লেখিকাঃ তাহিনা আইরাত ইরা
ভরা ক্লাসের ভিতর মাহির কে থাপ্পড় মারে প্রহর। পাশে নাহিদ মাথা নিচু করে আছে। চোখে মুখে তার ক্রোধ। তবে তা মাহিরের জন্য না, প্রহরের জন্য। প্রহর মাহিরের উদ্দেশ্যে চেচিয়ে ওঠে,
“তোর সাহস কীভাবে হয় একটা মেয়ের সম্মান নিয়ে মজা করার? তুই জানিস একটা মেয়ের কাছে তার ইজ্জত কত কিছু?”
প্রহরের কথা শেষ হওয়া মাত্রই ক্লাসে হুড়মুড়িয়ে ঢোকে আনিকা নামক সেই মেয়ের প্রেমিক। ছেলেটি সোজা গিয়ে মাহিরের কলার চেপে ধরে।
“শু*য়ো*রের বাচ্চা। তোরে জবাই করমু আমি। তুই আমার প্রেমিকার আ*প*ত্তিকর ভিডিও ভাইরাল করার সাহস কীভাবে পাস? তোর র*ক্ত দিয়ে আজ গোসল করবো আমি।”
বলেই, মাহির কে অগনিত ঘুষি মারতে থাকে ছেলেটি। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রহর, নাহিদ ও ক্লাসের কিছু ছেলে তাদের কে থামানোর জন্য যায়। ছেলেটিকে সরানো গেলেও মাহির আহত হয়। নাহিদ তাকে নিয়ে বাইরে চলে যায়। ছেলেটা তখনও মাহির কে গালিগালাজ করছিল। প্রহর এসব দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
___________Facebook
সজোরে দেয়ালে একটা ঘুষি মেরে মাটিতে বসে পড়ে মাহির। নাহিদ পাশে দাঁড়িয়ে প্রহর কে গালি দিচ্ছে। মাহির কে বসে পড়তে দেখে তার কাছে এগিয়ে আসে।
“কী হয়েছে মাহির?”
মাহির চোখে আগুন ঝড়িয়ে নাহিদ এর দিকে তাকায়। চেচিয়ে বলে ওঠে, “প্রহর..। ওই কু*ত্তা*র বাচ্চারে আমি ছাড়বো না। ও সবার সামনে আমার গায়ে হাত তুলেছে। ওর ওই হাত আমি কেটে ফেলবো।”
নাহিদ হাসে, যে হাসিতে মেশানো ছিল একরাশ রহস্য। মাহিরের কাঁধে হাত রাখে সে।
“আর ওই জিহাদ? আনিকার প্রেমিক। যে তোকে সবার সামনে গালি দিল। তার কী করবি?”
নাহিদের কথা শুনে মাহির মুচকি হাসে। নাহিদের দিকে তাকিয়ে সে বলে, “জিহাদ? ও তো চুনোপুঁটি। একটু টোকা দিলেই পড়ে যাবে।”
নাহিদ প্রতুত্তরে বলে, “তাহলে আজ রাতেই খালাস করে দেই?”
মাহির আবারো হাসে। বলে, “চল তাহলে, ভালোই মজা হবে।”
দুজনেই শয়তানি অট্টহাসি তে মেতে ওঠে। সেই হাসিতে ছিল শুধু রহস্য!
নাহিদ হাসি থামায়। চোখে মুখে কঠিনত্ব ধরিয়ে বলে, “ওই প্রহর বা*ঞ্চো*তের টার কী করবো? খেয়ে দেবো?”
