Ad Code

শ্যামকন্যার মায়াবী চোখ - পর্ব ৫২

 লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা

🚫🚫
কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।
🚫🚫
কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকা ভোরের নীরব প্রান্তর আধার এখনো দূর হয়নি, যেন নিশীথের বুক চিরে শীতের চাঁদর মুঠো করে ধরেছে কুয়াশা। এমন কালো আধারে এক অষ্টাদশী শ্যামলতীর কনকনে কাপে কাঁপে, হাতে কুপিবাতি। বাতির মৃদু আলোর কাঁপা কাঁপা ছায়ায় প্রকৃতির স্তব্ধতা দ্বিধায় দুলছে। ফজরের নামাজ শেষে, নিজের অজানা উদ্দেশ্যে গন্তব্যহীন পথে পা ফেলা এই কন্যা। কারো খোঁজে? নিজেকে পালাতে? না কি নিছকই প্রকৃতির সাথে মিলিয়ে যাওয়া? রহস্যের পরতের নিচে আড়ালে তার কারণ, প্রতিটি পদক্ষেপেই কোনো গভীর বেদনাবোধ মিশে আছে, অথচ স্বপ্নের কোনো অলিখিত ইঙ্গিত।
নীহারিকার নীল আবরণে মোড়া এই প্রভাতে, একাকিনী রহস্যময়ী, চলমান অজানার পথে। শীতল বাতাসে দোলে তার অঞ্চল, যেন কালো মেঘের খণ্ড, কুহেলিকার মাঝে তার রূপ, যেন স্বপ্নের অখণ্ড। কুপির শিখায় ঝলসে ওঠে তার মুখমণ্ডল শ্যামল, চক্ষু তার গভীর, ভাবনায় অতল। প্রতিবিম্বিত হয় সেই নয়নে জ্বলন্ত শিখার নৃত্য, যেন তার মনের গহনে লুকানো কোনো অমূল্য রত্ন। ওষ্ঠাধরে তার গোলাপি আভা, শীতের স্পর্শে কম্পমান, জিহ্বার অগ্রে আর্দ্রতা খোঁজে, যেন মরুভূমির তৃষ্ণার সন্ধান।
হিমশীতল বাতাসে জমে যায় নিঃশ্বাসের ধোঁয়া, তবুও থামে না, চলে যায় সে, যেন কোন অদৃশ্য টানে বোবা। হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় সে যেথা মিলেছে ধরা-আকাশ, যেখানে কুয়াশার আবরণে ঢাকা সকল দিগন্তের বিলাস। কেন এই স্থান? কেন এই ক্ষণ? কেন এই নির্জন প্রান্তর? উত্তর লুকানো রয়েছে বুঝি তার অন্তরের অন্তস্তর।
কোথায় যাবে? কোথায় থামবে? কে জানে তার পথের শেষ, হয়তো বা এই কুয়াশাচ্ছন্ন প্রান্তরেই লুকানো তার বিশেষ। নিয়তির লিখন পড়ে যেন এই শীতল প্রভাতে,
একাকিনী নারীর অন্তরের কথা, মৌন ভাষায় ব্যক্ত হতে।
অনুভূতির সূক্ষ্ম তন্তুতে বোনা অলৌকিক জাল,স্পন্দিত করে আঁখির অন্তর, করে তারে বিহ্বল। পশ্চাতে কারো উপস্থিতি যেন ছায়ার নীরব পদচারণা, অদৃশ্য সুতায় বাঁধা দুই প্রাণ - অজানা এক কারণা।ওষ্ঠপ্রান্তে ফুটে ওঠে হাসি, যেন চাঁদের কলা,অথচ চোখে গভীর প্রত্যয় - পিছন ফিরে না চলা। কে সেই অজানা? কেন এই ভোরে? কিসের টানে এলো? প্রশ্নগুলি মনে জাগে, তবু উত্তর পেলো না খোঁজে।
না ছিল কোনো সংকেত, না ছিল পূর্ব-আভাস,তবু কেমনে জেনেছে সে যে আঁখি করেছে প্রয়াস আসার এই শ্মশানভূমে, এই কুয়াশার প্রান্তে, যেখানে স্মৃতি মিশে আছে প্রভাতের শান্তে। দৈব যোগ? না কি নিয়তির খেলা? কে জানে এর উত্তর, হয়তো বা দুই আত্মার মাঝে আছে কোনো অমর সূর। যা বাঁধে তাদের অদৃশ্য বন্ধনে, করে একাকার, বিনা বার্তায়, বিনা সংকেতে, করে পথ সুগম তার।
কিন্তু আঁখির দৃঢ় প্রতিজ্ঞা - না ফেরা পিছন পানে, যতক্ষণ না সময় এসেছে মুখোমুখি হওয়ার মানে অপেক্ষা করুক সেই অজানা, যতদিন তার খুশি, যেদিন আসবে সামনে দাঁড়িয়ে, সেদিন মিটবে তৃষি।
নীহারের আবরণ ভেদি হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় আঁখি,
মুখে তার অপার্থিব হাসি, চোখে গভীর শান্তির সাক্ষী।
কুয়াশার পর্দা সরিয়ে অদৃশ্য দর্শকের পানে, উচ্চারিত হয় বাণী যা লিখিত ছিল বিধাতার খাতে,
——— "পুষ্পটি যেই ঝরে গেল বৃন্ত হতে আজি,
ভাববেন না আপনি স্রষ্টা তারে করেছেন ত্যাজি।
কোন এক অজানা উদ্যানে, দূর দিগন্তের পারে,
নব রূপে ফুটিয়েছেন তিনি, যতনে সাজিয়ে তারে।
যা কিছু হারালেন আপনি, যা গেল সরে,
অপেক্ষমান আছে কিছু, আরও উজ্জ্বল করে।
নীরবে বিধাতা বুনেন পথ, আলোকিত পরশ মেখে,
আপনার লাগি নূতন কোনো স্বপ্ন রয়েছে তাঁর চোখে।
এ যে হিসাবের জগৎ, প্রতিটি অঙ্ক মিলানো চাই,
স্রষ্টার লেখনীতে কভু ভুল থাকে নাই।
যা ছিল না তব ভাগ্যে লেখা, সে শূন্য পূরণ হবে,
নূতন কোনো রূপে এসে সান্ত্বনা আপনায় দিবে।"
নীহারের আড়ালে দুটি প্রাণ, একই সুরে বাঁধা, একজন চলে সামনে চেয়ে, অন্যজন পিছে কাঁদা। সময় যখন পূর্ণ হবে, মিলবে দুটি নয়ন, ততদিন থাক এই খেলা, এই অপূর্ণ শয়ন। নিরুদ্দেশ যাত্রায় মিলায় আঁখি কুয়াশার কোলে,অজানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজে চিরদিন দোলে। কেন এই পথ বেছে নেওয়া? কেন এই ভোর? নিজেই জানে না সে, কিংবা জানে - চুপি চোর। হয়তো বা জেনেছিল আগে থেকে কারো আগমন, কিংবা ছিল এ শুধুই মায়ার বিভ্রম। রহস্যের গভীরে লুকানো উত্তর হাজার,তবু নীরবতায় মৌন থাকে প্রশ্নের বাজার।
অন্ধকারের বুক চিরে দাঁড়িয়ে সেথায়, এক দৃঢ়কায় পুরুষ, কুয়াশার ছায়ায়। মহীরুহ সম উন্নত শির, দৃষ্টি অনন্ত পানে, হাতে তার সিগারেটের ধোঁয়া ওড়ে নীল আকাশের টানে। অদৃশ্য কোন চুম্বকের টানে বাঁধা তার দেহ, যেন কোন অলৌকিক শক্তি, অপার্থিব স্নেহ প্রতীক্ষার শেষে উচ্চারিত হয় তার কণ্ঠে বাণী, যা ছিল অনেক দিন ধরে হৃদয়ে গোপন কাহিনী,
——— "কী সহজ ভেবে বললে তুমি প্রতিটি কথার মালা,
জানো কি, হৃদয় তাহা শুনেছে নিরালা?
