Ad Code

শ্যামকন্যার মায়াবী চোখ - পর্ব ৪৪

 লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা

🚫🚫
কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।
🚫🚫
*
*
কারাগারের নির্বাক ছায়া ভেদ করে প্রবেশ করল নাঈম। তার পিতার সাথে অতীতে ছিন্নসূত্র কিছু ঋণ বাকি রয়ে গেছে, যা আজও তার বুকের পাঁজরে তীক্ষ্ণ কাঁটার মতো খচখচ করছে। চোখ-মুখে প্রতিশোধের আগুন, নাঈমের ঠোঁটে এক বিদ্রুপের ছায়া। নরম তুলতুলে রাজকীয় কুশনে বিরাজমান, নিজের শৌর্য আর অহংকারের প্রতিমূর্তি পিতা কুদ্দুস আলী আজ কারাগারের স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে নুয়ে বসে আছেন! কি অদ্ভুত নির্মমতা; কালের অনিবার্য ফেরে অপমানের আসনে রাজা আজ ভিখারি!
নাঈমের সামনে সময় সীমিত। পেছনে পুলিশের কঠোর তীক্ষ্ণ নজর, যার উপস্থিতি ঘরের নিস্তব্ধতায় ঘৃ'ণার বিদ্রূপ মিশিয়ে দেয়। নাঈমের দৃপ্ত পদক্ষেপের শব্দে বাতাস থমকে যায়। পিতার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে নাঈম, মুখে অমোঘ শীতলতা। কুদ্দুস আলী তবু নির্বাক, নতজানু, অপমানের বোঝা মাথায় চাপিয়ে নুইয়ে আছেন। পিতাপুত্রের এই নিস্তব্ধ মিলনে প্রকৃতি যেন সাক্ষী হয়ে থাকে অপ্রকাশিত শত অভিমান আর অমীমাংসিত ক্ষোভের নিষ্ঠুর স্পন্দনে।
নাঈমের চোখের দাহ আগুনের শিখায় রূপান্তরিত; তীক্ষ্ণ কণ্ঠে শূন্যতা কেঁপে উঠলো,
——— "খু'ন করার আগে একবার আমাকে বলতে পারতে!"
কুদ্দুস আলীর মাথা তবু নিচু, অপরাধের গ্লানি আর অপরিচিত এক লজ্জায় তিনি স্তব্ধ। তার নিষ্প্রভ চোখ কোনো ক্রমেই ছেলের আগুনদীপ্ত দৃষ্টির দিকে তুলতে পারে না। নাঈমের মুখে ছটফটে এক তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল,
——— "এখন আর চুপ করে কি লাভ? যা করার তো করেই ফেলেছো!"
গভীর শ্বাস ফেলে, একরকম নিজেকে সামলানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা করেই কুদ্দুস আলী বললেন,
——— "আমি যা করেছি, তোর আর তোর মায়ের জন্য করেছি।"
এ কথা শুনে নাঈমের হাসি যেন আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল, করুণার কণ্ঠে সেই হাসি জড়ালো বিষের মতো,
——— "এতদিন কষ্ট সহ্য করেছো আমাদের জন্য! কিন্তু শেষমেশ এটা কি করলে? আমাদের ভালোর জন্যই নাকি খু'ন করেছো?? তাই, এখন তো আমি কেবল খু'নির ছেলে, আমার মা এক খু'নির স্ত্রী। আমাদের ‘ভালো’ এখন এই পরিচয়ে সীমাবদ্ধ! তোমার সেই ‘সতর্কতায়’ আমাদের নতুন পরিচয়—একটা অ'ভি'শা'প ছাড়া আর কিছু নয়, বাবা! আর তুমি আমাদের জন্য এসবই করেছো! "
কুদ্দুস আলীর বুকের গহ্বর থেকে হঠাৎ করুণ অশ্রু-বৃষ্টির উত্থান; স্বীকারোক্তির প্রতিটি শব্দ অপরাধের তীক্ষ্ণ শলাকা হয়ে তার কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসছে,
——— "মাপ করে দে বাবা! সম্পত্তির নেশায় আমি আমার বিবেক হারিয়েছিলাম!"
তিনি নাঈমের হাত শক্ত করে ধরে ফেললেন, যেন পিতার এই লজ্জা ও ক্ষমাপ্রার্থনার ভার তাকে কোনোভাবে মুক্তি দেবে।
নাঈম চোখ নামিয়ে বেদনার এক গাঢ় ছায়ায় ঢেকে গেল। দীর্ঘশ্বাসে বিষাদ ও অপমানের রেশ ছড়িয়ে দিয়ে বলল,
——— "ঠিক এই কারণেই আমি অন্ধকার জীবনের পথ বেছে নিয়েছি। ছায়াচ্ছন্ন জগতের অন্তরালে বেঁচেছি, ভালোর মুখোশ পরে থেকেছি। কিন্তু কখনও লোভের কাছে নতি স্বীকার করিনি। সম্পত্তির শেকলে নিজেকে বাঁধিনি। কেননা লোভের ফল পাপ, আর পাপের চূড়ান্ত পরিণতি; মৃ'ত্যু! অবশ্য আমি যে পথে আছি; যে জীবনে আছি ; তা মৃত্যুর চেয়ে কম কিসে? "
কুদ্দুস আলীর বুকের অন্তঃস্থল থেকে এক অসহায় কান্নার ঝড় উঠে আসে, অন্তরের সমস্ত পাপের ভার বাইরে ফেটে বেরোতে চাইছে। তার সেই অশ্রুমোচন দেখে বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠে নাঈমের ঠোঁটে।
——— "তবুও শিকদার বাড়ির সেই গভীর সত্যটা বলতে পারলে না, বাবা? কেনো এই সত্য চাপা দিয়ে রাখলে?"
