Ad Code

শ্যামকন্যার মায়াবী চোখ - পর্ব ১৮

 লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা

🚫🚫
কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।
🚫🚫
*
*
*
~~একদিন মাটির ভেতরে হবে ঘর
ও মন আমার, কেন বান্ধো দালান ঘর?
ও মন আমার, কেন বান্ধো দালান ঘর?~~
আঁখি উন্মত্তপ্রায় দৌড়াচ্ছে, অশ্রুজল আঁখিকোণে বারিধারা সঞ্চারিত! বারংবার দুহাত দিয়ে অশ্রুবিন্দু মুছতে ব্যাস্ত! কিন্তু সে অশ্রু নিবৃত্তি মানতে নারাজ! যে আঁখি কেশবৃত মস্তক ব্যতীত বের হয় না, আজ তার মস্তকে কেশাবরণ নেই! তার ঊরুসংলগ্ন দীর্ঘ কেশরাশি বিপথগামী, মুক্তভাবে পৃষ্ঠদেশে পতিত! অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশও যেন ক্র'ন্দ'নপ্রস্তুত, দ'হ'নমুহূর্তে উপনীত! আঁখির পশ্চাতে পূর্বিকা উদ্বিগ্নস্বরে ক্রমাগত ডাকছে,
——— " এই আঁখি, থাম! পা'গ'লামি করিস না , আঁখি, আঁখিইইই! "
আঁখির কর্ণে কোনো শব্দ প্রতিফলিত হয় না! পূর্বিকার ডাক যেন শূন্যে বিলীন! আঁখি সমুদয় শক্তি সঞ্চয় করে পা'গ'ল'প্রায়! অবশেষে কাঙ্ক্ষিত গৃহের সম্মুখে থামল আঁখি! অন্তর ব'লকিত হলো! কেন রুপার ক্ষুদ্র গৃহে ইতোবৎ চিৎকার-চেচামেচি, শোরগোল? স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াল আঁখি! পূর্বিকা দমহারিতা হয়ে আঁখির পার্শ্বে উপনীত হলো! আঁখি যেন জীবনীশক্তিব'র্জিত প্রাণের ন্যায় ধীরে ধীরে সম্মুখপানে অগ্রসর হচ্ছে! যতই সামনে অগ্রসর হচ্ছে, ততই ক্রন্দনের সুর তীব্র হচ্ছে! প্রত্যেক পদক্ষেপে হৃদয়ে যেন শল্যপ্রহার অনুভূত হচ্ছে! প্রকৃতির দমকা বাতাসে সময় যেন ভারাক্রান্ত! আঁখি নিশ্চুপ, নির্বাক! কেবল রুপার গৃহাভিমুখে ধাবিত ! অবশেষে প্রবেশ করল আঁখি! পূর্বিকা কিছুই উচ্চারণ করছে না, কেবল আঁখিকে সামলানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে! রুপার বাড়ির ক্ষুদ্র উঠানে জনতায় গিজগিজ! নিশ্বাস নেওয়ার প্রাঙ্গণ নেই! কেন সকলেই ক্রন্দনরত? রুপার কক্ষের সামনে জনতার ভীড়, অগ্রসর হওয়া দু'ষ্কর! কেন তারা আঁখির গমন প্রতিহত করছে? ক্রু'দ্ধ হলো আঁখি! রাগে চোয়াল দৃঢ় করে আঁখি জনতার ভীড় ঠেলে অগ্রসর হতে লাগল! রুপার ঘরের সম্মুখে উপনীত হতেই আঁখির অন্তর আতঙ্কে বিহ্বল! রুপার বাবা এমন অবস্থায় শুয়ে আছে কেন? কয়েকজন তার মস্তকে জল ঢালছে, আবার কয়েকজন বাতাস করছে! রুপার অপছন্দনীয় কু'কুরটি কেন এমন করে ঘেউঘেউ করছে? রুপার বাবার দিকে ক্রো'ধভরে তীরবৎ ধাবিত হতে চাচ্ছে কু'কুরটি! কিন্তু জনতা লাঠিপেটা করে তাকে বিতাড়িত করছে! কিন্তু কু'কুরটি অনবরত