লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা


কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।


*
*
*
ফজরের আযানের সুমধুর ধ্বনি নিশীথ-শেষের পবিত্র বাতাসে অনুরণিত হয়, মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে—"আল্লাহু আকবার," অর্থাৎ আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ।।
সামুরাহ বিন জুনদুব (রা:) থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ পড়লো সে মহান আল্লাহর যিম্মায় রইলো। [৩২৭৮]
কাঙ্খিত কক্ষে ফজরের নামাজ আদায় করে আঁখি জায়নামাজে উপবেশন করে দৈনন্দিন এর ন্যায় আয়াতুল কুরসি পাঠ করছে।
আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসি পাঠ করবে, তার জান্নাতে প্রবেশের পথে মৃ'ত্যু ছাড়া আর কোনও অন্তরায় থাকবে না, (শুআবুল ঈমান, হাদিস : ২৩৯৫)।
অতঃপর আঁখি পবিত্র কোরআন শরীফ পাঠে মনোনিবেশ করে। কী মধুর সেই তেলাওয়াত, যেন প্রাণের অন্তঃস্থল প্রশান্তিতে পূর্ণ হয়! সূর্যোদয়ের পূর্ণতাও না হওয়া তৎপর্যন্ত আঁখির এই আমল অবিরাম চলতে থাকে।
আফিয়া বেগম এই একটি বিষয়ে কভু আঁখির প্রতি কিছু বলেন না, কিংবা বলার কোনো সুযোগ পান না। আঁখি তৎপরতার সঙ্গে ছোট বোন আলোকেও ডাকে নামাজের জন্য। আলো কোনওরকমে ঘুমের ঘোরে নামাজ আদায় করে পুনরায় গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়। অভ্যাস তো ছোটকাল হতেই নির্মিত হওয়া আবশ্যক!
তবে আঁখির তরুণী হৃদয় যেন কোনো অজানা আলোড়নে আন্দোলিত হচ্ছে আজ! সকাল সকালই বাড়ির পেছনে বাগানে চলে গেলো আঁখি! ভাবতে লাগলো গতকাল রাতের কথা!
--
নিশীথরাতে সে পুনরায় একখানি খাম প্রাপ্ত হয়েছে তার কালো কলেজের ব্যাগ হতে। কিন্তু খোলার সাহস হচ্ছে না আঁখির । তবে এই খাম পূর্ববর্তী খামসমূহের ন্যায় লম্বাকৃতি নয়। যাই হোক, আঁখির মনে খামটি খোলার আকাঙ্ক্ষা ক্রমবর্ধমান হচ্ছে। খাম দেখবে কি?আজকের খাম কালো রঙের, তার উপর সাদা নকশা অঙ্কিত। অতি মনোরম দেখাচ্ছে! অধিক বিলম্ব না করে
ভেতরের কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি বের করে আঁখি কিছুটা বিস্ময়ে স্তম্ভিত হলো। এটা তো টিপ! হ্যাঁ, টিপ—নারীর কপাল সজ্জিত করার অলঙ্কার! অসংখ্য ক্ষুদ্র কালো টিপের পাতা রয়েছে তন্মধ্যে। আঁখি কপট কৌতূহলে ভ্রুকুটি করল, কেননা সে তো কখনো টিপ পরিধান করে না! অদ্ভুত!! কিরূপে তার মনে ভাসছে যে কেও তাকে এটা দিয়েছে?? তার কিশোরী হৃদয় এক অজানা আকাঙ্ক্ষায় দুলছে, কিন্তু তার এটা ব্যাখ্যা করার ভাষা নেই!
