লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা


কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।


*
*
______________(গান)_____________
পুরানো সে দিনের কথা ভুলবে কিরে
হায় ও সে
চোখের দেখা, প্রাণের কথা
সে কি ভুলা যায়……
কিছু স্মৃতি এমন হয় যা আমাদের আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও মুছে ফেলা সম্ভব হয় না। জীবনের কৃতদাসী অতীতের ভয়ঙ্কর স্মৃতির স্রোত যখন আমাদের বাঁচার আকাঙ্ক্ষা নিবৃত্ত করতে থাকে, তখন জীবনের কিছু মূল্যবান চিরস্মরণীয় মুহূর্তগুলিই আমাদের অন্তরের মৃ'ত সত্তাকে পুনরুজ্জীবিত করে।
যারা এ মনস্তত্ত্বের আয়ত্তে প্রবিষ্ট হতে সক্ষম হয়, তারা বেঁচে থাকে। আর যারা সক্ষম নয়, তারা নিজের অস্তিত্বকে ধ্বং'সকারী কাজ করতেও দ্বিধা করে না।
প্রকৃতির নিয়মে সময় নিজস্ব গতি অনুসরণ করতে থাকে। সময় কারো জন্য অবসান ঘটায় না, জীবনও কারো জন্য থেমে থাকে না। এক সময় যখন মনে হতো, কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির অভাব অতিক্রম করা অসম্ভব, জীবন তাদের ছাড়াই বাঁচতে শিক্ষা দেয়।
কিছু মানুষ তাদের জীবনের অতুলনীয় মুহূর্তসমূহের স্মরণ করে বেঁচে থাকার শক্তি অর্জন করে। মনে হয় যেন তারা আবার সেই অমূল্য সময়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে, যা তাদের বাঁচিয়ে রাখছে। চোখ বন্ধ করলে আজও সেই মুহূর্তের স্পষ্ট চিত্র দেখা যায়। যেন সেই অভিজ্ঞতা এখনও বর্তমান।
----YouTube
ফ্লাসবেক
_______________(গান)_______________
আকাশে বাতাসে চল সাথী উরে যাই
ডানা মেলে রে …
ময়নারে ময়নারে যাবো তোর পিছু পিছু,
ডানা মেলে রে…
_______
-" কায় হা হামার গাছত বসি আছে বাহে?" (আঞ্চলিক ভাষায়)
বিকেলের কোমল আলোতে এক কিশোরী গাছের শাখায় বসে পেয়ারা খাচ্ছিল। সে মুহূর্ত যেন স্বপ্নের মতো প্রতিত হচ্ছিল তার নিকট। চারপাশে সবুজের শোভা, হালকা বাতাসে গাছের পাতা দুলছে। কিশোরী যখন পেয়ারা খাচ্ছে, তার ঘন কালো রেশমের মত লম্বা বেনি করা চুল কোমরের নিচে অব্দি পরে হালকা বাতাসে দুলছে। মাঝে মাঝে কপালের ছোট চুল গুচ্ছ হস্তে কানের কাছে সন্নিবিষ্ট করছে।
হঠাৎ লোকটির কথায় ভড়কে গেল সপ্তাদশি কিশোরী। একটি শুষ্ক ঢোক গিলে ভয়া'তুর দৃষ্টিতে তাকালে মোবারক পুনরায় চিৎকার করে বলল,
- "আব্বা… আব্বা, হামার গাছত চোর উঠিছে, এ চ্যাংড়ি নামেক। "