ঘেউঘেউ করছে, এদিকেই ধাবিত হতে চাচ্ছে! আঁখি অনুভূতিশূন্যপ্রায়ভাবে রুপার পিতাকে অতিক্রম করে অন্তঃকক্ষে প্রবেশ করল! অন্য সময় হলে রুপার পিতার নিকটে গমন করে জিজ্ঞাসা করত কি ঘটছে! কিন্তু এখন আঁখি যেন প্রাণহীন প্রতিমা! রুপার কক্ষে প্রবেশ করল আঁখি! হঠাৎ তার হৃদয়ে যেন ক'শাঘাত করল, ছু'ড়ি দ্বারা ক্ষ'তবি'ক্ষ'ত হল তার হৃদয়! আঁখির দৃষ্টিপথ আবছা! চারিপাশে অন্ধকার ! কর্ণে কোনো শব্দ পৌঁছায় না! আঁখি কি তবে বধির হয়ে গিয়েছে? দৃষ্টিপথ অস্পষ্ট! তবে কি অন্ধ হয়ে যাচ্ছে? আঁখি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে, শুধু উপরের দিকে তাকিয়ে! পূর্বিকা মুখ চেপে ক্রন্দনরত! পূর্বিকা যখন আঁখিকে ধরতে যাবে, তখন আঁখি ধপাস করে ভূমিতে আসীন হল! পাথরপ্রায় বসে আঁখি চোখ তুলে উপরের দিকে তাকিয়ে রইল! ফ্যানের সাথে গলায় ফাঁ'স দিয়ে ঝুলে রয়েছে শীর্ণ দেহ, প্রানচঞ্চল, কৌতুকপ্রবণ হরিণীসমা রূপা!
কিশোরী চপলতায় সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল, চঞ্চল রূপা এখন শীর্ণ দেহে ঝুলন্ত, তার বু'কের উপর কোন আবরণ নাই, ওড়না অনুপস্থিত, অর্ধনিমীলিত চোখ উপরে দৃষ্টি নিবদ্ধ , জিহ্বা সামান্য বাহিরে প্রসারিত, যেন মৃ'ত্যু আসার পূর্বক্ষণে ভ'য়, য'ন্ত্র'ণা, অবর্ণনীয় কষ্টের এক নির্মম চিহ্ন তাহার মুখমণ্ডলে বিদ্যমান।
———————
হাসপাতালে পরিবেষ্টিত করিডোরে মুগ্ধ, নাঈম, ইকরাম আলী ও মোশারফ সাহেবের সাথে কথা বলছেন পু'লিশ! সঙ্গতিতে অধোমুখে বসে আছেন রূপার পিতা। প্রত্যেকেই শো'কের বি'ষাদে অবগাহিত, অশ্রুসিক্ত নয়নে প্রত্যক্ষ অপেক্ষমাণ রয়েছেন রূপার মৃ'ত্যুত'দন্তের বিবরণের জন্য। এমতাবস্থায় চিকিৎসক বাহিরে আগমন করলে, মুগ্ধ সহ পুলিশ সমুদয় আত্মসংবরণ বিসর্জন করে অতি দ্রুত প্রশ্ন করলেন,
——— "রিপোর্টে কি এসেছে?? "
চিকিৎসক একবার তাকালেন পু'লিশের দিকে অত:পর সবার মুখচ্ছবির দিকে; প্রত্যেকেই গম্ভীর, বি'ষণ্নতায় নিমগ্ন। সেই পুরাতন শার্ট পরিহিত ক্ষীণকায় কালো ব্যক্তিটি, যিনি ভয়ার্ত নয়নে তাকিয়ে, তার পরিচয় বুঝতে কষ্ট হল না-ইনি রূপার পিতা। এক পিতার সম্মুখে কন্যার এই নি'র্ম'ম সত্য কি প্রকারে ব্যক্ত করা যায়? তিনি নিজেও তো এক কন্যার বাবা। রূপার পিতার দিক হতে দৃষ্টি ফিরিয়ে, মুগ্ধর বলিষ্ঠ গঠনের দিকে তাকালেন, এরপর পুলিশের দিকে তাকালেন চিকিৎসক। অতঃপর নিশ্চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
——— ওকে ধ'র্ষ'ণ করে খু'ন করা হয়েছে! এরপর প্ল্যান করে ফা'স দেওয়া হয়েছে যেন আ'ত্ম'হ'ত্যা বলে মনে হয়!
