লেখিকাঃ সাবিহা জান্নাত
পর্বঃ ১৪
~ আমার সাথে কেন কথা বলতে বলে কথা বলার অনেক মানুষ তো আছেই । যে আপনার সব সময় খেয়াল রাখবে, আপনার সাথে কথা বলবে, আপনার কি লাগবে না লাগবে সেই খোঁজ খবর রাখবে।তার কাছেই যান না ।
বিভোর শ্রুতির অভিমান এর কারন বুঝতে পেরে সে মুখ টিপে হাসে। শ্রুতি বিভোরের মুখে হাসিল ছাপ দেখেই রেগে যায়।
আমার সাথে একদম কথা বলতে আসবেনা না। বলেই শ্রুতি রাগান্বিত হয়ে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়ে। সেই রাতটা কেটে যায়।
বিভোরের নানু বাড়ির থেকে কিছুটা দূরে একটা এতিমখানা রয়েছে। ছোট ছোট বাচ্চাদের জন্য কিছু আয়োজন করা হয়েছে।আজ সেখাই যাওয়ার জন্য সবাই প্রস্তুতি নেয়।
শ্রুতি একটা নীল রঙের শাড়ি পড়েছে সাথে হাল্কা সাজ। বিভোর একটা হোয়াইট শার্ট পড়েছে। ফরমাল ড্রেসে তাকে একদম প্রিন্স এর মতো লাগছে। তার থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়া দায়।
সবাই গাড়িতে করে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে পৌঁছে যায়। প্রতিবছর ই মূলত এতিমখানায় বাচ্চাদের জন্য আয়োজন করা হয় এবার ও তার ব্যাতিক্রম নয়। একে একে সব কার্যক্রম শুরু করা হয়। বাচ্চাদের খাবার খাওয়া থেকে শুরু করে তাদের পোশাক এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেওয়া হয়।
শ্রুতির এই বিষয়টি অনেক ভালো লেগেছে। অন্যদের জন্য কিছু করতে পারলে হয়তো বা এর থেকে জীবনে সুখকর কিছু নেই। শ্রুতির মুখে হাঁসির ঝলক।
কিন্তু তা নিমিষেই দূর হয়ে যায় ইরা এবং বিভোর কে খুব কাছাকাছি দেখে। বিভোর ইরা কে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু ইরা সেটা বুঝতে চেষ্টা করছে না। শ্রুতি ইতস্তত বোধ করে তাদের কাছে যাবে কিনা ।
সে আর বেশি না ভেবে তাদের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যায়। দু কদম এগিয়ে যেতেই বিভোর এবং ইরার কথাগুলো কানে আসে...
~ তুমি ওই মেয়েটার জন্য আমার ভালোবাসা রিজেক্ট করলে। তুমি বলেছিলে ওই মেয়েটাকে তুমি ভালোবাসো না। তাহলে আমাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আবার ওই মেয়েটাকে বিয়ে করলে কেন? ওই মেয়েটার জন্য তুমি আমাকে ঠকাতে পারো না।
~ দেখো ইরা। আমার এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না । হ্যা আমি চাই নি শ্রুতি কে বিয়ে করতে সেই জন্য ই তিন বছর আগে ওর সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছিলাম। দেখো একদিন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, তোমার আমার সম্পর্কটা আবার আগের মতো......
