লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা


কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।


*
*
শিকদার বাড়ির ব্যাঙ্কোয়েট রুমে বসে আছেন ইকরাম আলী, আজগর আলী, আর কুদ্দুস আলী—তিন ভাই। টেবিলে সাজানো টিউলিপ-গ্লাসে লিকুইড অ্যাম্বার, মাঝে মাঝে একে অপরের দিকে তাকিয়ে তিক্ত হাসির আভাস ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের মুখে যেন বিজয়ের উল্লাস, কারণ আজ বাড়িতে তাদের সন্তানেরা অনুপস্থিত । এই মুহূর্তে শৃঙ্খলাহীনতার এমন সুযোগ বড়ই দুষ্প্রাপ্য, কারণ সাধারণত তাদের এই আড্ডাগুলো গ্রামের বাইরে, অফিসেই সীমাবদ্ধ থাকে। ইকরাম আলী হাস্যজ্জ্বোল ঠোঁটের কোণে এক চুমুক নিয়ে বললেন,
———" মোশারফ হয়তো ভেবেছে আমি নির্বোধ! আমার মেয়েকে তার অপদার্থ ছেলের হাতে তুলে দেবো? হা হা হা! "
আজগর আলী আর কুদ্দুস আলীও আচ্ছন্ন হাসিতে মগ্ন হলেন। ইকরাম আলী পুনরায় বললেন,
——— "আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি!"
——— কি সিদ্ধান্ত, ভাই?
কুদ্দুস আলী উৎসুক কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন। ইকরাম আলীর হাসির আভা আরো প্রসারিত হলো। তিনি বললেন,
——— "আমার মেয়ের বিয়ে দেবো।"
——— "তুমি তো বলেছিলে, দিবে না!"
আজগর আলীর কপালে ভাঁজ পড়লো। ইকরাম আলী আরেকবার গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন,
——— "হা হা হা! বিয়েতো দিবোই, তবে মোশারফের ছেলের সাথে নয়! খাদিমুল এমপির পুত্রের সাথে সব কথা পাকাপাকি হয়ে গেছে! তবু মোশারফের নাটক দেখতে আমি বেশ আগ্রহী।"
আজগর আলী সপ্রশংস হাসি দিয়ে বললেন,
——— "সঠিক সিদ্ধান্ত!"
——— "তবে এইটুকুতেই শেষ নয়! আরেকটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি!"
এ কথা শুনে দুজনের চোখে বিস্ময় দেখা দিলো। ইকরাম আলী সোফায় আরাম করে হেলান দিয়ে বললেন,
——— "আঁখিরও বিয়ে দিয়ে দেবো। ও কালিমা লাগানোর চক্রান্ত করছে , আর বাড়ির মান-সম্মান নষ্ট করতে চলেছে! ওর পড়াশোনা নিয়ে আমার আগ্রহ নেই। স্বামী যদি পড়াশোনা করায়, তবে করবে; আর না করালে, সেটা তার সমস্যা। সেও তো এখন বড় হয়ে উঠছে!"
এই কথা শুনে আজগর আর কুদ্দুস আলীর মুখে প্রসন্নতার ঝিলিক ফুটে উঠলো। আজগর আলী হেসে বললেন,
——— "তাহলে পাত্র খোঁজার দায়িত্ব আমার উপর ছেড়ে দাও। আমি উপযুক্ত যুবক দেখেছি, আমার বিদেশি ব্যবসা অংশীদার তাওহিদ চৌধুরির পুত্র। যথেষ্ট নাম-ডাক আছে!"
ইকরাম আলী গম্ভীর হয়ে বললেন,
——— "মোশারফ কী গ্যারান্টি দিচ্ছে যে, তার ছেলে আমার কন্যাকে সুষ্ঠুভাবে গৃহিণী করে তুলবে? কিংবা সে বড় মেয়ে রেখে ছোটটিকে পছন্দ করবে না, তার গ্যারান্টিই বা কী? সে আমাদের অপমান করতে চাইছে, হুহ! এসব কল্পনাই বাতুল! বরং আমরা তাকে অপমান করব, বিয়ের জন্য আসবে, কিন্তু কিছুই ঘটবে না! ঠিক তার সামনেই এই বাড়ির দুই মেয়ের বিয়ে হবে। হা হা হা! ততদিন তার নাটকও দেখে যাবো।"
তিন ভাই একসঙ্গে অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন। একসঙ্গে দুই মেয়ের বিয়ে—এ আনন্দ যেন তাদের হৃদয় ছুঁয়ে গেল।
এমতাবস্থায় শান্ত ঘরে প্রবেশ করলো। অল্পক্ষণ আগেই ফুর্তিতে ভরপুর হয়ে ফিরেছে, কিন্তু বাবা ও চাচাদের কথা শুনে তার মুখমণ্ডল পাথরের মতো শক্ত হয়ে এলো। সে টলতে টলতে এগিয়ে এসে ইকরাম আলীর সামনে বসলো, টেবিলে রাখা ম'দের বোতল তুলে একবারে ঢকঢক করে শেষ করে ফেলল। শান্তর এমন আচরণে তিন ভাই বিরক্ত হলেন—এ কেমন অভব্যতা! বাবা-চাচাদের আলোচনার মধ্যে ঢুকে তাদের সম্মুখে এভাবে বোতল খালি করল! শান্ত বোতলটা ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেললো, আর সাথে সাথেই কাঁচের বোতল চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়লো। সে ধীর কণ্ঠে, ফিচেল হাসি দিয়ে বলল,
——— "যাদের কথা বলছ, এই বাড়ির মেয়েদের সাথে বিয়ে দিবে! তারা তো আমারই পার্টনার! আমি যেখানে যাই, রাতে তারাও সেখানে যায়। আমি যা করি, ওরাও ঠিক তাই করে!