কুদ্দুস আলী থমকে রইলেন, অন্ধকারে দিশেহারা কোনো অপরাধী। কি করে বলবেন তিনি? সেই প্রাসাদের অন্তরালে যে তার স্ত্রী এবং সন্তান অজানা আবরণে লুকিয়ে! শিকদার বাড়ির প্রতিটি ইটের ফাঁকে তাদের ভবিষ্যতের অ'ভিশাপ আঁকা, যা প্রকাশ করা তার কাছে অসম্ভব। তবে আজগর আলীও যেন নিষ্ঠুরতায় কতই না পরিশীলিত—নাঈম আর কানিজ বেগমের দিকে কদাচিত তাকায়নি সে। যতটাই অন্যায় এবং নির্দয় সে, তবুও এই দুইজনকে কোনোদিন আঘাত করেনি।
নাঈমের কণ্ঠে বিষাক্ত অভিমান এবং চেপে রাখা ক্রোধ তীক্ষ্ণ তরবারির মতো শাণিত হয়ে ওঠে,
——— "চাইলে আমিও হয়তো হাজারো সাধারণ মানুষের মতো সাদামাটা জীবন যাপন করতে পারতাম! কিন্তু তা হয়নি, কারণ তুমি, ওই প্রাসাদের লোকগুলো, আমার নিষ্পাপ শৈশবকে শৃঙ্খলিত করেছো! হ্যাঁ, তোমাকে অত্যাচার করেছে তারা, সেই ছোটবেলা থেকেই অত্যাচারের প্রহরে প্রহরে তোমার জীবন জর্জরিত। কিন্তু, তুমি কি বিনা স্বার্থে কিছু করেছো, বাবা? বিনিময়ে কিছু চাওনি?"
কণ্ঠে বিদ্রূপের ছোঁয়া,
——— "চাইলেই তো ওই দানবদের ছেড়ে মা আর আমাকে নিয়ে চলে যেতে পারতে। আলাদা থেকে কর্ম করে খেয়ে আমাদের নিয়ে স্বাভাবিক জীবন নিয়ে বাঁচতে পারতে! কিন্তু না! তুমি তো ক্ষমতা, সম্পত্তির মায়ায় বাঁধা পড়ে রইলে। ইকরাম আর আজগরের মন জয় করার জন্য তুমি বিনিময়ে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছো। তাদের চাকরামী করেছো, আর সে সত্ত্বে কিছুটা সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছো। তোমার সেই মর্যাদার নেশায়, আমার শৈশব আর আমার মায়ের জীবন; কেবল এক নিষ্প্রাণ পুতুল হয়ে থেকেছে!"
নাঈমের দীর্ঘশ্বাসে সমস্ত গ্লানি যেন ঝরে পড়ে,
——— "যখন দেখলাম, নিজের পিতাই সেই কলুষিত কর্মের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে, ইকরামকে তোষামোদে ভরিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে, তখন আর নিজেকে কি করে সংযত রাখি বলো? একবার অন্তত ভেবে দেখো, তুমি কি কোনো দিন হিসাব করতে পারবে, তোমার হাত থেকে ঠিক কতগুলো জীবন ন'ষ্ট হয়েছে?"
কথাগুলো বলে কুদ্দুস আলীর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নাঈম উঠে দাঁড়ায়, যেন তার উচ্চতায় এক কঠোর নৈঃশব্দ্যের মহাসমুদ্র উথলে ওঠে। কণ্ঠে দাহ,
——— "আমি অন্ধকার জগতে পা রেখেছি, নিজের বাবার জন্যই।"
দু’চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু বিন্দু দুটো এক আঙুলের চাপে মুছে ফেলে নাঈম বিদীর্ণ অভিমানে এক স্থির দৃঢ়তায় গটগট করে এগিয়ে যেতে লাগলো। প্রতিটি পদক্ষেপ কারাগারের মেঝেতে গর্জনের প্রতিধ্বনি তোলে। পেছনে রইলেন কুদ্দুস আলী, নিষ্প্রাণ মাটির দিকে মাথা নত করে বসে, হাত মাথায় দিয়ে আকাশের দিকে যেন অদৃশ্য ক্ষমার আবেদন জানাচ্ছেন।
কাঁপা কণ্ঠে এক করুণ আর্তি ভেসে আসে পেছন থেকে,
——— "আমাকে মাফ করে দিস, বাপ! তোর মাকে দেখে রাখিস... তাকে বলিস, আমাকে যেন একটুকরো ক্ষমা দেয়!"
কিন্তু নাঈম পিছু ফিরে তাকাল না। নির্দয়, নির্বিকার সেই পদচারণা মিলিয়ে গেলো দূরের অন্ধকারে, যেন প্রতিশোধের অনল ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেছে। কুদ্দুস আলী নিস্তব্ধ কারাগারে একা, পাপ ও প্রলয়ের ভারে নত হয়ে কাঁদতে থাকেন; তার কান্না অনন্ত নির্বাসনের প্রতিধ্বনি, যা কোনোদিনও রেহাই পাবে না।
নাঈম বাইরে পা রাখতেই শীতের কনকনে শ্বাস তার চারপাশে বুনে দিলো হিমের কঠিন প্রলেপ, কিন্তু তার অভ্যন্তরিত জ্বালা মেটাতে পারলো না এই শীতের ছোঁয়া। চোখের কোল লালোভাবে অঙ্গারশ্রান্ত, অথচ সেখানে অদ্ভুত এক গূঢ় বিষাদও যেন জেগে আছে। রক্তের সম্পর্কের আকর্ষণ কতটুকু প্রগাঢ় হতে পারে, তা অনুভব করলো নাঈম – বিদ্বেষের ধোঁয়ায় সিক্ত হলেও যেন কোথাও না কোথাও সেই টান আছে।
দীর্ঘ লং কোটের ধুলা ঝেড়ে সে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো, প্রলয়ের পথে সুরের মতো। সামনে গিয়ে সেই চিরপরিচিত মুখের দীপ্তি ধরা দিলো তার দৃষ্টিতে। অপার্থিব এক হেসে ওঠা মুখ।
হাওয়াও এসেছে নাঈমের সাথে। একা আসার অনুমতি সে ছেলেটিকে দেয়নি—এই ভয়েই যে, একাকিত্বে হয়তো ভেঙে পড়বে সে, না জানি কী করে বসে! তাদের সম্পর্কের সুতো কতটা জটিলতায় ঘেরা, দুই পরিবারই একসময় তাদের বিবাহের স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হলো যখন কুদ্দুস আলীর নাম খু'নির খাতায় লেখা হলো। হাওয়ার বাবা, এহসান সাহেব, নিষ্ঠুর সত্যকে আলিঙ্গন করে জানিয়ে দিলেন তার সিদ্ধান্ত, একটি খু'নির ছেলের সাথে তিনি মেয়ের বিয়েতে সম্মতি দিতে পারেন না।
কিন্তু হাওয়ার সিদ্ধান্ত অটল। ভালোবাসার শিকড় তো মাটির গভীরে, শুধু পরিচয়ের বহিরাবরণে ম্লান হয় না। নাঈমের পরিচয় যেমনই হোক না কেন, তার প্রতি ভালোবাসা প্রবল, স্থায়ী। আজ বাড়ি থেকে আসতে তাকে অনেক বাধা পোহাতে হয়েছে, কিন্তু হাওয়ার মা,,তাকে সাহায্য করেছেন। যতই তিনি কানিজ বেগমের ভাইয়ের স্ত্রী হোন, তবুও মমতায় যেন তার নিজের বোনের মতো সম্পর্ক কানিজ বেগমের সাথে। তিনি নাঈমকেও নিজের সন্তানস্নেহে বরণ করে দেখে এসেছেন এবং তারও সমর্থন রয়েছে এই দুটি হৃদয়ের মিলনে। তার হৃদয়ের গভীরে সন্তানদের ভালোবাসার জয় তিনি চান, সামাজিক বিধি-বিধানের বেড়াজাল অতিক্রম করেও।
নাঈম অগ্রসর হলো হাওয়ার অভিমুখে, দুর্দম প্রতিজ্ঞা তার কঠিন হৃদয়ে নীরব অভ্যুদয় করেছে। হাওয়া তার উষ্ণ, দীপ্তিময় করতল নাঈমের হিমশীতল, দৃঢ় পাঞ্জায় নিবিড়ভাবে জড়িয়ে নিল। বলল,
——— "চল যাই!"
