Ad Code

শ্যামকন্যার মায়াবী চোখ - পর্ব ৪৫

 লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা

🚫🚫
কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।
🚫🚫
গাড়িতে আরোহন করবার অব্যবহিত পূর্বেই অদূর থেকে শ্রুত হলো এক বলিষ্ঠ পুরুষকণ্ঠ,
——— "আরাফ!!"
আরাফ ধীরে পেছন ফিরল, তার সঙ্গে গাড়ির ভিতর অবস্থানরত ড্রাইভারসহ, সাজ্জাদ সাহেব ও মোশারফ সাহেবের চোখও সেখানে নিবদ্ধ হলো। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একজন, কঠোর, প্রশান্ত অথচ শীতল মুখাবয়বের অধিকারী এক ব্যক্তিত্ব, শীতের মমিত কুয়াশায় প্রায় আড়ালেই বলা চলে। দূরত্ব কম হলেও, কঠোর মুখাবয়বটি কুয়াশার ছায়ায় রহস্যে আচ্ছাদিত। এই একমুখী দৃঢ়তা নীরব আরাফের বিদায়ে কোনো আবেগের ছাপ রেখে যায়নি; সেখানে নেই আনন্দ, নেই দুঃখ, যেন অনুভূতির স্তব্ধতা। তার মুখে কি কোনো প্রতিক্রিয়া লুকিয়ে আছে, না কি তা প্রকৃতপক্ষেই শূন্য?
আরাফ অনুভব করল, এই মানবের ভাবনার অতল গভীরতা বুঝে ওঠা তার সাধ্যের বাইরে।
আরাফের মনে উদিত হলো এক প্রশ্ন, যা এখনো উত্তরবিহীন, অপূর্ণ! সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল, এবং নির্দ্বিধায় বড় ভাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মুগ্ধর চোখ-মুখ রক্তিম, আগুনের শিখায় লালাভ, ঠোঁটের কোণে আটকে থাকা অনুভূতিহীন এক কঠোরতা। আরাফ হালকা মলিন হাসি ফুটিয়ে প্রশ্ন করল,
——— "আঁখিকে ভালোবাসো?"
মুগ্ধর মুখাবয়বের কঠোরতা ভাঙল না; সে নিঃশব্দে আরাফের দিকে তাকিয়ে রইল, নিঃশব্দ নীরবতা দিয়ে সমস্ত আবেগ বহন করছে। চোখের গভীরে একটুকরো বেদনা, নিঃশব্দে যা সমস্ত কথার থেকেও প্রবল। নীরবতা, কখনো এক অব্যক্ত সম্মতির মতো, আবার কখনো সমস্ত জবাবেই শূন্য, নির্ভর করে প্রশ্নের গভীরতার উপর! আর এখন, এই মুহূর্তে, আরাফ অনুভব করল, মুগ্ধর চোখে সে তার প্রশ্নের নিঃশব্দ উত্তর পেয়ে গেছে।
এক বুক শূন্যতা নিয়ে, বিষাদের কণ্ঠে হাসল আরাফ; তবুও তার কণ্ঠে সেই চিরচেনা নীরবতা। আস্তে বলল,
——— "আমার যা বুঝার, বুঝে নিয়েছি।"
এ বলে আরাফ আবারও পেছন ফিরতেই থেমে গেলো, আরাফের কাঁধে মুগ্ধ তার হাত স্থাপন করলো। আরাফ তাকিয়ে রইলো, প্রথমে মুগ্ধর হাতের দিকে, তারপর তার দৃষ্টি গড়ালো মুগ্ধর চোখের গভীরে। মুগ্ধ কোনো শব্দ উচ্চারণ করলো না; হঠাৎ করেই তার ভাইকে টেনে নিলো নিজের বুকে। আজ এই নি:শব্দ নির্লিপ্ততার অন্তর্গত এক হাহাকার মুগ্ধর কঠোর হৃদয়ে তোলপাড় করছে। সে যে শৃঙ্খলে বাঁধা, সে যে আজ বড্ড অপারগ। অথচ, ছোট ভাইটাকে যে কত গভীর ভালোবাসে সে! এই প্রিয় প্রাণটিকে কষ্ট পেতে দেখে মুগ্ধর হৃদয়ের অন্তরস্থল ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে ওঠে, সমস্ত অস্তিত্ব জ্বলে-পুড়ে খাঁ খাঁ করে।
আরাফ ফুপিয়ে ওঠে, কাঁপতে কাঁপতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তার ভাইকে। চোখের কোণে বেদনার স্ফুরণ, সেই নিঃশব্দ হাহাকার মুগ্ধর হৃদয়ে গভীর ছায়া ফেলে যায়। মুগ্ধ তার ছোট ভাইয়ের কপালে তপ্ত চুম্বন এঁকে দেয়, যেমনটি শৈশবে করত; যখন ছোট্ট আরাফ কান্না নিয়ে তার কাছে ছুটে আসত, কোনো এক চিহ্নিত ব্যথার ভার নিয়ে। সেই ব্যথা মুগ্ধ আপন হাতের পরশে মুছে ফেলত, আর যে কারণ তাকে আহত করত, মুগ্ধ তার অস্থিত্ব নিশ্চিহ্ন করে দিত।
কিন্তু আজ? আজ তো এই যন্ত্রণার উৎস অদৃশ্য, দুর্বোধ্য। মুগ্ধ চাইলেও কিছু করতে পারে না, এক নির্মম অক্ষমতার জালে বন্দী। এ যে ভিন্ন এক যাতনা, এক অন্তর্লীন আঘাত, যার নিরাময় সে দিতে অপারগ। আর এই যন্ত্রণার ঔষধ, এক নিষ্ঠুর নারীর করুণামুক্ত হৃদয়ের অন্তরালে লুকায়িত, যাকে ছুঁতে না পারার তীব্র
বেদনাই আজ মুগ্ধকে নিষ্পেষিত করছে।
বেশ খানিকক্ষণ দুটি বলিষ্ঠ দেহকাঠামোর পুরুষ স্থবির হয়ে জড়িয়ে রইল, তাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে বিভীষিকার এক ভয়াল ঝড় তাণ্ডব করে চলল। একজন করুণ ক্রন্দনে ভেঙে পড়ল, আর অন্যজন দাঁত শক্ত করে বুকের গভীরে গিলে নিতে চেষ্টা করল সেই অসহ্য বেদনার ঢেউ। অটোমোবাইলের অন্তর্গত নিস্তব্ধতা ভেঙে মোশারফ সাহেব দুই পুত্রের এমন এক বিপন্ন অবস্থা অবলোকন করে গভীর শ্বাস ত্যাগ করলেন।
মুগ্ধ অবশেষে নিজেকে ছুটিয়ে মুক্ত করল। তার দৃষ্টিজোড়া রক্তিম; কতবারই না যুদ্ধ করেছে সে চোখের সেই অনির্বাণ জলধারার বিরুদ্ধে। না, এক বিন্দুও ঝরতে দেবে না। পাষাণ, নির্দয় পুরুষ, সেই পরিচয়ে অটল থাকবে। সমস্ত অনুভূতির প্রবল স্রোত সে অন্তরটায় নিঃশব্দে গিলে নেবে, অন্তহীন ব্যথার
কঠিন গলিত শিলা বুকে ধারণ করবে।
অত্যন্ত ভারাক্রান্ত কণ্ঠে মুগ্ধ উচ্চারণ করল,
——— "নিজের খেয়াল রাখিস!"
আরাফের ঠোঁটে এক বিষণ্ন হাসির রেখা ফুটে উঠল, এবং সে শুধু বলল,
——— "ভালো থেকো....তাকে...নিয়ে!"
অতঃপর আর একটিও শব্দ উচ্চারণ না করে আরাফ দ্রুত গাড়ির দিকে অগ্রসর হলো, এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই দ্রুতগতিতে উধাও হয়ে গেল সেই যানবাহন, শীতল হিমেল বাতাসে শোঁ শোঁ শব্দ তুলে। কনকনে শীতের ঘন কুয়াশার আস্তরণে গাড়িটি সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেল।
মুগ্ধ স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। অপলক, ম্রিয়মাণ, নির্বাক। অন্তরের মর্মব্যথা অবশেষে এক দীর্ঘশ্বাসে নির্গত হয়ে পৃথিবীর ভারাক্রান্ত হাওয়া স্পর্শ করল। দুঃখ আর বেদনাবিদ্ধ সেই উচ্চারণে, যেন আকাশও বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে,
——— "এটাই তোর জন্য শুভকর হবে, ভাই!"
মুগ্ধের কণ্ঠে গভীর আক্ষেপের বিষাদ ঘন হয়ে ফুটে উঠল, ক্ষোভ থমকে যাওয়া মেঘের বজ্রধ্বনি হয়ে কানে বাজল,
——— "নয়তো ভবিষ্যতের নির্মম আ'ঘাত সহ্য করার শক্তি পাবি না!"
তৎপর, শীতের কুয়াশায় মোড়া প্রতিকায় সে এক অটল দৃষ্টিতে চেয়েই বলল,
——— "হিসেবটা শুধু তার আর আমার, তোর কোনো অধিকার নেই সেই সীমারেখা অতিক্রম করার। আমি তোকে কি করে প্রবেশ করতে দিতাম?"
