Ad Code

চারুলতা পর্ব - ৯

 লেখিকাঃ সাবিহা জান্নাত

কয়েক দিন পেরিয়ে গেছে। চারু ২য় বর্ষে উত্তীর্ণ হয়ে ক্লাস শুরু করেছে নিয়মিত। কাব্যের সাথে সে এখন খুব কম কথা বলে। কলেজে একাই যাওয়া আসা করে সে।
কাব্য ও চারুর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে । অজানা কারনে তাদের মধ্যে দুরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। চারু ও কাব্যের প্রতি ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলেছে।‌ মূলত চারুর কাব্যের প্রতি অবহেলায় তাদের মধ্যে দুরত্বের সৃষ্টি করেছে।
সে এখন শুধু অচেনা ব্যাক্তির অপেক্ষায়। যে কি না আড়ালে আবডালে তার সমস্ত খবর রাখছে। চারু অনেক চেষ্টার পর ও তার খোঁজ পায়নি।
চারু কবিতাকে সবকিছু বললেও এই বিষয়ে তেমন কিছুই বলেনি। চারু খুব মনমরা হয়ে কাব্যের ক্লাস করছে । কাব্য ও তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ।
চারু মনে মনে নিজেকে অপরাধী ভাবছে, তার জন্য ই কাব্য তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অথচ কাব্য তার সারাক্ষণ খেয়াল রাখতো।
চারু অনেক বার কাব্যের রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করেও সে কিছুই করতে পারেনি। কাব্য তাকে এখন ইগনোর করা শুরু করেছে রীতিমতো।
চারুর সাথে তার দেখা হলে সে এখন মুখ ফিরিয়ে নিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। চারুর হৃদয় পোড়ে। চারু দোটানায় পড়েছে , কাকে ভালোবাসে সে ?
লোকটার দর্শন পেতে চারু যেমন ছটফট করছে , তেমনি তার মনটা থেমে যাচ্ছে কাব্যের কথা ভাবতে। সবকিছুতেই সে যেন কাব্য কে খুঁজে বেড়ায়।
সে সবকিছু ভুলে কাব্যের হতে চায় কিন্তু সমাজ এবং সামাজিকতার মাঝে সে বন্দি। সে চাইলেও কাব্যের হতে পারবে না। কাব্য যে তাকে মোটেও চায়নি। আর পরিবার সেও তো কখনো মানবে না তাদের নিষিদ্ধ চাওয়া কে।
আর কাব্য সে কি কখনো পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে তার হবে । হবে না তো । কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চারুর চোখের কোণে পানি জমে গেছে কিন্তু সে নিজের চোখের পানি গুলো আড়াল করে নেয়। কান্না গুলো গলায় আটকে আসছে তার । তার চিৎকার করে কষ্ট কে মুক্তি দিতে ইচ্ছে করছে কিন্তু তার উপায় নেই।
এতো কিছুর ভাবনার মাঝে সে ভুলেই গিয়েছিল ক্লাস চলছে এখন। ক্লাস শেষে কাব্য বেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ যাবৎ কিন্তু চারু ভাবনার মাঝেই ডুবেছিল ।
কবিতা চারুকে কয়েকবার ধাক্কা দিতেই চারু বাস্তবতায় ফিরে আসে। কবিতা চারুর এমন আচরণে জিজ্ঞেস করেও কোনো জবাব পায় না।
চারুর পার্সোনাল মেটার ভেবেই বিষয়টি নিয়ে চারু কে বেশি জোর করে নি কবিতা। চারু এবং কবিতা কলেজ থেকে বেরিয়ে রাস্তায় চলে আসে।
রাস্তা পার হতেই কয়েকটা বখাটে ছেলে তাদের বিরক্ত করা শুরু করে। একজন চারুর ওড়না ধরার জন্য এগিয়ে আসতেই মধ্যে বয়স্ক একজন লোক এসে সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে।
লোকটা কে দেখেই ছেলেগুলো পালিয়ে যায়। কবিতা এবং চারু কে ভয় পেতে দেখেই লোকটা বলে উঠে,,
~ মা তোমরা ঠিক আছো। লোকটার কথায় দুজনেই মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক দেয়।
~ ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। রাস্তায় এমন বখাটে ছেলে গুলো থাকবেই তাদের কে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমরা আছি। আমি ওদের কে দেখে নিবো ।
কথাগুলো বলতে বলতে লোকটা চারুর দিকে একটা ভিজিটিং কার্ড এগিয়ে দেয়। ঠিক আছে তাহলে তোমরা যাও।
চারু কার্ড টা হাতে নিয়ে সেখানে থেকে চলে যায়। দুজনে কার্ড টা দেখেই বুঝতে পারে লোকটাকে দেখে কেন বখাটে ছেলেগুলো পালিয়ে ছিল।
