লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা


কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।


——— "আপনি কি পা'গ'ল?? ছেড়ে দিন ওনাকে!! "
হঠাৎ আঁখির চিৎকারে বিমূঢ় মুগ্ধ, র'ক্তা'ভ দৃষ্টিতে পেছন ফিরে তাকালো! সে তখনও আক্রোশে এক ব্যক্তিকে অমানবিকভাবে প্রহার করছিল। আঁখির কণ্ঠস্বর শোনার পরই সে থেমে গেল, এবং সেই ব্যক্তি প্রাণ হাতে নিয়ে পালালো! আশেপাশের জনতা নির্বাক, সকলেই মুগ্ধকে চিনে, তাই কেউ কিছু বলার ধৃষ্টতা দেখালো না। মুগ্ধের রো'ষ এবার আঁখির দিকে নিবদ্ধ। সে পকেটে হাত ঢুকিয়ে, ভীষণভাবে সামনের দিকে ঝুঁকে, আঁখির চোখে তীব্র ক্রো'ধে তাকিয়ে। এমনই তার দৃষ্টির তীব্রতা যে, মেয়ে না হলে বোধকরি তাকে মাটিতে আছাড় দিত! আঁখি অপ্রস্তুতভাবে বলল,
——— "সবাই দেখছে, এসব সিনক্রিয়েট করা বন্ধ করুন!"
মুগ্ধ দাঁত চেপে বলল,
——— "যখন লোকটা তোমার দিকে হাত বাড়াচ্ছিল, তখনো সবাই তাকিয়েছিল। তবে কেন ছিল তখন তাদের নিষ্ক্রিয়তা?"
আঁখির চোখেমুখে বি'র'ক্তি ছলছল করল,
——— "মানুষের ভিড়ে আমি খেয়াল করিনি।"
মুগ্ধ ধীরে ফিসফিসিয়ে, বিষাদমিশ্রিত ক্রো'ধে বলল,
——— "এখানে কেউ কি তোমার জন্য আলাদা পথ বানিয়ে দেবে? ভিড়ে কেন এসেছ? জানোনা, এ জগতে জা'নো'য়া'রে পূর্ণ?"
——— "আমি তো স্রেফ হাঁটছিলাম। হঠাৎ করেই এত ভিড় জমল,"
আঁখি অনুগত স্বরে বলল। মুগ্ধের কণ্ঠ তীক্ষ্ণ হলো, যেন ছু'রি চালিয়ে কা'ট'ছে বাতাস,
——— "হাঁটছিলে? এ পথ কি তোমার ব্যক্তিগত উদ্যান? আশেপাশে যে রা'ক্ষ'সে ভরা, তা কি তুমি জানো না?"
আঁখির কণ্ঠে অসন্তোষ ধ্বনিত হলো,
——— "এটা ছিল একটা তুচ্ছ ঘটনা, আর কিছু নয়। আপনি দয়া করে এটা বড় করবেন না।"
মুগ্ধ এক ভ্রু তুলে, চোখের তীব্র দৃষ্টিতে আঁখির দিকে তাকিয়ে বলল,
——— "তাহলে তুমি কি শুধু অপেক্ষা করছিলে কিছুর ঘটার?"
আঁখির সবর চূ'র্ণ হলো, সে কঠিন স্বরে বলল,
——— "আমাকে নিয়ে আপনার দুশ্চিন্তা করা দরকার নেই! আমাকে ছোঁয়া সহজ ব্যাপার নয়।"
মুগ্ধ এক বিদ্রূপের হাসি হেসে বলল,
——— "শুধু কৌশলে কেউ দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ছুঁয়ে যাবে, তাই তো?"
আঁখি তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
——— "ধন্যবাদ, ভাইয়া । আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবে না। কেউ যদি আমাকে ছোঁয়ার দুঃসাহস করে, তবে তাকে আমি ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নই!"
