লেখিকাঃ সাবিহা জান্নাত
পর্বঃ ০২
সূর্য মামা উঁকি দিয়েছে সবেমাত্র। বিভোর ভোরে ঘুম থেকে উঠেই জিমে বেরিয়েছে। লম্বা, ফর্সা, বডি ফিট দেহের বলিষ্ঠের মানব, নজরকাড়া রুপ, চুলগুলো কপালে এসে বিঁধেছে, বেশ টানাটানা চোখগুলো সবটাই নজড় কাড়া।
মুখে তার কিঞ্চিত হাঁসি।কেউ আড়চোখে তাকিয়ে আছে আবার কেউ বা কাছ থেকে থেকেও তাদের মন কেড়েছে নজড়কাড়া সুপুরুষ।
বিভোর জিম থেকে ফিরে আসার জন্য রওনা হয়। বাসা থেকে স্বল্প দূরত্বের মধ্যে হওয়াই সে হেঁটেই বেরিয়েছিল । বাসার নিকটে প্রায় এসেই গিয়েছে সে।
আনমনে হাঁটতে গিয়ে আচমকা কারো সাথে ধাক্কা লেগে মাটিতে দুইজনেই পড়ে যাওয়ার উপক্রম, তখন ই বিভোর মেয়েটার হাত টেনে ধরতেই সজোরে বিভোরের বুকের সাথে ধাক্কা লেগে দুইজনেই রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে।
বিভোর মাটিতে পড়লেও মেয়েটা বিভোরের বুকের উপর পড়ে যায়। মেয়েটা পড়ে যেতেই অস্ফুট স্বরে আর্তনাদ করে চোখ বন্ধ করে ফেলে।
বিভোর চোখ খুলে বুকের উপর পড়ে থাকা রমনী কে দেখেই চমকে উঠে,,,,,
~ শ্রুতি...! শ্রুতির সাথে তার এভাবে দেখা হবে সে কখনো ভাবতেও পারেনি। গল্পটার যেখানে সমাপ্তি টেনেছিল, তারপর কখনো শ্রুতির মুখোমুখি হওয়ার কথা কখনো আশা করেনি বিভোর।
কিছু সময় পর শ্রুতি চোখ খুলে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে তার মুখ দর্শন করতেই তার চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায়। বিভোর কে শুরুতে দেখলেও শ্রুতি অবাক হলেও এখন সে ঘৃনায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
বিভোরকে ছেড়ে দিয়ে বুকের উপর থেকে উঠে এদিক সেদিক না তাকিয়ে সোজা বাসার দিকে হাটা দেয় শ্রুতি। শ্রুতির চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়েছে বিভোর। কাজলতার চোখে তার জন্য এখন ঘৃনা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
খুব ভোরের কারনে রাস্তায় কাক পক্ষী ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব নেই।একটু দূরে একটা চায়ের টং সেখানে দুই একটা মানুষ মাত্রই ভীর জমিয়েছে। তবে দৃশ্য টা তাদের অগোচরে।
বিভোর রাস্তার অপর পাশে শ্রুতিদের বাসার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেদের বাসার দিকে রওনা দেয়।
রাস্তার এই পাশে এবং অপর পাশে দুইটা দুইতলার রাজকীয় বাসা। মাঝখানে শুধু রাস্তা । রাস্তাটা তাদের দুটি বাসা আলাদা করে রেখেছে।
বিভোর নিজের বাসার মধ্যে প্রবেশ করতেই তার আম্মু এক মগ কফি এগিয়ে দিতেই,,
~ খাবো না আমি। বিভোর স্পষ্ট জবাব দিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। বিথী চৌধুরী ছেলের চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়েছে। আমি কোনো ভুল করে ফেললাম না তো। নিজের ছেলেকে ই হারিয়ে ফেললাম না তো। এসব নানা প্রশ্ন বিথী চৌধুরীর মনে উদ্ভব হতে থাকে।
উপস্থিত সবাই বিভোরের এমন বিয়েভে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সবার মনে একটাই প্রশ্ন জাগতে থাকে, বিভোর তো কখনো এমন ছিল না। তাহলে কি তিন বছরের রাগ জমে অভিমানের পাহাড় হয়ে গেছে।
বিভোর নিজের রুমের মধ্যে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় বসে রয়েছে। বার বার শ্রুতির ঘৃনা ভরা দৃষ্টি চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সে কিছুতেই সেটা মেনে নিতে পারছে না। তার বুকের বা পাশটায় শুন্য শুন্য লাগছে। ব্যাথায় আর্তনাদ করছে তার হৃদয়।
সে ঘরের জিনিসপত্র এদিক সেদিক ছুড়ে ফেলছে। চোখগুলো রক্তিম বর্ন ধারন করেছে। রাগে তার চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
~ আমি পারিনি আমার অনুভূতি গুলো কে কবর দিতে। বার বার তোমার স্মৃতি গুলো আমাকে বড্ড যন্ত্রণা দিচ্ছে। তুমি একবার ফিরে আসো।আমি আবার ও তোমাকে আগলে রাখতে চাই ।