স্তব্ধ বাকরুদ্ধ সকলেই! এটা কি বললেন ডাক্তার?? রুপার বাবার চোখ বৃহৎ আকারে হয়ে গেলো! চিৎকার করে বললেন,
——— "এ...এটা হতে পারে না... না না... আপনি, আপনি ভুল করছেন, ডাক্তার!! "
রূপার পিতা বিলাপে বিধ্বস্ত, হাসপাতালের অঙ্গনে উচ্চ স্বরে চিৎকার করছেন, "রিপোর্টে ভুল এসেছে!" নাঈম তাঁকে ধরে রাখছে, তবু পিতৃবিবেকের এই আকুলতা যেন বাঁধ মানছে না। মুগ্ধর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো, রা'গে তার স্নায়ু টানটান, মস্তিষ্কে র'ক্তি'ম আগুন ছড়িয়ে পড়লো। চোখে তীব্র ক্রো'ধ, হাতের মুঠো দৃঢ়, সারা শরীরে রাগে কাঁপতে লাগলো। একটি মানবসন্তান কতটা জ'ঘ'ন্য হলে এমন ন'র'কতুল্য কাজ করতে পারে? কতটা অ'ধ'ম হলে এমন হী'ন'তা ঘটাতে পারে? ছোট্ট একটি মেয়ে, মা-বিহীন, এক পিতার আঁধারময় জীবনের একমাত্র আলো, তাকে এভাবে প'শু'র থেকেও নি'কৃ'ষ্টভা'বে হ'ত্যা করল সেই শ'য়'তা'ন! মুগ্ধ আর এক মুহূর্ত স্থির রইল না, পা বাড়াল হাসপাতালের বাইরের দিকে। তার এমন আচমকা প্রস্থান দেখে সকলে বিস্ময়ে হতবাক।
এদিকে, রূপার পিতা হাসপাতালের মেঝেতে হামাগুড়ি দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আর্তস্বরে বলছেন,
——— "আমি যদি রাতে ম'দ খেয়ে, জু'য়া খেলায় মত্ত হয়ে রাস্তায় পড়ে না থাকতাম... যদি আমি মেয়েটার প্রতি একটু যত্নশীল হতাম... যদি কাল রাতে আমি বাড়িতে থাকতাম, তবে আমার মেয়ে আজ জীবিত থাকত! কোন প'শু আমার মেয়েকে এমন য'ন্ত্র'ণা দিয়ে হ'ত্যা করল? কেন করল? আমি কার জন্যে বেঁচে থাকব? ওর মায়ের কাছে আমি কী জবাব দেব? আমি যে ওর মাকে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমার মেয়েকে আমি রক্ষা করব! আমি পারলাম না! সবাই আমাকে শা'স্তি দাও, আমাকে মে'রে ফেল! আমি বাঁচতে চাই না!"
—————
শেষবারের মতো গোসল সম্পন্ন করা হল রূপাকে! কা'ফনের সাদা কাপড়ে মুড়ে দিয়ে হলো, রুপার বিদায়যাত্রার প্রস্তুতি। এই সাদা কাপড় যেন জীবনের সমস্ত রঙিন স্মৃতির মোড়ক খুলে রুপাকে নীরব অশ্রুময় অধ্যায়ে রূপান্তরিত করল।
---
কা'ফনের মধ্য শায়িত রূপার দেহ, শান্তিতে ঘুমন্ত এক মায়াবী প্রতিমা। সেই প্রাণোচ্ছল, হাস্যোজ্জ্বল রূপা, যে জীবনভর মানুষকে হাসিয়ে রাখত, আজ নিজেই নীরব, না নীরব হতে চায় নি, কেও নীরব করে দিয়েছে। যার জীবনের শেষ কথা ছিল তার তিন সখিকে নিয়ে, সেই রূপা আজ সকলকে কাঁদিয়ে পরপারে যাত্রা করেছে, না চায় নি সে, মে'রে ফেলা হয়েছে তাকে। প্রত্যেকে তার মায়াবী মুখখানির দিকে একবার শেষবারের মতো দৃষ্টিপাত করছে। মুখখানি এমনই চকচক করছে, যেন রূপা জীবনের সমস্ত বেদনা হতে মুক্তি পেয়ে শান্তির নিদ্রায় বিভোর।