তার দৃষ্টিপথে আসে আরেকখানি চিরকুট, অতি যত্নে ভাজ করা। কি লেখা এতে? আবার কি প্রেমপত্র? আবার কি সেই নামহীন রহস্যময় পুরুষ তাকে ভুল করে প্রেরণ করেছে এই পত্রখানি? আঁখি অবশেষে চিরকুটটি খুলল, যেখানে অন্তরের গভীরতর প্রেমে প্রতিটি শব্দ অঙ্কিত রয়েছে। সেই অচেনা, অদেখা প্রেমিক পুরুষের হৃদয়ের নিঃসীম ভালোবাসা তার প্রতিটি বাক্যে প্রকাশ পাচ্ছে,
——— " প্রিয়তমা প্রণীতা,
এটা কেবল টিপ নয়, এটা আমার ওষ্ঠের প্রতিটি মৃদু স্পর্শের সঞ্চার বহন করে। যতবার তুমি এই টিপ তোমার ক্ষুদ্র ললাটে স্থাপন করবে, মনে রাখবে আমার অনন্ত ভালবাসার পরশ তোমার ললাটে অর্পিত হচ্ছে। প্রণীতা, তোমাকে স্পর্শ করার ক্ষমতা আমার নাই, অতএব আমি এই টিপ হয়েই তোমার ললাটে আমার প্রেম অঙ্কিত করলাম।
ডেবিটের স্থানে তুমি আমার দায়ভার লইয়া এই টিপ ধারণ করিও, আর আমি ক্রেডিট হইয়া তোমার প্রতি আমার ভালবাসার ঋণ পরিশোধ করিব।
এই টিপ দ্বারা তোমার ললাটে আমার অসীম প্রেমের ছাপ খচিত রইল, যা তোমার প্রতি আমার অম্লান ভালোবাসার সাক্ষরিত ।
প্রিয়তমা প্রণীতা, হৃদয়হরিণী তুমি, যা আমি নেওয়ার জন্য অঙ্গীকার করেছি। সঠিক সময় আসলে তোমাকে আপন করব। তখন আর কোনো গোপন খেলা থাকবে না। নিজে তোমার ললাটে টিপ পরায়ে দিব।
বলো প্রণীতা, তুমি কি আমার প্রদান করা সেই চুল বাঁধিবার কাষ্ঠখণ্ড পরিধান করেছো? ওহে হৃদয়হারিণী, তুমি কি আমাকে ক্ষমা করবে? সামান্য, ক্ষুদ্র বিন্দুমাত্র ক্ষমা! যেমন বৃষ্টির ক্ষীণ কণা ভূমি স্পর্শ করে, তেমনই একটি ক্ষুদ্র ক্ষমা দান করিও। এটা তোমার জন্য সংগ্রহ করার নিমিত্তে আমি চার প্রহরের জ্বলন্ত তাপে মেলায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। জানো কি, সেই সময়ে আমার পকেটে অর্থের প্রাচুর্য ছিল না, কেবল শূন্যতা। কিন্তু যখন সেই কাঠিটি আমার দৃষ্টিগোচর হলো, তখন আমার মনে হলো যেন এটা স্বয়ং তোমারই জন্য সৃষ্ট। সেই কারণে আমি চার ঘণ্টা নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলাম, পকেটে একবিন্দু অর্থ না থাকা সত্ত্বেও। দোকানদার আমার এই বিপন্ন অবস্থায় করুণার দৃষ্টি দিয়া বললেন, যদি আমি তার দ্রব্যাদি বিক্রয়ে সহায়তা করি, তবে তিনি এটা আমায় দান করবেন। প্রণীতা, আমি ক্লান্ত ছিলাম, তথাপি যখন তোমার জন্য সেই কাঠি হাতে পেলাম, তখন নিজেকে জগতের সর্বাধিক সৌভাগ্যবান পুরুষ ভেবেছিলাম।
কিন্তু, মায়াবতী, তোমার এক কার্য আমাকে বিরাট দুঃখ দিয়েছে। কেন তুমি এটা ভেবেছো যে, আমি ভুল করে তোমায় দিয়েছি? না প্রণীতা, ওটা তোমারই জন্যই, একান্ত তোমার জন্যই। অন্য কারও জন্য নয়। তোমার নাম লিখে প্রদান করি নি বলে কি তুমি মিথ্যা ভ্রমে পতিত হয়েছো? হাহাহা! বোকা প্রেয়সী আমার! পূর্বেও তোমারই ছিল, এবং এখনও তোমার জন্যই প্রদান করলাম।
এই যে বোকা রাণী , শূন্য পকেটের কথা বললাম, তুমি কি মনে করেছো যে, আমি অসহায়? হ্যাঁ, আমি নিতান্তই দুর্বল, তব তোমার প্রণয়ের নিকট একেবারে নিঃস্ব, প্রণয় না পাইয়া নিরুপায়, তোমায় অধরাইয়া নিতান্তই অসার! তবে শুনো আমি শুধু এটাই তোমাকে বুঝিয়েছি, তোমার জন্য আমি সকল কিছু করতে প্রস্তুত। তুমি আমার সব, তোমার নিমিত্ত সকল কিছুই তুচ্ছ!
