লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা

কপি করা নিষিদ্ধ। এই গল্প অতিরিক্ত রোমান্টিক নয়। ধোঁয়াশা ও রহস্যময়তায় ভরা গল্পটি শুধু ধৈর্যশীল এবং রহস্য সমাধানে আগ্রহী পাঠকদের জন্য।


ভায়োলেন্স যুক্ত পর্ব.! প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত

*
*
মুগ্ধ কেবিনের দুয়ারে প্রবেশ করতেই নৈঃশব্দ্যের মধ্যে এক বিষাদময় শীতলতা তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে এলো। এখানে তো থাকার কথা ছিল আফিয়া বেগমের। কণ্ঠে তীক্ষ্ণ উত্তেজনা আর চাপা রোষের ঢেউ নিয়ে, দরজার পাশে নির্জীব দণ্ডায়মান কনস্টেবলকে কঠোর স্বরে জিজ্ঞাসা করল,
——— "আফিয়া বেগম কোথায়?"
কনস্টেবলের দৃষ্টি নিষ্ফল প্রতিশ্রুতির মতো অসহায়। তার জবাবের পূর্বেই চিকিৎসকের চটুল উপস্থিতি মুগ্ধের ইন্দ্রিয় সজাগ করল। সিআইডির কর্তৃত্বে খানিক নতজানু, তবু বিব্রত ভঙ্গিমায় চিকিৎসক মৃদু কণ্ঠে জানাল,
——— "তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়েছে।"
চিকিৎসকের বাক্য যেন ঘন কালো মেঘের আড়ালে এক তীব্র বজ্রপাত। মুগ্ধের ঠোঁটে গভীর এক দীর্ঘশ্বাসের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হলো, অনমনীয় মানসিক ভার খানিকটা প্রশমিত হলো। কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে ফের জানতে চাইল,
——— "পেশেন্টের এখন কি অবস্থা? জ্ঞান ফিরবে কবে? সুস্থ হতে কতদিন লাগবে?"
ডাক্তার গুরুগম্ভীর জবাবে বললেন,
——— "পেশেন্টের অবস্থা অত্যন্ত গুরুতর। মাথায় তীব্র আ'ঘা'তের কারণে সেরিব্রাল হেমারেজ হয়েছে, অর্থাৎ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। তার মাথার ডানপাশের টেম্পোরাল লোব গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা জ্ঞান ফিরতে দেরি করাতে পারে। এছাড়া শরীরের একাধিক জায়গায় ফ্র্যাকচার হয়েছে, ডানপায়ের হাড় ভেঙে গেছে, পাঁজরের দুটি হাড় ভেঙে গিয়ে ফুসফুসের পাশে আঘাত করেছে। এই মুহূর্তে আমরা তাকে লাইফ সাপোর্টে রেখেছি, কারণ তার শ্বাসপ্রশ্বাসও স্থিতিশীল নয়। "
একটু থেমে শ্বাস নিয়ে ফের বললেন,
——— "জ্ঞান ফিরতে ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা লাগতে পারে, তবে সেটা নির্ভর করছে মস্তিষ্কের র'ক্তক্ষরণ কত দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা যায় তার ওপর। সম্পূর্ণ সুস্থ হতে কয়েক মাস সময় লাগবে, তাও যদি সে গুরুতর কোনো স্থায়ী ক্ষতির শিকার না হয়। আমরা ক্র্যানিয়াল সিটি স্ক্যান ও অন্যান্য টেস্ট করছি, রিপোর্ট অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এখন বলতে গেলে, এটি জীবন-মৃত্যুর সীমানায় ঝুলে থাকার মতো অবস্থা।"
চিকিৎসকের বাক্যের প্রতিটি শব্দ যেন এক বিষাক্ত তীরের মতো মুগ্ধের মস্তিষ্কে বিঁধতে থাকে। এই সংকটাপন্ন মুহূর্তেও তার মনের গহীনে অন্য এক স্তর সক্রিয়, আফিয়া বেগম শুধু এক রোগী নয়, বরং এক ভ'য়ং'কর খু'নে'র নেপথ্যের রহস্যের পৃষ্ঠপোষক। ট্রাক আর বাসের সংঘর্ষে এ দেহভঙ্গ হোক, কিংবা কোনো বৃহৎ ষড়যন্ত্রের অঙ্গ, সত্যের সম্মুখীন হতে হবে। এই যাত্রায় কেবল জীবন-মৃ'ত্যু নয়, বরং ন্যায়ের শাণিত সত্যও তীরে গিয়ে মিলবে।
এমন এক নারকীয় অপরাধী, যার হাতে র'ক্তের তাজা চিহ্ন এখনো মুছে যায়নি, যার কৃতকর্মের অদৃশ্য প্রতিধ্বনি এখনো নৈঃশব্দ্যের বুক চিরে হাহাকার তুলছে, তাকে এত সহজে মৃত্যুর রহস্যময় আঁধারে বিলীন হতে দেওয়া যায় না। অপরাধের কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত মুগ্ধের অন্তর আত্মসমর্পণ করবে না।
নিজের প্রগলভ স্নায়ুকে সংবরণ করে মুগ্ধ এক গভীর নিশ্বাস নিল। কণ্ঠে অদ্ভুত ভারী দৃঢ়তা ফুটে উঠল, যা কর্তৃত্ব আর প্রতিজ্ঞার সুনিপুণ সংমিশ্রণ। দৃষ্টির প্রখর আলোয় চিকিৎসকের মুখটি পরীক্ষা করল সে, তারপর একেবারে সংক্ষেপে বলল,
——— "হুঁ, চলুন।"
তবে পদক্ষেপে শৃঙ্খলা আনার আগে তার দৃষ্টি হঠাৎ বিদ্ধ হলো দরজার পাশে অবিচল দাঁড়িয়ে থাকা কনস্টেবলের দিকে। চোখের শীতল স্ফুলিঙ্গে কনস্টেবলের নিঃসাড় উপস্থিতি জ্বলন্ত কাঠ হয়ে ছাই হতে লাগল। তার কণ্ঠে শীতল অথচ ভীষণ ধ্বনিত বজ্রনিনাদ প্রতিধ্বনিত হলো,
——— "আপনি এখানে দাঁড়িয়ে কী করছেন?? যখন আমি এই কেবিনে প্রবেশ করছিলাম, তখন কেন আপনার মুখ থেকে কোনো শব্দ উচ্চারিত হয়নি? কীসের দাসত্বে আপনাকে নিয়োজিত করা হয়েছে? এখানে কার পাহারা দিচ্ছেন? বাতাসের? নাকি আপনি এখানে মশাদের প্রহরী হয়ে সময় কাটাচ্ছেন?"
কনস্টেবল একটানা নিঃশ্বাস ফেলার সাধ্য হারিয়ে, শূন্যদৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল। মুগ্ধর প্রতিটি শব্দ অগ্নিমেখা শলাকার মতো তার আত্মমর্যাদার গভীরে বিদ্ধ হচ্ছিল। কী বলবে সে? কীভাবে ব্যাখ্যা করবে তার সীমাহীন ব্যর্থতা? ঘুমের ক্লান্তি, কাজের চাপ, নিস্তরঙ্গ পরিবেশের সুযোগে যে চোখ একটু বুঁজেছিল, তা তো কোনো আত্মপক্ষ সমর্থনের উপযুক্ত কারণ হতে পারে না। তার বুকের ভেতর জড়ো হওয়া অপরাধবোধের শ্বাস নিজের ওজনেই গলা চেপে ধরল। আইসিইউয়ের সামনে অন্য একজন পাহারায় রয়েছে, এই অজুহাত কি তার দায়িত্বচ্যুতির পাপ ধুয়ে ফেলতে সক্ষম?