মোবারকের কথায় ভয়গ্রস্ত হয়ে সপ্তাদশি কিশোরী গাছ থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল। ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে সে কি করবে, কি বলবে বুঝতে পারছে না। পালাবে নাকি? না, সে কি চোর যে পালাবে? নিজ সাহসিকতার প্রমাণ দিতে এসে সে নিজেই নিজের উপর রাগী হয়ে উঠল। এখন কথাই গলা দিয়ে বের হয় না। নিজেকে বক্রবক্তার মাঝেই মোবারক পুনরায় বলল,
-" মোর গোরত আয়। "
কিশোরী এক পা নড়ল না। স্থির দাঁড়িয়ে রইল। ভয়েতে মাথা উঁচু করে মোবারকের দিকে একপলক তাকাল। মোবারক অপ্রস্তুত হয়ে স্তম্ভিত হল খানিক।
তার সামনে দাঁড়ানো ছোট্ট দেহের শ্যামবর্ণ কিশোরী, গাঢ় নীল রঙের গোল জামা পরিহিত। লোকেরা বলে গাঢ় নীল শ্যামবর্ণের মেয়েদের মানায় না, তবে এখানে উপস্থিত কিশোরীর প্রতি দৃষ্টি দেওয়া উচিত।
মাথার পূর্ণ হাটু পর্যন্ত রেশমের মতো কালো কেশ, যা বর্তমানে দুই পাশে বেনি হয়ে নীল ফিতা দিয়ে বাঁধা। মেয়েটির সৌন্দর্য যেন নিসর্গের এক অতুলনীয় সৃষ্টিরূপ। শ্যামবর্ণা তার ত্বক, যেন রজনীর অন্ধকারে আলোকিত জ্যোৎস্নার ছোঁয়ায় আবৃত, শীতলতার সেই অভিজ্ঞান রূপে প্রকাশিত। সেই রূপে ছিলো এমন এক স্নিগ্ধতা, যা প্রতিটি হৃদয়কে মুগ্ধতায় পূর্ণ করতে সক্ষম। তার অক্ষিপটে ঘন পাপড়ি, মায়ার আবরণে ঘেরা, যেন স্বপ্নীল জগৎ হতে উদ্ভাসিত।
ডান চক্ষুর নিম্নদেশে ক্ষুদ্র একটি তিলক, যা তার মোহনীয় সৌন্দর্যকে বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে; যেন ক্ষুদ্র সেই বিন্দুটিই তাহার মুখাবয়বের যাবতীয় রূপলাবণ্যের কেন্দ্রবিন্দু। তার গোলাকার, কোমল মুখমণ্ডলটি স্নেহ ও মায়ায় পূর্ণ, যেন এ জগৎ কখনও তার রূপের কোনো ক্ষত সৃষ্টি করতে পারবে না।
যখন সে মাথা হতে অবনমিত ওড়নাটিকে তুলে নেয়, তার মুখমণ্ডলে এক চরম ভীতি ও সরলতার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠে। সেই রেশমের ন্যায় ঘন কালো কেশগুচ্ছ, যা তার কোমর অবধি বিস্তৃত, সে দ্রুততার সহিত বেনি করা অবস্থাতেই কোনোরকম পেচিয়ে হাতখোপা করে ওড়নাটির আবরণে আচ্ছাদিত করে দেয়, যেন এ রমণীয় রূপ শুধু তার নিকটেই রক্ষিত থাকে।
মোবারক, এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের সম্মুখীন হয়ে, একমুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, মোবারক সামান্যভাবে অস্বস্তি বোধ করলেন। তাঁর কপালে একটি সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে গেল, তিনি প্রশ্ন করলেন,
- "তোর নাম কি বাহে?"