মুগ্ধ চোখ বুজে, এক গভীর শ্বাস ফেলে বলল,
——— "তোমাকে স্পর্শ করবে হুম? কেন করবে? নিজেকে এমনভাবে গড়ো, যেনো কেউ স্পর্শের পূর্বেই তার হাত চূ'র্ণ করে দিতে পারো!"
এ বলে মুগ্ধ সোজাসুজি ভঙ্গিতে দাঁড়াল। কিঞ্চিৎ সংকীর্ণ নেত্রে মেপে দেখল আঁখিকে। সামান্য এই মেয়েটির সাথে কথা বলতে হলে অবধারিতভাবে তাকে দেহভঙ্গি নুইয়ে আনতে হয়। বক্ষকে আড়াল করে মাথা অবনত হয়ে যায় অনায়াসে। পরমুহূর্তে গম্ভীর চিত্তে উল্টো পথে হাঁটা ধরল। দৃঢ় পা ফেলে অগ্রসর হলো, তবু একবারও পিছন ফিরে দেখল না।
———"নিমন্ত্রণ করতে হবে?"
মুগ্ধর কন্ঠের গাম্ভীর্যে প্রশ্নটি আকাশে রয়ে গেল। আঁখি, মুখ ভার করে, ধীর পায়ে পেছন পেছন অগ্রসর হতে লাগল।
--
দিনাজপুর শহর সমীপে মিলির বিবাহ অনুষ্ঠানের সমুদয় আয়োজনের পূর্বপ্রস্তুতি সম্পন্ন করতে মিলির পরিবারসহ হবু শ্বশুরবাড়ির পরিবার সমবেত হয়েছে। দিনাজপুরের অতি প্রসিদ্ধ শাহারিয়াজ বিপণি-বিতান এই উপলক্ষে ব্যস্ততায় মুখরিত। মিলির পিতা হাবিবুর রহমান, মাতা জবেদা বেগম, এবং ভ্রাতা শুভর সাথে মিলির হবু পতি ফাহাদ, শ্বশুর করিম সাহেব, শাশুড়ি আজমিরা বেগম, ননদ রিয়া এবং তার স্বামী খলিল সাহেব ও একমাত্র পুত্রসহ অন্যান্য আত্মীয়স্বজন একত্রিত । সঞ্চয় ও প্রাচুর্যে অবশ্যই ফাহাদের পরিবার অধিকতর উচ্চমানের।
আশ্চর্য হলেও যেহেতু বিবাহের যাবতীয় দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে আরাফ, যে উপস্থিত রয়েছে। অপর দিকে মিলির সুহৃদ আঁখি ও আছিয়া, তাদের মিত্রভাবনা প্রদর্শন করতে সহগমন করেছে। উভয় পক্ষের মিলিত প্রয়াসে কেনাকাটা কার্যক্রম সম্পন্ন হবে, কন্যাপক্ষ বরপক্ষকে বিবাহের নিমিত্ত যাবতীয় যা প্রয়োজন তা দান করবে, এবং বরের পরিবার কনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করবে। এটা উভয় পরিবারের বহুপ্রাচীন প্রথার অংশ।
শাহারিয়াজ পরিবারের অধীনে এই শপিং মলটি হবার দরুন আঁখি, শিকদার পরিবারের কন্যা, এখানের সন্নিকটে আসতে পারবে না বলেই পরিবারবর্গ কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। তাদের অমোঘ আদেশ; যদি কেনাকাটা করতে হয়, আরো বৃহৎ ও খ্যাতিমান বিপণী বিতান রয়েছে, প্রয়োজনে ঢাকা কিংবা বিদেশেও শপিং করিয়ে দিবে, তথাপি শাহারিয়াজের অঙ্গনে তার পা রাখা সম্পূর্ণরূপে বর্জনীয়। একমাত্র এই ক্ষুদ্র ঘটনা নিয়ে যে উত্তাল প্রবল হল শিকদার পরিবারে, তা কল্পনাতীত! বিষয়টি নিছক কেনাকাটা করবার সমস্যা নয়; আঁখির অতি প্রিয় বান্ধবীর বিবাহযজ্ঞে তার সার্বক্ষণিক উপস্থিতি কি অতি জরুরি নয়? কিন্তু ইকরাম আলী, কুদ্দুস আলী, এবং আজগর আলী একযোগে আঁখির শপিং মলে গমনপথ সম্পূর্ণরূপে রুদ্ধ করেছেন। তাদের স্পষ্ট বাক্য— শত্রুর অধীনে কোনো স্থানে গমন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, পাশে থাকতে মানা নেই, কিন্তু এই সীমা ল'ঙ্ঘ'ন করা যাবে না।
