লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা


কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।


*
*
সিআইডি বিউরোর নির্জন কক্ষে কালো ছায়ার আচ্ছাদনে নিস্তব্ধ চেয়ারে দণ্ডায়মান কুদ্দুস আলী। কক্ষের প্রখর আলোতে মুখাবয়বটি বিবর্ণ। সামনের কেমেরার লেন্স নিষ্পলক সাক্ষী হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। অপর প্রান্তে দাঁতপিষা সংযমে মুগ্ধ, ক্রোধ সংবরণে মুখাবয়ব শান্ত অথচ কঠিন। রুদ্র আর মহুয়া অবিচল দাঁড়িয়ে, তদন্তের গ্রন্থি উন্মোচনের প্রতীক্ষায়।
মুগ্ধের কণ্ঠস্বর স্থির, তবু গভীরতাসম্পন্ন যে অনিচ্ছুক হৃৎপিণ্ড কেঁপে ওঠে,
——— "নিন, এবার বিবৃত করুন। এতগুলো প্রলয়কাণ্ডের র'ক্তপিণ্ড কেন আপনার হাতে লেপন হলো?"
কুদ্দুস আলীর কপাল ঘামে ভিজে ওঠে, চোয়াল শক্ত হলেও মুকুলিত স্বরে সে বলে ওঠে,
———" আ-আমি… খু-খু'ন করিনি…!!
মুগ্ধ অস্ত্রশস্ত্রের ভারী শীতলতা তুলে রাখে টেবিলে, ধাতব ঝংকারে কক্ষের মৌনতাকে টুকরো টুকরো করে। সে পুনরায় বলল, কণ্ঠস্বর শীতল ও শূন্যতার গভীরে রুদ্র মেঘের বজ্রধ্বনি বহনকারী,
——— "দ্বিতীয় বার প্রশ্ন করব না। সত্য উচ্চারণ করুন।"
কুদ্দুস আলী, আতঙ্কে মুমূর্ষুপ্রায়, শরীরের কাঁপুনি দমাতে ব্যর্থ হয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে স্বীকারোক্তি করে,
——— "আমি... আমি বড় ভাইয়ের আদেশে... বুড়োকে হ'ত্যা করেছিলাম। আমি আর কিছু জানি না, শপথ করে বলছি।"
মহুয়া কঠোর চোখে তার দিকে তাকায়, প্রত্যেকটি শব্দ ধ্বনিতে শূলের মতো বিধে,
——— "বোকামি বা মিথ্যা বয়ান নয়। কীরূপে এ হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন করলেন, বিস্তারিত বর্ণনা করুন।"
কুদ্দুস আলীর কণ্ঠে আতঙ্কের কম্পন, শব্দগুলো বোঝার ভারে নতজানু হয়ে বেরোচ্ছে,
———," সেদিন, বিবাহের দাওয়াতে আতিথ্যের চূড়ান্ত পর্ব শেষ করে রাতের অন্ধকারে বাড়ি ফেরার সময়, ভাই হঠাৎ নির্দেশ দিল—ঐ বৃদ্ধকে মুছে ফেলতে হবে! কারণ, সেই বুড়ো নাকি আমাদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমি সাহস করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাইলে, ভাই এক কঠিন ধমক দিয়ে আমার প্রশ্নকে শিকলে বেঁধে থামিয়ে দেয়। তার আদেশ অমান্য করার সাহস আমার ছিল না।
পরে আমি নীরবে বুড়োর ছায়ার পিছু নিই, যেমন কোনো অন্ধকার শিকারী তার অবুঝ শিকারের সন্ধানে ধেয়ে যায়। বুড়ো যখন নিঃসঙ্গ হলো, আমি মধুর কথার মায়াজালে তাকে বিভ্রান্ত করলাম, প্রলোভনের মোহে তাকে নির্জন প্রান্তরে নিয়ে এলাম। সেখানে আমার হাত, হিং'স্র দানবের মতো, তার শিরায় আঘাত হানল, তাকে নিঃশেষ করে ফেললাম। কিন্তু যখন সেই বুড়ো প্রাণ ত্যাগের মুহূর্তে আমার মুখে থুতু ছুঁড়ে দিল, তখন ক্রোধের ভয়াল দাবানল আমার সত্তা গ্রাস করল। রাগে অন্ধ হয়ে, আমি মৃ'তদেহেও পাষণ্ডের আঘাত চালিয়ে গেলাম, তার অস্তিত্বকেই মাটি থেকে চিরতরে মুছে দিতে চাইলাম..."
কুদ্দুস আলী থেমে গেল, তার কণ্ঠ থমকে যাওয়া শূন্যতার সঙ্গে মিলিয়ে গেল, নিস্তব্ধতা হঠাৎ ভারী হয়ে ঝুলে রইল। রুদ্রের কণ্ঠ কঠোর ও ধারালো হয়ে উঠল, প্রতিটি শব্দ কুদ্দুস আলীর হৃদয়ে ছু'রি চালিয়ে দেয়,
——— "রিতু খালাকে কেন হ'ত্যা করতে চেয়েছিলেন? প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করার জন্য, তাই তো?"
কুদ্দুস আলীর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, রাগে চোখ ধিকিধিকি জ্বলছে। দাঁত কিঁচিয়ে সে বলল,
——— "ও... ওই তো সবসময় আমার পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে চাইত! ভয় দেখিয়ে, ব্ল্যাকমেল করে টাকা আদায় করতে চাইত! প্রতিনিয়ত আমাকে হুমকি দিত! তাই কাল রাতে টাকার লোভ দেখিয়ে তাকে ওখানে ডেকেছিলাম। কিন্তু..."
মুগ্ধর কণ্ঠে বরফের শীতলতা, কথা ছেদ করে বলে উঠল,
——— "কিন্তু আপনি নিশ্চিত না হয়েই চলে গেলেন যে সে মা'রা গিয়েছে। আর তাতেই আমরা গিয়ে তাকে জীবিত উদ্ধার করলাম।
এরপর মুগ্ধের ঠান্ডা ও তীক্ষ্ণ কণ্ঠর বিস্তার কক্ষের আবহে তীব্র উত্তেজনার ঢেউ তুলে দিল,
——— আপনি কি সত্যিই ভেবেছিলেন, মিসেস রিতু আপনার ফাঁদে সহজেই পা দিয়ে আপনার আহ্বান রক্ষা করতে গিয়েছিলেন? না, না! ওটা ছিল আমাদেরই কৌশল, আপনাকে এই মারণ ফাঁদে টেনে আনবার জন্য! তবে মিসেস রিতু, বিশ্বাসঘাতকতার মোহে আক্রান্ত হয়ে, আমাদের অজ্ঞাতে হঠাৎই আপনার সম্মুখে চলে গেলেন। এবং এখন, নিঃসন্দেহে, তার সেই ভুলের জন্যই নিজেকে দুঃখে গ্রাস করছে!