মেয়েটি চোখ মুচড়ে পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা মনে করতে লাগল।
________
বিকেলবেলায় পুকুরের সৌন্দর্য একটি অপরূপ মায়ায় সমৃদ্ধ। সূর্য পশ্চিমাকাশে নিঃশেষিত হতে হতে কমলা রঙের আলো পুকুরের জলেই প্রতিফলিত হয়ে ঝিলমিল করছে। পুকুরের চারপাশের গাছপালা সেই আলোয় স্নাত হয়ে এক রোমাঞ্চকর দৃশ্য সৃষ্টি করছে।
বাতাস ধীরে ধীরে প্রবাহিত হতে শুরু করেছে; কচুরিপানার পাতা মৃদু সঞ্চালিত হচ্ছে। পুকুরের জলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউ খেলছে, এবং সেই ঢেউয়ের সঙ্গেই সূর্যের আলো এক চমৎকার নাটকীয়তার সৃষ্টি করছে। পুকুরের ধারে বসা পাখিরা তাদের দিনের শেষ সংগীত পরিবেশন করছে।
ছোট ছোট শিশুরা খেলা করছে, তাদের খিলখিল হাসির আওয়াজ পরিবেশে প্রাণের সঞ্চার ঘটাচ্ছে। পুকুরের ধারে পাতা লাল-হলুদ ফুলগুলো বিকেলের সূর্যের আলোয় আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, যেন প্রকৃতি তার নিজস্ব রঙে মেতে উঠেছে।
এ সময় পুকুর পারে এসে উপস্থিত হয়েছে তিন বান্ধবী, রুপা, আছিয়া, এবং মিলি। তিনজনের হাতে তিনটি ভিন্ন বস্তু রয়েছে, রুপার হাতে লবণের একটি ছোট্ট বয়ম, আছিয়ার হাতে লাল গুরো মরিচের বয়ম, আর মিলির হাতে একটি খালি বাটি। মিলির হাতে বাটি দেখে রুপা মজা করে বলল,
-" এমা! তোর বাটি তো খালি!!! থাক তুই কষ্ট পাস না বইন। দাড়া তোকে একটা বুদ্ধি দেই,, তুই বরং ওই রাস্তার গলির মোড়ে রাস্তা আছে না? তুই ওখানে গিয়ে বস, দেখবি তোর বাটি ভরে গিয়েছে। "
মিলি রাগভরা দৃষ্টিতে তাকালে রুপা আবার বলল,
- "থাক, থাক ধন্যবাদ দিতে হবে না। যতই হোক তুই আমাদের বান্দন্যি , এতটুকু সাহায্য তো করতেই পারি!! "
বলেই রুপা এবং আছিয়া হাসতে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেল। মিলি রাগের সুরে বলল,
- "তবে রে..."
বলেই মিলি রুপাকে ধা'ওয়া দিতে লাগল। রুপা দৌড়াতে দৌড়াতে বলল,
- "মোটি, এরকম করে দৌড়ালে তুই আর ফুটবল থাকতি না! "
-" দাড়া বলছি, আজকে তোর একদিন কি আমার একদিন!! দাড়া!!
-" তোর একদিন আমার দশদিন ! হাহাহা!"
এদিকে আছিয়ার এখন বিরক্তি বাড়ছে। একদিকে আসতে দেরি হয়েছে, বিকেল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। সন্ধ্যা আসতে আর বেশি দেরি নেই। অন্যদিকে এক ব্যক্তির আসার নামই নেই, অথচ তাদের কান্ড দেখে মনে হচ্ছে সকাল শুরু হয়েছে। আছিয়া বিরক্তির সুরে বললো,
-" ভাই, তোরা থামবি???
মিলি রুপাকে ধরতে ধরতে বললো,
- "আমাকে বলছিস কেন? রুপাকে বল, ওই আগে শুরু করেছে!
- "তুই ফকিন্নির মতো বাটি নিয়ে ঘুরবি আর আমি বললেই দোষ?"
- "ধুর! তোদের সাথে কথা না বলে ছাগলের সাথে কথা বলা ভালো। আঁখি কোথায়? এখনো আসে না কেন? সন্ধ্যা নেমে যাবে।"
- "সরি সরি, একটু দেরি হয়ে গেল। আসলে রাস্তায়..."
আঁখি কাচুমাচু হয়ে বলল।
- " হুম, রাস্তায় একটা কালো ছাগল দেখা গেছে, তাই তুই অন্য রাস্তা দিয়ে এসেছিস। ভাই, তুই এই এক বাহানা কয়দিন দেস?? লাইক সিরিয়াসলি? কালো বিড়াল দেখলেও মানা যেতো, কিন্তু কালো ছাগল দেখে রাস্তা পালটানো? আমাকে পাগল ভাবছিস?"
রেগে বলল আছিয়া।
- "আরে না পাগল কেন ভাববে? তুই তো পাগলি, তাই পাগলি ভাববে! হিহিহি!"