সর্বশেষে বলি, তুমি আমার প্রণীতা, তোমার প্রেমে আমি উন্মত্ত, শেষ বলিয়া হয় না কখনো শেষ, ভালবাসি তোমায়, ভালবাসিবো অক্লান্ত অশেষ।
-তোমার নামহীন প্রেমিক। "
—--TikTok
——— "বাহিরে কি করিস? কাজ নেই নাকি পালানোর চিন্তা করছিস?"
বহিরাঙ্গণে কিঞ্চিৎ বিচরণ করছে আঁখি। তার পদচারণা নির্জন নয়, অন্তরে যুঝছে চিন্তার ঢেউ। হঠাৎ গম্ভীর স্বরে পশ্চাদ্দেশ হতে বাণী নিক্ষিপ্ত হলো। আঁখি অল্প উন্মুখ হল, এবং আফিয়া বেগমের দৃষ্টি সাক্ষাৎ করল। ক্রো'ধে উজ্জ্বল হয়ে, তার মুখাবয়বে অ'গ্নি বিকাশিত । আফিয়া বেগম কণ্ঠ কিঞ্চিৎ হ'র্ষা'তুরে, বললেন—
——— "তুই কিছু করেছিস, তাই না?"
আঁখি বিভ্রান্তমুখে প্রহরী দৃষ্টিতে তাকিয়ে। ধীর কণ্ঠে প্রতিউত্তর দিল—
——— "কি করার কথা বলছ বড় মা?"
——— "শশশশ! তোর ওই মুখে আমায় বড় মা বলবি না! বল্, আমার ছেলে কোথায়?"
——— "আমি কি করে জানব ভাইয়া কোথায়?"
আফিয়া বেগম দ্রুত আঁখির হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বললেন,
——— "আমার ছেলের কিছু হলে তোকে আমি ছাড়ব না!"
বিস্ফারিত নেত্রে আঁখি বড় মা'কে চলে যেতে দেখল। র'ক্তি'ম ক্রো'ধে জ্বলিত আফিয়া বেগম অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন। আঁখির মস্তিষ্ক বিহ্বল, কি বলে গেলেন বড় মা? নিতান্তই রহস্য!
পর্দার আড়াল হতে রোকেয়া বেগম দেখছিলেন। তাঁর ঠোঁটে এক কু'টি'ল হাসি, এবং দন্ত বিকশিত হল। মৃদু কণ্ঠে বললেন—
——— "আমি বড়ই অবাক হই, ভাবি, তোমার মতো নারী এতটা পা'ষা'ণ হৃদয়, কি করে?"
চলে গেলেন রোকেয়া বেগম। আঁখির দৃষ্টি তখন রোকেয়া বেগমের দিকে। তার চলমান পদক্ষেপ লক্ষ্য করে মনে জিজ্ঞাসা করল,
——— "আর কত কাল এই লুকোচুরি?"
-------------------------
গ্রাম্য পথিকের ন্যায় দুই বন্ধু পদচারণা করছে সরু পথ দিয়ে। মাটি ভারাক্রান্ত, শীতল, এবং তার উপর জলরাশি সঞ্চরণ করছে, পদচারণার শব্দ চেপ চেপ করে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এমন মেঘলা পরিবেশে হঠাৎ রোহান কৌতূহলাক্রান্ত হয়ে বলল—
——— "তুই বিয়ের জন্য এত ব্যাকুল কেন, বন্ধু?"
