লেখিকাঃ সাবিহা জান্নাত
কাব্য চারুকে কথা শোনানোর জন্য সামনে ডেকে নিয়ে এসেছিল । কিন্তু চারুর বুঝিয়ে কথা বলার ধরন দেখে সব রাগ নিমিষেই উড়ে যায়। ও মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে চারুর দিকে।
বাসায় ফিরে এসে কাব্য ফ্রেশ হতে চলে যায়। লম্বা একটা শাওয়ার নেয়। কাব্যের নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। সঠিকটা না জেনেই চারুকে আঘাত করাটা তার ঠিক হয় নি । কাব্যের নিজের অজান্তেই মন খারাপ হয়ে যায়। বার বার শুধু একটা কথাই তার মাথায় ঘুরছে ।
ফ্রেশ হয়ে ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে আসে ও । একটা টি-শার্ট আর ট্রাউজার পড়ে নেয় ।
দুপুরের খাবার খেয়ে নেয় নিজের রুমে বসে আছে কাব্য । ল্যাপটপে বসে ঘাঁটাঘাঁটি করছে সে ।
কাজ শেষ করে কাব্য বিকালে নিজের ঘর থেকে বেরিয়েছে সবেমাত্র। দো তলার কড়িডরে এসে দাঁড়িয়ে আছে কাব্য। হঠাৎ ই চারুকে তাড়াহুড়ো করে তার দাদুমনির ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে যেতে দেখে সে। ওকে দেখেই ভ্রু কুঁচকে ফেলে।
এতো তাড়াহুড়ো করে যাওয়ার কি আছে । কাব্য আরো বেশি অবাক হয়েছে চারুর ওড়নার নিচে কিছু একটা লুকিয়ে নিয়ে যেতে। সে কিছু একটা গোপন করছে।
কাব্য চারুর পিছনে পিছনে চলে যায়। চারুর ঘরের দরজায় যেতেই ও থেমে যায়। চারু একটা ছবি খুব যত্ন করে মুছে তার স্যুটকেসে রাখছে। ছবিটা তার মা বাবার।
তার দাদু মনির ঘরে লুকিয়ে রাখা ছিল হয়তো ছবিগুলো। কারন কাব্যের বাবা বোনের স্মৃতি সব মুছে ফেলতে চান । কোনো স্মৃতি রাখতে চান না এই বাড়িতে।
সেই ছবিগুলো হয়তো চারু পেয়েছে তাই সে এগুলো নিজের কাছে খুব যত্ন সহকারে তুলে রাখছে ।
কাব্য ছবিটা দূর থেকে দেখেই তার মুখটা মলিন হয়ে যায়। তার ফুপীকে সে অনেক ভালোবাসতো । তার ফুপীর ও কলিজা ছিল সে ।
তার ফুপীর হাতেই তার মানুষ হওয়া। তাকে খাইয়ে দেওয়া, গোসল করে দেওয়া, তার সাথে খেলাধুলা করা । তাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া , নিয়ে আসা সবটাই তার ফুপী করেছিল। তার সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল তার ফুপী। কিন্তু সেদিন তাদের জীবনের সব হাসিখুশি নিভে যায় যেদিন,,
অতীত

বাবা আমি তোমার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে পারবো না কথা টা চারুর আম্মু সোহানা তার নানুর উদ্দেশ্যে বলতেই তার নানু গম্ভীর হয়ে বলে উঠে,,
~আমি তাদের কথা দিয়ে দিয়েছি । আর তুমি খুব ভালো করেই জানো কথা দিয়ে তা ভঙ্গ করার মানুষ আমি না ।
~কিন্তু বাবা তুমি আমার মতামত না জেনেই তাদের কে কথা দিয়েছো মানে। আমার কি চাওয়া পাওয়ার কোনো দাম নেই । আমি এই ছেলেটাকে বিয়ে করতে পারবো না ( সোহানা )
~ আমি কোনো কথা শুনতে চাই না।আর তোমার মতামতের কোনো প্রয়োজন নেই আমার ।আমি যেখানে বিয়ে ঠিক করেছি সেখানেই হবে। আমার কথাই শেষ কথা ( সোহানার বাবা)
যেখানে উপস্থিত সবাই সবকিছু দেখছিল কিন্তু কেউ কোনো কথা বলতে পারে নি । সোহানার অসহায়তা দেখেও কারো কোনো কথার বলার সাহস হয় নি ।