মিলি রুপার চুল ধরে হাসতে হাসতে বলল।
- "সরি, বনু। রাগ করিস না, একটু দেরি হয়ে গিয়েছে।"
আঁখি মিহি কন্ঠে বলল।
রুপা মিলির হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,
- "বাই দ্য রাস্তা, তোর হাত খালি কেন?"
এতক্ষণে মিলি এবং আছিয়া লক্ষ্য করল আসলেই আঁখির হাত খালি। মিলি এবার রেগে গিয়ে বলল,
- " এটা কি হলো? পেয়ারা কোথায়?"
-" আসলে বড় আব্বু (বড় চাচা) গাছের কাছে যেতে নিষেধ করেছিলেন, তাই যাইনি। আর আনতে পারিনি।"
-" নিষেধ করলেন আর তুইও গেলি না?"
আঁখি মাথা নাড়ায়, অর্থাৎ না।
আঁখি, মিলি, রুপা, এবং আছিয়া—এই চার জন ছোটথেকেই বান্ধবী। সদ্য এসএসসি পরীক্ষার শেষ করেছে তারা। ছোট থেকেই একসাথে খাওয়া, খেলা, সবকিছুতেই তারা একসাথে। যদিও আঁখির পরিবার আর আছিয়ার পরিবার, একে অপরের পরিবারের সন্তানের সহিত বন্ধুত্ত করাটা পছন্দ করেন না । তবে কোনো এক অদৃশ্য কারণে তারা চুপ আছেন। তাদের বন্ধুত্বে সকলেই পরিচিত, বাড়ি থেকে বিদ্যালয়, সর্বত্রই তাদের সম্পর্কের প্রসিদ্ধি।
মিলি 'খাদক' নামে প্রসিদ্ধ। অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণের প্রতি তার প্রবণতা, যদিও তার শারীরিক গঠন কিছুটা মোটা, তাতে তার কোনো বিবেচনায় আসে না। তার মতে, একদিন তো মরতেই হবে; তাই খাদ্য দ্বারা মৃত্যুকে সমর্থন করবে। এই সবকিছুর মধ্যেও তার উপস্থিতির বুদ্ধি অপরিসীম।
রুপা চঞ্চল প্রকৃতির। সহজে সবার সাথে মিশে যায় এবং হাস্যরসের মাধ্যমে সবাইকে বিনোদিত রাখার অদ্ভুত ক্ষমতা তার রয়েছে।
আছিয়া হলো সর্বাধিক রাগী অধৈর্য। সামান্য কারণে অভ্যন্তরীণ অগ্নিসংযোগে পরিণত হয়, যা সকলেই জানে এবং তাকে বেশী খেপায়।
অন্যদিকে, আঁখি সহজসরল এবং তথাকথিত বোকা। তবে সকলের মধ্যমণি সে। ফলে অন্য তিনজন সদা তাকে আগলে রাখে। অন্যান্য সবার তুলনায় তার গায়ের রঙ শ্যাম, যা ফরসা গায়ের রঙের মেয়েদের সামনে কিছুটা ম্লান মনে হয়।
আঁখি, মিলি, রুপা ও আছিয়া, একে অপরের প্রাণভোমরা। বিকেল বেলা পুকুরপাড়ে একত্রিত হয়ে প্রকৃতির শীতল পরিবেশে মিলিত হয়ে, গল্পের ভাণ্ডার সাজাতে সাজাতে সময় কাটানো, সন্ধ্যার আগমনে তাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ গৃহে ফিরে যাওয়া, তাদের নিয়মে মধ্যে পরে।
প্রতিদিন তারা কিছু না কিছু খাওয়ার আয়োজন করতো। আজকের পরিকল্পনা ছিল পেয়ারার মাখা খাওয়া। রুপা, মিলি ও আছিয়া বর্তমানে পুকুরপাড়ে বসে আঁখির দিকে চেয়ে আছে। আঁখি অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে হাত কচলাচ্ছে। রুপা লবণ এর বয়ম নিয়ে হাত গালে রেখেছে, আছিয়া লাল গুড়ো মরিচের মতো লাল হয়ে বসে আছে, আর মিলি হাতের বাটি মাথায় টুপির মতো করে পরে বসে আছে। হঠাৎ, মিলির মনে একটি কুমন্তব্য আসে এবং সে শয়তানি হাসি দিয়ে বলে,
- " এই তোরা বাদ দেনা! সামান্য পেয়ারাই তো?? relax!! অন্য আরেকদিন খাওয়া যাবে! আঁখি আয় তো, তুই আমার পাশে বস!