বিভোরের অনুভূতি গুলো চিৎকার করে জানান দিতে চাইছে শ্রুতিকে। কিন্তু সে নিরুপায়, শ্রুতির কাছে যেতেও পারছে না আবার তাকে ছাড়া থাকতেও কষ্ট হচ্ছে।
বিভোরের ঘরে জিনিসপত্র ভাঙচুরের শব্দ শুনতে পায় তার দিদুন সারোরা চৌধুরী। নাতির রাগ সম্পর্কে তার ধারনা খুব স্পষ্ট।
~ দাদুভাই কি হয়েছে তোমার। দাদুভাই দরজা খুলো। সরোরা চৌধুরী সে বিচলিত হয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে দরজা ধাক্কা দিয়ে বিভোরের উদ্দেশ্যে বলে উঠে।
বিভোর স্থীর হয়ে বসে রয়েছে বিছানায়। সে অনুভূতিহীন হয়ে গেছে। তার মনটা থেমে গেছে এক রমনীর জন্য। যতটা সে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে সব ভুলে কিন্তু ভুলগুলো তাকে বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে স্মৃতি গুলো।
অনেক বার ধাক্কাধাক্কি করার পর বিভোর চোখের পানি গুলো মুছে দরজা খুলে দেয়। ততক্ষনে পরিবারের সব মহিলারা এসে উপস্থিত হয়েছে। সরোরা চৌধুরী নাতির ঘরে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দেয় বাকীরা বাহিরেই অপেক্ষা করছে।
সরোরা চৌধুরী নাতির গায়ে বুঝিয়ে দিয়ে বোঝাতে থাকেন,, দাদু ভাই তুমি রাগারাগি করো না। আমি বড় বউমাকে বুঝিয়ে বলবো। তুমি এখানেই থাকো , কোথাও যেতে হবে না তোমার।
সরোরা চৌধুরী নাতিকে অনেক বুঝিয়ে শান্ত করেন। বিভোর কিছুটা শান্ত হলে সরোরা চৌধুরী নাতির রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
বিভোর তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বিভোর রাগ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে। সে স্বাভাবিক হয়ে আছে।

শ্রুতি বিষয়টি নিয়ে কোনো মাথা ঘামায় না। বিভোরের বিষয়ে সে না কোনো কথা শুনতে চায় না কখনো ভাবতে চায় তাকে নিয়ে। মন থেকে উঠে যাওয়ার পর কখনো ফিরে তাকাতে ইচ্ছা করে আর। শ্রুতি সেটাই পণ করে নিয়েছে মনে মনে।
সকালের নাস্তা সেরে শ্রুতি কলেজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে সে সবেমাত্র। বিভোর বাইক নিয়ে বেরিয়েছে বন্ধুদের সাথে মিট করার জন্য। রাস্তায় দুজনের চোখাচোখি হতেই শ্রুতি অন্য দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।
একটা রিক্সা ডেকে নিয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সে এর মাঝে একটিবার ও বিভোরের দিকে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করেনি ।
রিক্সা চলছে আপন মনে।শ্রুতি চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। বিভোর পেছনে পেছনে বাইক নিয়ে আসছে শ্রুতি বুঝতে পেরে সে চুপচাপ বসে থাকে কোনোদিকে না তাকিয়ে।
অতীত

তপ্ত দুপুরে ২ ঘন্টা যাবৎ রোদ্রে দাঁড়িয়ে শ্রুতি অপেক্ষা করছে বিভোরের জন্য। কিন্তু বিভোরের দেখা নেই। এতোক্ষণে শ্রুতির রাগ মাথায় চড়ে বসেছে। নিজের রাগগুলো ফুঁসে রেখে উল্টো দিকের রাস্তায় হাটা ধরতেই শ্রুতির হাতে টান পড়ে।
বিভোর এসেছে। শ্রুতি বিভোরের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রাস্তায় হেঁটে চলে যায় শ্রুতি। বিভোর শ্রুতির পেছনে পেছনে ছুটছে।
~ আরে, দাঁড়াও। ওই দিকে কই যাচ্ছো। বাসা তো এদিকে। বিভোরের কথায় শ্রুতির রাগ বেড়েই চলেছে। রাগে কান দিয়ে তার ধোঁয়া বের হচ্ছে। রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে এখন এসেছে তার সাথে কথা বলতে । শ্রুতি বিভোর কে পাত্তা না দিয়ে অচেনা রাস্তায় চলে যাচ্ছে।
বিভোর শ্রুতির হাত ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে । শ্রুতি বাহুডোরে শক্ত করে আবদ্ধ করে রেখেছে। শ্রুতি বিভোরের শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজেও শান্ত হয়ে যায়।
