লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা


কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।


*
*
পুলিশ স্টেশনে মুগ্ধ আরামসে রাজকীয় ভঙ্গিতে কেদারায় আসীন, বাম পায়ের উপরে ডান পা সমুন্নত, যেন তার মনোভাব এবং গরিমায় কোনো প্রকার অ'স্থি'রতা নেই। হাতে চায়ের কাপ হতে উত্তপ্ত চায়ের ধোঁয়া ধীরপথে ওঠছে, আর মুগ্ধ নিস্তরঙ্গভাবে ফুঁ দিয়ে চুমুক দিচ্ছে। পার্শ্বে বসে আছেন এক বৃদ্ধ, বর্ষব্যাপ্ত কালের সাক্ষী তার শুভ্র দাড়ি। হাতে ধৃত চায়ের পাত্র, আর সেই পাত্র হস্তে ধারণ করে তিনি মৃদু হাস্যে আপ্লুত। হেসে উঠলেন খিলখিল ধ্বনিতে, যেন বাষ্পাঙ্কিত পুরনো স্মৃতির সহিত পুনর্মিলন ঘটছে। টেবিলে রাখা একখানি বালুকাসার বিস্কুট হস্তগত করে ধীরগতিতে খ'চখ'চ শব্দে চিবানো আরম্ভ করলেন।
মুগ্ধ আপন কপালে এলানো সিল্কি কুন্তল সরিয়ে ইন্সপেক্টর নিয়াজের প্রতি তী'ক্ষ্ণ নিবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকালো। নিয়াজ সাহেবের মুখে বি'রক্তির ছাপ স্পষ্ট, যা ক্রমশ ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করছে। দশ মিনিট ধরে একই দৃশ্য চলছে। মুগ্ধর নির্বিকার চাহনি ইন্সপেক্টরের ক্রো'ধ আরও প্রজ্বলিত করে তুলছে। ইন্সপেক্টর নিয়াজ সাহেব এরূপ বে'প'রোয়া, জে'দী, ও ভাবনাহীন যুবক পূর্বে কখনোই প্রত্যক্ষ করেন নাই।। গলা খাঁকারি দিয়ে ইন্সপেক্টর নিয়াজ অবশেষে বললেন,
—" তুমি ক্ষমতাবান বলেই মৌনতা পালন করছি, তবে আর না। দ্রুত আমার প্রশ্নের উত্তর দাও!
মুগ্ধ নীরবতা ভঙ্গ করে, ব্রাউন-আবৃত অধরে চায়ের পাত্র তুলে চুমুক গ্রহণ করল। তার পর দৃষ্টিপাত করল ইন্সপেক্টরের প্রতি, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বাম ভ্রু উচিয়ে বলল,
— " কিভাবে? যেভাবে আপনার উপস্থিতিতে অসহায়রা নির্বাক থাকে, ন্যায়ের অভাবে নিশ্চুপ থাকে, সেভাবে? "
মুগ্ধের উক্তি শ্রবণ করে নিয়াজ মহাশয় কর্কশ স্বরে কাশি শুরু করলেন। টেবিলস্থিত কাঁচনির্মিত গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করলেন। অতঃপর বিনীতভাবে অনুরোধের সুরে মুগ্ধের প্রতি নিবেদন করলেন,
— " দেখো, তুমি তো আমার ছেলের মতো। আমাকে আমার কাজ করতে দাও,, আমার প্রশ্নের উত্তর দাও! "
মুগ্ধ কোনো বাক্য উচ্চারণ করল না, কেবল তৃপ্তির সঙ্গে চায়ের পাত্রে অধর স্পর্শ করে অতি মন্থর গতিতে চুমুক দিচ্ছে। নিয়াজ সাহেব এবার রে'গেই জিজ্ঞেস করলেন,
— "যা জিজ্ঞাসা করেছি তার উত্তর দাও , আগে বলো, তোমার হাসপাতাল থেকে পালানোর মানে কি? এত সিকিউরিটির মাঝেও তুমি কিভাবে পালালে?"