কানে যা পৌঁছায় তাহা কেবল শব্দের খেলা,
হৃদয়ে যা বাজে তাহাই চিরজীবনের মেলা।
তোমার কাছে যা ছিল সামান্য, অবহেলার পণ,
সেই শব্দগুলি করেছে মোর হৃদয় উপবন।
প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি স্বর গেঁথেছি প্রাণে,
খুঁজেছি তাদের গোপন অর্থ নিভৃত ধ্যানে।
একবার ফিরে তাকাও, দেখো সেই হৃদয়ের দরজা,
শব্দের আড়ালে আছে সেখানে অভিমানী সুরের আশা।"
আঁখির কানে পৌঁছায়নি একটিও বাক্য। দূরে চলে গিয়েছে সে, পা বাড়িয়েছে এক নৈঃশব্দ্যময় পথে, বাড়ির অভিমুখে। তবু, হৃদয়ের কোনো সুপ্ত কোণ কি জানতো এ অনুভূতির রহস্য? তার শ্যামবর্ণ মুখখানা কুপিবাতির আলোয় আবছা দীপ্ত, যেন নিজ সত্তার পরিসীমায় প্রবেশ করছে একাকী। হাঁটতে হাঁটতে আঁখি নিজেই বলে উঠল, গভীর এক প্রত্যয়ের সঙ্গে,
——— "আমি নিজ হাতে যে দ্বার করেছিলাম রুদ্ধ, তাতে তালা দিয়েছি সব আশার বিনাশী মুদ্রা মুদ্রিত।
দুমরে-মুচড়ে ভেঙেছি চাবি, রেখেছি সব স্মৃতি লুকিয়ে,
কেমন করে খুলব সে দরজা, যখন হৃদয়ই গেছে হারিয়ে?
তবু কোথাও যেন শোনা যায় চুপিসারে এক মৃদু আওয়াজ,
হয়তো দরজার ওপারে কেউ, আজও করছে প্রতীক্ষার সাজ।
কি লাভ আর খুলে সে বন্ধ দ্বার, যেখান থেকে ফিরেছি সেদিন,
তবু মন বলে, হয়তো সেখানেই আছে লুকিয়ে আমার অতল স্বপ্নের ঋণ।"
আর থামলো না পুরুষটি সে, অপেক্ষার বিন্দুমাত্র নেই,
শীতের কুয়াশায় ঢেকে, পথে চলেছে একা বেপরোয়া।
কনকনে হিমে কাঁপে, কোটের শিশির কণা ঝাড়ে, কেন এল সে এখানে, কোনো উত্তর নেই তার জানা। তবুও, তার আগমনের খবর কি ছড়িয়ে পড়েনি আগে পূর্বাভাসের বিন্দু, একটুও জানানোর প্রয়োজন কি ছিল কারো? সে জানলো সব, না-বলা কথার অর্থও পড়তে শিখেছে যেন, পদে পদে চলার মাঝে শব্দহীন প্রতিধ্বনি সে শুনলো নীরবে।
কিন্তু এ যে অন্তরের খেলা, মুখোমুখি হবার প্রয়োজন কই? ভাষাহীন হৃদয়ই সব কথা জানে, অন্তরেই যে সমস্ত প্রকাশ। অসহ্য রাগে মাথা ঝলসে ওঠে, রক্তগরম ক্ষোভে সে, প্রশ্ন তো ছিল না, তবু উত্তর নিয়ে এসেছে অন্তর তার কাছে,
——— "নির্দয় নারী, ভেঙেছ মন,
করে গেছ এক অনন্ত ক্ষণ।
তোমারই জন্য এ হৃদয় খু'ন,
তবুও এ অপরাধী, নিঃশব্দ চুপ।
তোমাকে ঘেন্না করি প্রতিটি ক্ষণে,
চাই না আর তোমায় জীবনের বনে।
তবুও শেষ প্রহরে, একটুখানি সাথ,
তোমায় মে'রে ম'রতে চাই, চির বিদায়ের রাত।
এ নিষিদ্ধ অনুভূতি, আমি যে পাপী,
তবুও তৃষ্ণা রয়, একান্তে একটু পাশে থাকি।
ম'রার আগের সেই ক্ষণিকের স্বাদে,
তোমায় নিয়েই যাই অন্তিমের পথে।"
________________
শীতের ঘন কুয়াশায় মোড়ানো সকাল। তবে, এমন সকালেরও আজ কোনো মূল্য নেই। গ্রামের বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে জমায়েত হয়েছে বিপুল জনতা। শিরশিরে উত্তেজনা প্রতিটি দৃষ্টিকে অগ্নি সঞ্চারিত করেছে। কারো চোখ কারো ওপর স্থির, অনাহূত সন্দেহের চাপা আলোড়নে প্রতিটি ব্যক্তিই যেন অপরিচিত এবং আড়াল করা এক অব্যক্ত গোপনীয়তার প্রতি অনুরক্ত।
সিআইডির অটল নিয়মের শৃঙ্খলে চারপাশে বেষ্টন করেছে জনতার মিছিল; অপরাধের করাল ছায়া এঁটে বসেছে তাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে। আজ পলাতকতার কোনো সুযোগ নেই। কে সেই হ'ত্যাকারী, যে এই নিঃশ্বাস কাঁপানো নৃ'শংসতায় এক মর্মান্তিক অধ্যায়ের সূচনা করেছে? অজানা কৌতূহলের গভীরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মোশারফ সাহেব, সাজ্জাদ সাহেব, আজগর আলী সহ সমাজের খ্যাতিমান ব্যক্তিগণ।
পুরুষেরা একদিকে স্থির, নারীরা অন্যদিকে নীরব; তাদের মধ্যে সন্দেহ ও সংশয়ের অদৃশ্য প্রাচীর উঠেছে। ধূসর আকাশের তলে, জনতার বিশাল এ উপস্থিতির সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে সিআইডির তীক্ষ্ণ ও নিবিড় চক্ষু মুগ্ধ, রুদ্র ও মহুয়া। তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রতিটি প্রাণের নিঃশ্বাসে বুনে দিচ্ছে এক অপরিচিত সংশয়ের বীজ।
আজগর আলীর চোখে গভীর ভাবনার ছায়া, চিন্তার ভাঁজ তার কপালজুড়ে অন্ধকার রাত্রির মেঘের মতো জমে উঠেছে। কে এই হিংস্র খু'নি, কোন ঘাতকের অদৃশ্য হাত এতো র'ক্তস্নাত অধ্যায়ের নেপথ্যে? তাঁর অন্তরালে দ্বিধা, সংশয়, আর অমীমাংসিত এক অনির্দেশ্য ভয় মস্তিষ্কে আচ্ছন্নতা এনে দিয়েছে।
ওদিকে আঁখির কোল ঘেঁষে আলো চুপিসারে জড়িয়ে আছে, তার তনুতন শরীর ভয়ে কাঁপছে, তীব্র স্রোতে ভেসে যাওয়া দুর্বল পাতা। জনসমুদ্রের ভিড় আর খু'নির প্রসঙ্গ তার কোমল আত্মায় বজ্রপাতের ন্যায় আঘাত হেনে গেছে। আলো ভীত, নিরুপায়, যার কচি হৃদয় ভয়ে ত্রস্ত। এ দৃশ্য দেখে ভোলা তীব্র রাগে স্ফুরিত; মনে মনে স্তুব্ধকণ্ঠে আলোর জন্য অগণিত বকাবকি অভিসম্পাত বর্ষণ করল। আঁখি তো তার একান্ত আপা! শুধু তার একার! আলো কেন তার আঁচল আঁকড়ে ধরে থাকবে? ভোলার চোখে বিদ্রূপের কটূরেখা খেলে দাদিকেই জড়িয়ে ধরলো!