বিয়ের আগের দিন রাতে সোহানা তার বাবা মা, ভাই , ভাবী সবাইকে অনেক বুঝিয়েছে কিন্তু কেউ তার বাবার উপর কোনো কথা বলতে পারে নি । পা ধরে কেঁদে কেঁদে বলেছিল তবুও তার অসহায়ত্ব কারো মন কে নরম করতে পারে নি। তার প্রিয় মানুষটার সাথে তার বাবা বিয়ে দিতে রাজি নয় ।
অবশেষে সেই বিয়ের মুহুর্ত এসেই গেল কিন্তু কন্যাকে তার ঘরে পাওয়া গেল না। তাদের আর বুঝতে বাকি রইল না যে তার মেয়ে তাদের অবাধ্য হয়ে তার প্রিয় মানুষের সাথে চলে গেছে ।
মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে চলে গেছে তাদের মেয়ে এই কথা ভেবে সবার ই মনে ক্ষোভ জমে আছে। চাইলেও তাদের মেয়েকে তারা ক্ষমা করতে পারবে না। ৫ বছর বয়সী কাব্য শুধু সবটা দেখেছিল কিন্তু কোনো কিছুই বুঝতে পারেনি । কেন তার ফুপীকে সবাই এতো ঘৃনা করছে ।
সোহানা এবং সায়ন বিয়ে করে যখন নিজেদের বাসায় আসে তখন তাদের কে মেনে না নিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল । আমাদের আপনাদের বাসায় না রাখলে আমাদের কোনো আক্ষেপ নেই তবে আমাদের জন্য দোয়া করবেন। বলেই তারা বেরিয়ে যায় নিজেদের বাসা থেকে।
তাদের পথ চলা এতোটাও সহজ ছিল না । তবে দুজনেই শিক্ষিত থাকায় জব করে সংসার সাজিয়ে ছিল । ১ বছর পর তাদের কোল আলো করে আসে এক ফুটফুটে মেয়ে। তার বছর ঘুরতেই ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে অ্যাক্সিডেন্টে বাবা মা দুজনেই চারুকে একা রেখে চলে যায়।
লাশগুলো বাহিরে রেখেই ছোট্ট চারুকে কোনো পরিবার থেকেই না রাখার সিদ্ধান্ত হয় । সেদিন ছোট্ট বাচ্চাটার কান্না কারো মনকে বিচলিত করতে পারে নি। সেদিন থেকেই মেয়েটার স্থান হয়েছিল এতিমখানায়।
বর্তমান

অতীতের কথাগুলো কাব্যের মনে পড়তেই তার চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ে। কাব্য বড় হয়ে বুঝতে পারছে । সে তার ফুপীকে কখনো ঘৃনা করতে পারেনি। তার দৃষ্টিকোণ থেকে ভালোবাসা তো অন্যায় না। হয়তো তার দাদু চাইলেই তার ভালোবাসাকে মেনে নিতে পারতো।
জোড় করে কোনো কিছুই সম্ভব নয়। তার দাদুমনি জোর করে মেয়েকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিলে সে হয়তো সুখি হতো না কখনো। তাই তার ফুপীর সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া। তার দাদু নিজের ইগো বাদ দিয়ে মেয়ের মতামত কে সমর্থন করলে আজ সময় এবং সম্পর্ক গুলো অন্য রকম হতো।
সন্ধ্যার সময় রান্না শেষ করে চারু তার ঘরে বসে আছে। তার ঘরে কিছুতেই ভালো লাগছিল না বলে সে ছাদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় । ছাদে হালকা আলোয় আলোকিত চারিপাশ। সে দোলনায় বসে ফোন স্ক্রোল করছে ।
সে কিছু সময় পর ফোন টা পাশে রেখে আকাশের পানে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। চারদিকে কোলাহল তার মাঝে সে নিজেকে বড্ড একা অনুভব করছে । হঠাৎ ই কারেন্ট চলে যাওয়ায় চারিপাশ টা অন্ধকারে ছেয়ে যায়।