সঙ্গে সঙ্গে মুগ্ধ ক'টা'ক্ষের হাস্যপুষ্প ফুটিয়ে বলল,
— "আপনার দারোয়ান যদি নাক ডেকে ঘুমিয়ে থাকে, তাকে জাগানোরর দায়িত্ব তো নিশ্চয়ই আমার নয়, মহাশয়।"
ইন্সপেক্টর নিয়াজের ক্রো'ধ তখন জ্বালামুখী আ'গ্নেয়গি'রির ন্যায় উত্তাল। তিনি ক্রো'ধাভিভূত দৃষ্টিতে কনস্টেবলের দিকে তাকালেন। কনস্টেবল নিরুত্তর, মাথা নিচু করে নির্বাকভাবে দাঁড়িয়ে, তার দৃষ্টিতে ল'জ্জা ও বিচলিততা স্পষ্ট প্রতিফলিত, যেন কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ার স্প'র্ধা বা সাহস তার মধ্যে অবশিষ্ট নেই।
কিঞ্চিত সময় পূর্বে যখন হাসপাতালে মুগ্ধের অনুপস্থিতিতে গু'ঞ্জন, সশব্দ আন্দো'লন শুরু হলো, তখন ইন্সপেক্টর নিয়াজ সাহেব দৌড়ে মুগ্ধের সন্ধানে সর্বত্র নিখোঁজ অনুসন্ধান চালাতে চালাতে যখন তিনি ক্লান্ত, হঠাৎ থানার পক্ষ হতে আসা একটি ফোন তার হাতে পৌঁছাল। ফোনে অপরপক্ষের বাণী হলো,
— "স্যার, দ্রুত থানায় আসুন! মুগ্ধ এখানে থানায় বসে আছে, সাথে একজন বৃদ্ধ লোক ও আছে ! "
ইন্সপেক্টর তখন হতচকিত। যাকে সন্ধান করতে তিনি পা'গ'লের মতো এদিক ওদিক খোজে যাচ্ছে, সে ব্যক্তি কিনা আরামসে থানায় বসে আছে? হাসপাতালের করিডোরে শাহারিয়াজ পরিবারের বি'ষণ্ণ মুখাবয়ব। ঠিক সেই মুহূর্তে, ডাক্তার মোশারফ সাহেবের নিকট গমন করে প্রিসক্রিপশন দিয়ে বললেন,
— " রোগীকে স্যালাইন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবা আমরা দিয়েছি । তাই এখন তার শারীরিক অবস্থায় উন্নতি ঘটেছে , তবে পেশেন্ট এখনো পূর্ণরূপে সুস্থ নয়। আমি যা যা ঔষধ লাগে প্রেসক্রিপশনে লিখে দিয়েছি, পারলে নিয়মিত ঔষধ খেতে বলবেন । "
মোশারফ সাহেবের ক্রো'ধ তখন সপ্তমাকাশে। তার পুত্র উধাও হয়েছে, পু'লিশ তাকে হন্ন হয়ে খুঁজছে, আর উনি ডাক্তার প্রেসক্রিপশন প্রদান করতে ব্যস্ত। ইচ্ছে করলো প্রেসক্রিপশন ডাক্তারের মুখে ছু'ড়ে দিয়ে তাকেই খাইয়ে দিতে! কিন্তু সাজ্জাদ সাহেব ধৈর্য্য ধরে প্রেসক্রিপশন ফট করে হাতে নিয়ে বললেন,
— " ধন্যবাদ, প্রয়োজনে আবার আসব। "
অন্যদিকে রোহান, চি'ন্তাক্লিষ্ট মনে, তার বন্ধুর চিন্তায় বি'ক্ষি'প্ত। কল্পনায় অগাধ ভাবনা ঘূর্ণায়মান, তার বন্ধু কোথায় আছে এই চিন্তায় মস্তিষ্কে যেন আর কিছু স্থান পাচ্ছে না। সুহানা বেগম ক'রুণ রোদনে ক্লান্ত। আছিয়া বড় মা'কে শান্ত করবার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে । পুত্রের আগমনের পর হতেই যেন একের পর এক অ'মঙ্গ'লের স্রোত বইছে। সুহানা বেগমের অ'শ্রু'জলে হৃদয় ভা'ঙ্গ'ছে। মোশারফ সাহেব আর সহ্য করতে না পেরে স্ত্রী'কে ক'ঠোর বাণীতে ধ'মক দিয়ে বললেন,
— " এই, তুমি কি এখন একটু চুপ করবে ? যার জন্য কেঁদে ভাসাচ্ছো , তার কি কোনো খবর আছে?? এই যাও তো এখান থেকে! যত্তসব!!
