লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা


কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।


*
*
*
জেলের অন্ধকারে ইয়াসিনকে এমন প্র'হা'র করা হলো যে, তার দেহ প্রায় জীবনশক্তিহীন, মৃ'ত্যু'র দ্বারপ্রান্তে উপনীত হলো বলে, এত নি'র্ম'ম, নি'ষ্ঠু'র কেন বড় হিং'স্র অপ'রা'ধীর বেলায় নয়? শুধু কি ইয়াসিন ক্ষমতাবান নয় বলেই ওর এই পরিস্থিতি? একের পর এক প্র'হা'র করেও যখন ইয়াসিনের মুখে কিছুমাত্র বাক্য উচ্চারিত হলো না, হতাশ হয়ে বাইরে আসলেন তারা । ইকরাম আলী আপন আসন আসীন হয়ে গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করলেন,
——— "কিছু বলেছে ?
ইন্সপেক্টর নিয়াজ সাহেব কিঞ্চিৎ হতাশভাবে উত্তর দিলেন,
——— "এত? মা'রা'র পরেও একটাই কথা, সে কিছু জানে না। আমার মনে হয়, ছেলেটা সত্যই কিছু জানে না!"
ইকরাম আলীর ক্রো'ধের দীপ্তি দৃষ্টিগোচর হল, তিনি ক'ঠি'ন'স্বরে বললেন,
——— "আমার ছেলেকে শেষ কল তো ওই দিয়েছে.!! ওই তো আমার ছেলেকে ওই নির্জন জায়গায় ডেকেছে! জানে না, কিভাবে ? তুই কি ওর কাছে থেকে কথা বের করবি , না আমি আমার পন্থা অবলম্বন করব?"
নিয়াজ সাহেবের ক্রো'ধাগ্নি প্রজ্জ্বলিত হলো! এই ইকরাম আর মোশারফের মধ্যে তিনি আছেন চিপা গলিতে! অথচ, এককালে উনারা একই শ্রেণিতে বিদ্যাশিক্ষায় নিযুক্ত ছিল! কিন্তু দেখো, বিধির কী নি'র্ম'ম পরিহাস! ইকরাম ও মোশারফ পরিণত হয়েছে পরস্পরের শ'ত্রু'তে! আর নিয়াজ সাহেব, তাদের ‘স্যার স্যার’ ডাকতে আর তো'ষা'মোদে নিজের সত্তা ক্ষ'য় করতে করতে মাথার চুল পাকিয়ে ফেলেছেন! তিনি বি'ব্রত হয়ে বললেন,
——— " ও স্বীকার করেছে যে শান্তর সঙ্গে দেখা করার জন্য ডেকেছিল, কিন্তু জরুরি একটা প্রয়োজনে অন্য কোথাও যেতে বাধ্য হয়েছিল, তাই নাকি দেখা করতে পারে নি! "
ইকরাম আলী তাচ্ছিল্যভরে মৃদু হেসে বললেন,
——— "জরুরি কাজ! কি সেই কাজ? এটা ও বলে নি? "
ঠিক তখনই এক মৃদু, কোমল নারীকণ্ঠে উত্তর আসল,
——— "আমি সেই জরুরি কাজ!"
নারীকণ্ঠ শুনে উভয়েই পেছনে ফিরে তাকালেন। ইন্সপেক্টর নিয়াজ কঠোরভাবে প্রশ্ন করলেন,
——— " তুমি কে? এভাবে হুট করে থানায় কেন প্রবেশ করেছ?
মেয়েটি দৃঢ় পদক্ষেপে অগ্রসর হয়ে দাঁড়াল এবং বলল,
——— "ইয়াসিন আমার সঙ্গেই ছিল!"
ইকরাম আলী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটিকে নিরীক্ষণ করলেন, কমবয়সী, এই পূর্বিকার বয়সী হবে, তার রূপ চমৎকার! তিনি ধীর গলায় প্রশ্ন করিলেন,
——— "কি প্রমাণ আছে তোমার, যে সে তোমার সঙ্গেই ছিল?"
মেয়েটি শীতলস্বরে উত্তর দিল,
——— "প্রমাণ এই ছবিগুলি!"
ইন্সপেক্টর নিয়াজ ছবিগুলি হাতে নিয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে অবলোকন করলেন। অল্পক্ষণ পরে বিব্রত হয়ে কাশতে লাগলেন তিনি। ইকরাম আলী ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ফোন ছিনিয়ে দেখলেন, কিন্তু একবারই মাত্র দর্শন করেই ল'জ্জা'য় চোখ বন্ধ করলেন। ক্রো'ধপূর্ণ কণ্ঠে বললেন,
———" অ'স'ভ্য মেয়ে! গুরুজনের সামনে এমন বে'হা'য়া'পনা ছবি দেখাতে ল'জ্জা করে না? আর এটা কিছুই প্রমাণ করে না! তুমি যে ওকে বাঁচাতে মিথ্যা বলছ না, তার প্রমাণ কি?
মেয়েটি শান্তভঙ্গিতে বলল,
——— "ইয়াসিনের ফোনের লোকেশন চেক করে দেখুন। তাহলেই দেখবেন, ও আমার বেডরুমেই ছিল।"
ইকরাম আলী বিস্ময়, ক্রো'ধে উত্ত'প্ত হলেন। শঙ্কি'তস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন,
——— "বিয়ের আগেই এসব করতে ল'জ্জা লাগে না? তোমার বাবা-মা এই শিক্ষা দিয়েছে ?"
