লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা


কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।


"ও এখনো বেঁচে আছে। আমি যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন ওকে আমার থেকে কেও আলাদা করতে পারবে না।"
ফোনে কথোপকথন সমাপ্ত করে, আরাফ তার মানিব্যাগ থেকে একটি পুরনো ছবি বের করল, যার পৃষ্ঠদেশে কালো কালো দাগের ছাপ ফুটে উঠেছে। অত্যন্ত যত্নের সাথে ছবির চারপাশে আঙুল ঘোরাতে ঘোরাতে, কুনুই দিয়ে চোখের কোণ মুছে, বুকের বা পাশে হাত রেখে বলল,
- "আজও তোমাকে ঠিক ততটাই অনুভব করি যতটা প্রথম দিন তোমাকে দেখে অনুভব করেছিলাম। আজও তোমাকে দেখলে আমি থমকে যাই যেমনটা প্রথম দিন তোমাকে দেখে থমকেছিলাম। আজও তোমার চোখের অতল গহ্বরের মায়ায় আমি ডুবে যাই যেমনটা প্রথম দেখায় ডুবেছিলাম। আমি আজও ডুবে আছি। সারাজীবন ডুবে থাকতে চাই।"
এই বলে বিছানায় শুয়ে পড়ল আরাফ। ছবিটিকে বুকের সাথে দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরে, পুনরায় গভীর চিন্তায় তলিয়ে গেল।
-----YouTube
-ফ্লাশব্যাক
বিকেলের শেষ প্রহরের সূর্য লাল আভা দিয়ে চারপাশকে রঞ্জিত করে রেখেছে। অচিরেই সন্ধ্যার অন্ধকার পৃথিবীতে অবতরণ করবে। চারিদিকে এক শান্ত ও নির্মল বায়ু প্রবাহিত হচ্ছে, গাছের পাতা হালকা বাতাসে নাচছে। পাখিরা দিনের শেষ প্রভাতের বিদায় জানাতে তাদের নিজ নিজ নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। আলো ও ছায়ার লীলা যেন প্রকৃতির দিনের শেষ সময়কে উদযাপন করছে।
আঁখি ব্যাগভর্তি পেয়ারা নিয়ে রাস্তায় অগ্রসর হচ্ছিল, এমন সময় এক পথচারী তাঁর পথ রুদ্ধ করে দাঁড়াল। হঠাৎ করেই উপস্থিতি দেখে আঁখি ভড়কে যায় এরপর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানবটির দিকে ভ্রু কুচকে বলে,
-"ভোলা, তুই?"
ভোলা আঁখিকে জড়িয়ে ধরলে আঁখি ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটিয়ে তোলে। আঁখি চারটি পেয়ারা নিজের কাছে রেখে, বাকি ব্যাগভর্তি পেয়ারা ছোট্ট ভোলার হাতে প্রদান করে কপালে স্নেহের পরশ এঁকে দেন। বাবা মা ম'রা ভোলাকে বড্ড ভালোবাসে আঁখি, সবসময় ভোলার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসে । ভোলার আপন বলতে শুধু বৃদ্ধা দাদি আছেন। ভোলাকে বিদায় দিয়ে আঁখি পুকুরপাড়ে গিয়ে তিন বান্ধবীর হাতে পেয়ারা প্রদান করে, দ্রুত বাড়ির উদ্দেশ্যে ফিরে যায়। আজ পুকুরপাড়ে বসে পেয়ারা মাখা খাওয়া হবে না।
আজ কিছুটা দেরি হয়ে যাওয়ায়, শুকনো ঢোক গিলে, বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো আঁখি।
পাকা ও রাজকীয় রূপ ধারণকারী লাল ইটের নির্মিত বিশাল বাসভবন, যার চূড়ায় লাল টালির ছাউনি শোভিত। বাড়ির সম্মুখে এক বিরাট লোহার গেট রয়েছে, যেটি পার হওয়া মাত্রই সুদৃশ্য বাড়ির সামনের দৃশ্য প্রস্ফুটিত হয়। বিশাল বড় মাঠের একদিকে ফুলের বাগান, যেখানে রঙ-বেরঙের গোলাপ, গাঁদা, রজনীগন্ধা এবং অন্যান্য বিভিন্ন ফুলের ফুলঝুরি বিরাজমান। উঠানের অন্য পাশে ফলের বাগান, যেখানে আম, কাঁঠাল, নারকেল ও অন্যান্য ফলের গাছের সারি সাজানো।