এ কথায় সূক্ষ্ম কোন অদৃশ্য মন্ত্র উচ্চারিত হলো; উভয়ে পথিকের ন্যায় এগিয়ে চললো। নাঈম, তার বলিষ্ঠ বাহুতে আলিঙ্গিত করল হাওয়ার কাঁধ, এক দুর্নিবার নির্ভরতায় যা অব্যক্ত ভাষায় হৃদয় জাগ্রত করে। পদক্ষেপের তালে তালে হাওয়া উদাসীভরে উচ্চারণ করল,
———" চল, গরম চা খেয়ে আসি।"
নাঈম মৃদু হেসে উঠল, নিঃশব্দ প্রলেপ তার ঠোঁট ছুঁয়ে গেল; সে জানে, হাওয়া তার হৃৎপিণ্ডের ভার লাঘব করতে চেষ্টারত। কোনো কথা বিনা উচ্চারিত রেখেই সে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো চায়ের দোকানের সামনে, যেন এক অদৃশ্য আহ্বানে বন্দী। দু'কাপ তপ্ত চা হাতে নিয়ে তারা বসল ধূসর বেঞ্চির উপর। চারপাশে ছড়িয়ে কনকনে শীতের শীতল কুয়াশা, যা বর্ণহীন চাদরে জড়িয়ে রেখেছে প্রকৃতিকে, এক নীরব রহস্যাবৃত পরিবেশে।
গরম চায়ের বাষ্প কুয়াশার শুভ্রতায় মিশে তৈরি করল এক অদ্ভুত, স্বপ্নিল পরিবেশ। হাওয়া আস্তে করে মাথা রাখল নাঈমের কাঁধে, তার প্রশান্তির আশ্রয়। তার হাতে থাকা ধোঁয়া-উড়ন্ত চায়ের কাপটি পাশে রেখে দিল। তৃষ্ণার্ত চোখে সে তাকাল নাঈমের হাতে থাকা চায়ের কাপে।
নাঈমের চুম্বিত স্থান যেখানে চায়ের স্পর্শ পেয়েছে, সেইখানে হাওয়া নিজের ঠোঁট স্পর্শ করল, নিঃশব্দ আলিঙ্গনে আবদ্ধ হল তাদের হৃদয়ের গূঢ় সুর।
নাঈম হাওয়ার কপালে এক অতি মৃদু, পরম মমতায় আচ্ছাদিত চুম্বন এঁকে দিল; যেন সেই স্পর্শে ধরা থাকল অব্যক্ত অনুরাগের গভীরতা। তারপর, একক চায়ের কাপেই দুজন ভাগাভাগি করে পান করল উষ্ণ সুধা, তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত মিশে গেল নীরব প্রকৃতির শৈবাল-ঘন কুয়াশার অন্তরালে।
চায়ের বাষ্প যখন শেষ স্পর্শে ম্লান হয়ে মিলিয়ে গেল, তখন নাঈম হাওয়ার অবহেলায় রাখা দ্বিতীয় কাপটি তুলে নিল। কুয়াশার শীতল স্পর্শে প্রায় শীতল হওয়া সেই চায়ের শেষ চুমুকেও তারা দুজনে একই ভালোবাসায় অংশ নিল, যেন একাকী শীতলতায়ও জ্বলে উঠল অদৃশ্য উষ্ণতার দীপ।
চায়ের পর্ব শেষে, তারা অনাবৃত, ধীর পদক্ষেপে পথ ধরল গৃহের অভিমুখে। চারপাশের প্রকৃতি নত হয়ে দেখল তাদের নিস্তব্ধ প্রস্থান; প্রতিটি পদক্ষেপ এক সুদূর, নিঃশব্দ আলিঙ্গনের প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসতে থাকল প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপটে।
পথের মাঝপথে, নাঈম আকস্মিকভাবে হাওয়াকে জাপ্টে ধরে গভীরতর আবেগের এক আবরণে আবদ্ধ করল; অন্তরের পাথরপ্রতিম ভার আর অন্তঃস্থলে জমাট বাধা স্রোত সে স্থির রাখতে পারল না। চারপাশে ঘনীভূত কুয়াশার শুভ্রতা এত নিবিড় হয়ে উঠল যে তাদের নিবিড় মিলনের দৃশ্য তামসাচ্ছন্ন প্রকৃতির গর্ভে মিশে গেল। হাওয়া, কোমল স্নেহের ছোঁয়ায় তার আদুরে হাত বুলিয়ে দিল নাঈমের শক্তপৃষ্ঠে, যেন ছুঁয়ে দিচ্ছিল তার গভীর ক্ষত-বিক্ষত আত্মাকে।
নাঈমের তপ্ত, লবণাক্ত অশ্রুবিন্দুগুলো হাওয়ার শালের শুভ্রতা ভিজিয়ে দিয়ে এক অদৃশ্য বেদনার জলস্রোত বয়ে আনল। ভাঙা কণ্ঠের এক করুণ নিনাদে সে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল,
——— "ছেড়ে যাস না!"
