লেখিকাঃ সাদিয়া আকতার
আলভি হাই তুলে বলে " কি বন্ধু!.... এভাবে ষাঁড়ের মতো চিল্লাচ্ছো কেন?....."
: এই যে!!.... কাংখিত
তিল!!..... বলে ফোনের স্ক্রিন আলভি'র দিকে ঘুরিয়ে ধরে।
মুহুর্তে সব ঘুম
যেন আলভি আর ইন্সপেক্টর সামসের চোখ থেকে উধাও। আলভি তড়িঘড়ি এগিয়ে এসে ফোন হাতে নেয়,
প্রসারিত ভ্রু কোচকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে স্ক্রিনের দিকে। ওর চেহারায় ধীরে ধীরে
চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রবিন কে ফোন ফেরত দিয়ে মাথা নিচু করে গম্ভীরমুখে সারা
ঘরময় পায়চারি করতে থাকে। ইন্সপেক্টর সামস ও রবিন পরস্পরের দিকে জিজ্ঞাসু ভাবে তাকিয়ে
একপাশে দাড়ায়, তারা আলভি কে বোঝার চেষ্টা করছে।
আচানক আলভি ওদের
দিকে ফিরে বলে " হাতে মোটেও সময় নাই.....আমাদের হুলিয়া ফিরে যেতে হবে....এখনই!!.....তৈরি
হয়ে যাও....."
: এ.. এখন রাত দু'টো
বাজে!!....
: তো ??... বলছি
ইন্সপেক্টর সামস আপনিও চলুন... জানেন তো কি করতে হবে?!!...
: জ্বি...জ্বি....যাচ্ছি....বলে
ইন্সপেক্টর সামস তার রুমে ফিরে যায় তৈরি হতে।
উপায়ন্ত না পেয়ে
রবিনও আলভি'র সাথে রুমে চলে যায় ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিতে। চোখে মুখে পানি দিয়ে ফ্রেশ
হয়ে ফোনের চার্জার নিতে রবিন টেবিলের কাছে গেলে খেয়াল করে একজনের ছবি রাখা। একটু মনোযোগ
দিয়ে দেখতেই চমকে ওঠে আলভি কে বলে " এ... এটা কে জানো?!!...."
: হুম্মম...তুমি
চিনো?...
: স... সারোয়ার!!....
হ্যাঁ...দেখো ও.. ও খালি ওর চুল গুলো বড় করেছে....
অর্থপূর্ণ হাসি হেসে
আলভি বলে " বেশ!!...চলো!!..."
আলভি রুম থেকে বেরিয়ে
দেখে ইন্সপেক্টর সামস পুরো দস্তুর তৈরি হয়ে ধৃত ব্যাক্তি কে নিয়ে হাজির। লোকটি বারবার
নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলো কিন্তু সামসের সাথে পেরে ওঠা খুব একটা সহজ ছিলো না তার
জন্য। আলভি ধীর পায়ে এগিয়ে ধৃত লোকটির চোখের পট্টি খুলে দেয়। কিছুক্ষণ চোখ পিটপিট করে
তাকিয়ে আলভি দেখে চমকে ওঠে বলে " আ... আপনি!!"
রহস্যপূর্ণ হাসি
দিয়ে গম্ভীর হয়ে আলভি বলে " হুম্মম... নিশ্চয় সব বুঝে গেছো.... এখন শান্ত থাকো...
এতেই তোমার মঙ্গল...."
পুণরায় লোকটির চোখ
বেধে দেয়া হয় তবে এবার সে আর বাধা প্রদান করে না।
ইন্সপেক্টর সামস
হুলিয়া শহর যাওয়ার জন্য একটা গাড়ি ডেকে দেন, ভাড়া মিটিয়ে তারা চড়ে বসে সঙ্গে ধৃত লোকটি।
ড্রাইভারের পাশের সিটে রবিন আর পিছনে ধৃত লোকটি কে নিয়ে শক্ত হাতে হ্যান্ডকাফ ধরে আলভি
বসে। হুলিয়া পৌছতে ভোর হয়ে যাবে তাই আলভি রবিন কে ঘুমিয়ে যেতে বলে, সে সজাগ থাকবে বিধায়।
গাড়ি ছুটে চলেছে
আপন গতিতে। রবিন ঘুমানোর চেষ্টা করলেও কোন ভাবেই ঘুম আসছে না। নানা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক
খাচ্ছে কিন্তু কোন টারই ঠিক মতো উত্তর মিলছে না। নড়চড় করতে করতে শেষমেশ প্রশ্ন করেই
বসে আলভি কে " আমরা এভাবে কেন ফিরে যাচ্ছি?!!...."