সে মাথা নিচু করে, কণ্ঠস্বরের কম্পন ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে বলল,
——— "স্যার... স্যরি! ভুল হয়ে গেছে।"
মুগ্ধর চোখে তীব্র দাহ জ্বলে উঠল। তার দৃষ্টির শীতল কঠোরতা কনস্টেবলের কঙ্কালসম আত্মাকে ছিন্নভিন্ন করে দিল। সেই দৃষ্টি বলছিল, এই অজুহাত, এই সরল স্বীকারোক্তি, তার ক্রো'ধকে প্রশমিত করতে পারবে না। কণ্ঠে অগ্নিসংবরণহীন তিরস্কারের বজ্রনিনাদ ঝরে পড়ল,
——— "সরি? সরি মাই ফুট! আপনি কী ভাবছেন, একটি 'সরি' বললেই আপনার দায়বদ্ধতার সমস্ত পাপ মুক্তি পাবে? আপনাকে একজন অপরাধীর দেখভালের মতো গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আর আপনি এখানে দাঁড়িয়ে কী করছেন? এক নীরব মূর্তি, না ঘুমন্ত প্রহরী? দায়িত্ববোধের সংজ্ঞা কি আপনার জ্ঞানের গণ্ডিতে কখনো প্রবেশ করেনি? আপনি কি জানেন, যদি সেই অপরাধী এখান থেকে পালিয়ে যায় কিংবা কেও ক্ষতি করে ফেলে, সেটাই আপনার কর্মজীবনের শেষ অধ্যায়ের সূচনা করবে? কিংবা হয়তো এই অলসতার দায়ে আপনার জীবনই চূড়ান্ত কলঙ্কিত হবে।"
মুগ্ধ থামল না। তার কণ্ঠের প্রতিটি শব্দ ধ্বংসের চাবুকের মতো আঘাত হানল,
——— "ঘুমিয়েছেন? ক্লান্ত? এই দায়িত্বে আপনাকে নিযুক্ত করার আগে কেউ কি আপনার আরামের সনদ নিয়েছিল? নাকি আপনাকে একটি খেলনার পাহারাদার ভেবে এখানে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে? শুনে রাখুন, আমি নিজে এই দায়িত্বহীনতার তথ্য উপরের মহলে পাঠাব। আপনার নামে রিপোর্ট তৈরি হবে। প্রস্তুত থাকুন, কারণ এর ফলাফল আপনাকে বাকি জীবনের জন্য স্মরণ করিয়ে দেবে যে দায়িত্ব কখনোই অবহেলার জায়গা নয়।"
কনস্টেবল স্তব্ধ। তার বুকের গভীরে অদৃশ্য ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। ক্রোধ, অপমান, এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের ইচ্ছা, সব একসঙ্গে জট পাকিয়ে ওঠে। সে তো মানুষ, র'ক্তমাংসের তৈরি; ক্লান্তি কি তাকে স্পর্শ করবে না? আর এই নির্দয় সিআইডি অফিসার, যার কণ্ঠে শীতল বরফ আর জ্বলন্ত অগ্নির অদ্ভুত সংমিশ্রণ, তিনি কি একটিবারও ভেবে দেখলেন না যে, তার চোখের নিচের গাঢ় কালি এবং ক্লান্ত দৃষ্টি কী গল্প বলে? তার মনে অভিমান জমল, অথচ সে কিছু বলতে পারল না। নীরবেই ভাবল,
——— "হুঁহহ, মহাশয় হয়তো ভেবে নিয়েছেন আমি অলস। কিন্তু ওমন সংকটাপন্ন রোগী কখনোই তো কেবিনে থাকে না! এ তথ্য কি তিনি জানেন না? নাকি হাসপাতালে উনাকে ফেলে রেখে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ার সময় এসব ভাবার প্রয়োজন হয়নি? এখন রাতে এসে আমাকেই দোষারোপ করছেন। হুহ!"
তবু মুখ ফুটে কিছুই উচ্চারণ করল না সে। তবে মনে মনে এক তীব্র প্রতিবাদ জমিয়ে রাখল, যেন একদিন সুযোগ পেলে তা চরম শ্লেষে ফিরিয়ে দেবে। অথচ মুগ্ধ, তার চিন্তার সীমার বাইরে, নিজের নির্দেশনায় অবিচল। এক পা এগিয়ে যেতে যেতে পিছন ফিরে চমৎকার ঠান্ডা কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
——— "বকা জমিয়ে রাখুন। উপরের মহল থেকে আপনার নামের সিদ্ধান্ত এলে তখন কাজে লাগবে।"
কনস্টেবলের বুকের ভেতর বজ্রপাত হলো। অবাক বিস্ময়ে সে মুগ্ধের দিকে তাকাল। এই ব্যক্তি কি তার মনের কথাও শুনতে পান? তার অপ্রকাশিত অভিমানও কি তার কানে পৌঁছে যায়? নাকি এই কঠোর মানুষটি দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে তার অন্তর্নিহিত প্রতিরোধের আগুনও নিভিয়ে দিতে সক্ষম?
স্তম্ভিত কনস্টেবল আরেকবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মুগ্ধ ইতিমধ্যেই চলে গেছে, কিন্তু তার বলা বাক্যগুলো জায়গায় শূন্যতা রেখে গেল, যার মধ্যে অপমান, কর্তৃত্ব, এবং অদ্ভুত এক সতর্কবার্তা ঝুলে রয়েছে। সে ভাবল,
——— "আচ্ছা, এই লোক কি মানুষ, না অন্য কিছু? এতটাই তীক্ষ্ণ যে কেবল দৃষ্টিতে একজনের মনের গভীরতাও স্পষ্ট দেখে নিতে পারে?"
