Ad Code

শ্যামকন্যার মায়াবী চোখ - পর্ব ৫১

 লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা

🚫🚫
কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।
🚫🚫
——— "স্যার? মুগ্ধ স্যার? আপনি কি এখানে আছেন?"
অজানা অন্ধকারের এতো আবরণ কেন? এমন প্রশ্নের উত্থানেই সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ সমগ্র স্থান আলোকিত হয়ে এক মহিমান্বিত আলোকবিন্দু নিবদ্ধ হলো দূরে স্থিরদৃষ্টি প্রহেলিকা রূপে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তির ওপর! রুদ্র স্থাণু, দৃষ্টির মায়াজালে বদ্ধ, পলক পড়তে পারছে না। বিরাট নির্জনতা ভেদ করে আলো ছড়িয়ে পড়েছে এক অজানা শ্যামলবর্ণা নারীর অবয়বে। তার গাত্রাবরণে শুভ্র দীপ্তি, অপ্সরা-কল্পনার চিরকালীন সৌন্দর্য যেন শরীরে আবদ্ধ করেছে! কাঁধের প্রান্তে প্রসারিত প্রজাপতির পাখার মতো কৃত্রিম পাখায় সজ্জিত সে শ্যামলকান্তা রমণী বোধহয় পরিলোক থেকে নেমে এসেছে।
তার চারিপাশে ছোট ছোট শিশু-কন্যাগণ তাকে আবৃত করেছে, তারাও সাদৃশ্যবিহীন সৌন্দর্যের পোষাকে সজ্জিত, যেন তারা কোনো রহস্যময় মায়াবৃত্তির অংশ। রুদ্রর দৃষ্টিতে বিস্ময়, অবিশ্বাস, অনর্গল মুগ্ধতা।
সেই অপরূপা নারীর ঠোঁটের প্রান্তে অতি ক্ষুদ্র গহন হাসির রেখা। নীরবে সে ধীরে ধীরে রুদ্রের দিকে অগ্রসর হয়, তার পিছু পিছু ক্ষুদ্রাকৃতির শিশুগণ, প্রত্যেকেরই হাতে এক একটুকু শুভ্র গোলাপের কুঁড়ি। নিকটবর্তী হয়ে সে স্তব্ধ রুদ্রর সম্মুখে এসে থেমে দাঁড়ায়, কোমল কণ্ঠে মৃদু উচ্চারণ করে,
——— "চমক ভাই!"
রেস্তোরাঁর বিস্তৃত প্রান্তর সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্তেই আলোকিত হয়। সদৃশ্য হয় মহুয়ার অন্তর্দৃষ্টি পলকের ক্ষীণ কম্পনে আলোড়িত, ঠোঁটের প্রান্তে নিবিড় হাসি, তবু চক্ষুর গভীরে নিঃশব্দ অভিমান। দূর হতে মুগ্ধের দৃষ্টি আঁখির অবয়বে স্থির, প্রথম দর্শনের নিঃসীম মুগ্ধতাকে সে একপলকও হারাতে নারাজ। একটু দূরত্বে পাশেই বসে থাকা শান্ত ও নাঈম, ভাবাবেগ হীন অনায়াসে চিবিয়ে চলে চিকেন ফ্রাই, যেনো সকলটাই কোনো স্বপ্নজাল।
আঁখির কণ্ঠে 'চমক ভাই' সম্বোধন শুনে রুদ্রের মনের সমস্ত কল্পনাই মিলে গেলো! মুহূর্তেই স্পষ্ট হলো তার কাছে এই অভাবনীয় আয়োজন, এই অলৌকিক মুহূর্ত, সবই মহুয়া আর মুগ্ধ স্যারের নীলনকশা, তাকে অকুণ্ঠ খুশি করবার জন্য! এ-কারণেই মুগ্ধ তাকে এমন নির্জন স্থানের এক বৃহৎ রেস্তোয়ারায় ডেকেছে! রুদ্রের দৃষ্টিপথ আর্দ্র হয়ে উঠল। টলমল চোখে কোনো বাধা না রেখে সে মাটিতে হাটু গেড়ে বসে পড়ল; আচমকা আঁখির দুই পা জড়িয়ে ধরে প্রবল আবেগে ফুপিয়ে উঠল সে। আঁখি স্তব্ধ, অভাবনীয় প্রকাশভঙ্গিতে বাষ্পায়িত অনুভূতিকে সংজ্ঞায়িত করার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। চারপাশে তাকিয়ে বাকিরাও বিস্ময়ের পাথরে রূপান্তরিত, গোল চোখে দৃশ্যাবলী নিরীক্ষণ করছে।
এইসবের মাঝে শান্ত, হাসির আভায় লুকানো বিদ্রূপ নিয়ে নাঈমের কানে ফিসফিস করে বলল,
——— " সিআইডির গাধা কেমন করুণার হাহাকারে ফুপিয়ে উঠছে!"
নিঃশব্দ হাসিতে ঠোঁট চেপে রাখতে না পেরে সে ক্ষীণ মুচকি হেসে উঠল। পাশে থাকা নাঈমও মুখ চেপে সেই হাস্যরসে যোগ দিল, এ অপ্রত্যাশিত দৃশ্যের ব্যঙ্গোত্তাপেই তাদের রসবোধ পূর্ণতা পায়।
মুগ্ধ হতচকিত, অবিশ্বাসে অনড় হয়ে, অস্থিরতায় আকস্মিকভাবে উঠে দাঁড়ালো! দৃপ্ত পায়ে রুদ্রর নিকট গমন করল, আঁখির দিকে এক নিবিড় দৃষ্টিপাত করেই কঠোর কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
——— "রুদ্র, নিজেকে সামলে নাও! ও ভয় পাবে!"
তবে মুগ্ধের সেই আশঙ্কাকে ব্যর্থ প্রমাণ করে আঁখিও নীরবে হাটু গেড়ে বসে পড়ল রুদ্রর সম্মুখে। তার টলমল চোখে গভীর স্নেহের প্রতিচ্ছবি, রুদ্রর মাথায় কোমল করতল বুলিয়ে দিলো, তার একান্ত সান্ত্বনার স্পর্শে শান্তি দিতে চায়। মুগ্ধ বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে, স্থির চক্ষে সেই অতুলনীয় মুহূর্তের মায়ায় আটকে রইলো।
এদিকে মহুয়া মৃদু পদক্ষেপে এসে রুদ্রর পৃষ্ঠদেশে স্নেহপূর্ণ হাতে আলতো বুলিয়ে বলল,
———" উঠো! আজ তো তোমার পাখির জন্মদিন, তাই না? তোমার সেই হারানো পাখিকে ফিরিয়ে আনতে না পারলেও, এই পাখিটিকে অন্তত তোমার কাছে এনে দিয়েছি! এখন অন্তত এই অবরুদ্ধ অশ্রু আর ঢেলে দিও না!"