এই বলে তিনি দ্রুত পদক্ষেপে বের হলেন। একে একে শাহারিয়াজ পরিবারের সকলেই হাসপাতাল ত্যাগ করলেন। হাসপাতালে ইতিমধ্যেই গু'ঞ্জন, কা'নাঘুঁ'ষা শুরু হলো, মুগ্ধকে কেন্দ্র করে । ডাক্তার বির'ক্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে বিড়বিড় করে বললেন,
— " পেশেন্ট তো নয় যেন পাষাণ! এমন বে'প'রোয়া মানুষ আমার ক্যারিয়ারে দেখি নি! "
এদিকে মুগ্ধের প্রেমে মগ্ন সে নার্স, যার হৃদয় দুঃ'খে আবদ্ধ , ভেবেছিল মুগ্ধর সজাগ চেতনাপ্রাপ্তিতে কথা বলবে, পারলে ফোন নাম্বার টাও নিবে । কিন্তু মুগ্ধ যে এমন চুপিসারে সবাইকে ফাঁ'কি দিয়ে পালাবে তা কি কখনো সে ভাবতে পেরেছিলো?
---Threads
মুগ্ধ ধীরে ধীরে চায়ের গ্লাসটি টেবিলে রাখল, কিঞ্চিত নড়েচড়ে বসে , শীতল দৃষ্টি ইন্সপেক্টরের প্রতি পুনরায় নিবদ্ধ করল। তারপর স্বরাহ্বানিতে বলল,
— " Now you can ask me anything! "
ইন্সপেক্টর নিয়াজ সাহেব যেন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একপ্রকার মুক্তি অনুভব করলেন, যেন বহুক্ষণ বন্দী ছিলেন অজ্ঞাত উত্তে'জনায়। তিনি কাঠকাঠ কন্ঠে বললেন,
— "প্রশ্ন তো আছে অনেক ! সবার আগে বলো যেই রাতে তুমি বাংলাদেশে এসেছো , সেই রাতে……"
মুগ্ধ হঠাৎ তার ডান হাত উঁচু করে ইন্সপেক্টরের দিকে ইঙ্গিত করে তাকে থামিয়ে দিলো । তার মুখাবয়বে ভাবলেশহীনতার পরত ছায়া, নিরাসক্ত স্বরে বলল,
— "That's it, this is enough."
নিয়াজ সাহেব ভ্রুকুঞ্চন করে তাকালেন । তিনি একপ্রকার বিভ্রা'ন্তির মধ্যে নিমজ্জিত হলেন যে এই মুহূর্তে আসলে কে কাকে প্রশ্ন করছে?? মুগ্ধ যেন তার কথার ধা'রা'লো শ'লাকা দিয়েই ইন্সপেক্টর নিয়াজ সাহেবের মননশীলতায় আ'ঘা'ত করছে। কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস আর মুখে চিন্তাহীন হাস্য স্পষ্ট। অত:পর
মুগ্ধ আলস্য ভরে নিজের পরিধেয় নীল শার্টের হাতা গুটিয়ে লিপ্ত করল। সাথে সাথে তার সুচারু ফর্সা হাতের উপর ক্ষুদ্র লোমকূপ দৃশ্যমান হলো। এক অজানা তী'ক্ষ্ণতা তার চেহারায় প্রস্ফুটিত, বক্রমুখে হালকা হাস্য ঝরিয়ে মুগ্ধ ইন্সপেক্টর নিয়াজ সাহেবের চোখে চোখ রেখে তার কণ্ঠে তী'ক্ষ্ণ বিদ্রূপের সুর নিয়ে যেন প্রতিটি বাক্যে সে ইন্সপেক্টরকে ক'টাক্ষ করে বলা শুরু করল,
— "কানাডা থেকে আমি বাংলাদেশে রাত ঠিক দশটায় পৌঁছেছি! নোট ইট। এরপর সৈয়দপুর বিমানবন্দরে টিকিট কেটে সব কাজ শেষ করে ঠিক ১১টা ৩০ মিনিটে ফ্লাইটে উঠেছি এবং ১২টা ৩০ মিনিটে সৈয়দপুরে পৌঁছেছি! নোট ইট! কোথায় পৌঁছেছি? রংপুর বিভাগের নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর বিমানবন্দরে। আমার বাড়ি কই? দিনাজপুর জেলার পার্বতিপুরে! সময় কত? রাত ১২টা ৩০ মিনিট!
