলে এবং ছেলের বউকে অনেক জোড়াজুড়ি করে এই বাসায় চারুকে রাখতে পারছে। কিন্তু চারুর সমস্ত খরচ বহনের দায়িত্ব নিবে চারুর দাদু মনি এই শর্তে তাকে বাসায় রাখা হয়।
চারুকে তার দাদুমনি অনেক ভালাবাসা সত্ত্বেও স্বামীর কঠোর নিষেধ থাকার ফলে নিজের বাসায় রাখতে পারেনি তিনি চারুকে। অন্য জায়গায় রাখলে হয়তো আপন মানুষদের ভালোবাসা থেকে সে বঞ্চিত হবে, এই ভেবে তাকে তার নানুমনির কাছে রেখেছিল তিনি। তার ছেলের একমাত্র মেয়ে চারু, ফেলে দিতে পারেন নি চারুকে। তিনি ই চারুর সমস্ত শখ, আহ্লাদ মেটান ]
কাব্য হোয়াইট শার্ট এবং ব্লাক জিন্স প্যান্ট পরে । চুলে জেল , শরীরে পারফিউম ব্যবহার দিয়ে হাত ঘড়িটা পড়ার জন্য তাকিয়ে দেখে হাত ঘড়িটা তার স্থানে নেই। ঘড়িটা তো এখানেই রাখা ছিল , কই উধাও হয়ে গেল । অনেক খোঁজাখুঁজির পর ও সে তার ঘড়িটা খুঁজে পেল না । অবশেষে অন্য একটা ঘড়ি পড়ে রেডি হয়ে নিচে চলে আসে ।
সোফায় বসে কাব্যের বাবা কামরুল ইসলাম পত্রিকা পড়ছে। চারু সকালের নাস্তা রেডি করছে, সেগুলো টেবিলে সাজিয়ে রাখছে এর মাঝে কাব্য চলে আসে । ও কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা টেবিলে গিয়ে বসে পড়ে। একে একে সবাই টেবিলে বসে পড়লো। চারু সবাইকে সকালের নাস্তা দিয়ে দেয় ।
কাব্য আড়চোখে চারুর দিকে তাকিয়ে দেখে চেহারায় মলিনতার ছাপ। মুখে বিন্দু মাত্র হাঁসি নেই, চেহারা কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। লাবন্যময়ী চেহারায় কোনো চাকচিক্যতা নেই। রয়েছে শুধু মলিনতার ছাপ।
সকালের নাস্তা শেষ করে সবাই যে যার কাজের উদ্দেশ্যে চলে যায়।চারু নিজের রুমে গিয়ে কাপড়টা চেন্জ করে নিয়ে ব্লাক একটা থ্রি পিস পড়ে ওড়না টা শরীরে জড়িয়ে নেয়।
চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিয়ে ব্যাগ নিয়ে ওর নানুমনিকে কে বলে বেরিয়ে যায় বাসার নিচে। একটা রিক্সা নিয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।‌
সে অসহায় দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে সবকিছু দেখছে। মাঝে মাঝে তার কাছে এই প্রকৃতির সৌন্দর্য বিষাদ লাগে। সবকিছুই ঝাপসা ঝাপসা, তার জীবন টা নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। বাবা মা হীন তার জীবনে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে।
এতিমখানায় থাকার সময় ও তার এতোটা কষ্ট হয় নি আজ যতটা কষ্ট পায় আপন মানুষদের কাছে থেকে। চারুলতা শুধু সর্বক্ষনে একটা কথায় ভাবে এই জীবনের শেষ কথায় ।
এসব ভাবতে ভাবতে কলেজে পৌঁছে যায় রিক্সা। রিক্সায় ভাড়া মিটিয়ে সে কলেজের ভিতরে চলে যায়। ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতেই কবিতা চারুকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদীর স্বরে বলে উঠে,,,