রুদ্র টলমল চোখে ধীরে মহুয়ার দিকে মুখ তুলে চাইল, কণ্ঠে এক অপ্রকাশ্য আবেগের প্রবাহে বলল,
——— "তুমি জানো না মহুয়া, তুমি কি করেছো! আমার সমস্ত সুখ যেন এক পলকে ফিরিয়ে এনেছো!"
মহুয়া এক মৃদু হাসির রেশ রেখে বলল,
——— "এ কৃতিত্ব আমার নয়, সবই মুগ্ধ স্যারের জন্য হয়েছে!"
রুদ্র চোখের কোনের অশ্রু মুছে আঁখির বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করল। উঠে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকালো মুগ্ধর দিকে, যার চক্ষু অমলিনভাবে আঁখির নতশির উপস্থিতির প্রতি নিবদ্ধ। তার সেই নিস্পৃহ দৃষ্টি সময়কে থামিয়ে দিয়েছে।
রুদ্র আকস্মিক আবেগে মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরল, কণ্ঠে গভীর কৃতজ্ঞতায় বলল,
——— "অসংখ্য ধন্যবাদ, স্যার! আমার খুশির জন্য এত কিছু করেছেন!"
মুগ্ধ গলার স্বর ভারি করে, রুদ্রর পৃষ্ঠে একটি দৃঢ় হাত রেখে, আঁখির দিকে দৃষ্টিপাত করেই বলল,
——— "এ আয়োজন শুধু তোমার জন্য নয়, রুদ্র... এটা আমি নিজের জন্যই করেছি!"
মুগ্ধের সেই কথার অন্তর্গূঢ় অর্থ রুদ্রের কাছে অধরা রইলো, তবে তার নির্লিপ্ততা একপাশে রেখে রুদ্র ধীরে মুগ্ধকে ছাড়লো, আর পুনরায় ফিরে এসে আঁখির দুই কাঁধে হাত রেখে তাকে সযত্নে দাঁড় করালো। আঁখির চোখের ভেসে ওঠা অশ্রুকণা আঙুলের আলতো স্পর্শে মুছে দিয়ে বলল,
———" কাদবে না, বুঝলে? আমার আদরের বোনকে কাঁদতে আমি দিই না!"
আঁখির অন্তর্গত অশ্রু যেন বাধনছেঁড়া নদীর মতো প্রবল শোকের বেগে ভেসে উঠতে চাইলো, তবুও সে হাসির প্রতিচ্ছায়ায় মুখ তুলে বলে উঠল,
——— "তার আগে আপনার কান্না তো থামাতে হবে, তাই না, ভাইয়া?"
রুদ্রের হৃদয়ের অন্তঃসলিলা হাসি এবার ফুটে উঠল কণ্ঠে, মহুয়াও হাসিতে শামিল হলো; চারপাশে আনন্দের ছায়ায় ছুঁয়ে গেল মুহূর্ত। কেবল মুগ্ধ, একাকী প্রতিমার ন্যায় নিঃস্পন্দ, যেন পাথরের নিবিষ্টতার আবরণে এক গভীরতা নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে, কোনো অনুভূতির আভাস তার অন্তরে বিন্দুমাত্র নড়নচরণে প্রকাশ পেল না।
--
সেদিন মহুয়া ও রুদ্র মুগ্ধের সামনে কিছুটা এরকমই অন্তর্নিহিত আবেদন প্রকাশ করতে চেয়েছিল, যা কেবল তার উপস্থিতিতেই পূর্ণতা পাবে। আঁখির সামান্য সঙ্গেই রুদ্র তার মনের গহীনে হারানো পাখির প্রতিচ্ছবি আঁকতে পারে, তাকে জন্মদিনের নিরব দোয়ায় মোড়াতে পারে। কিন্তু মহুয়ার কণ্ঠে সেদিন জড়তা; মুগ্ধের এক কঠোর ধমকে তার সাহস নিমেষেই মিলিয়ে গিয়েছিল বিধেয় বলতে পারে নি।
তবে মুগ্ধ জানে রুদ্রের সেই হারানো বোনের কথা, যার প্রতিচ্ছবি সে আঁখির মাঝে খুঁজে ফেরে। তন্মধ্যে গতকাল প্রান্তর মৃত্যু! তাই রুদ্রের বিষাদময় হৃদয়ে সামান্য প্রশান্তি দিতে এ আয়োজন, CID-এর নিরন্তর দায়িত্বের মাঝে যা তাদের জন্য এক বিরল আনন্দ। আজ সেই মুহূর্ত, যেখানে এক ভাই তার হারানো বোনের স্মৃতি আঁখির মাঝে ফিরে পায়। এমনকি আঁখির পোশাকও মুগ্ধর রুচির প্রতিফলন—যা সে গত রাতে অর্ধেক রাত অবধি মহুয়ার সাথে শপিংমলে ঘুরে নিখুঁতভাবে বেছে এনেছে।
রেস্টুরেন্টের সমস্ত পরিবেশ আজ মুগ্ধর একক আয়োজনে পূর্ণ; অতিথিরা কেবল পথশিশু— শুধু কন্যা নয়! ক্ষুদে ছেলেরাও আছে, যারা কালো স্যুটে সজ্জিত, যেন ক্ষুদ্র বীরের মতো দীপ্ত। তাদের উচ্ছলতায় প্রতিধ্বনিত কাটে নিস্তব্ধতা, মুগ্ধর শীতল নির্দেশ ম্যানেজারের প্রতি, বাচ্চাদের বাধা দেয়ার সাহস কারও নেই।
তবে কি এ আয়োজন কেবল রুদ্রের ব্যথা হালকা করার জন্য? নাকি মুগ্ধর নিজের কোন গোপন আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ? মনে হয়, এই আড়ম্বরের অন্তরে তার নিজস্ব অপ্রকাশিত তৃষ্ণা এক শুদ্ধ সত্য হয়ে প্রকাশ পেতে চায়, নিষিদ্ধ বাসনার এক রুদ্ধ কুঠুরিতে।
এদিকে নাঈম, শান্তর দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফিসফিস করে ফের বলে উঠলো,
——— "দেখ, দেখ! এখনো কেমন তামাশা করে কাঁদছে এই সিআইডির গাধাগুলো!"
