লেখিকাঃ তাহিনা আইরাত ইরা
"উড়ে যাক মনের পক্ষিদল, মুছে যাক সব আশা"
ডাইরিতে শেষ লাইন টা লিখে উঠে যায় মোহ। নিজের মনের সব কথা ডাইরিটা তে লিখে রাখে সে। আপাতত এই ডাইরিটাই তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু।
নিস্তব্ধতা ভেদ করে আচমকা কলিংবেল বেজে ওঠে। ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটায় মোহ কিছুটা বিরক্ত হয়। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখে সামনে বিধ্বস্ত উষ্ণ দাঁড়িয়ে রয়েছে। মোহ বোঝে না, উষ্ণ এখানে কেন। দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এই পুরুষটা এতক্ষন কেঁদেছে। শরীর টাও ভেজা, হয়তো বৃষ্টিতে ভিজেছে। মোহ উষ্ণকে ভিতরে নিয়ে আসে। উষ্ণ এক দৃষ্টিতে মোহ'র দিকে তাকিয়ে। মোহ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। উষ্ণ নিজে থেকেই বলে ওঠে,
- "আমায় বিয়ে করবে মোহ?"
হতভম্ব হয়ে যায় মোহ। উষ্ণ এসব কী উল্টো পালটা বলছে? কপট রাগ দেখিয়ে মোহ বলে,
- "এসব কী বলছো তুমি? তোমার মাথা ঠিক আছে?"
- "আমার মাথা ঠিকই আছে মোহ। তুমি বলো, আমায় বিয়ে করবে?"
মোহ নাকচ করে। উষ্ণ রেগে মোহ'র কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে থাকে।
- "মোহ, তোমায় ভালোবাসি আমি! ভালোবাসি..
উষ্ণের মুখে ভালোবাসি কথা টা শুনে মোহ সজোরে তার গালে একটা থাপ্পড় মারে। উষ্ণ নির্বাক। মোহ নিজ থেকেই বলতে থাকে,
- " উষ্ণ..। তুমি আমার ব্যাপারে কিছুই জানো না। আমায় বিয়ে করলে তোমার জীবন টা শেষ হয়ে যাবে। লোকে খারাপ বলবে তোমায়। আমায় বিয়ে করা লাগবে না তোমার। আরও অনেল ভালো ভালো মেয়ে আছে, তাদের বিয়ে করো তুমি। আমায় ভুলে যাও।"
উষ্ণ শোনে না। পাগলামি করতে থাকে।
- "মোহ, আমি সব জানি। ওরা তোমার সাথে যা যা করেছে তার শাস্তি তারা পেয়েছে। এইযে, তুমি প্রহর কে অবহেলা করছো এটাই যেন ওর কাছে আগুনে পুড়ে মরার সমান। আর নাহিদ ও মাহির তো মরেই গেছে..। তাও তোমার হাতে!"
মোহ হতভম্ব। উষ্ণ এতকিছু কীভাবে জানলো? তটিনীর কাছ থেকেও যদি শোনে তবে মোহই যে ওদের দু'জন কে মেরেছে তা তটিনী কীভাবে জানবে?
হতভম্ব মোহ কে দেখে উষ্ণ বলে,
- "মোহ..। আমায় বিশ্বাস করতে পারো। আমি যদি প্রহরের মতো তোমাকে ঠকাই তাহলে আমায় মেরে ফেলো। অন্তত তোমার জীবনে ঠকবাজ এর জায়গা না হোক।"
মোহ নিস্তব্ধ, নির্বাক। কী বলবে সে? বিষাদসিন্ধু মনে গেথে রয়েছে। কীভাবে কী করবে? বুঝতে পারছে না। ভয় হয়, আবার যদি ঠকে যায়?..
মোহ'র কানে ভেসে আসে উষ্ণের কন্ঠস্বর..।
- "তোমার দহনে আমার হৃদয় জ্বলছে!"