মাহিরের চেহারায় কামনা ভেষে ওঠে। চোখ দুটো বন্ধ করে সে বলে, “খারাপ হয় না। মা*ল টা জোস কিন্তু।”
আবারো অট্টহাসি দেয় তারা। যা আর কেউ শুনতে পায় না।
_________YouTube
“শুনেছিস মোহ? আজ নাকি একটা সিনিয়র ভাই আনিকা আপুর আ*প*ত্তিকর ভিডিও ভাইরাল করে দিয়েছে। তার জন্য নাকি আজ অনেক ঝামেলা হয়েছে। মারামারি হয়েছে।”
টিনার কথায় হকচকিয়ে তার দিকে তাকায় মোহ। কিছু বুঝতে না পেরে টিনার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। টিনা মোহ কে জবাব না দিয়ে এভাবে তাকিয়ে থাকতে বিরক্ত হয়। বাহুতে একটা চাপড় মেরে বলে,
“কী হয়েছে? তাকিয়ে আছিস কেন?”
মোহ এবার অবুঝের মতো টিনাকে প্রশ্ন করে, “কী বলছিলি তুই তখন? আমি বুঝিনি।”
টিনা যেন আরও বিরক্ত হয়। এতক্ষণ ধরে তাহলে এই ন্যাকার সাথে কথা বলছিল সে। কণ্ঠে বিরক্তি ধরিয়ে সে বলে, “তুই কী বাচ্চা? তুই কিছু বুঝিস না? আরেহ, আনিকা আপুর লি*ং*ক ভাইরাল হয়েছে। যেটা আমাদের ভার্সিটিরই এক সিনিয়র ভাই করেছে।”
মোহ'র এবার টনক নড়ে। চমকিত হয়ে সে বলে, “কী? কে করেছে?”
টিনা নিচে তাকিয়ে বলে, “ওইযে মাহির ভাই আছে না, সে। ছেলেটা আমার ক্রাশ ছিল।”
টিনার কথা শুনে মোহ কিছু বলতে হবে তার আগেই একটা ছেলে এসে তাকে বলে, “আপনি মোহ?”
অবাক হয় মোহ। আস্তে করে উত্তর দেয়, “জ্বি। আমিই মোহ।”
ছেলেটি তার উদ্দেশ্যে বলে, “প্রহর ভাই আপনাকে ডাকছে।”
মোহ ও প্রহর পাশাপাশি বসা। খোলা মাঠ, পাশে কয়েকটি গাছ আর গাছের নিচে দুটো বেঞ্চ। সেই বেঞ্চিতেই তারা দুজন পাশাপাশি বসে আছে। মোহ'র ভিতর উৎকণ্ঠা কাজ করছে। কী হবে? প্রহর তাকে কী বলবে? এসব ভেবে ভয়ে আছে সে। হঠাৎ নিরবতা ছিন্ন করে প্রহর ডেকে ওঠে,
“মোহ....
কেঁপে ওঠে মোহ। প্রহরের আকুতিভরা ডাকটা যেন তার হৃদপিণ্ড ছেদ করে গিয়েছে। মোহ তার পাশে থাকা সুদর্শন পুরুষটির পানে তাকায়। সে আগে থেকেই মোহ'র শ্যামবর্ণা আদলের দিকে চেয়ে ছিল। মোহ তাকাতেই প্রহর চোখ সরিয়ে নেয়। মুখমণ্ডল কঠোর করে নেয়। অৎপর মোহ'র দিকে না তাকিয়েই বলে,
“আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই মোহ।”
মোহ প্রতুত্তর করে না। মাথা নিচু করে রাখে। প্রহর একবার মোহ'র দিকে তাকায় উত্তরের আশায়। মোহ'র উত্তর না দেওয়ায় আবার চোখ সরিয়ে নেয়। প্রহর জোরে একটা শ্বাস নেয়।
“মোহ, আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হয়তো তোমার পছন্দ নাও হতে পারে। কিন্তু তুমি আমাকে কথা দাও যে তুমি পুরো কথা না শুনে ওভার রিয়্যাক্ট করবে না।”