এর মানে, আমাকে অবশ্যই আরো পথ পাড়ি দিতে হত, তাই না? সৈয়দপুর এয়ারপোর্ট থেকে পার্বতিপুরের পথ ১৩.৩ কিলোমিটার। গাড়ি দিয়ে যেতে সময় লাগে ২৪ মিনিট। কিন্তু, স্যার, এতো রাতে আমার শ্বশুর নিশ্চই আমার জন্য গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে না, তাই না? এখন বলবেন আমি আমার পরিবারকে জানাইনি কেন? বললেই তো তারা গাড়ি নিয়ে চলে আসত! অফ কোর্স! কিন্তু স্যার, এত রাতে আমি ওসব ঝা'মেলায় যেতে চাইনি এবং এত বছর পর ফিরে এসে মাঝ রাতে আমার পরিবারকে ঝা'মেলায় ফেলতেও চাই নি। আর সব থেকে বড় কথা, আমার ইচ্ছে করে নি! আমি আমার ইচ্ছেমতো চলি, কাওকে ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করি না! আর মাঝে মাঝে ব্যাতিক্রম পরিস্থিতি তে পরাও ভালো! যাক'গে সেসব কথা! তারপর ৩০ মিনিট অপেক্ষা করেছি। কেন? কারণ ওই যে বললাম আমার শ্বশুর আমার জন্য গাড়ি নিয়ে আসে নি! হাহাহ! রাত তখন ১টা বাজলো। নোট ইট!! তখন আমি একটা গাড়ি পেয়েছি। ভাড়া করে অতিরিক্ত টাকা দিয়েও যেখানে ২৪ মিনিট লাগে সেখানে পৌঁছেছি ৪০ মিনিটে! এখন প্রশ্ন করবেন, এত সময় কেন? ওহ, স্যার, ড্রাইভার আমার শ্বশুর তো আর নয়! সে খুব ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়েছে। আমি গ্রামে পৌঁছেছি রাত ঠিক ১টা ৫৫ মিনিটে। কিন্তু স্যার, একটা কথা তো আপনি ভুলে গেছেন, এটা কি মাস? বর্ষাকাল! আর বৃষ্টির পানি আমার জন্য কতটা উপকারী সেটা তো নিজের চোখেই দেখেছেন!" ( কটাক্ষের হাসি দিয়ে বলল )
মুগ্ধ একটু থেমে পুনরায় বলে,
— "পথিমধ্যে ঝড়ের কারণে আমি আমার দাদুর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি! আর আমার ফোনের ব্যাটারি শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাই ফোন বন্ধ ছিল! এখন স্যার, আমি কিভাবে জানব যে সেখানে কে কাকে মা'রলো? এখন হয়তো বলবেন, চিৎ'কার শুনিনি ? হাহাহা! স্যার, খু'নি কি আপনার মতো এমন নি'র্বো'ধ ? সে কি ভিক'টিমকে চিৎ'কার করতে দিয়ে বলবে, ‘এই তুই চিৎকার কর, সবাই শুনুক, আর আমি ধরা পড়ি’? আপনার মতো বো'কা মস্তিষ্কের পু'লি'শ, খুনি কিভাবে ধরবে স্যার?"