---
প্রত্যেকে প্রস্তুত তাকে জানাজায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। মুগ্ধ, রোহান, আফ্রিদি, আরাফ, নাঈম, জীবন এবং এমনকি অসুস্থ শান্তও উপস্থিত। তাদের মুখে কোনো শব্দ নেই.! আছিয়া হাওমাও করে কাঁদছে, মিলি রূপাকে আকড়ে ধরে শোকাতুরভাবে চিৎকার করছে, যেন রূপার মৃ'ত্যু তার সহ্যসীমার বাইরে। মুগ্ধ চুপচাপ তার মাকে চোখের ইশারা করল যেন আছিয়াকে সামলায়। তারপর এক পলক দূরে কোণে বসে থাকা আঁখির দিকে তাকাল; কী অদ্ভুতভাবে মাটিতে বসে মেয়েটা, যেন এক শূন্যতাপূর্ণ মূর্তি! যেন আসবাব মাত্র! মুগ্ধ ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ।
পূর্বিকা আঁখির বাহু ধরে বারবার জোরে জোরে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলছে,
——— "কাঁদ আঁখি, কাঁদ! এভাবে বুকের ভেতর কষ্ট আটকে রাখিস না! আঁখি, ভেতরের জমা কষ্ট বের করে দে বোন,,, কাঁদ !"
কিন্তু আঁখি নীরব, যেন দৃষ্টিহীনভাবে দেখছে তার প্রাণের সখির শায়িত নিথর দেহের দিকে, যাকে কোনো প'শু নি'র্ম'ম ভাবে হ'ত্যা করেছে! আছিয়া চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলছে,
--- --- "রুপা, রুপারেএ বোন আমার!? কেন আমাদের ছেড়ে চলে গেলি, রে বোন! এই আমরা কাকে পটল ফুল বলব? রুপারে আমাকে আর ঝালমুড়ি বলবি না? আমাকে আর খেপাবি না?? তুই আমাদের ছেড়ে যেতে পারিস না, রুপা! রুপা, উঠ বলছি, উঠ! অনেক হয়েছে নাটক! এখন তুই উঠবি! আমি কিছু জানি না! মা, মা, মা গো! রুপা কেন উঠছে না? মা, ওকে বলো উঠতে! বলো, মা! এই রুপা, উঠ! আমি কিন্তু তোকে মা'রব,, উঠবি না তুই?? তোকে উঠতেই হবে রুপায়ায়া!"
আছিয়া মায়ের বুকে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ছে। মিলির মা, জবেদা বেগম, মিলিকে সামলাবার চেষ্টা করছেন, কিন্তু মিলি ক্রমাগত রূপার লা'শের পাশে শুয়ে গড়াগড়ি করে বলছে,
------ " রুপা মরে নি! ও আমাদের সাথে মজা করছে! দেখবে একটু পরেই উঠে বলবে, 'এই ফুটবল কেমন দিলাম বল?' না না, রুপা মরে নি!
এই রুপা, তুই একদিন আমায় বলেছিলি না, আমাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরলে সেতু বানাবি? তুই এখন তাহলে এভাবে কেন চলে গেলি? এই রুপা, দেখ, আমি কাদছি। এই দেখ, আমরা সবাই কাঁদছি! তাও উঠছিস না কেন? এই রুপা? রুপা? এই রুপা?
এই তুই আমাদের ভালোবাসিস না? এই তুই না বলেছিলি, আমাদের ছাড়া তোর আর কেউ নেই? তাহলে আমাদের একা রেখে কেন চলে গেলি? এই রুপা? এই পটল? পটলরে? আমাদের পটলফুল, তুই তো চঞ্চলতায় ভরপুর! তাহলে এভাবে চুপ করে শুয়ে আছিস কেন? রুপায়ায়ায়া!"