- " একমাত্র তুই আমাকে বোঝিস । আমি তো ইচ্ছে করে করিনি। বড় আব্বুই তো..."
- "হ্যাঁ, হ্যাঁ!…… বুঝেছি। এই ফ'কিন্নি দুইটা, এত খাদক কেন তোরা হু? মেয়েটা তো ইচ্ছে করে করেনি! "
রুপা এবং আছিয়া মিলির কার্যকলাপ দেখে বিস্মিত। মিলি যে কত বেশি খাদক, তা সত্ত্বেও সে এমন উদার মনোভাব প্রদর্শন করছে। এর পিছনে কিছু রহস্য আছে বলে মনে হচ্ছে। মিলি এরপর বলে,
- "আচ্ছা, বাদ দে! অন্যদিন খাওয়া যাবে। আচ্ছা আঁখি, তোর কি যেন স্বপ্ন আছে?"
আঁখি হাসি দিয়ে বলে,
- "পুলিশ!"
না চাইতেও স্বজোরে অপ্রত্যাশিতভাবে তিনজনই হেসে ফেললো। যেভাবে ভেজা বিড়াল সিংহ হওয়ার স্বপ্ন দেখে, আঁখিও পুলিশ হওয়ার স্বপ্ন দেখে। আসলে মানুষ বাস্তবের অসম্ভবতাকে কল্পনায় পূর্ণ করে।
- এই তোরা হাসছিস কেন?"
তিনজন হাসি থামিয়ে দেয়। মিলি সবাইকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলে,
- "আচ্ছা তুই পুলিশ হবি। তাহলে তোকে একটা কাজ করতে হবে, যদি পারিস তাহলে বুঝব তুই সত্যিই পারবি আর না পারলে বুঝবো তোর দারা হবে নাহ।
-"কি কাজ?"
- "আমাদের গ্রামে মদন চাচা আছে না? ওই যে খা'রুস টা'কলু চাচা?? যে পোলাপান দেখলেই পি'ডায়। ওর পেয়ারা গাছ থেকে চু'রি করে পেয়ারা আনতে হবে।"
মিলির কথা শুনে তিনজনই স্তম্ভিত হয়ে যায়। রুপা এবং আছিয়া মনে মনে ভাবছে, তবে এই ছিল ওর মনে? তাই তো বলে এর মতো খাদক এত সহজে মেনে নিলো? অন্যদিকে, আঁখির মুখ দেখার মতো, পুরোপুরি চুপসে গিয়েছে। যে মেয়ে নিজের গাছের পেয়ারা আনতে সাহস পায় না, সে করবে পেয়ারা চু'রি?
- "পুলিশ এর সাথে এটার কি সম্পর্ক?? আমি চো'র নাকি? আমি পারবো না চু'রি করতে।"
-"আরে শোন গভীর সম্পর্ক আছে। তুই যদি পুলিশ হস তখন তোকে তদন্ত করতে হবে। এমনও হতে পারে তোকে সন্ত্রা'সের আস্তানায় গিয়ে সবার আড়ালে তদন্ত করতে হলো। আবার ওখান থেকে সন্ত্রা'সীর বিপক্ষে প্রমাণ হিসাবে অনেক কিছু আনতেও হতে পারে। "
- "হুম কিন্তু,,"
-"কোনো কিন্তু টিন্ত না। যা বললাম তাই কর। মনে করবি ওই মদন টা'কলু চাচা একটা স'ন্ত্রাসী। পেয়ারা গাছ ওর আ'স্তানা। তুই যাবি আর টা'কলু চাচার বিরুদ্ধে প্রমান আনবি। মানে পেয়ারা!!!