মুগ্ধের তী'ক্ষ্ণ ব্য'ঙ্গা'ত্মক ভঙ্গি ইন্সপেক্টর নিয়াজকে তী'রের মতো বি'দ্ধ করছে। ক্রো:ধে যেন ফেটে পরছেন তিনি! মুগ্ধ সামান্য হাস্যাবস্থায় পাশে বসে থাকা বৃদ্ধের দিকে ফিরে তাকাল। বৃদ্ধের প্রতি সস্নেহে বলল,
— " কি দাদু, সেদিন রাতে তোমার কাছে ছিলাম না? তোমাকে যে ওই দুষ্টু ভিডিওটা দেখিয়েছিলাম! "
বৃদ্ধ, তার সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন। হাসতে চোখের কোণে কৃত্রিম রেখা ফুটে উঠল। বললেন,
— " হয়, হয়, হামার নাতি হামার বাড়িত থাকিছিল! হায়রে যে ঝ'ড় তুফান উঠিল! মুই ত ড'রাইছু! সারা রাইতোত মোবাইল খানত ওই চেং'রী মাইনষের না'ফানা'ফি দেখুনু , হাহাহা! হেব্বি একখান জিনিস! "
এরপর ধমক দিয়ে নিয়াজ সাহেব কে বললেন,
— "এ তুই! মোর নাতিক আর কিছু কবু না! "
নিয়াজ সাহেব অপ্রস্তুত হয়ে ক্রো'ধে দ'গ্ধ হলেন ছেলেটা এইভাবে কথায় কথায় তাকে অপ'মান করল? মনে হচ্ছিল যেন মুগ্ধকে জে'লে ভরে রাখেন। কিন্তু তিনি আরও অবাক হলেন যখন বু'ড়োর কথা শুনলেন; বু'ড়ো বয়সে মতি গোলমাল হলে যেমন হয়। বু'ড়োর কথা শুনে একটু অ'প্র'স্তুতও হলেন বটে! কিছুক্ষণ চুপ থেকে, বু'ড়ো'কে এড়িয়ে, নিয়াজ সাহেব নিজের রা'গ সামলে আবার মুগ্ধকে প্রশ্ন করলেন,
— " কিন্তু তুমি তোমার পরিবারকে এ বিষয়ে কেন কিছু বললে না? "
মুগ্ধ সংক্ষিপ্ত কণ্ঠে, নির্বিকারভাবে জবাব দিল,
— "প্রয়োজন মনে করি নি।"
ঠিক তখনই মুগ্ধের পকেটের ফোন বেজে উঠল। ইন্সপেক্টর নিয়াজ সাহেবের মাথায় হুট করে আরও প্রশ্ন জমা হলো । মুগ্ধ তার পকেট হতে ফোন বের করে কানে তুলল। ওপাশের কণ্ঠস্বর অশ্রুত থাকল। কেবল মুগ্ধের ঠোঁটের কোণে বক্র হাসি ফুটল। বলল,
—" ঠিক আছে। আমি আসছি।"
ফোন নামাইয়া মুগ্ধ গম্ভীর হলো। নিয়াজ সাহেব তখনই প্রশ্ন করতে যাবেন তার আগেই মুগ্ধ হাত উচিয়ে পূণরায় তাকে থামিয়ে বাকা সহাস্যে বলল,
— "স্যার, স্যার, স্যার, আমি আরবিন শাহারিয়াজ মুগ্ধ! সেই ফোনটা আমি আমার দাদুকে দিয়েছি দুষ্টু ভিডিও দেখার জন্য। এখন দাদু যদি বন্ধ করে রাখেন, আমি কি করব?"
নিয়াজ সাহেন চমকে উঠলেন, একি, এই ছেলে কিভাবে জানলো তিনি এই প্রশ্নই করবেন? নাহ এই ছেলেটাতো কোনো কথা বলার সুযোগই দিচ্ছে নাহ! এই অ'স'ভ্য ছেলেটা কি তবে মনের অভ্যন্তরস্থ ভাবনা পাঠ করতে সক্ষম? তখন পাশ হতে বৃদ্ধ উচ্চস্বরে বলে উঠলেন,
— " ফোনত আলা কেম্বা করি চার্জত দেয়, মোর ফম নাই বাহে! "
মুগ্ধ বাকা হেসে বলল,
— "আমি আবার দেখিয়ে দিয়ে আসব, দাদু!"
এই কথা বলেই মুগ্ধ ধপ করে উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ উঠে যাওয়ায় চমকে উঠেন নিয়াজ সাহেব! মুগ্ধ হঠাৎ করেই স্বীয় স্বরূপ পরিবর্তন করল, র'ক্ত'বর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঘাড় বাঁকিয়ে নিয়াজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে, নিয়াজ সাহেব মুগ্ধর এমন আকস্মিক পরিবর্তন দেখে আরো চম'কিত হলেন। মুগ্ধ চোয়াল দৃঢ় করে, গম্ভীর ও তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ভ'য়া'ব'হভাবে উচ্চারণ করল,
— "আমি ৬ বছর কানাডায় ছিলাম। দেশে ফিরে এসে আমি একজন সাধারণ মানুষকে মা'র'ব? যাকে আমি চিনিও না?? আপনাকে যে খবর দিয়েছে, তদন্ত করে দেখুন, হয়তো আসল খু'নি সেই! পু'লি'শের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করবেন। শুধু চেয়ারে বসে প্রমোশনের চিন্তা যে করছেন, এমন ভুলভাল তদন্ত করে আসল খু'নি'কে ছেড়ে দিচ্ছেন না তো? যে সময় আমার পিছনে ব্যয় করলেন, সেই সময় লোকেশনটির আশপাশের বাড়িগুলিতে জিজ্ঞাসা করলে, সঠিকভাবে ত'দন্ত করার ইচ্ছে থাকলে ৫ মিনিটে দাদুর সঙ্গে দেখা হয়ে যেত, এবং আসল সত্য জানতে পারতেন! শুধুমাত্র কারো কথায় আমাকে খু'নির ট্যাগ দিয়ে দিচ্ছেন, এই আপনার পু'লি'শের কাজ?