অবশেষে, আঁখি ত্বরিতভাবেই তার ভাগ্য মেনে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু নাঈম কি তা সহ্য করতে পারে? কিরূপে তা সম্ভব? সে বীর্যবান যুবক প্রবল ক্রো'ধে ও যু'দ্ধে তার পিতা ও চাচাদের নিকট হতে অনুমোদন আদায়ে সংকল্পবদ্ধ হয়। রোকেয়া বেগম ও কানিজ বেগমের গূঢ় সহযোগিতা নিয়ে, নাঈম আঁখিকে অবশেষে নিয়ে আসে। তার যুক্তি— বান্ধবীর বিবাহে যদি সাথেই না থাকতে পারে, তবে কি এই আনন্দের মূল্য? আনন্দ তো এখানে একত্রিত হয়েই! সুতরাং আঁখিকে টেনেই গাড়িতে তুলে এনেছে, যেন তাকে উৎসব হতে বঞ্চিত না করা যায়।
শপিং মলে সর্বজন সমাগত হবার পরপরই একপ্রকার উত্তাল অবস্থা শুরু হল। বিপুল জনতার ভিড়ে স্থানটি যেন স্নিগ্ধ বাতাসও গুমরিয়ে উঠছিল। আঁখির জন্য মিলির হবু শ্বশুরবাড়ির সম্মুখে থাকবার প্রবল অস্বস্তি ; এত মানুষের সামনে বসে থাকবার যন্ত্রণা তার সহ্য হলো না। অতঃপর আছিয়া, আঁখি, এবং নাঈম পাশেই অবস্থান করতে লাগল। অন্যদিকে, আরাফ মিলির পিতা হাবিবুর রহমানের সহিত রতিলাভ করতেছিল।নিরন্তর আঁখির প্রতি দৃষ্টিপাত করছে সে, কিন্তু তার নিকট উপস্থিত হবার সুযোগ তার মিলছে না। দায়িত্ব নেওয়া কি কেবল বচন মাত্র? সকল বিষয়ে সতত উপস্থিত থাকতে হচ্ছে ! এই স্থানে জনতার অনবরত ভিড়, ফলে মনের অন্তঃস্থলে নানা ভাবনা উদিত হচ্ছে। তথাপি, যেহেতু নাঈম আঁখির সহিত রয়েছে, তাই কিছু পরিমাণে নিশ্চিন্ততার আশ্রয় লাভ করছে, অন্তত অল্পস্বস্তির অবকাশ খুঁজে পাচ্ছে।
হঠাৎ করেই নাঈমের ফোন বেজে উঠল। তা গ্রহণ করে বাহিরে গিয়ে আর ফিরল না। ইতিমধ্যে আছিয়াও জীবনের কোন এক অন্তর্লোকে হারিয়া গেল; খুঁজে খুঁজে তারও সন্ধান মিলল না। আঁখি থাকল নিঃসঙ্গ, একলা। মিলির কাছে যাওয়ারও উপায় রইল না। মিষ্টি মেয়েটি তো হবু স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির কোলাহল পেয়ে তার সহচরীকে সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হয়ে পড়েছে। ইচ্ছামতো কেনাকাটা চলছে তার। মাঝে মাঝে চোখে মৃদু ভঙ্গিতে হবু স্বামী ফাহাদের প্রতি এক বিশেষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে, এবং হেসে লজ্জাবনত হচ্ছে।
কিন্তু এই মৃদু মধুর হাসি নন্দিত হল না মিলির শাশুড়ি ও ননদের অন্তরে। তাঁদের দৃষ্টিতে এ যেন বেহায়াপনা, অতি অসংলগ্ন। তাঁদের অভিমত— এখনকার কন্যারা এমন বেহায়া হল কিরূপে?