বাড়ির চারপাশে উঁচু পাঁচিল দ্বারা পরিবেষ্টিত। চমৎকার বাগানবিলাস এবং শান বাঁধানো পথটি সরাসরি বাড়ির দিকে নিয়ে গেছে।
বাড়ির প্রধান ফটকের পাশে একটি সুন্দর ঝর্ণা রয়েছে, যেখানে পাথরের বেঞ্চে বসার ব্যাবস্থা করা আছে। হঠাৎ বাড়ির অভ্যন্তর থেকে মদন ও মোবারককে প্রবাহিত হতে দেখে আঁখি বিস্মিত হলো। চু'রির সময় অতিবাহিত হয়নি, অথচ বিচারদান করতে চলে এসেছে। আজকের দিনটি অবশ্যই অ'শুভ, কপালে নিশ্চয়ই শনি আছে এ ধারণা সুস্পষ্টভাবে অনুভব করছে আঁখি।
বাহিরের পথে পা বাড়ানোর সময় আঁখিকে দেখে মদন ও মোবারক একসঙ্গে হাসির রেখা প্রসারিত করলেন। মদন হেসে হেসে বললেন,
-"মাই, তোক ত মুই সে কখন পেয়ারা দিয়া বাড়ি পাঠে দিছু। তুই এলাই আইলু! সব খায়ে ফেলছিস.?? যা মা বাইত যা।"
আঁখি ঠোঁটের মিথ্যা হাসি ঝুলিয়ে করে বাড়ির পথে রওনা হতেই মোবারক তাকে পিছু ডাকলেন। আঁখি ফিরে তাকালে দেখতে পেল মদন সামনের দিকে চলে গেছেন। মোবারক হাসিমুখে বললেন,
- "মুই বোঝা পারু নাই তুমি এত্তিকার এতো বড় বাড়ির বেটি।"
মোবারক তার আচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে, জানাতে চেষ্টা করেন যে তার উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না। সে ইচ্ছে করে কিছু করে নি। সব ভুল বুঝাবুঝির জন্য হয়েছে!! আঁখির মনে হলো, লোকটি কিছুটা অদ্ভুতভাবে তাকাচ্ছে। নিজের চিন্তা একপাশে রেখে আঁখি জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলল,
-“ আমি কিছু মনে করি নি ভাইয়া!! "
আঁখির কথা শুনে মোবারক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। কিছু কথা বলে মোবারক চলে গেলে, আঁখি বাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশ করল।
অন্যদিকে, একজোড়া চোখ ক্ষোভে দাতে দাত চেপে পুরো দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করল। এরপর রাগে ফুসতে ফুসতে আগন্তুক স্থান ত্যাগ করল।
----Instagram
আঁখি অন্তর্গৃহে প্রবেশ করতেই লক্ষ্য করল যে, পরিজনের সকলে বিশাল সোফায় আসীন রয়েছে। বড় চাচি আফিয়া বেগম, ছোট চাচি কানিজ বেগম, বড় চাচা ইকরাম আলী, ছোট চাচা কুদ্দুস আলী, পিতা আজগর আলী এবং মাতা রোকেয়া বেগম সহ ভাই-বোনেরা সকলে যেন কোনো গুরুতর আলোচনায় নিমগ্ন। আঁখির আগমনেই সকলের দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ হল। আঁখি কিছু বলার পূর্বেই বড় চাচি আফিয়া বেগম তীক্ষ্ণ স্বরে ধমকে উঠলেন,
-"এখন সময় হলো বাড়িতে আসার? মেয়ে মানুষ এতো বাহিরে কি? এমনেই কালো বাইরে ঘুরে ঘুরে আরো কালো হয়ে এসেছিস। এরপর বিয়ের জন্য ছেলে পাওয়া যাবে না।"
আফিয়া বেগম আরও কিছু বলতে উদ্যত হতেই, বড় চাচা ইকরাম আলী কণ্ঠস্বর কঠোর করে বললেন,
- “আহা, থামো তো! বাচ্চা মেয়ে, সবে মাত্রই বাড়িতে আসল!