বিভোর ইরার দুই হাত ধরে কথাটা শেষ না করতেই দেখে সামনে শ্রুতি দাঁড়িয়ে। নিশ্চয়ই শ্রুতি তাদের সব কথা শুনতে পেয়েছে এখন সে নিশ্চয় তাকে ভুল বুঝবে।
শ্রুতি কথাগুলো শোনামাত্রই ইমশোনাল হয়ে যায়। তাহলে বিভোর তাকে আবার ও ঠকিয়েছে। শ্রুতি নিজের কান্না, ইমোশন গুলোকে চেপে রেখে উল্টো দিকে হাঁটা দেয় ।
বিভোর অনেক চেষ্টা করেও শ্রুতিকে আটকাতে পারে না। শ্রুতি যতক্ষণ সময় পর্যন্ত সেখানে ছিল সে চুপচাপ একপাশে ঘুপটি মেরে দাঁড়িয়েছিল। বিভোরকে সে কথা বলার সুযোগ দেয়নি পর্যন্ত। সব কাজ শেষ হলে সন্ধায় সবাই ফিরে যাওয়ার জন্য উদ্ধিত হয়।
শ্রুতি বিভোরের সঙ্গে না বসে অন্য গাড়িতে করে বিভোরের কাজিন দের সঙ্গে বসে পড়ে। বিভোর শ্রুতির জন্য অপেক্ষা করে অবশেষে সে অন্য একটা গাড়িতে গিয়ে বসে পড়ে । কিছুক্ষণ পর ইরা গিয়ে বিভোরের পাশের সিটে বসে পড়ে। সবকিছুই শ্রুতির চোখে দৃশ্যমান কিন্তু সে বিষয়টি নিয়ে কোনো প্রকার অভিযোগ করে না।
সারা রাস্তায় শ্রুতি চুপচাপ বসে ছিল কারো সাথে কোনো প্রকার টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি। কি বলার আছে তার , যাকে প্রথম ভালোবেসে ছিল সে তাঁকে ঠকিয়ে চলে গিয়েছিল। তিন বছর তাকে ফিরে পেয়েছিল নতুন রুপে, হয়তো তার চোখে সে নতুন করে ভালোবাসা দেখতে পেয়েছিল , কিন্তু কে জানতো সে আবার ও তাকে ভেঙ্গে, চুরমার করে দেওয়ার জন্যই এসেছে।
তাহলে কি সব মিথ্যা ছিল, পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে বউ করা , সবার বিরুদ্ধে গিয়ে তার পাশে দাঁড়ানো। আর আজ তার ই সামনে অন্য একটা মেয়েকে ....
সে তো স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে বিভোর বলেছে সে শ্রুতিকে ভালোবাসে না বলেই ছেড়ে গিয়েছিল। আবার নতুন করে ইরা এবং তার মাঝে সম্পর্ক.....
শ্রুতি আর কিছু ভাবতে পারছে না। সে চোখ বন্ধ করে গাড়ির সিটের সাথে হেলান দিয়ে রয়েছে। সে না চাইতেও সেই মুহুর্তটা সব সময় তার চোখে ভাসছে।
কিছু সময় পর বাসায় পৌঁছে যায় তারা । শ্রুতি বিভোরের দিকে না তাকিয়ে সোজা রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। শ্রুতির মাথা টা প্রচন্ড ব্যাথা করছে। সে ওয়াশ রুমে গিয়ে লম্বা একটা শাওয়ার নেয়। ভেজা কাপড় চেঞ্জ করে ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে বিভোর কে ঘরের ভেতরে দেখেও সে তার দিকে ইনটেরেস্ট না দেখিয়ে আয়নার সামনে বসে চুল গুলো চিরনী করে নেয়।
এর মাঝেই বিভোরের মামাতো বোন তাদের জন্য কফি দিয়ে যায়। শ্রুতি সেখানে থেকে একটা কফির কাপ নিয়ে বেলকনোনিতে চলে যায়।
দোলনায় বসে সে বাহিরের প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখছে কিন্তু সবকিছু তাঁর কাছে ফিকে লাগছে।
~ মনে ঘোর অমাবস্যা থাকলে রংধনুর সৌন্দর্য টাকেও ফিকে লাগে...!!
