Ad Code

কাঠগোলাপ পর্ব ১

"শুনছো!" আমার ডাকে পিছনে ফিরে তাকালো প্রিয়ন্ত। তারপর বলল, "কিছু বলবে?"

আমি একটু থেমে বললাম, "হুম। আসলে........"

"যা বলার তাড়াতাড়ি বলো আমার অফিসের লেট হয়ে যাচ্ছে", তাড়াহুড়ো করে হাতের ঘড়ি পড়তে পড়তে বলল প্রিয়ন্ত।

আমি বললাম, "থাক তাহলে অন্য আরেক দিন বলবো। তুমি অফিসে যাও।"

প্রিয়ন্ত আমার দিকে ঘুরে আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, "কেনো অন্য দিন কেনো? এখনি বলো।"

"আমার জন্য কাঠগোলাপ আনবে প্রিয়!"

প্রিয়ন্ত আমার কাঁধ ছেড়ে জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে হেসে বলল, "সবাই তার প্রিয়জনের কাছ থেকে গোলাপ উপহার হিসেবে চায়। আর তুমি চাইছ কাঠগোলাপ! সত্যিই তুমি অদ্ভুত!"

প্রিয়ন্তের কথা শুনে চমকালাম আমি। খানিকটা মন খারাপও হলো। তবুও মন খারাপ ভাবটা চেহারায় প্রকাশ না করে বললাম, "আমি অদ্ভুত! হয়তো তোমার কথাই ঠিক, আমি সত্যিই অদ্ভুত ধরণের মেয়ে।"

প্রিয়ন্ত বলল, "অদ্ভুত বললাম বলে রাগ করলে?"

আমি বললাম, "আরে ধুর। রাগের কি আছে! তুমি কি রাগ করবার মতো কিছু বলেছ যে আমি রাগ করবো?"

"না, ঠিক তা নয়। আমি ভাবলাম তুমি হয়তো রাগ করেছ। আচ্ছা যাই হোক। আমি আসি। সাবধানে থেকো।"

"তুমিও সাবধানে যেও," ওর চলা পথের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম আমি।

Facebook

প্রিয়ন্তের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে এক বছর হতে চললো। কিন্তু এই এক বছরেও মানুষটাকে ঠিকঠাক চিনে উঠতে পারলাম না। মানুষটা কখনো ভালো তো, কখনো কখনো মনে হয় উনি বোধ হয় অনুভূতিহীন কোনো মানব। যার কাছে আমার অনুভূতিগুলো নিতান্তই বাচ্চামো আর হাস্যকর ঠেকে। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ আবেগী আমি। মায়ের অতি আদরে, বাবার প্রশ্রয় আর ভাইয়ের যত্নে বড় হওয়া মেয়ে কোনোদিন কষ্ট কি জিনিস তা বুঝতেই পারিনি! মা বলতেন, সোনায় মুড়ে মানুষ করছি আমি তোকে। তারপর যে তোর কি হবে! 

তখন মায়ের কথায় ততোটা পাত্তা দেইনি। কিন্তু আজ নিজে কারোর স্ত্রী, কারোর ছেলের বউ, কারোর ভাবি, কারোর চাচি-মামি হয়ে বুঝেছি আসলে মানিয়ে নেওয়া কি জিনিস! আজ এ দিনে না আসলে বুঝতেই পারতাম না যে একজন মেয়ে তার গোটা জীবনে ঠিক কতোটা ত্যাগ করতে পারে। ত্যাগ কম আর বেশি সব মেয়েকেই করতে হয়। আমার মাকেও হয়েছে, আমাকেও করতে হচ্ছে আর ভবিষ্যতে আমার মেয়েকেও করতে হবে। মেয়েদের পুরো জীবনটাই যে অন্যের জন্য! তারা কেবল অন্যের জন্য ত্যাগ করে যাবে কিন্তু দিন শেষে তাদের চোখের জল, এতোটুকু ক্লান্তি দূর করার জন্য কেউ নেই।

