লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা


কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।




গল্পে কিছু দৃশ্যের জন্য আগেই সতর্ক করছি।


*
*
*
——— "গোড়স্থানত ক'ল্লা পাওয়া গেইছে ওইইই,,,, গোড়স্থানত কা'টা ক'ল্লা পাওয়া গেইছেএএএএ!! "
——————
——— “প্রণীতা, চিরুনিটি তোমার দৃষ্টিতে কিছু অস্মৃতি আবহিত করছে কি? হ্যাঁ, তুমি সঠিকভাবে অনুমান করেছ। এটি রুপার প্রণয়ে প্রদত্ত সেই চিরুনি, যা ছয় বৎসর পূর্বে রুপা তোমায় অর্পণ করেছিল! এবং তুমি তা হারিয়েছিলে ! আর আমি এটা আমার সন্নিধানে অক্ষুণ্ণ রেখেছিলাম, তোমায় দেওয়ার আশায়।
প্রণীতা, তুমি কি আমায় ক্ষ'মা করবে? তিলমাত্র ক্ষ'মা করো, এই অতলান্ত বিলম্বের জন্য! আমি অজ্ঞাত শিকলে আবদ্ধ ছিলাম, এ কারণে এতদূর বিলম্বিত হলাম। আমি নতুন করে তোমায় সান্ত্বনা দিব না; বরং, আমি তোমার সঙ্গেই প্রতিটি ক্ষণে, প্রতি সেকেন্ডে, প্রতি মুহূর্তের শ্বাসে, প্রতি মিনিটের গতিতে, প্রতি ঘন্টায় তোমার চেতনা অনুভব করি।
আমি জানি প্রিয় সখি হারিয়ে কাল সারারাত নিদ্রাহীন ছিলে, আমি জানি, তুমি এখনও খাদ্য গ্রহণ করনি, আমি জানি, তোমার চোখের কোনে জল এখনও শুকায়নি। আমি জানি, তুমি পাথরের ন্যায় কঠিন হয়ে আছো! আমি জানি, তুমি রা'গে জলন্ত রাগিণী হয়ে উঠেছো! আমি এও জানি, তুমি কাল বৃষ্টিতে ভিজেছো।
সুতরাং, চিরুনির সঙ্গী করে, জ্বরের ঔষধ প্রদান করলাম, এবং এখন যে চিঠিটি তোমার পড়ে তুমি কাঁদছো! হ্যাঁ, আমি জানি, তুমি শব্দে কাঁদছো না! তবে, প্রণীতা, তুমি আমার দৃষ্টির আড়ালে লুকাতে পারবে না। চোখের জল মোছার জন্য আমি সূক্ষ্ম একটি রুমাল প্রদান করলাম। চোখের জল মুছে নিও, ভাববে আমি তোমার চোখের জল মুছে দিয়েছি।
তুমি কি ভেবেছো, আমি শুধুমাত্র তোমার প্রেমিক, যে সদা প্রেমপত্র লিখবে? না, আমি কেবল তোমার প্রেমিকই নই; আমি তোমার দুঃ'খের ধ্রুপদী সঙ্গী, বিষণ্নতার নির্ঘন্ট, হাসির সঙ্গীতের সুরকার, বিপদের সাথে যুদ্ধের সাথী, ব্য'থার অমলিন প্রতিবিম্ব। আমি বলব না, ‘তুমি কেঁদো না!’ বরং, কাঁদো প্রণীতা! কাঁদো! কাঁদো, আর নিজের মনকে হালকা করো। যদি আমি তোমার সঙ্গে থাকতাম, তবে আমার কাঁধ তোমার মাথার অবলম্বন হয়ে দাঁড়াত। তুমি অশ্রু সিক্ত হয়ে আমার কাধে মাথা দিতে, কিন্তু আমি এখন অপারগ।
জীবনের হিসাবের সূচিপত্রে, কিছু শূন্যতার পরিমাণ মেনে নিতে হয়, কারণ কিছু অভাবের ভার এমন এক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে, যা গাণিতিক সূচকেও চিত্রিত করা যায় না।
— তোমার অজ্ঞাত প্রেমিক"
