"শুনছো!" আমার ডাকে পিছনে ফিরে তাকালো প্রিয়ন্ত। তারপর বলল,
"কিছু বলবে?"
আমি একটু থেমে বললাম, "হুম। আসলে........"
"যা বলার তাড়াতাড়ি বলো আমার অফিসের লেট হয়ে যাচ্ছে", তাড়াহুড়ো
করে হাতের ঘড়ি পড়তে পড়তে বলল প্রিয়ন্ত।
আমি বললাম, "থাক তাহলে অন্য আরেক দিন বলবো। তুমি অফিসে যাও।"
প্রিয়ন্ত আমার দিকে ঘুরে আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, "কেনো অন্য দিন
কেনো? এখনি বলো।"
"আমার জন্য কাঠগোলাপ আনবে প্রিয়!"
প্রিয়ন্ত আমার কাঁধ ছেড়ে জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে হেসে বলল, "সবাই
তার প্রিয়জনের কাছ থেকে গোলাপ উপহার হিসেবে চায়। আর তুমি চাইছ কাঠগোলাপ! সত্যিই তুমি
অদ্ভুত!"
প্রিয়ন্তের কথা শুনে চমকালাম আমি। খানিকটা মন খারাপও হলো। তবুও মন খারাপ
ভাবটা চেহারায় প্রকাশ না করে বললাম, "আমি অদ্ভুত! হয়তো তোমার কথাই ঠিক, আমি সত্যিই
অদ্ভুত ধরণের মেয়ে।"
প্রিয়ন্ত বলল, "অদ্ভুত বললাম বলে রাগ করলে?"
আমি বললাম, "আরে ধুর। রাগের কি আছে! তুমি কি রাগ করবার মতো কিছু বলেছ
যে আমি রাগ করবো?"
"না, ঠিক তা নয়। আমি ভাবলাম তুমি হয়তো রাগ করেছ। আচ্ছা যাই হোক। আমি
আসি। সাবধানে থেকো।"
"তুমিও সাবধানে যেও," ওর চলা পথের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম আমি।
প্রিয়ন্তের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে এক বছর হতে চললো। কিন্তু এই এক বছরেও
মানুষটাকে ঠিকঠাক চিনে উঠতে পারলাম না। মানুষটা কখনো ভালো তো, কখনো কখনো মনে হয় উনি
বোধ হয় অনুভূতিহীন কোনো মানব। যার কাছে আমার অনুভূতিগুলো নিতান্তই বাচ্চামো আর হাস্যকর
ঠেকে। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ আবেগী আমি। মায়ের অতি আদরে, বাবার প্রশ্রয় আর ভাইয়ের যত্নে
বড় হওয়া মেয়ে কোনোদিন কষ্ট কি জিনিস তা বুঝতেই পারিনি! মা বলতেন, সোনায় মুড়ে মানুষ
করছি আমি তোকে। তারপর যে তোর কি হবে!
তখন মায়ের কথায় ততোটা পাত্তা দেইনি। কিন্তু আজ নিজে কারোর স্ত্রী, কারোর
ছেলের বউ, কারোর ভাবি, কারোর চাচি-মামি হয়ে বুঝেছি আসলে মানিয়ে নেওয়া কি জিনিস! আজ
এ দিনে না আসলে বুঝতেই পারতাম না যে একজন মেয়ে তার গোটা জীবনে ঠিক কতোটা ত্যাগ করতে
পারে। ত্যাগ কম আর বেশি সব মেয়েকেই করতে হয়। আমার মাকেও হয়েছে, আমাকেও করতে হচ্ছে আর
ভবিষ্যতে আমার মেয়েকেও করতে হবে। মেয়েদের পুরো জীবনটাই যে অন্যের জন্য! তারা কেবল অন্যের
জন্য ত্যাগ করে যাবে কিন্তু দিন শেষে তাদের চোখের জল, এতোটুকু ক্লান্তি দূর করার জন্য
কেউ নেই।
শাশুড়ির উচ্চশব্দে আমার ভাবনার সুতো কাটলো। উনি বলতে লাগলেন, "বলি,
সারাদিন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে? কাজ-কর্ম কি সব সিঁকেয় তুলেছ নাকি, হ্যাঁ? আজ
আবার আমার মেয়েটা এতোদিন পর আসবে। ভালো-মন্দ রান্না করতে হবে না? যাও গিয়ে দুপুরের
খাবারের আয়োজন করো। তাড়াতাড়ি যাও। দেরি করো না যেন!"