মেয়েটি স্পষ্টকণ্ঠে উত্তর করল,
——— "আগে আপনার ছেলেকে শিক্ষা দিন, কাকা!"
ইকরাম আলী ক্রো'ধে ফেটে পড়লেন,
——— " বে'য়া'দব মেয়ে কোথাকার ! চুপ কর! তুমি জানো কি, কার সাথে বলছ? আমার ছেলের নাম মুখে তুলার সাহস কে দিয়েছে?? নিয়াজ, এই অ'ভ'দ্র মেয়েটাকে জেলবন্দি কর!"
ইন্সপেক্টর নিয়াজ কিছুক্ষণ স্তব্ধ রইলেন, পরে মেয়েটিকে প্রশ্ন করলেন,
——— "তোমার নাম কি? পরিচয়?"
মেয়েটি তাচ্ছিল্যের হাসি সহকারে বলল,
——— "নাম দিয়ে কী হবে? সময়ের সাথে আমার নামও বদলায়। যে নামে ভালোবেসে ডাকবেন, সেটাই তো আমার নাম! আর পরিচয়? শান্তর শ'য়'নস'ঙ্গী।"
ইকরাম আলী ও ইন্সপেক্টর নিয়াজ বিস্ময়ে অভিভূত, ইকরাম আলী ক্রো'ধে তর্জনী উত্তোলন করে বললেন,
——— ""এইইই মেয়ে! আমার ছেলের নামে এমন কথা বলো!! সাহস তো কম নয় তোমার!!.
মেয়েটি হেসে বলল,
——— "আহহাহা!! শান্ত তো আগেই বলেছিল আমাকে! আপনি এমন উ'ত্তে'জিত হবেন, সেটাও জানতাম। যাক সেসব কথা। আমার বেশি সময় নেই। ইয়াসিনকে ছেড়ে দিন। তখন শান্ত আমার কাছেই আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ইয়াসিন আগেই ওকে তাদের আড্ডায় ডেকেছিল, যা আমি জানতাম না। তাই আমি ইয়াসিনকে ডাকি, আর ও লোভ সামলাতে না পেরে শান্তকে মানা করে আমার কাছে আসে। এরপর আপনার ছেলে কোথায় গেলো, কে নিয়ে গেলো, কোথায় ধু'লা'ই খেলো, সেটা আমরা কেউ জানি না। কারণ আমরা তখন প্রেমে ম:গ্ন ছিলাম!"
নি'র্ল'জ্জর মতো কথা বলে মেয়েটি মনে মনে এক বিদ্রূপময় হাসি মুখে আনল, ভাবল,
—— "আমার দিন কি এতই খা'রা'প হয়েছে, যে ইয়াসিনের মতো ছো'ট'লো'কে'র বা'চ্চার সাথে বে'ড শেয়ার করতে যাব! হুহ! "
------------------
শিকদার বাড়ির ড্রয়িং রুমে কুদ্দুস আলী সোফায় বসে দলিলপত্র পর্যালোচনায় নিমগ্ন রয়েছেন। মুখে চিন্তার ছাপ, চোখে চশমা; ভারী ভাবনায় আচ্ছন্ন। হঠাৎ রিতু খালা চায়ের পেয়ালা নিয়ে নীরবে উপস্থিত হলেন। কানিজ বেগম তাকে পাঠিয়েছেন। কুদ্দুস আলী ভ্রু কুচকে তাকিয়ে দেখলেন। তিনি পেয়ালা নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই রিতু খালা সরে দাঁড়ালেন। কুদ্দুস আলী বি'রক্ত'ভাবে বললেন,
——— "কি হলো ? চা দিন!"
কিন্তু রিতু খালা মৃদু তির'স্কারের সুরে বললেন,
——— " নিজের জীবন তো গুছিয়ে নিয়েছিস, আমার জীবনের কি হবে?
সঙ্গে সঙ্গেই কুদ্দুস আলীর চেহারা ক'ঠিন হয়ে গেল। তিনি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন, তীব্র ক্রো'ধে রিতু খালার চুলের মুঠি ধরে বললেন,
——— "এই বাড়িতে খাচ্ছিস, পরছিস, যখন যা চাচ্ছিস তাই পাচ্ছিস, এতেও হয় না তোর?? তোকে যে এখনো জী'বি'ত রেখেছি, এটাই অনেক! বেশি কথা বলতে যাস না, নতুবা চিরদিনের জন্যই কথা বন্ধ করে দিব!
এই বলেই তিনি গরম চায়ের পেয়ালা রিতু খালার হাতে ঢেলে দিলেন। য'ন্ত্র'ণায় চিৎ'কার করে উঠলেন রিতু খালা। কানিজ বেগম চিৎকার শুনে দৌড়ে আসলেন। রিতুর চোখে অ'শ্রু। তার জ্ব'লন্ত চায়ের গরম তরল হাতে ঢেলে পড়েছে দেখে কানিজ বেগম আ'তঙ্কি'ত হয়ে উঠলেন, চেঁচিয়ে বললেন,
——— "তোমার দ্বারা কি একটা কাজও ঠিকভাবে হবে না, রিতু?"
কুদ্দুস আলী উদাসীনভাবে পুনরায় সোফায় বসলেন এবং দলিলপত্রের দিকে চোখ রেখে কঠি'নস্বরে বললেন,
——— "যে কাজ পারে না, তার এই বাড়িতে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু টাকা দিয়ে অ'কর্ম'ণ্য পুষে কোনো লাভ নেই!! বের হয়ে যেতে বলো ওকে!"