কুদ্দুস আলী নিঃশব্দে বসে রইল, ভয় ও অপরাধবোধের ভারে নত হয়ে। রুদ্র, কঠোরতার শাণিত ধ্বনিতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
———" এবার বলুন, কেন এতগুলো হ'ত্যা করেছেন? নিজের আপন ভাইয়ের জীবন কেড়ে নিলেন কেন? আর আগের সেই চারটি খু'ন? নিশ্চয়ই সেগুলোও আপনার ইঙ্গিতেই সংঘটিত হয়েছিল?"
কুদ্দুস আলীর গলা কম্পমান, আতঙ্কের ছায়ায় আচ্ছন্ন,
——— "না, না! সত্যি বলছি, আমি কিছু জানি না! ঐ খু'নগুলো কে করেছে, কেন করেছে, আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। আমি করিনি, শপথ করে বলছি! বিশ্বাস করুন!"
মহুয়া রাগে ফেটে পড়ে, তার কণ্ঠ কঠিন ও নির্দয়,
——— "আমরা অপরাধীদের কোনো বিশ্বাস করি না!"
মুগ্ধ চুপচাপ, গম্ভীর চোখে গভীর কিছু ভাবতে লাগল। কিছুক্ষণ পর, সে বলল,
——— "কুদ্দুস আলী ঠিকই বলছে। বাকি খু'নগুলো তার হাতে রঞ্জিত নয়!"
রুদ্র আর মহুয়া বিস্ময়ের ঘোরে মুগ্ধের দিকে তাকাল, যেন সময় হঠাৎ থেমে গেছে। রুদ্র তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রতিবাদ করল,
——— "তাহলে রিতুকে কেন মা'রতে চাইলেন? প্রমাণ মুছে ফেলার জন্যই তো, তাই না?"
মুগ্ধ ব্যঙ্গাত্মক হাসল, ঠোঁটের কোণে রহস্যের ছায়া,
——— "প্রমাণ তো নিশ্চয়ই মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন, তবে তা কোনো হ'ত্যাকাণ্ডের প্রমাণ নয়। বরং অন্য কোনো বিষয়, তাই তো, কুদ্দুস আলী?"
কুদ্দুস আলী চোখেমুখে ভয়ের ঘাম মুছতে চেষ্টা করলেন, বুকের স্পন্দন বেড়ে গেল। মহুয়া জিজ্ঞাসা করল,
——— "তাহলে আর কী প্রমাণ আপনি মুছতে চেয়েছিলেন? কী এমন সত্য লুকাতে চেয়েছিলেন?"
কুদ্দুস আলী অসহায় হয়ে মাথা নিচু করলেন, অপরাধের বোঝা কাঁধে চেপে বসেছে। মুগ্ধের ঠান্ডা ও হিমশীতল কণ্ঠ আবার বেজে উঠল, এক খেয়ালি হাসি ফুটিয়ে,
——— "মিসেস রিতু আপনার বড় বোন, তাই তো?"
কুদ্দুস আলী চমকে তাকালেন, চোখে অবিশ্বাস আর আতঙ্কের ছায়া। মুগ্ধ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
——— "আপনার কি মনে হয়? আমরা কেবল আপনাদের বাড়ির সৌন্দর্য দেখতে গিয়েছিলাম? নিন, এবার সমস্ত ঘটনা খুলে বলুন। সবকিছু।"
কুদ্দুস আলী নিমগ্ন স্বরে বললেন,
——— "হ্যাঁ রিতু আমার আপন বোন নয়; তবে র'ক্তের সম্পর্কের মাঝে নির্মম নিষ্ঠুর এক দাগ; সৎ বোন সে আমার।"
মুগ্ধ গভীর কণ্ঠে বলল,
——— "অর্ধেক নয়, পুরোটা বলুন।"
কুদ্দুস আলী ভারী মাথাটি সামান্য নিচু করে বলে চললেন,
——— "আমি কোনো বৈধ পুত্র নই। আমার অস্তিত্বকে অবৈধ বলেই এ সমাজ চিনে। আমার মা, বিধবা এক নারী, শিকদার বাড়িতে কাজ করে ভৃত্য জীবন কাটাতেন। কোলে ছিল ছোট্ট রিতু, আর এই নিষ্ঠুর সংসারে তার সামান্য অবশিষ্ট আশ্রয়। মা ছিলেন অনিন্দ্যসুন্দর, কিন্তু সেই সৌন্দর্য হয়ে দাঁড়াল পাপের মিথ্যা আবরণের শিকার। একদিন সেই গৃহের মালিক, রাশেদ আলী, যে পিতার নামে আমার পরিচয়, কুৎসিত প্রবৃত্তির কাছে নিজের মনুষ্যত্ব বিকিয়ে দেন। বাড়ির সকলকে বাহিরে পাঠিয়ে নির্জন রাতে যখন তার বিকৃত ইচ্ছায় মা চূ'র্ণ হতে লাগলেন, তখন একটাই চিৎকার ছিল—রিতুর নিশ্চুপ চাহনি। সেই মুহূর্তে নির্বাক মায়ের দেহে রয়ে গেল অপমানের চিহ্ন, আর আমি জন্মালাম সে পাপের ফলস্বরূপ। কিন্তু আমার মায়ের প্রাণ বলছিল না, তিনি আমাকে মে'রে ফেলবেন। মায়ের হৃদয়ে কি বৈধ অবৈধ মানে, সন্তানই তো তার জীবনের পরিচয়। এই নিষ্ঠুর দুনিয়ায় আমার স্থান দিলেন, আর তাঁর জীবন ফুরিয়ে গেল অকস্মাৎ।"
কিছুক্ষণ স্তব্ধ রইলেন কুদ্দুস আলী। আবার ভাঙা স্বরে বলতে লাগলেন,