YouTube

এইতো সেবার আমার ভয়াবহ জ্বর হলো। জীবনে প্রথম বাবা-মায়ের থেকে এতোটা দূরে। আগে অসুখের সময় বাবা থাকতেন মাথার পাশে আর মা রাত জেগে সেবা করতেন। প্রিয়ন্ত তখন সারাদিন অফিস করে রাতে আমার দেখাশুনা করেছে। আমার কাজগুলোও করে দিয়েছে। এসমস্ত দেখে আমার শাশুড়ী আমাকে নানান রকম কথা শোনাতে লাগলেন। আমি কেমন বউ। বউ হয়ে স্বামীকে দিয়ে কাজ করাই আরো কতো কি! আমি কখনো প্রিয়ন্তের কাছে এসব নিয়ে অভিযোগ করতাম না। শুধু নীরবে সব হজম করতাম আর কাজ শেষ করে সারা দুপুর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতাম। এমনকি মাকে অব্দি বলতে পারি নি সেসব। বাবা-মা এসব শুনলে কষ্ট পাবেন। 
আমি কতো আদরের মেয়ে তাদের। ভাইয়া তো এসব জানলে আমাকে এক মুহূর্তের জন্যেও এখানে রাখবে না। কিন্তু আমি যে প্রিয়ন্তকে এ কদিনে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি। আমি কি করে থাকবো উনাকে ছাড়া! আমি আজও জানি না সে আমাকে ভালোবাসে কিনা। কিন্তু আমি যে প্রিয়ন্তকে কতোটা চাই, তা হয়তো তাকে কোনোদিনই বলতে পারবো না। আমি বরাবরই ভীষণ চাপা স্বভাবের। আমি আমার ভবিষ্যতের স্বামীর জন্য অনেক আবেগ, অনেক মুহূর্ত জমা করে রেখেছিলাম। তাই কখনো প্রেম করাও হয়ে উঠে নি। অনার্স শেষ করার পর বাবা যখন তার পছন্দ করা ছেলের সাথে বিয়ের জন্য বলল তখন আমার রাজি না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। প্রিয়ন্ত দেখতে অতোটা ফর্সা না হলেও শ্যামলা রঙে মায়াবী মুখের গড়ন। ছেলে দেখতে লম্বা, চওড়া, ভালো জব করে ব্যস বাবা-মায়ের পছন্দের আর কি লাগে! হয়ে গেলো বিয়ে। এরপর একটু একটু করে প্রিয়ন্তকে বোঝার চেষ্টা করেছি। মা বলতেন সংসার করতে হলে আগে একে অপরের পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে জানতে হয়। আমি উনার সব পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারে জেনেছি। তবুও বোধ করি মানুষটার মন আজও বুঝে উঠতে পারলাম না! মানুষটাই যে এমন, রহস্যে ঘেরা! সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে প্রিয়ন্ত নিজ হাতে আমার প্রত্যেকটি কাজে সাহায্য করে। এতেও আমার শাশুড়ির ভীষণ অসুবিধে। ছেলের সামনে কিছু বলার সাহস না হলেও আড়ালে আবডালে আমাকে ঠিকই কথা শোনাতে ছাড়েন না। 

শাশুড়ির উচ্চশব্দে আমার ভাবনার সুতো কাটলো। উনি বলতে লাগলেন, "বলি, সারাদিন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে? কাজ-কর্ম কি সব সিঁকেয় তুলেছ নাকি, হ্যাঁ? আজ আবার আমার মেয়েটা এতোদিন পর আসবে। ভালো-মন্দ রান্না করতে হবে না? যাও গিয়ে দুপুরের খাবারের আয়োজন করো। তাড়াতাড়ি যাও। দেরি করো না যেন!"