মুগ্ধ র'ক্তি'ম চোখ জোড়া বন্ধ করে ঘাড় চতুর্দিক ঘুড়িয়ে সোজা করল, আরেকবার স্থির দৃষ্টিতে ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে অ'প'মা'নের সূরে নিয়াজ সাহেবকে নিচু করে, গালে জু'তো মা'রা'র মতো কথা বলল,
— "পুলিশ স'ন্দেহ করবেই, কিন্তু যে অভিযোগ করেছে, তাকে কি আদৌ স'ন্দেহ করেছেন? নাকি স্রেফ কে'সটা হেলায় সেরে ফেলতে চাইছেন? আমি জানি আপনি আরো কি কি প্রশ্ন করতে চান। হসপিটাল হতেই আমি শুনেছি যে আপনারা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। মানে আপনারা কতটা ইউসলেস ভাবুন!! তাই জ্ঞান ফিরতেই এখানে এসেছি । এখন যদি আপনারা স্টেশনে না থেকে গলিতে মহিলা কনস্টেবলের সঙ্গে র'ঙ্গ'লী'লা করেন, তাহলে বুঝবেন কিভাবে?
আমি আরবিন শাহারিয়াজ মুগ্ধ,, who am I? আরবিন শাহারিয়াজ মুগ্ধ!! কাওকে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করি না। আর কোন কাজও স্থগিত রাখি না। যেন দ্বিতীয়বার কানের কাছে ঘে'উ ঘে'উ না করেন এই জন্যই আসা। পরের বার আমার কাছে আসার আগে ১০০ বার চিন্তা করে, ঠিকমতো খোঁজখবর নিয়ে আসবেন। আর হ্যাঁ, আসল খু'নিকে খুঁজুন, যদি সাহস থাকে, যদি বু'কের পা'টা থাকে! "
মুগ্ধ আর এক মুহূর্ত স্থির থাকল না। তার চোয়াল শক্ত করেই, পায়ের গতি ত্বরান্বিত করে গটগট করে বের হয়ে গেল। বৃদ্ধ লোকটিও নিয়াজ সাহেব কে চোখ রা'ঙিয়ে, মুগ্ধর পিছু পিছু গেল। এই বৃদ্ধ, যে গ্রামবাসীদের নিকট এক গরিব ভিখিরি মাত্র, তার জীবনকালের কাহিনী যেন অকথিত ক'রু:ণায় আচ্ছন্ন। কিন্তু মুগ্ধ, যাকে অধিকাংশ মানুষ ঘা'ড়'ত্যা'ড়া, রা'গী, ব'দ'মে'জা'জি বে'প'রো'য়া, আরো যত খা'রা'প দিক বলে অভিহিত করতে দ্বিধা করে না, তার হৃদয়ে লুক্কায়িত রয়েছে এক অপূর্ব মানবিকতা। মুগ্ধ, যা অধিকাংশ লোক জানে না, কিংবা কেও দেখেও দেখেন না; গরিব, অসহায় ও বঞ্চিত মানুষের নিকট যেন সে ফেরেশতা সদৃশ।
গ্রামের প্রতিটি দরিদ্র, ভিক্ষুক, রিকশাচালক, জেলে, কৃষক, দিনমজুর থেকে শুরু করে যারাই অভাব অনাটনে, দুঃখী; সবাই মুগ্ধকে হ্রদয়ের অন্তঃস্থল হতে ভালোবাসে। মুগ্ধ সবার মুখে এক ফোটা হাসি ফুটাতে সব করতে প্রস্তুত , এমনকি প্রয়োজন হলে তার নিজের জীবনও উৎসর্গ করতে দ্বিধা নেই । তেমনি মুগ্ধের এক কথায় লোকেরাও প্রাণ দিতেও প্রস্তুত, এতটাই গভীর ভালোবাসা পোষণ করে সকলেই মুগ্ধর প্রতি।