: সত্যর আত্মপ্রকাশ
ঘটবে...
রবিনের কৌতহল যেন
অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। মনে মনে ভাবে তারমানে আলভি খু**নি কে চিনতে পেরেছে কিন্তু কে?
কিভাবে? আবার কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে কিন্তু আলভি'র দিকে ফিরে লক্ষ্য করে সে খুব গম্ভীর
ভাবে বসে আছে। অগত্যা সঠিক সময়ের অপেক্ষায় নিজেকে শান্ত রাখে। নানা কথা ভাবতে ভাবতে
রবিনের চোখ লেগে যায়।
হঠাৎ শরীরে হালকা
ঝাকুনি অনুভব করে চমকে ওঠে রবিন, তাকিয়ে দেখে ইন্সপেক্টর বাবুলাল মৃদ্যু হেসে বলছেন
" উঠুন ডাক্তার বাবু!!..."
: আ... আমারা পৌছে
গেছি!... চোখ কচলিয়ে বলে রবিন।
: জলদি করো বন্ধু!!....
পাশে থেকে বলে আলভি।
রবিন দ্রুত গাড়ি
থেকে নেমে চেহারায় পানির ঝাপটা দিয়ে নিজেকে ফ্রেশ করে নেয়।
আলভি ইতোমধ্যে ধৃত
লোকটিকে ইন্সপেক্টর বাবুলালের হাতে তুলে দিয়ে আরো কিছু নির্দেশনা বলে বিদায় নেয়।
রাস্তার পাশে একটি
খালি রিক্সা দেখে ডাক দিলে লোকটি যেতে চায় গন্তব্যে। আলভি রবিন কে নিয়ে উঠে বসে। স্মীত
হেসে বলে " বলো কি জানতে যাও?!..."
: ম... মানে?!...
: জানা কথা!!....
তোমার অনেক প্রশ্ন দলা পাকিয়েছে এর মধ্যে....
: থাক!!.... সব একবারে
শুনবো... এখন কার বাড়ি যাচ্ছি?!!....
: মেইন মাস্টারমাইন্ড
যে....
: এ...এভাবে?!!....
কোন ব্যাকআপ টীম ছাড়া!!....
: হুম্মম্ম.... এভাবেই
সেফ আমরা.... তবে টীম আছে...পেছনে....
রবিন আস্বস্ত হয়,
সে আর কিছু জানতে চায় না।
রিক্সাওয়ালা তাদেরকে
একটি পুরনো দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড় করায়। ভাড়া চুকিয়ে আলভি কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ
দৃষ্টি দিয়ে বাড়ির চারপাশটা দেখে নেয়। রবিন কে ইশারা করে তাকে অনুসরণ করতে। বাড়ির
মেন গেটে দাঁড়িয়ে আলভি কলিং বেলের সুইচে দুইবার চাপ দেয়। কিছুক্ষণ পর দোতালার কোন
দরজা খুলে কারো নিচে নেমে আসার পদ শব্দ শোনা যায়।
কৌতুহলের আতিশয্যে
রবিনের হৃদপিণ্ডে ঢিপঢিপ শব্দরা ঝড় তুলে যায়। কিন্তু সে লক্ষ্য করে মধ্যবয়স্ক এক
লোক কেচি গেটের তালা খুলে তাদেরকে ভেতরে আসতে আহবান করে যাকে সে মোটেও চেনে না।
আলভিও কিছুটা অপ্রস্তুত
হয়ে জিজ্ঞেস করে " আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না..... "
বয়স্ক লোকটি হাসিমুখে
জানায় " আমি এই বাড়ির কেয়ারটেকার...... মালিক উপরে আছে আপনারা চলুন.....