আমি রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলাম। উনি তখনও পিছন থেকে চিৎকার করতে থাকলেন, "উফ আমার হয়েছে যতো জ্বালা। ছেলের বউ ঘরে এনেছি। তাকে দিয়ে একটা কাজ যদি ঠিকমতো করানো যায়।"

আমি শাশুড়ির কথায় পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজ করতে লাগলাম। খুব ইচ্ছে করছে মুখের উপর কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু মায়ের নিষেধ, বড়রা একটু আকটু বকাঝকা করবেনই। পরে আবার রাগ কমলে কাছে টেনে নেন। কখনো তাদের সাথে খারাপ আচরণ বা বেয়াদবি করা যাবে না। কিন্তু আমি বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে আমার শাশুড়িকে শুধু শাসন করতেই দেখেছি, ভালোবাসতে কখনো দেখিনি! যেন আমার সাথে ভালো করে কথা বলতেও অনেক কষ্ট হয় তার। দু'দিন অন্তর অন্তর আমার ননদ তার বাচ্চাদের নিয়ে এ বাড়িতে আসে। আর আসলে সপ্তাহখানিক তো থেকেই যায়। আবার কখনো বা মাসও গড়ায়। তবুও অনেকদিন পর সে এ বাড়িতে কিভাবে এলো সেটাই বোধগম্য হলো না আমার! যতোদিন আমার ননদ এ বাড়িতে থাকে ততদিন 
যেন আমার শাশুড়ির অত্যাচারের মাত্রা আরো দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পায়। আমার ননদ মুখে মুখে তার মাকে এসব করতে নিষেধ করলেও সুযোগ পেলে সেও কটুক্তি করতে দ্বিধা করে না। আগে এসবে অনেক কষ্ট হতো, ভীষণ খারাপ লাগতো, কান্না পেতো খুব। কিন্তু এখন এগুলো অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এগুলো এখন আর তেমন গায়ে লাগে না। আমার হঠাৎ মনে হলো মেয়েদের আসলে মন খারাপ বলে কিছু থাকতে নেই। এই যে আমাকে শত মন খারাপের মাঝেও শাশুড়ির কথা হজম করে সব কাজ করতে হচ্ছে। এরপর ননদ, নন্দাই এলে তাদের সামনে মুখে একটা প্লাস্টিক হাসি ঝুলিয়ে তাদেরকে আপ্যায়ন করতে হবে। এসবের মাঝে মন খারাপের সময় কই! আগে সামান্য মন খারাপ হলেই না খেয়ে দরজা লাগিয়ে রাখতাম। মা ভাতের থালা হাতে দরজা ধাক্কা দিতে দিতে যখন ক্লান্ত হয়ে যেতেন তখন আমাকে বকাঝকা করে ফিরে যেতেন। এরপর বাবার ওই এক মামণি ডাকেই দরজা খুলে বেরিয়ে আসতাম। তারপর গাল ফুলিয়ে বাবার কাছে মায়ের নামে অভিযোগের ঝুড়ি নিয়ে বসতাম। বাবাও হাসি মুখে সেসব শুনতেন আর কথার খেয়ালে খেয়ালে কখন যে আমাকে দিয়ে ভাতের পুরো থালাটা খালি করে দিতেন টেরই পেতাম না! বাবা বোধ হয় ম্যাজিক জানতেন। এরপর ভাইয়াকে কারণে অকারণে জ্বালানো, বিরক্ত করা। রাত নেই, দিন নেই ভাইয়ার কাছে শুধু আবদার আর আবদার। 

কিন্তু অদ্ভুতভাবে ভাইয়া দুষ্টুমি করে মার দিলেও কখনো আমার উপর রাগ করতো না। আমাদের পরিবারটা মধ্যবিত্ত হলেও সুখের কোনো কমতি ছিল না। আজ খুব মনে পড়ছে ওদের সবাইকে। কতোদিন হয়ে গেলো নিজের বাবা-মায়ের কাছে যাই না!

সন্ধ্যার পর আজ প্রিয়ন্ত অন্যান্য দিনের তুলনায় তাড়াতাড়িই বাসায় ফিরলো। আমি সারাদিন কাজ কর্ম করে অনেকটাই ক্লান্ত। আমি চুপচাপ ঘরের বাতি নিভিয়ে শুয়ে ছিলাম। প্রিয়ন্ত আলতো হাতে আমার মাথায় হাত ছোঁয়াতেই উনার শীতল স্পর্শে আমার সারাদিনের সব ক্লান্তি, অবসাদ এক নিমিষেই দূর হয়ে গেলো। আমি চোখ পিটপিট করে একবার উনার দিকে তাকালাম। তারপর আবার অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। বললাম, "তুমি কখন এলে?"