ইকরাম আলী স্থির কণ্ঠে বললেন,
——— "তাতে সমস্যাই বা কোথায়? তুইও তো কোনো মেয়েকে বিয়ে করে আনবি! তারাও তো কারো মেয়ে, কারো বোন! তারা যদি তোর সাথে জীবন কাটাতে পারে, তোর বোনেরা কেন পারবে না?"
শান্ত কুৎসিত হেসে উঠলো, বলল,
——— "এমনি এমনি আমি কু'কু'র হইনি! কু'কু'রের সন্তান কি কখনো অন্য কিছু হয়?
ইকরাম আলীর মুখ কঠিন হয়ে উঠলো, সাথে আজগর আর কুদ্দুসও ক্ষুব্ধ হলেন। শান্ত হাসতে হাসতে বলল,
——— "যাদের সাথে আমি রাত্রি যাপন করি, তারা স্বেচ্ছায় প্রত্যেকেই আমার পায়ের কাছে নিজেদের উৎসর্গ করে, আমার সম্পদের জন্য! ওরাই আমার পা চে'টে জীবন চালাতে চায়! আর তুমি বিয়ের কথা বলছ! কেনো আমি এই সুখের জীবন ধ্বং'স করব? তাছাড়া অন্যের জীবন ধ্বংস করবার প্রয়োজনটাই বা কেনো হবে? যদি কেউ এসে ধ্বং'স করতে বলে, তবেই আমি তবে হাসিমুখেই সব শেষ করে দেবো!
কুদ্দুস আলীর রাগ তখন আকাশ ছোঁয়া। তিনি কঠোর কণ্ঠে বললেন,
——— "বড়দের সাথে কথা বলার শিষ্টাচার তুই জানিস না?"
শান্ত তার দিকে একপলক তাকিয়ে ব্যঙ্গাত্মক হেসে বলল,
——— "এখন আবার জা'র'জ সন্তানদের কথা শুনতে হবে আমাকে?"
কুদ্দুস আলীর মুখমণ্ডল কালো আচ্ছাদনে ঢেকে পরলো! ইকরাম আলী এতদিনের পুঞ্জীভূত ক্রো'ধে ফেটে পড়লেন! উঠে দাঁড়িয়ে সপাটে চ'ড় মারলেন শান্তর মুখে! শান্ত থমকে গেল, তার চোখে যেন আগুন জ্বলে উঠল। র'ক্তচক্ষুতে তাকিয়ে বলল,
——— "আমি অপরাধে লিপ্ত হয়েছি বটে, কিন্তু কখনোই কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে পবিত্রতা কলুষিত করিনি। যা আকাঙ্ক্ষা করেছি, তা আমার শর্তে, আমার বিধানে; শিকার তার চিৎকারে সঙ্গমিত হবার পূর্বেই তার আত্মা আমার নিকট বিনত হয়ে পড়ে।"
বলে শান্ত দ্রুত বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম করল। তখন আজগর আলী গর্জে উঠলেন,
——— "পাপ তোকে ধ্বং'স করে দেবে! আজ পর্যন্ত কেউ টিকে থাকতে পারে নি! এইসব ফিল্মি সংলাপ দিয়ে বাঁচতে পারবি না!"
শান্ত ঘুরে দাঁড়ালো, চারপাশে নজর বুলিয়ে তার বলিষ্ঠ দেহকে একটু মুচড়ালো, মাথার এলিয়ে থাকা চুল হাত দিয়ে সরিয়ে বলল,
——— "অসৎ আমাকে আপন করে নেয়নি, বরং আমিই অসৎকে আলিঙ্গন করেছি, যেন আমার পরিবারের দিকে কু-নজর একবারও নিক্ষিপ্ত না হয়। তাদের সুরক্ষার বলয়ে, আমার হাত পাপের র'ক্তে নিমজ্জিত করতে আমি বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হবোনা, বরং সে পাপই হয়েছে আমার ন্যায়ের শৌর্য।"
তারপর ধূমায়িত সিগারেটের দিকে একবার চেয়ে বলল,
——— "কিন্তু একথা ভুলেও ভাবিস না যে তোরা আমার পরিবার।"
বলে বিদ্যুতের গতিতে চলে গেল শান্ত। আজগর আলী ক্রো'ধে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,
——— "ভাই, ওকে তুমি কিছু বলো না কেন? ছেলেটা দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে! আমাদের দেখলে বড় বড় নেতারাও মাথা নিচু করে সালাম ঠুকে, আর ও... আমাদের সঙ্গেই এমন তুইতোকারি করে!"