মুগ্ধ ধীরপদে আইসিইউ এর দিকে এগিয়ে যায়, কিছু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য! যেতেই নজরে পরে দৃশ্যপটের অন্তর্নিহিত কাব্যিক অথচ করুণ বাস্তবতার শিরশিরে স্পর্শে। হাসপাতালের তুষারশীতল করিডোরে অন্ধকার ও আলো সূক্ষ্ম নৃত্য করছে, যেখানে প্রত্যেকটি নিঃশ্বাস একটি প্রশ্নের নীরব প্রেক্ষাপট রচনা করছে। দূর প্রান্তে রেলিঙের পাশে, আকাশপানে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে শান্ত। তার চোখে প্রজ্জ্বলিত রক্তাভ দীপ্তি, চূর্ণ-বিচূর্ণ নক্ষত্রের ক্রোধমিশ্রিত আহ্বান, অথচ মুখাবয়বে অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য। সেই নৈঃশব্দ্য প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বিস্ময়ের ভাষায়, বোধগম্য নয়, অথচ অনুভবযোগ্য।
কিছুটা দূরে নাঈম, ধ্বস্তস্তুপের মতো গাল বেয়ে অশ্রুর লালাভ রেখাগুলো এখনো তাজা। মাথা নিচু, যেন সমগ্র পৃথিবীর ভার সে একাই বহন করছে। তার সামনের বেঞ্চে নিঃশব্দ প্রতিমার মতো বসে রয়েছে কানিজ বেগম, রুবিনা বেগম আর হাওয়া। তাদের চোখের কোণে জমাট বাঁধা জল, ঠোঁটের কোণে স্তব্ধতার ছাপ, আর বুকের গভীরে অনন্ত বেদনার সঙ্গীত। রুবিনা বেগম আর হাওয়া সন্ধ্যায় এসেছে ! প্রথমে হাওয়ার বাবা রাজি হয় নি। তবে বউ আর মেয়ের জোরাজোরিতে বাধ্য হয়ে রেখে গিয়েছেন। তবে কঠোর ভাবে জানিয়েছেন সকালেই নিয়ে যাবে ফের! হাওয়ার উপস্থিতি ক্ষয়িষ্ণু শিখা, নাঈমের অবস্থা দেখে রক্তপলাশে রঞ্জিত ভালোবাসার স্মৃতি বুকে নিয়ে বসে রয়েছে। তার চোখের পাতায় লেখা রয়েছে অকথিত ক্রন্দনের মহাকাব্য।
এদিকে, করিডোরের পাশে টুলে বসে থাকা দ্বিতীয় কনস্টেবল নিস্পৃহ প্রহরীর মতো পাহারা দিচ্ছে। তার অবস্থান পাণ্ডুলিপি, যেখানে মানবতা ও আইন পরস্পর দ্বন্দ্বে লিপ্ত।
তখন সকালেই আজগর আলী, গাড়িতে বসে সোজা অনিবার্য দায়িত্বের বোঝা নিয়ে সৈয়দপুরের আকাশপথ ধরে ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করেছেন। তার ব্যবসার জরুরি প্রয়োজনে, জীবনের এক বহুমুখী দাবির কাছে পরিবারকে একপ্রকার ঋণাত্মক রেখে, গিয়েছেন সপ্তাখানেকের জন্য! । বাড়িতে আলোর অস্তিত্ব জ্বরের ক্লান্তিহীন বাষ্পে দগ্ধ, তখন সেই চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো তাকে একপ্রকার অসহায়ভাবে ছেড়ে দিয়েছে। আলো তার বড় আম্মু যাকে একদিন মমতার মূর্ত প্রতীক ভেবেছিল, সে-ই র'ক্তা'ক্ত অপরাধের অন্ধকারে লিপ্ত এক খু'নি। এই অমোঘ সত্য তাকে অন্তর থেকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। ভয়ের তাড়নায় শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় জ্বরের অগ্নিসঞ্চার করেছে।
রোকেয়া বেগম মমতার অমলচ্ছায়ায় আলোকে বরাবর আগলে রেখেছেন, একারণেই হাসপাতালের সেই দরজায় পা রাখতে পারেননি। মাতৃত্বের অনাবিষ্কৃত গভীর বেদনা তাকে আটকে রেখেছে ঘরে। কিন্তু কানিজ বেগম, পরিবারের সেই বিতর্কিত নারী, তিনি সমস্ত বাধার স্রোত উপেক্ষা করে একপ্রকার আগুনের শিখার মতো ছুটে এসেছেন।
তবু এই আসা কি নিস্পাপ? শান্ত, যার মনের গহীনে কানিজ বেগমের বলা প্রতিটি অবমাননাকর কথা এখনো সজীব। এই নারী আজ তার মায়ের চরিত্রের উপর এমন বি'ষা'ক্ত প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, যা শান্তকে অবর্ণনীয় ক্ষতের মাঝে নিক্ষেপ করেছিল। তবে কি এক অনিবার্য বিধান এই যে কানিজ বেগম সেই চৌকাঠ অতিক্রম করলেন, যেখানে তার প্রভাব শান্তর আত্মার শান্তিকে ক্ষতবিক্ষত করে?
তারপরও কানিজ বেগম মা তো। এই একটি সম্পর্ক সমস্ত ঘৃণার দেয়াল ভেঙে দেয়। যতই শান্তের মনে ঘৃণার আগুন জ্বলুক, মা নামের এই অবিনাশী আত্মার কাছে সবকিছুই পরাভূত।
নাঈম, তার বড় মায়ের মাতৃত্বের এক মহাজাগতিক প্রকাশ, সারাদিন হাসপাতালে কাটিয়ে দিয়েছে বড় মা'র জন্য। একজন খু'নির জন্য। এই অদ্ভুত মায়া, এই মানবিক সম্পর্কের অতল গহ্বর, তাকে কীভাবে রাতেও হাসপাতালের মেঝেতে ধরে রাখে? উল্টো তার মায়ের, কানিজ বেগমের প্রশ্ন, "আমি মা হয়ে কীভাবে বাড়িতে থাকতে পারি, যখন আমার সন্তান একটি পরিবারের এই ঘন-অন্ধকারে আলোক প্রজ্বলনের চেষ্টায় এতটা নিবেদিত?"
আজগর আলী, দূরদর্শী কর্তা, যেন এক স্থির মহিরুহ। তিনি সবকিছু দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করে বিশুদ্ধ বিচারের রূপরেখা তৈরি করেন। শান্তর রাগের ভয়াবহ বিস্ফোরণ, তার অতীতের অসহনীয় আচরণ আজগর আলীর মনে গভীর শঙ্কা সঞ্চার করেছে। তিনি জানেন, ক্রোধে শান্ত পুনরায় এমন কিছু করে বসতে পারে যা সম্পর্কের গভীর ক্ষত তৈরি করবে। তাই কানিজ বেগমকে কৌশলে শান্তর কাছ থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
রুবিনা বেগম তার উপস্থিতি দিয়েই পরিবেশকে ভারমুক্ত রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। হাওয়াকে রাতের জন্য বাড়িতে চলে যেতে বললেও সে নির্লিপ্তভাবে থেকে গেছে, শুধু নাঈমের জন্য!
কানিজ বেগম এসেছেন, একান্ত আলাদা গাড়ি করে। দূরত্বে নিজেকে রক্ষা করার, অথচ সন্তানের জন্য কাছে থাকার দ্বৈততা। যে গাড়িতে শান্ত আর নাঈম ছিল, সে গাড়িতে তিনি আসেননি, যেন তার উপস্থিতি শান্তর অগ্নিগর্ভ মনে আর কোনো শিখা না জ্বালায়।
তবে মায়ের মর্মপীড়া কি কখনো এমন দূরত্বে ম্লান হয়? নাঈম এখনো একবারও তার মায়ের চোখে তাকায়নি। তাকালেই তার সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেই তীব্র যন্ত্রণা, যখন তার মা, কানিজ বেগম, তার বড় মায়ের চরিত্রে দাগ লাগিয়ে একের পর এক কঠোর বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন। সেই স্মৃতির দহন নাঈমের হৃদয়ে অমোচনীয় ক্ষত সৃষ্টি করেছে, করে যাচ্ছে।
আর এই অবহেলা, এই চরম অভিমান, কানিজ বেগমকে অন্তহীন অশ্রুধারায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি জানেন, তার সন্তান তার প্রতি ঘৃ'ণা নিয়ে দূরে সরে রয়েছে। তবু মাতৃত্বের চিরন্তন স্নেহ তাঁকে ঠাঁই বসিয়ে রেখেছে হাসপাতালের ওই নীরব করিডোরে।
মা, যে নামের অর্থ সীমাহীন ত্যাগ, দুঃখ, আর অপেক্ষা, সে কি এমন সহজেই সম্পর্কের দহন থেকে সরে আসতে পারে? কানিজ বেগম জানেন, তার সমস্ত ব্যথা, ভুল, আর অনুশোচনার শেষে একটাই প্রশ্ন অমোঘ,“মা হয়ে আমি কিভাবে দূরে থাকতে পারি?”