- "কিন্তু চু'রি করা ঠিক হবে না,,,"
মিলি বিরক্ত হয়ে বললো,
- "আবার? তুই এটাকে চু'রি কেন বলছিস? উনিতো আমাদের চাচা হয়। সে যেমন চাচা হোক দেখার বিষয় নাহ। আর আমরা হলাম উনার মেয়ের মতো। তাহলে বাবার মতো চাচার গাছ থেকে আমরা উনার মেয়ের মতো ভাতিজিরা যদি না বলে পেয়ারা খাই তাহলে এটাকে চু'রি বলে না।"
একটু থেমে মিলি আবার বলল,
- "শুন তুই যদি এটা করতে পারিস তাহলে তুই পুলিশ হতে পারবি। যা আঁখি দেখিয়ে দে সবাইকে। তুই ভিতুর ডিম না। যারা যারা তোকে ভিতু বলে তাদের মুখে ঝা'মা ঘসে দে। দেখিয়ে দে তুইও পারবি!!!
ব্যাস!! সরল, বোকা আঁখির জন্য এটুকুই যথেষ্ঠ। সেও সাহসের প্রদর্শন করতে এগিয়ে গেল। পিছনে ফিরে তাকালে মিলি আবারও বলে,
- "আমি জানি তুমি পারবে। অল দ্য বেস্ট!!"
আঁখি গভীর শ্বাস নিয়ে তার পরীক্ষার দিকে এগিয়ে গেল। মিলির কার্যকলাপ দেখে রুপা এবং আছিয়া চমৎকৃত। মিলি তাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
- " কি,,? কেমন দিলাম বল?"
রুপা এবং আছিয়া চিৎকার করে মিলিকে জড়িয়ে ধরে নাচতে শুরু করল।
--
হেঁটে হেঁটে আঁখি মদন চাচার বাড়ির পেছনে এসে থেমে গেল। বর্তমানে মদন চাচার কোনো উপস্থিতি নেই; তিনি সাধারণত রাতেই বাড়ি ফিরেন। বাড়িতে এখন চাচি ছাড়া আর কেউ নেই। আঁখি গ্রামের মেয়ে হিসেবে গাছের দিকে অবলীলায় উঠতে পারল, যা তার কাছে কোনো কঠিন কাজ মনে হয়নি। পেয়ারা গাছে বড় বড় পেয়ারা ঝুলছে। আঁখি চারটি পেয়ারা পেড়ে নিল। তারপর কিছু সময় বসে থাকার সিদ্ধান্ত নিল, কিছুটা শান্ত পরিবেশ উপভোগ করতে সে পেয়ারা ওখানে বসেই খেতে লাগলো।
কিন্তু আঁখি জানত না, তার ওপর একদৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছিল। চারপাশের গ্রামীণ নিস্তব্ধতা, পাখির কলরব এবং হালকা বাতাসের মৃদু সুর; এই সবকিছুর সাথে নিঃশব্দে তার প্রতি নজর রেখেছে কেও। গাছের অন্যপাশ থেকে এক আগন্তুক আঁখির দিকে তাকিয়ে ছিল । তার চোখে এক নাম না জানা আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছিল, যা সে প্রকাশের ভাষা খুঁজে পায় নি। আঁখির পেয়ারা খাওয়ার দৃশ্য তার মুখে এক অদ্ভুত আনন্দের ছাপ ফেলছিল।
আগন্তুক অতি মগ্নভাবে তার প্রতিটি নড়াচড়া, হাসি, এবং মিষ্টি মুখের অভিব্যক্তিতে মুগ্ধ হচ্ছিল। আঁখি পুরোপুরি নিজের জগতে হারিয়ে গিয়ে, পেয়ারার টুকরো খেতে খেতে কখনো গাছের পাতা ছুঁয়ে দেখছিল, কখনো নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হচ্ছিল। এই সহজ-সরল মুহূর্তগুলো আগন্তুকের মনে গভীর এক ছাপ রেখে যাচ্ছিল, যা তার চিত্তে অপ্রকাশিত অনুভূতির সৃষ্টি করছিল।
------
আঁখি চুপ করে আছে। ভয়গ্রস্ত অবস্থায় তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। মোবারক যখন জোরে ধমক দেয়, আঁখি কাঁপা কাঁপা স্বরে উচ্চারণ করে,
- "অঅ আঁখি!!!" (তোতলানো স্বরে)