এক ভ'য়ং'কর অ'ভি'শ'প্ত রাত্রির অবসান হয়ে, ভোরের স্বর্ণালোক উদিত হয়েছে মাত্র। শীতল, হিমশীতল বায়ু প্রবাহিত, নিকটস্থ তরুগণের মাঝে পাখিকুলের কিচিরমিচির ধ্বনিত। শিকদার বাড়ির পশ্চাতে অবস্থিত এক বৃক্ষের শাখায় আলোর জেদে নির্মিত দোলনায় আঁখি আসীন । সে কিছু পূর্বেই নামাজ সমাপন করেছে, এবং তার পর হতে অতি স্থির, নিশ্চুপ। গত রাত্রির পর হতে সে কারও সহিত বাক্যালাপ করে নাই; হাজার প্রশ্ন করলেও সে নীরব, নিস্তব্ধ। দোলনায় দোলছে এবং তার দীর্ঘ কেশপাশ ভূমিতে পতিত , কারও প্রতি তার কোনো লক্ষ্য নেই। চোখ লা'লা'ভ, এমন যে বহু রজনী সে নিদ্রাবিহীন । চোখের কোণে অশ্রু এখনো শুকায়নি। এক নিস্তব্ধ ভাবনায় পাথরের ন্যায় স্থির হয়ে সে চিঠির দিকে তাকিয়ে, যেন অনুভূতিহীন কন্যা! পত্র কিরূপে এলো, সে অবগত নয়। তার ছোট বোনের ভাষ্যমতে, পত্রখানি তার হাতে অজানা কেও দিয়েছে। কে দিলো, তা সে জানে না বটে; তথাপি এইকথা আঁখির বিশ্বাসযোগ্য বোধ হয় না। কেননা, আঁখির অবগত মতে আলো গৃহেই অবস্থান করেছিল গতকাল। হস্তে চিঠি এবং রূপার দানকৃত ষড়বৎসর (ছয় বছর) আগের কুরঁজী (চিরুনি) ! হাতে সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ করে আঁখি নিশ্চিত করল যে এই কুরঁজী রূপার দানকৃত। হ্যাঁ, এটাই সেই টিয়াবর্ণা পুরনো কুরঁজী, যা রূপা দিয়েছিল। বলেছিল, রুপার কাছে আঁখির কেশসজ্জা বিশেষ প্রিয়, সুতরাং এটা দিয়েই যেন কেশ সম্বন্ধন করে । অথচ, হঠাৎ করেই সেই কুরঁজী কিরূপে হারিয়ে গেলো, এটা আজও আঁখির অজ্ঞাত। সেদিন হা'হা'কার করেই কেঁদেছিলো সে। আজ দীর্ঘকাল পর পুনরায় প্রাপ্ত হয়ে আঁখি কৃতজ্ঞতাবোধ করবে, না শো'কাহত হবে, তা সে বুঝতে পারছে না! এবং আজকে প্রাপ্ত চিঠির পর আঁখি সম্পুর্ন নিশ্চিত, এই কুরঁজী তাঁকেই প্রেরিত করা হয়েছে, আর পূর্বের দুই চিঠি অনুসন্ধিৎসুকভাবে তাকেই দেওয়া হয়েছিল । অন্য পরিস্থিতিতে হয়তো আঁখির কিশোরী অন্তঃকরণ অস্থির হত, জানার জন্য যে, কে এই অজ্ঞাত পা'গলপ্রেমিক পুরুষ, যে দীর্ঘকাল তার পিছু নিয়ে আসছে! আঁখির এমন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় কিরূপে জানলো সে? নিশ্চয়ই সে আঁখির পরিচিত কেও হবে । আঁখি জানে না, এর প্রতি ক্ষো'ভ প্রকাশ করবে, নাকি কৃতজ্ঞতাবোধে আবদ্ধ হবে। শুধু অনুভূতিশূন্যতায় অশ্রু মোচন করে বলল,
——— "তোর দেওয়া সেই হারিয়ে যাওয়া চিরুনি আবারো ফিরে পেলাম ; কিন্তু তুই তো এমনভাবে হারিয়ে গেলি, আর কোনোদিনও তোকে ফিরে পাবো না রুপা! "
এই নির্জন একান্ততার মধ্যে হঠাৎ করেই চি'ৎ'কারের প্রতিধ্বনি তার কর্ণগোচর হলো । এত প্রভাতে এরূপ শোর'গো'লের কারণ কী? এমন সময় আঁখির সেই চিরপরিচিত ছোট্ট ভোলা, জানে না সে কোথা হতে এত প্রাতে আসল, শ্বা'সরুদ্ধ হয়ে শিকদার বাড়ির পশ্চাতভাগে দৌড়ে গিয়ে আঁখিকে উচ্চৈঃস্বরে সম্বোধন করল,
——— “বইননন!!!”