বৃদ্ধ লোকটি—যে ভিক্ষাবৃত্তিতে লিপ্ত — সে মুগ্ধকে নিজের নাতির থেকেও বেশি ভালোবাসেন। তার নাতি মুগ্ধকে যখন পু'লি'শ খু'নি হিসাবে সন্দেহ করতে লাগল, এবং তিনি যখন এটা জানতে পারলেন, তখন সে নিজেই সাক্ষী হিসাবে উপস্থিত হয়েছেন। তার নিকট মুগ্ধ কেবলমাত্র এক দুষ্টু নাতি নয়; মুগ্ধ তার জীবনের আলো, তার এক চিলতে ক্ষুদ্র হাসির কারণ ।
ইন্সপেক্টর নিয়াজ সাহেবের মুখ থমথমে ও কঠিন হয়ে আছে। ওই অ'স'ভ্য বে'য়া'দব ছেলেটা কি কোনো ভাবে তাকে কু'কু'রের সঙ্গে তুলনা করে গেলো নাকি ডিরেক্ট কু'কুর বলে গেলো? কথাটা ভাবতেই তার মনের ভেতর ক্রো'ধের আ'গুন দা'উদাউ করে জ্বলছে। এতদিন তো তার বাবার অ'প'মান সহ্য করতে হয়েছে, আর আজ নিজেই এই বে'য়া'দব ছেলে তার সহ্যের সীমা শেষ করে দিয়ে তার সম্মান ও পেশাগত মর্যাদার এমন অবমাননা করে গেল যে, নিয়াজ সাহেব আর মুখ তুলে মাথা উঁচু করে থাকতে পারছেন না। তার চারিপাশের লোকজন যেন তার দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে; তাদের নিরব চাহনি যেন তাহার চরিত্রকে চূ'র্ণ করে তুলছে।
এই কয়েক মিনিটের কথোপকথনে মুগ্ধ তো তাকে কথা বলতে দিলোই না বরং তার পেশা ও ব্যক্তিত্বকে ক'ল'ঙ্কি'ত করে গেলো, যে ল'জ্জায় মাটির সাথে মিশে যাবার উপক্রম। তার সম্মানের অস্তিত্ব যেন মুছে ফেলল ওই অ'স'ভ্য ছেলেটা। নিয়াজ সাহেব হঠাৎ করে রা'গে মুষলধারে আ'গুন হয়ে উঠলেন, তার গলাতে একরাশ ক্রো'ধের স্বর দিয়ে তিনি চারিদিকে তাকিয়ে ধমকালেন,
— " এই! এখানে কি নাটক চলছে? কি দেখছো তোমরা?? সবাই এখান থেকে বে'রিয়ে যাও! যাও সবাই!
তার ধমকের আওয়াজে উপস্থিত সকলেই চমকে উঠে ধীরে ধীরে চোখমুখ কালো করে যে যার কাজে করতে লাগল। নিয়াজ সাহেব স্বজোরে টেবিলের উপর হাত দিয়ে আ'ঘাত করে বসে পরলেন।
-------------
নতুন দিবসের আগমন, মাঝে পেরিয়েছে দু'দিন , মুগ্ধ তার মায়ের অনু'নয়-আহাজারিতে ঔষধ সেবন করেছে যথারীতি। সে এখন সম্পূর্ণরূপে সুস্থ। তথাপি গত দুইদিনে পিতৃগর্ভ মোশারফ সাহেবের সহিত বাক্য বিনিময় করেনি। পিতা ও পুত্র নীরবতায় দ্ব'ন্দ্ব রচনা করছে যেন! কিন্তু মোশারফ সাহেব আ'ত'ঙ্কে দিনযাপন করছেন, ভ'য় তার, পুত্র যেন পুনরায় শিকদার বাড়ির কন্যাকে বিবাহ করতে না চায়। কেননা, এবার যদি বলে ফেলে, নিশ্চয়ই বাড়ির সকলের সম্মুখে বলবে। আরম্ভে কেবলমাত্র মোশারফ সাহেব এবং সাজ্জাদ সাহেব জানতেন।