আমি রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলাম। উনি তখনও পিছন থেকে চিৎকার করতে থাকলেন,
"উফ আমার হয়েছে যতো জ্বালা। ছেলের বউ ঘরে এনেছি। তাকে দিয়ে একটা কাজ যদি ঠিকমতো
করানো যায়।"
কিন্তু অদ্ভুতভাবে ভাইয়া দুষ্টুমি করে মার দিলেও কখনো আমার উপর রাগ করতো
না। আমাদের পরিবারটা মধ্যবিত্ত হলেও সুখের কোনো কমতি ছিল না। আজ খুব মনে পড়ছে ওদের
সবাইকে। কতোদিন হয়ে গেলো নিজের বাবা-মায়ের কাছে যাই না!
সন্ধ্যার পর আজ প্রিয়ন্ত অন্যান্য দিনের তুলনায় তাড়াতাড়িই বাসায় ফিরলো।
আমি সারাদিন কাজ কর্ম করে অনেকটাই ক্লান্ত। আমি চুপচাপ ঘরের বাতি নিভিয়ে শুয়ে ছিলাম।
প্রিয়ন্ত আলতো হাতে আমার মাথায় হাত ছোঁয়াতেই উনার শীতল স্পর্শে আমার সারাদিনের সব ক্লান্তি,
অবসাদ এক নিমিষেই দূর হয়ে গেলো। আমি চোখ পিটপিট করে একবার উনার দিকে তাকালাম। তারপর
আবার অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। বললাম, "তুমি কখন এলে?"
সে বলল, "এইতো মাত্রই। তোমার কি শরীর খারাপ?"
আমি স্পষ্ট উত্তর দিলাম, "না।"
"তাহলে কি মন খারাপ?"
আমি প্রিয়ন্তর কথা শুনে চমকে উনার দিকে তাকালাম। বললাম, "মেয়েদের
মন খারাপ হতে নেই প্রিয়! মন খারাপ তাদের মানায় না।"
আমার এই ছোট্ট কথায় প্রিয়ন্ত কি বুঝলো কে জানে। প্রিয়ন্ত ছোট একটি দীর্ঘশ্বাস
ফেলে বলল, "আমি যদি ঘরের আলোটা একটু জ্বালাই তাহলে কি তোমার সমস্যা হবে?"
আমি বললাম, "না। আমার এখন আলো ভালো লাগছে না। আলোর চেয়ে অন্ধকারই
বরং অধিক শ্রেয়, চোখে সয়ে যায়।"
প্রিয়ন্ত আর কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। আমি উঠে বসলাম। হাঁটু মুড়ে
মাথাটা কাত করে হাঁটুর উপর রাখলাম। তারপর বিষন্ন চোখে বাইরে তাকালাম।
আজ বাইরে মস্ত এক চাঁদ। তবে কি আজ পূর্ণিমা! বাইরে পূর্ণিমা হলেও আমার
মনে আজ ঘুটঘুটে আমাবস্যা। তাই এই পূর্ণিমাটাও যেন বিষন্ন।
আগে সামান্য কারণে কতোই না কেঁদে কেটে বুক ভাসিয়েছি। বাবা,মা, ভাইয়াকে
জ্বালানোর শাস্তি বুঝি এভাবেই পাচ্ছি! আমার ভাবনার মাঝেই প্রিয়ন্ত ঘরে প্রবেশ করলো।
তারপর নিঃশব্দে আমার পাশে এসে বসলো। উনাকে এই আঁধারেও চিনতে আমার ভুল হলো না। মানুষটির
নিঃস্বাসের শব্দটাও যে আমার ভীষণ চেনা! প্রিয়ন্ত আমার কানের কাছে কি যেন একটা গুঁজে
দিলো। তারপর হেসে বলল, "এখন আশা করি তোমার আলো জ্বালাতে কোনো সমস্যা নেই!"
এক ফালি চাঁদের আলোতে প্রিয়ন্তের শ্যাম বর্ণের মুখটিকে ভীষণ মায়াবী দেখাচ্ছে।
এই ছেলেটার মুখে এতো মায়া কেনো। সৃষ্টিকর্তা বুঝি সমস্ত মায়া এ ছেলেটির মুখেই ঢেলে
দিয়েছেন! আমাকে এভাবে তাকাতে দেখে মিটিমিটি হাসছে প্রিয়ন্ত। এতে যেন উনার রূপ আরো হাজার
গুণ বেড়ে গেছে।
আমি আমার কানের পিছনে স্পর্শ করে নরম কিছুর ছোঁয়া অনুভব করলাম। আমি আনমনেই
মুখ ফুটে বললাম, "কাঠগোলাপ!"
0 Comments