ইকরাম আলী কঠিন মুখে, গভীর রাগে জ্বলতে থাকা চোখে তাকিয়ে বললেন,
——— "আমাদের বংশের রক্ত তার শরীরে বইছে—এটাই স্বাভাবিক নয়? আমাদের পরে এই বংশের উপযুক্ত শাসন তার হাতেই থাকবে, তাই ওর মতো ছেলেই দরকার।"
___________________
মিলি মঞ্চে আসীন, তার প্রফুল্ল মুখে এক অভাবনীয় আনন্দের প্রতিচ্ছবি। বিবাহের এ উৎসবে যেন তার সুখের সীমা নেই। অপরদিকে আঁখি আছিয়ার সাথে তর্কে লিপ্ত, কেননা আছিয়া তাকে দুপুরবেলা একা রেখে গিয়েছিলো। আছিয়ার নানান যুক্তির অবতারণায় আঁখির ক্ষো'ভ প্রশমিত হয়। দূর থেকে আরাফের দৃষ্টি আঁখির দিকেই নিবদ্ধ—সে দেখে যায় তার হাসির স্নিগ্ধ সৌন্দর্য। নাঈম আঁখির পাশেই বসে আছে; আঁখি খিলখিল করে হাসছে, বাচ্চাদের নৃত্যে মুগ্ধ সে । রোহানও সেখানে, তবে তার মনে অন্য চিন্তার উদ্রেক—আফ্রিদি আর মুগ্ধই বা কোথায় হারিয়ে গেছে?
ঠিক তখনই রোহান মুগ্ধকে দেখতে পেল, তার মুখে যেন গভীরতম র'ক্তমাখা ক্রো'ধের ছায়া ফুটে উঠেছে। ঘামে ভেজা ধূসর শার্ট তার পেশিবহুল দেহে আঠার মতো লেপ্টে আছে, ফর্সা মুখমণ্ডল লা'লচে ক্রো'ধে যেন আ'গু'নের শিখা হয়ে উঠেছে। রোহান ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে মুগ্ধর হাত ধরে দৃঢ় স্বরে বলল,
——— "কোথায় ছিলি?"
——— "কাজ ছিল।"
মুগ্ধের কণ্ঠস্বরে তীক্ষ্ণতার সঙ্গে অদৃশ্য রুদ্ধতা। রোহান কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না, কী ঘটেছে যে মুগ্ধ এমন তীব্র ক্রো'ধে আছে? মনে হলো যেন সে র'ক্ত'মাখা হাতে ফিরে এসেছে কোনো নি'ষ্ঠুর হ'ত্যা'র পর! ঠিক সেই মুহূর্তে মুগ্ধর কঠিন কণ্ঠে ভেসে এলো,
——— "আফ্রিদি কোথায়?"
——— "জানি না! বিকেলে চা খেয়ে আসার পর আর দেখছি না, বোধহয় চলে গিয়েছে!"
মুগ্ধর চোয়াল শক্ত হলো। গভীর ক্রো'ধে গর্জে উঠল,
——— "চলে গেল মানে? ওর সঙ্গে আমার বিশেষ কথা ছিল। এতদিন ভদ্রতা রক্ষা করেছি, কিন্তু এখন সেই ভদ্রতা আর তার জন্য প্রযোজ্য নয়। এবার তাকে আমার প্রকৃত রূপ দেখাতে হবে।"
রোহান মুগ্ধর ক্রো'ধের গভীরতা উপলব্ধি করে সোজাসাপটা প্রশ্ন ছুঁড়ল,
——— "আঁখির জন্য এসব করছিস?"
মুগ্ধ একবার দূরে আঁখির দিকে তাকাল—যে তখন প্রাণবন্ত হাসিতে নিমগ্ন । তারপর চোখ বুজে গভীর ক্রোধের বিস্ফোরণে বলল,
——— " আমি কারও জন্য কিছু করি না!"
রোহানের মেজাজও তীব্র হলো, আর সে স্থির সংকল্প করল আজ মুগ্ধর কাছ থেকে সত্যটা বের করবেই! এক ধরনের শঠ বুদ্ধি মাথায় এলো। মুচকি হেসে বলল,
——— "তাহলে পূর্বিকাকে ভালোবাসিস?"
মুগ্ধ তৎক্ষণাৎ রোহানের কলার চেপে ধরে কঠিন কণ্ঠে বলে উঠল,
——— "আমার হৃদয়ে ভালোবাসার কোনো স্থান নেই! সেখানে আছে শুধুই একরাশ বি'ষ!"
রোহান হেসে বলল,
——— "আমি তো জানি তুই পূর্বিকাকে খুবই ভালোবাসিস! ওকেই তো মনপ্রাণে আঁকড়ে ধরেছিস, তাই তো শ'ত্রুপক্ষের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও তাকে বিয়ে করার জন্য মরিয়া!"