শান্ত বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বলল,
———" হুঁ, তোর মতোই! আঁখিও তো ওদের মতো করুণ রসের গাধার মতোই কাঁদছে! আহা, যত্তসব অভিনয়ের ঢং! এই নাটকীয়তা সহ্য করতেই পারি না!"
মুগ্ধ আর কোনো কথা না বলে নিজের ভেতর কঠোর এক গাম্ভীর্য ধারণ করে চেয়ারে বসে পড়লো, নির্বিকার।
এদিকে, একটু পরেই ছোট ছোট শিশুর দল গুনগুন শব্দে আঁখিকে ঘিরে জড়ো হতে থাকল, তাদের চোখেমুখে নিস্পাপ কৌতূহলের আলোক ঝিলিক। এই উচ্ছ্বাসের বহর দেখে আঁখির দুচোখ বেয়ে সুখের জোয়ার নেমে এলো। ওদিকে রুদ্র এক দৃষ্টিতে প্রাণভরে দেখছে আঁখির ওই স্বর্গীয় হাসি, তার মুখের কোণে লুকানো মৃদু আনন্দ ধীর গতি ছড়িয়ে যাচ্ছে, আর মহুয়া এই হাসির আবহে নিজেকে আরও মোহিত বোধ করছে।
এরই মধ্যে, এক পরিবেশক নিয়ে এলো বিশাল এক পঞ্চতলা কেক হাজির হলো, তার উচ্চতায় সীমাহীন উচ্ছ্বাসের আকৃতি ধরা পড়েছে। কেকটি দেখে সেই বাচ্চাদের মধ্যে আনন্দের তরঙ্গ বয়ে গেল, সবাই মিলে উল্লাসে ফেটে পড়ল। মহুয়া এগিয়ে গিয়ে শান্ত ও নাঈমের দিকে তাকিয়ে ধীর কণ্ঠে বলল,
——— "এখন কেক কাটার পালা! আপনারাও আসুন।"
শান্ত ঠোঁটের কোণে এক গোপন হাসি এনে বলল,
——— "এত নাটকের তো কোনো প্রয়োজন নেই আমাদের সামনে!"
মহুয়া ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কিছু বলতে পারল না; কেবল নিঃশব্দ হাসিতে তার কুণ্ঠা ঢাকা পড়ল। তারপর সেই হাসির আড়ালে নিজেকে সামলে মুগ্ধর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
——— "স্যার, আসুন!"
মুগ্ধ উদাসীনভাবে উত্তর দিল,
——— "তোমরাই কাটো।"
মহুয়া হালকা দ্বিধাভরা কণ্ঠে বলল,
——— "স্যার, এত আয়োজন তো আপনারই কারণে। আপনাকে ছাড়া এই মুহূর্ত কেমন ফাঁকা মনে হবে।"
মুগ্ধ অনড় স্থিরতায় বলল,
——— "আমি তো আছিই। যাও, তোমরাই কেক কাটো। আমি এখানেই বসে, শান্তিতে, এই স্থিরতায় আছি।"
মুগ্ধ মহুয়ার কথা শুনলেও তার মনোযোগ সম্পূর্ণরূপে নিবদ্ধ ছিল এক মায়াবী শ্যামবর্ণ কন্যার দিকে, যার প্রাণবন্ত মুখমণ্ডলে হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ছে, যার আনন্দময় খিলখিল শব্দ অলৌকিক সৌন্দর্যে ঘেরা এক মাধুর্যপ্রবাহ।
অতঃপর মহুয়া আর কোনো পীড়াপীড়ি করল না। সে ধীর পায়ে রুদ্রর দিকে এগিয়ে যেতেই রুদ্র ভ্রু কুঁচকে, ক্ষীণ উদ্বেগভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
——— "স্যার আসলেন না?"
মহুয়া অপ্রস্তুতভাবে উত্তর দিল,
——— "না!"
——— "কেন?"
——— "আমি জানি না!"
রুদ্র, মুগ্ধর দিকে চোখ তুলে তাকাল। মুগ্ধ দূরত্বের কঠোর দেয়াল তুলে, গাম্ভীর্যের চূড়ায় পা তুলে বসে রয়েছে। চোখ নিবদ্ধ নিস্তব্ধ মোবাইল স্ক্রিনে। রুদ্র সংকল্পিত পদক্ষেপে তার কাছে এগিয়ে এসে বলল,
——— "স্যার, আপনি কেন আসছেন না? আপনার উপস্থিতি ছাড়া কেক কাটার এই মুহূর্তের পূর্ণতা আসবে না। আসুন, দয়া করে!"
মুগ্ধ এক নিঃশব্দ হাসিতে মুখের কোণে অভ্যন্তরীণ ব্যঙ্গের আভাস এনে বলল,
——— "রুদ্র, তুমি নিজের কাজে মনোযোগ দাও। আঁখিকে নিয়ে কেক কাটো, এটাই তো চেয়েছিলে। আমার দিকে তাকানোর বা আমার অনুপস্থিতি নিয়ে চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি নিজ দায়িত্বে নিজেকে নিয়ে ঠিক আছি। অহেতুক জেদ কোরো না।"
রুদ্র এক মুহূর্ত স্থবির হয়ে রইল, অজ্ঞাত গহ্বরে হারিয়ে গেছে। কিছু না বলে স্থির থাকল, প্রশ্নের অতলান্তে নিজেকে সমর্পণ করেছে। যদি তীব্র আগ্রহ প্রকাশ করে স্যারের ক্রোধকে উসকে দেয়, তবে পরিস্থিতি আরও ঘনীভূত হবে, এবং আরেক সংকটের সৃষ্টি হবে। তাই সে নির্বাক স্থিরতা রক্ষা করে, নিরবে অপেক্ষা করতে লাগল, আর কতক্ষণ?
এই সময়ে, নাঈম উঠে পড়েছে আঁখির দিকে এগিয়ে গিয়েছে তার আগ্রহ এক লহমায় অন্যদিকে সরে গেছে। গিয়ে আঁখির পিঠে সংযুক্ত কৃত্রিম প্রজাপতির পাখাকে কৌতূহলভরা স্পর্শে টেনে বলল,
——— "কিরে মুরগি এখন পাখি হইল বুঝি? আহা, আল্লাহ্‌! এ যে ভূপৃষ্ঠের বাসিন্দা গাছে উড়তে শিখল! বুঝছি, এখন মাটি ছেড়ে আকাশে খোয়ার করতে হবে!"
নাঈমের এই উপহাস মিশ্রিত বক্তব্যে বাচ্চারা এক যোগে শব্দ করে অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল! আঁখি বিরক্তির অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বলল,
——— "আহ, তুই তো আসলেই কানা! থেকে যা কানাই হয়ে!"