এর মাঝে দুইটা দিন কেটে যায় সেখানে। বিভোর অনেক বার শ্রুতিকে বোঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু সে বার বার তাকে এড়িয়ে গেছে।
আজ বিভোরের বিভোরের মামাতো বোন আনিকার বিয়ে। প্রথম দেখায় তাদের পছন্দ হয়ে এবং সব ঠিকঠাক হয়ে যায়। ছোট করে বিয়ের আয়োজন করে তাদের বিয়েটা সম্পূর্ন করতে চায় এখন। পরবর্তিতে ঘটা করে আয়োজন করে বউকে ছেলেপক্ষ নিয়ে যাবে। ততদিন আনিকা এই বাড়িতেই থাকবে।
বিয়ের সব আয়োজন করা শেষ। সন্ধায় বরপক্ষ এসে হাজির। বর এসেছে বর এসেছে বলে সবাই বাড়ির গেটের উদ্দেশ্যে চলে যায়।শ্রুতি কন্যার কাছেই বসে থাকে। বিভোর বড় ছেলে বিধায় তার অনেক দায়িত্ব।যা সে পালনে ব্যস্ত।
বাড়ির বিশাল ফাঁকা জায়গাটায় সবকিছুর আয়োজন করা হয়েছে। শ্রুতি সবটা সময় রুমের ভেতরে বসে ছিল সবার সাথে। সবার জোড়া জোড়ি করায় সে বাহিরে যায়। সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হওয়ায় শ্রুতি আবার ও একা হয়ে যায়।
সবকিছুর সৌন্দর্য সে ঘুরে ঘুরে দেখছে।রাতের অন্ধকারে চারদিকে লাইটিং করা, ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ চারদিকে। হঠাৎ শ্রুতির ফোনে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে এবং তাকে বাগানের পেছনের দিকটায় যেতে বসে।
শ্রুতি কিছুটা অবাক হয়ে যায় কারন কন্ঠটা তার অপরিচিত। দ্বিধাবোধ করে , সে হাঁটতে হাঁটতে সে বাগানের পেছনের দিকটায় চলে যায়। সেখানেও সুন্দর করে লাইটিং করা হয়েছে ।
সেখানে মানুষ জন এখন খুব কম রয়েছে সব সময়ের তুলনায়। সবাই বিয়ের সব কাজ কর্মে ব্যস্ত আছে। সেখানে শুধু ছোট ছোট বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি করছে আর কিছু প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়ে রয়েছে।
হঠাৎ ই শ্রুতির চোখ যায় ইরা এবং বিভোরের দিকে। তারা একেঅপরের খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে। ইরা বিভোর কে জড়িয়ে ধরায় শ্রুতি কিছু মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। পরক্ষনেই ইরা বিভোরের গালে কিস করতেই শ্রুতির দুচোখ ভরে যায়।
সে আর সেখানে অপেক্ষা না করে দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করে। বিভোর শ্রুতির চলে যাওয়া দেখে নেয়। বিভোর ইরা কে ছেড়ে দিয়ে তার গালে পরপর দুই দুইটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। যার ফলশ্রুতিতে ইরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
বিভোর সেদিকে না তাকিয়ে শ্রুতির পিছু নেয়। মূলত বিভোর কে এখানে ইরাই ডেকে নিয়ে এসেছিল। সে তার সাথে এমন ব্যবহার করছে বিভোর কখনো ভাবতে পারেনি। শ্রুতিকে বিভোরের প্রতি ভুল বোঝানোর জন্য ই এমনটি মূলত করা হয়েছিল ।
বিভোর শ্রুতির পেছনে পেছনে গিয়েও তার সাথে কথা বলতে পারে না। শ্রুতি রুমের ভিতরে গিয়ে ভেতরে থেকে দরজা লাগিয়ে দেয়। বিভোর অনেক ধাক্কাধাক্কি করার পর ও শ্রুতি তার ডাকে সাড়া দেয়না।
সে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কান্না করছে অবিরাম। তার চোখে অবিরাম ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তার অনুমান সঠিক হয়েছে , বিভোর আবার তাকে ঠকিয়েছে। তা নাহলে আজ সে যা নিজের চোখে দেখছে তা কি করে ভুল হতে পারে।
বিভোর অনেক্ষণ যাবৎ দরজায় দাঁড়িয়ে শ্রুতির অপেক্ষায় রইল কিন্তু শ্রুতির কোনো সাড়াশব্দ নেই। এদিকে বিয়ে প্রায় শেষের দিকে, বিভোরের ডাক পড়তেই সে সেদিকে ছুটে চলে।