——— "আমার শিরায় শিরায় প্রবাহিত সেই নীরব অপমানের র'ক্তধারা। আমাকে তারা মে'রে ফেলতে চেয়েছিল, কিন্তু মা'রে নি। এক করুণ নাটক সাজিয়ে রাশেদের বৈধ সন্তান বলে পরিচয় দিলো। সমাজকে বুঝাতে স্ত্রীকে দূরে পাঠালো; মিথ্যার শিকলে জড়িয়ে আমাকে পরিচিত করল তাদেরই সন্তান হিসেবে। অথচ, সেই ঘরেই আমার পরিচয় মিথ্যা, আর আমাকে বয়ে বেড়াতে হতো মায়ের অপরাধের সুনামি। রাশেদের স্ত্রী কখনোই সন্তান বলে স্বীকার করেনি, বরং নি'র্মম নির্যাতন সয়ে জীবন কাটিয়েছি। রিতু, সেই অনাথ কন্যা, থেকেছে বাড়ির অভ্যন্তরে পরাধীন মেয়ে হয়ে, যেন তারও কোনো পরিচয় নেই। আমাদের দু’জনকে ভৃত্য আর দাসের মতো দিন কাটাতে হতো। ইকরাম আর আজগরের কৃতদাস হয়ে জীবন কাটিয়েছি, মা'র খেয়েছি। এমনকি বড় হয়েও চাকরের মতো তাদের কদর্য ব্যবসার সেবায় নিয়োজিত থেকেছি। বাইরের দুনিয়ায় সম্মান জুটলেও ভেতরে লুকিয়ে রয়েছে নি'র্মম অপমানের শৃঙ্খল। সব কিছু মুখ বুজে সয়েছি, স্ত্রী আর সন্তানদের জন্য। "
কুদ্দুস আলী গাঢ় স্বরে আবার বললেন,
———" ওদের প্রতি এতকাল ধরে জমে থাকা আমার ঘৃ'ণা বালির পাহাড়ের মতো বড় হয়ে উঠেছে। সেই ঘৃ'ণার আগুনে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম—ওদের সমস্ত সম্পত্তি ছিনিয়ে নেব, ওদেরই পদতলে নতজানু করে গোলাম বানিয়ে রাখব। সেই বংশের অহংকারের মুকুট ছিঁড়ে নিয়ে চুরমার করে দেব। কিন্তু মাঝেমাঝে রিতু, ভয় দেখিয়ে বাধা হয়ে দাঁড়াতো! টাকা চাইত; মিথ্যে মায়া-মমতা বিকিয়ে, মুখ খোলার ভয় দেখাতো! বলত, ‘সব বলব! সত্যটা সবাইকে জানিয়ে দেব।’ আমার প্রতিশোধের পথে সেই রিতুই কাঁ'টা হয়ে থাকায়, ওকেই সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিলাম।"
মুগ্ধ ঠোঁটে তির্যক হাসির ছোঁয়া নিয়ে বলল,
——— "আপনি এই সামান্য বুদ্ধি নিয়ে ইকরাম আলীর মতো চতুর ও কৌশলী ব্যক্তির কাছ থেকে সম্পত্তি ছিনিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন? একবারও আপনার মনে হলো না, এত জনের মধ্যে ইকরাম আলী কেন বিশেষ করে আপনাকেই সেই বৃদ্ধকে মা'রতে নির্দেশ দিল? ওর তো উদ্দেশ্য ছিল এক ঢিলে দুই পাখি মারা—সেই বৃদ্ধকে সরানো, আর আপনাকে খু'নি সাজিয়ে শিকলবন্দি করা।"
মুগ্ধ তির্যক হাসির আবরণে গভীর বিষণ্ণতা মিশিয়ে বলল,
———" যদি আপনি কিঞ্চিৎ বুদ্ধির প্রয়োগ করতেন, তবে বৃদ্ধকে হ'ত্যার পূর্বে অন্তত একবার জানতে চাইতেন, কী এমন অজানা গূঢ় তথ্যের অধিকারী তিনি, যা তাদের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু আপনি নির্বোধের মতো ইকরাম আলীর সুদূরপ্রসারী চক্রান্তে পা দিয়ে, স্বহস্তে সে বৃদ্ধের প্রাণসংহার করলেন! এতটুকু বুদ্ধি নিয়ে যে আপনি বাকি হ'ত্যাগুলোর সঙ্গে যুক্ত নন, তাতে আমি সম্পূর্ণ প্রত্যয়ী। আরও অক্ষমতার স্বাক্ষর রেখেছেন আপনি, যেমনটি মিসেস রিতুকে জীবন্মৃত অবস্থায় ফেলে রেখে এসেছেন। এক কুশলী ঘা'তক কখনও তার শিকারের নিঃশেষ ধ্বংস নিশ্চিত না করে পিছু হটে না। এ যাবৎ যতগুলো হ'ত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, সেগুলো নিঃসন্দেহে এমন এক মস্তিষ্কের সৃষ্টি, যার ধৈর্য, শীতল কৌশল, আর নিপুণ পরিকল্পনায় তৈরি! "
কুদ্দুস আলীর চোখে জল সমস্ত গ্লানি আর অপমানের প্রতিফলন। মুগ্ধর প্রতিটি বাক্য তার বুকের গহীনে তীব্র শূলের মতো বিঁধে যাচ্ছে। আর এই সত্যের মর্মর ধ্বনি শুনে এবার রুদ্র ও মহুয়া গভীর উপলব্ধিতে পৌঁছালো—কেন মুগ্ধ এমন নির্দ্বিধায় বলেছে যে এই ঘা'তক কুদ্দুস আলী নন।
মুগ্ধ দৃঢ়তায় দাঁড়িয়ে, চোয়াল শক্ত করে, গাঢ় কণ্ঠে বলল,
———" এবার নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য তিলে তিলে দহন ভোগ করুন!"
এই কথা বলেই মুগ্ধ পা বাড়াল প্রস্থানের পথে, তার পিছু নিলো রুদ্র ও মহুয়া। কুদ্দুস আলীকে ফেলে গেল তারা সেই নীরব অন্ধকারে, যেখানে কুদ্দুস জীবনের প্রতিটি ক্ষণে দুঃখ আর গ্লানির বোঝা বয়ে এসেছে। জীবনের সায়াহ্নে পৌঁছেও তার পরিণতি সেই দুঃখের বৃত্তে আবদ্ধ। যে পথ পাপের, সে কখনো সুখের সোপান হতে পারে না—সে মায়া দেয় কিছু সময়ের জন্য, কিন্তু শেষে কষ্টের এক বিষবৃক্ষ হয়ে সারাজীবন তিলে তিলে দংশন করে যায়।
--
রুদ্র মুগ্ধর পাশে ধীরে ধীরে হেঁটে প্রশ্ন করল,
——— "তাহলে স্যার, বাকি খু'নগুলো কি ইকরাম আলীই করিয়েছে? আর শেষ মুহূর্তে এসে কেউ তাকেই হ'ত্যা করেছে?"