মিলির শ্বা'সক'ষ্ট আছে, এটা তাকে আরও কাহিল করছে, কিন্তু সে রূপাকে ছাড়তে রাজি না। চিৎকার করে তার প্রিয় সখির লা'শকে ঝাঁকাতে থাকল, যেন তার আকুল প্রার্থনায় রূপা পুনরায় জেগে উঠবে।
---
রূপার লা'শের খাটিয়া তুলার সময় আসল। রূপার বাবা, ইকরাম আলী, মোশারফ সাহেব এবং অন্যান্যরা কাঁধে তুলে নিলেন। শ'ত্রু'তা আজ কেও রাখল না; সকলের শ'ত্রু'তা দূরে রেখে এক করুণ একাত্মতায় পরিণত হলো এ মুহুর্ত । তারা তাদের সন্তানতুল্য কিশোরী কন্যাকে বিদায় জানাচ্ছেন।
আরাফ একবার পিছু ফিরে আঁখির দিকে তাকাল-কেন সে নড়ছে না? কেন সে কাঁদছে না? গভীর চিন্তায় তার মন বি'ক্ষি'প্ত। পূর্বিকা বারবার আঁখিকে ঝাঁকাচ্ছে, কিন্তু আঁখির কোনো সাড়া নেই। অবশেষে আঁখি যখন দেখল তার প্রিয় সখির খাটিয়া তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন হঠাৎ শক্ত কন্ঠে চিৎকার করে উঠল,
——— " রুপাকে কেও নিয়ে যাবেন না!"
সকলেই পিছু ফিরল। আঁখির চেহারা শক্ত, র'ক্তচক্ষু লাল, কিন্তু চোখে কান্নার কোনো লক্ষণ নেই। সে পুনরায় ধ'ম'কে বলল,
——— "রূপাকে ছেড়ে দিন বলছি! কেও তাকে নিয়ে যাবেন না!"
আজগর আলী রোকেয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
——— "মেয়েটাকে সামলাও!"
আঁখি ধপ করে দাঁড়িয়ে ক্রমশ উন্মত্ত হয়ে দৌড়াতে লাগল, ক্রো'ধে চিৎকার করে উঠল,
——— "ছেড়ে দিন ওকে! ও ম'রে নি! কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ওকে!"
রোকেয়া বেগম আর পূর্বিকা আঁখিকে শক্ত করে দুই হাত চেপে ধরল, যেন তার পা'গ'লামী আরও ভ'য়ানক আকার না ধারণ করে। আফিয়া বেগম ও কানিজ বেগম নিজেদের অশ্রু চুপিসারে মুছছিলেন, কিন্তু তাদের মনেও বয়ে যাচ্ছিল বন্ধুত্বের অটুট বন্ধনের স্মৃতি। এই চার বান্ধবীর মধ্যে ছিল বহু কিছুতে অমিল-থাকার অমিল, খাওয়ার অমিল, পরার অমিল-কিন্তু মন-প্রাণে ছিল অদ্ভুত এক মিল। আজ সেই বন্ধনের এক অবিচ্ছেদ্য সখি রূপা আর নেই, কেও বি'ভৎ'স ভাবে তার কোমলপ্রাণ কেড়ে নিয়েছে, মে'রে ফেলেছে তাদের পটলফুলকে, সেই ভ'য়ং'কর সত্য চোখের সামনে আঁখি মেনে নিতে পারছে না।
আঁখি ছটফট করছে, যেন গলা কা'টা মুরগি। বারবার অসহায় কণ্ঠে বলতে লাগল,
——— "রূপা ম'র'তে পারে না! রূপা ম'রে নি! কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ওকে? মা ওদের থামতে বলো! আপু এই আপু ওদের থামতে বলো রুপা ম'রে নি! ও...ওদের......
আঁখির চোখে আস্তে আস্তে সবকিছু ঝাপসা হয়ে এলো। তার অসহায় দৃষ্টি শুধুমাত্র দেখল, তার সখি রূপাকে খাটিয়ায় করে নিয়ে চলে গেলো। অস্পষ্ট কণ্ঠে আঁখি বলে উঠল,
——— " আ...মি ক...কাউকে ছ...ছাড়ব না..."