"
আলভি এক মুহূর্ত
কিছু একটা ভেবে দৌড় দেয় দোতলার সিঁড়ি বেয়ে, রবিনও কিছু বুঝে উঠতে না পেরে আলভিকে
অনুসরণ করে।
দোতলায় পৌঁছে এঘর
ওঘর খোঁজে একটি রুমের সামনে এসে পৌঁছায় আলভি। পুরো রুমটা ইলেকট্রিক ডিভাইস গ্যাজেট
কম্পিউটার রাউটার ইত্যাদি দিয়ে সাজানো। যেন ছোটখাটো একটা আইটি চেম্বার। আলভির অনুমান
সঠিক হয় সে দেখতে পায় কেউ একজন কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে দাঁড়িয়ে কোন প্রোগ্রাম
ডিলিট করায় ব্যস্ত। দৌড়ে যেয়ে পেছন থেকে জাপটে ধরে ব্যক্তিটিকে সরিয়ে দেয় সেখান
থেকে। কম্পিউটার স্ক্রিনে দেখে প্রোগ্রাম ডিলিট হওয়া শুরু হয়েছে, দ্রুত ক্যান্সেল
করে দিতে চেষ্টা করে। রবিনও এর মধ্যে চলে আসে। সে দেখতে পায় কালো হুডি পড়া কোন ব্যক্তি
আলভি'র সাথে ধস্তাধস্তি করছে। আলভি এক হাতে কোনো রকমে সে ব্যক্তিকে বাধা দিয়ে কম্পিউটারে
কিছু করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। রবিন দৌড়ে এসে লোকটিকে পেছন থেকে হাত মোচড়িয়ে কাবু
করে দেয়। অবশেষে আলভি প্রোগ্রাম ডিলিট হওয়া ক্যান্সেল করতে সক্ষম হয়।
লম্বা একটা শ্বাস
নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় বলে " কৃষ্ণকমল বোস!!...... "
এই নাম শুনে ব্যক্তিটি
একটু চমকে ওঠে আলভির দিকে তাকায়। রবিন তার এক হাত ছেড়ে দিলে লোকটি বিধ্বস্ত শরীরে
ধপ করে নিচে বসে পড়ে। মুখ ঢেকে আপন মনে কিছুক্ষণ কান্না করে লোকটি। এরপর সে যখনই মুখ
তুলে তাদের দিকে চায় রবিন বিস্মিত হয়ে বলে " শান্তানু!!... তুমি!!!....."
: হ্যাঁ....হ্যাঁ..
আমি.... আমিইইই......
: কিন্তু!!... তুমি
এসব কেন করলে...
শান্তানু কোন জবাব
না দিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। অল্প কিছু সময় বাদে বাইরে পুলিশের গাড়ির শব্দ শোনা
যায়, ইন্সপেক্টর বাবুলাল কয়েকজন কনস্টেবল কে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেন। তিনিও যেন মুহূর্ত
কালের জন্য থমকে যান শান্তানু কে দেখে। আলভির দিকে তিনি জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকালে সে
ইশারা করে এইসব ঘটনার প্রধান পরিকল্পনাকারী সে। ইন্সপেক্টর বাবুলাল আদেশ দিলে তারা
শান্তানুর হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেয়। শান্তানু এতে তেমন কোন বাধাই দেয় না নিশ্চুপে
বেরিয়ে যায় পুলিশ সদস্যদের সাথে। আলভি রবিন ওরাও পুলিশ ভ্যানে এসে থানায় উপস্থিত হয়।
থানার সামনে ইতোমধ্যে
প্রচন্ড ভিড়। পুলিশ ভ্যান থেকে নেমে রবিন ভ্রু কোচকে লক্ষ্য করে কেউ সাংবাদিক, কেউবা
আবার পার্টির লোক, সাধারণ জনগণ সবার উৎসুক নজর আজকে একজন সাইকো কে ধরা হয়েছে তাই।
একেক জনের একেক রকম প্রশ্ন, নিজের মতের পক্ষে সাফাই। পুলিশ ব্যারিকেডে আড়াল করে শান্তানুকে
থানার ভেতরে নিয়ে আসা হয়।
থানার ভেতরে আসতে
রবিনের কাছে পার্টির লোকদের থানার সামনে আসার বিষয়টা স্পষ্ট হয়। কারণ ইন্সপেক্টর
সামস ইতোমধ্যে এমপি জামশেদ, মি. ফারহাদ, বিপন রায়, প্রিন্সিপাল শাহাবুদ্দিন কে অ্যারেস্ট
করে নিয়ে এসেছেন। শান্তানু এতক্ষণ স্বাভাবিকই ছিলো কিন্তু যখনই সে তার সামনে তাদের
চারজন কে দেখতে পায়, অস্বাভাবিক রকমের উত্তেজিত হয়ে ছুটে যায় ওদের দিকে। কেউ কিছু
বুঝে ওঠার আগেই শান্তানু এমপি জামশেদের নাক বরাবর প্রচন্ড এক ঘুসি দিয়ে বসে, আঘাত
পেয়ে তিনি একটু দূরে সরে যান। শান্তানুর সব রাগ তখন মি. ফারহাদের ওপর সে তাকেও আঘাত
করে পরপর দু'বার। ক্ষীপ্র শান্তানু বিপন রায়ের'র দিকে ছুটলে কয়েকজন কনস্টেবল তাকে
বাধা দিতে এগিয়ে যায়।
কিন্তু হঠাৎ আলভি
তাদেরকে থামিয়ে দেয় বলে " ওর ক্ষোভ মিটতে দাও......."