কানিজ বেগম তৎক্ষণাৎ কুদ্দুস আলীর কথার প্রতি কোনো ভ্রূক্ষেপ না করে রিতুকে ঠান্ডা পানিতে হাত ধুবার জন্য নিয়ে চললেন। রিতু খালা তীব্র ক্রো'ধে নিজের মনে বললেন,
——— তুই যাই করিস না কেন,, যাদের জন্য আমার সঙ্গে এমন করেছিস, তারাই তোকে ডুবিয়ে মা'র'বে! তোকে আমি কিছুতেই ছাড়ব না!
--------------
——— “চল রূপার বাড়ি যাই।”
কলেজের গেটের সম্মুখে আঁখি, আছিয়া ও মিলির নিকট এ প্রস্তাব রাখল। আছিয়া একবার আকাশের দিকে চোখ তুলল। ঘন মেঘে ঢাকা নীলিমা যেন বি'ষণ্ণ রাত্রির অর্থাৎ বৃষ্টির আগমনের বার্তা দিচ্ছিল। সে বলল,
——— “কিন্তু,, মনে হচ্ছে বৃষ্টি আসবে।”
আঁখি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল,
——— “উহুম, বল আল্লাহ চাইলে বৃষ্টি নামতে পারে! আর তা হলে হোক, দরকার পরলে সবাই একসাথে ভিজব। তবুও চল রূপার সাথে দেখা করতে যাই, কত যুগ হলো দেখি না যেন।”
আছিয়া ও মিলির মনে বি'ষা'দের ছায়া পড়ল। সত্যই, কলেজের জন্য আর দেখাও হচ্ছে না। আগের মতো পুকুর পারের সে আড্ডাটাও হচ্ছে না! মা-ম'রা মেয়েটার যে কেও নেই, তারা ব্যতীত। মিলি হেসে বলল,
——— “হ্যাঁ, চল দরকার পরলে আজ ভিজব! চারজনেই! জ্বর আসলে আসুক!”
যে কথা সে কাজ, তিনজন পায়ে পায়ে রওনা হলো রূপার বাড়ির দিকে।
—————
চা'কু হাতে ধাবমান, র'ক্তা'ভ মাথায় টগবগিয়ে রা'গের তা'প। আজ সে তার পথের প্রতিবন্ধককে মৃ'ত্যু'র উপহার দিবেই। যে করেই হউক! পায়ে ভারি আওয়াজ তুলে চলছে, যেন প্রতিটি পদক্ষেপে অ'গ্নির স্পর্শ আছে। তার কাঙ্ক্ষিত স্থানে আসল সে। তার শ'ত্রু দাঁড়িয়ে, সিগারেট ফুঁকছে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে। আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা নয়! পেছন হতেই আ'ক্র'মণ করেই চা'কু বসিয়ে দিবে আজ। আফ্রিদি ছুটল, কিন্তু যেই না ছু'রি তুলল, সঙ্গে সঙ্গে মুগ্ধ পেছনে ঘুরে শক্তহস্তে আফ্রিদির হাতে থাকা চা'কু ধরে ফেলল। চা'কু ধরায় শক্তপোক্ত হাত কে'টে র'ক্ত গড়িয়ে পরলো মুগ্ধর!
——— “আজ তোকে মে'রে'ই ফেলব!”
আফ্রিদি চীৎকার করে আবার বলল,
——— “ছাড় হাত! তুই কি ভেবেছিস, মুগ্ধ? তুই আমার পূর্বিকে কে'ড়ে নিবি, দরকার পরলে ফাঁ'সি'তেও ঝুলব, কিন্তু ওকে তোর হাতে দিতে পারব না!”
মুগ্ধের মুখ শীতল, চোয়াল শ'ক্ত। র'ক্ত তার রুক্ষ বলিষ্ঠ হাত হতে টপটপ করে মাটিতে পরে চলছে, কিন্তু তার দৃঢ়তার ভঙ্গি অপরিবর্তিত। আফ্রিদির বাড়ি যখন গেলো তখনও আফ্রিদির খোজ পায় নি সে! পূণরায় আজ ডেকেছিল আফ্রিদির সাথে কথা বলার জন্য! মুগ্ধ জানত, আফ্রিদি ক্রো'ধা'ন্বিত, কিন্তু পেছন হতে তাকে মা'র'তে আসবে, তা কল্পনাও করে নি। মুগ্ধর ক্রো'ধ অ'গ্নি'তে রূপ নিল। দাঁত কটমটিয়ে বলল,
——— “তুই জানিস কাকে মা'র'তে এসেছিস?”
——— “আমার শ'ত্রু'কে!”
——— "মা'র'তে পারলি ? "
———" হাত ছাড় আমার,, তারপর তোকে মা'র'ব আমি! "
———" তুই কাকে দেখছিস? "
———" আমার চির'শ'ত্রু'কে! "
——— "তোর ছু*রির আঘাতের প্রয়োজন নেই। যেই ক্ষণে তুই আমার প্রাণহরণের পরিকল্পনা করেছিস, সেই ক্ষণেই আমি মৃ'ত! কেবল দেহ নয়, তোর প্রতি যে বিশ্বাস,, সেও বিলুপ্ত। আমাদের বহুদিনের সখ্য, যা আমি চিরস্থায়ী বলেছিলাম, আজ অবসান। দেহ না, কিন্তু হৃদয় র'ক্তা'ক্ত, ক্ষ'ত'বি'ক্ষ'ত! তুই সেই পা'ষা'ণ হৃ'দ'য়ে আ'ঘা'ত করেছিস, যা তোকে বন্ধু বলে স্থান দিয়েছিল।
পেছন থেকে কেন, কা'পু'রু'ষের মতো? যদি সত্যিই ম'র'ণ দিতে চাস, সম্মুখে এসে এই পাথরবুকে আ'ঘা'ত কর!