সে বলল, "এইতো মাত্রই। তোমার কি শরীর খারাপ?"

আমি স্পষ্ট উত্তর দিলাম, "না।"

"তাহলে কি মন খারাপ?"

আমি প্রিয়ন্তর কথা শুনে চমকে উনার দিকে তাকালাম। বললাম, "মেয়েদের মন খারাপ হতে নেই প্রিয়! মন খারাপ তাদের মানায় না।"

আমার এই ছোট্ট কথায় প্রিয়ন্ত কি বুঝলো কে জানে। প্রিয়ন্ত ছোট একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "আমি যদি ঘরের আলোটা একটু জ্বালাই তাহলে কি তোমার সমস্যা হবে?"

আমি বললাম, "না। আমার এখন আলো ভালো লাগছে না। আলোর চেয়ে অন্ধকারই বরং অধিক শ্রেয়, চোখে সয়ে যায়।"

প্রিয়ন্ত আর কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। আমি উঠে বসলাম। হাঁটু মুড়ে মাথাটা কাত করে হাঁটুর উপর রাখলাম। তারপর বিষন্ন চোখে বাইরে তাকালাম।

Instagram

আজ বাইরে মস্ত এক চাঁদ। তবে কি আজ পূর্ণিমা! বাইরে পূর্ণিমা হলেও আমার মনে আজ ঘুটঘুটে আমাবস্যা। তাই এই পূর্ণিমাটাও যেন বিষন্ন।

আমার ইচ্ছে ছিল বিয়ের পর নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে প্রিয় বলে সম্বোধন করবো। কিন্তু সে কি সত্যিই আমার প্রিয় মানুষ হতে পেরেছে! কি জানি। এই প্রশ্নটা আমার আজও অজানা। আজও অব্দি নিজের প্রিয় মানুষটির মনের কথা জানতে পারলাম না। তার মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটিও আর শোনা হলো না! হঠাৎ অনুভব করলাম চোখটা জ্বলছে খুব। কিন্তু কি আশ্চর্য কান্নাটা যেন গলায় আটকে গেছে। আজকাল কান্নাটাও আর যখন তখন আসে না! 

আগে সামান্য কারণে কতোই না কেঁদে কেটে বুক ভাসিয়েছি। বাবা,মা, ভাইয়াকে জ্বালানোর শাস্তি বুঝি এভাবেই পাচ্ছি! আমার ভাবনার মাঝেই প্রিয়ন্ত ঘরে প্রবেশ করলো। তারপর নিঃশব্দে আমার পাশে এসে বসলো। উনাকে এই আঁধারেও চিনতে আমার ভুল হলো না। মানুষটির নিঃস্বাসের শব্দটাও যে আমার ভীষণ চেনা! প্রিয়ন্ত আমার কানের কাছে কি যেন একটা গুঁজে দিলো। তারপর হেসে বলল, "এখন আশা করি তোমার আলো জ্বালাতে কোনো সমস্যা নেই!"

WhatsApp

এক ফালি চাঁদের আলোতে প্রিয়ন্তের শ্যাম বর্ণের মুখটিকে ভীষণ মায়াবী দেখাচ্ছে। এই ছেলেটার মুখে এতো মায়া কেনো। সৃষ্টিকর্তা বুঝি সমস্ত মায়া এ ছেলেটির মুখেই ঢেলে দিয়েছেন! আমাকে এভাবে তাকাতে দেখে মিটিমিটি হাসছে প্রিয়ন্ত। এতে যেন উনার রূপ আরো হাজার গুণ বেড়ে গেছে।

আমি আমার কানের পিছনে স্পর্শ করে নরম কিছুর ছোঁয়া অনুভব করলাম। আমি আনমনেই মুখ ফুটে বললাম, "কাঠগোলাপ!"



Post a Comment

0 Comments

Close Menu