তবে আঁখির দৃষ্টি তখনকার মতো স্থির অন্য কোনো দিকে, মুগ্ধর প্রতীক্ষারত চেহারায়। মুগ্ধর দিকে চেয়ে সে বুঝতে চেষ্টা করছে কোন নৈঃশব্দ্যের ভাষায় আজকের করাল দিনের পর্দা উন্মোচিত হবে।
মুগ্ধ এবার এক তির্যক হাসির রেখা ছুঁয়ে কথা বলার সাহসী আর অনিশ্চিত নীরবতা ভঙ্গ করল। কণ্ঠে গভীরতর রহস্যের ছায়া আকাশপটে আঁকা হল,
——— “খু'নি এখানেই আছে, আমাদের মাঝেই দাঁড়িয়ে।”
তার প্রতিধ্বনিতে সময় স্তব্ধ হলো, শীতল হাওয়া থমকে দাঁড়াল। মুহূর্তে সকলে একে অপরের দিকে ভীত ও সন্দেহভরে চেয়ে রইল, প্রতিটি দৃষ্টি নীরব তীক্ষ্ণ তির হয়ে ছুটে যাচ্ছে। এমন মুহূর্তে শান্ত ও নাঈমের চেহারায় বিরক্তির আঁচড়। গতরাতে দেরিতে ঘরে ফেরা আর এই প্রাতঃকালে জমাট কুয়াশায় এমন দুঃসহ উত্তেজনায় জর্জরিত। তাদের দৃষ্টিতে শীতল তীক্ষ্ণতা মিশে গেল।
এমন সময়ে এক বৃদ্ধা তাঁর কাঁপা কণ্ঠে বিস্ময়ের ছায়া টেনে জিজ্ঞাসা করল,
——— “কে? কে এমন নৃ'শংস কাজ করেছে?”
মুগ্ধ নিস্তরঙ্গ স্থিরতায় পায়চারি শুরু করল, মহাকাব্যের গোপন দৃশ্যপট উন্মোচনের পূর্ব মুহূর্তে কাহিনির সূক্ষ্ম রেখাগুলি তার পদচিহ্নে জমাট বাঁধছে। সে থমকে দাঁড়াল, পকেটে হাত গুঁজে এক দুর্বোধ্য হাসি হেসে বলল,
——— “বলব, বলব অবশ্যই। তবে আগে সেই ধুরন্ধর ছলনাগুলি বলি, যে প্রতারণার জালে আমাদেরও এতদিন বিভ্রান্ত করেছে।”
মুগ্ধ রুদ্রকে ইশারা করতেই রুদ্র এবার কঠোর মুখভঙ্গিতে এক নিস্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করে বলল,
——— “মোবারক! হ্যাঁ, সেই মোবারক এই গ্রামেরই এক সাধারণ কৃষক মদনের মেয়ের জামাই। মদন ও মোবারক দুজনেই শিকদার বাড়ির কাজের নীচু চক্রে আবদ্ধ। আর রাসেল সাহেব, গ্রামের খ্যাতিমান কলেজের সেই হিসাববিজ্ঞান শিক্ষক। রুপা, সেই নিষ্পাপ মেয়েটি, যার পবিত্রতা ছিঁ'ড়ে খানখান করা হয়েছিল নি'ষ্ঠুরতার নির্মম হাতেঘাতে। তার বাবার বিচূর্ণ হৃদয়, যে ভগ্নপ্রাণ, খু'নির হাতে মাথা কে'টে সেই মেয়ের কবরের কাছেই রেখে দেওয়া হয়েছে তাকে! এবং শেষত ইকরাম আলী, এই গ্রামেরই চেয়ারম্যান, ক্ষমতার অলিন্দে ঘুরপাক খাওয়া সেই ব্যক্তি। এদের প্রত্যেকের পরিচয় আলাদা হলেও, এক বিষাক্ত সুতোয় এরা সকলেই বাঁধা।”
অত:পর রুদ্র চুপ হলো! মুগ্ধের কণ্ঠ অপার বিষাদে শূন্যকে বিদ্ধ করল, মর্মভেদী তীব্রতায়,
——— “মোবারক, রাসেল, রুপার বাবা, ইকরাম আলী, প্রতিটি আত্মা ছিল মদের নেশায় আসক্ত, নারীলোভে অন্ধ, ভ্রষ্টতার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত। আর এই চারজনের মধ্যে যে কেউ, হ্যাঁ, এদেরই কেউ সেই পশুত্বের রূপ ধরে, রুপার ওপর নারকীয় লালসার ছোবল বসিয়েছিল।"
রুপার কথা পুনরায় শুনে আঁখির বুক অবশ হয়ে এলো; তার হৃদয়বিদীর্ণ হলো তীব্র ব্যথায়। চোখ দুটি টলমল করে উঠল জলকণায়, রুপার জন্যে কান্না থমকে আছে তার নিঃশব্দ চোখের কোণে।
রুদ্রের হাতে ধরা কিছু নীরব সাক্ষী মৃ'ত্যুর করাল ছায়া বয়ে আনা কিছু প্রমাণাদি, যা সযত্নে রাখা স্বচ্ছ প্রমাণ খামে। মুগ্ধ ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে সেই প্রমাণ রুদ্রের হাত থেকে তুলে নিল। চোখে নেমে এল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, আর নিস্তব্ধ জনতার সামনে সেই রহস্যময় খাম উঁচিয়ে ধরল, যেন সত্যকে এক মুহূর্তে উন্মোচন করল,
——— “দেখুন, এটি একটি কাপড়ের টুকরো! এই দামি শাড়ির অংশবিশেষ আমরা পেয়েছি মোবারকের মৃ'তদেহের পাশে, সেই শীতল ভূমিতে যেখানে চিরদিনের জন্য অচেতন হয়ে পড়েছিল সে। এই টুকরোটি আটকে ছিল কাটা ঝোপের সঙ্গে, অসহায়ভাবে ঝুলছিল, নিঃশব্দ সাক্ষী হিসেবে। তবে, খু'নি মনে করেছিল প্রমাণ মুছে ফেলবে, তাই পুরো শাড়িটিই পুড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু সে হয়তো জানে না, পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও, আমরা সেই পোড়া স্থান থেকেও সমস্ত কিছুর অণুপরমাণু অবধি উন্মোচন করতে পারি।”
সকলের মাঝে, কণ্ঠে তীব্র কৌতূহল মিশিয়ে এক মহিলা বলে উঠল,
——— "শাড়ি? তবে কি এই হ'ত্যাকাণ্ড নারীর কর্ম?"