------
অত:পর মুগ্ধ দীর্ঘ সময় ধরে জিজ্ঞাসাবাদ সম্পন্ন করল। প্রশ্নের পর প্রশ্ন তার ধারালো অনুসন্ধিৎসার তীব্রতায় বিদ্ধ করল উপস্থিত সকলকে। তবু, সেই সূক্ষ্ম তদন্তপর্বের পরেও তার দুটি গভীর কালো চোখে যেনো লুকিয়ে রইল অদৃশ্য কোনো অপূর্ণতার তৃষ্ণা। তার দৃষ্টি অন্ধকার ভেদ করে খুঁজে ফিরছে এক নামহীন অস্তিত্ব। কাকে? সেই চুনোপুঁটি বলে হেয় করা ব্যক্তিকে? সেই অকথ্য শ্যামবর্ণার প্রতি তার এতটুকু মনোযোগ? নাকি সেই ঔদ্ধত্যময় মায়াবতীর দিকে? কে জানে! মুগ্ধ তো মুখে কিছুই প্রকাশ করে না, আমিও তো তার মানসপটে প্রবেশের অধিকারী নই। হায়, অজ্ঞতার এই সুতীব্র বিষ!
মুগ্ধ এক পলক ঘড়ির দিকে তাকাল। মধ্যরাতের নিস্তব্ধতায় ঘড়ির কাঁটা যেন তার জন্যই সংকেত পাঠাচ্ছে। সময় তখন ঠিক ১টা। মুহূর্তের বিরতিতে তার গলা থেকে বেরিয়ে এল এক ধ্রুপদী খাঁকারি। তারপর এক ধ্রুপদী কণ্ঠে উচ্চারণ করল, পাথর খোদাই করা ভাষায় কথা বলছেন,
——— "আপনাদের পরিবারে আর কেও আসে নি?"
সমস্ত কল্পনার গহীন বৃত্তে আঁখি নামটি ছড়িয়ে পড়লো। যেনো তার উপস্থিতিই বাস্তবতার সুতোয় বোনা প্রত্যাশার শেষ মণিকোঠা। হাওয়ার তীব্র উদ্বেগ ঝরে পড়ল বর্ণনায়,
——— "স্যার, আঁখি... ও তো ছিল! কোথায় গেলো?"
মুগ্ধ নিজের গোপন অন্তর্দর্শনের জানালায় দাঁড়িয়ে আছে। চক্ষু মুদে, দীর্ঘশ্বাসে এক অনিবার্য রহস্যময়তা দানা বাঁধল। অতঃপর ভ্রূক্ষেপে এক গাম্ভীর্যের শিলালিপি ছুঁড়ে বলল,
——— "হুম। চিন্তার কোনো অবকাশ নেই। এখানেই আছে, কোথাও। আমি দেখছি। আপনারা বসুন।"
এই বলেই মুগ্ধ গটগট পায়ে চলে গেল। তার হাবভাবেই স্পষ্ট, তিনি সিআইডি! একা পথচলায় সিদ্ধহস্ত। অন্যদের অসহায়তা কিংবা উৎকণ্ঠা তার পথচলায় বিঘ্ন ঘটাতে অক্ষম। নাঈম ও শান্তর রক্তের স্রোতে ক্রোধের সঞ্চার হলেও তারা নিশ্চুপ। তাদের অস্থির অন্তঃকরণ জানে তাদের বোন আঁখি কোথায়। আসলে মন বিষন্নতার আকাশে নিমজ্জিত থাকিলে কিছুই ভালো নাহি লাগে! এটিই ঘটিয়াছে তাহাদিগের মাঝে!
কিন্তু হাওয়া? হাওয়া ক্রমাগত ভাবনায় নিমগ্ন। ভাসিয়া ভাসিয়া উরাল দিয়াছে ভিন্ন চিন্তামগ্নে! তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে আফিয়া বেগমের নির্মম মুখশ্রী। আঁখির প্রতি তার অনমনীয় বিরাগ, তার কঠোর বাক্যবাণ, সব কিছুই অজান্তে তাদের সম্পর্কের গভীরে অনতিক্রম্য ব্যবধান সৃষ্টি করেছিল। অথচ আজ, আফিয়া বেগম নিজেই শয্যাশায়ী। আর এই আঁখি? যে মেয়ে কখনো তার বড় মায়ের ভালোবাসার ছায়াও পায়নি, আজ সে-ই পাথরের মতো অচল হয়ে গেছে কাঁদতে কাঁদতে।
আফিয়া বেগম কি জানেন? যার প্রতি তার হৃদয় বরফের মতো শীতল, সেই আঁখিই আজ তার জন্য অশ্রুর ধারা বইয়ে দিয়েছে।
হাওয়া এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সেই দীর্ঘশ্বাসে পুরো মানবিক সম্পর্কের করুণ অসারতা ফুটে উঠল।
হায় মানবতা! এই কি তার প্রকৃত রূপ? যাকে অবজ্ঞায় হারিয়ে ফেলা হয়, শেষপর্যন্ত সে-ই বুকের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে দাঁড়ায়। জীবনের এমনই নিষ্ঠুর পরিহাস, সেই মেয়েটি, যে কখনো ভালোবাসা পায়নি, আজ তার অশ্রু বয়ে নিয়ে যায় অপমানিত অতীতের ভার। অতীতের অনুকম্পাহীন কাহিনির ছায়ায় এ এক নতুন করুণ অধ্যায়ের সূচনা। সৃষ্টির স্রোতেও বোধহয় এমন জটিল বিপরীতধর্মী নাট্যমঞ্চ বিরল।
_________
কনকনে শীতল রাতে হাসপাতালের নির্জন করিডোরে, শ্যামলবর্ণ আঁখি নিঃশব্দে বসে আছে; তার চোখে জল, ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে, অথচ শব্দহীন। সমস্ত অস্তিত্বে শীতল স্থবিরতা ভর করেছে। ফিসফিসে কান্নার শব্দের বদলে তার হৃদয় থেকে ছুটে যাচ্ছে নিরব প্রার্থনার বাণী। সিজদায় অবনত ছিল তার মন, একটিমাত্র আকুতিতে, তার বড় মা যেন আরোগ্য লাভ করেন।
ভিড়ে বেজার মনে একটু প্রশান্তি পেতে, নাঈম ও শান্তকে বলে এসেছে সে। একাকী অবস্থানের ইচ্ছায় এখানে এসেছে। করিডোরে এখন কেউ নেই; কিছুক্ষণ আগেও দুই বয়স্কা নারীর উপস্থিতি ছিল, তারাও অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আঁখি, যেন স্বর্গের রহস্য খুঁজছে। গাছের শুকনো ডালপালার মাঝে টিকে থাকা পাতার মতো নিঃসঙ্গ সে।
ঠিক তখন, শব্দহীন পদক্ষেপে এক বলিষ্ঠ পুরুষ তার পাশে এসে বসল। মুগ্ধ। তার চেহারায় ধরা পড়ল নিবিড় গাম্ভীর্যের ছাপ। নিস্তরঙ্গ শূন্যতা ভেদ করে সে খুঁজে নিয়েছে এই অবাধ্য শ্যামাঙ্গীকে। আঁখি অনুভব করল পাশে বসার সেই নিঃশব্দ অথচ দৃঢ় আগমন। একবার তাকিয়ে দেখল, কিন্তু কোনো শব্দ করল না। তার চোখ ফের জানালার ফাঁক দিয়ে সন্ধানী চাঁদের দিকে।
মুগ্ধ হালকা ঝুঁকে হাঁটুতে হাত রেখে গভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দিল,
——— "অরন্যে একাকী থাকা ভূতেরা ভর করেছে কী?"