বাড়ির ছেলে মেয়েরা শ্রুতির খোঁজ করে তার রুমের দরজা অনেক বার ধাক্কাধাক্কি করায় শ্রুতি অবশেষে দরজা খুলে দেয়। তাকে সেখানে থেকে বিয়ের স্টেজে নিয়ে যাবার জন্য অনেক জোড়া জোড়ি করে কিন্তু শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে রুমেই থেকে যায়।
রাত প্রায় গভীর হয়ে এসেছে। চারিদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করেছে।ঝিঁঝিঁ পোকার মৃদু আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, ঐ দূর প্রান্ত থেকে শেয়াল কুকুরের ডাক কানে ভেসে আসছে।
চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজমান। এর ই মাঝে দুই নরনারী নিদ্রাহীন হয়ে পড়েছে। প্রিয় মানুষের দেওয়া অবহেলায় কেউ একজন সমস্ত অভিযোগ গুলো তুলে ধরছে প্রকৃতির মাঝে।
চারিদিকে গাঢ় অন্ধকারের মাঝে নিজের অস্তিত্বও অদৃশ্যমান, প্রকৃতির সৌন্দর্য অদৃশ্য তবুও বেলকনিতে দাঁড়িয়ে গ্রীল দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে আছে অভিমানী রমনী। প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে নিরব হয়ে সমস্ত অভিযোগ তার।
অন্যদিকে মাঝরাতে অন্ধকার ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলছে কেউ একজন। তার অভিযোগ ভুল বোঝাবুঝিতে প্রিয় মানুষের দূরে যাওয়া।
পেয়েও প্রিয় মানুষ কে হারানোর আশঙ্কা কাজ করছে তার মধ্যে। আকাশে এক ফালি চাঁদ দেখা গিয়েছে কিন্তু তার আবছা আলো রাতের পৃথিবীটা কে আলোকিত করতে পারেনি।
তার সমস্ত অভিযোগ ওই প্রকৃতির প্রতি। কেন বার বার প্রিয় মানুষ কে কাছে পেয়েও তার থেকে দূরে যেতে হয়। কাছে গিয়ে আবারো ফিরে যেতে হয় অসীমে। দুরত্ব সৃষ্টি হয় দুজনের মাঝে।
শেষ হয়েও হয় না তাদের মাঝের দূরত্ব। তবে কি প্রকৃতি এটাই চায়, কখনো না হোক তাদের সন্ধি। কিন্তু তার তো বিচ্ছেদের স্বাদ গ্রহণ করার অসীম ক্ষমতা নেই।
আকাশের পানে তাকিয়ে দু ফোঁটা চোখের জল ফেলে বিভোর। ঘুটঘুটে অন্ধকার ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে। মাঝরাতে নিদ্রাহীন তার প্রিয়তমার থেকে দূরে সরে যাওয়ার যন্ত্রনা তাকে গ্রাস করে ফেলছে।
তার ইচ্ছে করছে ছুটে যাই প্রিয়তমার কাছে কিন্তু সেও কি সম্ভব। এতো কিছু ঘটে যাওয়ার পরও কি তার প্রিয়তমা তাকে গ্রহণ করবে। আলিঙ্গন করে নিবে তাকে বাহুডোরে। সে শুধুই এক দুঃস্বপ্ন।
তার প্রিয়তমা যে বড্ড অভিমানি। যে মনে তাকে খুব করে আঁকড়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিল, সে মনেই তার প্রতি, বিরক্ত, ঘৃনা পোষন করে রেখেছে। সমস্ত অভিমান, অভিযোগ ভুলে অনূভুতি গুলো কে মাটি চাপা দিয়ে রেখেছে।
ভুল বোঝাবুঝির কারণে আজ দুইজনের পথ আলাদা, কখনো কি পথ আবার ও এক হবে। কোনো এক স্বপ্নের শহরে হাতে হাত মিলিয়ে পাশাপাশি চলবে দুজনে।
শ্রুতি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। সে স্থান ত্যাগ করে বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দেয়। অনুভূতিগুলো বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছে। নানান চিন্তা ভাবনা করতে করতে সে ঘুমিয়ে পড়ে।
কিন্তু বিভোর নির্ঘুম রাত আকাশের পানে তাকিয়ে চাঁদের সাথে অনুভূতি শেয়ার করে কাটিয়ে দেয়। শেষ রাত্রে সে ছাদেই সবার সহিত শুয়ে পড়ে।কাল রাতে অতিথি আসায় অনেক জন ই ছাদে ঘুমিয়ে ছিল , বিভোর ও তাদের সঙ্গেই কাটিয়ে দেয়।
ভোরের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে যায় শ্রুতির। বিছানা ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হতে যায় সে। লম্বা একটা শাওয়ার নেয় সে। ক্ষণে ক্ষণে গতকালের ঘটনা চোখের সামনে ভাসছে তার। প্রিয় মানুষটার অন্য কারো প্রতি আসক্তি।