লাল চোখ, যন্ত্রণার আগুনে ঝলসে ক্লান্ত অভিমান জমে রয়েছে সেখানে। ক্লান্ত সেই কণ্ঠে, অভিমানের ভারে চাপা আর্তনাদ মিশিয়ে বলল,
——— "তুই তো তার কাছে গিয়েছিস, তোর আত্মার সবটুকু উন্মোচন করে তাকে দেখিয়েছিস; প্রমাণ দিয়েছিস তোর ভালোবাসার প্রতাপ কত গভীর, কত অপ্রতিরোধ্য! তাকে কাঁদিয়েছিস, নিজেও অশ্রুপাত করেছিস!"
মুগ্ধ থমকালো! গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠস্বর ক্রমে যেন ভেঙে যেতে লাগল, শক্ত অথচ বেদনাভারে নতজানু সেই চিরচেনা আওয়াজে এক অবর্ণনীয় যন্ত্রণা ফুটে উঠল। গভীর ব্যথা মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
——— "কিন্তু আমি তার কাছে যেতে পারি নি! নিজের সত্তার গভীরতম সত্য, হৃদয়ের অন্তর্লীন আর্তিগুলো তার সামনে তুলে ধরতে পারি নি! গুমরে কেঁদে, তৃষিত আর্তনায় তাকে বুঝিয়ে বলতে পারি নি কী ভয়ঙ্কর ক্ষত সে আমার অস্তিত্বে অমোচনীয়ভাবে এঁকে দিয়েছে।"
তার গলার স্বর যেন ঘনীভূত অশ্রুর ভারে চাপা পড়ে গেল। মুগ্ধ আরো বলল,
——— "সে জানে না, এই নির্মম, নির্দয় বলে পরিচিত পুরুষের হৃদয়ে সে কত দগদগে যন্ত্রণা রেখে গেছে, কতটা গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে! এই ক্ষত প্রতিটি নিঃশ্বাসে আমাকে দহন করে, প্রতিটি ধ্বস্ত পদক্ষেপে আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলে এক অদৃশ্য দুঃসহ শূন্যতার দিকে।"
মুগ্ধ একা একাই দাঁড়িয়ে ভারি কণ্ঠে নিজের অভ্যন্তরের কষ্ট বিলাপ করল। ধীরে ধীরে সে পকেট থেকে ফোনটা বের করল একবার, চোখের নিস্তব্ধ গভীরতায় একটা ম্লান দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল। আজ জীবনকে ডেকেছে সে, কিছু জরুরি ও অশ্রুমলিন সত্য ব্যক্ত করার জন্য। জীবন জানিয়ে দিয়েছে, সে আসছে। আর সেই প্রত্যাশার ভারে মুগ্ধ এখানেই দাঁড়িয়ে আছে, প্রতিটি মুহূর্ত একটি অদৃশ্য শৃঙ্খলে বেঁধে রেখেছে তার সত্তাকে।
তারপর গভীর আত্মার গভীর থেকে উঠে এলো নিঃশব্দ কণ্ঠের শ্বাসরুদ্ধ বাণী, চাপা ক্ষোভের আর্তনাদে:
——— "আমি বলতে পারি নি তাকে! তোর কাহিনি সবাই জানল, কিন্তু আমারটা? আমার বেদনার কথা কি কেউ কখনো জানবে? ওই বিষাক্ত হৃদয়ের পাষাণ মেয়েটা যে আগেই তোর ভাইয়ের হৃদয়ে বিষ দাত বসিয়ে, নখরাঘাত করেছে! তুই কখনোই জানতে পারবি না, আরাফ! আর কেউ জানবে না! সেই নির্দয় মেয়েটা নিজেও জানে না, জানে না সে কী যন্ত্রণা সৃষ্টি করে গেছে!"
মাঝেমধ্যে যাদের হৃদয়হীন পাষাণ বলে আমরা মনে করি, কিংবা যারা নিজেদেরকে পাষাণ হিসেবে পরিচিত করে তোলে, তাঁদের অন্তর্গত অনুভূতি কি আদৌ আমরা বুঝতে পারি? একটিমাত্র শব্দে তাঁদেরকে আখ্যায়িত করে ফেলা হয়, পাথর, অনুভূতিহীন, পাষাণ পুরুষ! যেন এই সংক্ষিপ্ত শব্দগুচ্ছই তাঁদের সমগ্র পরিচয়। কিন্তু যদি কখনো তাঁদের অন্তরের গহীন দৃশ্যটিকে প্রতিফলিত করা যেত, তবে কি এই শব্দগুলো এত সহজেই প্রকাশ পেত?
অনেকে চোখের জলে কিংবা কারও কাছে নিজেকে খুলে বলে নিজের মনকে হালকা করে ফেলে, কিন্তু যারা নিজেদের গভীর বেদনা একা সহ্য করে যায়? তারা তো দুনিয়ার চোখে পাষাণ, অথচ প্রকৃত সত্যে এই মানুষগুলোই সবচেয়ে দুর্বল, সবচেয়ে অরক্ষিত। নিজের অন্তর্গত যন্ত্রণা নিজের ভেতর গিলে নেওয়া, প্রতিটি অনুভূতির বোঝা কাঁধে বয়ে বেড়ানো, এ যেন এক মর্মভেদী শোক! তাঁদের এই গূঢ় যন্ত্রণার ভার একমাত্র তাঁরাই বুঝতে সক্ষম। বাকিরা তো স্রেফ তাঁকে "পাষাণ" বলে পাশ কাটিয়ে যায়।
তাঁদের এই কষ্ট যেন জীবনমৃত্যুর অন্তর্গত এক অন্তহীন অন্তর্লীন অগ্নিসমক্ষ! যে আগুনের লেলিহান শিখা তাঁরা নিজেরাই অনুভব করেন, অন্য কেউ নয়।
মুগ্ধ বহুক্ষণ ধরে স্থির দাঁড়িয়ে, যেন ধৈর্যের এক স্থবির প্রতিমূর্তি। হঠাৎ করেই পিছন থেকে উদ্ভাসিত হলো গভীর পুরুষালি কণ্ঠ,
——— " সরি স্যার, দেরি হয়ে গিয়েছে।"
এই বলে জীবন এগিয়ে এসে মুগ্ধর সম্মুখে উপস্থিত হলো। কিন্তু মুগ্ধর মুখাবয়ব দেখে সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ালো মুহূর্তে, যেন মুগ্ধর অন্তর্লোকে ঘূর্ণিঝড়ের স্পর্শ অনুভব করল। ক্রমে উপলব্ধি করল, মুগ্ধ আপ্রাণ চেষ্টা করছে তার অগ্নিময় অনুভূতিগুলোকে ভেতরেই বশ মানাতে, যেন পাষাণের কঠোরতায় গ্রাস করতে।
মুগ্ধর লাল রক্তাভ নয়ন আর লাল মুখাবয়বের প্রতি চেয়ে জীবন উপলব্ধি করল সেই অন্তর্দহন। মুগ্ধ জীবনের কাঁধে হাত রেখে গুরুগম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করল,
——— "অনেক ধৈর্য দেখিয়েছ, এবার ভাঙো!"
জীবন বিস্ময়ে প্রতিধ্বনিত করল,
——— "মানে?”
মুগ্ধ গভীর দৃষ্টিতে জীবনের অন্তর্নিহিত অস্বচ্ছ কৌতূহল লক্ষ্য করে, ভারী স্বরে বলল,
——— “ অনেক কঠোর হয়েছ! এবার কোমল হওয়ার পালা!”
জীবন বিষণ্ণ বিস্ময়ে উচ্চারণ করল,
——— “স্যার, আপনার কথার অর্থ বুঝে উঠতে পারিনি।”
মুগ্ধ তিক্ত হেসে বলল,
——— “"প্রেম, ভালোবাসা সকলের ভাগ্যে জোটে না, জীবন! কত হৃদয় অন্তর্দাহের অনলে নিঃশেষিত হয়ে যায়! আমাকেই দেখো না? প্রতিনিয়ত ভালোবাসার মরীচিকায় বিভোর হয়ে, নিজের জীবনকে গৌরবের সাথে শুষ্ক মরুভূমির মতো উজাড় করে দিয়েছি। নিঃশেষিত সেই মরুতে ভালোবাসার একবিন্দু সুধার প্রত্যাশায় অপেক্ষা করেছি! অথচ তুমি? তুমি সেই পূর্ণ ভালোবাসাকে প্রতিনিয়ত অবজ্ঞায় পরিত্যাগ করছ, যেন কোনো অমর্যাদাহীন মহাত্মার অনন্য সাধনায় নিজেকে চিরকালীন বন্দীত্বে আবদ্ধ করেছ!"
জীবন স্থবির হয়ে গেল; মুগ্ধ ধীর পদক্ষেপে চলতে শুরু করল, জীবনের কাঁধে হাত রেখে। জীবন কী বলবে, মর্মে উপলব্ধি করতে পারল না। মুগ্ধের কণ্ঠে বেদনাহত সুর,
——— “যাকে তুমি তার আবেগের শূন্যতাবোধে দূরে সরিয়ে দিয়েছ, জানো তো? সেই আবেগেই নিহিত ছিল তার শুদ্ধতম ভালোবাসা। আবেগ ব্যতীত প্রেম অসার!”