ইকরাম আলী আঁখির দিকে স্নেহমাখা দৃষ্টিপাত করে বললেন,
- যা মা, ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নে!!
আফিয়া বেগম মুখ ভার করে নিশ্চুপ রইলেন। আঁখি যাবার সময় একবার পিতামাতার দিকে একপলক তাকিয়ে মাথা নিচু করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। আফিয়া বেগম, আঁখির মা রোকেয়া বেগমের নিকট কটাক্ষের সুরে বলে উঠিলন,
- "সেয়ানা মেয়ে,, ঠিকমতো শাসনে রাখ। পরে হাত ছাড়া হলে পস্তাবি ।"
এটা বলেই গটগট করেই প্রস্থান করলেন আফিয়া বেগম। রোকেয়া বেগম মেয়ের অদূরে অগ্রসরমান ছায়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। আঁখির পিতা আজগর আলীর দিকে একবার তাকিয়ে, তিনিও স্থান ত্যাগ করলেন। একে একে গৃহস্থের সকলেই আপন আপন কাজে ফিরে গেল।
-------
চারিদিকে পিনপতন নীরবতা, যেন মৃতপ্রায়। ঘন কালো আঁধার আচ্ছন্ন করেছে সমগ্র ধরিত্রী। নিশীথের নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে দূর হতে শিয়ালের ডাক আর ঝিঁঝিঁ পোকার সুর ভেসে আসছে। সমগ্র গৃহকুল যখন নিদ্রার নিলীন আবেশে মগ্ন, আঁখির চোখে তখন তার ছিটেফোঁটাও নেই। এরপর পাশে শয়নে ছোট বোনের গায়ে কাথা সমার্পণ করে, আলো-আঁধার মাখা কক্ষে ছেড়ে যেতে লাগল ছাদগমনের উদ্দেশ্যে।
ঘড়িতে রাত্রি দশটা বারো বেজে গিয়েছে। অর্থাৎ গ্রামে অতি গভীর নিশীথ। দিবাভাগে দীর্ঘ নিদ্রার পরিণামে আঁখির চোখে আর কিছুতেই নিদ্রা আসছে না। তার উপর মনে করেছিল মদন চাচা ও মোবারক হয়তো তার নামে অভিযোগ করতে এসেছিল, কিন্তু এই বিষয়ে কোনো কথা উচ্চারিত হয় নি। এতেই বুঝতে পারা যায় যে, কিছু বলাও হয় নি। যদি বলে থাকত, তবে আর কেও না হলেও আফিয়া বেগম সমগ্র গৃহ মাথায় তুলে ফেলতেন। রাত্রে খাওয়াও ঠিকমতো হয় নাই, ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে হচ্ছে; অতএব নিদ্রা আরো অধিক পালিয়েছে । গভীর নিশীথের চাঁদ নাকি রহস্যময়ী সৌন্দর্য ধারণ করে, তাই আজ মনের ভয়কে পাশ কাটিয়ে বাহিরে এসেছে রজনীর চন্দ্র বিলাসে মত্ত হতে।
ছাদের দরজার সম্মুখে এসে দাঁড়াইলো আঁখি। বিশালতর ছাদ, যাকে ক্ষুদ্র খেলার মাঠ বললে ত্রুটির কিছু নেই। ছাদে প্রবেশ করতে করতেই তার বাঁ পাশেই একটি ক্ষুদ্র দোলনা দৃষ্টিগোচর হয়। ছাদের ডান পাশে বসবার জন্য কাঠের বেঞ্চি রাখা। সামনের দিকে কাপড় শুকাবার দড়ি টানানো রয়েছে। ছাদের এক প্রান্তে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফুলের টব সাজানো রয়েছে। ছাদ হতে গৃহের চতুর্দিক অবলোকন করতে পারা যায়।
নিশীথের স্নিগ্ধতায় এখন আঁখির মন প্রফুল্লিত। জ্যোৎস্না পূর্ণিমা রাত্রি, চাঁদ যেন তার সমস্ত আলো ঢেলে রজনীকে অনিন্দ্যসুন্দর করে তুলেছে। চাঁদের জ্যোৎস্নায় রাত্রি যেনো মায়াবী হয়ে উঠেছে, নব রূপে সজ্জিত।
ছাদের রেলিং ধরে নিশীথের স্নিগ্ধ সমীরণ অনুভব করছে আঁখি, চোখ বুঝে । আহা! কী মনোহর পরিবেশ!