(র'ক্তি'ম চোখে চেয়ে, একটু থেমে)
তুই কি সেই, যে সহচর্যে হাসি-কান্না ভাগ করত?
যার সাথে বেড়ে উঠেছি? এক থালায় ভাগ করে খেয়েছি? তুই কি সে, যে আমার না বলা কথাগুলিকে হৃদয়ের গভীরে অনুভব করতি? এই রা'গী, অবা'ধ্য, একগুঁয়ে ছেলেটির অন্তরে প্রবেশ করতে পারতি? তুই কি সেই? তবে আজ কেন তুই বুঝতে পারলি না? কেন তুই আমার অন্তরের পাতাগুলি পাঠে ব্যর্থ হলি?"
র'ক্তি'ম চোখে মুগ্ধ ফের গম্ভীর কন্ঠে বলতে লাগল,
——— “তুই কি জানিস আমি কাকে দেখছি? হেরে যাওয়া আমাকে, আর সেই ছোটবেলার বন্ধুকে, যে আমি না থাকলে স্কুলেও যেত না! আমার জন্য স্কুলের বেঞ্চ ধরে রেখে দিত, একসাথে বসবে বলে! আমার জন্য টিফিনে বেশি খাবার আনত, ভাগে যেন কম না পরে!! মনে আছে, একদিন তুই দশ টাকা হারিয়ে ফেলেছিলি। সারাদিন তুই আর আমি একসাথে খুঁজেছিলাম, কিন্তু পাই নি। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল, সেদিন আমি ভিষণ বি'র'ক্ত হয়ে বলেছিলাম, কত টাকা লাগবে আমায় বল, আমি দিব। আর তুই সেদিন হেসে বলেছিলি,
——— ‘টাকাটা বাহানা মাত্র, সারাটা দিন একসাথে কাটালাম আমিতো এটাই চেয়েছিলাম! এর চেয়ে দামি আমার কাছে আর কিচ্ছু নয়! তোর টাকা তুই তোর প'কে'টে রাখ!’
——— "তুই কি সেই আফ্রিদি? "
মুগ্ধ ধীরে কঠিনস্বরে বলল,
——— "যে বন্ধুত্ব একদিন দশ টাকার অজুহাতে গড়া, আজ তারই মূল্য তুই দশ টাকারও কম করে দিলি।"
আফ্রিদির বুক কেঁ'পে উঠল। স্মৃতির ঢেউয়ে তার চেতনা হতে অতীত ভেসে উঠল হাজারো মধুময় সে বন্ধুত্তের প্রহর। ছোটবেলার সেই দিন, যেদিন ইচ্ছাকৃতভাবে আফ্রিদি মি'থ্যে বলে মাঠে সারাটা সময় কাটিয়েছিল। তখন সে ভাবত, তার প্রিয় বন্ধু মুগ্ধ তাকে সময় দেয় না, তার সাথেই থাকে না। মুহূর্তেই আফ্রিদির হাত আলগা হলো। চোখের কোণে অশ্রুর বিন্দু, মুগ্ধর চোখ কঠিন, শীতল, তবে আফ্রিদির অন্তরে তুষা'রের ন্যায় বিদ্ধ হল সেই দৃষ্টি। ঠিক সেই মুহূর্তে রোহান চায়ের দোকান থেকে এসে দুইজনকে এই অবস্থায় দেখে স্তম্ভিত হল। তৎক্ষণাৎ দৌড়ে এসে আফ্রিদির হাত হতে ছু'রি কেড়ে নিয়ে জোরে একটি ঢিল মারল দূরে। রোহান কটমটিয়ে আফ্রিদিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে এক চ'ড় মেরে বলল,
——— “তুই এত নি'চে নামতে পারলি আফ্রিদি? নিজের বন্ধুকে মা'র'তে তোর বুক কাঁ'পল না? আজ তোকে আমার বন্ধু বলতে ল'জ্জা করছে ! থু'তু মা'রি তোকে আমি ! ”
মুগ্ধ রোহানের কাঁধে হাত রেখে শান্তভাবে বলল,
——— “পিপীলিকার পাখা গজায় ম'রি'বার তরে! যেতে দে!”