জীবন স্তব্ধ ও নির্বাক, যেন কোনো গভীর উপলব্ধির ঘেরাটোপে আবদ্ধ। তার অন্তর জ্বলতে লাগল অজ্ঞাত শঙ্কায়। মুগ্ধ কি সবই জানে? আর জানবেই না বা কেন? মুগ্ধ তো অনুভবের ভাষা বুঝতে জানে, পড়তে জানে সেই চোখের নির্জন কথামালা।
মুগ্ধ আরও এগিয়ে এলো, বেদনাকে বশে এনে দৃঢ়তার আঘ্রাণ ছড়িয়ে দিল। মুগ্ধ বলল,
——— “আছিয়া বিলাসে জীবন কাটায়, আর তুমি মধ্যবিত্ত ঘরের এক সাদাসিধে ছেলে, এটাই সংকট, তাই তো? তবে শোনো, সেই আভিজাত্যের মেয়েটি, যে কখনো মাছ-মাংস-ডিম ছাড়া ভাত ছুঁতো না, এখন সে শুধু নুন ভাত খায়। পানি ভাত খায়। যে মেয়ে নিজে হাতে এক গ্লাস পানি তুলে আনতে জানত না, এখন রান্নাঘরে গিয়ে রান্না শেখার জন্য নিজের হাত পুড়িয়ে ফেলে। যে মেয়ে প্রতি সপ্তাহে রাজকীয় নতুন পোশাক ছাড়া চলতেই পারত না, আজ সে মাত্র দু-তিনটি পোশাকই পালটিয়ে পরে। সেগুলো ছিঁড়ে গেলে নিজে সেলাই করে, আবার পরে। মাসের শেষে সেই সীমাবদ্ধ জীবন কাটায়! শুধু এক মধ্যবিত্ত ঘরের পুরুষের সাথে ঘর বাধবে বলে! তাকে এই অবস্থায় দেখে পরিবারের প্রত্যেকটি মানুষের হৃদয় টুকরো টুকরো হয়ে যায়! বলো তো, এসব তুমি আবেগ বলে তুচ্ছ করে ফেলে দেবে? নাকি ছোট কিছু ভেবে তাকে উপেক্ষা করবে?”
জীবনের কণ্ঠে কথা এসে আটকে গেল, অশ্রুগ্রন্থি বিদীর্ণ হতে চায় অথচ অভিমানে আবদ্ধ। মুগ্ধের ঠোঁটের কোণে এক করুণ হাসি ফুটে উঠল, একান্ত তিক্ততায় মিশ্রিত, আর সে গভীর প্রত্যয়ে বলল,
——— “তবুও যদি ভেবে নাও যে সে নগণ্য, আর এ কেবল তার আবেগের সীমাবদ্ধতা, তাহলে থাকুক। সবসময় দূরে ঠেলে দিতে হবে কেন? কেন তাকে অপার ভালোবাসার শীতল শাসনে শূন্যতায় পরিণত করবে? পাশে থেকো, বন্ধু হয়ে, সহচর হয়ে। তার পাশে থেকো, এই জীবনসংগ্রামে তার সঙ্গী হও।
দূরে ঠেলে দিয়ে তুমি তাকে কেবল অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছো। সেই অন্ধকার মুহূর্তে, তার কষ্টের সময়, বন্ধু হয়ে পাশে থেকো। যদি শেষতক ভালোবাসা না থাকে, তবে সে নিজেই চলে যাবে। চলে যেতে দিও। আমি তো বলিনি, ঘর বেঁধেই রাখতে হবে। তবে যে উপলব্ধির কথা তুমি বলো, অন্তত সেই উপলব্ধির প্রান্তসীমা পর্যন্ত তার সাথে থেকো। তার সহচর হয়ে থেকো, না হয় জীবনের দুঃসহ প্রবাহে ঝরে পড়বে সে, চূ'র্ণ হয়ে যাবে।”
জীবন কথা বলতে গিয়েও ঠোঁট থরথর করে কাঁপল, কণ্ঠ থেকে অস্ফুট উচ্চারণ বেরোল,
——— “ক-কিন্তু...”
মুগ্ধ দৃঢ়তায় তার বাক্য কেটে দিল, কোনো আপত্তির সুযোগই রইল না। গভীর, অথচ স্নেহমাখা কঠোরতায় উচ্চারণ করল,
——— “আর কোনো কিন্তু নয়! সে আর ছোটটি নেই! আঠারো পেরিয়েছে, প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে সে। মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় অধিক পরিণতবোধসম্পন্ন হয়। আর সেই স্নেহের আদরের মেয়ে, সে নিজেকে আমূল বদলে ফেলেছে, শুধু তোমাকে পাবার আশায়। ভেবেছো কি, কতখানি পরিপক্বতা অর্জন করেছে সে?
পরিবারের বিধিনিষেধ, সমাজের কট্টর বাঁধন, সব আমি দেখব! সব দায় আমার! আমি আছি, জীবন! আমি থাকতে কেউ তোমাকে এক চুলও আঘাত করতে পারবে না। আজ আমি তোমার স্যার হিসেবে নয়, ভাই হয়ে বলছি; তারও আর তোমারও! আর দূরে ঠেলে দিও না তাকে। বন্ধু হয়ে থেকো তার পাশে।"
মুগ্ধর ওরূপ আশ্বাসবাণী শুনেও জীবন যেন বিশ্বাসের প্রাসাদে বিদ্যুত্পাতের শিহরণ অনুভব করল, যেন সৃষ্টির নিয়ম বিঘ্নিত হয়ে মুগ্ধ স্বয়ং এমন বাক্য উচ্চারণ করছে! সে কি বিশ্বাস করবে এই কথা, যা তার জন্য মুগ্ধ বলছে? অথচ জীবনের আত্মসংযম, আছিয়ার জন্য নিবৃত্তির শপথ, ছিল মুগ্ধের সখ্য ও সম্মানের জলাঞ্জলি থেকে আত্মরক্ষা। আর আজ সেই মুগ্ধই তার বোনের নিকট জীবনকে প্রেরণ করছে, পাশে থাকার আদেশ দিচ্ছে!
মুগ্ধ ফের কঠোর ও গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
——— "আমি জানি, তুমি আমার বিশ্বাসে আঘাত করবে না বলেই এতকাল দূরত্ব রক্ষা করেছ। আজ আমিই তোমাকে আদেশ বলো কিংবা অনুরোধ, যাও, তার সান্নিধ্যে থাকো! প্রয়োজন পড়লে এই দুই চোখে সাক্ষী হয়ে, নিজের প্রতিজ্ঞার সাথে থেকে তোমাদের বিবাহোৎসব সম্পন্ন করাবো।"
মুগ্ধ ফের গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, যেন বুকের ভেতর জমে থাকা এক বেদনার স্রোত মুক্তি পেল। তারপর ভারী কণ্ঠে বলল:
——— "কভু কারো দীর্ঘশ্বাসের কারণ হইও না। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস যেই ক্ষণে ত্যাগ করবে, শেষবার যখন দৃষ্টির আলোক ক্ষীণ হয়ে আসবে, ঠিক সেই মুহূর্তে অনুশোচনার তীব্র দহন তোমাকে আচ্ছন্ন করবে। স্মৃতিপটে ভেসে উঠবে সেই এক প্রাণ, যাকে আঘাত দিয়েছিলে। চরম ইচ্ছা জাগবে ক্ষমা প্রার্থনার, অথচ নির্বাক হয়ে পড়বে। মৃ'ত্যুশয্যায় লাঞ্ছিত সেই অনুশোচনা নিয়েই বিদায় নিতে হবে। সেই অব্যক্ত আফসোসের অমর যন্ত্রণা হইও না!"
জীবন বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, হৃদয়ের ভেতর অনন্ত প্রশ্নের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। সে কি সত্যিই এমন সুখ পাওয়ার অধিকারী? এমন ভালোবাসা, যা তাকে মৃত্যুর আনন্দেও তৃপ্তি এনে দেবে? সত্যিই কি সে পাবে তার ছোট্ট পরিটাকে, যাকে নিজের অন্তরতম গভীরতায় ভালোবেসে এসেছে? তবু আপাতত সে নিজের উচ্ছ্বাসটুকু চেপে রাখল। কারণ সে জানে, আরাফ চলে গিয়েছে। আর এখন মুগ্ধের অবস্থা তার অজানা নয়; এই মানুষটাকে সে খুব ভালো করেই চিনে।
জীবন গভীর দৃষ্টিতে মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে, একটু দ্বিধার মিশ্রণ নিয়ে বলল,
——— "মেয়েটাকে ভালোবাসেন, স্যার?"
——— "না..."
মুগ্ধ কথাটা বেশ জোর করেই বলল, নিজের গলার স্বর চেপে ধরে সেই শব্দটি টেনে আনতে হলো। কঠিন কণ্ঠে যন্ত্রণার চাপা অনুরণন, যা এক মুহূর্তের জন্য পরিবেশের নিস্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করল। মুগ্ধের ভেতরকার বেদনা যেন মুহূর্তে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইল, কিন্তু সে তা শক্ত হাতে রুদ্ধ করে রেখেছে।
জীবন বিস্মিত হয়ে কেবল বলতে চাইল,
——— "তাহলে ম..."