~ তুই কলেজে আসিস নি কেন আগামী দিন। আমি তোর জন্য কত অপেক্ষা করলাম । তুই কলেজে না আসলে , তোর সাথে একদিন দেখা না হলে আমার দিনটায় খারাপ যায়।
~ কবিতার কথায় চারু জোরপূর্বক হাসি দেওয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু মুখে তার মলিনতার ছাপ স্পষ্ট। সে আড়াল করার চেষ্টা করেও পারলো না কবিতা ঠিকই বুঝতে পারলো।
~ কি হয়েছে তোর । মুখটা এমন শুকনো লাগছে যে। মন খারাপ তোর আর আমি তোর জন্য কিছু করতে পারবো না এটা হয় । বল কি হয়েছে ।
কবিতা চারুর বেষ্টফ্রেন্ড যে কি না তার সর্বক্ষণের সঙ্গী। চারুলতা সবকিছু শেয়ার করে তার সাথে। সে কলেজ লাইফে মাত্র এক বছরে তার সাথে খুব মিশে গেছে। তার সাথে কথা বলতে তার কোনো দ্বিধা নেই। কবিতা ও চারুকে নিজের বোনের মতো দেখে। তার খুব কেয়ার করে ও । দাদু মনি , নানুমনির পরে একমাত্র ভালোবাসা সে কবিতার থেকেই পেয়েছে ।
কবিতা চারুকে একটা বেঞ্চিতে বসে পড়ে। চারুর দিকে পানির বোতল টা এগিয়ে দেয়। চারু পানি খেয়ে কিছু সময় দম নেয়। সে কিছুতেই কিছু বলতে চায় না কবিতা সেদিনের কলেজের ঘটনা । কিন্তু কবিতা ও নাছোড়বান্দা। সে খুব জোড়া জোড়ি করার পর চারু তাকে সেদিনের ঘটনা বলতে বাধ্য হয়।
কাব্য স্যারের চারুকে থাপ্পড় দেওয়ার ঘটনা টা শুনেই কবিতা কবিতা দাঁতে দাঁত চেপে রাগ গুলো সহ্য করে । হঠাৎ কারো আওয়াজ পেয়ে চারু এবং কবিতা দুজনেই ফিরে তাকিয়ে দেখে সেদিনের মেয়েগুলো জারা কাব্য স্যারকে প্রপোজ করার জন্য পাঠিয়েছিল।
তারা ফের একই কাজ চারুকে দিয়ে করার জন্য এসেছিল । তাদের দেখেই কবিতা বিষয় টা বুঝতে পারছে । ও চারুকে ফুল আর চিঠিটা নিতে বলে । চারু ভয়ে ভয়ে সেগুলো নিয়ে নেয় কবিতার কথায়।
কাব্য মাত্রই অফিসকক্ষ থেকে বেরিয়েছে। ক্লাস রুমে যাওয়ার জন্য। কবিতা চারুর হাত ধরে টানতে টানতে কাব্য স্যারের সামনে নিয়ে যায়। কাব্য ও ওদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে। ও কিছুটা বিষয়টি আন্দাজ করে ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
কাব্যের ভাবনার মাঝেই কবিতা বলে উঠে,,,
~ কি ভাবছেন এভাবে তাকিয়ে থেকে, আপনাকে এগুলো দেওয়ার জন্য নিয়ে এসেছি । হ্যা এগুলো আপনাকে দেওয়ার জন্যই নিয়ে এসেছি তবে প্রপোজ করার জন্য নয়।
আপনার মতো একজন কাপুরুষ যে কিনা অকারনে দুর্বল মেয়েদের উপর হাত উঠায় আর যাই হোক এই পবিত্র ফুলটা সেই মানুষটির জন্য না। আর আপনার মতো কাপুরুষকে চারুর ওই নরম হাত দিয়ে প্রপোজ করাটা মানাবে না।
এইগুলো চারুর কাছে একটা মেয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে আপনার জন্য। ভাবলাম আজ আমি এগুলো আপনাকে দেই , আমিও দেখতে চাই আপনার হাতের কত জোড়। বলেই ফুল আর চিঠিটা কাব্যের হাতে ধরিয়ে দিয়ে চারুকে নিয়ে ক্লাস রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় ।