একা থেকে বিরক্ত আঁখির মন হঠাৎ করেই চিন্তান্বিত হল, এ যাত্রায় সারা বিপণি-বিতানটি ঘুরে দেখা যাক! ইতোপূর্বে এর সান্নিধ্যে আসবার সুযোগ হয় নি, ভবিষ্যতেও আর আসবার সম্ভাবনা অজ্ঞাত। এমনিতেও শপিং মলটি অপূর্ব, দৃষ্টিনন্দন— বিশাল পাঁচতলায় বেষ্টিত। পুরোটা ঘুরে দেখলে সময় যে অতি সহজেই পার হয়ে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না। ভাবল, হয়তো আছিয়াকেও খুঁজে পাবে। সেই ভাবনা নিয়েই আঁখি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে এক কোণ হতে অন্য কোণে বিচরণ করছিল।
হঠাৎ করেই আঁখি অনুভব করল, তার চারিপাশে লোকজনের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে উঠছে; ভিড় জমেছে এত অধিক, যে তা বুঝতে পারেনি। সেই ভিড়ের মাঝেই হঠাৎ এক বয়স্ক লোক, বাবার সমবয়সী, আঁখির নিঃসঙ্গ অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করতে উদগ্র আগ্রহ প্রকাশ করল। অনেকক্ষণ ধরেই লোকটি আঁখিকে লক্ষ করছিল, ভেবেছে বোধহয় মেয়েটি হারিয়ে গিয়েছে। ভিড়ের সুযোগ নিয়ে লোকটি আঁখির পিঠে অ'শ্লী'লভা'বে স্পর্শ করার লা'ল'সা দমন করতে ব্যর্থ হল। কিন্তু কপাল তার! স্পর্শের আগেই কোথা হতে যেন মুগ্ধ ব'জ্রসম এক আগমন ঘটাল! কোনো কথা বলারও অবকাশ না দিয়ে মুগ্ধের শক্ত ঘুষি লোকটির নাকে আঘাত হানল। লোকটি এক ধাক্কায় ছিটকে পড়ল। আঁখিসহ আশেপাশের সকলেই স্তম্ভিত!
আঁখি মুগ্ধকে দেখে যেন শিহরিয়া উঠল। তার অন্তরে বজ্রাঘাত ঘটল; এতদিন পর মুগ্ধ হঠাৎ এখানে? আকাশ হতে যেন মাটিতে পড়ল আঁখি ! মুগ্ধ তার পিছনে কী করছে? আর ঐ লোকটিকে কেনই বা আ'ঘা'ত করল? আঁখির বিস্ময় সীমাহীন; নিঃশব্দে মুগ্ধের দিকে হা করে তাকিয়ে রইল। সে শুনেছিল, একমাস ধরেই মুগ্ধ নিখোঁজ, তার সঙ্গে কারো কোনো যোগাযোগ ছিল না। এতদিন পর এই রহস্যময় পুরুষ এখানে কী করছে? পরক্ষণেই অন্তরপথে উদিত হলো এটা তো তাদের-ই স্থান; কেন সে আসবে না?