হাওয়া, গভীর প্রত্যয়ের কোমল সুরে প্রতিজ্ঞা করল,
——— "কখনোই যাবো না!"
নাঈম যেন ভঙ্গুর আত্মার প্রতিটি খণ্ডে বিশ্বাসের সম্বল খুঁজে ফিরছিল। কণ্ঠস্বর বিষণ্ণ প্রার্থনায় মিশে বলল,
——— "জীবনে কাওকে বিশ্বাস করিনি! শুধু তোকে করেছি! বিশ্বাসের অপমান করিস না। আমাকে মিথ্যা প্রমাণ করিস না!"
হাওয়া আলতো হাতে নাঈমকে নিজের সম্মুখে টেনে আনল, তার লম্বা, বলিষ্ঠ দেহটিকে নিজের কাছে একটু অবনমিত করে। পায়ের পাতা উঁচু করে দাঁড়িয়ে, তার অধর লেগে রইল নাঈমের কপালে এক অনন্ত প্রতিশ্রুতির চিহ্ন রেখে। নীরব এক চুম্বনে সে বলল,
——— "কখনো না!"
সেই মুহূর্তে, প্রকৃতির প্রতিটি কণা যেন তাদের প্রতিজ্ঞার মহিমায় মুগ্ধ হয়ে স্থির হয়ে রইল, সাক্ষী রইল অবিনশ্বর ভালোবাসার এই নিবিড় দৃশ্যের।
অসীম কষ্টের ক্ষণে, যেখানে মনশ্চক্ষু একা- একমাত্র সঙ্গী, সেখানে একটিমাত্র মানবিক স্পর্শের আকুতি হৃদয়কে অনিবার্যভাবে আচ্ছন্ন করে। জীবনের প্রান্তিক বেদনার কালো ছায়ায়, একটি আপনজনের নীরব উপস্থিতিই যেন মহিমাময় প্রাপ্তি। সে হতে পারে প্রণয়াসক্ত কিংবা অমৃতপ্রদায়ক অভিভাবক, আত্মার সঙ্গী, রক্তের সম্পর্ক, কিংবা এক সহৃদয় প্রভঞ্জন বন্ধু—এমন এক জনের আকাঙ্ক্ষা, যাঁর বুকে নীরব সমর্থন। হৃদয়ের কপোল অবনত, অভিমান নত, শুধু আশ্রয়ে বুকে সমর্পণ করে বলুক—"আমি আছি।"
এই শব্দের গভীরতায়ই লুকিয়ে থাকে নিঃশব্দ বোধের সমাপন। বাক্যের মায়াজালে নয়, শুধুমাত্র শিরার রক্ত প্রবাহে আর্তিজন্ম যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ, এক সহৃদয়ের কাঁধে মাথা রাখার আকাঙ্ক্ষা—কিছু শোকের প্রান্তসীমায় আলিঙ্গনখানি বাঞ্ছিত। এতটুকু মাত্র; আর কিছু নয়, সত্যি!
___________________
পরবর্তী কিছুকাল স্রোতের মতই বয়ে গেছে। শীতের করাল থাবা এমনই তীব্রতায় প্রবল হয়েছে যে, এক হাত দূরত্বেও মানুষটিকে দেখা যেন পরাবাস্তব কল্পনার মতোই অবাস্তব। মহাকুয়াশার শ্বেত আস্তরণ সবকিছুকে গ্রাস করে রেখেছে। আজ আঁখির কলেজের ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের চূড়ান্ত পরীক্ষা অন্তিম পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। শ্রেণিকক্ষে সে পরীক্ষার সমাপ্তি ঘোষণা করে বোর্ডের খুঁটিনাটি মুছছে, কিন্তু হৃদয়টি দুঃসহ ভার বহন করছে।
আছিয়া, যে এককালে তার জীবনের ছায়াসঙ্গী হয়ে উঠেছিল, কেন যেন নিঃশব্দে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, সংলাপের প্রবাহে এক শুষ্ক মরু রচনা করেছে। প্রয়োজনের বাইরে কথার দিশা হয় না তার। যেন এক অজানা দূরত্ব বিস্তৃত হয়েছে, এক রহস্যময় বিচ্ছেদ উন্মোচিত হয়েছে। কেমন পরিবর্তিত হয়ে গেল মেয়েটি!
আঁখির চাচার খু'নি হিসেবে ধৃত হওয়ার অপবাদ কি এই বিষাদাবহ বিচ্ছেদের উৎস? নাকি হৃদয়ের অব্যক্ত ভালোবাসায় দহন হতে হতে আছিয়া নিজেকে আত্মসমর্পিত নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্বে ডুবিয়ে ফেলেছে? যে আবেগ গভীরে গুমরে ম'রছে, তাকে বোবা যন্ত্রণার বি'ষবাষ্পে ভাসিয়ে নিয়েছে?
মিলি আর পরীক্ষায় উপস্থিত হলো না। সে গৃহিণীর ভূমিকায় প্রবেশ করেছে, বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সংসারের কাজকর্মে নিমগ্ন। ফোনের ওপারে তার খিলখিল হাসি যেন এক সরল সুখের প্রতিধ্বনি হয়ে বাজল। বলল, পড়াশোনা তার দ্বারা আর হবে না; স্বামীর সান্নিধ্যে সংসার সে দিব্যি উপভোগ করছে! পড়ার পিছুটানে মন দেয়ার অর্থ কী? আঁখি শুনে কেবল হেসেছে। আর বলবেই বা কী? যে কথা ও সুখানুভূতির অতীত, তা মন্তব্যে বর্ণিত হতে পারে না।
অন্যদিকে, আরাফের চেহারায় গাম্ভীর্য ক্রমশ জমাট বাঁধছে। তার হাসি যেন দুর্লভ হয়ে উঠেছে, স্বভাবতই চোখ-মুখ সর্বদাই এক অভিমানী লালচে আভায় আবৃত। কিন্তু আঁখি যখন সামনে থাকে, তখন তার মুখে সামান্য হাসির রেখা খেলে যায়, অজান্তেই। এদিকে, সবকিছুই এক অমোঘ চক্রে চলে যাচ্ছে, একদম স্থির, নিরুপদ্রব। জীবন একটি ধূসর মেঘমালা, যার মাঝে সুখের মৃদু ঝলক তবু ক্ষণিকের জন্য উঁকি দেয়।
আঁখির পাশ দিয়ে আছিয়া যেতেই আঁখি মৃদু স্বরে ডাকল,
——— "এই আছিয়া? দাঁড়া, একসঙ্গে যাই!"