ঠিক তখনই জীবনের ফোন বেজে উঠল, মুহূর্তটাকে ছিন্ন করে। মায়ের ফোন! শাড়ি কিনতে হবে, নিশ্চয়ই সেই কথাই বলতে কল করেছেন। তার মা তো সারাক্ষণ ফোন দিয়ে যোগাযোগ রাখেন। জীবনের মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠল। এই তো সেই প্রথম নারী, তার প্রথম ভালোবাসা; মা! সে কখনো বিরক্ত হয় না, বরং মায়ের এমন খুঁটিনাটি যত্ন ভালোই লাগে।
জীবন ফোন কানে দিয়ে একটু পাশে গিয়ে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর মুগ্ধ দাঁড়িয়ে রইল। নীরব ইশারায় জানিয়ে দিল যে সে চলে যাচ্ছে। এরপর ধীরপায়ে হাঁটা শুরু করল মুগ্ধ। চেতনায় গহীন এক সিদ্ধান্ত বদ্ধমূল হয়ে আছে। সে জানে, এখন তার কোথায় যেতে হবে।
____________
আঁখি ভগ্নপ্রাণে, শীতের হিমকুণ্ঠিত কুয়াশায় ধীরপদে অগ্রসরমান; প্রত্যেক পদক্ষেপ স্থবির যন্ত্রণা। শীতের প্রাবল্যে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জমে শুষ্ক হিমপিণ্ডের মতো নিস্পন্দ, আর করুণ ক্রন্দনে অশ্রুসিক্ত গালদ্বয় এমন ফেটে ক্ষত-বিক্ষত যে, যেন মুহূর্তেই শোণিতরক্তের স্রোতধারা ফুঁসে উঠবে। শুষ্কাধরিত অধরযুগল এমন বিবর্ণ যে প্রাণের চিহ্নমাত্রও অবশিষ্ট নেই। মৃ'ত, হিমকঠিন দেহের মতোই আচ্ছন্ন, যেন বরফের প্রগাঢ় শীতলতা হতে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত এক নিষ্প্রাণ কায়া।
শ্যামল বর্ণধারিণী তরুণীটির সুষমায় শীতের কর্কশতর বর্বরতা এমন শুষ্ক শ্বেতপিশাচের শূন্যতা ধারণ করেছে, কালোত্তীর্ণ ক্লেদে বিবর্ণতা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। আরাফের প্রস্থানপরে, সে নিষ্প্রাণ শীতার্ত কলেজ প্রাঙ্গণের বৃক্ষছায়ায় দীর্ঘক্ষণ ব্যথিত হৃদয়ে আসীন। তার অশ্রুপাতের প্রবলতাটি এমন মর্মন্তুদ ছিল যে, আরাফ ভগ্নহৃদয়ে চূর্ণ হয়ে যেত, এই আঁখি জানত! বারংবার সেই আত্মাকে সে অনুনয় জানিয়েছিল: "বেদনা ভিন্ন কিছুই আমার কাছ থেকে লাভ করবেন না।" কিন্তু যে আত্মা আপন ইচ্ছায় দুঃখকে আলিঙ্গন করতে ব্যাকুল, সেখানে সে আর কী করতে পারে? তার অস্তিত্বের পরিধিতে অপরাধীর লাঞ্ছনা হয়ে কেবলই বসে আছে। যখন কেউ তার জন্য বেদনাবিধুর হয় কিংবা নিজ সত্তাকে আত্মগোপন করে, তখন এক প্রাকৃত মর্মপীড়া হৃদয়কে তীব্র আঘাত করে। সেই একই নিষ্ঠুর অনুভূতি আঁখিকে তাড়িত করছে এখন।
আছিয়া ক্রুদ্ধ শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন বাতাসের বুকে উন্মত্তের মতো ছুটে চলেছে; অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বিষণ্নতার গভীর সুর ফুঁপিয়ে উঠছে বারংবার। তার ভাই আরাফ এমন নীরব, এমন অন্তর্হিত হতে পারে, এটা বিশ্বাসই হচ্ছে না! কীভাবে কোনো কথা না বলেই তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারল? আজকের সকালেও তো কলেজের প্রাঙ্গণে ভাইয়ের সাক্ষাৎ হয়েছিল, তখনও কোনো বিদায়সংকেত দেয়নি! তখন, পরীক্ষার শেষে যখন আছিয়া ভাইকে আঁখির দিকে অগ্রসর হতে দেখেছিল, ক্রোধে তার র'ক্ত ফুটে উঠেছিল। সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়েছিল তার জন্য, কারণ সেই আঁখি, যার জন্য তার প্রিয় ভাই ব্যথিত হয়, দুঃখভোগ করে। বোন হয়ে এমন দুঃখ সে কীভাবে মেনে নেবে?
গৃহে প্রবেশ করতেই অশ্রুসিক্ত পরিবেশের ভারে বুকটা যেন ধ্বসে পড়লো। প্রিয় ভাইয়ের প্রস্থান সংবাদ সে পেলো এমন এক তীব্র শোকের ক্ষণে, যেখানে মাত্র কয়েকক্ষণ আগে সে তাকে কলেজে প্রতিভাত দেখেছিল। মনোজগতের এ এক অদ্ভুত পরিহাস, যেখানে বিদায়ের শব্দ মুঠোফোনে নয়, নীরব নিঃশ্বাসে পৌঁছে যায়।
প্রেয়সীকে বিদায় জানাবার সুযোগ পেলো অথচ ছোট বোনকে বিদায়ের শব্দটুকুও জানিয়ে যেতে পারলো না?এ কেমন নির্মম খেলা এই নিয়তির! এই ক্রন্দন মুহূর্তে আছিয়া যেন দিকভ্রান্ত, বেদনাহত হয়ে শুধু দৌড়াচ্ছে, কোথায়, কিসের উদ্দেশ্যে, সে জানে না। দৌড়ানো ছাড়া আর কিছু যেন এই মুহূর্তে অর্থহীন।
হঠাৎ অদূরে দৃষ্টিতে ধরা পড়লো এক মহামানবীয় অবয়ব। সামনে আসা এই ব্যক্তিটির উপস্থিতিতে যেন পরিবেশে নিঃস্তব্ধতার এক বিষাদঘন স্তর নেমে এলো।
আঁখিকে এলোমেলো পায়ে অগ্রসর হতে দেখে আছিয়ার দৃষ্টি কঠিন শৈলসম দৃঢ়তায় স্থির হয়ে গেল। এই মেয়ে! হ্যাঁ, এটাই সেই অন্তর্গত দহনযন্ত্রণার মূল উৎস। এই মেয়েটির জন্যই আজ তার ভাই চলে গিয়েছে, শূন্যতার অতল গহ্বরে বিলীন হয়ে গেছে তার আপনজন।
চোয়াল শক্ত করে দহনমুখর এক প্রত্যয় নিয়ে আঁখির সম্মুখে দাঁড়ালো আছিয়া। আঁখি তাকে দেখে এক ম্লান হাসির প্রলেপে পরিস্থিতিকে সহজ করতে চাইল। কিন্তু আছিয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হৃদয় যেন সেই হিমশীতল কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে উত্তপ্ত শোলার আঘাত হয়ে নেমে এলো। আছিয়ার মুষ্টিবদ্ধ হাত কঠিন শৈলচূর্ণের মতো আঁখির মুখের মসৃণ গালে আ'ঘা'ত হানে; শব্দটি যেন হিমায়িত পরিবেশকে বিদীর্ণ করে উচ্চকিত প্রতিধ্বনি হয়ে উঠলো।
অন্যের হৃদয়বিদারক স্নায়ুকে অগ্রাহ্য করে যেন প্রকৃতিও স্তব্ধ হয়ে গেল, এই শীতের অন্ধকারাচ্ছন্ন কুয়াশায় আছিয়ার প্রতিশোধের প্রতিধ্বনি ক্ষণকাল পর্যন্ত মৌনতায় বিচলিত রইল।
আছিয়ার আকষ্মিক থা'প্পড়ে আঁখি নড়ে উঠল, শুষ্ক গাল ফেটে তরতর করে তাজা র'ক্তের প্রবাহ দেখা মেলল! চেতনাহীন এক জগতে প্রবেশ করল। এই প্রচণ্ড শীতে,, রক্তে ভেজা গাল, ক্ষত তার অন্তরের যন্ত্রণার কাছে তুচ্ছ মনে হলো। কিন্তু সেই চ'রের যন্ত্রণা শুধু গালে নয়, তার হৃদয়ের গভীরে গিয়ে আঘাত করল। সেই আছিয়া, তার শৈশবের সখি, যে এতদিন আদরের ছোঁয়া দিয়েই তাকে আগলে রেখেছিল, আজ সেই মমতাময়ী হাত তীব্র আক্রোশের সঞ্চারে তার গালে আছড়ে পড়ল!
মুহূর্তেই যেন আঁখির মনের ভেতরে প্রচণ্ড ঝড় উঠলো। চারপাশের বাস্তবতার ভারসাম্য হারিয়ে সে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল, যেন তার সামনে থাকা পৃথিবীটা এক ঝলকে পাল্টে গেছে। সেই বন্ধুত্ব, সেই স্নেহ, সব কেমন করে এক মুহূর্তে অন্তহীন শূন্যতায় মিশে গেল।
কিন্তু আছিয়া শান্ত হলো না। ক্রোধের দৃষ্টি নিয়ে সে এগিয়ে এসে আঁখির কলেজ ড্রেসের সাদা এপ্রোনের কলারে শক্ত করে হাত রাখলো। মুখে নির্দয় অথচ ফিসফিসে স্বরে বলে উঠলো,
——— "তুই… তুই… তোর জন্যই আমার ভাই চলে গিয়েছে! আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গিয়েছে! একদম দূরে! তুই খেলেছিস আমার ভাইয়ের মন নিয়ে, তুই তার জীবনটা শেষ করে দিলি! তুই আমার বান্ধবী না! আজ থেকে তোর আর আমার কোনো বন্ধুত্ব নেই!"