মুগ্ধ ধীরস্বরে প্রত্যুত্তর দিল,
-——— "হালালভাবে চাই। যেন ছুঁতে গেলে, আমার অধিকার ল'ঙ্ঘ'নের কথা কেও তুলতে না পারে।"
রোহান স্তম্ভিত, বিস্মিত, অবকের চরম সীমানায়! একি শুনছে? কি বলছে তার বন্ধু? পুনরায় প্রশ্ন করল,
———— "মানে তুই,,,, "
মুগ্ধ বি'র'ক্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কিন্তু রোহান নাছোড়বান্দা, ঠেলতেই থাকল। অবশেষে মুগ্ধ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে, চোখ বন্ধ করল, এবং অন্তরাত্মায় লুকায়িত সেই মুখচ্ছবির স্মৃতিরেখায় ডুবল। ঘোরলাগা স্বরে বলতে লাগল,
——— "যখন প্রথমবার ওকে দেখেছি, তখন থেকে আর কিছু দেখি নি। ওর ছোট্ট নিষ্পাপ মুখটি মস্তিষ্কে গেঁথে গিয়েছিল। ও অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিল, নতুবা তখনই ওকে তুলে বিয়ে করে নিতাম । আমি ওকে চাই, হালালভাবে চাই, সম্পূর্ণভাবে চাই। যেন ছুঁতে গেলে আমার অধিকারে কোনো প্রশ্ন না উঠে। ওকে না পেলে সবকিছু ধ্বং'স করে ফেলব আমি! ও আমাকে ভালোবাসুক বা না বাসুক, আমি ওকে ভালোবাসি, এটাই যথেষ্ট। বিয়েকে জটিল করিস না, এটা অন্যায় নয়। হালালভাবে কাওকে নিজের করে নেওয়া অন্যায় হতে পারে না। (একটু থেমে) ওকে দেখলেই আমার সমস্ত অস্তিত্ব তার জন্য আকুল হয়ে ওঠে। ইচ্ছে করে ওকে আঁকড়ে ধরতে, বুকের ভিতরে লুকিয়ে রাখতে। কিন্তু আমি ওকে স্পর্শ করব না, কারণ সে পবিত্র, যেমন ফুটন্ত পুষ্পকলি পবিত্র থাকে। আমি ওকে হালালভাবে স্পর্শ করব, আপন করে নিব। কিন্তু যদি কেও তার দিকে কু'দৃ'ষ্টি দেয়, আমি তার মাথা ধড় হতে বিচ্ছিন্ন করে ফেলব।"
শেষ বাক্যটুকু চোয়াল শক্ত করে বলল মুগ্ধ! আবারো মুগ্ধের ঠোঁটের কোণে বাকা হাসি ফুটল। সে বলল,
——— "আমি জানি, যাকে আমি ভালোবাসি, যে আমার অন্তরে আছে, সে আমাকে ম'রে গেলেও বিয়ে করবে না, রাজি তো দূর। কিন্তু ওকে আমি যেকোনো মূল্যে চাই।"
রোহান যেন চমকের পর চমক খেয়েই যাচ্ছে! স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এমন বাক্য তার কানে পৌঁছিবে, তা কল্পনাও করে নাই। যে মুগ্ধ পা'ষা'ণ হৃদয়ের পুরুষ, সে কিরূপে এতটুকু প্রেমে আকণ্ঠ ডুবে যেতে পারে? তা জেনে রোহান সঙ্ক'টমগ্ন! জিজ্ঞেসিল,
———— "কবে থেকে এমন?"
মুগ্ধ সংক্ষেপে বলল,
——— "তোর জানার প্রয়োজন নেই।"
রোহান কর্কশ স্বরে বলল,
——— "আমি তোর বন্ধু, সবার আগে জানার অধিকার আমার!"
মুগ্ধ তখন কঠোর স্বরে উত্তর দিল,
——— "মুগ্ধ কাওকে সম্পূর্ণ অধিকার দেয় না!"
রোহান ভ্রূ কুঁচকিয়ে তাকাল, মুগ্ধ সিগারেটে টান দিয়ে বলল,
——— "জীবনের সব কথা কাওকে বলার প্রয়োজন নেই। কিছু কথা গোপন রাখতে হয়, কারণ সব প্রকাশিত হয়ে গেলে , তখন বিপদ ঘটে নিজ জন্য এবং যে শুনবে তার জন্যও।"
হাটতে লাগল দুজন! রোহানের বোধে আসল যে, মুগ্ধ তাকে কিছু বলবে না। তথাপি রোহানও সহজে পরাভূত হবার নয়। সে জেনেই ছাড়বে, এর উৎস কোথায়। আর এও স্পষ্ট যে, মুগ্ধ পূর্বিকাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে। কিন্তু তার আর এক সত্তা, আফ্রিদি, কোথায়? কাল হতেই সে লাপাত্তা। অতএব, দুজনের গন্তব্য আফ্রিদির বাড়ির দিকে। রোহান আফ্রিদির খোঁজে চলেছে, কিন্তু মুগ্ধের লক্ষ্য ভিন্ন!