হঠাৎ আঁখির পশ্চাৎ হইতে কারো মেয়েলি কণ্ঠে আহ্বান ভেসে আসল,
-“আপা, তুমি এখানে?”
ছোট বোনের কণ্ঠ শুনে আঁখি পেছনে ফিরে তাকালো। দেখল তার বোন চোখ ডলতে ডলতে তার দিকে আসছে। আঁখি পূর্বেই আশঙ্কা করেছিল, তার বোন তাকে ছাড়া নিদ্রা যাপন করবে না, তবে মনের ইচ্ছা পূরণের জন্য সে বোনকে শয্যায় ফেলেই বাহিরে এসেছে। আলোর বদভ্যাস, আপাকে জড়িয়ে না ধরলে তার নিদ্রা হয় না। সুতরাং আঁখি যখন তাকে ছেড়ে যাচ্ছিল , তখনই তার ঘুম ভেঙেছিল । তার পর আপার পশ্চাদ্ধাবনে, ছাদ অবধি চলে এসেছে।
আঁখি প্রশ্ন করল,
- “আমি যে এখানে, এটা তুই কিভাবে জানলি, আলু?”
আলো উত্তর দিল,
- “আমি তোমার পিছু পিছু এসেছি। তুমি জানো না, তোমাকে ছাড়া আমার ঘুম হয় না।”
আলোর মাথায় আঁখি চাটি মেরে বলল,
-“ওরে আমার আলু পাখি! যখন বিয়ে করবি, তখন কি করবি? তখন তো আমায় মনেও রাখবি না।”
আলো ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,
- “এহ! বললেই হল? আমি তোমাকে আমার সাথে করে নিয়ে যাব।”
আঁখি আলোর গাল টিপে বলল,
-“তাহলে তোর স্বামী কোথায় থাকবে শুনি?”
আলো বলল,
- “কেনো? আমাদের সাথেই থাকবে। আমরা তিনজনে একসাথে থাকব।”
আলোর কথা শুনিয়া আঁখি হেসে ফেলল। বড় বোন যেন তার প্রাণের অধিক প্রিয়। তাকে ছাড়া আলোর চলবে না। সমস্ত কিছুর জন্য তার বড় বোনকে চাই। তদ্রূপ ছোট বোনকে সর্বদা আগলিয়ে রাখে আঁখি। আঁখি আর বাক্য বৃদ্ধি করতে দিল না, বলল,
- “অনেক রাত হয়েছে, রুমে চল ঘুমাব।”
আলো বোনের দিকে তাকিয়ে ছিল, হঠাৎ তার নিচে চোখ গেলে দেখতে পায়, বড় চাচির ন্যায় একটি ছায়া গেটের বাহিরে যাচ্ছে। এত রাত্রে কোথায় যাইতেছেন চাচি? এদিকে আলোকে এমনভাবে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আঁখি বলল,
- “কী দেখছিস ওভাবে?”
আলো বলল,
- “আপা, বড় আম্মু।”
আঁখি বলল,
-“কোথায় বড় আম্মু?”
আলো বলল,
-“চলে যাচ্ছে ।”
আলোর কথা উপহাস করে আঁখি বলিল,
- “হ্যাঁ, ভূ'তও আছে। এখন এখান থেকে না গেলে ঘাড় মট'কাবে।”
আঁখির কথায় ভয় পেয়ে যায় আলো। তাড়াতাড়ি করতে লাগল কক্ষে যাবার জন্য। আঁখি হেসে বোনকে নিয়েয়া যাওয়ার পূর্বে একবার পিছু ফিরে গৃহের গেটের দিকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে , পা বাড়াল কক্ষের অভিমুখে।
0 Comments