Ad Code

মুহূর্ত

লেখিকাঃ সাদিয়া আকতার

সেদিন মায়ের ডাকে তড়িঘড়ি আড়মোড়া ভেঙে উঠে নিজেকে পরিপাটি করে তৈরি যায় ফাহিম। ঘুমের রেশ যেন কাটতেই চাইছে না চোখ থেকে। গতরাতে মামাতো বোনের বিয়ে ছিল, আড্ডাবাজি করে বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। পরিণতি স্বরূপ হাই তুলতে তুলতে মা'কে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পরে। মা অবশ্য বলেছিলেন আর ক'টা দিন থেকে যেতে কিন্তু ফাহিম কাজের অজুহাত দেখিয়ে চলে যেতে চায়। ফাহিমের এখন বাড়ি আসা মানে মায়ের সেই আদর ভালবাসার রূপের চেয়ে ঘটক রূপের অধিক সাক্ষাৎ পাওয়া। ফাহিমও বড্ড কৌশলের সাথে মা'কে প্রতিবার নিজের অজুহাত গুলো ভিন্ন রূপে তুলে ধরে। এসব ভেবে খানিক আপন মনে হেসে দেয় ফাহিম।
" যাবেন নাকি মামা?...." রিক্সা ওয়ালার ডাকে ভাবনার জগৎ ছেড়ে সামনে তাকায় ফাহিম। ভাড়া মিটিয়ে বাস স্ট্যান্ডে যাওয়ার জন্য চড়ে বসে রিক্সায়।
কোলাহল বিহীন ভোরের স্নিগ্ধতা আর নির্মল বায়ুতে মনের ভেতর অনাবিল প্রশান্তি বয়ে যায় ফাহিমের। রাস্তার মধ্য বরাবর সারি সারি ফুল গাছ, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বিভিন্ন নকশার আলোর খুঁটি, চারিপার্শ্বের পরিচ্ছন্নতা দেখে নিজের জেলা কে নিয়ে বেশ গর্ব হয় ফাহিমের। ঢাকায় গেলে রাজশাহীর এই পরিচ্ছন্ন সবুজে ঘেরা শহরের পরিবেশ তাকে খুব টানে। সেখানে যান্ত্রিক জীবনে কৃত্তিমত্তায় সবার দিন কেটে যায়, মনের প্রশান্তির জন্য প্রয়োজন হয় রিসোর্ট কিম্বা কোন আর্টিফিশিয়াল সজ্জায় সজ্জিত রেস্টুরেন্ট।
" চলে আসছি...... পনোরো টাকা মামা...." বলে রিক্সাওয়ালা।
ফাহিম মানিব্যাগ থেকে এক'শ টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে কিছু একটা ভেবে বলে " পুরো টাই রাখেন মামা!..... দোয়া করেন... "
কাউন্টারের সামনে থেকে ঢাকা গামী কোচে ওঠে পরে ফাহিম। সিট নাম্বার (B - 1) মিলিয়ে বসে যায়। জানালার পাশে সিট পাওয়ার অনুভব টা একটু আলাদা।
ঘড়িতে যখন ঠিক ৬.৩০ বাস স্টার্ট দিয়ে ধীর ধীরে চলা শুরু হয়। ফাহিম তার মা কে কল দিয়ে আরেক বার বিদায় জানায়। কল কেটে কিছুটা আনমনে পাশের খালি সিটের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে এবারের ছ'ঘন্টার যাত্রা পথ তাকে একলা পাড়ি দিতে হবে। তবে তার ভাবনায় গুড়ে বালি ছিটিয়ে মিনিট পনেরো পর ভদ্রা বাস কাউন্টার থেকে ওঠে তার সহ যাত্রী।
ফাহিম খেয়াল একটি মেয়ে ইতস্তত করে তার সিটের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আপাদমস্তক মেয়েটিকে একবার দেখে ফাহিম বুঝে যায় সেই তার কাঙ্খিত সহযাত্রী। এক মুহূর্ত কিছু ভেবে ফাহিম নিজের সিট ছেড়ে মেয়েটিকে বলে " আপনি উইন্ডো সিটে বসেন!!.... আমি এটাতে বসছি..... "
জবাবে মেয়েটি শুধু এক গাল হাসি দেয়।
মনের অজান্তে ফাহিমের ওষ্ঠ ধরেও ঈষৎ হাসির রেখা স্পষ্ট হয়। কিছুটা পথ দুজনেই চুপচাপ দৃষ্টি বিনিময় করে পাড়ি দেয়।
ফাহিম প্রথম জড়তা নিয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে " ঢাকায় কোন কাজে যাচ্ছেন?.... "
সামান্য হেসে মেয়েটি জবাব দেয় " কাজ না... ঘুরতে যাচ্ছি.... মামার বাসায়....."