রুদ্র, বরফশীতল দৃঢ় কণ্ঠে প্রতিউত্তর করল,
——— "প্রথমে আমাদের সম্পূর্ণ ঘটনাক্রম উপস্থাপন করতে দিন।"
তার কঠোর কণ্ঠের শীতলতায় সকলেই স্তব্ধ হয়ে নীরব রইল। এই নীরবতার মাঝে, রুদ্রের হাত থেকে মুগ্ধ তুলে নিল আরও একটি প্রমাণ; প্রমাণটি সচ্ছ প্লাস্টিকের ব্যাগে সযত্নে মোড়ানো। দৃষ্টির ধারালো প্রখরতায় চোখ রইল সকলের উপর। গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল,
——— "এটি একটি ক'ন'ড'ম, রাসেলের নিথর দেহের সন্নিকটে পাওয়া গেছে এটি আগেই। তবে পুলিশের অযোগ্যতার কারণে এতদিন এই সূক্ষ্ম প্রমাণ কেউই নজরে আনতে পারেনি। খুনি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত চতুর। গ্লাভসের আড়ালে হাত ঢেকে রেখে সে প্রমাণের স্পর্শ করেছে। তবে ভুলের অবকাশে সে একটি ক্ষুদ্র নিদর্শন রেখে গেছে নিজের চোখের এক পতিত পাপড়ি।"
এরপর, শাণিত দৃষ্টির তীক্ষ্ণতায় রুদ্রের হাতে তুলে দিলো প্রমাণপত্র। মুগ্ধের এমন অপরাজেয় কৌশলের প্রকাশ দেখে সুহানা বেগমের অন্তর দিগন্ত প্রসারিত হয়ে উঠলো। তার ছেলেটি আজ যে শুধু পূর্ণতা পেয়েছে তা-ই নয়, এক ন্যায়পথের সেনানী হয়ে দাঁড়িয়েছে; এক নির্ভীক সিআইডি, অপ্রতিরোধ্য প্রজ্ঞার প্রতিভূ।
মুগ্ধের কণ্ঠে তখন রিক্ত সমাচারের গূঢ় শৈল্পিক গাম্ভীর্য। কঠিন, কঠোর ভাষায় সে ঘোষণা করলো,
——— “হ্যাঁ, খুনি চতুর, এতে সন্দেহ নেই। প্রতারণার মোহনায় সে সরাসরি প্রবেশ করেছে রূপার বাড়িতে, সেই স্থানেই নি'র্মম নির্মাল্যরূপে হ'ত্যা করেছে তারই বাবাকে। তবে ভুলের রেখা এঁকেছে সে, এক ফাঁক রেখে গিয়েছে তারই ত্রুটিপূর্ণ কৌশলে। খুনি সেই চেয়ারে রেখে গিয়েছে গ্লাভস বিহীন স্পর্শের চিহ্ন, যে চেয়ারে রূপার বাবা বিশ্রামরত ছিলেন। আমাদের পাণিতলে এসেছে সেই অপরিচিত আঙুলের ছাপ! এ ছাপের অধিকারী ওই স্থানে আগমন করা তো দূরের কথা, চিন্তার অবকাশও রাখেনি কখনো!"
মুগ্ধ থামলো! এবার রুদ্র কঠোর কন্ঠে প্রত্যেকের দিকে তাকিয়ে বলল,
——— "কিন্তু মুদ্রার উল্টো পিঠও স্পষ্ট খুনির অসতর্ক পায়ের স্পর্শ রয়ে গেছে মাটিতে। রূপার গৃহমাটির উপর প্রলেপিত বালি সেই চিহ্ন ধারণ করেছে। রূপার বাবার অসাবধানতায় হাতে থেকে পানি পরে ভিজেছিল মাটি, আর ওই প্রলেপে খুনির পায়ের অভিজাত চিহ্ন ফুটে উঠেছে অনবদ্য সাক্ষ্য হিসেবেই। সেই জুতোর চিহ্নের ব্র্যান্ড, যেটা শুধু সেই ব্যবহার করে ! "
মুগ্ধ অস্বস্তির তরঙ্গ পাঠালো শ্রোতার হৃদয়তলে। এক দৃপ্ত দৃষ্টির দীপ্তিতে সে পুনরায় উচ্চারণ করলো,
——— “এবার আসা যাক এই গ্রামপল্লীর প্রাক্তন চেয়ারম্যান ইকরাম আলীর প্রসঙ্গে!”
কথার প্রতিটি ধ্বনি গ্রামবাসীর মর্মমূলে শিহরণ জাগালো। অজানা আতঙ্কের করাল ছায়া গ্রাস করলো প্রত্যেকের হৃদয়, একরাশ অজানা বিপদের অশুভ ইঙ্গিত তাদের বুকের উপর ভার হয়ে চেপে বসলো। ফিসফিসিয়ে উঠলো গুঞ্জন, সন্দেহের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়লো নিঃশব্দ বাতাসে। এদিকে মোশারফ সাহেবের ঠোঁটের কোণে ক্ষণিকের জন্য দেখা দিলো হাসির আভাস, যা পরক্ষণেই শূন্যতাতে বিলীন হয়ে গেলো। আর রোহান, তার চোখে জ্বলজ্বলে কৌতূহল, আনন্দে ভরে উঠেছে তার বন্ধু সিআইডির অতুলনীয় দক্ষতা দেখে।
এমন এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে মুগ্ধ নিঃশব্দ পদক্ষেপে এগিয়ে গেলো এক নারীর সম্মুখে। তার অভিসন্ধিপূর্ণ চাহনির তীক্ষ্ণতা সেই নারীর অন্তরে রণভীতি সঞ্চার করলো। আর গ্রামবাসী চমকে তাকিয়ে রইল অবাক দৃষ্টিতে। মুগ্ধের ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক গাঢ়, করুণামিশ্রিত হাসির রেখা, আর তারপর, শীতল অথচ কঠোর কণ্ঠে সে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
——— “আপনার স্বামীকে কেমনভাবে হ'ত্যা করেছেন, সেটা না হয় আপনার মুখেই শুনা যাক, আফিয়া বেগম?"
ক্রোধে কিড়মিড় করে তাকালেন আফিয়া বেগম! জলছে আগুন চোখে! এক মুহূর্তের স্তব্ধতা। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ জনতা; অবিশ্বাসে আকাশচুম্বী নিস্তব্ধতায় গ্রামবাসীর মুখ হাঁ হয়ে আছে। ধপ করে উঠে পড়লেন আজগর; তার মুখশ্রীতে প্রতিফলিত হলো ক্রোধ ও হতাশার শীতল ঝড়। নাঈমের চোয়াল কঠিন ইস্পাতের মতো শক্ত হয়ে উঠলো, চোখের পাতায় জমাট বাঁধা এক নিরবদ্রোহ। আঁখি যেন রোবটের মতো স্থিরতায় থেমে গেলো । আর আলো, কণ্ঠ তার কাঁপছে শঙ্কায়, নিস্তেজ স্বরে ফিসফিস করে উঠলো,
——— “বড় আম্মু! বড় আব্বুকে… মেরে ফেলেছে?”