এই কথা বলেই র'ক্তা'ক্ত হাত নিয়ে দ্রুত চলে গেল মুগ্ধ। রোহান একবার রা'গী দৃষ্টিতে আফ্রিদির দিকে তাকিয়ে নিজেও ফুঁসে উঠে চলে গেল। একমাত্র আফ্রিদি দাঁড়িয়ে রইল, মনে চলল এক গভীর প্রশ্ন,
——— " মুগ্ধ কি চায়,, ওর আসল উদ্দেশ্য কি? "
------------
রূপা বাঁশের চাটির ঘরে মাটির মেঝেতে পরম যত্নে কাদা দিয়ে লেপছিল। মেঝেটি সুন্দরভাবে লেপে সমাপ্ত করার পর, সে তার উপর বালি ছিটিয়ে দিল, যেন দ্রুত শুষ্ক হয়। পাটের ছালা বিছিয়ে ঘর হতে বাহিরে আসল, রান্নাঘরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চিন্তায় নিমগ্ন হল; আজ কি রান্না করা যায়? ঘরে মাত্র দুইটি আলু বিদ্যমান। নিজস্ব উদ্যানের কাঁচা মরিচ আছে, আর একটুকরা পেঁয়াজ কুটে সরিষার তেলে ভর্তা রচনা করলেই যথেষ্ট। আধা সের চালও আছে, এর দ্বারা রাত্রির ভোজন সম্পন্ন হবে। যদি কিছু ভাত অবশিষ্ট থাকে, তার পিতা প্রভাতকালে সেই পান্তা ভাত খেয়ে কাজে যাবে।
রূপার পিতা আঁখিদের চাতালকলেই কাজ করেন, যা ধান প্রক্রিয়াকরণের কেন্দ্র। চাতালকলটির তত্ত্বাবধান করেন কুদ্দুস আলী, আর মোকামের ভার গ্রহণ করেন আজগর আলী। এই সকল ভাবতে ভাবতে রূপার হৃদয়পটে তার দাদির স্মৃতি উদ্ভাসিত হল। মায়ের কোনো স্মৃতি তার মনে নেই; জন্মকালে ই তার মাতা ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন। শৈশবে তার দাদিই তাকে আগলে রেখেছিলেন। কিন্তু আট-দশ বৎসর বয়সেই দাদিও পার্থিব বন্ধন ত্যাগ করেন। এই সকল স্মৃতির গভীরে নিমজ্জিত রূপা এক দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল।
ঠিক সেই মুহূর্তেই পশ্চাৎ হতে উচ্চকণ্ঠে আহ্বান ভেসে আসল তিনটি চীরচেনা কন্ঠিস্বর,
—— "পটলফুললল!! আমরা এসেছি!"
রুপা পশ্চাতে ফিরে দেখল আঁখি, আছিয়া, আর মিলি দাঁড়িয়ে ! ভাতের হাড়ি নামিয়ে, রূপা তাড়িত্বে বাহিরে বাড়ির উঠানে দৌড়ে গেল! তাদের দর্শনমাত্রই রূপার ম'লিন মুখটি হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠল। চারজন পরস্পরের হাত ধরে বৃত্তাকারে লাফাইতে লাগল খুশিতে; উচ্চস্বরে তাদের সেই শৈশবের মিত্রতার ছড়াটি আওড়াইতে লাগল,
——— "বিড়াল লুটায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, ঝালমুড়ির অ'গ্নি,
ফুটবলে দ্রুতগতি, পটলফুলে রণর'ঙ্গি'নী।
মোদের বন্ধন অমর, কোনো কালেই নাহি ক্ষ'য়,
সহস্র ঝঞ্ঝা'তেও মোরা একত্র, হস্ত ধরে রয়।"
এইরূপে চার সখী একত্রিত হয়ে অট্টহাস্যে মগ্ন হল! বহুদিনের জমিত কথামৃত যেন বাতাসে ভেসে উঠল, অকথিত কাহিনীর ভাণ্ডার যেন উন্মুক্ত হল হাল্কা পবনে। মাটির উঠোনে পিরা ও টুলের উপর আসন গ্রহণ করে, তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হতে লাগল অপ্রতিরোধ্য হাসির জোয়ার। ফুচকার মোহে আসর আরও জমে উঠল, সকলেই ফুচকা মুখে দিয়ে হর্ষোচ্ছ্বাসে মত্ত। হঠাৎ সেই অপর্ণবর্ণ, মলিন কু'কু'রটি পুনরায় লেংড়িয়ে প্রবেশ করল প্রাঙ্গণে। রূপা, যে টুলের উপর আসীন ছিল, সহসা ক্ষো'ভে টুল উত্তোলন করে কু'কু'রটির মস্তকে আ'ঘা'ত হানল। চীৎকার করে বলল,
——— এইই! তুই আবার এসেছিস?
আঁখি, মিলি, ও আছিয়া—তিনজনেই অনতিবিলম্বে কেশার্শ্ব ঘুরিয়ে কণ্ঠার্জিত তীক্ষ্ণস্বরে সে চিহ্নিত কু'কু'রটিকে পয়ঃকৃষ্ট চিৎকারে নতঃশিরে করল। সেই কু'কু'রের বিকট চিৎকারে সহসা সঙ্গে সঙ্গে আঁখির মুখাবয়বে ক'ঠো'রতা উপনীত হলো, দৃষ্টিপটে র'ক্তি'ম জ্যোতিঃসংলগ্ন হলো মুহুর্তে। অতঃপর রা'গে স্ফীত কণ্ঠে রুপার প্রতি চিল্লিয়ে ধ'ম'ক দিয়ে বলল,
——— "রুপাআয়ায়া..!!"