——————
——— "কতদিন আর লুকিয়ে পিছু নিবি, এবার বলে দে!"
বেঞ্চে দুই বন্ধু বসে, মিনহাজের কথায় আরাফ বৃতৃষ্ণা হেসে উঠল, বলল,
——— "সময় হয় নি!"
——— "যেদিন উড়ে যাবে সেদিন বুঝবি!"
আরাফের চোয়াল কঠোর হয়ে গেল। সে দৃঢ়কণ্ঠে বলল,
——— "উড়বে, কিন্তু আমার আকাশে! অন্য কারো আকাশে নয়!"
মিনহাজ কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
——— "ঠিক কবে থেকে ভালোবাসিস? এখনো বলিস নি!"
আরাফ নিরুত্তাপভাবে বলল,
——— "যবে থেকে জানিস!"
——— "ছ মাস?"
——— "তারও অধিক!"
মিনহাজ চিন্তায় ডুবে গেল। আরাফ তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
——— "দীর্ঘকাল! হিসেব রাখি নাই। তারিখ, সময়, বার, মিনিট, সেকেন্ড—তাকে দেখে সমস্ত ভুলে গিয়েছি। জীবনের হিসেব এখন বিশৃঙ্খল! সেই হিসেব মিলবে যেদিন তাকে আপন করে পাবো!"
মিনহাজ চিন্তিতস্বরে বলল—
——— "কিন্তু ও তো অনেক ছোট! তার থেকেও বড় কথা, ও যে বাড়ির মেয়ে, সেই বাড়ির সাথে তোদের শত্রুতা..."
আরাফ দ্রুত থামিয়ে দিল—
——— "হুশশ! ছোট? বড় হয়ে যাবে! শত্রুতা? হয় বাড়বে, নতুবা শেষ হবে! কিন্তু সে আমারই হবে!"
----------------
পিয়াজ, মরিচ কুচি কুচি করে কে'টে সরষের তেল ও লবণ মিশিয়ে রুপা তৃপ্তিসহকারে শুকনো ভাত খাচ্ছে। ঘরে আনাজপাতি নেই! বাড়ির পেছনে যে মরিচের গাছ সে নিজ হাতে বুনেছিল, তাতে ফুটেছে ছোট ছোট তাজা কাঁচা মরিচ। সেই মরিচ গাছ হতে ছিঁড়ে, খেয়ে পেট ভরল। এর স্বাদ কিরূপ? জিজ্ঞাসা করো অনাহারে থাকা রুপাকে, সে বলবে, আহা! কি স্বাদ সেই অতি সাধারণ খাবারের!
ঠিক এই সময় রুপার বাবা, টালমাটাল অবস্থায়, ঘরে প্রবেশ করল। দাঁড়াবার শক্তি তার নেই, ঘোলাটে চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন, দেখলেন, যা খাবার পর থালাবাসন ধুচ্ছে রুপা। পেছন হতে বলে উঠলেন,
——— "তোর সাথে কথা আছে! রুমে আয়!"
বলেই রুমের দিকে চলে গেলেন। রুপা জিজ্ঞাসা করার সুযোগও পেল না। দ্রুত থালাবাসন ধুয়ে বাবার রুমে ছুটল, জানিবার জন্য যে কি বলবেন তিনি! তখন দেখলো, আঙ্গিনায় বসে এক সাদা কালো রঙা মলিন কুকুর, শরীরে কেবলই ময়লার স্তর! দেখতে কি নোংরা! এক পা তার অক্ষম, দৈন্যদশা প্রকট। রূপা দেখল আর একমুহূর্তে একটি পাথর তুলে নিক্ষেপ করে বলল,
———" তুই আবারও এসেছিস? দূর হ, এখান হতে যা ভাগ!"