প্রহরের ঠোঁটের কোনে এক টুকরো হাসি ফুটে ওঠে যা মোহ দেখার আগেই প্রহর নিজের চেহারা স্বাভাবিক করে ফেলে। প্রহর চোখ বন্ধ করে। তারপর নিজের যায়গা থেকে উঠে মোহ'র সামনে দাঁড়ায়। মোহ বুঝতে পারে না প্রহরের উদ্দেশ্য। আবার প্রহর কে কিছু জিজ্ঞাসা ও করতে পারে না। প্রহর মোহ'র হাত ধরে। মোহ চমকে তাকায়। আবার অস্বস্তি ও হয়। এভাবে একটা ছেলে তাকে স্পর্শ করছে। একটু কষ্ট পায় মোহ। কারণ এর আগে কেউ তার উপর এভাবে অধিকার খাটায়নি। প্রহর মোহ কে মাঠের মাঝে নিয়ে যায়। সূর্যের এমন রুদ্রমূর্তি দেখে মোহ'র আরও অস্বস্তি হতে থাকে।
প্রহর একটু সময় নিয়ে আচমকা মোহ'র সামনে হাটু গেড়ে বসে। দু'পা পিছিয়ে যায় মোহ। হতভম্ব হয়ে তাকায় প্রহরের দিকে। মোহ কিছু বলতেই যাবে তার আগেই প্রহর তাকে কথা না বলার জন্য ইশারা করে। প্রহরের ইশারা দেখে মোহ থেমে যায়। প্রহর মোহ'র উদ্দেশ্যে বলা শুরু করে,
“মোহ, আমি জানি না কীভাবে ভালোবাসার প্রস্তাব দিতে হয়। কখনো কাউকে দিই নি। তুমিই প্রথম ও তুমিই শেষ। জানো মোহ, প্রথম বার যখন তোমাকে দেখেছিলাম, তোমাকে দেখে থমকে গেছিলাম আমি। তোমাকে দেখার পর আমার হৃদস্পন্দন তার গতি ১০ গুন বাড়িয়ে দেয়। বুকে টান লাগে ভীষণ। ভার্সিটিতে এ কয়েক মাস তোমাকে আমি প্রতিদিন দেখেছি। তোমার খোঁজ নিয়েছি। তোমার জন্মের পর থেকে কী কী হয়েছে তা সব আমার নখদর্পনে। সেদিন বৃষ্টিতে তোমায় দৌড়ে আসতে দেখে আমি নিজের অস্তিত্ব ভুলে গেছিলাম। রাতে ঘুমানোর সময় তোমাকে অনুভব করতে মন চায়। তোমাকে না দেখলে অস্থিরতা ঘিরে ধরে আমায়। ঠিক ভাবে কোনো কাজ করতে পারি না, শুধু তোমার কথা মনে পড়ে। প্রথম দেখায় প্রেমে পড়াকে বোধহয় 'লাভ এট ফার্স্ট সাইট' বলা হয়। হয়তো আমিও এই লাভ এট ফার্স্ট সাইটের শিকার। আমার তোমাকে চাই মোহ, খুব করে চাই। আমায় তোমার নিঃসঙ্গ রাতের সঙ্গী বানাবে? আমায় তোমার ভালোবাসার পুতুল বানাবে ভৃঙ্গলতা?”
ভৃঙ্গলতা..! নাম টা শুনে মোহ'র গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। মোহ'র চোখে তখন পানি টলমল করছিল। এই অশ্রু কীসের তা সে জানে না। তবে এই মুহূর্তে এসে কেন যেন প্রহর কে তার খুব আপন মনে হয়েছে। কেন যেন মনে হচ্ছে এই মানুষটা তাকে ভালোবাসতে পারবে। তবে কিছু একটা মনে পড়ায় পিছিয়ে যায় মোহ। মোহ কে এভাবে পিছিয়ে যেতে দেখে প্রহর উঠে তার কাছে যায়। অস্থির হয়ে বলে,
“মোহ, কী হয়েছে? আমাকে তোমার ভালো লাগে না?”