মুগ্ধ গম্ভীরভাবে পা ফেলে এগোতে লাগল, তার গন্তব্য ডক্টর উজ্জ্বল সাহেবের সাথে তদন্তের বিশেষ আলোচনা। চেহারায় নিস্তরঙ্গ দৃঢ়তা মিশিয়ে মুগ্ধ উত্তর দিল,
——— "যে সব হ'ত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সেখানের মধ্যে, মোবারক, রূপার বাবা, শ্রমিক হিসেবে যুক্ত ছিল। কিন্তু রূপা আর মাস্টার ইকরাম আলীর কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই। ইকরাম আলীকে যে হ'ত্যা করেছে, সে নিশ্চয়ই তাকে অন্তরঙ্গভাবে চিনত। তার ব্যবসার সকল ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে, সহকারীদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। আর শিকদার বাড়িতে নিয়মিত নজর রাখতে হবে—ওখানেই এই রহস্যের জট খুলতে পারে।"
________________
তদন্ত-সংক্রান্ত কথোপকথন শেষ হতেই, মিথিলা মুখ নিচু করে, নিঃশব্দে মুগ্ধর সামনে এসে দাঁড়ালো। তার হাতে বিবাহের আমন্ত্রণপত্র। মুগ্ধ গম্ভীর অবয়বে স্থির দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে। মিথিলা আমন্ত্রণপত্রটি মুগ্ধর হাতে তুলে দিয়ে অস্ফুট কণ্ঠে বলল,
——— "আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে… তুমি আসলে খুশি হবো। আর আগের সকল ভুলের জন্য আমাকে ক্ষমা করো।"
মুগ্ধ কোনো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না করে নিস্তরঙ্গ হেসে, শুধু হাতে কার্ডটা তুলে নিল। অমোঘ ভাষায় শুধু একটিই কথা বলল,
——— "বিবাহিত জীবনে সুখী হও।"
মিথিলা আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না; চোখের কোণে জমে ওঠা জলরাশির ভার সয়ে, নীরবে বিদায় নিল। সকলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে সে, তাই মুগ্ধকেও তা করতে হলো। এতকিছুর পরেও এই পাষাণ হৃদয়ের সামনে এলে আজও বুকের অন্তঃস্থলে অনির্বচনীয় কাঁপন সৃষ্টি হয়। অথচ এই পাথর-সম পুরুষ কখনোই ভালোবাসার মর্ম উপলব্ধি করল না।
____________
মহুয়া সবে চলে যেতে উদ্যত হয়েছে, এমন সময় ছায়ার মতো হঠাৎ উদ্ভাসিত হলো রুদ্র। নিঃশব্দে তার পায়ের গতিপথ রুদ্ধ করে, দেয়ালের সঙ্গে নিবিড় করে চেপে ধরল তাকে। বিস্ময়ে গোল গোল চোখ মেলে তাকিয়ে আছে মহুয়া, রুদ্রের ঠোঁটে জাগ্রত হাসি। মহুয়া বিরক্ত ও বিব্রত হয়ে বলল,
——— "এই, তুমি কি শুরু করেছ? কেউ দেখে ফেললে কি হবে? আমায় ছেড়ে দাও! নির্লজ্জ!"
রুদ্র মৃদু স্বরে বলল,
——— "চুপ করো। এখানে কেউ নেই। নির্ভয়ে থাকো।"
———" এ জায়গা প্রেম নিবেদনের জন্য নয়! এ কাজের জায়গা! এখন ছেড়ে দাও!"
মহুয়ার বিরক্তি সহসা ধস্তাধস্তির রূপ ধারণ করল, কিন্তু রুদ্র আরো নিবিড় বন্ধনে তাকে আলিঙ্গন করে বলল,
——— "ছাড়বো, তবে একটি শর্তে!"
——— "কী শর্ত?"
রুদ্র ঠোঁট কামরে হেসে বলল,
——— "মহুয়া, শীত করছে!"
মহুয়া ভ্রু কুচকে বলল,
——— "আমি কী করবো! শীতের পোশাক তো পরেছোই! এখন ছেড়ে দাও! মুগ্ধ স্যার অপেক্ষায় আছেন, তাকে দেরি করালে অসন্তুষ্ট হবেন!"
রুদ্র তার মুখ মহুয়াকে এতটাই কাছে আনল যে দু’জনের নাসারন্ধ্র পরস্পর স্পর্শ করল। ফিসফিসিয়ে বলল,
——— " মুগ্ধ স্যার তো একাকী জীবন বেছে নিয়েছেন, আমার মতো প্রেমিকের কাতরতার মর্ম কি তিনি উপলব্ধি করতে পারবেন?"
মহুয়া দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
——— "এখন কী চাই তা স্পষ্ট করে বলো।"
——— "এমন মূর্খের মতো প্রশ্ন কেন করো?"
——— "বলবে নাকি চিৎকার দেব?"
——— "হুম, দাও চিৎকার!"
মহুয়া কাতর গলায় বলল,
——— "প্লিজ, বলো না কী চাইছো?"
রুদ্র নিঃশব্দে হাসল, তারপর তার বরফঠান্ডা হাত দিয়ে মহুয়ার উষ্ণ গাল দু’টি আলতো চাপে ধরল, নাকের সাথে নাক ঘষে মৃদুস্বরে ফিসফিস করে বলল,
——— "একটু উষ্ণতা দাও!"
——— "কী?"
——— "আমায়!"
এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে, কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই রুদ্র মহুয়াকে দৃঢ়ভাবে বুকে টেনে নিল। মহুয়ার গালে এক ক্ষণিক চুম্বনের উষ্ণতা ছড়িয়ে দিয়ে, তাকে ছেড়ে হঠাৎই নিরুদ্দেশের মতো হনহনিয়ে চলে গেল। মহুয়া বিস্ময়ে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল, মন্থর পলকহীন দৃষ্টিতে। এটা নিছক অসভ্যতা? কিন্তু মুখের কোণে এক প্রশান্ত হাসি ফুটল, যার অর্থ সে নিজেই ঠিক করে উঠতে পারল না।
বলা বাহুল্য, রুদ্র ও মহুয়ার এই চোরাগোপ্তা, দুষ্ট-মধুর প্রেমালাপ এখনো কারো দৃষ্টিগোচর হয়নি। এমন প্রণয় রাত্রির স্তব্ধ ছায়ায় ঘেরা, নিবিড় নিস্তব্ধতায় প্রোথিত; তাদের হৃদয়াবেগের বীজ অপ্রকাশ্যেই গড়ে তুলছে অদৃশ্য বাগান। তারা নির্ধারিত মুহূর্তে কালের হাতে তা প্রকাশ্যে তুলে দিতে ইচ্ছুক, যখন আসবে সঠিক সময়ের আহ্বান।
এই প্রণয়চক্র তাদের দিনলিপির অঙ্গীভূত হয়ে আছে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে, লুকোচুরি খেলা—দুজনের ইঙ্গিতবাহী দৃষ্টি, কখনো চাপা হাসির বাণী, আবার কখনো নিস্তব্ধ স্পর্শে উদ্ভাসিত সংলাপ, যা তাদের নিয়ত গভীরতর বন্ধনে আবদ্ধ করে তুলছে।
_______________
সমগ্র গ্রামব্যাপী এক কাঁপন ধরানো স্রোত বইছে কুদ্দুস আলীর কুকীর্তির সংবাদে। এককালের ধন্যিত সম্মান আর আভিজাত্যের সমারোহে মোড়ানো কুদ্দুস আলীর নাম আজ মানুষের মুখে মুখে বিরোধী ধ্বনি তুলেছে।
"কি পরিহাস!"—এমন কথা আজ চায়ের কাপে ঝড়ে উঠেছে সর্বত্র, কল্পনাতীত তুচ্ছ প্রবৃত্তির শিকার হয়ে এক নি:সহায় বৃদ্ধকে হ'ত্যা করেছে কুদ্দুস আলী! সামান্য কিছু রোষ আর আকাঙ্ক্ষার জন্য এতদিনের অর্জিত মানমর্যাদা এক আঘাতেই চূর্ণ করে দিল! এ কী অদৃষ্টের পরিহাস! সম্মানের স্থাপনা, যার গায়ে লাগতো শ্রদ্ধার পরশ, আজ নিন্দা আর ঘৃ'ণায় ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে।
গ্রামের বাতাসে আজ আর তার প্রশংসার গান নেই; বরং ধ্বনিত হচ্ছে ভয়ানক নিন্দা, প্রতিটি কণ্ঠ কুদ্দুস আলীর জীবনের রুদ্ধদ্বার শেষাবধির করুণ রচনাটি উদ্ঘাটন করে চলেছে—সম্মান, যে হাতছানি দিয়ে তাকে উচ্চকক্ষের মর্যাদায় আহ্বান করেছিল, আজ তারই প্রতিটি স্তম্ভ ধ্বসে মিশে গিয়েছে মাটির গভীরে।
_____________
রজনীর অন্ধকার চাদরে আচ্ছাদিত হয়েছে পারিপার্শ্বিক ধরণী; শ্বেত কুয়াশার মিহি পরত নিঃশব্দে জড়িয়েছে প্রতিটি গাছের ডাল ও পথের ধূলিকণা। তুষারের কনকনে তীক্ষ্ণ হিমেল হাওয়ায় বাইরে গমন দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। অগ্নিশিখার মৃদু আলোয় আরাফ ইংরেজি উপন্যাসের পৃষ্ঠাগুলি উল্টাচ্ছিল; হঠাৎ, তাঁর নিবিড় একাকীত্বে উপস্থিত হলো মুগ্ধ, এক অভাবিত দৃশ্যপট রচনা করে।
আরাফের মুখে প্রশস্ত হাসি ফুটে উঠল, যেন বহু প্রতীক্ষিত অতিথির আগমনে উচ্ছ্বসিত। শয্যা ত্যাগ করে উঠে বসে বলল,
——— "আসো ভাই! "
তবু, অন্তরালে সন্দেহের সূক্ষ্ম ছায়া খেলে গেল; মুগ্ধ কখনোই এভাবে অযাচিতভাবে প্রবেশ করেন না। আজ, এই উপস্থিতির অর্থ নিশ্চয় গভীর কোনো কারণ বহন করে। মুগ্ধ গম্ভীর পদক্ষেপে এগিয়ে এসে আরাফের শয্যায় নীরবে বসে পড়ল। আরাফ প্রশ্রয়ের সুরে বলল,
———" কিছু কি বলবে?"
মুগ্ধ, চিরন্তন গাম্ভীর্যের শৃঙ্খলাবদ্ধ, অতল গভীর কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
——— "আঁখির পিছু ছেড়ে দে!"
আরাফের মনে যেন বজ্রাঘাত হানল, বিস্ময়ের স্থবিরতায় পাথরপ্রতিম হয়ে গেল সে; চোখ বিস্ফারিত, বাকরুদ্ধ, নির্নিমেষে চেয়ে রইল মুগ্ধর কঠোর অভিব্যক্তির প্রতি। কেন হঠাৎ আঁখির প্রসঙ্গ উচ্চারিত হলো মুগ্ধর র'ক্তমাংসের অধীর অঙ্গীকারে? আঁখির সম্পর্কে অবগতি লাভই বা কীভাবে সম্ভব হলো তার? এবং, পিছু হটতে বলার তাৎপর্যই বা কী?
আরাফের দেহজুড়ে বরফের শীতলতা স্থায়ী হল, রক্তের প্রবাহ শ্লথ হয়ে যেন জমে গেল তুষার-প্রাবৃত্ত পাথরের মতো। মুগ্ধর মুখাবয়বে কঠোরতার ছায়ার খেলা যেন কোনো গূঢ় নিয়তি ঘোষণার দূত।
মুগ্ধ, গম্ভীর কণ্ঠে, এক শ্বেতাভ শীতল শিলাখণ্ডের দৃঢ়তায় উচ্চারণ করল,
——— "আর কখনো যেন দেখি না, ওর ধারে কাছে তোর ছায়াটিও ঘোরাফেরা করছে!"