মুগ্ধ, ক্রো'ধে কাঁপতে কাঁপতে বজ্রনিনাদে বলল,
——— "পূর্বিকার প্রতি আমার অনুভূতি কখনোই ভালোবাসার নামক মোহে আবদ্ধ হয়নি, যা তুই বলছিস।"
রোহান হেসে বলল,
———" মধু, যাই বলিস! আমি তো সবই জানি! তুই আসলে কাকে ভালোবাসিস, তা আমার অজানা নয়! তবে একটা কথা শোন,,,
রোহান একবার চারপাশে তাকাল। মুগ্ধ তখনও রোহানের কলার চেপে ধরে আছে। রোহান মুগ্ধর কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
——— "কাঁচা বয়সের মেয়ের প্রেমে পড়ে গেছিস, লু'চ্চা কোথাকার! সাবধানে, মানে ইয়ে করিস নইলে কাঁদিয়ে ফেলবি। তখন তোকে ফিডার কিনে কান্না থামাতে হবে। হাহাহা! এখনি কাঁদায় মাখামাখি করছিস,, বিয়ের পর আবার,,,,,
অর্ধেক বলে রোহান দ্রুত কলার ছাড়িয়ে দিলো ভো দৌড়, কারণ সে জানে আর এক মুহূর্তের জন্যও তাকে ধরতে পারলে মুগ্ধ তাকে চূ'র্ণবি'চূ'র্ণ করে ফেলবে। পিছন থেকে জীবন কাতর কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
———" আপনি কেন প্রকৃত সত্য বললেন না, স্যার?"
মুগ্ধের কণ্ঠে এক অপার বিষণ্ণতা বাজল, গভীর নির্লিপ্ত সুরে বলল,
——— "সে কোমল আত্মা, সত্যের শ্বেতভারের বোঝা তার সহ্য হবে না।"
জীবন নিঃশব্দে আরও কয়েক পা এগিয়ে এসে পুনরায় বলল,
——— "কিন্তু স্যার, আপনি নিজেই কি সেই কঠিন সত্য মেনে নিতে সক্ষম হয়েছেন?"
মুগ্ধ ধীরে ধীরে তার চোখ জীবনের দিকে তুলল, সেই চোখে এক অজানা অ'গ্নিস্ফুলিঙ্গ খেলে গেল। শান্ত অথচ প্রচ্ছন্ন ভেতরের অগ্নিকে প্রকাশ করল,
——— " সত্যকে আমি সন্ধান করব, এবং যেদিন সেই প্রকৃত সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াবো, সেদিন..."
জীবনের চোখে এক অস্থির সংকোচ ফুটে উঠল। চাপা গলায় সে আবার জিজ্ঞাসা করল,
——— "সেদিন কী ঘটবে?"
মুগ্ধ হঠাৎ এক তীব্র ক্রুদ্ধ হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
——— " The end! "
সঙ্গে সঙ্গেই মুগ্ধ দ্রুতপদে পথ ধরল, যেন গোসলের প্রয়োজন তাকে পিছু তাড়া করছে। আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে সে বাড়ির দিকে রওনা হলো। পিছনে জীবন দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃদু স্বরে বলে উঠল,
——— "স্যার, আপনি যা-ই বলুন, আসলে আপনি জালে আটকে গেছেন— নির্মমভাবে। আমি দেখব, এর সমাপ্তি আপনি কিভাবে করেন!"
এরপর জীবনের চোখ পড়ল হৈ-হুল্লোড়ে মাঝে বসে থাকা আছিয়ার দিকে। আছিয়া তার দিকে তাকিয়ে ছিল, তার চাহনিতে বিষাদ। চোখাচোখি হতেই জীবন দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো, যেন সেই বিষণ্নতা এড়িয়ে যেতে চায়। ধীরে ধীরে সে সেখান থেকে সরে গিয়ে দূরে একা দাঁড়িয়ে চাঁদের দিকে চেয়ে রইল। হালকা কণ্ঠে সে মৃদু স্বরে বলল,
——— "কিছু কথা, কিছু দীর্ঘশ্বাস, কিছু চাহনি, কিছু আকাঙ্ক্ষা, কিছু প্রাপ্তি, কিছু হারানো... কিছু জিনিস তোমার অজানাই থাকুক।"
_________________
আফ্রিদি নিশীথের নিবিড় আঁধারে নদীতীরে নির্জন স্থানে বসে , যেখানে পূর্বিকা আর সে কতশত প্রহর কেটেছে, হাস্য-পরিহাসে নিমগ্ন থেকেছে, ঝগড়ার পর পূর্বিকার স্নিগ্ধ কন্ঠে রাগ প্রশমিত হয়েছে বারংবার। আজ সেই অন্তর শূন্যতায় অভিভূত, বুকের ভেতর শূন্যতা গ্রাস করছে। দুচোখ জ্বলে উঠছে ক্রো'ধের আগুনে। গভীর ক্রোধে আপন মনেই ফিসফিস করে বলে উঠছে,
——— "নারী, তুমি ছলনাময়ী! তুমি প্রতারণার প্রতিমূর্তি! বিশ্বাসঘাতিনীর বেশ ধরেছো!"