মোশারফ সাহেব স্থিরবিশ্বাসে যে, এটা তাদের দুই ভ্রাতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ । কিন্তু দু'র্ভা'গ্যক্রমে আড়ি পেতে আরাফ শ্রবণ করেছে এই গো'পন সংলাপ; এই তথ্য মোশারফ সাহেব অবগত নন। তথাপি, পুত্র যেন এই বিষয়ে কিয়ৎকাল মূক থাকুক, সেই প্রার্থনায় তিনি আজও সজাগ। যদি এটা প্রকাশ পায়, পরিসরব্যাপী কে'লে'ঙ্কা'রি আবরণে বিস্তৃত হবে। তবে মুগ্ধ এই দুইদিনেও এটা প্রকাশও করে নি, যা মোশারফ সাহেবকে অধিকতর আশ্চর্য করেছে। সাজ্জাদ সাহেব তো মনে করছেন, মুগ্ধ বোধ হয় জ্বরের তাড়নায় বিষয়টি ভুলে গিয়েছে, তাই আর বলে নি । কিন্তু মোশারফ সাহেব ভাবেন, এটা সত্য নয়—তিনি তো তার ছেলেকে ভালো করেই চিনেন, জানেন; মুগ্ধের মৌনতার অন্তঃস্থলে কোনো গভীর কারণ নিহিত আছে এটা মোশারফ সাহেব নিশ্চিত।
এর পরেও মুগ্ধের অনু'পস্থিতি পরিবারে কিয়ৎকালের বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। মুগ্ধ বাড়িতে থেকেছে খুবই কম সময়, অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছে বাহিরে। কেবল মমমতাময়ী মা, দাদি এবং চাচির অনুরোধে শুধু খেতেই বাড়িতে এসেছে। মোশারফ সাহেব তাতে রু'ষ্ট; পুত্রের এমন বে'প'রো'য়া আচরণের প্রতি তিনি বেশ বি'র'ক্ত । কিরূপে এমন বে'য়া'দব পুত্রকে সকলেই মাথায় তুলে রাখতে পারে, তাই তিনি ভাবতে পারেন না; সবই যেন এক অদ্ভুত প্রহেলিকা!
আরেকদিকে, শান্তর অনুপস্থিতি তার পরিবারে কারো প্রতিই কোনো প্রভাব ফেলে নি। কারণ, এ রকম আকস্মিক গায়েব হওয়া তার নিত্য অভ্যাস। কখনো কখনো এক মাস ধরে সে বাড়ির দিকে ফিরেও তাকায় না। কোথায় যায়, কী করে, এসব কাওকে বলেও না, ইচ্ছে করলে ফোনে সংবাদ দেয়, না হলে নীরবতার অন্তরালে হারিয়ে থাকে। এটাই শান্তর স্বভাব। তাই তার এ দু'দিন নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারটায় কেও তেমন বিষেশ নজর দেয় নি।
তবে, আফিয়া বেগম, মাতৃ হৃদয়ের মমতা কি সেইসব বুঝে? সন্তানের প্রতি মাতার অন্তর্দৃষ্টির ডোর সর্বাগ্রে টেনে উঠে। মনটা কেমন সন্তানের জন্য হা'সফা'স করে আফিয়া বেগমের। দুঃ'স্বপ্ন দেখেছেন ছেলেকে নিয়ে, আ'তকে উঠে ভ'য়ে কা'ন্না'কাটি শুরু করেছেন আফিয়া বেগম! ছেলে তার বাড়ি কেন ফিরছে না? অতঃপর তিনি ইকরাম আলীকে পুত্রের সন্ধান করতে অনুরোধ করলে ইকরাম আলী নির্বিকারভাবে প্রত্যুত্তরে বললেন,
— "তোমার ছেলে কোথায় কি করছে, সেটা আমার দেখার বিষয় না। এটা তো তোমার ছেলের পুরনো অভ্যাস। আমার কি আর কোনো কাজ নেই নাকি যে তোমার ছেলে কোথায় কী করছে খোজ নিতে যাব? আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি তোমার ছেলে আমার নাম ব্যবহার করেই দেখো গিয়ে ফু'র্তি করছে। কাজকর্মের তো কোনো বালাই নেই,, যত্তসব!! "
তবু, মায়ের হৃদয় কি তা শুনে মেনে নিতে পারে? মা তো মা'ই হয়!
0 Comments