সবকিছু স্পষ্ট হল তখনই, যখন সেই অর্ধবয়স্ক লোকটি দুটি ঘু'ষি খেয়ে আঁখির নিকট ক্ষমা চাইল। আঁখি আরো আশ্চর্য হল, কারণ সে তো কিছুই টের পায় নি, এমনকি বুঝতেও পারেনি কী ঘটছিল। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা উন্মোচিত হল যখন লোকটি ক্ষ'মা চাওয়ার পরও মুগ্ধ ক্রমাগত আ'ঘা'ত করতেই থাকল। যেন কোনো অসং'বর'ণীয় ক্রো'ধ তার অন্তরে জ্বলে উঠেছে, আর সে ক্রো'ধে আকাশ-বাতাস কম্পিত হচ্ছে !
---
মুগ্ধ বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে চলতে লাগল। অন্তরে ক্রোধ; এই রমণী হেঁটে হেঁটে কতদূর এসেছে, ভাবতেই আঁখির উপর ক্রো'ধ আরো প্রবল হল। তার সঙ্গেই এমন হবে না তবে আর কার সঙ্গে হবে? আঁখি মুখ গোমড়া করে পেছনে পেছনে যাচ্ছে, যেন নিজের মনেই ক্ষু'ব্ধ ছিল।
ঠিক সেই মুহূর্তেই, হঠাৎ করেই বাতাসের বেগে সামনের দিক হতে তালগাছের মতো এক লম্বাবতী কন্যা মুগ্ধকে পাশ কাটিয়ে প্রচণ্ড ধাক্কায় আঁখির উপর পতিত হল। প্রকৃতপক্ষে, মুগ্ধের সুঠাম বাহুর আড়ালে যে ক্ষুদ্রদেহী আঁখি ছিল, তাহা লম্বাবতী রমণীর দৃষ্টিতে পড়েই নি। ফলে, মুহূর্তেই উভয়ে উলটিয়া পড়ল ফ্লোরে । আঁখির ঠিক উপরে সেই কন্যা গড়িয়ে পড়ল; এমনভাবে চেপে ফেলল যেন আঁখি শ্বাস পাবার উপায়ও না রাখল!
আঁখি যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগল, কাই কুই শব্দ করে কষ্টে দম বাঁধা দিয়ে ফেলল। সেই কন্যাটিও উল্টে পড়ে মুখ থুবরে নাসিকা ফ্লোরে গিয়ে পড়ে গোঙ্গাতে লাগল। এই আকস্মিক ঘটনায় মুগ্ধ হঠাৎ স্তম্ভিত হয়ে গেল। হন্তদন্ত হইয়া দ্রুত সেই লম্বা মেয়েটিকে সরিয়ে ফেলল, পরমুহূর্তেই আঁখিকে শক্ত হাতে এক হেচকা টানে শুয়া থেকে তুলে দাঁড় করালো! আশেপাশের লোকজন হা করে চমকিত দৃষ্টিতে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করতে লাগল।
কিন্তু মুগ্ধের ক্রো'ধ যেন সপ্তম স্বর্গের সীমা অতিক্রম করে। তার অন্তরাত্মায় ইচ্ছা জাগে, যেন নীচে বসে থাকা বটবৃক্ষসম কন্যাটিকে মুহূর্তেই কোনো শাস্তি দিতে পারে! নিঃশ্বাস নিলো গভীরভাবে, চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে, অনন্ত ক্রোধের তাপে চোখ খুলে দেখলো আঁখির দিকে; যে অবুঝ শিশুর মতো নিরীহভাবে মাথা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রোধের বিস্ফোরণে তার কণ্ঠ ঝড়ের মতো প্রতিধ্বনিত হলো,
——— "এই মেয়ে, তুমি কি শিশু? সোজা পথে দুই পা ফেলতে পারো না? তোমাকে কি কোলে তুলে হাটতে হবে? অ'স'ভ্য কোথাকার! "
মুগ্ধের গর্জনে আশেপাশের মানুষের মন আন্দোলিত হলো, যেন গহীন অরণ্যে গর্জন করেছে বাঘ। এমন সময় প্রিয়া উঠে দাঁড়ালো, ভয় তার মুখে স্পষ্ট, নাক ডলতে ডলতে মৃদু স্বরে বলল,
——— "ভাই, দয়া করে ওকে কিছু বলবেন না! আসলে ভুলটা আমারই হয়েছে। আমি তাড়াহুড়ো করে এগোচ্ছিলাম, কিন্তু আপনার পেছনে যে ও ছিল, তা খেয়াল করিনি! ও তো ছোট; দয়া করে কিছু বলবেন না!"