আঁখি তাকায়, ভ্রু কুঞ্চনে জাগে অসহিষ্ণুতা।
তার নীরবতাই উত্তর, তার নীরবতাই ভাষা।
মুগ্ধ ফের বলে, কণ্ঠে শুষ্ক আদেশের সুর,
——— "এই নৈঃশব্দ্যের জঠরে, কীসের খোঁজ করছো, শ্যামবতী?"
আঁখি তার নিরুত্তর, ব্যথাভারাতুর চোখে তাকাল। যেন এই পৃথিবীর সব শব্দ, অনুভূতি ও ব্যথা একাকী ধারণ করছে সে। ফের মুখ ঘুরিয়ে নিলো আকাশপানে!
নয়নের জলে যে ভাসে আজ, সেই তো নির্দয় ছিল কাল, দেখে মুগ্ধ মুচকি হাসে, ভাবে এও এক অপরূপ খেয়াল। পাথর-হৃদয় গলে যায়, যখন বেদনার বান ডাকে, তখন কেমন লাগে দেখা, যে কভু কারো ব্যথা না রাখে।
মুগ্ধের ঠোঁটে বিদ্রূপের হাসি, কিন্তু চোখে তার গভীর জিজ্ঞাসা,
———"কোন অভিশাপে নয়ন তোমার সজল?
কোন মরীচিকা দেখালো তোমায় মরুভূমির জল?"
উত্তরে শুধু পাথর-ভাঙা কণ্ঠস্বর,
———"যত হারাই, ততই যেন বাড়ে হারানোর তৃষ্ণা।
কী নিষ্ঠুর এই নিয়তি-খেলা, প্রতিটি প্রহর শুধু বিদায়ের ভাষা।"
——— "যেভাবে কেড়েছো আমার থেকে তুমি?"
———"কে আপনি?"
প্রশ্ন ওঠে থেমে থেমে।
———"সেই, তোমার মস্তিষ্ক ভুলেছে যারে! "
ফিরে তাকায় আঁখি যখন, মুগ্ধ ওঠে দাঁড়ায়,
বিদায় বেলায় শেষ কথা তার গভীর অর্থ ছড়ায়,
——— "স্মৃতির দরজায় আর করো না আঘাত।
যা হারিয়ে গেছে, তারে হারানোই থাক।"
মুগ্ধ হিমেল হাওয়ার মতোই হনহনিয়ে চলে গেল। আঁখি নিস্তব্ধ অশ্রুসিক্ত নয়নে তার প্রস্থানপথের দিকে অবিচল তাকিয়ে রইল। যেতে যেতে মুগ্ধ নিজে নিজেই বলল,
——— "তুমি বললে নিষ্ঠুর আমি,
আমি জানি তা সত্যি।
তোমার শোক নদীর মতো,
আমার, মরুভূমি।
আজ তুমি খু'নি, অপরাধী,
তবু কেন চোখে জল আসে?
মা হারানোর বেদনা বুঝি,
তোমার এখন প্রতিটি শ্বাসে?
______________________
অতঃপর কেটে গিয়েছে এক সপ্তাহ, বছরের অন্তিম প্রান্তসীমায় পৌঁছেছে সময়। ডিসেম্বরের শীতল পরিসরে, বাংলার পৌষ মাসে প্রকৃতি আপন বৈরাগ্যের প্রতিমূর্তি হয়ে বিরাজমান। কুয়াশার গভীর আবরণে আকাশ আর পৃথিবী যেন একাকার; দৃষ্টির সীমা মুছে গিয়ে সৃষ্টি করেছে এক রহস্যময় জগত। উত্তরের দিনাজপুরে হীমশীতল বাতাসের স্পর্শে প্রতিটি অস্তিত্ব জমাট বরফে রূপান্তরিত হওয়ার প্রতীক্ষায়। বরফপাতের অভাব কেবল একটি বাস্তবের অনুপস্থিতি; কিন্তু অনুভবে তা জেগে ওঠে শিরা-উপশিরায়।
এই নির্মম শীতের নিঃসঙ্গতায়ও, জীবন তার চিরন্তন গতিধারা থামিয়ে রাখেনি। কুয়াশার চাদরে মোড়ানো প্রান্তর পেরিয়ে কৃষকেরা মাঠে যায়, শ্রমজীবীরা হাতুড়ি আর কাস্তে হাতে অন্নের সন্ধানে নামে। আর এই সময়টাই তো আনন্দের! পিঠার সুগন্ধ, টুরের আমন্ত্রণ, পিকনিকের হাসি, সবই শীতের সঙ্গে মিশে তৈরি করে এক উৎসবমুখর পরিবেশ। কিন্তু শীত কি সবার জীবনে একইরকম প্রশান্তি বয়ে আনে?