রুপা, আছিয়া, মিলি—তিনজনেই ভী'ত, কাঁপ'নাক্রান্ত,, প্রথমবারের মতো এমন উচ্চকণ্ঠ আঁখির মুখে শ্রবণ করে তারা বিস্ময়াক্রান্ত। রুপা বিস্মিত দৃষ্টিতে আঁখির দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে। আঁখি উল্লম্ফনে উঠে দণ্ডায়মান হলো এবং কু'কু'রটির নিকট হেটে উপস্থিত হলো । সেই অপ'কৃষ্ট, নোং'রায় বিভূষিত কু'কু'র, যে রুপার অঙ্গুলিক্রান্ত টুলের দ্বারা পীড়িত, সকলকে পুনর্বার বিস্ময়ে আচ্ছন্ন করে আঁখি দ্ধিধাহীন হাতে কু'কু'রটির মাথায় স্পর্শ করল! তৎপরতায় তার হাত দিয়ে বুলিয়ে দিল সেই জ'ঘ'ন্য আব'র্জ'না'য় আচ্ছন্ন কুকুরটিকে। আছিয়া, মিলি, এবং রুপা তৎক্ষণাৎ বি'র'ক্তি, বিমু'খতা'ব্যঞ্জ'ক দৃষ্টিপাতে চোখ-মুখ বি'কৃ'ত করল। মিলি বলল,
——— "ছিহহ, আঁখি! তুই এটা কি করলি? তুই ওই নোং'রা কু'কু'রকে স্পর্শ করলি কিভাবে ?"
রুপা সাথেই বলল,
——— "ছিহ! ওটাকে ছাড়, আঁখি! আজ তো ওকে আমি…"
এই বলে রুপা পুনরায় তৎক্ষণাৎ তেড়ে আসল কু'কু'রটির দিকে। তাকে মে'রে দূরীকরণে উদ্যোগী হলো। আঁখি তখনি তৎক্ষণাৎ কু'কু'রটির সম্মুখে দাঁড়িয়ে গমন করল। অবলা কু'কু'রটি অবলোকন করল যে, তাকে রক্ষার নিমিত্ত আঁখি অগ্রপদস্থ হয়েছে। সে কু'কু'রটি তার পশ্চাতে দাঁড়িয়ে রইল—জিহ্বা অর্ধেক বর্গাচ্ছন্ন করে বাহির, উচ্ছ্বাসিত নিশ্বাসে প্রকম্পিত সাদা কালো রঙার সেই কু'কু'রটি । রুপা বলল,
——— "শুন আঁখি, এই কু'কুর'টা আমাকে অনেক জা'লা'য়! সবসময় বাড়িতে এসে বসে থাকে! আর ঘে'উ ঘে'উ করে ঘুমের বারোটা বাজায় ! খাওয়ার সময় মুখ হা করে তাকিয়ে থাকে, চোখে ন'জ'র লাগায়! তুই শুধু শুধু রা'গ করিস না! এদের বেশি প্রশ্রয় দিলে মাথায় চড়ে বসে!"
——— "কত দিন হলো আসছে?"
——— "অনেক দিন ধরেই!"
——— "আসার কারণ?"
——— "আরে বলিস না! একদিন মুরগির মাংস রান্না করছিলাম। আব্বা অনেকদিন পরে মুরগি আনলেন। খাওয়া শেষে কু'কু'রটি হঠাৎ কোথায় হইতে উদয় হল কে জানে! ভাবলাম, অবলা প্রাণী, নাহয় খানিকটা দেই! তাকে হাড় দিলাম। সেই থেকেই শুরু হয়েছে আসা! এত তাড়িয়ে দেই, তাও আসে!
আঁখি ক্রো'ধা'ন্বিত মুখে ব্যঙ্গময় হাস্য সংযুক্ত করে বলল,
———"দেখলি তো, তুই একখণ্ড হাড় দিলি, আর তাতে তোর পাহারাদার হয়ে গেল! বুঝতে পারছিস না? একটা অবলা প্রাণীকে একটু খাবার দিয়েছিস, তাই সে তোর প্রতি এতটা বিশ্বাসী হয়ে গেছে। আর তুই এই বিশ্বাসের বদলে ওকে মা'র'তে চাস? ভাব, মানুষ হয়ে কীভাবে এতটা নি'ষ্ঠু'র হইতে পারিস?এই পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তার দেওয়া প্রতিটা জীবেরই একটা উদ্দেশ্য আছে। আর তুই একজন মানুষ হয়ে তোর দায়িত্বটুকুও বুঝলি না? ও যে আজ তোর বাড়িতে আসে, সেটা শুধুই তোর দেওয়া সেই একটুকরো হাড়ের জন্য নয়, বরং তোর দেওয়া ভালোবাসার জন্য।"
আঁখি তখনি গুরুগম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
——— "বল, সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ জীব কি?"
——— "মা... মা... মানুষ!"
কেঁ'পে কেঁ'পে উত্তর দিল রুপা। প্রথমবারের মতো আঁখির এমন রূপে পরিদর্শন করে তার বিস্ময় চরমে। আছিয়া ও মিলিও উঠে উপস্থিত হল, রুপার দু'পাশে গমন করল। তারা উভয়েই চক্ষুগোচরে বা'ঘি'নী'র রূপে তাদের বিড়ালটিকে প্রত্যক্ষ করল যেন! এতদিন কি তবে তারা ভুল ভেবে আসছিল? একটি সামান্য কু'কু'রের জন্য এমন ক্রো'ধ? আঁখি পুনরায় গুরুগম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
——— "বল, সৃষ্টিকর্তার নি'কৃ'ষ্টতম জীব কি?"
তিনজনেই চিন্তায় মগ্ন হইল। হঠাৎ করে আছিয়া বলল,
——— "সা'প!"
আঁখি বাঁকা হাস্যে মুখ বি'কৃত করিয়া দন্তপেষণসহ ধীর তেজস্বী স্বরে বলল,
——— " ভুল!!! সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীবও মানুষ!"