শান্ত চোখে তীব্র অগ্নির শিখা ফুটিয়ে চিৎকার করে উঠল, রাগ আর অবিশ্বাসে গলা ফেটে পড়ছে তার,
——— "এইইই! তোদের এত সাহস হলো কি করে আমার মা'কে খু'নি বলার!"
মুগ্ধ শান্তর দিকে তাকাল কঠিন, অভেদ্য চোখে, তার মুখে এক ঠাণ্ডা হাসি ফুটে উঠল। সেই হাসিতে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত, এক অভ্রান্ত আত্মবিশ্বাস। সে শান্ত গলায় বলল,
———"তুই আর নাঈম তো আমাদের সাহায্য করেছিস তোর মা'কে ধরিয়ে দিতে! হ্যাঁ, তোরা দুজনই!"
শান্ত আর নাঈম স্তব্ধ হয়ে গেল। অবাক দৃষ্টিতে তারা মুগ্ধর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, একরাশ অবিশ্বাস আর বিভ্রান্তির ঘোর তাদের দৃষ্টিতে। মুগ্ধ নিস্তেজ অথচ বিষাক্ত হাসিতে বলল,
——— "তোদের কী মনে হয়েছিল? গতকাল রাতে আমি তোদের বোনের শুধু জন্মদিন পালনের জন্যই নিমন্ত্রণ করেছিলাম? শুধুই তোদের আমোদ-প্রমোদের আয়োজন করেছিলাম, এমনটাই ভেবেছিলি! আহ, মুর্খেরা! ওটা ছিল আমার শেষ চাল, নিখুঁত কৌশল। আর এই চাল চালতে আমাদের ইন্সপেক্টর মহুয়াও সাহায্য করেছে বটে। তার অসহায় কণ্ঠে তোদের কাছে অনুরোধ করেছিল, আফিয়া বেগমের হাতে বানানো সেই নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের চা যেন তার জন্য আনা হয়। কেননা সেই চায়ের স্বাদ তার মায়ের স্মৃতি জাগায়!"
মহুয়া কাচুমাচু করে এদিক ওদিকে তাকাচ্ছে বারংবার! রুদ্র নিজেও জানতো না গতরাতের বিষয়টি মুগ্ধর কোনো চাল হতে পারে! জেনেছে আজ আসার পথে! মুগ্ধ থামলো একটু, কথা পুরোপুরি মগজে ঢোকায় সকলকে। এরপর মৃদু হাসি বজায় রেখে বলল,
——— “তবে, তোদের বোধহয় জানা নেই, ইকরাম আলীর দেহে সেই একই চায়ের অদৃশ্য বি'ষের চি'হ্ন মিলেছিল পোস্টমর্টেমে। আফিয়া বেগম বুদ্ধিমতী, সন্দেহ হওয়ার পর পরই চুপিসারে বদলে দিয়েছিলেন সেই চায়ের ব্র্যান্ড। একবারে বন্ধ করে দিয়েছিলেন এলাচের সেই বিশেষ চা বানানো। কিন্তু মাস পেরিয়ে গেলেও যখন দেখলেন আমরা চা নিয়ে কেউ কিছু বলছি না, তখন নিশ্চিত হয়ে আবার দুদিন আগে ঠিক সেই একই ব্র্যান্ডের চা আনলেন তিনি, তৈরি শুরু করলেন ফের বানাতে! মানুষ অভ্যেসের দাস! আর এখানেই করলেন তার প্রথম এবং চূড়ান্ত ভুল!”
অত:পর রুদ্র তার গম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করলো,
——— "আর এতক্ষণ যে খুনির প্রমাণের কথা আমরা বলছিলাম, সেই সবটাই গ্রামপতির সহধর্মিণী, শিকদার বাড়ির বড় বউ,আফিয়া বেগমের বিরুদ্ধে!"
রুদ্রের এই কথায় যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিলো! আফিয়া বেগমের চোখে ফুটে উঠলো প্রচণ্ড রাগ আর অবজ্ঞার দৃষ্টি, যা নিক্ষিপ্ত হলো রুদ্র ও মুগ্ধের দিকে। চারপাশে জনতার মধ্যে রীতিমতো তুমুল হইচই শুরু হলো, সবাই ফিসফিসিয়ে বলতে লাগলো, এতগুলো খু'ন, তবে কি সত্যিই আফিয়া বেগমের হাতে সম্পন্ন হয়েছে? জনতার মধ্যে থেকে কেউ কেউ ছি ছি শুরু করে দিলো, তাদের বিস্ময় আর অবিশ্বাস স্পষ্ট হয়ে উঠলো মুখে।
আজগর ভেতরে ভেতরে অভূতপূর্ব সংকটে পড়ে গেলো। তার অন্তরে একদিকে ভয়, অন্যদিকে গোপন হতাশা। সে মনে মনে বিড়বিড় করে উঠলো,
——— “কী করেছো ভাবি? এতগুলো খু'ন?? আর নিজের স্বামীকেই…! একবার বললেই তো আমি সাহায্য করে দিতাম! আমারই তো শক্তি আর ক্ষমতা ছিল…”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো আজগর, এমনকি নিজের মনেই সন্দেহ জাগলো, এই বিপদে আফিয়া বেগম যদি তাকে ফাঁসিয়ে দেয়? তারও তো গোপনীয়তা আফিয়া বেগমের নখদর্পণে! গ্রামে তার যে মানমর্যাদা আর প্রতিপত্তি আছে, সেই সম্মান রক্ষা করাও জরুরি। নিজের মনে অগোছালো ভাবনা চেপে রেখে আজগর মুখে ভান ধরে বিস্ময় আর বেদনার অভিনয় করে চিৎকার করে উঠলো,
——— “ভাবি, তুমি? তুমি আমার ভাইকে খু'ন করেছো? কেন করেছো এমন? আমার ভাই তো আমার বাবার মতো ছিল, হায় আল্লাহ! এই অভাগা চোখ দিয়ে এই দুঃখ দেখতে হলো! আর আমার ভাই… সে নারীলোভী ছিল ঠিকই, তবে যতই হোক, সে তো আমার কলিজার ভাই! তাকে শাস্তি দেওয়া যেত আইনের আওতায় এনে, কিন্তু তাই বলে প্রাণটাই কেড়ে নেবে? আর এতগুলো খু'ন?? এ কী করে করলে, ভাবি?”