নিশ্বাস ফেলুন আর প্রশ্ন করুন রাত্রির নক্ষত্রবিচ্ছুরিত আকাশের নীচে শুয়ে থাকা পথবাসীদের। তাদের কম্পিত ঠোঁট আর ফ্যাকাসে চোখে ছায়া ফেলুন। রিক্ত দিনমজুরদের দিকে তাকান, যাদের হাতের প্রতিটি কুঞ্চন দুর্ভিক্ষের কাব্য বয়। উত্তরাধিকারহীন জেলেদের গল্প শুনুন, যাদের প্রতিটি ঢেউয়ের সাথে জীবনের যুদ্ধ। সেখানে আনন্দের কোনো স্থান নেই, থাকে কেবল এক নীরব সংগ্রাম।
এই শীত কেবল প্রকৃতির নয়, জীবনেরও কঠিনতম পরীক্ষা। আনন্দের উষ্ণতায় বাঁচা মানুষেরা কখনো জানবে না হীমশীতল দারিদ্র্যের শীতল ছোবল কতটা নির্মম হতে পারে।
আফিয়া বেগমের দুর্ঘটনার পরবর্তী সকালের দিনিই পৌছেছিল সিআইডি! সেদিন সূর্য আলোকরশ্মি নয়, বিষণ্ণতার ছায়া বহন করছিল। আফিয়া বেগমের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানার তাড়নায় মুগ্ধ ও রুদ্র ছুটে গিয়েছিল হাসপাতালের সেই নির্বাক করিডোরে।
ডাক্তার স্পষ্ট ভাষায় সেদিন বলেছিল,
———— ——— "এক্সিডেন্টের পর থেকেই রোগী চেতনাহীন অবস্থায় ছিলেন। তবে গত ২৪ ঘণ্টার নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং ক্লিনিকাল টেস্টের পর আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে তিনি গভীর কোমায় চলে গেছেন। মস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোবের তীব্র আঘাত এবং সেরিব্রাল হেমারেজ (মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ) এর কারণে নিউরোনাল অ্যাক্টিভিটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার ব্রেন স্টেমের কার্যকারিতা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে, যা তাকে কোমায় ঠেলে দিয়েছে।
একথা শুনে স্তব্ধ হয়েছিল বটে! এতবড় অপরাধীর শাস্তি পাওয়ার আগেই ধীরে ধীরে জীবন থেকে ফিসলে যাচ্ছে। এটি কি পরিণতির নিষ্ঠুর রসিকতা? নাকি অপরাধী তার শাস্তি প্রকৃতির কাছেই খুঁজে পেয়েছে?
ডাক্তার আরো বলেছিলেন,
——— ——— "পেশেন্টকে এখনো আইসিইউ-তেই রাখা হয়েছে, কারণ তার অবস্থা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে শ্বাসপ্রশ্বাস নিশ্চিত করা হচ্ছে, এবং মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ ও ফুলে যাওয়া নিয়ন্ত্রণে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে দীর্ঘমেয়াদী কোমায় থাকলে আমরা তাকে বিশেষায়িত যত্নের জন্য অন্য ইউনিটে স্থানান্তর করতে বাধ্য হতে পারি। তার অবস্থা এখনো জীবন-মৃ'ত্যুর সীমানায় রয়েছে।"
অত:পর ডাক্তার দৃঢ় অথচ শীতল কণ্ঠে স্পষ্ট জানিয়ে বলেছিলেন,
——— "যদি আগামী দুই মাসের ভেতরে আফিয়া বেগম কোমার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে না আসেন, তবে তাকে আইসিইউ থেকে এলটিএসইউ-তে স্থানান্তর করা হবে। এটি সেই ইউনিট, যেখানে দীর্ঘমেয়াদী কোমায় নিমজ্জিত রোগীদের জন্য বিশেষায়িত যত্ন প্রদান করা হয়।"
এইসকল কথাগুলি মুগ্ধ ও রুদ্রের মনে এক অদ্ভুত সংশয়ের দোলা জাগিয়েছিল। সমস্ত ঘটনাপ্রবাহ যেন আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছিল তাদের সামনে। আফিয়া বেগম কি সত্যিই সত্যের পলাতক ছিলেন? আত্মার ভারে ক্লান্ত হয়ে কি নিজেকে বিলীন করার চেষ্টা করেছিলেন? নাকি এই দূর্ঘটনা ছিল নিছকই এক হতভাগ্য সংঘটনা?
তদন্তে সিআইডি ইতোমধ্যেই আবিষ্কার করেছে যে, যাদের আফিয়া বেগম হ'ত্যা করেছেন, তাদের অধিকাংশের সঙ্গেই তার কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল না। ইকরাম আলী ব্যতিক্রমে! এমনকি বাকিদের সহিত অবৈধ সম্পর্কেও ছিলেন না বলেই প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। তবে, প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে বাকি লোকদের র'ক্তে কেন রঞ্জিত হলো তার হাত? এ এমন এক উত্তর, যা একমাত্র আফিয়া বেগমের অচেতন মনেই হয়তো লুকিয়ে রয়েছে।
তার নিথর শরীর আর স্থবির স্নায়ু যেন এক অবিনশ্বর সিন্দুক, যার চাবি শুধু সময়ের হাতে। কোমার অতল গভীরে তার মস্তিষ্ক কি কোনো কাহিনি বুনছে? সত্যের মুদ্রাদোষে কি সে চিরকাল নীরব থেকে যাবে? নাকি তার জ্ঞান ফিরে আসবে, এবং সেই সিন্দুকের রহস্যময় দ্বার খুলে সমাজকে মুখোমুখি দাঁড় করাবে এমন এক সত্যের, যা হয়তো সহ্য করার ক্ষমতা সবার নেই?
মুগ্ধ ও রুদ্র এক অবর্ণনীয় দ্বিধায় নিমজ্জিত। তাদের সামনে অপেক্ষা শুধু সময়ের। সময়, যে নির্মম, অচল এবং অপরিবর্তনীয়। আর সেই সময়ই হয়তো নির্ধারণ করবে সত্য ও মিথ্যার চূড়ান্ত ভাগ্য।
চিকিৎসকগণ আরও জানিয়েছিলেন, আফিয়া বেগমের মর্মের গহন অন্ধকারে সুস্থতার আকাঙ্ক্ষার লেশমাত্র নেই। তাঁর মানসিক জগত কোমার গভীর তন্দ্রার সঙ্গে এক আপসহীন বদ্ধতায় বন্দী। রোগীর ইচ্ছাশক্তির অভাবে ঔষধের ক্ষমতা যে শূন্যে লীন হয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনকি কঠোর বাস্তবতায়ও স্বীকার করতে হয়, আফিয়া বেগম এক অতুলনীয় বিপজ্জনক নারী। ধরা দিয়েও ধরা না পড়ার শিল্পে তিনি অদ্বিতীয়া।
তাঁর খেলাটি এখনো অসমাপ্ত। গভীর নিদ্রার আড়ালে তিনি যে দুর্বোধ্য খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন, তা প্রখর মেধাবীদেরও কপালে ঘামের রেখা এঁকে দিয়েছে। যমুনার ঢেউ যেমন অপরিসীম অন্ধকারে কাঁপন তোলে, তেমনই তাঁর নীরব অবস্থান সবার মনে শঙ্কার ঢেউ তুলেছে।
শুনেছি , এক নারীর চাতুর্য যখন শয়তানীতেও শৈল্পিক হয়ে ওঠে, তখন স্বয়ং শয়তান তাঁর পাশে বসে দাস্যবৃত্তি করে, আর নিঃশব্দে তাঁর প্রতিটি পরিকল্পনা নোট করে নেয়। আফিয়া বেগম যেন সেই অলিখিত প্রবাদটির জীবন্ত প্রতিমূর্তি, এক মায়াময় রহস্যের আবরণে মোড়ানো তিমির সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী।