: ওহ!... আমারও মামাতো বোনের বিয়ে ছিলো.... গতকালই...
: হুম...
: পড়াশোনা?...
: রাজশাহী কলেজে... অনার্স সেকেন্ড ইয়ার....
: হুম্মম....
আবারো কিছু পথ নিরবে কেটে যায়। ফাহিম আড় চোখে মেয়েটিকে আরো একবার দেখে। একটা মায়া ভাব মেয়েটির চেহারায়। সে শুনেছে মেয়েরা নাকি গোলাপি রঙ বেশি পছন্দ করে তবে এই অপরিচিতাকে বেগুনি রঙ্গেও দারুন মানিয়েছে। ফাহিম যখন এত শত ভেবে মিটি মিটি হাসছিল মেয়েটি হঠাৎ তার দিকে তাকায়। চোখাচোখি হতে লাজুক হাসি দিয়ে একটু নড়েচড়ে বসে ফাহিম।
এবার মেয়েটি জিজ্ঞেস করে " ঢাকায় যাওয়ার কারণ.... "
মাথা নিচু করে ফাহিম জবাব দেয় " জব করি... গার্মেন্টস টেকনোলজিস্ট... "
: ইম্প্রেসিভ!!....
ফাহিম একটু মজা করে বলে " কাউরে ইমপ্রেস করতে পারিনি...…"
মুচকি এসে মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে বলে " কেন?..."
ফাহিম বিজ্ঞ ব্যক্তিদের মত গুরু গম্ভীর স্বরে বলে " চিন্তাধারায় মিল হয় না.... এখন প্রায় সবার ধারণা... সম্পর্কে মনোমালিন্য হলে আরেকজনের অপশন বেছে নেওয়া.... "
মেয়েটি সামান্য দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে " এই অভিযোগ কিন্তু আমাদেরও.... সত্যি বলতে ছেড়ে যাওয়াটা কোন একতরফা ব্যাপার নয়.... কখনো ছেলেরাও তীব্র আঘাত দিয়ে চলে যায়..... "
ফাহিম কিঞ্চিত ভ্রু কুঞ্জন করে বলে " এক্সপেরিয়েন্স আছে নাকি?!!..... "
: না!... তবে ভয় পাই...
: হুম্মম.... সম্পর্ক নিয়ে আপনার ওপেনিয়ন কি??....
: সত্য বলা... তাহলে বিশ্বাস'টা অটুট থাকে... আর এই বিশ্বাসের জন্যই নিজেদের মধ্যে কেয়ারিং ভাবটা আপনা আপনি চলে আসে.....
মেয়েটি যখন এ কথাগুলো বলছিল ফাহিম মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে এক মনে তাকিয়ে থাকে। জবাবে সে বলে " আমারও ঠিক সেম ওপেনিয়ন!!!....."
এবার তাদের ভাবটা একটু গাঢ় হয়। সম্পর্কের সূত্র ধরে গল্পের লাইনটা কখন যেন একজন আরেকজনের বাড়িতে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথায় এসে শেষ হয়। মৃদ্যু হাসি মজায় নিজেদের পছন্দ-অপছন্দর কথাগুলো বলা হয়ে যায়।
সিরাজগঞ্জে পৌঁছে যাত্রাপথের বিরতি ঘোষণা করে বাস এসে থামে ফুড ভিলেজ রেস্তোরার সামনে।
ফাহিম মেয়েটিকে সাথে করে রেস্টুরেন্টের ভেতরে যায়। মেয়েটি কিছুক্ষণ এদিক ওদিকে চেয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালে ফাহিম পেছন থেকে ডাক দিয়ে বলে " এই শোনো!!.... তোমার ব্যাগটা আমাকে দিয়ে যাও.... "
ফাহিমের কথায় মেয়েটির ভিমড়ি খাওয়ার অবস্থা। একে তো ফাহিম আনমনে তুমি করে বলেছে এরপর আবার তার ব্যাগ চাচ্ছে। থতমত হয়ে সে বলে " আ... আমার ব্যাগ দিয়ে আপনার কি কাজ?..."
: আমার কোন কাজ নাই... জাস্ট ফ্রি ভাবে যেন যেতে পারো তাই বলছি....
এক মুহূর্ত কিছু ভেবে মুচকি হেসে মেয়েটি বলে " সিসি ক্যামেরা আছে কিন্তু... আর হ্যাঁ... আমার নাম এই না.... সুনেহ্রা!!...."
ফাহিম ঈষৎ হেসে মনে মনে বার কয়েক মেয়েটির নাম আওড়ায়।
সুনেহ্রা কে সাথে নিয়ে একটা টেবিলে বসে কিছু খাবার অর্ডার করে ফাহিম যদিও সে বারবার আপত্তি তুলছিল খাবার নিয়ে এসেছে বিধায়। কিন্তু ফাহিমের জোরাজোরিতে অবশেষে মানতে বাধ্য হয়।