কথা শেষ করেই আজগর আলী তার চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু মুছতে শুরু করলো, পুরো গ্রাম দেখতে পেল তার গভীর বেদনা।
আফিয়া বেগমের চোখে দাহানলের শিখা, তার দৃষ্টির পলক আজগর আলীর দিকে স্ফুলিঙ্গের মতো ছুটে গেলো। আজগর আলী তখন প্রাসাদপতনের শোকমগ্ন পুত্রের মতো ক্রমাগত হাহাকার করে যাচ্ছেন। একদিকে কপট কান্নার ছলনায় গ্রামের প্রভাবশালী মানুষেরা তাকে সমবেদনা জানাতে এগিয়ে আসছে।
এই দৃশ্য দেখেই পাশে দাঁড়ানো রোকেয়া বেগমের মুখে ভাঁড়ামি হাসি ফুটে উঠলো, কটাক্ষমিশ্রিত কথায় মনে মনে বলল,
———“এহ্! দেখো ঢংটা! যেন বড় ভাইয়ের মরার শোকে হাহাকার করেই ম'রবে! আসলে নিজেও তো ভাইয়ের প্রাণ নিতে চেয়েছিল!”
কিন্তু নিজের কথার গভীরে বিদ্ধ হয়ে হঠাৎ সন্দেহের আঁচ পেলো রোকেয়া। তার মনে শঙ্কার ঘনঘটা তৈরি হলো, আফিয়া বেগম যদি তাকেও ফাঁদে ফেলে দেয়? সেই ভয়ে রোকেয়া বেগমও ভান ধরে আচলের আড়ালে চোখ মুছে বলল,
——— "ছি ছি ভাবি! নিজের স্বামীকে খু'ন করেছো এমন নির্মমতায়? এতটুকু কি বুক কাঁপলো না? হ্যাঁ, সে হয়তো নারীলোভী ছিল, কিন্তু পুলিশে অভিযোগ করলে কি ক্ষতি হতো? এই নিষ্ঠুরতায় ভর করে এতগুলো নিরীহ প্রাণ নিলে? কীভাবে পারলে ভাবি!"
রোকেয়ার চোখের জলের কপট প্রকাশে উপস্থিত জনতা সহানুভূতির ঢেউয়ে ভেসে গেল। কেউ আর সন্দেহ করলো না তার ভানটিকে। তাদের সমবেদনার মাঝেই কানিজ বেগমের চোখ পড়ল রোকেয়ার কূট অভিনয়ে। মনে মনে হেসে উঠলো, ভাবল যে, আমাকেও বুঝি অভিনয়ের মঞ্চে নামতে হবে। তার অন্তরে ক্রোধ আর দীর্ঘ দিনের বিরূপতার জ্বালা দাউদাউ করে জ্বলতে লাগলো। এই সুযোগে তার স্বামীর প্রতিশোধের পথ খুঁজে পেল সে।
কানিজ বেগম মুখের বাঁকে চোখের জল মুছতে মুছতে গলার গাম্ভীর্যে বলল,
——— "আমার স্বামীকেও বড় ভাই আর ভাবি মিলে ফাঁসিয়ে দিয়েছে! নতুবা তাকে তো প্রাণনাশের হুমকিই দিতেন তারা। বাধ্য হয়ে আমার স্বামী ওমন খু'নের মতো অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়েছিল, তা না হলে সে প্রাণে বাঁচতে পারতো না! আর বড় ভাই… সে হয়তো ভাবির কোনো কথা শুনতেই চায়নি, তাই তাকেও ঠাণ্ডা মাথায় হ'ত্যা করা হলো। ভাবির পাপে এতগুলো প্রাণ হানির মূলে সেই এক দাহানল! আমার মনে হয়, তার তাদের সাথে অবৈধ সম্পর্ক ছিল, আর সেই কলঙ্ক ঢাকতে এই হ'ত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে সে! সিআইডি তো বললই, ওরা সবাই নারীলোভী ছিল।”
সকলের মুখে মুখে এখন একটাই কথা, আফিয়া বেগমের সেই পাপপঙ্কিল সম্পর্ক! কানিজ বেগমের কথার পর সকলেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করলো, এই ন'রঘা'তিনী নারী সত্যিই তাদের সঙ্গী ছিল অধর্মের গভীর অন্ধকারে। ইকরাম আলী হয়তো সেই পাপ জানবার দুঃসাহস করেছিল, আর সেই কারণেই সবাইকে একে একে মৃ'ত্যুর যাঁতাকলে পিষ্ট করেছে সে। আফিয়া বেগমের দিক থেকে সবাই কেবল বিরক্তির মুখ ফিরিয়ে নিলো, কেউ কেউ তো ঘৃ'ণার থুতু ছুড়ে দিলো। আজগর আলী মনের মধ্যে কৃত্রিম বিষাদের আড়ালে আসলে সন্তুষ্টি অনুভব করলেন। মেজো ভাইয়ের বউয়ের এই প্রজ্ঞাবলে তিনি মুগ্ধ হলেন, মানতেই হবে, কানিজ বেগমের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির সুবাদেই কুদ্দুস আলী এতদিন নিরাপদে টিকে ছিল!
মায়ের এমন কথা, তন্মধ্যে সকলের তিক্ততা ও ধিক্কারবাণী শুনে না পেরে, নাঈম গর্জে উঠলো,
——— “মা! আর একটা আপত্তিকর শব্দ যেন আমার বড় মাকে নিয়ে উচ্চারিত না হয়,, নয়ত খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম!”
কানিজ বেগমের কণ্ঠে কপট কান্নার ভার আরও বাড়লো, মুখ ঢেকে কান্নার সুরে সকলকে বললেন,
——— "দেখো তোমরা! আমার ছেলেকেও কেমন বশ করেছে ভাবি! দেখো কেমন নির্দয়ভাবে হুমকি দিয়ে মায়ের সাথে কথা বলছে!"
নাঈমের র'ক্ত ক্রোধে টগবগিয়ে ফুটতে লাগলো, আর দূরে দাঁড়িয়ে শান্ত, উদ্যমে মায়ের মর্যাদায় আঘাত হানার দুঃসাহস দেখে তার চোখে আগুন জ্বলছে। কিছু না ভেবে, মাটিতে পরে থাকা গাছের মোটা ডাল তুলে হাতে তীব্র রোষে দৌড়ে গেল কানিজ বেগমের দিকে। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল,
———"তোর এত বড় সাহস হয় কীভাবে? আমার মায়ের চরিত্রে দাগ লাগাস?? শ'য়'তানে'র বাচ্চা!"
তারপরই জনসমাগম ঠেলেঠুলে, ধাক্কাধাক্কি করে সকলকে ফেলে, মে'রে ফাঁকা জায়গা করে এগিয়ে গেল দৌড়ে। হাতের ডাল দিয়ে কানিজ বেগমের মাথায় আঘাত হানতে যাবে ঠিক তখনই মুগ্ধ দ্রুত হস্তে লাঠিটি ধরে শক্ত কণ্ঠে বাধা দিল,
——— “সিআইডির উপস্থিতি সত্ত্বেও আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এত বড় দুঃসাহস কোথা থেকে পেলি?”
মুগ্ধের অবিচল কঠোর দৃষ্টি আর বজ্রসদৃশ কণ্ঠে যেন সব স্তব্ধ হয়ে গেল। লাঠিটি শান্তর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে শান্তকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল, এমন দৃঢ়তায় যেন নিজের ভেতরের হিংস্রতা কঠোর নিয়ন্ত্রণে রেখেছে!