মুগ্ধের চোখ প্রিয়ার দিকে ঘুরলো, কিন্তু ক্রো'ধ তখনো তার র'ক্তে উত্তপ্ত। মনে হলো, কন্যাটি মুগ্ধর বয়সের সমান, তবু কণ্ঠের গম্ভীরতায় মুগ্ধ কঠিন স্বরে বললো,
——— "অনেক ক্ষুদ্রজীব আশপাশে বিচরণ করে, দ্বিতীয়বার চলার সময় দৃষ্টি নামিয়ে চলতে ভুলবেন না! অন্যথা, যা আজ ঘটেছে, পুনরায় আবারও কাওকে পি'ষে ফেলবেন!’’
প্রিয়া কিছুটা থমকে গেল, তবুও সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। তার উচ্চতা ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি, প্রকৃতপক্ষে আঁখির মতো ছোটখাটো কাউকে সে তাড়াহুড়োর মাঝে খেয়াল করেনি। তবুও কিছু বলার প্রয়াস করলো প্রিয়া, কিন্তু মুগ্ধর রাগ তখনো যেন আগুনের মতো জ্বলছে। আঁখির দিকে চেয়ে দাঁত কটমটিয়ে নির্দেশ দিলো,
——— "চলো এখান থেকে!"
আঁখির মাথা যেন ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে, কিন্তু তার ক্রো'ধে যেন মাথার শিরাগুলো বি'স্ফো'রিত হচ্ছে! এই লোকের সাহস হয় কীভাবে তাকে ধম'কা'নোর? এমনভাবে অ'প'মান করার? আঁখি কি তাকে ডেকে এনেছে? আঁখি বুঝে আসে না কেন যখনই মুগ্ধ আসে, তখনই সে কোনো না কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়? আঁখির মাথায় ঘুরপাক খায়—এই পরিস্থিতি হলে মুগ্ধ আসে, নাকি মুগ্ধ সামনে এলেই এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়? ক্রোধে আঁখি বলে উঠলো,
——— "আমি কোনো শিশুকন্যা নই, আমি নিজের পথ একা চলতে পারি!"