আরাফের চোয়াল দৃঢ় হয়ে গেল। হৃদয়ে বদ্ধ আবেগের দাবানল জ্বলে ওঠে। গম্ভীর কণ্ঠে সে বলল,
——— “আমি আর ছোট নই, ভাই। যথেষ্ট বুঝি, কোনটি নিকটবর্তী রাখার যোগ্য আর কোনটি দূরত্বে সরিয়ে রাখার। আমার বিচারে এটুকু উপলব্ধি করতে শিখেছি।”
মুগ্ধর মুখাবয়বে ক্ষোভের প্রবল উত্তাপ প্রতিফলিত হলো। রাগ যেন অন্তঃস্থল থেকে অগ্নিরূপে বিক্ষিপ্ত হলো। অপ্রতিরোধ্য ক্রোধে ধপ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
——— “তুই যা শুনেছিস, তাই করবি। আমি তোর বড় ভাই। আমার প্রজ্ঞা তোর চেয়ে প্রবলতর, আর আমি ঠিক জানি কোনটি তোর মঙ্গলের জন্য উপযুক্ত আর কোনটি ধ্বং'সাত্মক।”
আরাফও দণ্ডায়মান হলো, চোখে উদ্দীপ্ত প্রতিজ্ঞার দীপ্তি, কঠোর কণ্ঠে বলল,
——— “এটা আমার ব্যক্তিগত অধ্যায়। এখানে তোমার অনধিকার প্রবেশের কোনো স্থান নেই।”
মুগ্ধর হাত মুষ্টিবদ্ধ হলো, প্রবল ক্রোধে কাঁপতে লাগল। অথচ আত্মনিয়ন্ত্রণের ভারী শৃঙ্খলে নিজেকে আবদ্ধ রেখে সে শুধু বলল,
——— “তোকে আমি বলেছিলাম—আমার প্রিয়জনের প্রতি কেউ তাকালে, তাকে নিঃশেষ করে দিতে আমার দ্বিধা নেই। তাকেও ম'রতে হবে। আমার হাতে তার খতম অবধারিত।”
আরাফ হতবাক হয়ে গেল! এ কী সব উলট পালট কথা উচ্চারণ করছে মুগ্ধ? রাগে থরথর করে বলে উঠল,
——— “আমি তাকে ভালোবাসি। কেউ এসে আমার ভালোবাসার দাবিকে অস্বীকার করলে, তাতে আমি পিছিয়ে যাব না! এমনকি তুমি বললেও না!”
মুগ্ধর চোখে রাগের অনল ছলছল করে উঠল। এখান থেকে না সরে গেলে তার সংযম ভেঙে যাবে। অন্তরে দহন নিয়ে দ্রুত পা বাড়াল বাহিরের দিকে। দরজার কাছে এসে একবার পেছন ফিরে বলল,
——— “নিজেকে সামলানোর প্রস্তুতি নিয়ে নিস।”
এই বলে ক্রোধ ও বেদনার ঝটকায় হনহনিয়ে প্রস্থান করল মুগ্ধ। আর আরাফ সেখানে অভিভূত, বাক্যহারা হয়ে রইল। মুগ্ধর কথাগুলি তার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে, অচেনা দোলাচলে আচ্ছন্ন করে তুলছে। কেন বলল মুগ্ধ এমন কথা? কেন? আরাফ ধীরে ঠান্ডা ফ্লোরে বসে পড়ল। অস্ফুট কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে উঠল,
——— “আঁখি কি... ভাই... ভালো...”
হতাশায় চুলের মুঠি আঁকড়ে ধরল আরাফ! তীব্র বেদনাবোধে চিৎকার করে উঠল,
——— “না! আমি ভালোবাসি তাকে। সে শুধু আমার! একান্ত আমার! অন্য কারও নয়।”
আরাফের মাথা ঠান্ডা বরফ-সন্নিহিত ফ্লোরে স্থিত, চুলের মুঠি নির্দয়তার সঙ্গে আকর্ষণ করল। দরজার আড়ালে থেকে আছিয়া দুই ভাইয়ের উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডা নিঃশব্দে প্রত্যক্ষ করছিল। হঠাৎ তীব্র কষ্টের ঢেউয়ে আছিয়া দ্রুত চোখের জল মুছল, আবেগে অবরুদ্ধ হয়ে দৌড়ে নিজ কক্ষে প্রবেশ করল। দরজা বন্ধ করে আত্মপ্রবঞ্চনার ভারে নিস্তেজ হয়ে সেই একই শীতল ফ্লোরে ধপাস করে বসে পড়ল। অশ্রুধারা অবিরত বয়ে যেতে লাগল; কনকনে শীত তার শরীরকে কাঁপিয়ে তুলল, আর সেই শীতলতার মাঝে কান্নার গভীরতা ঢেউ তুলল হৃদয়ে।
এতকাল পরে সত্যের নির্মম উপলব্ধি আছিয়ার হৃদয়ে আঘাত হানল। তার ভাই আরাফও আঁখিকে ভালোবাসে! সে নিজেও তো অভুক্ত ভালোবাসার যন্ত্রণায় নিরন্তর ভুগছে, গুমরে ম'রছে। তবে কি এখন তার প্রিয় ভাইও একই অ'ভি'শাপে পতিত হবে? ম'রবে কি সে? আছিয়া তো নিজেই প্রতিদিন ম'র'ছে—প্রতিটি মুহূর্তে। কিন্তু আজ তার হৃদয়ে আগুনের শিখা দাউদাউ করে জ্বলে উঠল; এই অসম ভালোবাসার দ্বৈরথ, তার দুই ভাইয়ের অন্তর্দহন, আর সহ্য হলো না। আঁখির প্রতি তার অন্তরে প্রজ্জ্বলিত হলো বিদ্বেষের অগ্নি। দাঁত কিড়মিড়িয়ে, ক্রোধের জ্বলন্ত ধ্বনি তার ঠোঁট থেকে নির্গত হলো। আঁখিকে উদ্দেশ করে সে বলল,
——— “তুই অনেক খেলেছিস, আমার ভাইদের হৃদয়ের সাথে! এবার তোর এই খেলা আমি সহ্য করব না! তোকে আমি ছেড়ে কথা বলব না, আঁখি!”