কিন্তু আছিয়া সামান্যতমও পিছু ফিরল না। নিস্পৃহভাবে কেবল বলল,
——— "আমার তাড়া আছে।"
আঁখি দুঃখে বিদীর্ণ হৃদয় নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইল, অবাক হয়ে ভাবল, এই হঠাৎ বদল কেন? আছিয়ার এমন বিচ্ছিন্নতা কেন এত গভীর হয়ে উঠল? চারপাশের সহপাঠীরা একে একে প্রস্থান করছে; ক্লাসরুম শূন্য হয়ে পড়ছে। আঁখি আর কীই বা করবে? ম্লান হাসিতে নিজেকে সামলে নিয়ে পা বাড়াল।
কিন্তু দরজার কাছে পৌঁছাতেই সামনে এসে পথ রুদ্ধ করল আরাফ। আঁখির ভ্রু কুঁচকে উঠল। আরাফের মুখে বিষাদের ছাপ, চোখে গভীর উদ্বেগ। চারপাশের কোলাহল সে উপেক্ষা করল, তার কণ্ঠস্বর করুণ ও আর্জনময়,
——— "কথা বলতে চাই! একা! ক্লাসে থাকো।"
আরাফ এক ধীর অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে আসতেই আঁখি সামান্য পিছু হটল। আজকের আরাফকে যেন অন্যরকম লাগছে, তার এই পরিবর্তন গত কয়েকদিন ধরেই আঁখির চোখে পড়েছে। কৌতুকময় ভঙ্গি বা খুনসুটির কোনোরূপ আভাসও আজ তার কথায় অনুপস্থিত; কণ্ঠে গম্ভীরতার সুর নেমে এসেছে।
আঁখি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল, এক অদ্ভুত অস্থিরতায় আচ্ছন্ন। হয়তো আছিয়ার আচরণে এমন পরিবর্তনের রহস্য এখান থেকেই জানা যাবে, এই ভাবনায় সে অপেক্ষা করতে থাকল। ধীরে ধীরে ক্লাসরুমটি খালি হয়ে গেল। একে একে সহপাঠীরা বেরিয়ে গেল, তবে যাওয়ার আগে অনেকেই কৌতূহলভরে আরাফ ও আঁখির দিকে একবার চেয়ে দেখল।
কারণ কলেজজুড়ে সবারই নজরে পড়েছে যে আরাফ, এক শিক্ষকের গণ্ডির সীমা অতিক্রম করে, আঁখির প্রতি অস্বাভাবিক যত্নশীল হয়ে উঠেছে। তার দৃষ্টিতে অতিরিক্ত স্নেহ, যা কোনো সাধারণ শিক্ষক-ছাত্রীর সম্পর্ককে ছাড়িয়ে গেছে। আজ দুজনেই যখন হঠাৎ করে খালি ক্লাসরুমে একত্রে দাঁড়িয়ে রইল, সন্দেহ আর কৌতূহল মনের গভীরে অঙ্কুরিত হতে শুরু করল সবার।
মৃদু ফিসফাস, চাপা হাসির গুঞ্জন, আর কৌতূহলপূর্ণ চোখের চাহনি—সব মিলিয়ে এক রহস্যময় পরিস্থিতি তৈরি হলো। তবুও, নিজেদের কৌতূহল দমিয়ে রেখে সকলেই ধীরে ধীরে প্রস্থান করল। একে একে বেরিয়ে যেতে যেতে ফাঁকা করে গেল পুরো ক্লাসরুম, তাদের ফিসফাসগুলো বাতাসে মিলিয়ে গেল, রেখে গেল এক নিস্তব্ধ পরিবেশ, যেখানে শুধু আরাফ ও আঁখি রয়ে গেল, সময় যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে।
আঁখি সঙ্কুচিত কণ্ঠে বলল,
——— "আছিয়া..."
আরাফ ধীর পায়ে এগিয়ে এলো, তার উচ্চতা আঁখির সম্মুখে ছায়াসম এক নিঃশব্দ বিস্তার। মাথা সামান্য ঝুঁকে আবেগভাস্বর চাহনি নিয়ে বলল,
———" আমাকে ভালোবাসো?"
আরাফের র'ক্তাভ মুখের উপর গভীর সঙ্কল্পের ছায়া, সুগঠিত ধবল মুখাবয়ব র'ক্তবর্ণের পুষ্প ফুটিয়েছে। দুটি চোখ টলমল করে ওঠে—তবে তাও থামিয়ে রেখেছে সে, একটি অদৃশ্য প্রাচীরের অন্তরালে। খোচা খোচা দাড়ির শ্লেষ, যেনো দুর্দম উন্মাদনায় বেড়ে ওঠা কোনো অপরাজেয় বন্য বৃক্ষ। মাথার চুল, দীর্ঘ ও অগোছালো, ঘাড়ের কাছ অবধি এসে তাকে ঘিরে রেখেছে এক আদি প্রাচীন সুরক্ষাকবচের মতো। আরাফের এমন প্রশ্নে আঁখি মৃদু বিস্ময়ে থমকে দাঁড়ায়। নিঃশব্দের ভারী পরিসরে কিছুক্ষণের নীরবতার পর সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আরাফকে নিরীক্ষণ করে বলল,
——— "এ প্রশ্নের উত্তর তো আপনার জানা, স্যার।"
আরাফের কন্ঠে ব্যথার তীক্ষ্ণ কম্পন ঝরে পড়ল,
——— "আজ আর লুকোচুরি নয় আঁখি! আজ সরাসরি সব খুলে বলো! বলো না, ভালোবাসো আমাকে?"
আঁখি নিরুত্তর, গম্ভীর অভিব্যক্তিতে পেছন ফিরে দাঁড়ালো। এক লহমার জন্য সেই মুখের অটল কঠোরতাই তার সিদ্ধান্তের সংকেত। তারপর অতি সংক্ষিপ্ত অথচ শীতল কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
———" না।"
একটি ক্ষুদ্র শব্দ, কিন্তু তাতে আরাফের হৃদয়ে প্রলয়-আঘাত নেমে এলো, অদৃশ্য কোনো অজগরের প্যাঁচে বন্দি হয়ে গেলো তার বক্ষ। অনুভব করল, রক্তস্রোত শুষে নিচ্ছে কারো আকর্ষণশক্তি। যন্ত্রণার এই আকস্মিক চাপে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হলো তার। তবু সেই দুঃসহ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে আঁখির পেছনে এসে, কান ঘেঁষে উত্তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বলল,
——— "তবে কি অন্য কাউকে ভালোবাসেন, ম্যাডাম?"