_________________
রুদ্র আজ প্রবেশ করেছে গয়নার দোকানের দীপ্তিময় পরিবেশে, এক স্বপ্ন পূরণের তাগিদে। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ ডায়মন্ড রিং-এর ঝিলিকময় সম্ভারে। মহুয়াকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার অভিপ্রায়ে সে প্রতিটি রিংয়ের সূক্ষ্ম কারুকাজ পর্যবেক্ষণ করছে, তার প্রাণপাখির সৌন্দর্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এক নিখুঁত উপহার খুঁজে পায়। প্রেমের প্রহর আর কত দীর্ঘায়িত হবে? যৌবনের দীপ্ত সূর্য তো পশ্চিমের পথে ঢলে পড়ার আগেই প্রেয়সীর সঙ্গে জীবনের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানায়।
মহুয়ার আঙুলের মাপ তার হৃদয়ে অঙ্কিত; অতএব, সে বেছে নিল এক আভিজাত্যের প্রতীক, ডায়মন্ড রিং, যার উপরিভাগে ক্ষুদ্র একটি ফুলের নকশা। মহুয়ার পছন্দের মৃদু সরলতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ভারী কারুকাজ পরিহার করল রুদ্র। তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল অনির্বচনীয় হাসি, মিষ্টি, শান্ত, আর গভীর এক প্রত্যয়ের প্রকাশ।
স্মৃতিপটে ভেসে উঠল সেই মুহূর্ত, যখন মহুয়াকে এসিপি স্যার তার ত্রুটির জন্য তিন দিনের বরখাস্ত আদেশ দিয়েছিলেন। ভগ্ন হৃদয় মহুয়াকে রুদ্র তার বুকে টেনে নিয়েছিল, সান্ত্বনার গভীরতর আলিঙ্গনে। কত অশ্রুর স্রোত যে সেই মুহূর্তে মুছে দিয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। বারংবার সে প্রিয়তমাকে সতর্ক করেছে, যেন কাজের প্রতি অমনোযোগ আর কখনো না হয়। আর মহুয়া, শিশুর সরলতায় তার কথায় সায় জানিয়ে কেবলমাত্র জড়িয়ে ধরেছিল।
আজ হাসপাতাল থেকে চাচি ঊর্মিলা বেগমকে দেখে সরাসরি এখানে এসেছে রুদ্র। মহুয়ার জন্য চমকের প্রস্তুতিতে তার হৃদয় উদগ্রীব, আর ঠোঁটের কোণে সেই মিষ্টি হাসি যেন অমর প্রেমের সিলমোহর। এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে তার একমাত্র লক্ষ্য, মহুয়ার হৃদয়ের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাবার চূড়ান্ত আয়োজন।
অতঃপর রুদ্র গয়নার দোকান থেকে বেরিয়ে এলো, হাতের মুঠোয় ছোট্ট বাক্সে লুকানো এক অনন্ত স্বপ্ন। মুখে তার এক অনির্বচনীয় প্রশান্তির হাসি। সামনের পথ ধরে এগিয়ে যেতে যেতে নিজেই উচ্চারণ করল,
——— “আমার এই একাকীত্বে মোড়া জীবনের একমাত্র আলো, একমাত্র প্রাপ্তিকে সারাজীবনের জন্য আমার করে নেব। খুব শিগগিরই, মহুয়া! তুমি এসেছিলে আমার শূন্য হৃদয়ে বসন্তের প্রথম কুসুম হয়ে। আমার জীবনের সমস্ত বেদনার অতল থেকে আমায় তুলে এনেছ। আর হাসতে শিখিয়েছো। মহু! তুমি আমার সকলটুকু। আমার হৃদয়, আমার অস্তিত্ব। এবার সেই হৃদয়কে তোমার হাতে তুলে দেওয়ার পালা।"
____________________
জীবন মৃদুস্বরে আছিয়ার পৃষ্ঠে করুণামাখা হাত বুলিয়ে বলল,
——— "পরি! বুঝার চেষ্টা করো ! এখনকার হিমেল বাতাসের নির্মমতা দেখেছো?"
আছিয়া দৃষ্টিহীন জেদ আর শিশুসুলভ প্রত্যাশায় ঠোঁট বাঁকিয়ে উত্তর করল,
——— "আমি সাইকেলেই চড়বই, চড়বই জীবন ভাই!"
জীবনের বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাসের এক অদৃশ্য ঝড় উঠল। এ মেয়ে! এ যেন তার প্রতিদিনের অনির্দেশ্য ধাঁধা। কখন যে কী দাবি জাগায়, সেই রহস্যের গভীরতর অন্তরালে জীবনের শ্বাস আটকে যায়। কই, বড় হলোই বা কবে? এই শীতল বিকেলে তাকে একবার নয়, পঞ্চাশবার ফোনে আকুল আহ্বান জানিয়েছে। জীবন তৎক্ষণাৎ ব্যাকুলতায় ছুটে এসেছে। এতবার কল! শঙ্কা আর কল্পনায় ছায়াপাত হয়েছে তার মনে—কোনো অঘটন ঘটেনি তো? সেই দুর্ভাবনায় দৌড়ের প্রখরতায় দেহ ঘামে সিক্ত হয়ে উঠেছে।
কিন্তু এখানে এসে দেখে, মেয়েটির কাণ্ড! এই শৈত্যে, এই নিমজ্জিত রক্তক্ষরণের হিমে সে সাইকেলে চড়তে চায়! সাইকেলে চড়ে নাকি যাবে ফুলের বাগানে!
আছিয়া জেদ আর কান্নার সীমান্তে দাঁড়িয়ে কাঁপা স্বরে অনুরোধ করেই যাচ্ছে। জীবনের অন্তরে যেন এক অসহায় ঝড় বয়ে যায়। অবশেষে ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,
——— "আচ্ছা, চুপ করো। অশ্রুপাতের স্রোত বন্ধ করো। বলো, এই নির্মম বিকেলে সাইকেল কোথা থেকে আনব আমি?"
——— "আপনার বাড়িতে একটি সাইকেল আছে না? আমি দেখেছি!"
আছিয়া নির্লজ্জ সত্যের স্বরে কথা বলল.! জীবন মাথায় হাত রাখল, আর এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
——— "হায় আল্লাহ! মেয়ে তো দেখি বাড়ির প্রতিটি কোনায় নজর রেখেছে!"
আছিয়া তৎক্ষণাৎ কৌতুকমাখা সুরে প্রত্যুত্তর দিল,
——— "হুহ, নজর রাখবই তো! এখন যান, সাইকেল নিয়ে আসুন! আমি এখানেই অপেক্ষা করছি!"
তার ঠোঁটে হাসির সূক্ষ্ম রেখা ফুটে উঠল, যেন তার কৌশল ও জেদের সম্মিলিত বিজয়ের স্মারক। জীবন, নিরুপায় হয়ে, মাথা ঝাঁকাল। এই শিশুর মতো পীড়াপীড়ি কি উপেক্ষা করা সম্ভব? তার এই ছোট্ট পরির ছোট্ট ইচ্ছাকে অপূর্ণ রাখবে কি করে?
জীবনের বাড়ি এখান থেকে কেবল দু’মিনিটের পথ, আছিয়া যেন সবকিছু ভেবেই রেখেছে। জীবনের হৃদয়জুড়ে এক গভীর বোঝার অনুভূতি সঞ্চারিত হলো। আবারও দৌড় দিল সে। পেছনে আছিয়া তার ছুটে যাওয়া দেখে এক ফিকে হাসি হাসল, এই দৃশ্যই ছিল তার অভীষ্ট।
মাত্র এক মিনিটের ব্যবধানে জীবন সাইকেল নিয়ে ফিরে এল। ঘাম ও পরিশ্রমে তার কপালে ফোঁটা ফোঁটা জল জমেছে। সাইকেলটি সামনে দাঁড় করিয়ে বলল,
——— "সাইকেলে চড়তে পারবে? পড়ে যাবে না তো?"