~ নাহ্ যে মানুষটা বার বার তাকে ঠকিয়ে গেছে, তাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে সে কখনোই আমার প্রিয় মানুষ হইতে পারে না। সে শুধুই ভেসে আসা মেঘ, যে আসে আবার চলে যায়।
নতুন করে তার হৃদয় কে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে সে, আমার অনুভূতি গুলো নিয়ে খেলেছে সে, তার প্রতি আর কোনো ফিলিংস নেই। যদি কিছু থাকে তাহলে শুধুই ঘৃনা। তার জন্য চোখের পানি ফেলাও অপরাধ।
আজকের পর, ইভেন এই সময় পর থেকেই তার প্রতি আমার কোনো অনুভূতি নেই।এই বিয়েটাও মিথ্যা, যে মিথ্যা সম্পর্ক থেকে আমি খুব শীঘ্রই বেরিয়ে আসবো।
শ্রুতি মুহুর্তে ই নিজেকে শক্ত করে নেয়। খুব বেশি কষ্টের মাঝেও নিজেকে সামলে নিতে পারে সে। শাওয়ার শেষে বেরিয়ে আসে রুমে। চুলগুলো মুছে চিরনী করে সে।
~ আজকের পর এই মিথ্যে সম্পর্কে কষ্ট পেলেই তা শুধু বিভোর চৌধুরীই পাবে , শ্রুতি চৌধুরী নয় । শ্রুতিরা কখনো স্মৃতি হয় না , শ্রুতিরা বিরাজমান থাকে সব ভালোবাসার মানুষদের হৃদয়ে।
আয়নার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলতে বলতে শ্রুতির ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিত হাঁসির ঝলক। কালো শাড়ি, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, চোখে গাঢ় কাজলে রাঙে সে। চুলগুলো খোঁপা করে নেয় সে।
আমার কাউকে হারানোর আক্ষেপ নেই, তবে বিভোর চৌধুরীর থেকে রিভেঞ্জ না নিলে মনে আফসোস থাকবে। সে আমাকে দু দুইবার ঠকিয়েছে।
শ্রুতি তৈরি হওয়া শেষে নিচে যায়। সেখানে সবাই উপস্থিত আছে। বরপক্ষের লোকজন চলে গেলেও বর বউয়ের বাড়িতেই থেকে গেছে। তাদের কেই অতিথি আপ্যায়ন করা হচ্ছে।
শ্রুতি তাদের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। রান্না শেষে খাবার গুলো টেবিলে সাজিয়ে রাখছে সবাই মিলে।শ্রুতি একপাশে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে।
রান্নাঘর থেকে সবাই চলে যেতেই ইরা শ্রুতির পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে। শ্রুতি তার সাথে কোনো কথা বলে না বরং চুপচাপ অন্যদিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে রান্নাঘর থেকে চলে আসবে তখন ইরার কথায় দাঁড়িয়ে পড়ে,,,
~ আফসোস হচ্ছে নাকি, নিজের বরকে অন্য একজনের সাথে দেখে।
ইরার কথায় শ্রুতির মস্তিষ্কে র-ক্ত উঠে যায়। সে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে মুখে হাঁসি নিয়ে ইরার দিকে ফিরে তাকিয়ে তার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,,,,
~ জানো তো, বাশি খাবারে মাছিদের ইন্টেরেস্ট থাকলেও শ্রুতির তাতে কোনো ইন্টেরেস্ট নেই।শুনেছি ব্যবহার করা জিনিস নাকি ফেলে দিতে নেই বরং অন্য জনকে দিয়ে দিতে হয়,
আই মিন যাদের সেই জিনিসটা পূর্নাঙ্গ অবস্থায় পাওয়ার সামর্থ নেই। তাদের কে দিয়ে দিলে নাকি অনন্ত তাদের উপকার হবে - গুরুজনেরা বলতো।
পুরোনো জিনিস আর কতদিন ব্যবহার করবো বলো , অন্যজনকে দিয়ে দেওয়াই ভালো। হাসিমুখে কথা গুলো বলেই শ্রুতি চলে যাওয়ার জন্য উদ্ধুত হয়।
শ্রুতির কথাগুলো ইরার গাঁয়ে যে কাটার মতো বিঁধেছে তা সে বেশ বুঝতে পেরেছে। কিছু মানুষের সাথে তর্কে না জড়িয়ে হাঁসি মুখে একটা জবাব ই যথেষ্ট তাদের কষ্ট দিতে । তাতে আপনার কথায় তারা যতটা না কষ্ট পাবে তার থেকে আপনার হাসিতেই তারা জ্বলে পুড়ে ছারখার হবে।
শ্রুতি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তেই ইরার আম্মু এবং বীথি চোধুরী সেখানে আসে। তারা স্পষ্ট শ্রুতির কথাগুলো শুনতে পেয়েছে।
~ কি বললে তুমি। তুমি আমার মেয়ের সাথে তুলনা করছো নিজেকে, কি আছে তোমার, আছো তো সেই অন্যের বাসায়...