আরাফের কণ্ঠে তীব্র আবেগের ভারে গলা যেনো আটকে এলো, কথা কাঁপছে, তবু সেসব শব্দ অবিচল প্রস্তরের মতো ভাঙতে চাইছে। আঁখি ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো আরাফের চোখের দিকে—সেখানে অজস্র অলঙ্ঘনীয় আবেগের বন্যা। আঁখি শীতল অথচ স্পষ্ট উচ্চারণে বলল,
——— "না!"
আরাফের মুখে তখন এক নিস্তেজ হাসির আভাস ফুটে উঠল। গভীর বেদনার সেই হাসি যেনো সমস্ত অস্তিত্বকে ছিন্নভিন্ন করে। সংযত কণ্ঠে বলল,
——— "তবে চিঠির আশায় কেন এতো প্রতীক্ষায় বসে থাকো?"
আঁখি থমকে গেল, স্তব্ধতা তার সমস্ত চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। আরাফ সেই নিবিড় ভঙ্গিতেই নত হয়ে থেকে মৃদু মুচকি হাসল, তারপর বলল,
——— "হয়তো তুমি ভুলে গিয়েছো, আমি তোমার পিছু সর্বদা রয়ে যাই, যতটুকু অবসর পাই। তবে তোমাকে আমি দেখেছি, নির্দিষ্ট একদিন পুকুরপাড়ে, একটি কাগজের প্রতীক্ষায় বসে থাকতে। কি ভেবেছিলে, ওই শিশুদের আর বুড়োদের আমি জিজ্ঞাসা করিনি? হ্যাঁ, কিছুই জানতে পারিনি,তাদের বোবা আর অন্ধ ভাষা কিছুই প্রকাশ করেনি। তবু, আমি দেখেছি তোমায়, অপেক্ষায় নিমজ্জিত সেই প্রতীক্ষায় স্থির বসে ছিলে। বলো, কেন অপেক্ষা করেছিলে ঐ পত্রখণ্ডের জন্য?"
আঁখির অন্তর বিধ্বস্ত, চূর্ণবিচূর্ণ, নির্বাক তার মনোজগৎ,শব্দেরা মুহূর্তে শূন্য হয়ে গেছে। আরাফের ঠোঁটে করুণ এক হাসি, অথচ সেই লালচক্ষু তার হৃদয়ানুভূতির ভয়ঙ্কর গভীরতা প্রমাণ করছে। সে শ্যামবর্ণার মুগ্ধতায় বুঁদ হয়ে আছে, তার অনিমেষে তাকিয়ে থাকা যেন এক নিরাবেগের আকুতি। মুহূর্তের নিস্তব্ধতায় আরাফ মুখ খোলে
———“আমি তো পরাজিত,,,, আঁখি। হ্যাঁ, আমি,,, নিঃসন্দেহে ব্যর্থ! হেরে গিয়েছি আমি,,,,, তোমার হৃদয়ের দ্বার রুদ্ধ, আমাকে গ্রহণের সাহস নেই তাতে। আমি,,, আঁখি,,, আমি শর্তহীন পরাজিত,,,, আমি তোমায় নিজের করতে পারিনি! আমার হৃদয়ে দুরারোগ ব্যথা গাঁথা,,,, অনন্তকাল সেই বেদনার ভার বহন করতে হবে।”
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে, বিষাদগ্রস্ত স্বরে আরাফ উচ্চারণ করে। আঁখি দু’হাত মুখে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল, সকল আবেগ ঝরছে অনির্বচনীয় কষ্টের মাঝে। তার অন্তর জেনেছিল এমনই এক বিষাদময় প্রতিধ্বনি তার জীবনভাগ্যে বাধা, বারংবার সে আরাফকে সংযমের পথনির্দেশ করেছে, অথচ আরাফ বুঝেও বুঝতে চায়নি, শুধুমাত্র তাকে অনুসরণ করে গেছে অসহায়তায়।
আঁখির এই কান্নায় এক তীব্র স্নেহ ঝরে পড়ল আরাফের অন্তর থেকে। কাপা কাপা হাতে সে আঁখির চোখের জল মুছিয়ে বলে উঠলো,
———“চুপ! কেন আমার সামনে অশ্রুবর্ষণ করছো? হুঁ? চুপ করো, দুষ্টু মেয়ে! তোমার কাছে কি আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, শুধুই অশ্রু?”
এ কথা বলে সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াল, কিন্তু নিজের অদম্য কষ্টে অশ্রুবিন্দু ঝরে পড়ল তার চোখ থেকে, নিঃসীম এক অন্ধকারে হারিয়ে গেল তার মনের আবেগ।
আঁখি গভীরতম বেদনাকে আর আটকে রাখতে পারল না; শব্দ করে কেঁদে উঠল, কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,
——— "বারবার, বারবার আপনাকে বলেছি,,, আ-আমার পিছু করবেন না! কেন করবেন না বুঝেন না? বারংবার বলেছি, ভালোবাসি,,, না আমি আপনাকে,,,! শুনেছেন আপনি? এ-একবারও শুনেছেন? কেন, কেন আজ ভেঙে পড়লেন? কেন? আমার সামনে এসে কেন ভাঙছেন?,,,,কেন আমাকে এমন অপরাধীর আসনে বসাচ্ছেন? যেন আপনার এই ভগ্ন হৃদয় আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে মা'রে!,,, যেন আ-আমার হৃদয় চূর্ণ হয় অপরাধবোধে!,, যেন আমি,,,,, আমি নিজেই বি'ষাক্ত অপরাধবোধের হাতে নিঃশেষ হয়ে যাই?"