নিজের চিন্তার ভার আর সহ্য করতে পারছে না সে। পূর্বিকার কারণে ছোটবেলার বন্ধু মুগ্ধের সাথে সে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, এমনকি তাকে হ'ত্যা'র প্রয়াসও করেছে! মুগ্ধ যে কতবার তাকে বোঝানোর, কথা বলার চেষ্টা করেছে, এখনও চাইছে, কিন্তু আফ্রিদির কঠিন হৃদয় সেই অনুরোধকে উপেক্ষা করেছে। কী ভ্রান্তি! সেই মুগ্ধ, যাকে সে বিপদে সর্ব প্রথম, কাছে; পাশে পেয়েছে, জীবনপথের অকৃত্রিম বন্ধু ছিল, আজ তার সঙ্গ হারিয়েছে শুধুমাত্র পূর্বিকার জন্য! অথচ মুগ্ধ জানত না আফ্রিদির অন্তর্লীন প্রেমের কথা—তাকে কখনও বলা হয়নি। রাগের উত্তাপে মুগ্ধের প্রতি সমস্ত কথা বন্ধ করে দিয়েছিল আফ্রিদি।
রোহানের কথা যদি সত্য হয়, যদি মুগ্ধ সত্যিই আঁখির জন্য এসব করেছে, তবে আফ্রিদির মতো খুশি কেউ হবে না! কিন্তু পূর্বিকা? সে কেন নিজের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করল? কেন মুগ্ধের কাছে গিয়ে কথা বলল? যখন আফ্রিদি পূর্বিকাকে জোর করে টেনে নিয়ে গেলো, তখন পূর্বিকা বলেছিল, তার বাবা দেখলে স'র্বনাশ হবে! অথচ মুগ্ধর সাথে সাক্ষাতের সময় সেই সাবধানবাণী কোথায় ছিল? মুগ্ধ তো শ'ত্রুপরিবারের সন্তান! তাহলে কি নারীরা অর্থের কাছে পরাজিত হয়ে যায়?
এসব ভাবতে ভাবতে, ক্রো'ধে তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল, সারা দেহে ক্রোধের উত্তাপ ছড়িয়ে যায়। হঠাৎ করে এক প্রচণ্ড চিৎকারে ভেঙে পড়ে,
——— "আমি প্রতারককে ঘৃ'ণা করি! আমি সেই বিশ্বাসঘাতিনীকেও ঘৃ'ণা করি, যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়!"
অন্ধকারের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয় আফ্রিদির আর্তনাদ, এক নারীর জন্য নিজেকে কীভাবে ধ্বং'স করে ফেলেছে, তা ভাবতেই তার সমস্ত সত্তা এক গভীর অনুশোচনায় ডুবে যায়। চোখ বুজে বিষাদের সুরে আফ্রিদি বলে উঠে,
——— "মুগ্ধ, ক্ষমা কর! আমি আমাদের বন্ধুত্বটাকে নিজের হাতেই শেষ করেছি। তুই সত্যিই বলেছিলি; আমাদের বন্ধুত্বর মূল্য এখন দশ টাকার চেয়েও নিম্ন! "
_______________
আঁখির হৃদয়ের অন্তঃস্তলে এক অস্বস্তি ক্রমাগত বেড়ে উঠছে। বাইরে থেকে সে সবার হাসি-ঠাট্টায় শরিক হলেও, মনের গভীরে তার চিন্তার ছায়া যেন গাঢ় হয়ে উঠছে। হীরণ কি তাকে মিথ্যা বলেছে? মিলি পরিষ্কার জানিয়েছে, দুল হারানোর কোনো কথা সে জানে না। তবে হীরণ কেন বলল, মিলি নিজেই নাকি বলেছে খুঁজে দিতে? আর সত্যিই তো, মিলির কানে দুল ছিল! আঁখির মনে পড়ে, যখন সে খাটের তলায় ঢুকেছিল, এক প্রচণ্ড শব্দ শুনেছিল, যেন দরজা ভেঙে কেউ ভেতরে ঢুকেছে। কিন্তু দ্রুত বেরিয়ে এসে সে কাউকে দেখল না—শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
এই ভাবনার আবর্তে ঘুরপাক খেতে খেতেই নাঈমের কণ্ঠস্বর তাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনল,
——— "এই মুরগি, একটু কলের কাছে আয় তো?"
আঁখি ভ্রু কুঁচকে তাকাল। নাঈম তো কিছুক্ষণ আগেই ফোনে কথা বলে ফিরে এসেছে, তবে তার দুই হাত কালিতে মাখা! আঁখি ঠাট্টা করে বলল,
——— "মানুষের মুখে কালি লাগে শুনেছিলাম, তোর দেখি হাতে লেগেছে!"
নাঈম বিরক্ত হয়ে জবাব দিল,
——— "চুপ কর! পাতিলের ধারে গিয়েছিলাম, সেখানেই ধান্দায় পড়ে হাত মাখিয়ে ফেলেছি। এখন বেশি কথা না বলে কল চেপে দিবি? আমি হাত ধুই!"
আঁখি ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
——— "এই আমার কোনো কাজ নেই? বাথরুমে গিয়ে ধুয়ে আয়!"
——— "সারাদিন তো আমার মাথা খাওয়াই তোর কাজ! আর বাথরুমে যদি কালি লেগে যায়, তখন কি তুই পরিষ্কার করে দিবি?"