এই বলে আঁখি জোরে পা ফেলে হনহনিয়ে চলে গেলো, যেন প্রতিটি পদক্ষেপ তার ক্রোধের প্রতিচ্ছবি। প্রিয়া না চাইতেও ফিক করে হেসে উঠলো, কারণ পুরো পরিস্থিতি তাকে সাপে-নেউল দ্বন্দ্বের মতো মনে হলো, আঁখি আর মুগ্ধর মাঝে। মুগ্ধ তার সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে আঁখির চলে যাওয়ার দৃশ্য নিরীক্ষণ করছে, যেন প্রতিটি মুহূর্ত তার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে। শীতল কিন্তু গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
——— "তোমার এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র চুনোপুঁটির তেজ আমার সামনে নিতান্তই অর্থহীন! তুমি এখনো জানো না, তুমি কোন ব্যাক্তির দৃষ্টিসীমায় প্রবেশ করেছো।"
__
প্রিয়া নীরবে পথ ধরল, তবে পা ফেলল খুব সতর্কতায়!! আবার কখন কাকে পদতলে পিষ্ট করে ফেলে সে সন্দেহে। কিছু দূর যেতেই দৃষ্টি পড়ল রুদ্রের দিকে-অ'গ্নি শিখার ন্যায় দপদপ করে সে এগিয়ে আসছে! তার সাথে চিন্তিত চেহারায় ঊর্মিলা বেগম, রুদ্রর চাচি। রুদ্র প্রিয়াকে দেখে, কপালে ভাঁজ ফেলে, ক্ষু'ব্ধ স্বরে উচ্চারণ করল,
——— "তুমি কি আমাকে চোর-পুলিশের খেলায় নামিয়েছো? বে'য়া'দব মেয়ে কোথাকার! কতক্ষণ ধরে খুঁজছি তোমাকে! এই কারণেই তোমার মতো নীচু শ্রেণির মেয়েকে সঙ্গে আনার ইচ্ছা ছিল না।"
রুদ্রর মুখে এই বিষোদ্গার বাক্য উচ্চারিত করে, চাচির হাত ধরে দ্রুত পা চালিয়ে বাইরে যেতে লাগল। মূলত, রুদ্রর এই আগমন ছিল চাচির আবদারের ফল, যিনি কিছু কেনাকাটা করতে চেয়েছিলেন। অথচ এটিও এক ভণিতা মাত্র! আসল উদ্দেশ্য ছিল, রুদ্র যেন প্রিয়ার সাথে কিছুক্ষণ একান্তে সময় কাটাতে পারে; ঊর্মিলা বেগমের মনের এই অভিপ্রায় সুস্পষ্ট। উপরন্তু, প্রিয়ার জন্য নতুন পোশাক কেনার প্রয়োজনও ছিল; মেয়েটি সবসময় পুরোনো পোশাকেই দিন পার করে। তাই এক ঢিলে দুই পাখি মা'রা'র অভিপ্রায়ে ছিলেন ঊর্মিলা বেগম। কিন্তু প্রিয়া কোথায় যেন অদৃশ্য হয়েছিল! রুদ্রর তো সময় নেই এভাবে মার্কেট করিয়ে দেয়ার, তবু কোনোরকমে সুযোগ বুঝে সে এসেছিল। কিন্তু প্রিয়াকে খুঁজতেই যতক্ষণ গেল! প্রিয়াও মুখ গোমড়া করে রুদ্রর পিছু পিছু দৌড়াতে লাগল। রুদ্রর পাশে এসে দাঁড়িয়েই বলল...
———— "আমার ভুল হয়ে গিয়েছে! সরি! আর তুমিই তো আমার থেকে ফোন কেরে নিয়েছো! যদি ফোন থাকত তাহলে তো কল করে জানতে পারতে! হুহ"
রুদ্র দাঁড়িয়ে এক তীব্র দৃষ্টিতে প্রিয়ার দিকে তাকাল, যেন চোখে বিদ্রূপের শিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে। গভীর ক্রো'ধে বলল,
——— "তোমার কাছে সময়ের মূল্য নাই বা থাকতে পারে! কিন্তু আমার প্রতিটা সেকেন্ড অমূল্য!"
এ কথার পর কোনো প্রতিক্রিয়া অপেক্ষা না করেই, রুদ্র তীব্র গতি নিয়ে হনহনিয়ে এগিয়ে চলল। প্রিয়া কিছুক্ষণ স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রুদ্রর সেই দুরন্ত যাত্রাপথের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে, ফিসফিসিয়ে বলল,
——— "তোর জন্যই তো আমি আমার জীবনটা ত্যাগ করেছি। তার কি মূল্য হবে? কয়েকটি বছর অকস্মাৎ শেষ করে দিলাম তোর কারণে!"