আরাফ ধীর পায়ে ফের আঁখির দিকে ফিরে দাঁড়ালো, এবার আর চোখের জল আড়াল করার প্রয়োজন বোধ করলো না। আজ না দেখালে আর কবে দেখাবে? তার হৃদয়ের অশ্রুজল আজ যেন কিছু বলছে, কিছু ব্যথার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে চাচ্ছে। একটি করুণ হাসি তার ঠোঁটে ফুটে উঠল,
———“এই অশ্রুজল, এই কান্না, এই মর্মযাতনা, এটুকু কি কেবল আমার নামেই উৎসর্গিত?”
আঁখি নির্বাক; তার ঠোঁট আর কোনো বাক্য উচ্চারণ করতে পারে না। আরাফের কণ্ঠ যেন এক অসহায় অভিমান নিয়ে পুনরায় উদ্ভাসিত,
———“বলবে না? এই কান্না কি আমার জন্যেই?”
আঁখি কোনো প্রতিউত্তর দিতে পারল না; ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, তার মস্তিষ্ক অবশ হয়ে ব্রাঞ্চে ধপ করে মাথা রেখে বসে পড়ল। কত অপরাধবোধ তার অন্তরের গভীরে গেঁথে গেছে, পুরোনো সেই সব অনুভূতির ভার এখন আরও গভীর হয়ে উঠেছে। এবার আর নতুন করে সেই যন্ত্রণার বোঝা সহ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
আরাফকে এভাবে বিধ্বস্ত হতে দেখতে তার পক্ষে আর সহ্য করা যাচ্ছে না। সে মেনে নিক বা না নিক, জানে যে এই মানুষটা সত্যিই তাকে হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে ভালোবেসেছে।
আরাফ কনকনে ঠান্ডা মেঝেতে হাটু গেড়ে বসে পড়ল, যেন সমস্ত অভিমান, সমস্ত আশা এক ফোঁটা চোখের জলে মিশে গেল। কণ্ঠে এক নিঃসীম বেদনার প্রতিধ্বনি, আর সেই প্রতিটি শব্দ যেন আঁখির হৃদয়ের গভীরে স্পর্শ করে।
———"যদি এই কান্নাটুকু আমার নামেই হয়, তবে কেঁদে যাও, আঁখি। অন্তত এটুকু তো আমার নামেই হোক তাহলে। আমার জন্য।"
তারপর সে আঁখির সামনে নত হয়ে বসে উপরে মুখ তুলে চাইল, চোখে এক ব্যাকুল মায়ার ঝলক,
——— “কি করবো, ম্যাডাম? ভালোবাসি তো! তাই আপনার সেই অনবরত নিষেধও মেনে চলতে পারিনি; বারবার পিছু নিয়েছি। আপনি ভালোবাসেন বা না বাসেন, আমি তো বাসি! হ্যাঁ, জানি, সবার সব চাওয়া পূর্ণ হয় না,,,,,,আমারও হয়নি। ইচ্ছা ছিল,,,, আপনাকে একান্তে নিজের করে রাখার, বুকের গভীরে লুকিয়ে রাখার। কিন্তু, আপনি তো,,, অন্য,,, কারো….”
আরাফের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো, সেই বিষাদময়তা গলার গভীরে আটকে গেল। কষ্টের মাঝেও এক করুণ হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে,
———“দেখেছেন, অন্য কারো কথা ভাবতেই পারি না আমি! কি নিদারুণ পাগল আমি, আঁখি! হয়তো এটাই আমার দোষ, এই ভালোবাসাই আমার অপরাধ।”
আঁখি দুই হাতে কান চেপে ধরলো, আর একটিও শব্দ শুনতে চায় না, আর কোনো ব্যথার ধ্বনি হৃদয় ভেদ করে তাকে আঘাত করুক, এ আর সহ্য হয় না! অথচ আরাফের ঠোঁটে এক ম্লান হাসি ফুটে উঠল, ব্যথা আর মমতায় পূর্ণ। সে বলল,
———“একটুখানি তাকাবেন, ম্যাডাম! একটুখানি…।”
কিন্তু আঁখি কোনো প্রতিউত্তর দিল না, মাথা তুললো না, কেবল কান্না জড়িয়ে যাচ্ছে তার কণ্ঠে। আরাফ ব্যাকুল কণ্ঠে আবার বলল,
——— “শেষবারের মতো একটু তাকাও, আঁখি। একটিবার! একটুখানি দেখার সুযোগ দাও, আর কোনোদিন তোমায় বিরক্ত করবো না। কথা দিলাম, কখনও আর সামনে আসব না।”
তবুও আঁখি মুখ তুলে তাকালো না। আরাফের চোখে এক তীব্র হতাশার আলো ফুটে উঠল। সে হেসে, নিজেকে সামলে, ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। সেই মুহূর্তে তার হৃদয়ের সমস্ত ভার মাটিতে বিলীন হয়ে গেল। আঁখির মাথায় কোমল হাতে হাত বুলিয়ে বলল,
———“হয়েছে তো, ম্যাডাম! এত কান্না কেন? এত কষ্ট দিয়ে আর শাস্তি দেবেন না”
নীরবতার মেঘমালা কেটে গিয়ে ক্লাসরুমের ভেতর আঁখির গভীর ক্রন্দনধ্বনি সুরের মতো প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। ব্র্যাঞ্চের ওপরে অবনত মাথা রেখে পৃথিবীর সমস্ত পা'পবোধ তার বুকের মধ্যে জমে উঠেছে। অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা আরাফ অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে নির্বাক, আঁখির ফুপানোর প্রতিটি ঢেউ তার হৃদয়ে বেদনার তরঙ্গ তৈরি করছে। ক্লাসরুমের ঐ শুন্যতায় দুজনের শোক গভীর নীরব বোধের গান গাইছে।
অবশেষে আঁখি ক্রমশ কম্পমান দৃষ্টিতে মাথা তুলল। অশ্রুজলে ভিজে যাওয়া কণ্ঠে সে বলল,
——— "ক্ষমা করুন আমায়…আ-আমি,,,কখনো আ-আপনাকে,,,ক,,কষ্ট দিতে চাইনি!!,, আমি,,,আমি তো চেয়েছি,,,আ-আপনি ভালো থাকুন সবসময়!!! কিন্তু,,,,আপনি যা চেয়েছেন,,,,,ওটা,,,আমি,,, আমি আর অপরাধীর এই অভিশপ্ত মুকুট পরিধান করে থাকতে পারছি না…,"
আরাফ একবার চোখ মুছে অশ্রুসিক্ত হাসি মেলে বলল,
——— "হয়েছে মেডাম! কে অপরাধী করেছে, শুনি? হুম? কেউ অপরাধী নয়! চিন্তা করবেন না, মেডাম! আর কষ্টে ভুগবেন না! আমি চলে যাবো, বহুদূরে, এমন স্থানে যেখানে আমার অস্তিত্ব আপন ভুবনে একেবারেই তুচ্ছ হয়ে যাবে!