স্তব্ধ হয়ে রইল সকলে! আঁখির মুখে ‘মানুষ’ শব্দের এমন তীব্রতা যেন চারিদিক নিস্তব্ধ করে দিল। মানুষ? হ্যাঁ, সত্যই তো, আঁখি ভুল কিছুই তো বলে নি! এই জগতে কত মানুষ মুখোশে ঢেকে বহিয়া বেড়ায় পশুর চেয়েও নি'কৃ'ষ্ট প্রবৃত্তি। আঁখির চোখে অশ্রুর বিন্দু যেন টলমল করে উঠল, কিন্তু সে অশ্রু কোন ব্য'থার তা কেওই বুঝতে পারল না। র'ক্তি'ম আঁখি দাতে দাত পিষে, কঠিন গলায় পুনর্বার বলল,
——— "আমি সেইসব মানুষকে ঘৃ'ণা করি, যারা অন্য মানুষকে 'কু'কু'র' বলে গা'লি দেয়! কারণ, এক একটি কু'কু'র যদি একটি হাড় পায়, সে লে'জ গু'টিয়ে ফিরে আসে, প্রেম আর নিষ্ঠার সঙ্গে। কিন্তু মানুষ? মানুষ সহজেই বিশ্বাস ভ'ঙ্গ করে, প্র'তা'রণা'র বৃত্তে আবদ্ধ হয়! মানুষের মধ্যে এমন অনেক অমানুষ আছে, যারা মুখোশের আড়ালে নি'পীড়'ক, নি'ষ্ঠু'র, অ'ধ'ম। কু'কু'রের সঙ্গে তুলনা দিয়ে কু'কু'রকে অপমান করা হয়, অথচ কুকুরের অন্তত একটা বিশুদ্ধ হৃদয় থাকে, যা মানুষকে অনেক সময় শিক্ষা দেয়—বিশ্বাস আর ভালোবাসার মূল্য। আর মানুষ? তারা তো মাঝে মাঝে নিজেদের নৈতিকতাকে বি'ক্রি করেও সস্তা স্বার্থ চরিতার্থ করে। সত্যি বলছি, কুকুরের পাশে দাঁড়িয়ে মানুষকে যদি বিচার করতে হয়, তবে মানুষই বরং অধিক নি'কৃ'ষ্ট!"
(নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা'আলার নিকট সমস্ত প্রাণীর তুলনায় তারাই মূক ও বধির, যারা উপলদ্ধি করে না। [সুরা আনফাল -৮:২২]
তাফসীরে মুফতি তাকি উসমানীঃ
পূর্বের আয়াতে ‘শোনা’ দ্বারা ‘উপলব্ধি করা’ বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ কাফেরগণ শোনার দাবী করলেও বোঝার চেষ্টা করে না। এ হিসেবে তারা পশুরও অধম। কেননা বাকশক্তিহীন পশু কোন কথা না বুঝলে সেটা নিন্দাযোগ্য নয়, যেহেতু তাদের সে যোগ্যতাই নেই এবং তাদের কাছে এটা দাবীও থাকে না। কিন্তু মানুষের তো বোঝার যোগ্যতা আছে এবং তার কাছে দাবীও রয়েছে যে, সে বুঝে-শুনে ভালো পথ গ্রহণ করুক। তথাপি সে বোঝার চেষ্টা না করলে পশু অপেক্ষাও অধম সাব্যস্ত হবে বৈকি!)
প্রত্যেকেই বাকরুদ্ধ, কারো কিছু বলবার সাধ্য হল না! কারণ আঁখি মিথ্যা তো কিছু বলেনি। রুপা এখন হাত জোর করে আঁখিকে বলল,
——— "ক্ষ'মা কর, বোন! আমার খুব ভুল হয়ে গিয়েছে! আর এমন করব না! আর এমন হয়ে থাকিস না বনু!! তোকে এভাবে দেখে ভ'য় করছে এখন।"
মিলি বিস্ময়ে বলল,
——— "এখন তো আমি কনফিউজড!"
——— "কিসে?"
আছিয়া প্রশ্ন করল। মিলি আঁখির দিকে তাকিয়ে বলল,
——— "বিলাই রাণী বলমু নাকি বা'ঘি'নী বলমু?"
আঁখি ফিক করে হাসল, জোরে জোরে হাসিতে মেতে গেল। চোখের টলমল জল সে আঙুল দিয়ে মুছে ফেলল। রুপা, আছিয়া, মিলি—তিনজনে অবাক । আজ আঁখির হাসিতে কেমন যেন আলাদা রূপ! আঁখি হেসে কোমরে দুই হাত গুজে বলল,
——— "আমি তোদের কাছে আগেও বিলাই আর এখনো!"
এবার কে কী বলবে? তিনজন একত্রে স্বস্তির নিশ্বাস গ্রহণ করল। ওরা তো ভয় পেয়ে গিয়েছিল! ভেবেছিল রাগের কারণে হয়তো কথাই বলবে না আঁখি ! সত্যিই যারা চুপচাপ থাকে তারা গর্জন করে উঠলে আ'ত্মা কে'পে উঠে যেন!