কুকুরটি কর্কশ কণ্ঠে তার নিজস্ব স্বরে চিৎকার করে, পঙ্গু পদ লেংড়িয়ে আঙ্গিনা হতে চপলতায় প্রস্থান করল!
রুপা, মা-ম'রা কন্যা, তার বাবার সাথেই বসবাস। ভাগ্যক্রমে সে পেল তিন সখী, যারা তার প্রাণভোমরা। প্রথম হায়েযে যখন মায়ের পাশে থাকা উচিৎ ছিল, সেইখানে তার মায়ের মতো পাশে রইল তিন সখী, যারা তার জীবনের সকল আবেগ ও দুর্দশার সাথী।
-----------
ইয়াসিন হন্তদন্ত হয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে উপস্থিত হল হাসপাতালে। তার কপাল ঘামে ভিযে সিক্ত, শ্বাসের গতি দ্রুত, দম নেয়ার অবকাশ যেন মিলছে না। দ্রুত পদক্ষেপে সেই কাঙ্খিত কেবিনের সম্মুখে উপনীত হয়ে, এক মুহূর্ত কালক্ষেপণ না করেই সোজা প্রবেশ করল। শান্ত শুয়ে রয়েছে, তার নেত্রজোড়ায় গভীর ক্লান্তি ও শারীরিক য'ন্ত্র'ণার অমোঘ চিহ্ন। মুখমণ্ডল এখনও ফোলা, মৌমাছির দং'শনের ক্ষ'ত'চিহ্ন স্পষ্ট আকারে রূপায়িত রয়েছে। ত্বকের কিছু অংশ কালিমাময় হয়ে গিয়েছে, য'ন্ত্র'ণায় তার দেহ ক্ষুদ্রাকারে কুঁ'ক'ড়ে । তবে শান্তর চৈতন্য ফিরে এসেছে, এবং সিয়াম তার পাশ্বে বসে চিন্তাগ্রস্ত মুখে নিস্তব্ধতার সহিত নিমগ্ন ।
ইয়াসিন প্রবেশ করেই আত'ঙ্ক'মিশ্রিত কণ্ঠে কহিল,
——— "তুই ঠিক আছিস?"
শান্ত ক্লান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে দেখল, তাহার কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠল, অত্যন্ত কষ্ট করে বলল,
——— " হু,, "
সিয়াম উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,
——— "ডাক্তার বলেছে মৌমাছির বি'ষের প্রভাব কমছে, কিন্তু শরীরের ক্ষ'তি ব্যাপক হয়েছে। স্নায়ুতন্ত্রের কিছু অংশ এখনও স্বাভাবিকভাবে কার্যকরী হচ্ছে না, তাই পুরোপুরি সুস্থ হতে বেশ সময় লাগবে শারীরিকভাবেও এখন খুব দুর্বল।"
ইয়াসিন শান্তর পাশে এসে দাঁড়িয়ে, কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
——— "তুই ওখানে কি করে গেলি শান্ত?? তোর ফোন বন্ধ ছিল, তোর বাড়ি গেলাম, কেউ কিছু বলতে পারল না। পরে আড্ডা খানায় তোর ফোন পেলাম। আমি দুদিন ধরে তোকে খুঁজেছি, পা'গলে'র মতো!"
ইয়াসিন তার কপালের ঘাম মুছতে মুছতে আরও বলল,
——— "তুই জানিস আমি কত ভ'য় পেয়েছি? তুই ওরকম জায়গায় কেন গেলি বল আমায়? আর তোর এই অবস্থা কে করল? তোর যদি কিছু হয়ে যেত, তোর পরিবারের লোক আমাকে ছাড়তই না! পুলিশ আমাকেই ফাঁ'সি দিত!"
ঠিক তখনই দরজার দিক হতে গুরুগম্ভীর এক কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হলো,
——— "হ্যাঁ, তুমি ঠিকই ভেবেছো!"
তিনজনের দৃষ্টি দরজার দিকে ফিরল। তথায় দাঁড়িয়ে ইকরাম আলী, রা'গা'ন্বিত মুখমণ্ডল, তার পার্শ্বে উপস্থিত পুলিশ!
0 Comments