শান্ত রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে এক নিমিষে তার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্বজনদের দিকে বিষণ্ণ ঘৃ'ণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। একসময় যারা ‘ভাবি, ভাবি’ বলে স্তুতি আর প্রশংসায় আপ্লুত ছিল, আজ তারাই নিজেদের রক্ষার তাগিদে কৃত্রিম কান্নার ভান ধরেছে। আর সেই মূর্খ, বোধবুদ্ধিহীন গ্রামবাসী, এদের সেই ভানভরা অভিনয়কেই সত্য বলে ধরে নিয়ে শান্তর মাকে অ'ভিশাপ দিতে শুরু করেছে! ক্রমাগত ক্রোধের উত্তাপে তার শ্বাস ভারী হয়ে এলো। নাঈমও নিজের ক্ষোভে দিশাহারা, কানের উপর হাত চাপা দিয়ে বসে পড়লো, এই গ্লানিকর অপমান সে সহ্য করতে পারছে না। আঁখি মনের যন্ত্রণায় মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলছে।
আর এই তীব্র কোলাহলের মাঝেই আফিয়া বেগম রয়েছেন নিঃশব্দ, মুখে অসীম স্থৈর্য আর কঠিন নির্লিপ্ততা। মহুয়া এগিয়ে এসে তার হাতের শৃঙ্খলে বাঁধন পরিয়ে গভীর অথচ কঠোর কণ্ঠে নির্দেশ দিল,
——— "চলুন!"
আফিয়া বেগমের চোখে এক মুহূর্তে ফুটে উঠলো র'ক্তলাল ক্রোধের ভয়ানক দাহ। তার সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন, হিমশীতল কণ্ঠে নিম্নস্বরে ফিসফিসিয়ে মহুয়াকে লক্ষ্য করে বলল,
——— "তুই আমার ছেলেকে ধোঁকা দিয়েছিস! তুই যা
করেছিস, তার প্রতিশোধ আমার ছেলে নিজেই নিবে।"
তারপর তার দৃষ্টিতে ফুটে উঠলো এক শয়তানি হাসির শীতল সুর। মহুয়ার অন্তরে হিমশীতল আতঙ্কের স্রোত বয়ে গেল, তার চক্ষু বিস্ময়ে বড় হয়ে এলো।
মুগ্ধ নির্বিকার গলায় নির্দেশ দিলো,
———“নিয়ে আসো তাকে!”
রুদ্র আর মুগ্ধ একে একে গাড়ির দিকে চলে গেলো। মহুয়া, কাঁপা কাঁপা হাতে আফিয়া বেগমের শিকলবন্দি হাত ধরে আস্তে আস্তে তাকে নিয়ে এগোতে থাকল, সেই স্তব্ধতার মাঝে আফিয়া বেগমের চুপচাপ থাকা, মন্দ্র হাসির প্রতিধ্বনি ভেসে বেড়াচ্ছে, তার এক নির্মম প্রতিশোধের শপথ।
পিছনে বিষাদময় দৃশ্যের ভারে ভারাক্রান্ত আঁখি ব্যাকুল হৃদয়ে তার ছোট্ট বোন আলোকে সামলে নিয়ে ছুটে চললো আফিয়া বেগমের দিকে। নিঃস্ব বুকের চিৎকারে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কেবল আর্তনাদ করে উঠল,
———“আমার বড় মা! আমার বড় মা খু-খুনি নন...খুন…”
কিন্তু সে কথা আর আফিয়া বেগমের কানে পৌঁছালো না। মুহূর্তেই নাঈম শক্ত হাতে আঁখিকে টেনে ধরল, তার মুখ চেপে ধরে কঠিন অথচ কাতর হাতের বাঁধনে আটকে ফেললো। আঁখি ছটফট করতে লাগলো, চরম যন্ত্রণায় ব্যাকুল চোখে নাঈমের দিকে তাকালো, সেই চোখে তীব্র বেদনার জলে মাখানো নির্বাক প্রশ্ন। নাঈমের চোখও তখন অশ্রুজলে পরিপূর্ণ, ক্রো'ধ আর মর্মপীড়ার গভীরে সেই চোখের শিরাগুলো টকটকে র'ক্তবর্ণ ধারণ করেছে। প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তিতে সে নিজের কান্না চেপে রাখলো, কেবল কাতর দৃষ্টিতে মাথা নাড়িয়ে আঁখিকে বোঝাল, এই দুর্দশায় তার আর কিছু বলার নেই।
আঁখি তীব্র শোকের ভারে ধীরে ধীরে চোখ বুজে নিলো, আর অনিচ্ছায় নিজের শরীরটাকে ছেড়ে দিলো নাঈমের শক্ত বেষ্টনীতে। নাঈম পেছন থেকে আঁখিকে ধরে রাখল, নিজের সর্বস্ব দিয়ে তাকে সামলে রাখতে চায়।
অতঃপর, ধুলোবালি উড়িয়ে সিআইডির গাড়ি আফিয়া বেগমকে নিয়ে দ্রুত চলে গেল, জনতার চোখের সামনে সেই গাড়ি মিলিয়ে গেল দৃষ্টির অগোচরে। আফিয়া বেগমকে সিআইডি সঙ্গে করে নিয়ে চলে যেতেই আজগর আলীর অন্তরাত্মায় শয়তানের বিষবাষ্প চড়তে লাগল; মাথায় এলো অপলাপনা ছক, এক নতুন খলনল! কূটকৌশলে নিজের বংশমর্যাদার গৌরব আর শক্তি সংরক্ষণ করবে, এমন সংকল্পে দৃঢ় হলো সে।
সবাই তখন আফিয়া বেগমের নামে অমঙ্গল কামনা আর কটূক্তি করতে ব্যস্ত। এ সময় আজগর আলী গলা সাফ করে, তার সহকারী থেকে চশমা চেয়ে নিয়ে এক হতাশ ভঙ্গিতে ধীর স্বরে বলল,
——— “সকলেই থামুন!”
তার কথা শুনে আশেপাশের সমস্ত গ্রামবাসীর কৌতূহলী দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো তার দিকে।
সাজ্জাদ সাহেব ক্ষিপ্ত হয়ে মোশারফ সাহেবের কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললেন,
——— “এ যে ইকরামের থেকেও অনেক বড় চালবাজ! দেখবে এখন কেমন করে সবাইকে বোকা বানাবে!”
মোশারফ সাহেব ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে দিয়ে বললেন,
——— “ওদের র'ক্তে বিষের বাহার। ও সেই বি'ষকে পরিপূর্ণ করতেই এসেছে!”
আজগর আলী চোখের কোণে জলের রেখা মুছে, বেদনার ভারে পরিপূর্ণ কণ্ঠে বলতে লাগল,
——— “আমার ভাবি যে এমন নিষ্ঠুর, এমন র'ক্ত-পিপাসু হতে পারে, তা ভাবতেই পারিনি আমরা। তবে একটা সত্য প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছি, যা এতকাল ধরে পরিবারের মর্যাদা রক্ষার্থে লুকিয়ে রেখেছিলাম আমরা! আমার ভাই কখনোই এমন লালসায় অধীর ছিল না; সে কেবল তার স্ত্রীকেই ভালোবাসত। অথচ আমার ভাবি তার স্বামীর এই নিষ্কলুষ ভালোবাসাকে পায়ে ঠেলে অবৈধ রাত জাগরণে অন্য পুরুষের বাহুডোরে নিজেকে সমর্পণ করত!”