মোহ তার দিকে তাকিয়ে কেঁদে দেয়। প্রেয়সীর কান্না দেখে প্রহরের হৃদয়ে যন্ত্রণা শুরু হয়। আরও অস্থির হয়ে ওঠে সে। মোহ হঠাৎ বলে ওঠে,
“আপনি এতো সুদর্শন হয়ে আমার মতো একটা কালো মেয়েকে ভালোবাসতে পারলেন কীভাবে?”
মোহ'র এহেন কথায় প্রহর রেগে যায়। কাঁধ ঝাকিয়ে বলে,
“এই মেয়ে, একদম বাজে কথা বলবে না। কে বলেছে তুমি কালো? তুমি সবচেয়ে সুন্দর। আমার চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে তুমি।”
মোহ অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। আচমকা জড়িয়ে ধরে প্রহর কে। প্রহর প্রথমে কিছু না বুঝলেও পরবর্তীতে বোঝার সাথেই মোহ কে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। দুজন একে অপরের সাথে মিশে যায়। প্রহর মোহ কে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
“মোহ, তুমি আমায় ভালোবাসো?”
মোহ হিচকি তুলতে তুলতে বলে, “হ্যাঁ। সেই প্রথম দিন থেকে ভালোবাসি। আপনি কী ভেবেছেন? শুধু আপনিই আমায় না দেখে থাকতে পারেন না? ভুল। আমিও আপনাকে না দেখে থাকতে পারি না। ভীষণ ভালোবাসি আপনাকে। আপনার ভৃঙ্গলতা আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে।”
মোহ'র কথা শুনে প্রহরের ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে। যা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখে মোহ।
____________
কথাগুলো বলতে বলতে প্রহরের চোখের কোণে অশ্রু জমে৷ প্রভা তা দেখার আগেই প্রহর চোখ মুছে ফেলে। প্রভা প্রহরের দিকে তাকিয়ে বলে,
”তাহলে এখান থেকেই তোমাদের প্রেম কাহিনী শুরু হয়েছিল। বাহ বাহ! বেশ রোমাঞ্চকর তো।”
প্রভার কথায় প্রহর হাসে। বোনকে বুঝতে দেয় না মনের রক্তক্ষরণ। প্রভা পা উঠিয়ে আরাম করে বসে।
“ভাই, পরের ঘটনা শোনাও না। তোমাদের কীভাবে ব্রেকাপ হলো সেটা শোনার জন্য আমি উৎসাহিত।”
প্রহর বাড়তি কথা না বাড়িয়ে আবারো অতীতে ফিরে যায়।
“আমাদের প্রেম খুব ভালোই চলছিল। ওর পরিবার সম্পর্কে সব কিছুই জানতাম আমি। আমার খুব খারাপ লাগতো। আমাদের প্রেমের ২ মাস অব্দি ও টিনার বাড়িতেই থাকতো। তারপর আত্মসম্মানবোধের কারণে একটা এনজিও তে চাকরি নিয়ে হোস্টেলে থাকা শুরু করে। আমি কখনো তাকে বাড়ি ফিরে যেতে বলতাম না। আমি জানতাম ও তার বাড়ি ফিরে গেলে আরও বেশি কষ্ট পাবে। আবার আমার বাড়িতেও আনতে চাইতাম না। তখন বাবা ছিল। মা বাবা একটা মেয়েকে বাড়িতে আনা ভালো চোখে দেখতো না। তুই ও তখন গ্রামে থাকতি।”
প্রভা গালে হাত দিয়ে বলে, “মোহ'র সাথে তোমার বিয়ে কীভাবে হলো?”
প্রহর চোখ বন্ধ করে প্রভার কথার উত্তর দেয়, “শুনবি?”
প্রভা তৎক্ষনাৎ লাফিয়ে ওঠে। খিলখিল করে হেসে বলে, “আমি শুনবো না তো কে শুনবে হ্যাঁ?”
0 Comments