এই বলে আঁখির দেহ নিস্তেজ হয়ে পড়ল। পূর্বিকা, রোকেয়া বেগমের হাতের বাধনেই অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে লাগল।
---
নি'ষ্ঠুরতার নি'র্ম'ম বলি রূপার কোমল প্রাণ হিং'স্র ন'রপ'শুর হাতে বিলীন হলো! কতদিন আর চলবে এই অ'ত্যা'চা'র? কত কাল ধরে চলবে এই পৈ'শা'চি'ক নি'র্যা'তন? সহস্রাধিক রূপাকে এই ভুবনে হরণ করার অধিকার কে দিলো? মর্ত্যের নি'ষ্ঠু'র ক্রীড়াকর, যারা তাদের নির্দয়তার বি'ষা'ক্ত গ্রাসে চিরতরে হরণ করে নেয় সেই নিষ্পাপ প্রাণগুলি! আজ সেই রূপা—যে একদা চঞ্চলতা ও প্রফুল্লতায় ভরে ছিল—সে এখন শায়িত ত্রিসহস্ত মাটির গভীরে! রূপা, যার হাসির গুঞ্জন আর শ্রুত হবে না, যার কর্মঠ পিতার উপার্জনের চিন্তা আর তাকে ছোঁবে না। রূপা, যার প্রিয় সখীগণের হৃদয় আরও কখনো প্রফুল্ল করবে না! সে আজ নিদ্রাবশে, চিরকালের জন্য, মৃ'ত্যু'র অমোঘ বেষ্টনে আবদ্ধ!
কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না; প্রত্যেকেই ব্যস্ততায় ফিরে যায়, নিজেদের কর্মে নিমগ্ন। ইকরাম আলী, আজগর আলী, কুদ্দুস আলী-সকলেই, সকল ধকল পার করে এসে বসলেন মাত্র। ঠিক তখনই রোকেয়া বেগম হন্তদন্ত হয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলেন,
--- আ...আঁখিকে কো...থাও পাওয়া যা...যাচ্ছে না!
---------
ঝড়োহাওয়া, তুফান, বিজলির জ্যোতি বারংবার রাত্রির আকাশে ঝলকিত হচ্ছে। প্রবল এই ঝড়ে বিদঘুটে অন্ধকারে কবরস্থানে অবসানে বসে এক কিশোরী। তার মনে ভয় কিংবা আ'তঙ্কের ন্যূনতম অস্তিত্ব নেই; বরং ভিজা একাকার আঁখির নয়নজলে বৃষ্টির পানি মিশিত হচ্ছে। অন্ধকার ঝড়ের রাতে কবরস্থানে একা মানবী বসে থাকা চারটি খানি বিষয় নয়।
সে একা নয়; তার পাশে রুপার অপ্রিয় কু'কুরটিও ভিজে স্যতস্যতে অবস্থিত। অবলা প্রাণীর চোখেও জল মিশে যাচ্ছে বৃষ্টির পানির সঙ্গে। আঁখির হাতে রুপার জন্য নির্মিত রুমালটি , যা সে সুই-সুতোর মাধ্যমে কারুকাজ করেছিল রুপাকে প্রদান করার জন্য।
আঁখির অক্ষিদয় লাল, মুখ শক্ত, শরীর কাঁপছে; তথাপি সে বসেই রয়েছে। চোখে মুখে স্পষ্ট ভ'য়ান'ক ক্রো'ধ! শুধু গড়িয়ে পরছে চোখের জল! হঠাৎ, পৃষ্ঠদেশে কারো উপস্থিতি অনুভব করল আঁখি। এই ভী'তিকর অন্ধকারে কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তথাপি সে পেছনে ফিরল না; কেবল রুপার কবরের দিকে পলকহীন তাকিয়ে অশ্রুবিসর্জন দিচ্ছে। আচমকা, সে পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে-পেচপেচ শব্দ করে কেও এদিকে এগিয়ে আসছে। তবুও সে স্থির!
হঠাৎ করেই আঁখির মাথার উপরে কেও ছাতা ধরল, সঙ্গে সঙ্গে কানে বেজে উঠল এক গুরুগম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠস্বর,
——— " এখান থেকে উঠো!"
আঁখি ঘাড় ঘুরিয়ে র'ক্তিমা রা'গি'নী হয়ে পশ্চাতে তাকাল। চোখ উঁচু করে দেখার চেষ্টা করল কে সেই অজানা। কিন্তু অন্ধকারে মুখ অস্পষ্ট ; কেবল বজ্রের ঝলকে অবয়বটি ধরা পড়ছে। হাতে ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে এক লম্বাচওড়া, বলিষ্ঠ পুরুষ। যখন সে ব্যাক্তি ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালালো , আঁখি চমকে উঠল। এই পুরুষটি এখানে কেন? কেমন করে জানল যে আঁখি এখানে উপস্থিত?