——— "আপনি আছেন কী করতে? আমাকে ধরে নেবেন তো!"
আছিয়া শিশুর মতো নির্ভার আস্থায় বলে উঠল। জীবন মৃদু হেসে, এক চিলতে স্নেহ মাখা চোখে তাকিয়ে বলল,
——— "হুম, বসো। তবে চাকার কাছে পা দেবে না। বুঝেছো?"
আছিয়া কথাটি মেনে, এক ধরনের ভীরুতা নিয়ে সাইকেলের পেছনে আসন গ্রহণ করল। তার অভ্যাস চারচাকার গাড়ির মসৃণতার সঙ্গে, কিন্তু এই দুই চাকায় ভারসাম্য খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা যেন তার জন্য এক নবজন্ম। তবু, এ সাইকেলে ভ্রমণের ভাবনা, তার প্রেমময় কল্পনার অমলিন স্বপ্ন। সে ভয়ে ভয়ে বসল, আর বসার সঙ্গে সঙ্গেই ভারসাম্য হারিয়ে প্রায় পড়ে যেতে লাগল।
জীবন তৎক্ষণাৎ তার নরম, কচি হাত শক্তভাবে ধরে টেনে বলল,
——— "দেখলে তো? ধরেছি তো তোমায়।"
আছিয়া লজ্জায় চোখ নামিয়ে আসন ঠিক করে বসল। এক অনুচ্চারিত রোমাঞ্চ তার সত্তায় ছুঁয়ে গেল। সে জীবনের পেছনে নিজের কোমল দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল, যেন এই পৃথিবীতে তার নিরাপত্তার একমাত্র আশ্রয় এই মানুষ। তার ছোট্ট হাত জীবনের বলিষ্ঠ শরীরের শার্ট খামচে ধরল। জীবন আবারও মৃদু হাসল, যেন এই দৃশ্য তার অন্তরে এক অনন্ত সুখের ঢেউ তোলে।
সাইকেলের প্যাডেলে পা রাখল জীবন, শুরু করল এক নিঃশব্দ যাত্রা। চাকার ঘূর্ণনে শীতল বাতাস আছিয়ার মুখে এসে লাগল। এই ক্ষণিকের নির্ভার প্রেম তাদের সামান্য জীবনের সেরা উপাখ্যান হয়ে উঠল।
জীবন পথ চলতে চলতে বলল,
——— "এই গরীবের বুকে রয়েছে তোমার জন্য অজস্র ভালোবাসা, পরি। টাকা-পয়সায় গরিব হতে পারি, কিন্তু হৃদয়ের ঐশ্বর্যে বড়লোক আমি। তোমার জন্য কোনো ত্রুটি থাকবে না, কোনো দুঃখ ছুঁতে পারবে না, কোনো শূন্যতা তোমাকে গ্রাস করতে দেবে না।"
________________
ঠাস! ঠাস! ঠাস!
একটি চিৎকার, যেন সমগ্র অস্তিত্ব বিদীর্ণ করে, ভেসে এলো বাতাসে। এক নারীর করুণ আহাজারি আর বুকভাঙা কান্না ছাপিয়ে শান্তর হাতের বে'ল্টের প্রতিটি আ'ঘাত হয়ে উঠল দুরন্ত ঝড়ের অন্ধধ্বংস। চোখ র'ক্তবর্ণ, দেহ উত্তাল শ্বাসে কাঁপছে, শান্ত যেন হিং'স্র প'শুর প্রতিমূর্তি। সামনে পড়ে থাকা মহুয়া, বেদনায় কাতর, তবু তার কণ্ঠস্বর শান্তর প্রতিশোধের আগুন নেভাতে ব্যর্থ।
শান্ত দাঁতে দাঁত চেপে ফুঁসে উঠল, যেন বজ্রের বিকট গর্জন,
———"তুই বলেছিলি, সব প্রমাণ মুছে ফেলেছিস! তবে সিআইডি আমার মাকে ধরল কীভাবে? তোর চোখের সামনে আমার মা চলন্ত গাড়ি থেকে নামল কীভাবে? তুই ধাক্কা দিয়েছিস, তাই না? তোর জন্যই আমার মা আজ কোমায়!"
রাগের বশে বে'ল্টটি আবারও আছড়ে পড়ল মহুয়ার ক্ষ'ত'বিক্ষ'ত শরীরে। কান্নার বন্যায় ভেসে মহুয়া হঠাৎ শান্তর পা জড়িয়ে ধরে, কাঁপা কণ্ঠে মিনতি করল,
———"শান্ত,.... আমাকে ক্ষমা করে দাও!.. আমার ভু..ল হয়ে গিয়েছে। আমি বুঝতে পারিনি,... প্লিজ!"
শান্ত তখনই হাঁটু গেড়ে বসল। মহুয়ার চোয়াল চেপে ধরে চোখে বিদ্বেষের আগুন ছড়িয়ে বলল,
———"তোর সাহস হয় কী করে আমার নাম ধরে ডাকার? আমাকে ‘তুমি’ বলার যোগ্যতাই বা তোর হলো কী করে?"
তারপর তীব্র আ'ঘা'তে আবারও চ'র ক'ষিয়ে দিল। মহুয়ার মুখ থুবড়ে পড়ল, কিন্তু শান্ত তাতে কর্ণপাত করল না। দাঁতে দাঁত চেপে আরেকবার ফুঁসল,
———"তোকে আমি তৈরি করেছি! তুই যে আজ সিআইডিতে, সেটা আমার কারণেই। আর তুই? তুই আমাদেরই পেছন থেকে ছু'রি মারলি? সিআইডিদের সঙ্গে হাত মেলালি?"
মহুয়া থরথরিয়ে কেঁপে বলল,
——— "না-না-না! আ..মি জা..জানতাম না... মুগ্ধ স্যার এটা পরিকল্পনা করেছিলেন!"
শান্ত হিং'স্র হেসে বলল,
——— "তুই আবার মুগ্ধকে সম্মান দিলি কোন সাহসে? তার নাম উচ্চারণ করবি না আমার সামনে।"
মহুয়া আবারো কাঁপা গলায় মিনতি করল,
——— "স-স-সরি স্যার!"
শান্ত এবার অন্ধকারের গভীরতা নিয়ে বিদ্রূপ করল,
——— "তুই সিআইডির ওই রুদ্রের সঙ্গে প্রেম করছিস, তাই না? কী করে ওকে মিথ্যে বলিস? কোন পঙ্কিল গর্ত থেকে উঠে এসেছিস, ভুলে গিয়েছিস মহুয়া? তোর মতো নীচ কিছু আমি নিজে তৈরি করেছি, এটা ভাবলেই আমার র'ক্ত ফুটে ওঠে!"
মহুয়া কেঁদে ফেলে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু শান্তর চোখে তখন শুধুই অগ্নি। সে আরেকবার বে'ল্ট হাতে তুলে নিল, যেন মহুয়ার সঙ্গে প্রতারিত বিশ্বাসের র'ক্তক্ষরণের শেষ অধ্যায় লেখার জন্য প্রস্তুত।
0 Comments