লোকটা প্রাক্তন পুলিশ অফিসার। চারু এবং কবিতা একেঅপরের সাথে কথা বলে নিজেদের রাস্তায় চলে যায়। চারুর শরীর এখনো কাঁপছে। সে কখনো এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় নি।
যদিও হয়েছিল কাব্য তার সাথে ছিল । সে তাকে আগলে রাখতো । কিন্তু এখন তার কিছু হলেও কাব্যের কিছু যায় আসে না। তার দিকে আর কাব্য ফিরেও তাকায় না। তার কোনো খেয়াল রাখে না আর কাব্য।
রাস্তায় হেঁটে যেতে যেতে কথাগুলো ভাবছে চারুলতা।‌ও পাশ ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখে একটা গাড়ি তাকে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়ে। কাব্য তাকে দেখে গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে।
গাড়িতে উঠে বস, কাব্যের কথাটা কানে আসতেই চারু লতা থমকে যায়। কাব্য তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। চারুলতা কোনো প্রকার শব্দ না করে গাড়িতে উঠে বসে। দুজনেই নিরব । কাব্য গাড়ি ড্রাইভিং করছে আপন মনে।
চারুলতা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে কাব্যের পানে। যে ছেলেটা সব সময় তার কেয়ার করতো আজ তাকে নিয়ে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। চারু লতা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিখুঁতভাবে কাব্যকে পর্যবেক্ষণ করছে ।
এটা সেই কাব্য তো যাকে আমি চিনি । সে এতোটা বদলে গেল কেন। আজ তার বড় বিপদে তাকে সঙ্গে পায়নি । না এতে কাব্যের কোনো দোষ নেই। সে তো ইচ্ছে করেই কাব্য কে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল ।
চারু লতা সিটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রয়েছে।
অতীত,,,
কাব্য চারুর হাত ধরায় চারু কাব্যের উপর চেঁচিয়ে উঠে রীতিমত। আপনি আমাকে স্পর্শ করবেন না কাব্য ভাইয়া । আপনার যখন তখন স্পর্শে আমার নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা লাগে। এভাবে অপর মেয়েকে স্পর্শ করতে আপনার কোনো সমস্যা না হলেও আমার সমস্যা হয় । ছাড়ুন আমার হাত বলেই চারু কাব্যের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।
না চারু ছাড়িয়ে নেয় নি কাব্য ইচ্ছে করেই ছেড়ে দিয়েছে। চারুর কথাগুলো শুনে প্রথমে কাব্যের কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছিল কিন্তু পরে সে নিরব হয়ে যায়। সে কোনো প্রতিবাদ করেনি , চুপচাপ সবটা সহ্য করেছে । জোর করে কিছুই পাওয়া যায় না ।
কাব্য জোর করে চারুর মন পেতে চেয়েছিল কিন্তু চারু বুঝিয়ে দিল ভালোবাসা জোর করে পাওয়া যায় না যদি হৃদয়ের টান না থাকে। কাব্য সেদিন ই চারুর থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। ছেড়ে দিয়েছে তার উপর অধিকার খাটানো ।
কাব্যের প্রতি এমন ব্যবহারে চারু নিজেই কষ্ট পেয়েছে। কি পেতে গিয়ে কি হারালো সে। ওয়াশ রুমে গিয়ে ঝড়না ছেড়ে অনেকক্ষণ যাবৎ সে কান্না করছে। তার সব চোখের পানি গুলো ঝড়নার পানিতে মিশে যাচ্ছে।
চারুর বুক ফেটে কান্না আসছে । সে কাঁদতে চেয়েও কাঁদতে পারছে না । কাব্য কে হারিয়ে ফেলার ভয়ে রোজ কান্না করা মেয়েটাও আজ সে তার প্রিয় মানুষ টাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে।
অতীতের কথাগুলো মনে পড়তেই চারুর চোখ খুলে যায়। ও পাশে তাকিয়ে দেখে কাব্যের দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির। সে কি তাহলে খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে কাব্যকে ।যার ফলে কাব্য আর তার মাঝে দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছে । কাব্য কি সত্যি তাকে ভুলে গেছে।
বাসায় এসে গেছি নেমে পড়। কাব্যের কথাটা কানে আসতেই চারুলতার ভাবনার ছেদ ঘটে। চারুলতা গাড়ি থেকে নেমে সোজা নিজের ঘরে চলে যায়। কাঁধের ব্যাগটা টেবিলে রেখে সে ওয়াশ রুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে।