খাবারের পর্ব চুকিয়ে বের হওয়ার সময় ফাহিম সুনেহ্রা কে বলে " হিমসর খাবে??... "
: উম্ম??.... হিমসর?!!... কিঞ্চিত ভ্রু কুটি করে সুনেহ্রা জিজ্ঞেস করে।
ফাহিম কিছুটা শব্দ করে হেসে বলে " মিস সুনেহ্রা!!... আপনি কি আইসক্রিম খাবেন?..."
আইসক্রিমের যে বাংলা অর্থ হিমসর এটা সুনেহ্রার জানা ছিল না। লাজুক হেসে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়।
বাস তখন যমুনা সেতু পাড়ি দিচ্ছিলো ফাহিম সুনেহ্রা কে ছোট্ট একটা ভিডিও করে দেয়। এভাবে ধীরে ধীরে তাদের মাঝে বেশ ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। যদিও ফাহিম লক্ষ্য করেছে মেয়েটির চোখের চাউনি হয়তো না বলা কোন কথার আভাস দিচ্ছে বারবার।
বাস তখন সাভার।
হঠাৎ বিকট এক শব্দ ফাহিমের কানে আসে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে অনুভব করে মাথায় প্রচন্ড জোরে আঘাত পেয়েছে কোথাও যেন তার পা ভীষণ চাপে আটকা পরে সে উল্টোভাবে ঝুলছে।
এতক্ষণে সম্বিত ফিরে পায় ফাহিম সে বুঝতে পারে তাদের বাস এক্সিডেন্ট করে উল্টে গেছে। চারিদিক থেকে মানুষের চিৎকার হাহাকার ভেসে আসছে। খানিক বাদে ফাহিমের স্মরণ হয় সুনেহ্রার কথা। কোনমতে মাথা তুলে পাশে তাকিয়ে দেখতে পায় তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করছে মেয়েটি। ফাহিম যেই সুনেহ্রা কে আগলে নিতে যাবে তৎক্ষণাৎ সে লক্ষ্য করে একটি রড তার পেটে গেঁথে গেছে।
ফাহিম নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। অশ্রুসজল চোখে চিৎকার করে ডাকতে থাকে " কেউ কি আছেন আমাদের এদিকে একটু আসেন..... এক যাত্রীর অবস্থা ভীষণ খারাপ!!!...."
ফাহিমের কথায় অসহ্য যন্ত্রণায়ও মেয়েটি সামান্য হেসে ফাহিমের দিকে তার রক্তমাখা হাত বাড়িয়ে বলে " তো....তোমার কপাল থেকে রক্ত বের হচ্ছে....নি...নিজেকে আগে সামলাও... আ... আমার জীবনের এটাই শ.. শেষ মুহূর্ত!!........ "
: না... না... সুনেহ্রা... ক.. কিচ্ছু হবে না তোমার... আমি হসপিটালে নিয়ে যাবো তোমাকে....
: সে সময়... হয়তো তোমাকে দিতে পারবো না.....
: এসব বলোনা.... তুমি জানো না আমার তোমাকে....
: থামলে কেন... শেষ সময়ে বলে যাও না.... আমাকে ভালো.....
: হুম্মম্মম.... অনেক.....
সুনেহ্রা সেদিন ফাহিমের বলা কথা শুনতে পেয়েছিলো কিনা অনুমান করা যায় না। কারণ ততক্ষণে তার যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা চোখ দুটো বুজে গেছে। কিছুক্ষণ আগেও যে মুখে ছিল ভুবন মোহিনী হাসির রেখা।
দু'বছর পর......
অতীতের এসব কথা ভেবে অশ্রু সজল চোখে সুনেহ্রার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে তার জন্য মনভরে দোয়া করছিল ফাহিম।
হ্যাঁ,,,,,সেদিনের বাস দুর্ঘটনায় সুনেহ্রা ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে চলে যায়। তবে ফাহিম আজও ভুলতে পারেনি তাকে।
নতুন করে জীবন সাজানোর কথা বললে ফাহিম বলে,,,,,
" জীবনে কার সাথে কত সময় পার করা হয় এটার থেকেও...... কার সাথে কোন মুহূর্ত পার করা হয় সেটাই গুরুত্বপূর্ণ........... "
( গল্প টি আপনার কেমন লাগছে কিংবা এর প্লটের কোন ভুল ত্রুটি থাকলে কমেন্ট বক্সে জানানোর অনুরোধ রইলো)

Post a Comment

0 Comments

Close Menu