চারু কবিতা কে অনেক নিষেধ সত্ত্বেও কথা গুলো বলে সে কাব্যকে। আমিও দেখবো কে তোকে কি বলে । আর যদি তোকে বাসায় কিছু বলে তাহলে চিন্তা করিস না এর ব্যবস্থা করবো । ওর সাহস কি করে হয় তোর শরীরে আঘাত করার বলেই চারুকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে টেনে নিয়ে যায়।
কাব্য কবিতার কথা শুনে প্রচন্ড রেগে যায়। চিঠি টা পড়ার পর আরো বেশি রেগে যায়। ও রাগান্বিত চেহারা নিয়ে ক্লাস রুমে প্রবেশ করে।
ক্লাসে প্রবেশ করেই চিঠি আর ফুলটা উঁচু করে ধরে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলে উঠে,,
~ নীতি কে । যে আমার জন্য এগুলো পাঠিয়ে দিয়েছে। অনেক বার জিজ্ঞেস করার পরও সে কোনো জবাব পায় না। পুরো ক্লাস রুম নিস্তব্ধ। কাব্যের রাগ দেখে সবাই ভয় পেয়ে চুপ করে আছে। কবিতা আর চারুও চুপচাপ সেগুলো দেখছে ক্লাস রুমে বসে ।
~ হু ইস নীতি। আমি আর একবার জিজ্ঞেস করবো কে এগুলো দিয়েছে। যদি উত্তর না পাই এগুলোর সাথে যারা যারা জড়িত আছে সবাইকে কলেজ থেকে বের করে দিবো ।
কয়েকজন ভয় পেয়ে নীতি এবং ওর সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে তাকাতেই ওরা দাঁড়িয়ে পড়ে। কাব্য ওদের কে দেখে রাগান্বিত হয়ে বলে উঠে,
~ তোমরা বেয়াদব এর মতো একজন শিক্ষক কে প্রপোজাল পাঠাও। ভদ্রতা সভ্যতা কিছু শেখায় নি তোমাদের । গেট আউট ফ্রম হেয়ার ।
ওরা সবাই এখনো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে । কি হলো আমার কথা বুঝতে পারো নি , গেট আউট। ওরা কাব্যের কথা শুনে সবাই ভয় পেয়ে ব্যাগ নিয়ে ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
নেক্সট টাইম যদি এমন ভুল কেউ করো তাহলে তোমাদের পরিনতি কি হবে নিশ্চয় বুঝতে পারছো। কাব্য নিজের রাগটা কন্ট্রোল করে ক্লাস নেওয়া শুরু করেছে । ক্লাসে পিনপিন নিরবতা। ভয়ে সবাই চুপসে গেছে ।
ক্লাস শেষে কাব্যের আচমকা ডাকে চারু শিউড়ে উঠে,
~ এ ইউ। এখন যে পড়া পড়ালাম সেটা তুমি এখানে বোর্ডে করে দাও । চারু ভয়ে ভয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায়। টেবিল থেকে মার্কার পেন নেয় কাঁপা কাঁপা হাতে ।কবিতা ওকে ইশারায় ভয় না পেয়ে পড়াটা বুঝিয়ে দিতে বলে। চারু খুব সাহস করে পড়াটা বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করে। কাব্য স্যার যে তাকে এখন থ্রেট দেওয়ার জন্য সামনে নিয়ে এসেছেন এটা চারু খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে। এখন কিছু ভুল করলেই তার উপর কাব্যের সমস্ত রাগ ঝাড়বে।


Post a Comment

0 Comments

Close Menu