চোখের পানিতে তার বন্যা বয়ে যাচ্ছে। চারু লতা তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে ওয়াশ রুম থেকে। আয়নার সামনে বসে চুল চিরনি করছে সে । আয়নায় নিজেকে দেখে নিজের ই অচেনা লাগছে তার ।
~ আমি তাকে চেয়েই বা কি করবো ।সে তো আর আমার নয়। আমার চাওয়া পাওয়া গুলো কারো কাছে মূল্য নেই। কাব্য তো কখনো আমাকে ভালোইবাসে না।আর তার পরিবার তো কখনো আমাকে মেনে নিবে না । আমি তো সামান্য তাদের বাসার আশ্রিতা। আশ্রিতা হয়ে বউ হওয়ার স্বপ্ন, বামুন হয়ে চাঁন্দের পানে হাত বাড়ানোর সমান নয় কি।
এসব নানা কথা চারু নিজে নিজেই আপন মনে বলে যাচ্ছে। চারুর প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে। সে বিছানায় গিয়ে গাঁ এলিয়ে দেয়। দুপুরের খাবারের জন্য তার নানুমনি তাকে অনেক বার ডাকা সত্ত্বেও সে সাড়া দেয়নি। সে অনেক ঘুমানোর চেষ্টা করে কিন্তু কিছুতেই তার চোখে ঘুম আসছে না ।
অন্যদিকে কাব্য ফ্রেশ হয়ে বেলকোনিতে দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস গুলো উড়িয়ে দিচ্ছে আকাশের উর্ধ্বপানে। সিগারেটের ধোঁয়া গুলো উড়ে যাচ্ছে দৃষ্টি তাহার স্থীর সেই পানে। এই কয়েকদিনে নিকোটিনের ধোঁয়া গুলো সঙ্গী হয়েছে তার ।
কিছু আক্ষেপ একান্তই ব্যক্তিগত, যা কাউকে বলা যায় না। কাব্য তার মনের কোণে জমে থাকা আক্ষেপ গুলো প্রকাশ করতে পারছে না । চারুকে সে তার সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসে ছিল । না পাওয়ার আক্ষেপ গুলো তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।
বাহিরে সে পরিপাটি দেখালেও ভেতরে ভেতরে সে ভেঙ্গে পড়ছে।চারুর দেওয়ার কষ্ট গুলো তার হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলেছে।চারু চাইলেই পারতো সব অভিযোগ ভুলে গিয়ে তাকে কাছে টেনে নিতে ।
কাব্য অনেক স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে ছিল ।চারুলতা শুধুই তার। চারুলতা শুধু তাকে নিয়েই বাঁচতে চাইবে কিন্তু চারুলতা সেটা মিথ্যে প্রমান করে দিয়ে তার সমস্ত স্বপ্ন গুলো ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। ছুটে চলেছে সে তার দিগন্তে।
" দুই প্রান্তের দুইজন একে অপরকে ভালোবেসেও অজানা কারনে কষ্ট পাচ্ছে। তাদের একে অপরের জন্য হৃদয় পুড়ছে তবুও কেউ কিছুই জানতে পারছে না । তাদের মাঝে অভিমানের পাহাড় জমে গেছে "
রাতটা তারা পার করে দেয় তারা নির্ঘুম কাটিয়ে। পরেরদিন সকালে চারুলতা রেডি হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ক্লাস শেষে চারুলতা বেড়োতে যাবে এমন সময় গেটে দারোয়ান তাকে একটা বক্স দেয়।
কেউ একজন তার জন্য পাঠিয়েছে । চারু বক্সটা নিয়ে বাসায় রওনা দেয়। বাসায় গিয়ে সে খুব আগ্রহের সহিত বক্স টা খুলে। সেখানে কিছু ছবি এবং চিরকুট।
ছবিগুলো দেখেই চারু চমকে উঠে। সেদিনের বখাটে ছেলেগুলো যারা চারু আর কবিতা কে বিরক্ত করেছিল । ছেলেগুলো র-ক্তা-ক্ত মৃ-ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে । তাদের একজনের চোখগুলো উঠানো, একজনের হাত ভেঙ্গে দেওয়া, কারো পা গুলো ভেঙ্গে দেওয়া। কেউ খুব নৃশংস ভাবে তাদের মেরেছে।
চারু কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটা খুলে পড়া শুরু করে,,
~ যে চোখ আমার অপরুপার দিকে কু-দৃষ্টিতে তাকায় , সেই চোখ কখনো দেখতে পাবে না । যে হাত দিয়ে আমার চারুলতাকে স্পর্শ করার চেষ্টা সেই হাত কখনো অক্ষ্যত অবস্থায় থাকবে না ।
তোমার আশেপাশে যেই আশার চেষ্টা করবে আমি তাকেই শেষ করে ফেলবো। তোমার আশেপাশে আমি কাউকে যে সহ্য করতে পারবো না মায়াবতী।
চিঠিটা পড়েই চারু লতা বরফের মতো জমে যায়। আমার আশেপাশে আশা সবার ক্ষতি করবে মানে, কাব্য ভাইয়ার কোনো ক্ষতি করে বসবে না তো ...!


Post a Comment

0 Comments

Close Menu