এই তীব্র বাক্যগুলোতে আছিয়ার কণ্ঠের প্রতিটি শব্দ কাঁটার মতো আঁখির হৃদয়ে বিঁধে গেল। সমস্ত সম্পর্ক, সমস্ত স্মৃতি যেন মুহূর্তেই আছাড় খেয়ে পড়ল এক গভীর বিস্মৃতির গহ্বরে।
আছিয়া কাঁদতে কাঁদতে মর্মযন্ত্রণার শব্দগুলো উচ্চারণ করল। যেই সে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, আঁখি অকস্মাৎ খপ করে তার হাত শক্ত মুঠোয় আবদ্ধ করল। আছিয়ার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন ঘৃণার স্রোত বইল, আঁখির স্পর্শ তার র'ক্তে বি'ষ ছড়াল। দাও দাও জ্বলতে থাকা ক্রোধে সে চিৎকার করে উঠল:
——— "আমার হাত ছাড়!"
কিন্তু আঁখির চোয়াল দৃঢ়, চোখ দু’টি অশ্রুতে ভিজে উঠেছে, র'ক্তবর্ণ দাহ্য জ্বালায় দীপ্তমান। আছিয়া হঠাৎ উপলব্ধি করল যে আঁখির মুঠো এতটা শক্ত হয়ে গেছে, যেন তার মাংস ছিঁড়ে হাড় ভেঙে ফেলার উপক্রম। হতভম্ব হয়ে, অবিশ্বাসের চোখে আছিয়া আঁখির দিকে তাকাল। এই ফিনফিনে, নরম শরীরের মেয়েটির এমন প্রচণ্ড শক্তি কোথা থেকে এলো? কী অদ্ভুত পরিবর্তন!
আঁখির চেহারায় অদ্ভুত এক বিভীষিকাময় ছায়া পড়েছে, যার সঙ্গে আছিয়ার পূর্ব পরিচয় নেই। শীতল কনকনে বাতাসের প্রবাহেও আছিয়ার শরীর শীতল ভয় ও অস্বস্তিতে কেঁপে উঠল। এমন আঁখি যেন কখনো কল্পনাতেও ছিল না; অস্পষ্ট, অচেনা এবং অতিপ্রাকৃত এক রূপ, যা তাকে স্তব্ধ করে দিল।
আছিয়া চিৎকার করে প্রতিবাদ করল,
———" এই, তুই আমাকে তোর শক্তি দেখাচ্ছিস?"
আঁখি মৃদু হেসে উঠল,শীতল ও রহস্যাবৃত। তার মুঠো আছিয়ার ডান হাত আরও প্রবল শক্তিতে চেপে ধরল। ব্যথায় আছিয়া কুঁকড়ে উঠল, মুখ থেকে অসহ্য যন্ত্রণার আর্তনাদ বেরিয়ে এল। ব্যথা প্রশমিত করতে চেয়েও আছিয়া যখন অন্য হাত দিয়ে আঁখিকে ধাক্কা দিতে উদ্যত হলো, আঁখি সেই হাতও অমোঘ কঠোরতায় আবদ্ধ করল, যেন নিঃসীম শক্তি তার নরম চেহারার অন্তরে লুকিয়ে ছিল।
আঁখি নির্লিপ্ত, অপলক চাহনিতে আছিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, ভিতরে এক অচেনা, ধ্বংসাত্মক অভিসন্ধি জাগ্রত। তার প্রাণপ্রিয় সখি কি সত্যিই বন্ধুত্বের সেই শাশ্বত বন্ধন ভেঙে দিয়েছে? হাসল আঁখি, এক অপ্রকৃতিস্থ হাসি অমানিশার অন্ধকারে আত্মঘাতী বিষাক্ত কাঁটা।
পলাতক কুয়াশার আবরণে আপতিত সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের অবয়ব ক্রমশ দৃশ্যমান হয়ে উঠল; অপার্থিব, ভূতগ্রস্ত এক পরিবেশ রচিত হলো চারিদিকে। দূর থেকে আগত ছায়াগুলি ছড়িয়ে পড়ল দিকবিদিক, কিছু ডান পাশে, কিছু বাম, সামনে ও পশ্চাতে, যেন অশুভ ছায়াময় উপস্থিতি আঁখি ও আছিয়াকে অবরোধ করবার মরণফাঁদ পেতেছে। আঁখি কৌতূহল ভুলে রুদ্ধশ্বাসে ঘাড় ঘুড়ালো ,চাহনিতে জাগ্রত হলো বিভীষিকাময় সাইকোপ্রবণ আচরণের ছায়া।
অবাক বিস্ময়ে, তৎক্ষণাৎ, রহস্যময় লোকগুলি অশরীরী সত্ত্বার মতোই মিলিয়ে গেল, আবর্তিত হল সেই পথেই, যেখান থেকে তারা এসেছিল। কুয়াশার রহস্যঘন চাদরে বিলীন হলো তাদের অস্তিত্ব, রেখে গেল ভৌতিক শূন্যতা ও শিরশিরে নীরবতা, যা ত্রাসের পরিধি স্পর্শ করল।
আছিয়ার নয়ন ভিজল জলে, আর আঁখি তার শীতল করুণায় আছিয়ার ডান হাত ত্যাগ করল। আছিয়ার চোখের কষ্টকর অশ্রু মুছে দিতে উদ্যত হলে আছিয়া, ঘৃণার বিষাদে পূর্ণ, মুখ ফিরিয়ে নিল প্রত্যাখ্যানের গরিমায়। আঁখি এক বিষণ্ন হাসিতে বিমল হয়ে উঠল; নিঃশব্দে মুছে দিল সে অস্ফুট অশ্রু, আর আছিয়ার গালের উপর নরম মমতা সঞ্চার করল, বাম হাতটি কঠোর দৃঢ়তায় ধরে বলল,
——— "তুই আমাকে জানিস নরম ও কোমল এক আঁখি হিসেবে, চিনিস এক অসহায়, দূর্বল প্রাণী হিসেবে, দেখিস বলদের মতো সরল ও অযত্নপূর্ণ, আর এক নিষ্ক্রিয় ছেচকা আঁখি হিসেবে।"
আঁখি হেসে উঠল, যেন অনবদ্য অভিসন্ধির ছায়া সেই হাসিতে স্পন্দিত,
——— "আমি চাই, তুই আমাকে এইরূপেই জানিস; অন্য ভয়ংকর, অনতিক্রম্য রূপ যেন তোর চোখে কখনো প্রকাশ না পায়!"
আছিয়ার হাতটি আঁখি মুক্ত করে দিল, আর কঠিন, সঙ্কল্পবদ্ধ স্বরে বলল,
——— "চলে যা!"
আছিয়া ঘৃণার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, জ্বলন্ত ক্রোধ ও অভিমানে কাঁদতে কাঁদতে দিগ্বিদিক দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল, কান্না আকাশের অন্তরালেও ধ্বনিত হলো।
আঁখির অধরে মৃদু এক রহস্যময় হাসির ছায়া ফুটে উঠল। পদক্ষেপ রাখল অন্যপথে, গৃহপানে নয়, বরং নিঃসঙ্গতার সুরে মোড়ানো অসীম শূন্যতায়। সে এলোমেলো পায়ের চাপে বহুক্ষণ ধরে অগ্রসর হলো, বিস্তীর্ণ এক পরিসরে পৌঁছুল, যেথায় চন্দ্রমল্লিকার ফুলগুচ্ছ রচিত অব্যক্ত মায়াবী প্রান্তর। দুই ধারের শূন্যতায় ফুলের অপূর্ব বিস্তার, আর বাষ্প-কুয়াশার আবেশে ঘনিয়ে আসা এক নির্জন বিকেলের রহস্য।
মলিন সাদা কলেজের এপ্রোনের বাঁধনে আচ্ছাদিত আঁখি স্বগতভাবে চিন্তা করল, তার অন্তরে যে ক্ষত নির্মিত হয়েছে, তা যদি র'ক্তরূপে প্রকাশিত হত, তবে কি এটা তার এই শুভ্র বস্ত্রকে র'ক্তের অমোঘ লালে আবৃত করত? আঁখি হাসল, অদ্ভুত হাসি! সে স্থির হয়ে বসল সেই ভেজা শীতল তৃণে, যেন প্রকৃতির কোলেই আশ্রয় নিলো।
কুয়াশায় ভেজা বায়ুতে তার শালের ভাঁজটুকু আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে নিল শরীরে। মাথা আবৃত করল আঁটো শাট ভাবে, কেবল দুই চক্ষু ছাড়া সমস্ত মুখ ঢেকে ফেলল। অথচ সেই চক্ষুদ্বয়ও বদ্ধ রহিল, দৃষ্টির অবসরে,অব্যক্তির অন্তর্দহন লুকিয়ে রইল সেই নিস্তব্ধ বিকেলের অসীম অন্তরালে।
কিছুক্ষণ পর আঁখির পাশেই নীরবে উপস্থিত হলো এক বলিষ্ঠ পুরুষ। মুখাবয়বে সদা বিরাজমান কঠোরতার অসীম রেখা, যেন অনুভূতির চেয়ে অধিকতর প্রাচীন কিছু। নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখেই বসে পড়ল সে, সমুদ্রের ঢেউ আর তীরের মাঝে অব্যক্ত দূরত্ব। মাথা হতে ধীরে হুডিটি সরায়ে অনুভব করল বায়ুর শীতল তেজ কেমনভাবে কানে আঘাত হানে। নাহ, এক ধরনের সুখানুভূতি যেন প্রবাহিত হলো, তবে মুহূর্তেই আবার হুডিটি তুলে নিল মাথায়। কনকনে ঠান্ডায় নির্বিকার বসে রইল সে, কোনো বাক্য বিনিময়ে প্রবৃত্ত না হয়ে, নিঃশব্দে সেই শূন্যতার সহচর হয়ে থাকল।
নীরবতায় প্রকৃতির বিশুদ্ধতা মিশে আছে, দুজনেই নিস্তব্ধ অথচ অদৃশ্য কথোপকথনের অনুচ্চারিত স্রোতে ভেসে চলল।
মুগ্ধ পকেট থেকে একখানা ক্ষুদ্র আ্যন্টিসেপটিক মলম বের করে আঁখির দিকে বাড়িয়ে দৃঢ় ও কঠিন কণ্ঠে বলল,
——— "গালে মলমটা লাগাবে! আগে জায়গাটা পরিষ্কার করো! বাড়ি যাও! শীত এখন প্রবল হয়ে উঠেছে। সংক্রমণ হতে পারে! আর হ্যাঁ, সন্ধ্যা নিকটেই; ঘনায়মান অন্ধকারের পূর্বেই ফিরে যেয়ো!"