মুগ্ধ চোয়াল শক্ত করে ধমকে বলল,
——— " এখান থেকে উঠো বলছি!!"
আঁখি নি:শব্দ! সাড়া নেই! মুগ্ধ ক্রো'ধে গম্ভীর হয়ে বলল,
——— "এই ঝড়ের রাতে একা কবরস্থানে এসে তুমি ভুল করেছো!"
——— " ভ'য় কাকে দেখাচ্ছেন? "
——— " বেশি সাহস দেখিও না!"
আঁখি পূণরায় নিশ্চুপ ! মুগ্ধর ক্রো'ধ সপ্তম আকশে! তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,
——— তুমি জানো না আমি এখানে কি করতে এসেছি?
আঁখি রুপার কবরের দিকে চেয়ে দাত কিড়িমিড়িয়ে বলল,
——— "আপনি জানেন আমি কি করতে এসেছি?? "
এরপর আঁখি বলল,
——— "রুপা কি বলত জানেন?
--‘কাঁদতে নেই, কাঁদলে ব্য'থা আরও গভীর হয়। ব্য'থাকে বোকা বানা, হেসে ফেল।’
মুগ্ধ খানিক্ষন আঁখির দিকে নি:শব্দে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল,
——— "আমাদের জীবনে অনেক কিছু অপূর্ণতা থেকে যায়। একটি দীর্ঘশ্বাস থেকে যায়-কিছু বলতে না পারার, কিছু করতে না পারার, কিছু জানাতে না পারার ; ঠিক তোমার হাতের ওই রুমালের মতোই। কিন্তু তবুও, পথ চলতে হয়। এটা নিয়ম!"
একটু থেমে গম্ভীরকন্ঠে,
——— "আজ ছেড়ে দিলাম, দ্বিতীয়বার ছাড়ব না!"
উক্ত বাক্যটি উচ্চারণ করে এক নিমেষ কালও অপচয় না করে, ছাতাটি আঁখির পাশে রেখেই, বৃষ্টিতে ভিজে সিক্ত হয়ে, কঠোর চোয়াল সংযোজিত করে, বৃহৎ বৃহৎ পদক্ষেপে, ক্রো'ধে প্রদীপ্ত লাল-অক্ষি সহকারে, মুগ্ধ তার ক্ষুব্ধচিত্তে উত্তাল ক্রো'ধে গর্জিত হতে হতে যাত্রা করল। মুগ্ধের গমনান্তরে কিছুক্ষণ পর, নাঈমসহ সকল কাজের লোক হন্তদন্ত হয়ে কবরস্থানে উপস্থিত হলো। নাঈম আঁখিকে দেখে যেন এক গভীর সস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। সকলেই ভিজে একাকার! নাঈম চিন্তাগ্রস্ত হইয়া আঁখিকে বলল,
——— "তুই কাওকে না বলে এখানে কেন এসেছিস??"
★★★★★★
ঠক! ঠক! ঠক!
——— May I come in? (গম্ভীর স্বরে)
——— ত...ত...তুইই এ......
——— মৃ'ত্যু'কে গণনার বিধানে জানি,
চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি নির্ধারিত ধন ধানী;
——— আয়ায়ায়ায়ায়া!
★★★★★
——— তু...তুমি? তু...আ...আ...মায় ছেড়ে দা...ও আমি ......আ...আর এমন করব না!
——— ঋণ-পা'পের ফলশ্রুতি সর্বশেষ,
নশ্বরের ক্রূ'র সমাপ্তি-নিঃশেষ।"
——— নায়ায়ায়ায়ায়ায়া!!
——— মৃ'ত্যুকে গণনার বিধানে জানি,
চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি নির্ধারিত ধন ধানী;
ঋণ-পাপের ফলশ্রুতি সর্বশেষ,
নশ্বরের ক্রূ'র সমাপ্তি-নিঃশেষ। আহহাহাহা!!



Post a Comment

0 Comments

Close Menu