আঁখি বিরক্তিতে মুখ শক্ত করে উঠল। কোনো উপায় নেই—গিয়ে সাহায্য করতেই হবে। মিলিদের চাপকল ব্যবহৃত হয় না প্রায়, শক্ত হয়ে আছে বেশ। দুজনে বাড়ির কর্ণধারের দিকে হাঁটতে লাগল। একটু দূরে চেয়ারে বসে থাকা আরাফ সব শুনেছে, যদিও বক্সে বাজা গানের শব্দে কিছুটা মিশে গিয়েছিল কথাগুলো। তার মনের কোণে মৃদু হাসি ফুটল; তার ছোট্ট পাখিটা কল চাপতে যাচ্ছে! বিয়ে হলে এসবের ধারে কাছেও যেতে দেবে না সে; এমন প্রতিজ্ঞা যেন নীরবে জমে উঠল তার মনে।
____________
রাত্রির প্রহর এগারোর কাটায় এসে থেমেছে, তবু সেই প্রাঙ্গণে চলমান বক্সের কর্কশ ধ্বনি যেন আঁখির মস্তিষ্কে এক ক্রমাগত হুলুস্থুল তুলেছে। ক্লান্তিতে চোখ ভারী হয়ে এসেছে, নিদ্রার জন্য প্রাণ যেন আকুল। খাওয়া-দাওয়া বাহিরেই সেরেছে সবাই, কেউ ঘরে ফিরতে ইচ্ছুক নয়—সারা রাতের আনন্দ যেন এখানেই জমে উঠেছে।
আঁখি চেয়ারে হেলান দিয়ে ঝিমোতে ঝিমোতে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। নাঈম কাছে এসে মাথায় চাপড় মেরে বলল,
——— “ঘরে গিয়ে ঘুমা! কাল অনেক কাজ পড়ে আছে।”
অর্ধচেতন চোখে তাকালো আঁখি। অনেক দিন যাবত সে সঠিকভাবে ঘুমাতে পারেনি, খাবারেরও ঠিক নেই। আর সেই সঙ্গে এই অবিরাম আওয়াজ যেন তার মাথায় বাজ পড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একপ্রকার ঘুমের ঘোরেই উঠে দাঁড়াল, পা টেনে টেনে চলে গেল ঘরের দিকে। আরাফের বাবা সাজ্জাদ সাহেব জরুরি কাজে ডেকেছে তাকে নয়ত এ দৃশ্য সে কখনো মিস করতো না!
বাড়ির গেটে প্রবেশ করতেই হঠাৎ পায়ের নিচে কিছু অনুভব হলো। আঁখি চমকে উঠল, ছিটকে দূরে সরে গিয়ে দাঁড়ালো। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে, হীরণ আঁখির পায়ের উপর পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বেশ কষ্টে শব্দ উচ্চারণ করে ক্ষমা চাচ্ছে,
——— “আ,,,আপু, আ,,,আমাকে ক্ষমা করে দিন!”
আঁখি হতবাক, চোখ গোল করে তাকিয়ে রইল। হুশ ফিরতেই অবাক হয়ে বলল,
——— “আপনি এসব কী করছেন কি ভাইয়া??”
হীরণ আরও জোরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
——— “না আপু, আমাকে ক্ষমা না করলে আমাকে মে'রে ফেলবে! প্লিজ আপু, আমাকে ক্ষমা করে দিন!”
আঁখি এবার বেশ অবাক হয়ে উঠল। লোকটা অদ্ভুত তো! বয়সে বড়, চেহারা কালো কাপড়ে ঢাকা। পুরো শরীরও ঢাকা, পায়ের উপর প্রায় শুয়ে পড়েছে। বিরক্ত স্বরে বলল,
——— “আপনি এমন কী করেছেন যে এভাবে মাপ চাইছেন?”
হীরণ ফিসফিসিয়ে বলল,
——— “আমি... আমি ওর জিনিসে নজর দিয়েছিলাম…”
——— “ওর? ও কে?”
——— “না, কিছু না। আপনি আমায় ক্ষমা করেন, নাহলে আমাকে মে'রে ফেলবে!”
এবার আঁখি আরও অবাক হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
——— “আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু কে?”
কিন্তু হীরণ চোখ তুলল না, মাথা নিচু করেই আঁখির পায়ের কাছে একটা ছোট কাগজ রেখে দৌড়ে পালাল বাইরের ঘন আধারের পথে। আঁখি বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল, পায়ের দিকে তাকাতেই যেন তার শ্বাস বন্ধ হয়ে এল! অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,
——— র,,রক্ত??