আঁখি তেমনি চোখ বুজে বিষণ্ণস্বরে প্রতিউত্তর করল,
———— "ক্যান্সারের রোগীকে সংক্রমণের ভয় দেখান?? মনের গহীনে যে ক্ষত বিদ্ধ হয়েছে, তা কি এমন সামান্য ওষুধে সারবে? যার জীবনই অন্ধকারে নিমজ্জিত, তাকে সন্ধ্যার অন্ধকারের ভয় দেখানো নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ নয় কি?"
মুগ্ধ মলমটি তার সামনে রেখে বিরক্তি চাপা দিয়ে বলল,
——— "শোনো মেয়ে, অকারণ আজেবাজে কথা বলার অবকাশ আমার নেই!"
ঠিক তখনই ফোনটি বেজে উঠল। পকেট থেকে বের করে মুগ্ধ দেখল, রুদ্রর নাম্বার ভেসে উঠেছে। কত কাজ ফেলে রেখেছে! যখন শুনল আরাফ চলে যাচ্ছে, তখন সব কিছু ছেড়ে ভাইয়ের কাছে ছুটে এসেছিল, আর এখনো ফিরতে পারেনি। ফোন রিসিভ করে বলল,
——— "আমি এখন জরুরি কাজে ব্যস্ত! পরে আসছি!"
নিজের মনকে বোঝাল মুগ্ধ—ব্যক্তিগত জীবনে মাঝেমধ্যে নিয়ম ভেঙে সময় দেওয়া প্রয়োজন, নয়তো জীবনের স্বাদ বিবর্ণ, পানসুটে হয়ে পড়বে। একদিন সেই মনুষ্য শরীর, রক্ত-মাংসে গঠিত হলেও, যন্ত্রে পরিণত হবে। হঠাৎ আঁখির চোখ দুটো টলমল করে উঠল, সে বলল,
——— "আমি বড় ক্লান্ত!"
মুগ্ধ একবার তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
——— "বাড়ি যাও।"
আঁখি হাসল, বিষাদমাখা বিদ্রুপ হাসি, মনে মনে বলে উঠল,
——— "যে কাজটি করতে এসেছেন, কেন করেন না? এই মায়া, এই দরদ, সহ্য হয় না আর!"
মুগ্ধর মোবাইলে আরেকবার টুং করে শব্দ হলো, যেন এক ধ্বংসবার্তা অনুপ্রবেশ করল তার অস্তিত্বে। সে অনিচ্ছাসত্ত্বেও চোখ মেলে দেখল, আর মূহূর্তেই তার রক্ত যেন উন্মত্ত প্রবাহে উত্তাল হলো; ক্রোধের কাঁপন ছড়িয়ে পড়ল তার শিরা-উপশিরায়। জীবন মেসেজ করেছে,
———" প্রিয় স্যার! এ মহাসুযোগ! এখনই! এ স্থানে আর কেউই উপস্থিত নেই! যা করার, এখনই করে ফেলুন! আমি প্রহরা দিব; কেহ আসলে অবিলম্বে সংবাদ দিব!"
মুগ্ধর ইচ্ছে হলো, ঐ অভিশপ্ত যন্ত্রখণ্ডটিকে আছাড় মেরে টুকরো টুকরো করে ফেলতে! সে যে জীবনকে সুপরামর্শ দিয়েছিল, আছিয়ার সম্মুখে প্রকাশিত করুক হৃদয়ের গভীর মুগ্ধতা, অতঃপর জীবন সেই নির্দেশনা তুচ্ছ করে তার পিছুপিছু এখানে পর্যন্ত আসার সাহস করেছে! উপরন্তু এই অবোধ্য, অশোভন মেসেজ প্রেরণ করেছে! মুগ্ধর দৃষ্টি আঁখির ওপর স্থির হলো, এবং তার অন্তর থেকে গভীর শ্বাস বেরিয়ে এলো। সে আত্মমনে উচ্চারণ করল,
——— "পারি না! এই এক বিষম পরীক্ষায় আমি ব্যর্থ হই! হৃদয় প্রচণ্ড তীক্ষ্ণ বেদনায় বিদীর্ণ হয়।! প্রচণ্ড!"
মুগ্ধ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, দৃষ্টির অদৃশ্য শিকল আঁখির চোখে নিবদ্ধ হয়ে আছে। আঁখি তেমনি চোখ মুদে স্থির; চোখের কোণে জমে থাকা জলধারা ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ল, মুগ্ধর দৃষ্টি থেকে তা অধরা রইল না। সে বুড়ো আঙুলের আলতো স্পর্শে মুছে দিল সে বেদনাবাহী অশ্রু, আর অন্তর্লোকে বিদগ্ধস্বরে উচ্চারণ করল,
——— "এই চোখে তো অশ্রুর আধার থাকার কথা নয়! এ চোখ তো শুধুমাত্র আনন্দের রঙে উজ্জ্বল থাকার কথা ছিল, মেয়ে! তুমি কেন এমন এক দুঃসহ কাজ সম্পাদন করলে? উত্তর দাও! আমি যে প্রতীক্ষায় প্রতিটি মুহূর্ত পেরিয়ে যাচ্ছি; উত্তরের প্রত্যাশায় হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করছি! অথচ সে উত্তর আজও অধরা! তুমি আমার জীবনটাকে তছনছ করে দিলে, নির্দয় মেয়ে!"
আঁখি এক নিঃশব্দ হাসিতে মুখর হল, তার ক্ষীণস্বরে বলল,
——— "দুই বিন্দু চোখের জল মুছে দিয়ে মনে মনে এমন তীব্র কটু বাক্য প্রয়োগ করবার কোনো প্রয়োজন নেই!"
মুগ্ধ নির্বাক বসে রইল, নির্বাকতার অন্তরালে নিঃসীম শূন্যতায় ডুবে গেছে। এই উদ্ধত, দুর্ধর্ষ মেয়েটি যেন তাকে ধ্বংস করবার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত, তার প্রতিটি প্রহরে পরাজয়ের ছায়া বিস্তার করে। মুগ্ধ অপলক তাকিয়ে রইল আঁখির ভাসা ভাসা চোখের গভীরে, যা আধভাঙ্গা আবরণে আবদ্ধ। আঁখি এক পলকে চোখ খুলে মুগ্ধর দিকে তাকাল, শালের নিচে লুকিয়ে থাকা এক পলকের হাসি তার দৃষ্টির অগোচর রয়ে গেল।
তৎপরতায় আঁখি হাত বাড়িয়ে মলমটি তুলে নিল, এবং ধীরে ধীরে নিজেই উঠে দাঁড়াল। শীতল হাওয়ার প্রকোপ থেকে শাল আরও আঁকড়ে ধরল, আর নিঃশব্দ পদক্ষেপে বিদায় নিল। মুগ্ধ অবশস্থানে রইল, সেই পলকের বিদায় শব্দহীন প্রতিধ্বনি হয়ে বেজে উঠল।
পথচলতি আঁখি হঠাৎ পা থামিয়ে পিছু ফিরে, মুচকি হেসে, এক দুর্বোধ্য উচ্চারণ করল মনে মনে,
———" চিন্তার প্রয়োজন নেই; যে প্রাচীর আমি নিজ হাতে গড়েছি, ভাঙবও আমি নিজেই! সেদিন…… সেদিন আপনি দেখবেন এক বিকৃত, কুৎসিত আঁখিকে!"
আঁখি নীরব পদক্ষেপে দূরবর্তী অজানায় গুটিয়ে গেল। মুগ্ধ স্থবির হয়ে বসে রইল, ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। নিচু, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল,
——— "বোকা রমণী, তোমার তথাকথিত কুৎসিত চেহারার দর্শন আমি বহু পূর্বেই লাভ করেছি। আমার প্রতীক্ষা কেবল সেই মুহূর্তের, যখন তুমি খোলসমুক্ত হবে আমার সামনে। তবে কি তুমি আমার প্রকৃত রূপ প্রত্যক্ষ করেছো কখনও? আমি তো তোমার কল্পনার সীমার অনেক অতীত, অজ্ঞেয় এক সত্যে।"
আঁখি চলে যেতেই জীবন নীরব পায়ে এগিয়ে এল। ঠান্ডা, শিশিরভেজা ঘাসে বসে পড়ল মুগ্ধর সামনে, এক দৃষ্টে নিরীক্ষণ করতে লাগল তাকে। মুগ্ধ তবু তার দিকে দৃষ্টিপাত করল না; সম্মুখের শূন্যতায় স্থির হয়ে থাকল, যেন সেখানে জীবনের কোনো অস্তিত্বই নেই।
জীবন আজ একটু মুগ্ধের মনের গভীরে প্রবেশের প্রয়াসে তেমন বার্তা পাঠিয়েছিল,মনের সুর ছুঁয়ে দেখার কৌতূহলে। গভীর শ্বাস ফেলে জীবন বিদ্রুপ মেশানো কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
——— "আজ কী নতুন বাহানা শোনাবেন, মহাশয়?"