মদন সদ্য কন্যার বিবাহ সম্পন্ন করেছেন। পেশায় তিনি সব্জির ব্যবসায়ী। মদনের কন্যা এবং জামাই, বিয়ের পর এই প্রথম তাদের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। সকাল থেকে মদনের স্ত্রী আপ্যায়নের কোন ত্রুটি রাখেন নি , মদন সারাদিন পরিশ্রমের পর বিশ্রামে লিপ্ত ছিলেন। মোবারক গ্রামজুড়ে ঘোরাঘুরি করলেও, শশুরের প্রিয় পেয়ারা গাছটি চোখে পড়েনি। তাই বিকেলে পেয়ারা খাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়। মদন কাউকে গাছের নিকটে ঘেষতে দেন না, তাই মোবারক শশুরকে জানিয়ে তবেই বাইরে যায়। হঠাৎ মদন তার বাড়ির পিছনে জামাইয়ের চিৎকার শুনতে পান। শিশুর কপট আচরণ ও চুরির উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায়, মদন আজকের জন্য একটি শিক্ষা দিতে প্রস্তত হন, ঘরের কোণে রাখা লাঠি হাতে নিয়ে বাড়ির পিছনে চলে যান, উদ্দেশ্য লাঠির পে'টা করা।
- "কায় হা,, কায় মোর গাছত হাত নাগাইছে?? তোক তো মুই,,,,,"
মদন আঁখিকে দেখার পর স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। হাতের লাঠি পরে গেলো মুহুর্তের মধ্যেই। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখের ভাব পরিবর্তিত হয়ে হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
- "এ মাই, তুই?? তুই কি করিছিত? তুই পেয়ারা খাবু, মোক কলেই তো পারতি৷ মুই পারি দিতাম।" (হাসিমুখে)
আঁখির চোখের জল টইটুম্বুর হয়ে উঠেছে, এই বাধ ভেঙে গেলো বলে। এটা দেখে মদন ভড়কে গিয়ে অগ্নিমূর্তির ন্যায় তাকালো মোবারকের পানে। মোবারক কিছু বুঝল না। মদন আঁখির কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন, তবে এতে কাজ হচ্ছে না দেখে, মদন নিজেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে গাছের দিকে উঠে অর্ধেক পেয়ারা নিয়ে ঘরে দৌড়ে একটা ব্যাগের ভিতরে ভরে দিয়ে এসে বললেন,
- "কান্দেন না মাই, আরো খাবু?? আরো পারি দেইম??"
আঁখি দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে 'না' বললো। মদন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এবং আঁখিকে বাড়িতে ফিরে যেতে বললেন।
মোবারক হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে সবার ত্রাস নিয়ে সব দৃশ্য দেখছিল। তাঁর শশুর এমন এক চোরকে ছাড় দিলেন, তার সামনে! এটি তার আত্মসম্মানে আঘাত করেছে। মোবারক কিছু বলার আগেই, মদন রেগে বললেন,
- "জারুয়া (শয়তান) চ্যাংড়া, টপ করি বাড়ি আইসেক।"
এই বলে মদন দ্রুত বাড়ির দিকে চলে গেলেন। বেচারা মোবারক হতভম্ব হয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে তার শশুরের পেছনে গমন করলো।
এদিকে এক জোড়া চোখ গোপনে সবার কাণ্ডকারখানা পরখ করছিল। ঠোঁটের কোণে প্রথমে মৃদু হাসি থাকলেও, এখন তা রা'গে কঠিন হয়ে উঠেছে। হাতের মুঠি শক্ত হয়ে এসেছে। দ্রুত ক্রোধে হুস হুস করে তার স্থানে ফিরে গেল, কাউকে অনুসরণ করার উদ্দেশ্যে।
0 Comments