——— "আর তুই যতই পাখা লাগাস না কেন, মুরগি মুরগিই থাকবি।"
ফের অট্টহাসে ফেটে পরলো বাচ্চাপার্টি! কিছুক্ষণ পরেই, সে বিশাল টেবিলের কেন্দ্রে স্থাপিত ঐ মহিরুহের মতো দৃষ্টিনন্দন কেকটির দিকে এগিয়ে গেল, যার চারপাশে অদেখা প্রতীক্ষার প্রবাহে উৎসুক শিশুদের মুগ্ধ দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে। রুদ্র এক কোমল প্রশ্রয়ে এগিয়ে এসে আঁখির পাশে দাঁড়াল; মুখে তার মৃদু হাসি, আর সে এক স্নেহময় স্পর্শে আঁখির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো, যেন আশীর্বাদের শীতল পরশে আবৃত করল তাকে।
কিন্তু নাঈম মৃদু ব্যঙ্গের মেঘে ছেয়ে আছে,তীক্ষ্ণ বিদ্রুপের তালে আঁখির মাথায় আলতো আঘাত করে বলল,
——— "এতো বড় কেক তুমি একা খাবি? রাক্ষসী একা কি করে উজাড় করবে এই নৈবেদ্য?"
শিশুরা আবারও অদৃশ্য হাসির মধুর সুরে পরিবেশকে জাগিয়ে তুলল; সেই আনন্দের প্রতিধ্বনি চারপাশে এক উজ্জ্বল উল্লাসের আবেশ ছড়িয়ে দিল। কিন্তু শান্ত তখনও কঠিন পাথরের মতো নির্নিমেষে বসে রইল, মুগ্ধর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। মুগ্ধর চঞ্চল দৃষ্টি আঁখির প্রতি নিবদ্ধ, আর সেই দৃষ্টি শান্তর অন্তরে তীব্র বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে তুলেছে, অধিকারবোধে উত্তপ্ত, এই ঔদ্ধত্যের ফল শীঘ্রই সে তাকে বুঝিয়ে দেবে।
এরপর কেক কাটার আচার সমাপ্ত হলো। আঁখি রুদ্র, নাঈম আর মহুয়াকে সযত্নে কেক খাইয়ে দিলো, তবে তার দৃষ্টি ছায়ার মতো ঘুরছিল শান্ত ও মুগ্ধর দিকে। শিশুগণ আনন্দে বিভোর; তাদের সঙ্গে মেতে উঠল রুদ্র, মহুয়া আর নাঈম। নাঈম মজা করে আঁখির মুখে কেক মাখিয়ে দিল, বিরক্তিতে আঁখির হাতের মুষ্টির কয়েক ঘুষি গিয়ে পড়ল নাঈমের শক্তপোক্ত পেটের ওপর!
অতঃপর আঁখির দৃষ্টি গড়াল নির্জন কোণে বসে থাকা শান্তর দিকে, যার কঠিন চোখে জ্বলছিল গভীর অপ্রকাশিত প্রতিশোধের স্পর্শ। মুগ্ধর প্রতি শান্তর দৃষ্টি, শীতল প্রতিহিংসার তির, যেটি অনবরত তাকে বিদ্ধ করে চলে। আঁখি সে দিকে তাকাতেই মুগ্ধর সঙ্গে তার চোখাচোখি হয়ে গেল। এই অপ্রত্যাশিত সংযোগে আঁখি একটু অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে রইল, তবে নিজেকে সামলে কেক হাতে শান্তর দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। কোমল প্রত্যাশা নিয়ে কেকটি তুলে বলল,
——— "নাও ভাইয়া!"
কিন্তু শান্ত তার অন্তর্গত ক্রোধে অনড় থেকে নাক কুঁচকে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
——— "হপ, আমি এই সস্তা কেক-সেক খাই না, দূরে যা এখান থেকে!"
আঁখি থমকে চোরা চোখে তাকালো মুগ্ধর দিকে, নিঃশব্দ ভাষায় সহানুভূতির অনুসন্ধান করে, যে ভাষায় শব্দের প্রয়োজন নেই, কেবল দৃষ্টির গভীরতা। এদিকে, রুদ্র, মহুয়া, নাঈম, আর শিশুদের মাঝে কেক বিতরণে মগ্ন, এই ছোটো উল্লাস তাদের অব্যক্ত সখ্যতার এক প্রতীক হয়ে উঠেছে।
আঁখি কেক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, বিষন্ন সন্ধ্যায় প্রদীপের ক্ষীণ শিখা। মুগ্ধের দিকে যাবে কি যাবে না, দ্বিধায় কুণ্ঠিত। এদিকে মুগ্ধ, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আঁখির দিকেই মগ্ন। শান্তর আর সহ্য হলো না! কঠিন পদক্ষেপে ধীর অথচ দৃপ্তভাবে এগিয়ে এসে মুগ্ধের সম্মুখে বসে শান্ত বলল, চোয়াল শক্ত করে,
——— "ওই দিকে এমনভাবে কি দেখছিস তুই?"
——— "অন্ধ নাকি? দেখতে পাচ্ছিস না?"
মুগ্ধ আঁখির দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এক বিন্দু বিচলিত না হয়েই উত্তর দিল। শান্তর আসা-যাওয়ার বালাই তার নেই। শান্ত ততোধিক ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,
——— "যেদিকে তোর দৃষ্টি নিবদ্ধ, সে দৃষ্টির মর্যাদা বুঝতে তোর চোখ উপড়ে নিতে বাধ্য হব!"
——— "আগে স্পর্শ কর! সাহস আছে তো?"
——— "আগে আমার দিকে তাকিয়ে কথা বল সাহস থাকলে!"
——— "তোকে দেখে কি করব, বল?"
——— "আমার বোনের দিকে হায়েনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছিস কেন?"
———" নীচু জীবনের দিকে দৃষ্টি প্রখর হয়। কি করব বল! পেশাদার গোয়েন্দা বলে কথা!"
——— "জানিস কার সাথে কথা বলছিস তুই?"
——— "কেন, ভুলে গেছি নাকি? যা, এখনই হাসপাতালে গিয়ে চেক কর!"