________________
নিসা বেগম রাতের অন্ধকারে আহার সমাপ্ত করে উষ্ণ কম্বলের আশ্রয়ে নিজেকে আচ্ছন্ন করেছেন। সাজ্জাদ সাহেব এখনো বাড়ির প্রাঙ্গণে প্রত্যাবর্তন করেননি; কর্মব্যস্ততায় বিলম্বিত। দরজা ভেজানোই ছিল, হঠাৎ দরজার খোলার শব্দ ভেসে এলো। নিসা বেগম ভাবলেন, বুঝি সাজ্জাদ সাহেব ফিরে এসেছেন। কিন্তু প্রগাঢ় অন্ধকারের ছায়ায় আরাফের বিমর্ষ, বিদ্ধস্ত মুখশ্রী দেখে তার ভ্রু অচেতনে কুঁচকে গেল। উদ্বেগের তীব্র তরঙ্গে শয্যা থেকে দ্রুত উঠে বসলেন। জিজ্ঞাসা করলেন,
——— “কী হয়েছে, বাবা? তোর এমন বিধ্বস্ত চেহারা কেন?”
আরাফ কোনো বাক্য উচ্চারণ করল না। তার দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয় নিঃশব্দে মায়ের পাশে এসে বসে পড়ল। মুহূর্তের মধ্যেই নিজের ক্লান্ত অস্তিত্ব মায়ের কোলের প্রশান্তিতে শুইয়ে দিল। নিসা বেগম চিন্তায় উদ্বিগ্ন হলেন; মাতৃহৃদয়ের অপার মমতায় তিনি সন্তানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন, যাতে তার প্রতিটি স্পর্শে আরাফের বিষাদ প্রশমিত হয়।
মায়ের কোলে মাথা রেখে আরাফ অশ্রুসিক্ত, বিদীর্ণ কন্ঠে বলল,
——— "মা, আমি আঁখি কে ভালোবাসি!"
নিসা বেগম যেন বজ্রাহত হয়ে গেলেন! সহস্র ঝড় ঝাপটা দেহে সঞ্চারিত হয়ে তাঁর হাত থমকে গেল ছেলের মাথা থেকে। এ কি কথা শুনছেন তিনি? তাঁর প্রাণপ্রিয় সন্তান, যে কিনা সর্বদা হালকা হাসি মুখে মেতে থাকে, সে এমন আকুল করে কিছু বলতে পারে, তা কি তিনি কল্পনাও করতে পেরেছিলেন? আবারও আরাফের আকুতিমিশ্রিত কন্ঠস্বর, হাহাকারের প্রতিধ্বনি, শুনতে পেলেন তিনি,
——— "ওকে আমার করে দাও মা! আমি ওকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারি না। ওকে আমার কাছে এনে দাও, মা!"
আরাফের ফুপানো কান্নায় নিসা বেগমের হৃৎপিণ্ডে অপরিসীম শূন্যতা সৃষ্টি হলো। সে শূন্যতার মধ্যে দাঁড়িয়ে, যেন এক পাথরের মূর্তি হয়ে তিনি তাকিয়ে রইলেন। জীবনের এই রহস্যময়, অপ্রত্যাশিত অধ্যায়টি তাঁকে স্তব্ধ করে দিল। ছেলেটি, যার নির্মল হাসি তাকে সাহস যোগায়, তার অশ্রুধারায় আজ বয়ে যাচ্ছে এক গভীর বেদনাভরা আবেগ! ছেলের মুখাবয়বের সেই অনন্ত বেদনার ছাপ দেখে তিনি কেঁপে উঠলেন, তারপর অশান্তচিত্তে কপালে হাত রেখে বললেন,
——— "এ-এসব কিভাবে হলো বাবা?"
মায়ের কোলে মুখ গুঁজে আরাফের বিষণ্ণ কণ্ঠস্বর বেজে উঠল, এক আশ্বাসের করুণ আকুতি নিয়ে বাচ্চাদের মতো অনুরোধ করে বলল,
——— "মা, আমি প্রতিজ্ঞা করছি— আঁখিকে কখনও কোনো দুঃখের ছায়ায়ও যেতে দেব না। তাকে রানীর মতো আগলে রাখব... তাকে আমার করে দাও, মা!"
আবারও আরাফের কান্নায় তীব্র ব্যাকুলতার সুর ধ্বনিত হলো। নিসা বেগমের বুকের ভেতর হাহাকারের ঝড় বয়ে গেল। কল্পনাও করতে পারেননি, তাঁর ছেলেটি এমন অনন্ত আকাঙ্ক্ষার জ্বরে পোড়াতে পারে নিজেকে, এমন নিষ্পাপ শিশুর মতো ব্যথায় ভেঙে পড়তে পারে শুধুমাত্র এক নারীর আরাধনার জন্য। অথচ সে জানে, যাকে ভালোবাসার জন্য এমন আবেগের তৃষ্ণা, সে শত্রুর কন্যা। তবে কি ভালোবাসা এই দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে উঠে, তার মতো অনন্ত শক্তি ধারণ করে? নিসা বেগম ছেলের কপালে এক গভীর, শান্তনার চুম্বন এঁকে বললেন,
——— "যদি সে তোর প্রকৃত সাথী হয়, তবে এই পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই যে তোকে তার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে।"
আরাফ আর কোনো বাক্য উচ্চারণ করল না। মায়ের কোলে মুখ গুঁজে রইল, অশ্রুর নিরবধি প্রবাহে তীব্র নীরবতা ধ্বনিত হতে লাগল। এ বেদনামিশ্রিত নীরবতা অনন্ত অনুধাবনের দিকে ইঙ্গিত করে, যেখানে একটিই নির্মম সত্য উদ্ভাসিত, তার বড় ভাই মুগ্ধ আঁখি কে ভালোবাসে। আরাফের হৃদয়ে অশান্তির ঝড় বইতে লাগল। আঁখির হৃদয়েও কি সত্যিই মুগ্ধের প্রতি অনন্য আবেগ লুকিয়ে আছে? তবে কেন এতদিন আঁখির কাছে নিরন্তর প্রার্থনায় সে একটিও প্রতিউত্তরের ছোঁয়া পেল না? কেন এতকাল ধরে আঁখির নিকট এমনই এক নিঃশব্দ প্রহরের সঙ্গী হয়ে রইল আরাফ?