শান্তনু একে একে
বিপন রায় ও প্রিন্সিপালকেও আঘাত করে এরপরে সে চিৎকার করে কান্না করতে করতে বলে
" আমার মা!... বাবার!!.... খু**নি এরা!!!!......... "
কয়েকজন কনস্টেবল
এসে শান্তানু কে ইন্টারোগেশন রুমের দিকে নিয়ে যায়।
অপরদিকে ইন্সপেক্টর
বাবুলালের ইশারায় ওদের চারজনকে থানার লকআপে পুলিশ সদস্যদের কড়া প্রহরায় রাখা হয়
।
-------------------------
ইন্টারোগেশন রুম।
অন্ধকার এক কামরায়
মাঝ বরাবর লম্বা স্ট্যান্ডে ঝুলানো বৈদ্যুতিক বাল্ব। টেবিলের এক প্রান্তে মাথা নিচু
করে বসে আছে শান্তানু অপর প্রান্তে বসা ইন্সপেক্টর বাবুলাল, ডিটেকটি আলভি ও ইন্সপেক্টর
সামস।
ইন্টারোগেশন রুমের
কাচের অপর পাশে উৎসুক নজরে অপেক্ষা করছে রবিন ও থানার কনস্টেবলরা।
ইন্সপেক্টর বাবুলাল
নিবেশক যন্ত্র চালু করে টেবিলের মধ্যখানে রাখেন।
শান্তানুর জিজ্ঞাসাবাদ
শুরু হয়।
ইন্সপেক্টর বাবুলাল
তাকে জিজ্ঞেস করেন " তোমার নাম কি?.... "
: শ...শান্তানু বোস!....তবে
বাবা-মা রেখেছিলেন কৃষ্ণ কমল বোস!!.....
ইন্সপেক্টর বাবুলাল
পুনরায় তাকে জিজ্ঞেস করেন " শিপন রায়... ফারজানা... জিসান... এদের হ**ত্যা**কাণ্ডে
তুমি কি জড়িত??
মাথা নিচু করে শান্তানু
ক্ষীণ স্বরে জবাব দেয় " জ্বি আমি!!..... "
আলভি এবার বলে
" তোমার সাথে হওয়া সব ঘটনা খোলামেলা বল..... কেন তুমি এতগুলো নিষ্পাপ মানুষের
প্রাণ কেড়ে নিলে???.... "
শান্তানু তাচ্ছিল্যের
হাসি দিয়ে বলে " স্যার!!.... আপনি কাদেরকে নিষ্পাপ বলছেন!.... এরাও ওদের বাবার
মতই ছিল.... এরাও অন্যায়কেই সাপোর্ট করতো... যখন আমি তাদেরকে ভয় দেখিয়েছি.... তখনই
তারা সোজা পথে হাঁটছে.... আর তাছাড়া এদেরকে আমার মা*র*তেই হত..... আমি বোঝাতে চাই...
চোখের সামনে নিজের সন্তানকে হারানো যে রকম যন্ত্রণার.... ঠিক তেমনি নির্দোষ বাবা মায়ের
মৃত্যুও ততটাই যন্ত্রণার...... "
আলভি গম্ভীর স্বরে
জিজ্ঞেস করে " কি হয়েছিল তোমার বাবা-মায়ের সাথে??!!...... "
শান্তনু বলতে শুরু
করে " আমি তখন সবেমাত্র ক্লাস ওয়ানের ছাত্র..................
চলমান........
( গল্প টি আপনার
কেমন লাগছে কিংবা এর প্লটের কোন ভুল ত্রুটি থাকলে কমেন্ট বক্সে জানানোর অনুরোধ রইলো)
আত্মহত্যার নেপথ্যে পর্ব ১০ (শেষ খণ্ড)
0 Comments