আর কিছু বলল না, শুধু ধীরে ধীরে রুদ্রর পিছু নিয়ে চলতে শুরু করল। রুদ্র ইতিমধ্যেই প্রিয়ার সম্পর্কে সব তথ্য সংগ্রহ করেছে। মেয়েটি এক সময় বস্তিতে বাস করত, সেখানেই তার শৈশব কেটেছে। কিন্তু তবুও রুদ্রর কাছে মেয়েটা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। তবুও, এক অদ্ভুত সখ্যতা বোধ করে, যেন তার সাথে কোনো অদৃশ্য যোগসূত্র আছে। তবু, এইসব অনুভূতিকে রুদ্র কোনো গুরুত্ব দেয় না। তার বাড়িতে এই মেয়ের পাশে তার চাচিকে একা রেখে যায় না। সবসময় দুজন সিআইডি অফিসারকে কাজের লোকের ছদ্মবেশে রেখেছে নজরদারিতে। প্রিয়া কিছু করলেই, রুদ্রর আদেশে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে!
---
আঁখি নিঃশব্দে চলতে চলতে পৌঁছালো সেই স্থানে, যেখানে মিলি কেনাকাটায় মগ্ন ছিল। কিন্তু পৌঁছেই চমকে উঠল; কোথাও কারো চিহ্নমাত্র নেই! এখন কী করবে আঁখি? এত বিশাল মার্কেটে কোথায় খুঁজবে তাদের? নাঈমই বা কোথায় গেলো, আঁখিকে এভাবে ফেলে? হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে সে ধপ করে নিকটস্থ আসনে বসে পড়ল। নাঈমকে না পেয়ে এখন নিজেই একা একা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। হেটেই যাবে লাগবে না কোনো গাড়ি!
এই সময় মুগ্ধ এসে উপস্থিত হল। আঁখি মুখের অভিব্যক্তি দ্রুত কঠোর করে ফিরিয়ে নিল, যেন তার প্রতি বির'ক্তি ফুটে উঠছে। এই লোককে সে আর দেখতে চায় না! একদম কুফা আঁখির জন্য। মুগ্ধ তার ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে ফোন বের করল, যেন কোনো গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে উদ্যত। এরপর আঁখির দিকে ফিরে তপ্ত শ্বাস ত্যাগ করল,চোখে অদ্ভুত দৃঢ়তা।
——— "অনেক দিন পর??"
পশ্চাত হতে প্রতিধ্বনিত হলো নাঈমের কণ্ঠস্বরে ব্যঞ্জিত এক দুর্বোধ্য মৃদুতা। ঠোঁটে তির্যক হাসির মৃদু রেখা, গতি ধীর! মুগ্ধর দিকে ক্রমশ অগ্রসরমান। মুগ্ধর মুখমণ্ডলেও এক রহস্যময় বক্র হাসি!
নাঈম করতল প্রসারিত করিল, মুগ্ধও বিনা বাক্যে সেই করস্পর্শ গ্রহণ করল। মুহূর্তটি ক্ষণিক, অথচ অন্তর্লোকে তীব্র ও গভীর!! দুজনেই সুদীর্ঘ, বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী, গৌরবর্ণে দীপ্ত!! নিঃশব্দে দুই দৃষ্টি পরস্পর মিলিত হয়ে বহু অপ্রকাশিত বাক্যের আদানপ্রদান করছে।
নাঈম বক্র হাস্যে বলল,
——— "সাবধান !"
——— "তোমার উচিৎ !"
বাকা হেসে মুগ্ধর শীতল প্রতিত্তোর।
——— "ধ্বং'স আসন্ন! ধারণার অতিক্রমে ভয়াবহতা।"
——— "ধ্বং'স নিয়েই খেলছি।"
——— " শেষ হয়ে যাবে!"
——— "বি'ষা'ক্ত'তা আমার র'ক্তে'র সঙ্গী!"
——— "জানো না, কোন গূঢ় খেলায় প্রবেশ করেছ! অন্ধকার গিলে নেবে!"
ঠোঁটে তীর্যক হাসির রেখা ফুটিয়ে মুগ্ধ বলল,
0 Comments