~ বললাম তো সরি। আমার ভুল হয়ে গেছে , আর কখনো এমন লেট হবে না। তুমি শান্ত হও। অনেক আগেই বেরিয়েছিলাম তোমার সাথে দেখা করার জন্য কিন্তু ফ্রেন্ডরা ইচ্ছে করেই আমাকে আঁটকে রেখেছিল। আর কখনো এমন হবে না সরি।
শ্রুতি বিভোরের শান্ত মস্তিষ্কের কথা শুনে শান্ত হয়ে যায়। তবে মুখ ফুটে কিছু বলে না বিভোর কে। চুপচাপ বাসার রাস্তার দিকে হাটা ধরে সে।
~ পানি খাবে ( স্বাভাবিক ভাবে বলে উঠে বিভোর )
~ খাবো না আমি।আমি বাসায় যাবো রাগী লুকে বিভোরের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলতেই বিভোর ভয়ে মুখ চুপসে যায়।
~ ঠিক আছে ।তুমি এখানে অপেক্ষা করো আমি ওখানে বাইক রেখে এসেছি।আমি বাইক নিয়ে আসছি।
~" আমি বাইকে যাবো না" বিভোরের কথায় শ্রুতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথাটা বলতেই বিভোর কথা না বাড়িয়ে বলে উঠে,
~ তাহলে আমি রিক্সা ডেকে দিচ্ছি। শ্রুতি এখন তার উপর প্রচন্ড রেগে আছে। রৌদ্রে দাঁড়িয়ে থেকে তার রাগ মাথায় চেপে বসেছে। সেই জন্য শ্রুতি যা বলবে বিভোর সেটাই মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
~ আমি রিক্সা করেও যাবো না। কোনো কিছুতেই করে যাবো না আমি । আমি হেঁটে বাসায় যাবো । শ্রুতির কথায় বিভোর একটা শুকনো ঢোক গিলে বলে উঠে,,,
~ হেঁটে যাবে মানে। এই তপ্ত দুপুরের ঠাটাপড়া রৌদ্রে হেঁটে কিভাবে বাসায় যাবো। মাথা ঠিক আছে তোমার ।
~ এই তপ্ত দুপুরের রৌদ্রে আমি যদি দুই ঘন্টা যাবৎ দাঁড়িয়ে থাকতে পারি তাহলে বাসায় যেতে আপনার সমস্যা কোথায়। আপনি গেলে যাবেন না গেলে আ যাবেন আমি হেঁটেই যাবো বলেই পা বাড়ায় শ্রুতি।
বিভোর শ্রুতির কথার পিটে আর কথা বাড়ায় না । দৌড়ে বাইকের চাবি তার বন্ধুকে দিয়ে সে আবার শ্রুতির কাছে ফিরে আসে।
তপ্ত দুপুরের ঠাটাপড়া রৌদ্রের মধ্যে রাস্তায় হাঁটছে শ্রুতি আর বিভোর। বিভোর ঘেমে একাকার হয়ে গেছে, সঙ্গে শ্রুতিও। তবে বিভোর কোনো টু শব্দটি করছে না।
রাগের মাথায় কি করে বসবে নিজেও বুঝতে পারবে না শ্রুতি। তার রাগের কারনে বিভোর সব সময় সাবধানে চলাফেরা করার চেষ্টা করে কিন্তু তবুও সে মাঝে মাঝে ভুল করে বসে।
[ বিভোর ভার্সিটি ২য় বর্ষের ছাত্র এবং শ্রুতি ইন্টার ফাস্ট ইয়ারের ছাত্রী। দুজনের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও একে অপরের প্রেমে পড়েছে দুইজন।
বিভোর যে কি না শান্ত মস্তিষ্কের তার বিপরীতে শ্রুতি প্রচন্ড রাগী, জেদি। তবুও বিভোর খুব যত্ন করে শ্রুতিকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করে।
শ্রুতি যখন প্রচন্ড রেগে যায় তখন বিভোর চুপচাপ সেগুলো সহ্য করে শ্রুতিও বিপরীতে সেটাই করে। দুজনের মাঝে একে অপরকে বোঝার অদম্য ক্ষমতা রয়েছে।কিন্তু যখন দুজনের ঝগড়া লাগে তখন বিশ্বযুদ্ধ হবার উপক্রম ]
শ্রুতির দেওয়া আজকের শাস্তি টা বিভোর সারাটা জীবন মনে রাখবে। হাঁটতে হাঁটতে তারা এক পর্যায়ে বাসার কাছে পৌঁছে যায়।
আপা কলেজে এসে গেছি । রিক্সা ওয়ালা মামার কথায় শ্রুতি বর্তমানে ফিরে আসে। রিক্সা থেকে নেমে শ্রুতি ভাড়া মিটিয়ে ক্যাম্পাসের ভিতরে প্রবেশ করে।
প্রতিদিন এর মতো নিয়ম করে ফ্রেন্ড সার্কেলের সাথে আড্ডা দিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করে সে। তার ৫ জন ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে তিনজন মেয়ে এবং দুইজন ছেলে। সে এবার ভার্সিটি ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী।
কলেজ শেষ করে সবেমাত্র ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়েছে শ্রুতি। রিক্সা ডাকবে এমন সময় পরিচিত কন্ঠস্বর কানে ভেসে আসতেই পিছনে ফিরে তাকায় শ্রুতি। পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখে,,,,,,,!
0 Comments