শান্তর অন্তরের রক্ত আগুনের উত্তাপে ফুটছে! ইচ্ছে করছে, মুগ্ধর গালে এমন এক ঘূর্ণিত আঘাত হেনে দিতে যাতে তার সমস্ত ঔদ্ধত্য ভেঙে চূর্ণ হয়। কতখানি সাহস ও মনের কঠোরতা যে, মুগ্ধ তার সঙ্গে এমন তুচ্ছতায় কথা বলছে! অথচ মুগ্ধর চেহারায় একটুও বিচলিত ভাব নেই। আজ সকল নিয়ম ভঙ্গের দিন বলে স্থির করেছে সে।
মহুয়া শান্তর তপ্ত মুখচ্ছবি দেখে একটু থমকে গেল, কিন্তু রুদ্রের সঙ্গে স্বল্প কিছু বাক্য বিনিময়ের পর মহুয়া দ্রুত শান্তর দিকে এগিয়ে এলো। মুগ্ধকে দেখে সে মৃদু হাসল যেন কিছু লুকিয়ে আছে সেই হাসিতে, তারপর শান্তর কাছে এসে বলল,
——— "আপনি একটু এদিকে আসবেন?"
——— "কী প্রয়োজনে?"
শান্ত বিরক্তি চেপে রাগত সুরে জিজ্ঞাসা করল। মহুয়া হালকা হাসি দিয়ে বলল,
——— "একটু প্রয়োজনীয় কথা আছে! "
শান্ত বিরক্ত হয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল এবং মহুয়ার দিকে কটাক্ষে তাকিয়ে রইল। মহুয়া সামান্য দূরে গিয়েই দাঁড়িয়ে তাকে আহ্বান করল। তার শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে তীক্ষ্ণতা এবং কিছু গূঢ় ইঙ্গিত যেন স্পষ্ট।
শান্ত ততোধিক উত্তেজনায় বলল,
———" কি বলবে, সরাসরি বলো!"
মহুয়া চাপা হাসির আড়ালে কোমল কণ্ঠে বলল,
——— "এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন আপনি? নিজের রাগকে সামলান! আমি বারবার বলেছিলাম না নিজের রাগ কন্ট্রলে রাখতে? "
শান্ত ক্রোধে দৃষ্টিকে শাণিত করে মহুয়ার দিকে চেয়ে কঠিন কণ্ঠে বলল,
——— "শোনো মহুয়া, কেবল আমার পায়ে পরে অনুরোধ করেছো! তাই আজ এখানে আঁখিকে আনতে সম্মত হয়েছি! আর সেই কারণেই, মুগ্ধের মতো এক বেহায়া ব্যক্তির উপস্থিতিতেও স্থির আছি। এজন্য তোমার উচিত আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া! এখন দেখো, ওই মুগ্ধের নির্লজ্জ দৃষ্টি কেমন নির্দ্বিধায় আঁখির প্রতি নিবদ্ধ! এ দৃশ্য আর আমার সহ্য হচ্ছে না, মহুয়া! ওকে থামাতে বলো, না হয় আমার হাত নিজেই শাসনে চলবে, এবং তখন তোমার কথাও কানে তুলব না!"
মহুয়া কোমল, শান্ত কণ্ঠে শান্তকে বোঝানোর চেষ্টা করল,
——— "এভাবে উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? আসলে এই সমস্ত আয়োজন স্যারেরই পরিকল্পনা। আর মেয়েটিকেও তো মিষ্টি লাগছে! সবাই-ই দেখছে! মুগ্ধ স্যার দেখলে ক্ষতি কি?"
শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে দমিত ক্রোধে বলল,
———" এই! আমার বোনের সুরক্ষায় কী ক্ষতি হতে পারে, আর কী না, সেই পাঠ আমায় শেখাতে এসো না। আর আমার সম্মুখে মুগ্ধর প্রতি এত সম্মান দেওয়ার সাহস কোথায় পেলে?? তোমার আসল স্যার কে তা কি ভুলে গিয়েছো? নাকি আমার মনে করাতে হবে.?? দ্বিতীয়বার এমন দূর্সাহস দেখালে তোমার আসল জায়গা কোথায় দেখিয়ে দিব আমি! "
মহুয়া অপ্রস্তুত হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে! অনুনয়ের সুরে বলল,
——— "আচ্ছা, আচ্ছা! তবে এই বিরক্তির আবরণ খুলে ফেলুন! আপনি নিজেই তো বলেছিলেন, আজকের এই মুহূর্তের জন্য আপনার হাসি বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত। তবে এখন ধৈর্য হারাচ্ছেন কেন? প্লিজ, নিজেকে সংযত করুন!
মহুয়ার কথায় শান্তর অন্তরে সামান্য শীতলতার প্রবাহ বইলেও, বিক্ষুব্ধ মনের উত্তাপ চাপা থাকে। সে ধীরে আসন গ্রহণ করল, ক্রোধের শিখা তবু অন্তরে বহমান।
মহুয়া গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসিমুখে রুদ্রর কাছে এগিয়ে গেলো। ইতিমধ্যে, শিশুদের সেই কোমল যুগল নৃত্যের আয়োজন শুরু হতে চলেছে। আঁখি দূর থেকে মুগ্ধের দিকে অদৃশ্য দৃষ্টিপাত করেই যাচ্ছে; অন্তরের অগোচরে প্রশান্ত হাসি, যদিও তার মুখাবয়বে কোনো স্পষ্ট প্রতিফলন নেই। অথচ, আঁখির কোনো পদক্ষেপের পূর্বেই, মুগ্ধ অতর্কিত বিদ্রোহে উন্মত্ত হয়ে উঠলো; সিঁড়ি ভেঙে সে হনহনিয়ে রেস্টুরেন্টের ঊর্ধ্বতলে অদৃশ্য হলো।
আঁখি স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে সেই দৃষ্টিগোচর আড়ালকে আবেগহীন চিত্তে বিদায় জানালো, কিন্তু তার মনের আভ্যন্তরীণ স্বকীয় হাসিটি তবুও রয়ে গেলো। তবে সে উপলব্ধি করলো, আগে তাকে মুখ হতে কেকের অবশিষ্টাংশ মুছে ফেলার জন্য ওয়াশরুমে প্রবেশ করতে হবে। নাঈম তাকে এক কদাকার প্রেতের রূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে!
মহুয়ার নিকট হতে আঁখি ওয়াশরুমের দিক নির্দেশনা জানলো এবং স্থির পদক্ষেপে এগিয়ে গেলো সেই পথে। এমন মুহূর্তেই শান্তকে চারপাশে একদল দুষ্টু শিশু-কিশোরা আবৃত করে ধরলো। বিরক্ত চিত্তে শান্ত তাদের দিকে তাকাল। এমন সময়ে এক ক্ষুদ্রকায়া মেয়েশিশু কৌতুকময় ভঙ্গিতে উচ্চারণ করলো,
——— "ওই হ্যান্ডসাম! আমার ডান্স পার্টনার হবে?"