সে মৃদু চোখ বুজল, নিজের তর্জনী ঠোঁটে ছোঁয়াল, তারপর তা নিঃশব্দে আঁখির কপালে রাখল। বেদনামাখা স্বর ধ্বনিত হলো,
——— "এই কপালের অধিকার আমার নয়, এ অধিকার আমার ঠোঁটের নিকটে কখনো আসবে না!"
বুকের অগোচর বেদনা সয়ে আঙুল সরিয়ে নিঃশব্দে চলে গেল আরাফ। দরজার সামনে এসে শেষবারের মতো পিছু ফিরে আক্ষেপমাখা দৃষ্টিতে তাকাল, সেই শ্যামাঙ্গী প্রেয়সীকে হৃদয়-ছিন্ন ক্ষণে মুছে রাখতে চায়, অশ্রুজলে তাকে ক্রন্দিত দেখার দৃশ্য তার অন্তরে দহন ছড়িয়ে দেয়। ভাঙা কণ্ঠে বলে উঠল,
——— "তবুও, যদি কখনো আমার প্রয়োজন হয়, আমাকে ডেকো; কেবল স্মরণ করো, আমি আসব! আঁখি, শুনেছো? মৃ'ত্যু অবধি, এমনকি মরণোত্তরও যদি আমাকে ডাকার প্রয়োজন হয়, আমি থাকবো, তোমার জন্যে! ভালোবাসি তোমাকে, মেডাম।"
এই বলে, আরাফ অসংলগ্ন পদক্ষেপে অদৃশ্যের পথে পা বাড়াল, রেখে গেল নিঃসঙ্গতা আর নিঃশব্দ ক্রন্দন!
---
কখনো কখনো প্রেমের কাছে আত্মসমর্পণ অবধারিত। ভালোবাসা কোন চুক্তির দাস নয় যে, আমি তাকে ভালোবাসি বলে সেও আমায় ভালোবাসতে বাধ্য! শব্দে লেখা “ভালো” শব্দটিতেই রক্ষিত রয়েছে আত্মতৃপ্তির নির্যাস। প্রিয়জনের সুখেই যে মিলে শান্তি, সে নিজের হোক কিংবা অন্যের পাশে! সত্যিকারের ভালোবাসা কেবল আত্মদানেই পরিপূর্ণ, সেখানে শ্রদ্ধা আর মর্যাদার পরিস্ফুটন।
এই জগৎ বহু উপায়ে বিক্রয়যোগ্য হলেও ভালোবাসা একমাত্র সেই স্থান, যেখানে অর্থ কিংবা ক্ষমতার প্রয়োগ অকেজো। টাকায় সুখ হয়ত কিনতে পারো, কিন্ত শান্তির সেই অমৃত কেমন করে খুঁজে পাবে? একান্ত আরাধ্য শান্তি যে শুধু ভালোবাসাতেই মেলে, যা সবার কপালে অনুকূল নয়। অথচ যাদের কপালে ভালোবাসার শ্রীফল টুটে তারা এর মূল্যায়ন করে না। পৃথিবীর এমনই এক শাশ্বত পরিহাস চলমান।
_____
বিচলিত পদক্ষেপে আরাফ গমন করছে, গৃহপানে নয়, বরং রেলস্টেশনের দিকে। বহু আগেই তার অন্তর্গত সংকল্প স্থির হয়েছিল; নির্ধারিত ছিল প্রতিটি পদক্ষেপ, মৌন প্রতিজ্ঞার গোপন আয়োজন! হঠাৎ শহর অভিমুখে তার এই অভিযাত্রার বার্তা গৃহে পৌঁছাতেই কেঁদে ওঠে সমগ্র পরিবার; কান্নার বেদনায় আছন্ন তাঁদের হৃদয়, সর্বত্রই হুলস্থুল কাণ্ডের মহোৎসব। আজ সন্ধ্যার গাঢ় নীল অন্ধকারে রওনা করবে সে, সঙ্গে হাতে ধরা এক নির্বিকার টিকিট, নির্ধারিত গতির চূড়ান্ত প্রমাণ।
পিতৃদ্বয়, বাবা ও চাচা, গাড়ির অভ্যন্তরে নির্বাক অপেক্ষারত, তাঁদের হৃদয়ে উদ্বেগের গূঢ় কাঁপুনি, যেন এই অবধি যতিচিহ্ন নেই চিন্তার প্রবল প্রবাহে। এই অকস্মাৎ প্রস্থানের হেতুতে তাঁদের মনের মুকুর ভেঙে গেছে! তাঁরা জানেন না, এই চলে যাওয়ায় আরাফের মনোভাবের সেই গহীন বেদনা, যা তাঁরা কোনোদিনও অনুভব করতে পারবেন না।
কিন্তু, প্রকৃত সত্য জানে কে? হৃদয়ের অন্তরালে সঞ্চিত সেই অমোঘ অভিপ্রায়, যদি আজ আঁখি তার প্রণয়ের নিবেদন গ্রহণ করত, তবে কি সে এই টিকিটের বিনাশ ঘটিয়ে এক টুকরো কাগজের অমূল্যতায় তাকে নিঃশেষ করে দিত না? হয়তো একমুহূর্তে প্রতিজ্ঞা করত বিবাহের, বেঁধে ফেলত জীবনের অনন্ত সুতোর বাঁধনে। এতদিন সে কিছু বলেনি আঁখিকে, কেবল মেয়েটির নিরন্তর পরীক্ষার ভারে তাকে অযথা ভারাক্রান্ত করতে চায়নি।
আগেই স্থির করে রেখেছিল, যদি আঁখি তার প্রেম প্রত্যাখ্যান করে, তবে এই গ্রাম পরিত্যাগ করাই হবে তার নিয়তি। নয়তো এই অবাধ্য মন, একবার আবারও বেঁধে ফেলবে তাকে, সেই কিশোরী শ্যামলিকার শ্যামল ছায়ায়, এক অন্তর্নিহিত টান যা তাকে পুনর্বার টেনে নেবে তার নিকট।

Post a Comment

0 Comments

Close Menu