চারদিকে সব আওয়াজ মুহুর্তে ই কমে যায়। চারিদিকটায় নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। চারু অন্ধকারে ভীষণ ভয় পায় । তার মনে হচ্ছে এদিক সেদিক কেউ আছে। আশেপাশে তাকিয়ে সে কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন নিয়ে টর্চ জ্বালিয়ে এদিক সেদিক দেখতে থাকে।
সে ফিরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই কারো সাথে ধাক্কা লেগে হাত থেকে তার ফোনটা পড়ে যায়। অন্ধকারে সে ভয় পেয়ে চিৎকার করতেই কেউ একজন তার মুখ চেপে তার হাত ধরে তাকে কাছে টেনে নেয়।
চারু এখন ছেলেটার খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে। তার নিঃশ্বাস গুলো ছেলেটার বুকের উপর আছরে পড়ছে । চারুর নিঃশ্বাস ক্রমেই বেড়ে চলেছে ছেলেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছে সে ।
সে চারুকে আরো নিজের সাথে চেপে ধরতেই চারুর শরীরে শিহরণ বয়ে যায়। অজানা এক আশংকা কাজ করছে চারুর কে এই ছেলেটা, এভাবে তাকে নিজের কাছে টেনে রাখছে কেন।
চারু ছেলেটার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার অনেক চেষ্টা করছে কিন্তু কোনো কাজ ই হচ্ছে না। ছেলেটার সাথে সে পেরে উঠতে পারছে না। ছেলেটা চারুর অবাধ্য চুলগুলো হাত দিয়ে কানের পিঠে গুঁজে দিচ্ছে খুব আলতোভাবে।
ছেলেটা চারুকে চমকে দিয়ে তার ঠোঁট দিয়ে চারুর নরম ঠোঁটে স্পর্শ করতেই চারু স্তব্ধ হয়ে যায়। পরপর কয়েকবার কাব্য চারুর ঠোঁট স্পর্শ করতেই চারু নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকে।
কিন্তু ছেলেটা চারুকে ছেড়ে না দিয়ে তাকে নিজের সাথে মিশে নেওয়ার চেষ্টা করছে । অন্ধকারে চারু ছেলেটার কোনো মুখ দেখতে পারছে না । ফোনটাও নিচে পড়ে যাওয়ায় সে কিছুই দেখতে পারছে না ।
চারু ছেলেটার স্পর্শ পেয়ে বার বার সেদিন রাতের ঘটনা মনে করতে থাকে। সেম স্পর্শ সেদিন রাতেও সে পেয়েছিল । তাহলে কি এই ছেলেটাই ছিল যে তাকে যত্ন করেছিল ।
তাহলে সে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করছে কেন তার থেকে। চারু খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে,,
~ কে আপনি ।
ছেলেটা চুপ কোনো কথা বলছে না। চারু আবার কথা বলতে যাবে তখন ই ছেলেটা চারুর মুখে তার আঙ্গুল দিয়ে তাকে বাধা দেয়।
কারেন্ট চলে আসায় ছেলেটার মুখে আলো পড়তেই চারু কাব্য দেখে চমকে উঠে। তাহলে কি কাব্য ছিল তার সাথে এতক্ষণ। কাব্যের দৃষ্টি স্থির। চারু কাব্যের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
~ছাড়ুন আমাকে । আমাকে এভাবে নিজের সাথে আটকে রেখেছেন কেন। চারু বাকি কথাগুলো বলতে যাবে তখন ই কাব্য চারুর মুখ আঙ্গুল দিয়ে তাকে চুপ করিয়ে দেয়
কিন্তু চারুর ছটফটানি কমছে না দেখে কাব্য চারুকে ছেড়ে দেয়।
চারু ছাড়া পেয়ে ফোনটা নিচে থেকে উঠিয়ে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে দৌড় দেয়। তার পিছনে তাকানোর সময় নেই। কাব্য তার সাথে ছিল সে ভেবেই ভয়ে তার আত্মা কেঁপে উঠছে।