শান্ত বিস্ময়বিহ্বলতায় বৃহৎ চোখে শিশুটির দিকে চেয়ে রইলো। অপরদিকে আরও এক কন্যাশিশু তৎক্ষণাৎ এগিয়ে এসে বলল,
——— "এই, এই! এই হ্যান্ডসাম আমার! কেউ তাকাবি না!"
এই নিয়ে শিশুগণ তৎক্ষণাৎ আলাপ-বিতর্ক এবং হালকা হস্তচালনায় রত হলো। শান্ত তাদের এই উচ্ছৃঙ্খল পেষণে নিজেকে বন্দী করে, টেবিলের উপর হাত রেখে গালে ভর দিয়ে নিস্তব্ধভাবে বসে রইলো, যেন জীবনের সব পাপের শাস্তি স্বয়ং বিধাতা এই নিষ্পাপদের হাতেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অন্তরাত্মায় এক মুহূর্তে প্রবল ইচ্ছা জাগলো, এই অশান্ত আত্মাগুলিকে দূরে তুলে আছাড় মেরে উরিয়ে দিতে।
কিন্তু হঠাৎ করেই সেই কোলাহলময় ক্ষুদ্রকায় কন্যাগণের মাঝে সে তার অতীতের স্মৃতিপটের ছবি দেখতে পেল, ছোটবেলার সেই ছোট্ট বোন, পূর্বিকা! সে-ও তো এমন উচ্ছলতার আধারে ছিল! অতীতের রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা সেই স্মৃতি আকস্মিক বেদনায় বুকের গহীনে হাহাকার তুলে আনলো, মৃদু কিন্তু গভীর শোকের ছায়ায় শান্তর চিত্ত আচ্ছন্ন হয়ে উঠল হুট করেই!
__________________
——— "কেমন আছো মা?"
নগরীর রাত্রি শাসনে উচুব্রিজের এক প্রান্তে বাইকের গায়ে আছড়ে পড়া ছায়ার ভিতর দাড়িয়ে কানে ফোন চেপে জিজ্ঞেস করলো আরাফ! অপর প্রান্তে, প্রৌঢ়া নিসা বেগমের কণ্ঠে কাঁপা সুরে ধ্বনিত হলো,
——— "ভালো আছি বাবা! তুই কেমন আছিস? খাচ্ছিস তো ঠিকমতো? কী করে আছিস ঐ খানে, আমাদের ছেড়ে বাঁচিস কি করে বাপ? আমার অন্তরের টুকরা ছিঁড়ে যায়!"
——— "আহা মা! আবার শুরু করলে! এর জন্যই তো ফোন দিতে মন চায় না! খেয়েছো বলো তো!"
———" হ্যাঁ!"
আঁচলের গভীরে মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙে পড়লেন নিসা বেগম। কেউ না জানুক, মা তো জানেন তার সন্তানের হৃদয়ে কত গোপন আঘাত, কেন সে এই দূরত্বের স্রোতে ভাসছে! নিসা বেগমের কান্নার নিস্তব্ধতা বুঝতে পেরে আরাফ বলল,
——— "মা, কেন এভাবে আবার কাঁদছো? আমি খুব ভালো আছি, মা! আচ্ছা, এখন রাখছি।"
বাক্যসমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই ফোন কেটে দিলো আরাফ। ঢাকায় নিজস্ব নির্জন আকাশচুম্বী ফ্ল্যাটে থাকছে! বড় এক প্রতিষ্ঠানে সদ্য প্রতিষ্ঠিত কর্মজীবী সে! কাজ শেষে সহকর্মীদের অনুরোধে শহরের কলরবে তাকে আসতেই হলো। কিন্তু নিজেকে একটু গুটিয়ে নিয়ে মায়ের সান্নিধ্যের ছায়া খুঁজে ফেলে, কিছুটা একান্ত বাতাসের ছোঁয়া পেতে এলোমেলো হাওয়ায় দাঁড়িয়ে রইল। শহরের গাঢ় শীত তাকে স্পর্শ করতে পারে না; এই হিমেল বাতাসে তবুও তার প্রাণের আগুন নিভে না।নিজেই আপনমনে উচ্চারণ করল,
——— "প্রিয়জনের জন্মদিনে তার কাছে পৌঁছতে না পারার এই হাহাকারটাই কি তবে সত্যিকারের বেদনার নিবিড় অভিজ্ঞান? কেমন আছো তুমি? মনে পড়েনি, তাই তো?"
আরাফের ঠোঁটে হাসির রেখা খেলে গেল। মুগ্ধ মাঝে মধ্যেই খোঁজ নেয়, কল করে জিজ্ঞেস করে। আরাফও কথার প্রতিত্তরে সাড়া দেয়, বড় ভাইয়ের প্রতি কোনো ক্রোধ, কোনো অভিযোগ তার বুকে নেই! তবুও হৃৎকম্পে একটুকরো শূলের গোপন কাঁপন রয়ে যায়। যখনই ভাবনায় আসে, তার হৃদয়ের শ্যামবতী, তার অস্তিত্বের শাশ্বত ধ্রুবতারা, আসলে তার নয়, সে ভাইয়ের অধিকারভুক্ত। তবুও, ভাইয়ের প্রতি সেই মায়ার টানে আবদ্ধ সে, ভালোবাসে তাকে সমানভাবে। আর সেই শ্যামবর্ণ কুমারীকেও! কী করবে সে? চোখে সহ্য করার সেই ক্ষমতা নেই, যে দৃশ্য তার সামনে দুইজনকে মিলিত দেখাবে! তাই নিঃশব্দে, নীরবে দূরে সরে এসেছে সে।
মৃদু হাস্যে আরাফ বলে উঠল,
———" আমার ভাই তোমায় সত্যিই ভালো রাখবে। বলব না যে আমার চেয়েও বেশি, কারণ, আমার সে সুযোগ কখনো আসেনি! কীভাবে বুঝবে তুমি? তবে হ্যাঁ! আমার ভাই তোমার সুখের আশ্রয় হয়ে উঠবে, নিঃসন্দেহে, তার খেয়ালে তুমি থাকবে অনির্বাণ দীপের মতো!"