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে মোহ।
- "দহন? তা আবার কী?"
- "বুকের বা পাশের গভীরতা, হৃদয়ের শূন্যতা..। হয়তো এটাকেই দহন বলে..।
মোহ মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছে। হয়তো বিশ্বাস হচ্ছে না উষ্ণের কথাগুলো..
আচমকা জানালা ভেদ করে একটা গুলি মোহ'র পাশের দেয়ালে এসে লাগে। মোহ ও উষ্ণ দু'জনেই চমকে যায়। জানালার দিকে তাকাতেই তাদের চোখ কপালে উঠে যায়। প্রহর! প্রহর করেছে গুলি টা। প্রহরের চোখে আগুন ঝড়ছে। যেন এখনই সেই আগুনে মোহ ও উষ্ণ কে সে ভম্ব করে দেবে।
প্রহর এগিয়ে এসে বলে,
- " মোহ আমার স্ত্রী। আর আমার স্ত্রীকে আমার সামনেই বিবাহের প্রস্তাব দেওয়া কোনো আদর্শ পুরুষের কাজ হতে পারে না।"
- "আমার হয়ে থাকো মোহ। বিশ্বাস করো, আমার জন্য তোমার গায়ে কলঙ্ক লেগেছে আবার আমিই তোমার কলঙ্ক লুকিয়ে রাখবো..।"
প্রহরের এহেন আকুতিভরা কথায় মোহ'র কোনো পরিবর্তন হয় না। যেন সে প্রহরের কথা শুনেও শোনেনি। উষ্ণ একদৃষ্টিতে প্রহর কে দেখছে। সে শুনেছে গিরগিটির রঙ বদলায়। তবে আজ প্রথম দেখলো। উষ্ণ মোহ কে উদ্দেশ্য করে বলে,
- "তুমি যদি তোমার অতীতকে সুযোগ দিতে চাও তবে দিতে পারো..। এটা একান্তই তোমার ইচ্ছা। তবে মনে রেখো, এই উষ্ণের বুকে তার মোহ'র প্রতিচ্ছবি সারাজীবন স্পষ্ট থাকবে।"
বুক কেঁপে ওঠে মোহ'র। উষ্ণের শেষ কথাটা তার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। উষ্ণের পানে তাকায় মোহ। উষ্ণ মোহ'র চোখের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসি দেয়।
- "পাখির মতো উড়ে বেড়াও আমার বিভ্রম। কাউকে ভয় পেয়ো না। চাঁদের গায়ে ও তো কলঙ্ক আছে, সে কী আলো ছড়ানো বন্ধ করে দিয়েছে!? "
মোহ টলমলে চোখে বলে,
- "চাঁদের তো নিজস্ব কোনো রং নেই..। অন্যের আলোয় নিজেকে আলোকিত করে!"
প্রহরের বুকে আগুন জ্বলছে। ভালেবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাওয়ার পরও ধরে রাখতে পারলো না। তার ভৃঙ্গলতা যে তার হয়ে থাকতে চায় না..।
মোহ তার হয়ে থাকতে চায় না বুঝতে পেরে প্রহর সরে যায়। যে নিজে থেকে থাকতে চায় না তাকে ধরে রেখে কী লাভ? উঠে দাঁড়ায় সে। মোহ'র উদ্দেশ্যে বলে,
- "আমার প্রিয় ভৃঙ্গলতা! তুমি যদি আমায় ভালো না বাসো তবে আমি তোমায় জোর করবো না। তুমি আমার সাথে থাকবে কী থাকবে না এটা তোমার ব্যাপার। আমি চলে যাচ্ছি..। উষ্ণ..?