মুগ্ধ গভীর তপ্ত শ্বাস ছাড়ল, কণ্ঠস্বর কঠোর ও শুষ্ক,
——— "তোমাকে বলেছিলাম, আমার বোনের সঙ্গে গিয়ে কথা বলবে! আর তুমি এখানে এসেছো!"
জীবন গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রত্যুত্তর করল, কণ্ঠে তীক্ষ্ণ বিদ্রুপের সুর,
——— "হ্যাঁ, যাবই তো! আপনি যে আদেশ দিয়েছেন, তা উপেক্ষা করার দুঃসাহস দেখাব কী করে? তবে দেখতে চেয়েছিলাম, আপনি এখানে কী অনিষ্টে লিপ্ত!"
মুগ্ধ তার চোখে ধীর অথচ জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাল, যেন জীবনকে সম্পূর্ণ পাঠ করে নিতে চায়,
——— "হয়েছে দেখা?"
জীবন ঠোঁট বাঁকিয়ে, মৃদু হাসি গিলে, মুখের ভঙ্গি কঠোর করল,
———" হুম, দেখলামও! আর সেইসঙ্গে অনেক কিছু বুঝলামও!"
মুগ্ধ আর কিছু বলল না, নিঃশব্দে বসে রইল, তার চোখে অদ্ভুত কঠিন ধ্যান। জীবনও স্থির থাকল, যেন এক নিষ্প্রাণ ছায়া, অথচ তাদের মধ্যকার গাম্ভীর্যের আচ্ছাদনে লুকিয়ে থাকা রঙ্গরস অদৃশ্য ধ্বনিতে বেজে উঠল।
তাদের সম্পর্ক বড় অদ্ভুত, মুগ্ধের কঠোরতার মুখোশ শুধু বাইরে, অন্তর তার কোমল ও মমতায় পূর্ণ, বিশেষত যাঁদের সে হৃদয়ে স্থান দিয়েছে। সেখানে জীবনের অবস্থান পাথরের মতো দৃঢ়; একান্ত ছোট ভাইসুলভ।
আর জীবন, যদিও সে আপাতদৃষ্টিতে গাম্ভীর্যের প্রতিমূর্তি, কখনো কখনো মুগ্ধকে খেপানোর দুর্মর আনন্দে মেতে ওঠে। এ দুজনের সম্পর্ক চিরন্তন দ্বন্দ্বময় খেলা, যেখানে রাগ আর হাসির মিশ্রণে গাম্ভীর্যের মুখোশে লুকিয়ে থাকা স্নেহময় বন্ধন প্রকাশিত হয়।
___________________
বিকেল বিদায় নিয়ে সন্ধ্যার আবির্ভাবের প্রতীক্ষায় থাকলেও অন্ধকারের ছায়া অনেক আগেই পৃথিবীর কোলে বিস্তার করেছে। শীতের আগমনী সুর বাজতেই ক্ষুদ্র দিনটি মায়াবী ইঙ্গিতে নিমেষে বিলীন হয়ে যায়, এক অলস, শীতল ছন্দে। আফিয়া বেগম, মোটা চাদরে আবৃত, নিজস্ব প্রবল প্রত্যয়ে চিৎকার করতে করতে গৃহকর্মে নিমগ্ন।
অতীতের কালো স্মৃতি যেন সময়ের অনলেই পুড়ে কুহকী ছায়া হয়ে ঘোরে। রিতু খালার কণ্ঠস্বর আজ নির্বাক পাথরের প্রস্তর হয়ে গেছে, যেখানে কুদ্দুস আলীর নির্মম ছু'রির আঘাত জীবনের দগদগে ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়েছিল। ভাগ্য প্রসন্ন ছিল যে সেদিন মুগ্ধ, রুদ্র ঠিক সময়ে উপস্থিত হয়ে জীবনের অন্তিম নিশ্বাসটি ধরে রাখতে পেরেছিল।
তবে অপারেশনের পর, রিতু খালা আজ জীবনের বুকে বেঁচে থেকেও যেন এক কণ্ঠরুদ্ধ ভ্রান্ত উপস্থিতি। শব্দ বের করা মানে তার জন্য দুর্ভেদ্য কষ্ট, নিঃশব্দ যন্ত্রণার আকাশে আটকে থাকা বোবা কান্না।
রিতু খালা ব্যতীত শিকদার বাড়ির চৌকস পরিসরে রন্ধনকর্মে অন্য কোনো কর্মীর হাতে স্পর্শ পড়ার প্রয়াসেও যেন অলঙ্ঘ্য নিষেধাজ্ঞা চাপায় আফিয়া বেগম। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন এ গৃহিণী নিজেই সেই কর্তৃত্ব রক্ষায় সদা সচেতন। তরকারি ও সবজি কাটা বিষয়টি, তার নিকট বিশেষজ্ঞ শিল্পের মতোই সূক্ষ্ম, আর রিতু খালার দক্ষতা এ ক্ষেত্রে ছিল অতুলনীয়; নিপুণতার এমন শৈল্পিক প্রয়োগ যেন কোনো রন্ধনকর্মীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে লালিত হয় না।
কিন্তু বর্তমানের নির্মম বাস্তবতায় রিতু খালার অনুপস্থিতিতে কাজের ভার যেন পাহাড়প্রমাণ হয়ে উঠেছে। তীক্ষ্ণ সবজির ধারা কাটার সৌকর্য তার নিজের হাতেই এখন ছিন্ন হতে হয়, কেননা অন্য কারোর আনাড়ি স্পর্শ তাকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। তার নিখুঁত ও প্রখর রন্ধনকৌশলের তুলনা যে কল্পনাতীত, অপর কারোর পরিশ্রমও তার চোখে তুচ্ছ বলেই প্রতীয়মান।
রোকেয়া বেগমকে প্রেরণ করা হয়েছে বৃদ্ধ শ্বশুরের জন্য হালকা নাস্তা পরিবেশনের নিমিত্তে। আর কানিজ বেগম? এখন অধিক গৃহকর্মে নিজেকে বিশেষত সম্পৃক্ত করেন না, কারণ আফিয়া বেগম নিজেই তাকে নিষ্ক্রিয় রেখে দেন। কানিজ বেগমের সময় কাটে ঘরে শুয়ে-বসে, শূন্যতা ভরা অন্তরের অন্তরালে কাঁথা সেলাই করার মধ্যে। স্বামীর কারাবরণের পর তার জীবনের সব রঙ যেন বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল, বেদনাবিধুর ভারে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি।
তবে এখন কালের প্রভাব ও বাস্তবতার নিষ্ঠুর শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। সন্তানের প্রতি অবিচল মায়ের শক্ত থাকতে হয়, নাঈমের জন্য। সেই ছেলেকে তো কোনোদিন স্বাভাবিক জীবন উপহার দিতে পারেননি, পিতামাতার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দগদগে ক্ষত এখনো অন্তর ঝলসে দেয়। তবুও নাঈমের হৃদয়ে কোনো অভিযোগ নেই, কোনো ব্যথার ছায়া ছুঁতে দেয় না সে।
তবে কানিজ বেগমও এই সত্য অস্বীকার করতে পারবেন না যে, একদিন তিনিও স্বামীর পাপের কাব্যতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। তারও সম্পত্তির মোহ ছিল, গোলাম বানানোর প্রতারণাপূর্ণ বাসনায় জড়িত ছিলেন। কিন্তু এখন স্বামী নেই, স্বপ্নের দহনেই সেই মোহ ভস্মীভূত। অতীতের শূন্য স্মৃতির ভারে ডুবে থেকে আর কী লাভ? তাই নিজের মতো নিস্তব্ধ সময়ের ভেলায় ভেসে চলেন, জীবনের হ্রদে একাকীত্বের প্রতিধ্বনি শুনে।
বিদ্ধস্ত, ক্লান্ত পায়ের ভারে আঁখি ধীরে ধীরে বাড়ির চৌকাঠ পেরোল। রান্নাঘরের তপ্ত বায়ুর মধ্যে আফিয়া বেগম তখনও উপস্থিত, সদ্য রান্না বসিয়ে আবার ফিরে এসে খেয়াল করছিলেন মেয়েটির ফেরার অপেক্ষায়। আঁখির অবয়ব দৃষ্টিগোচর হতেই ক্রোধের অগ্নিবাণ যেন ঝলসে উঠল তার দৃষ্টিতে।
মেয়েটি কি অসীম সাহস অর্জন করেছে, এমন বেপরোয়াভাবে দীর্ঘক্ষণ বাইরে কাটানোর? যে সমাজের কঠিন নিয়মাবলী আর শৃঙ্খল বুকে ধারণ করে তারা বসবাস করেন, সেখানে আঁখির এমন দুঃসাহসিকতা মেনে নেওয়া যে দুরূহ। কলেজের পরীক্ষা শেষ হয়েছে সেই দুপুরের প্রখর তাপমাত্রায়, আর মেয়ে ফিরে এসেছে সন্ধ্যার আচ্ছাদিত নীরবতার আবরণে।
আফিয়া বেগমের রাগে উত্তাল হৃদয় ক্রোধের প্রকট ভাষায় ফেটে পড়ল। তার চিৎকার চারপাশের নিস্তব্ধতা ভেদ করে চঞ্চল বাতাসকে প্রতিধ্বনিত করে, মেয়ে আর তার স্বাধীনতার সীমা মেপে নেওয়ার বিদ্রুপে বিদ্ধ করে তুলল সেই মুহূর্তটিকে।
আজগর আলী তখন শোবার ঘরে নরম তুলতুলে খাটের ওপর গা এলিয়ে দিয়ে আরামদায়ক কম্বলের উষ্ণ আবরণে নিজেকে মুড়ে ছিলেন। শরীরের অলসতা আর শীতের মৃদু পরশে তন্দ্রালু অবস্থায় শুয়ে রয়েছেন, যদিও শীঘ্রই তাকে অফিসের কর্মব্যস্ততার জগতে প্রবেশ করতে হবে। ব্যাবসার যাবতীয় দায়ভার তার কাঁধে এসে ন্যস্ত হওয়ায়, এ বিশ্রামের মুহূর্তগুলো তার কাছে স্বর্ণময় বলেই মনে হয়।
গ্রামবাসীর চোখে কুদ্দুস আলীর খু'নি হিসেবে প্রমাণিত হওয়ার পরও আজগর আলীর দাপট যেন একরকম অটুট থেকে গেছে। গ্রামবাসীরা হয়তো পুঞ্জিভূত নিন্দার ক্ষোভ লুকিয়ে রেখেছে, তবে তার সামনাসামনি বলার মতো সাহস আর কারো নেই। এত দিনের অভ্যস্ত প্রভাব কি সহজেই ম্লান হয়?