_____________________
আঁখি ওয়াশরুমে প্রবেশ করে মুখে অর্পিত কেকের প্রলেপ অপসারণার্থে জলবিন্দুর স্রোতে মুখের প্রতি প্রতিটি কোণিকা নিষ্ঠার সাথে মুছে ফেলে। মুখমণ্ডল আঠালো আবরণ হতে মুক্ত করবার পর, সযত্নে রুমালের ঘষণে মুখমণ্ডল থেকে অবশিষ্ট চিহ্ন অপসারিত হলো। রেস্টুরেন্টের অভ্যন্তরে তাপমাত্রার কোনো হ্রাস নেই, কারণ
শীত নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা বিদ্যমান।
বের হতেই একদল ক্ষুদে মানব-শিশু আঁখির হাতের মুঠো ধারণ করল। আঁখি ক্ষুদ্র এক হাসি ছড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল,
——— “কি হয়েছে?”
——— “আমাদের সাথে চলো!”
আঁখি বিস্ময়ে গোল গোল নেত্রে তাদের প্রতি অবলোকন করল। শিশুগুলি আকর্ষণের অবিন্যস্ত স্রোতে আঁখিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, কোনোরূপ নড়াচড়ার অবকাশ নেই। আঁখি বাধ্য হয়ে তাদের অনুসরণ করল। কিন্তু, বাস্তবিক পরমাশ্চর্যে নিমগ্ন হলো সে, যখন দেখে বাচ্চারা তাকে সিঁড়ি ভেদ করে ছাদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই কনকনে হিমশীতল প্রহরে ছাদে কি আকস্মিক উদ্দেশ্যে তার অবস্থান?
আঁখির বিস্ময়স্তর আরো একটি ধাপ অতিক্রম করল, যখন শিশুরা তাকে ফেলে নিঃশব্দে মিলিয়ে গেল। আঁখি নিরাভরণ বিস্ময়ে স্থির, ঠোঁটের কোণে প্রশ্নের উদয়। আর তখনই কানে এলো এক প্রলয়ঘাতী শব্দের গর্জন, অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশকে বিদীর্ণ করে এক উজ্জ্বল মহাকাব্যের সূচনা করছে। আঁখি অনিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল। আকাশজুড়ে আতশবাজির রোশনাই যেন এক দিগন্তব্যাপী আলোকমালায় রূপ নিয়েছে।
ফিরে ফিরে বিস্ফোরিত হচ্ছে রঙিন আলোকশিখা, আর সেই আগুনের আঁচলে ইংরেজিতে খচিত এক গূঢ় শব্দাবলী,
❝“Happy death day in advance, Pranita❞
আঁখি বিস্ময়ের স্থিরতায় আটকে রইল। হৃৎপিণ্ড থমকে থমকে উঠছে, অদৃশ্য রহস্যের ঘোর তাকে চেপে ধরছে। সেই অজ্ঞাতনামা, নামহীন কাব্যিক পুরুষ কি এখানে, এত কাছে, এত সন্নিকটে? আঁখি আকুল হয়ে ছুটে গেল রেলিংয়ের কাছে, গভীর রাতের কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকারের মাঝে চোখ মেলে তাকাল। কিন্তু নিচে, চারপাশে কেউ নেই, একাকী নির্জনতা নৈঃশব্দ্যে ঘেরা। তবুও এই আতশবাজির আয়োজন কে করল? কার জন্য এই অভিনব আকাশবন্দনা?
তবে মৃত্যুর পরম্পরায় প্রেরিত অমোঘ শুভেচ্ছা পেয়ে আঁখির অন্তরে হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে পড়লো! যেন তার অভ্যন্তরীণ অস্বস্তির অন্ধকারে এক ধূসর আলোর বিন্দু। জন্মদিনের সকল আড়ম্বর তার বিতৃষ্ণার উচ্চতম শিখরে বিদ্ধ; তবে মহুয়ার একান্ত অনুরোধে এবং রুদ্র ও পথশিশুদের নির্মল আনন্দের প্রত্যাশায় সে এই বৈরাগ্যকে সংবরণ করেছে।
হঠাৎ, পেছন থেকে কঠিন অথচ শান্ত পুরুষালি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, প্রতিধ্বনি ছুঁয়ে গেল আঁখির অস্তিত্বের গভীর প্রান্তর,
——— "হয়েছি মাটির তৈরি, ফিরবো মাটির ঘরে,
এসেছি কেঁদে আমি, হাসিয়েছি সবারে।
শেষে যাবো ঘুমিয়ে, রেখে যাবো স্মৃতি,
সেদিন কাঁদবে সবাই, ভুলবে এই পৃথিবী।
এই জীবনের ভেলায়, সামান্য ক্ষণিকা,
তোমার কাছে চাহি একটু সময়িকা।
জন্মস্মরণ তো সবাই পালন করে বারংবার,
চলো, আমরা মৃত্যুদিন পালন করি এবার!
এই ক্ষণস্থায়ী প্রহরে চাই তোমার হাত,
শেষ পথ চলায় দিবে কি আমার সাথ?"
পেছনে ফিরে আঁখির দৃষ্টিতে প্রতিফলিত হলো সেই সুদৃঢ় কঠোর মুখাবয়ব; মুগ্ধ অবিচল পাথর-মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, শীতের দীর্ঘ কোটের গহ্বরে এক হাত লুকিয়ে, আরেক হাতে এক খণ্ড কাগজ ধারণ করে। আঁখির ভ্রু সংকুচিত হলো মুগ্ধের দিকে তাকিয়ে। এক গভীর, নিরাবেগ কণ্ঠে মুগ্ধ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
——— "এসব সংবেদনশীল আবর্জনা কে লিখেছে? শুধুই অপদার্থতা!”
এই বলেই বিরক্তি সহকারে হাতে থাকা কাগজটি বাতাসে নিক্ষেপ করে ছুড়ে ফেলল। অথচ আঁখির মুখে সামান্যতম প্রতিক্রিয়ার ছাপ পড়লো না; তার স্থির চাহনিতে এক স্নিগ্ধ অবজ্ঞা জাগ্রত। মুগ্ধের অনড় উপস্থিতিকে উপেক্ষা করেই ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সে; এক পলকেই ছুঁয়ে গেল সেই পতিত কাগজটি—এই হাতের লেখা তার হৃদয়ের অন্তর্লীন পরিচয়ের মতোই চিরপরিচিত। আঁখির ঠোঁটে প্রস্ফুটিত হলো এক রহস্যময় বাঁকা হাসি। মুগ্ধ পুনরায় কঠোর প্রশ্নে উচ্চারণ করলেন,
——— "তুমি এখানে কেন?”