তড়িঘড়ি করে কাগজটা তুলে নিলো আঁখি। ছোট্ট কাগজটা খুলতেই চোখে পড়ল একটা মাত্র লাইন,
❝তুমি কি আমার কথাকে তুচ্ছ হিসেবে নিয়েছো প্রণীতা???❞
অন্ধকার রাতের নির্জনতা ভেদ করে যান্ত্রিক সুরের কর্কশ ধ্বনি কেবল বাড়িতেই নয়, আঁখির মনের অভ্যন্তরেও এক অবিরাম আওয়াজ তুলছে। কেমন যেন শূন্যতায় ডুবে গেল তার চেতনা। ধীরে ধীরে তার পায়ের জোর ফুরিয়ে গেল, এবং অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাড়ির গেটের সামনেই ধপাস করে বসে পড়ল। মস্তিষ্কে এক ঘোর লাগা অনুভূতি—চারপাশের সবকিছু যেন কুয়াশার মতো অস্পষ্ট। মাথা ভার হয়ে এসেছে, মনে হচ্ছিল পুরো পৃথিবীটাই যেন ঘুরছে। চোখের সামনে বিশাল প্যান্ডেলের ভেতর সবাই উৎফুল্ল হয়ে উল্লাস করছে, মঞ্চে বসে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মত্ত। নারীসমাজ গোল হয়ে রান্নার সরঞ্জামাদি গোছাতে ব্যস্ত ; পুরুষসমাজ দেখছে সব ঠিকঠাক আছে কিনা! কানের ভেতর ঢুকে পড়ছে সেই অসহ্য গান—কিছুতেই রেহাই নেই।
তবুও এই দৃশ্যপট আর তার মাথার ভেতরের ভাবনার স্রোত সম্পূর্ণ বিপরীত। সে দেখছে ঠিকই, কিন্তু মনের ভিতর চলছে আরেক মহাযুদ্ধ।
——— ‘কোন কথার কথা বলল সে? হীরণ কি বলেছিল... ওর জিনিস... নজর… মাপ? কেন এমন করবে?’
মনের এই প্রশ্নগুলো যেন আঁখির ভেতরের স্থিতি ভেঙে তাকে বিপর্যস্ত করে তুলছিল। এই রহস্যময় বাক্যগুলোর অর্থ কী? কে মে'রে ফেলবে? কোন অভিসন্ধি লুকিয়ে আছে এর পেছনে?
আঁখি চুপচাপ বসে রইল, তার চারপাশের উচ্ছ্বাসের কোনো তেমন মূল্য আর নেই। ছোট্ট, নির্জন বাড়ির আঙিনায় নেমে এসেছে এক অনাবিষ্কৃত অশান্তি। হঠাৎ যেন মাথায় এক ঝলক বিদ্যুৎ খেলে গেল। এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল আঁখি। অস্থিরতা তাকে যেন উন্মত্ত করে তুলল। সে দ্রুততা নিয়ে দৌড়ে চলে গেল মিলির ঘরের দিকে। সেখানে ঢুকে সে পাগলের মতো কিছু খুঁজতে শুরু করল। ঘরে আত্মীয়-স্বজনের ব্যাগে ভর্তি, তার ভেতর কোথাও আঁখির ব্যাগটি আছে, কিন্তু তা খুঁজে পাচ্ছে না। অবশেষে, অবসন্ন মনে ব্যাগ খুঁজে পেলো আঁখি।
হন্তদন্ত হয়ে ব্যাগের চেইন খুলতেই ভেসে এলো আরো একটি কাগজ। দ্রুততার সাথে কাগজটি তুলে নিল এবং ভাঁজ খুলল। চিঠির প্রথম কয়েকটি শব্দই যেন তার রক্তকে জমিয়ে দিল। চিঠিতে নিদারুণ হুমকির বাণী,
❝আজ কোনো উপহার নেই, কোনো স্মারকও নয়। এইবার কিছু রেখে যাচ্ছি না, শুধু হুঁশিয়ারি।
বিয়ের এই উন্মাদনায় প্রবেশ করছো তুমি, চারপাশে উৎসুক জনতার ঢল, তাদের চোখের চাহনি যেন শিকার খুঁজছে। তুমি যদি নিজেকে সামলাতে না পার, তাহলে আমায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা অসম্ভব হবে। আমার সহ্যশক্তি সীমিত, আর কেউ যদি তোমার দিকে এক নজরও বেশি সময় ধরে তাকায়, তবে সে অক্ষত ফিরবে না। আমার র'ক্তে যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বলছে, তা হাতে ফেটে পড়লে কেবল ধ্বং'স হবে। তুমি যদি সতর্ক না থাকো—কেউ সাহস দেখাতে এলে, তাকে আমি ছিঁ'ড়ে ফেলব। বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। দৃষ্টির আড়ালেই লুকিয়ে আছি, কিন্তু কেউ যদি ধৃষ্টতা করে, তার ফল হবে সর্বনাশ।❞
চিঠিখানি পড়তেই আঁখির ঠোঁটের কোণে অস্ফুট উচ্চারণ,
——— "কাব্যরাজ, আপনি...?"