খাবার টেবিলে বসে রাতের খাবার খাচ্ছে সবাই। চারু সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। সে ভয়ে ভয়ে কাব্যের দিকে এগিয়ে গিয়ে খাবার তুলে দিচ্ছে। কাব্যের দৃষ্টি স্থির। সে দৃষ্টিতে সে চারুকে খুব ভালো ভাবে প্রত্যক্ষ করছে।
রাতে বিছানায় বসে চারু ভেবে পাচ্ছে না কাব্য তার সাথে এমন করছে। কিন্তু কেন । ওনি তো আমাকে মোটেও পছন্দ করেন না। বার বার আমাকে অপমান করেন তাহলে এমন কাজ করার কারন কি। ওনি কি আমাকে ব্যবহার করতে চাইছে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চারুর চোখে জল গড়িয়ে পড়ছে।সে নিজেকে খুব কষ্টে সামলে নিয়ে পড়তে বসে।পড়া শেষ করে সে ঘুমিয়ে পড়েছে ।
আজ শুক্রবার

সবার ছুটি। ঝিমঝিম বৃষ্টির দিনে বাসায় বিরিয়ানি রান্না হচ্ছে। কাব্য বিরিয়ানির ঘ্রাণ পেয়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়। ও ভেবেছিল হয়তো ওর আম্মু রান্নাঘরে আছে।
কিন্তু চারুকে রান্নাঘরে দেখে কিছুটা থমকে যায়। চারু কাব্যকে দেখেই দৃষ্টি নামিয়ে কাজ করতে থাকে। কাব্য এর আগেও চারুকে দেখেছে কিন্তু কখনো মুগ্ধতা নিয়ে তাকে দেখেনি এভাবে।
তার মায়াবী চোখ । লাবন্যময়ী চেহারা সবটাই যেন কাব্য কে আকর্ষণ করে। বার বার তাকে কাছে টানে ।
বিকালে কাব্য ওর আম্মু এবং বোন কে নিয়ে শপিং এ বেরিয়েছে। কেনাকাটা শেষে কাব্য একটা সাদা শুভ্র রাঙা শাড়ি পছন্দ করে । সেটা সে চারুর জন্য কিনেছে শোনামাত্র ই ওর আম্মু এবং বোন কিছুটা চমকে যায়।
~ ওর তো কেউ নেই । আমাদের ও তো কিছু দায়িত্ব রয়েছে ওর প্রতি। আজকে সবার জন্য শপিং করা হলো তাই ভাবলাম ওর জন্য কিছু না নিলে ও মন খারাপ করবে । ছেলের কথা শুনে রুপন্তী রহমান আর কিছু বলে না ।
রুপন্তী রহমান কাধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে চারুর দাদু মনি ।
~ কেমন আছো। চারুর দাদু মনির কথা কথায় রুপন্তী রহমান বলে উঠে, ভালো।
~ মেয়েটা কেমন আছে । এই প্যাকটা ওকে দিয়ে দিও । ভেবে ছিলাম কারো কাছে দিয়ে দিবো , তোমাকে পেলাম তাই ভাবলাম তোমার কাছেই দিয়ে দেই বলেই একটা প্যাকেট রুপন্তী রহমান এর দিকে এগিয়ে দেয়।
কাব্য এবং কেয়া এতক্ষণ ধরে সবকিছু খেয়াল করছিল। চারুর দাদুমনি সেখানে থেকে চলে যেতেই কেয়া ওর আম্মুর কাছে গিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে,,
~ আম্মু এসব কি। এই মহিলা টা সবকিছু আমাদের কাছে দেয় কেন। নিজে দিয়ে আসতে পারে না।
কেয়ার কথা শোনামাত্র রুপন্তী রহমান রাগী কন্ঠে বলে,,
~ভদ্রভাবে কথাগুলো। উনি তোমার বয়সে বড় । দিন দিন কি সব ভদ্রতা সভ্যতা ভুলে গেছো ।
মায়ের কথা শুনে কেয়া চুপ হয়ে যায়। তাদের প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র কেনার শেষে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
চারুর জিনিসপত্র গুলো তাকে দিয়ে দেওয়া হয়। শাড়িটা তার মামী মুনি আর কিছু জিনিসপত্র তার দাদু মনির দেওয়া এটা সে জানলেও কাব্য যে তার জন্য পছন্দ করে শাড়িটা নিয়েছিল এটা তার অগোচরেই রয়ে গেল।
0 Comments