আঁখি প্রতিধ্বনিরূপে নীরবতায় হাসল। রাতের হিমেল বাতাসে ছাদের কনকনে শীতে আচ্ছন্ন আকাশের নিচে রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে সে অপার্থিব নক্ষত্রবীথির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। মুগ্ধ সেখানে অনড়; তার প্রখর দৃষ্টি প্রতিটি সূক্ষ্ম ক্ষণে আঁখিকে পর্যবেক্ষণে অটুট রইল।
আঁখি মলিন কাগজ খানায় চোখ বুলালো! কাব্যরাজের লিখা শব্দগুলির উত্তরে হেসেই বলল,
———“অপরাধী আমি, এ দায় আমার সঙ্গী,
ভেঙেছি যে মন, তাই পাপীর রঙ মাখি রঙ্গী।
ভালোবাসার চাহিদা যে আমার অধিকার নয়,
পাপের রাস্তায় চলেছি, তাই হৃদয়ে নয় স্নেহ সঞ্চয়।
তবু , এ পথের শেষে যদি দেখান সঙ্গ,
আপনার ছায়ায় থাকবো লুকিয়ে, মুছে যাবো অন্তরঙ্গ।
মৃত্যুর সে স্মরণে আমরা করবো না দ্বিধা,
তবে জানেন না, আমি চিরদিনেরই বিধ্বংসী দাগধীতা।”
মুগ্ধ স্থির দাঁড়িয়ে রইল, তার মুখাবয়বে আবেগের লেশমাত্র প্রতিফলিত হলো না। ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এসে আঁখির পাশে দাঁড়িয়ে সে বলল,
——— "খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে এসব করো? আর কাজ নেই?"
আঁখি হাসিমুখে মুগ্ধর প্রশ্ন এরিয়ে উলটো প্রশ্ন করে বলল,
——— “আপনি কারণ ব্যতীত এমন কিছু করেননি, তাই না?"
মুগ্ধ দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির রেখে মৃদু কণ্ঠে প্রশ্ন তুলল,
———"তুমি কি মনে করো, তোমার জন্মদিন পালনই আমার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল?”
আঁখি কৌতুকভরা হাসিতে জবাব দিল,
——— “আমার ভাইদের হাতেনাতে ধরার জন্যই করেছেন, তাই তো? প্রত্যেক শিশুর কাছে ছোট্ট ট্র্যাকার চিপ বসিয়ে রেখেছেন, তাই না?”
মুগ্ধ ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলল,
———তার চেয়েও বেশি কিছু।”
আঁখি মৃদু হাসল এবং বলল,
——— “চেষ্টা করে দেখুন, ফলাফল মন্দ হবে না।”
মুগ্ধ কোনো উত্তর করল না; সামনের দিকে চাহনিকে অটুট রেখে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। ঠিক সেই মুহূর্তে টুং করে তার ফোনে একটি বার্তা এল। মুগ্ধ দ্রুত ফোন বের করে মেসেজ দেখল, জীবনের পাঠানো বার্তা:
———স্যার, আমার কাজ সমাপ্ত। আমি বিদায় নিচ্ছি।”
মুগ্ধ সুনিপুণ দক্ষতায় এক হাতে টাইপ করল নির্দেশ,
———"আজকের মতো এখানেই শেষ। যাও।”
আঁখি বুঝলো, এখানে দাঁড়িয়ে থাকার আর কোনো অর্থ নেই। তাই নির্জন পথে ধীর পায়ে যাত্রা শুরু করলো। হঠাৎ পেছন থেকে ভেসে এলো মুগ্ধর কণ্ঠস্বর,
——— "সকলেই তো সময় পায়! তবে এই নির্দয় হৃদয়হীন ষাঁড়টি পায় না কেন?"
আঁখি থমকে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকালো, মুগ্ধ সেই একই ভঙ্গিমায় সেখানে। একটি তিক্ত হাসির ছায়া আঁখির মনে খেলে গেল, তবে বাহিরে প্রকাশ করলো না। ফের মুগ্ধর পাশে এসে দাঁড়িয়ে দূর আকাশের ম্রিয়মাণ অন্ধকারে চেয়ে বলল,
——— "কী বলবেন? কেন থেমে আছে কথার স্রোত?"
———" সব ব্যথা বোঝার ক্ষমতা কি তোমার আছে? আমার যন্ত্রণা জানো কি?"
——— "কোথায় ব্যথা? বলুন, শুনতে চাই।"
মুগ্ধ আঁখির দিকে তাকিয়ে বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে বলল,
——— "এইখানে আঁচড়, স্পর্শহীন, যে বোঝেনি; হাহাকার শুধু এখানেই।"
আঁখির ঠোঁটে সেই তীব্র কঠিন হাসির রেখা ফুটে উঠলো,
——— "আহা! আমি তো ডাক্তার নই, ব্যথা সুধাবো কেমন করে?"
——— "যে ব্যথার তপ্ত ছোঁয়া বুঝবে না,, তার জন্য দুঃখ নিক্ষেপ করাও কি অন্যায় নয়?"
——— "আমি নিজেও তো ছিলাম পরিস্থতির দাস, বন্দী সেই শিকলে।"
মুগ্ধ কঠোর কন্ঠে সামনের অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশের পানে তাকিয়ে বলল,
——— "জানো কি, কিসের কথা বলছি?"
আঁখিও সামনের আধারপানা ছায়ায় স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
——— "অনেক কিছুই জানি।"
———" আহা, নির্বোধ মেয়ে, কিছুই জানো না! মর্ম তুমি কি বুঝবে!"
———" ততটুকুই আপনি জেনেছেন, যতটুকু জানিয়েছি! "
——— "বাকিটুকু বলো, শুনছি।"
——— "সময়ের তো অভাব! সঠিক দিন টি আসুক! "
——— "ভয় পাচ্ছো না তো মৃ'ত্যুকে?"
———" মৃত্যুর ভয়! আমি? হাহাহ! মৃত্যুর ছায়া তো কত কাছে এল, আবার দূরেও সরলো। কাজ তো শেষ হয়নি আমার।"
এক বিন্দুতে!"
——— "আমায় চিনতে পেরেছো কি?"
——— "কেন? ভুলে গেলেন আপনার পরিচয়? স্মৃতিশক্তি কি কমে গেছে?"
মুগ্ধ রহস্যময় হাসি হাসে, যেন অজানা গূঢ় বার্তার ইঙ্গিত,
——— "যে আমি, সেই আমিতে তুমি নেই। সবই জানতে পারবে, সব শেষ হলে।"
আঁখির ঠোঁটে অজ্ঞাত এক মৃদু হাসির রেখা, কণ্ঠে এক অদৃশ্য বিষাদের সুর,
——— "জীবনের সেই দিনটিই আমার প্রিয়, যে দিনটিতে জীবন হবে শেষ, সুখ আর দুঃখ মিলে যাবে।


Post a Comment

0 Comments

Close Menu