চারজনই পুনরায় হাসিতে মেতে উঠল। সাক্ষী রূপে উপস্থিত সেই সাদা-কালো কু'কু'রটি। চারিদিকে হাসির ঝং'কার বিরাজমান! আকাশে কা'লো মেঘে আচ্ছন্ন, ঠান্ডা শীতল বাতাস বয়। তখনি আকাশের দুর্দমনীয় ক্রো'ধে মুষলধারে বর্ষিত হল বৃষ্টি! ভিজে গেল চার কন্যা—তাদের সঙ্গে সেই অ'প'মানিত পথবাসী কু"কু'রটিও! এহেন অ'শু'চি জ'ন্তু এবার নিশ্চয়ই ধৌত হবে বর্ষার অঝোর ধারা তলে? চার কন্যা বৃষ্টির অমৃত ধারায় একাকার হল! তাদের সমস্ত অঙ্গে বৃষ্টির সিক্ততা প্রবলভাবে লেপ্টে থাকল। হাতে হাত ধরে তারা চক্রাকারে আবর্তিত হতে লাগল, উচ্চারিত হল সেই পুরনো ছড়াটি, যা তাহাদের শৈশবকালে থেকে, একসাথে ধ্বনিত হল,
——— "বিড়াল লুটায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, ঝালমুড়ির অ'গ্নি,
ফুটবলে দ্রুতগতি, পটলফুলে রণরঙ্গিনী।
মোদের বন্ধন অমর, কোনো কালেই নাহি ক্ষয়,
সহস্র ঝঞ্ঝাতেও মোরা একত্র, হস্ত ধরে রয়।"
আজ আঁখি নিয়ম ভা'ঙবে! ভিজবে সে.! যে যা কিছু বলার বলুক! বকা'র যথেষ্ট ক্ষেত্র থাকলেও, তা আঁখির ধ্যানের মধ্যে প্রবিষ্ট হবে না আজ! আজ এই অনুপম ক্ষণটির স্মৃতিফলকে চিরস্থায়ী খোদাই থাকবে! রুপা তার তিন সখির দিকে চেয়ে রইল। বেশ কিছুক্ষণ কাটল, কেন যেন আজ এই তিন মুখের থেকে দৃষ্টি সড়ছে না! কত সুন্দর লাগছে ওদের হাসতে! হাত ধরে বৃত্তাকার হয়েই হঠাৎ রুপা বলে উঠল আবেগমাখা সে বন্ধুত্তের বন্ধনের বুলি,
——— " যদি মহান সৃষ্টিকর্তা কভু আমাকে অনুজ্ঞা প্রদান করেন, আমি কী অভিলাষ করি? তবে আমি বলব, আমার এই ত্রৈসখী বাঞ্ছনীয়। হে ধরা, হে আকাশ-সমীরণ, হে মেঘমালা, হে দূর্বার প্রান্তর, হে বনস্পতি, হে নির্ঝরিণী, হে সপুষ্পিত লতা-গুল্ম, হে প্রান্তরের বিস্তীর্ণ তৃণরাজি!! তোমরা যারা আমায় ঘিরে আছ, যদি কৌতূহলে জানতে চাও, আমি কার নিমিত্তে শ্বাস গ্রহণ করি? তবে নিশ্চয় জেনো, এই ত্রৈসখীর ব্যতীত আমি নিঃ'স'ঙ্গ, অপূ'র্ণ।
আঁখি, তুই আমার সরলতার প্রতিচ্ছবি, আমার ক্ষুদ্র মৃগনাভি, তুই কোমলতা, যাকে আমি স্নেহবন্ধনে আবদ্ধ রাখি। আছিয়া, তুই আমার ঝালমুড়ির সমুজ্জ্বল উষ্ণতা, রাগের আ'গ্নে'য়শি'খার মধ্যে তব প্রখর বল , তুই তো আমার অদম্য শক্তি। মিলি, তুই আমার ক্রীড়ামুখর ফুটবল প্রানসঞ্চারিণী, তোর সাহচর্যেই তো জীবনের প্রকৃত আনন্দ খুঁজি।
আর আমি, তোদের প্রমত্ত পটলফুল, চপলতায় ভরপুর, তোদের হাসির মাধ্যমে যেন সমগ্র জগতকে প্রাণোচ্ছল করি।
যদি আমি যাত্রা করি পরলোকে, তবে তোরা একে অপরকে শক্তহস্তে ধারণ করিস, যেন এই বন্ধন কখনও বিচ্ছিন্ন না হয়। আমি চাই, তোদের হাসির ধ্বনি যেন অবিরাম প্রতিধ্বনিত হয়, আর তোরা একে অপরের পাশে সহৃদয় দাঁড়িয়ে থাকবি, কারণ তোরাই আমার শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
হে আল্লাহ! আমার আকুল প্রার্থনা তোমার নিকট, আকাশকে বলিও, আমি ইচ্ছা করি, এই বন্ধুত্বের মহামন্ডলে আকাশে কোনো মেঘমালা কালিমা না ধারণ করে, কোনো অন্ধকার যেন তার পরিসীমায় প্রবেশ না করে.!
যদি কিছু ঘটে, আমি প্রার্থনা করি, তোরা পরস্পরে থেকে সকল দুঃখ, বি'পদ প্রতিহত করবি। তোদের হাস্যরব যেন পুনরায় জগৎকে জীবন্ত করে তোলে, আর আমি তোদের সুখে পরম শান্তি লাভ করব।
কারণ তোদের বিহনে আমি নিতান্ত শূন্য। হতে পারে এই শেষ, নিশ্বেসে নেই বিশ্বেস, কিন্তু আমার ভালোবাসা তোদের চিরকালের সহচর থাকবে।"
0 Comments