এই ভাবনাগুলো তার মনোজগতে এমনভাবে আঘাত হানল যেন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে; মনে হচ্ছে শূন্যতায় বুঁদ হয়ে যাচ্ছে সমস্ত অস্তিত্ব। তাই তো এই আবেগের অনিঃশেষ চাপ আর সহ্য করতে না পেরে ছুটে এসেছে মায়ের কাছে— সমস্ত অব্যক্ত আকুতি উন্মোচন করে দিয়েছে নিঃসংকোচে, অন্তরে জমে থাকা গভীর আর্তনাদে সমস্ত কিছু প্রকাশ করে দিয়েছে মায়ের কাছে।
-----Facebook
———" সরি ভাইয়া! আমি বুঝি নি! "
মেয়েটার কণ্ঠে দুঃখের ছোঁয়া, মাথা নিচু করে সে নিজেই নিজেকে সংকুচিত করে ফেলল। আরাফ বিস্মিত দৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে রইল ক্ষীণকায়, শ্যামল বর্ণের কিশোরীর দিকে। আছিয়া তার হাত ধরে স্কুলে নিয়ে এসেছে আজ, তাকে সঙ্গে আসতে প্রায় বাধ্যই করেছে; ক্লাস ৮-এর পরীক্ষার ফলাফল আশানুরূপ না হওয়ায় অনিচ্ছায় পা ফেলতে বাধ্য হলো সে। কিন্তু হঠাৎ করেই, এই শ্যামবর্ণা কিশোরী দৌড়ে এসে আরাফকে সজোরে ধাক্কা মারে। সেই ধাক্কায় যেন অনন্ত আকর্ষণে আটকে যায় আরাফের দৃষ্টি।
আছিয়া আঁখির পাশে দাঁড়িয়ে সস্নেহে বলল,
——— ওই আঁখি, ব্যথা পাস নি তো?
আরাফের কপালে অল্প ভাঁজ পড়ে; মনে মনে কয়েকবার নামটি পুনরুচ্চারণ করল, “আঁখি।” চোখে জল টলমল করছে তার; সেই অবাক চোখের জল যেন আরও গাঢ় দাগ ফেলে দিলো আরাফের হৃদয়ে। যেন কোনো এক অস্ফুট বেদনার ছায়া নিয়ে সে স্থির তাকিয়ে আছে। আরাফের অন্তরে এক আশ্চর্য কোমলতা জাগ্রত হয়, সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে সান্ত্বনাস্বরূপ বলে ওঠে,
——— "আরে, আরে, আমি তো রাগই করিনি! তুমি কাঁদছো কেন হুম? কেঁদো না! "
আঁখি তার টলমল ডাগর ডাগর চোখের চাহনিতে মৃদু ইশারা করল আরাফের দিকে, যেন কোনো অপার্থিব গোপন তথ্য সে প্রকাশ করতে চায়। আরাফ চোখ কুঁচকে নিজের দিকে তাকাতেই অবাক বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল; তার সাদা শার্টটি কালি-লেপ্টে একাকার হয়ে গেছে, যেন কোনো শিল্পীর দুর্লভ আঁচড় খুঁজে পেয়েছে তার ধবধবে পোশাক। এরপর আঁখির দিকে তাকাতেই আরাফ দেখতে পেল মেয়েটির নরম, নুপুর-ছোঁয়া হাতেও কালি মাখা! আবেগমগ্ন দৃষ্টিতে আঁখির দিকে চেয়ে থাকার মুহূর্তে এমনটিই ঘটেছে, যা তার মনোযোগের দৃষ্টিসীমায় অধরাই থেকে গিয়েছে, সে টেরই পায় নি।
আঁখি দ্রুত লিখতে গিয়ে কলমের নিব ভেঙে ফেলেছে, আর সেই ফাটল দিয়ে কালির বন্যা বইছে। সে ভেজা হাতে কালি-মাখা কলমটি ফেলে দিতে তাড়াহুড়ো করে ছুটল, আর তার কচি হাত কালিতে ভরে উঠল। দরজার বাইরে পা রাখতেই হঠাৎ ধাক্কা খেল এক প্রগাঢ়, বলিষ্ঠ দেহের সঙ্গে। সে মুহূর্তে, অজান্তেই তার কালিতে মাখা হাত দুটি আরাফের বুকের কাছে গিয়ে ঠেকল। ফলস্বরূপ, আরাফের শুভ্র শার্টটি ললাটলিখনের মতো কালি-দাগে পরিপূর্ণ হয়ে গেল, কেবল বাহিরেরই নয়, অন্তরের অপ্রকাশিত স্পন্দন প্রকাশ পেল সেই দৃশ্যের মাধ্যমে।
আরাফ বুঝতে পারল আঁখির মনে কোথায় যেন কোন গভীর না-বলা ভাষা আছে। সে নিঃশব্দে আঁখির দিকে ঝুঁকে গিয়ে, তার চোখের অশ্রুবিন্দু কোমল হাতে মুছে দিয়ে বলে উঠল,
——— "কেবল শরীরে নয়, তুমি এমন এক ধাক্কা দিয়েছো যা আমার গোটা অস্তিত্বকেই কাঁপিয়ে দিয়েছে!"
ব্যাস, সেদিন থেকেই আরাফের জীবনে অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের সূত্রপাত ঘটল; আঁখির প্রতি এমন নিবিড় অনুসন্ধান অস্তিত্বের গভীরে প্রবেশের একটি অবিরত প্রয়াস। কোথায় সে যায়, কি করে, কার সান্নিধ্যে বিরাজমান - সমস্তই আরাফের বিচক্ষণ দৃষ্টিতে প্রতিফলিত। কেহ যদি আঁখির সন্নিকটবর্তী হওয়ার সাহস করত, আরাফ তৎক্ষণাৎ এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে যেত তার পথে।
এক দৃষ্টে দেখার জন্য, শ্যামল গাত্রবর্ণের সেই অপরূপার মুখে সামান্য এক রেশ হাসির স্পর্শ দেখার জন্য, এক পলকের অভিলাষে যে হৃদয় আকাঙ্ক্ষিত থাকত তা যেন অলঙ্ঘনীয়। আঁখির একটুখানি হাসি দর্শন, সেই ক্ষণিক উজ্জ্বলতায় শ্যামল বর্ণের কন্যার গাল দুটি পূর্ণতায় উত্থিত হওয়া, গোলাপ-অভিষিক্ত ঠোঁটের নরম রেখায় অঙ্কিত হাসির মায়াবী রেখাটি আর ডাগর ডাগর গভীরতায় ডুবন্ত চোখের কোণে খেলতে থাকা এক ঝলক খুশির জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত হলো আরাফ।
__
আরাফের অধর থেকে এখন বেদনামাখা, বিষাদগ্রস্ত কণ্ঠের নিঃশ্বাসে প্রশ্ন বেরিয়ে এলো,
——— "তুমি কি আমার চিরন্তন প্রেয়সী হয়ে উঠবে না? আমি কি কখনোই তোমার মর্মে পৌঁছাতে পারবো না, নির্দয়ী?"
0 Comments