কথাটি বলে এক মুহূর্ত থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, যেন হৃদয়ের অভ্যন্তরে জমাট বাঁধা কষ্ট উপচে পড়ছে। তারপর পুনরায় বিষাদের স্বরে বলল,
——— “আমার অসহায় ভাই যখন জানতে পারল যে তার স্ত্রী তাকে আর তার সন্তানকে রেখে অন্যের সাথে অবৈধ রাত্রিজাগরণে লিপ্ত, তখন তার হৃদয় একেবারে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। তবে সে নিজেকে ধরে রেখেছিল, শুধু আপনাদের কথা ভেবে। আপনাদের জন্য সে নিজ জীবন নিঃস্ব করে কাটিয়েছে, নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে। কিন্তু ঘরের বউ ভালোবাসা না দিলে বাহিরের দৃষ্টিতে দোষ কোথায়? আমার ভাই কখনোই এমন কিছু করতে চায়নি। কেবল একবুক বেদনা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলত, সে একজন চেয়ারম্যান হয়েও বউয়ের ভালোবাসা পেল না। আর শেষে এই তুচ্ছ জীবনের মূল্যও রইল না, তাকেই বধ করা হলো।
আর যাদের ভাবি র'ক্তে ভাসিয়েছে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস তাদের সাথেও অশুভ সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ ছিল আমার ভাবি। মুখ খুলে দেবে এই ভয়েই তাদের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে!”
আজগর আলীর কথায় এক বিষাদমাখা নাটকীয়তার স্রোত বয়ে গেল চারদিকে; গ্রামবাসীর মনে হালকা হলেও সন্দেহের বিষ বপন করল সে, এবং তাতেই সে পেল কুটিল ষড়যন্ত্রের পরম তৃপ্তি। আজগর আলীর করুণ মুখে অশ্রুধারা দেখে গ্রামবাসীর মন গলে গেল, তার জন্যে সবার বুক ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। একজন ক্রোধমিশ্রিত সুরে বলে উঠল,
——— “হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমাদের চেয়ারম্যান তো ভালোই ছিল! ঘরের বউ যদি এমন পরগাছা হয়, তবে তার দোষ কোথায়? আহারে, আমাদের চেয়ারম্যানকেই মে'রে ফেলল ওই বেই*শ**!”
গ্রামের বুকে একবুক বিরূপ ধ্বনি বয়ে গেল। সকলেই আফিয়া বেগমকে নিয়ে কটূক্তি করতে লাগল; সমস্ত পাপের বোঝা চাপিয়ে দিল তারই ঘাড়ে। এই দৃশ্য দেখে আজগর আলীর হৃদয়ে গোপন তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। তবে মুখে দুঃখমিশ্রিত স্বরে সে আবার বলল,
——— “আপনারা তো আমাদের চিনেন! হৃদয়ের পরিচয় জানেন! আমরা কি এমন অসততার পথে কখনো পা বাড়াতে পারি? তবুও, আমার ভাবির কুকর্মের জন্যে আমি আপনাদের কাছে হাতে-পায়ে ধরছি। এই পাপের বোঝা যেন না থেকে যায়,! আমি আশা করি আপনারা আমাদের ভুল বুঝবেন না! অবশ্য আপনাদের কি দোষ দিব? ভুল বুঝাটাই তো স্বাভাবিক! যেখানে আমাদের বাড়ির বউ-ই এমন......তবুও আমরা ক্ষমাপ্রার্থী!”
বলে, সে অশ্রুভারিত নয়নে বিদায় নিয়ে উঠল গাড়িতে। অসহায় চাহনিতে গ্রামবাসী তাকিয়ে রইল তার পিছু। তখন একজন বয়স্কা নারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠল,
——— “আহা রে, কেমন তীব্র কষ্টে ভরা জীবন! শিকদার বাড়ির লোকগুলা অন্তরের কত খাটি! অথচ এই বাড়ির বউয়ের চরিত্র এমন কলুষিত, এমন নির্মম ছি ছি!”
সকলেই এই ‘হায় হায়’ রবে আবদ্ধ হয়ে একে একে বিদায় নিল, হতাশার শব্দতরঙ্গ ছড়িয়ে দিয়ে। শাহারিয়াজ পরিবারের লোকজনও ধীরে ধীরে সরে পড়ল, ওই স্থান আর সহ্য করা অসম্ভব। আছিয়া একপলক আঁখির ক্ষ'ত-বি'ক্ষ'ত মুখের দিকে তাকাল, কিন্তু বুকের মাঝে টান অনুভব করেও কিছু বলল না; দাঁত চেপে নির্দয় পদক্ষেপে চলে গেল।
শান্ত পাথরের মতো মাটিতে বসে রইল, রক্তাভ চোখে প্রতিশোধের নীল অগ্নি জ্বলছে। শিকদার বাড়ির সকলেই তার চারপাশ ছেড়ে চলে গেলে, মাঠটি শূন্যতায় ঢাকা পড়ে গেল; এতক্ষনের জনারণ্যে মুখরিত সেই স্থল মুহূর্তেই বুনো শূন্যতায় ঠাসা হয়ে উঠল। নাঈম ততক্ষণে আঁখিকে ধরে রেখেছিল, এখন তাকে ছেড়ে দিয়ে শান্তর পাশে এসে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। তার পিঠে মৃদু স্পর্শ দিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগল।
শান্ত, তার রক্তাভ দৃষ্টিতে ভয়ানক প্রতিজ্ঞার আগুন জ্বেলে ফিসফিসিয়ে বলল,
——— “কাওকে ছাড়ব না।”
নাঈম নীরব সম্মতি জানাল, কোনো কথা বলল না, অব্যক্ত আক্রোশে সমস্ত কষ্ট মিলে এক প্রান্তরেই নিহিত রইল।
____________
গাড়ির নিস্তব্ধতার মাঝে হঠাৎ আজগর আলীর অ্যাসিস্ট্যান্টের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ ভেসে এল,
——— “স্যার, এখন কী করবেন? ভাবিজান যদি সব উগরে দেন সিআইডির কাছে?”
আজগর আলীর ঠোঁটের কোণে রহস্যময় এক হাসি ফুটে উঠল। সেই হাসির বিষদাঁতে সিঁধিয়ে আসন্ন অন্ধকারের স্পর্শ স্পষ্ট হয়ে উঠল। নিঃশব্দে সে বলল,
——— “আমার আদরের ভাবিকে কিছু বলার সুযোগ দিলে তো বলবে?”
এই কথা বলেই সে ফোন হাতে তুলে একটি নম্বরে ডায়াল করল। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে সংযোগ স্থাপিত হতেই আজগর আলী গা এলিয়ে দিল সিটে। জানালার বাইরে উদাস নয়নে তাকিয়ে ম্লান অথচ শীতল হাসিতে বলল,
——— “শোনো, কিছুক্ষণের মধ্যেই হাইওয়ে ধরে সিআইডির গাড়ি যাবে। গাড়িটা যেন বিস্ফোরণের তাণ্ডবে ধূলিসাৎ হয়! বাকি ব্যবস্থাটা আমিই করব।”


Post a Comment

0 Comments

Close Menu