আঁখির দৃষ্টি দেয়ালের ঘড়ির দিকে নিবদ্ধ হলো— রাত এগারোটা ত্রিশ। তবে কি এই মুহূর্তেই কাব্যরাজ উপস্থিত? সেই অজ্ঞাত, অব্যক্ত পুরুষ? তীব্র ধাক্কায় হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেলো। অনিশ্চয়তার ভ্রুকুটি মস্তিষ্কে আঘাত করলো। ব্যাগের গহীনে চিঠি দুটি রেখে দিলো সে, কিন্তু চোখের পাতায় আর ঘুমের ছায়া নেই। যে নিঃসীম অস্থিরতা চেতনাকে গ্রাস করেছিল, তা তাকে প্রবলভাবে টেনে নিয়ে গেলো ঘরের বাইরে। দেহে শিহরণ বইছে, চক্ষু যেন অদৃশ্য রশ্মি হয়ে স্ক্যান করছে চারিপাশ— কোথাও সন্দেহজনক কিছু খুঁজে পাওয়া যায় কি না।
তবু হীরণের চলমান দেহকে সেসময় কোনোদিকে ছুটল, দেখে নি আঁখি। তার পা ছুটছে, ছুটছে এদিক-ওদিক। প্রবল গানের বিকট শব্দে পরিবেশ এমন এক স্থবিরতায় মগ্ন যেন কেউ মৃ'ত্যুবরণ করলেও কারো কানে পৌঁছবে না সেই সংবাদ। আঁখি দৌড়ে এবার পিছনের দিকে গেলো, সে তাকে খুঁজে বের করবে। তাকে বলতে হবে,
——— "আমার পিছু ছাড়ুন । এই প্রেম, এই মোহ— এ আমার জন্য নয়, কখনও ছিলো না; কখনো হবেও না।"
দ্রুতপদে ধাবমান আঁখি যখন একেবারে দূর প্রান্তে এসে পৌঁছালো, তখনই যেন হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেল। গভীর নিশ্বাসের পর তার মনে হলো, এ সময়ে, একাকী এমন দূরে এসে পৌঁছানো কি সঙ্গত হলো? তবু কৌতূহলী দৃষ্টি চারপাশে ছড়িয়ে দিতে লাগলো। মনের অজান্তেই দৃষ্টি বাশঝাড়ের দিকে নিবদ্ধ হলো—সেখানে যেন কিছু নড়ছে! সাপ নাকি? নিঃশব্দে এক পা সামনে বাড়ালো, ঠিক তখনই পেছন থেকে বজ্রকঠিন কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হলো,
——— "আর এক কদম এগুলে, পা ভাঙব!"
চমকে পেছনে ঘুরলো আঁখি! কাব্যরাজ কি? অন্ধকারের আধার বুঝতে দিচ্ছে না। ভয়ে ও বিস্ময়ে দৌড়ে সামনে এগোতেই প্রতিভাত হলো এক সুদর্শন, কঠোর মুখাবয়ব। তার চোয়াল কঠিন, হাতের মুঠি সঞ্চারিত হচ্ছে প্রচণ্ড ক্রো'ধে। আর সেই কর্কশ কণ্ঠস্বর যেন ছুরির মতো বক্ষ বিদীর্ণ করল,
——— "রাতের এমন প্রহরে তুমি একা এখানে কি খুঁজছো?"
———"কা—কাওকে না!"
আঁখির কণ্ঠ ক্ষীণ হলো। মুগ্ধ তার হাত রুক্ষ শক্তপোক্ত কচলাতে কচলাতে বলল,,
——— "এখানে আর এক দণ্ডও দাঁড়িয়ে থাকলে, আমার এই হাত কোনো এক দুর্ভাগীর নরম গালের উপর অনিবার্যভাবে আঘাত হানবে!"
আঁখির দৃষ্টি মুগ্ধের মুখের ওপর নিবদ্ধ হলো, ক্ষুদ্র চোখে বিস্ময়ের প্রতিফলন। আবছা আলোর নিচে তার রাগী চেহারাটা যেন আরও কঠিন হয়ে ফুটে উঠলো। মুগ্ধ কি সত্যিই তার গালে আঘাত করার কথা বলল? তার রাগের তীব্রতা সত্ত্বেও আঁখি আর কিছু বললো না। এ রাতে, এখানে দাঁড়িয়ে সে আর তর্ক করতে চায় না। এক নিঃশব্দ তাচ্ছিল্যে ভ্রু কুঁচকে গটগটিয়ে বাড়ির দিকে পা চালালো। মুগ্ধ তার পানে দৃষ্টিপাত করল, পকেটে হাত গুজে এক বিদ্রূপাত্মক হাসি ছুঁড়ে বলল,
——-— "জীবনের শেষ দিন দেখার ইচ্ছে কি তবে এত প্রবল? তা-ই তো খুঁজে ফিরছো!"
অন্যদিকে, যেখানে আঁখি সাপের অস্তিত্বের আশঙ্কায় ছিল, সেই ঝোপঝাড়ে জীবন দাঁড়িয়ে, পকেটে হাত গুঁজে। হতাশার সুরে ম্লান এক হাসিতে জীবন বলল,
——— "আজও আপনি পারলেন না, স্যার!"
______________________
গভীর নিশীথের চাঁদপানে রক্তাভ দৃষ্টিপাত করে রইল আগন্তুক। তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্রমে উত্তেজিত হচ্ছে, ক্রোধে ফুসে উঠে বিষণ্ণ এক দানবিক হাসি হেসে বলল,
——— পর্যাপ্ত বিরতি হয়েছে; এবার প্রকৃত খেলাটি শুরু করার কাল এসেছে।
0 Comments