ঘরের দরজা খোলা থাকায় ভাবির ক্রুদ্ধ চিৎকার হঠাৎ করেই ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে ছড়িয়ে পড়ল। আজগর আলী খানিক মুচকি হাসলেন, এই রাগের উচ্চারণও তার কাছে সুমধুর সঙ্গীত হয়ে ধরা দিল। এমন সুর যে মাইকের দানবীয় আওয়াজকেও ম্লান করে দিতে পারে! এই চিৎকারের গাঢ় প্রতিধ্বনিত ঝংকারে, তার মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা অবাধ্য অনুভূতিগুলো যেন নবজাগরণের শিহরণে মাথা তুলে বসে। কোকিলের গানে মুগ্ধ হলে যেমন হৃদয় উদ্বেলিত হয়, তেমনি তার মন স্নিগ্ধ অস্থিরতায় আলোড়িত হয়।
আফিয়া বেগম ক্রোধে উত্তাল কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন,
——— “তোর পা কি আজকাল এতটাই দীর্ঘতর হয়ে উঠল যে পথের মাপ ভুলে যাস? কলেজের নামে অজানা কোন অবকাশে উধাও হোস? কেন প্রতিনিয়ত এত দেরি হয় তোর? একবারে পা কে'টে হাতে ধরিয়ে দেব, তুই যেন মনে রাখিস কোথায় চলার সীমা! কলেজের দ্বার চিরতরে বন্ধ করব তোর জন্য! আমি তো বারবার বলেছিলাম, মেয়েদের অতিরিক্ত শিক্ষার ভার না দিতে, নইলে তারা আর মানুষ থাকবে না; উন্মত্ত কোনো অন্যরূপ ধারণ করবে!”
শেষের কথাগুলো এত উচ্চকণ্ঠে আর তীব্র অভিমানে ছুঁড়ে দিলেন, যেন প্রতিধ্বনি রোকেয়া বেগমের কর্ণপটকে আঘাত করুক। যদিও শ্বশুরের ঘর দূরে থাকায় সেই তীব্র শব্দ সেখানে পৌঁছাতে পারল না, বিক্ষুব্ধ বাতাসে বিলীন হয়ে গেল।
আঁখির গালে র'ক্তের ক্ষীণ রেখা দেখে আফিয়া বেগমের ভ্রু তৎক্ষণাৎ সংক্ষিপ্ত হয়ে কুঞ্চিত হলো, চোখে ফুটে উঠল বিরক্তি আর অসন্তোষ। শীতের কাঁপুনিতে জুবুথুবু মেয়ে, যার চোখের কোণে এখনো অশ্রুর টলমল কণিকা। আফিয়া বেগম মুখ বিকৃত করে বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন,
——— “কোথায় গিয়ে মুখ আর গাল এভাবে চিরে এলি? সারাদিন কি এ রকম তুচ্ছ ব্যাপারগুলো দেখতে হবে আমাকে? আমার তো আর অবসর নেই এই অকাজের ভার বহন করতে! যে স্থান থেকে এই দুরবস্থা এনে নিয়ে এসেছিস, ফিরে যা সেইখানে! আমার সামনে থেকে দূর হ!”
এ কথা বলেই তীব্র উষ্ণ রাগ নিয়ে আবার রান্নাঘরের দিকে গমন করলেন। তরকারি নাড়তে হবে। রান্নাঘরে প্রবেশ করে ঢাকনার বাঁধন খুলতেই তপ্ত ধোঁয়ার মোহনীয় গন্ধ নাসাপথে প্রবাহিত হলো। খুন্তি দিয়ে তরকারি অনবরত নাড়তে নাড়তে হঠাৎ কে যেন অদৃশ্য মায়াজালে পেছন থেকে আকস্মিক জাপটে ধরল তাকে.! আঁখি আকস্মিক মায়ায় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল আফিয়া বেগমকে, সমস্ত কষ্ট আর শূন্যতা তার ছোট্ট বুকের গভীর থেকে ফুঁপিয়ে উঠে বেরিয়ে আসতে চায়। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে আঁখি কান্নায় ভেঙে পড়ল, চোখের জল ঝরছে অবিরাম। আফিয়া বেগম তৎক্ষণাৎ ঝাঁঝালো কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন,
——— “তোর কোনো কাজ নেই, হ্যাঁ? এই নোং'রা, অপরিশুদ্ধ হাত দিয়ে আমায় স্পর্শ করার এতটুকু দুঃসাহস কোথায় পেলি? ছেড়ে দে আমায়, দূরে যা!”
কিন্তু আঁখি কোনোভাবেই ছাড়ল না, বরং আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরল, ভাঙাচোরা আত্মা তার আফিয়া বেগমের উষ্ণতায় আশ্রয় খুঁজে পেতে চায়। পেট চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আঁখি অসহায় স্বরে বলে উঠল,
——— “ আ-আমি আবারো নিঃসঙ্গ হয়ে গেলাম, বড় মা! কেন.... আমার সঙ্গেই এমন হয়? কেন বলো, কেন?”
আঁখির কথাগুলো মর্মান্তিক যন্ত্রণায় ভেসে আসে, তার গালের র'ক্তমাখা ক্ষত আফিয়া বেগমের মোটা চাদরে মিশে গিয়ে আরও র'ক্তা'ক্ত হয়। অন্তর্গত যন্ত্রণা সহ্য করা আর সম্ভব নয়! আফিয়া বেগমের দুচোখে তখন এক ফোঁটা জল চিকচিক করে ওঠে, তবুও রাগকে অটুট রাখার মরিয়া প্রচেষ্টায় খুন্তি দিয়ে তরকারি নাড়ছেন। ধরা গলায় রুক্ষ ধ্বনি তুলে বললেন,
——— “আজ রাতের খাবার তোর জন্য বন্ধ! এইসব বাহির থেকে এসে কৃত্রিম কান্নাকাটি করিস, হ্যাঁ? ভেবেছিস, এত সহজে অভিনয়ে ভুলিয়ে দেবে আমায়? দেরি করে এসে একটু জড়িয়ে কান্না কাঁদলেই সব মাফ হয়ে যাবে? তা কখনোই হবে না, বুঝলি!”
_____YouTube
রন্ধনশালার প্রবেশদ্বারে বলিষ্ঠ এক পুরুষ প্রতিমার মতো দাঁড়িয়ে; ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপমিশ্রিত হাসির রেখা জড়িত। কিছুক্ষণ নিরব স্থিরতায় দাঁড়িয়ে থেকে, সে ধীর পদক্ষেপে সরে গেল। কুয়াশায় আচ্ছাদিত প্রান্তরের বাগানবাড়ির দিকে পা বাড়িয়ে অন্ধকারের গভীরে নিজেকে বিলীন করল। সেখানে দাঁড়িয়ে শীতল রাতের শিহরণে, সে ধীর হাতে একখানা বিড়ি জ্বালাল। শীতের নির্মম শিহরণ আর বিবর্ণ আকাশের চাদরে, ধোঁয়ার পাক ধীরে ধীরে আকাশের বুকে মিশে যেতে লাগল। কাঁপুনি ছড়িয়ে দেওয়া শীতলতায়, সে দোলনার দড়িতে ধীরে ধীরে বসে পড়ল। বিড়ির ধোঁয়া একবার গিলে নিয়ে, মুখ হা করে তামাকের ধোঁয়া ছাড়ল, সেই ধোঁয়ার ভাঁজে লুকিয়ে রেখেছে তার অপার বেদনাময় সত্য। কনকনে ঠান্ডার মধ্যে সে বিড়ির কষে টান দিয়ে, মুখের ধোঁয়ার সর্পিল রেখাগুলিকে মুক্তি দিতে দিতে যেন অমোঘ এক সত্যের রূপরেখা আঁকছে শীতল অন্ধকারে।
অন্ধকারের নির্জনতায়, মৃদু হাসির ধ্বনিতে শান্ত বলল,
——— “মানুষ জীবনের অবলম্বনে আহার গ্রহণ করে, আর এই প্রাসাদপ্রমায়ণ বাড়িতে জীবন ধারণের জন্য অবিরাম প্রহসন আর কপটতার অভিনয় করতে হয়।”


Post a Comment

0 Comments

Close Menu