ইরার আম্মুর কথা শেষ না হতেই শ্রুতি বলতে শুরু করে.....
~ ভুল বললেন, খালাশাশুড়ি আম্মা.....। আমি অন্যের বাসায় নয় বরং আমার নিজের বাবার বাসায় থাকি। কারন বাসাটা শুধু আপনার বোন জামাইয়ের একার ছিল না আবার বাবার ও ছিল।
আর হ্যা ভাববেন না যে, বাবা চলে গেছে বলে বাবার সব প্রোপার্টি সাথে নিয়ে গেছে , বরং সবকিছু তাঁর উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখেই গেছে।
আর কি যেন বললেন, আমি নিজেকে আপনার মেয়ের সাথে তুলনা করছি, এউ কি সম্ভব কোথায় আগরতলা আর কোথায় চকিরতলা।
আপনারা মা মেয়ে যাকে নিয়ে খুব বেশি গর্ব করছেন না, সে যদি আপনার মেয়ের মাঝে বিশেষ কিছু খুঁজে পেত তাহলে আপনার মেয়েকে বিয়ের আসরে রিজেক্ট করে আমার পায়ে পড়ে বিয়ে করে বউ করতো না।
শ্রুতির কথায় ইরার আম্মু তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। দিন দিন তোমার সাহস দেখি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
~ দেখেছো আপা। তোমার সামনে কেমন করে কথা বলছে মেয়েটা। প্রশ্রয় পেয়ে মেয়েটার সাহস দিন দিন বেড়েই চলেছে। এখন ই কিছু বলো না হলে পড়ে মাথায় উঠে বসছে।
ছোট বোনের কথা শুনে বীথি চৌধুরী বলে উঠে,,,,
~ ও ভুল কিছু বলেনি তো। তুমি যেমনটা বলেছে তার যোগ্য জবাব দিয়েছে। আগে নিজের ব্যবহার ঠিক করো, ছোট দের সঙ্গে কি আচরন করতে হয় এটাও তো ভুলে গেছ। বউমা এখানে থেকে চলো তো, এদের সঙ্গে তর্ক জড়িয়ো না তাতে নিজের ই কথা খরচ।
বিভোর এর আম্মু শ্রুতি কে নিয়ে সেখানে থেকে চলে যান।ইরা এবং ওর আম্মু নিরবাক হয়ে যান তার কথা শুনে। নিজের বোন হয়ে অন্যের গুন গাইছে।
শ্রুতি শাশুড়ি মায়ের সাথে পায়ে তাল মিলিয়ে চলে যায়। সময় বুঝে মা মেয়ে দুজনেরই ব্যান্ড বাজিয়ে দিবো। আমাকে তো এখনো চিনতে পারো নি, যেদিন চিনতে পারবে সেদিন বুঝবে ধানি লঙ্কার ঝাল অন্য লঙ্কার থেকে কেন বেশি।
কথা গুলো মনে মনে ভাবছে শ্রুতি আর শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে চলছে। বিভোরের আম্মু শ্রুতিকে সব আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।
~ জানো তো নাতবউ এই দিনটার ই অপেক্ষা করেছিলাম আমি। আমার এই বালাজোড়া আমি খুব যত্ন করে রেখেছিলাম বংশের বড় নাতি বিভোরের বউড়ে পরাইনের লাইগা।
দাও দেখিনি হাত দুটি এগিয়ে দাও। বলেই বিভোরের নানুমনি উপস্থিত সকলের মাঝে শ্রুতির দুই হাতে দুটি বালা পড়িয়ে দেয়।
তয় সবাইরে দেখছি আমার নাতিটারে দেখছি না যার জন্য নাত বউয়ের এতো আয়োজন। হেয় কই গেছে বউটারে একা ফাইলা। এতো কিছুর মাঝে সবাই উপস্থিত থাকলেও বিভোর অনুপস্থিত ছিল । সবাই বিভোরের খোঁজ খবর করলেও শ্রুতি তার কথা মনেও নিয়ে আসে নি।
0 Comments