উষ্ণ প্রহরের পানে তাকায়। প্রহর আবারো বলতে থাকে,
- " আমার ভৃঙ্গলতা কে কষ্ট দিও না..। সে যদি কখনো তোমার হাতে আঘাত পায় তবে আমি তোমার হাত কেটে কুকুরকে খাওয়াবো।"
- "আঘাত তো তুমিই দিয়েছিলে আমায়। শরীরে, মনে সব জায়গায়। "
মোহ'র কথায় আর কিছু বলতে পারে না প্রহর। পিছন দিকে ঘুরে হাটতে থাকে। শপথ করেছে সে, আর কোনোদিন পিছনে তাকাবে না। এবার নতুন করে জীবন শুরু করবে।
উষ্ণ মোহ'র হাত ধরে। চমকে ওঠে মোহ। উষ্ণের দিকে তাকাতেই তাদের চোখাচোখি হয়ে যায়। মোহ গভীর দৃষ্টিতে উষ্ণের ওই উজ্জ্বল বাদামি চোখজোড়া অবলোকন করতে থাকে। মোহ'র ভাবনা ভেঙে উষ্ণ বলে,
- "আমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর পাই নি।"
মোহ লাজুক হাসে। উষ্ণের দিকে না তাকিয়েই বলে,
- " আমি রাজি। চলো..।"
উষ্ণ আনন্দের হাসি হাসে। বহুদিন এমন হাসি হাসে নি সে। মোহ'র হাত ধরে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। এক নতুন জীবনের উদ্দেশ্য।
____________WhatsApp
শত আনন্দ আজ ভর করেছে উষ্ণের মনে। মোহ কে নিজের করে পেয়ে আজ মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ উষ্ণ।
তটিনী পাশ থেকে ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে নবদম্পতির দিকে। আজ সে খুশি, তবে অন্তরের কোথাও যেন শুণ্যতা কাজ করছে। সে জানে না এমন কেন হচ্ছে। তবু হচ্ছে। কোথাও একটা কাটা ফুটে রয়েছে। বিষাদসিন্ধু ভর করেছে। উষ্ণ মোহ কে নিয়ে নিজের বাড়ি যায়। তটিনীও বাড়িতে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হয়। উষ্ণ চেয়েছিল তটিনীকে পৌঁছে দিতে। তবে তটিনী একা যাবে বলে জেদ ধরে। হাটতে হাটতে চৌরাস্তার কাছে দাঁড়িয়ে তটিনী এক অদ্ভুৎ জিনিস দেখে..। তবে ভয় না পেয়ে সে ঘটনা টা ভিডিও করতে থাকে।
- "তবে সব ঝামেলার মূল তুমিই ভাইয়া..।"
তটিনী চলে যায়।
________Facebook
এই নবদম্পতির কোনো বাসর ঘর নেই। কোনো অনুষ্ঠান নেই। আছে শুধু ভালোবাসা। মোহ'র ইচ্ছা অনুযায়ী আজ উষ্ণ তাকে নিয়ে বারান্দায় চন্দ্র বিলাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতি বোধ হয় তা চায় নি। সেজন্যই আকাশ থেকে বর্ষনের বিন্দু নামতে শুরু করেছে। উষ্ণ ও মোহ উপায় না পেয়ে ঘরের ভিতর থেকে বৃষ্টি দেখতে থাকে। মোহ উষ্ণ কে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাসা করে,
- "আমার তো এর আগেও বিয়ে হয়েছে। তাছাড়া আমি ধ*র্ষি*তা ও। তবে আমায় বিয়ে কেন করলে? আর কোনো পেয়ে পেলে না?"
মোহ'র এমন ফালতু প্রশ্নে উষ্ণের মাথা গরম হয়ে যায়। উষ্ণ মোহ কে নিজের দিকে ফেরায়। গাল ধরে বলে,
- "আমি তোমার মন ও ব্যাক্তিত্ব দেখে তোমায় ভালোবেসেছি আর বিয়ে করেছি মোহ। আর কিছুই না। তাই এসব ফালতু কথা আর উচ্চারণ করবে না।"
0 Comments