আঁখি যেন এক রোবটের ন্যায় শূন্য দৃষ্টিতে তার ঘাড় ঘুড়িয়ে পেছনে তাকালো। ভোলা তার আপার অবস্থা দেখে আ'ত'ঙ্কিত হলো। আপাকে অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে, কতটা ভ'য়া'বহ! এত ঘন, বিপুল কেশ এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ; সেই মায়াবী চোখ, যাতে শুধু মায়ার প্রতিচ্ছবি রহিত, আজ সেথায় যেন ভ'য়ং'ক'র ক্রো'ধ ছাড়া কিছুই রহিল না। চোখ র'ক্ত'ব'র্ণে প্রজ্জ্বলিত। ভোলা গিলে ফেলল এক ঢোঁক লা'লা'সিক্ত তৃষ্ণা এবং কেঁপ কেঁপে বলল,
——— “র...রুপা বইনের কবরে..."
———————
প্রভাতের প্রাচুর্যে ঢেকে গিয়েছে গ্রাম, অথচ শীতল বায়ুর মধ্যে কেমন এক অদৃশ্য উত্তাপ অনুভূত । রুপার কবরের চারিপাশে ভিড় । গ্রামের সকল পুরুষেরা জড়ো , কেবল কিছু নারীগণ ছাড়া সকলে অনুপস্থিত । আঁখি দ্রুত দৌড়ে ভোলার সহিত ঘটনাস্থলে আসল। তার পরিবারও উপস্থিত, কিন্তু সে তাতে কোনো মনযোগ দিল না। হঠাৎ দেখল দূরগামী পথে ছিটকে পড়া র'ক্তে'র বিন্দুবিন্দু যা কালচে বর্ণ ধারণ করে অবিচলিতভাবে রুপার কবরের দিকে গিয়েই থেমেছে! ভোলা আ'ত'ঙ্কে আঁখির হাত শক্ত করব ধরল! ওই পথ তো রুপার বাড়ির দিকেই যাচ্ছে! র'ক্ত কি তবে রুপার বাড়ি হতে কবর পর্যন্ত পৌঁছিয়েছে? ভিড় ঠেলে ভোলার হাত ধরেই সরাসরি রুপার কবরের দিকে অগ্রসর হল। কবরের নিকটবর্তী হবার সঙ্গে সঙ্গেই আঁখি চট করে দুই হাতে ভোলার চোখ ঢেকে দিল।
অন্য সকলের ভীত বা আত'ঙ্কিত চেহারার বিপরীতে আঁখির মুখে কোনো ভ'য়ের চিহ্ন নেই। তার দৃষ্টি স্থির, নিষ্পলক। পাশের কেও কেও ব'মি করেই স্থান ত্যাগ করছে; দৃশ্যটি ম'র্মা'ন্তিক। রুপার কবরের সমগ্র প্রান্তে সুরক্ষা বসানো, যেন প্রমাণ নষ্ট না হয়। আর কবরের পায়ের নিকটে শায়িত রুপার বাবার কা'টা বি'ভ'ৎ'স মাথা, বি'ভ'ৎ'স ভাবে কেও তার শিরচ্ছেদ করে রুপার কবরের নিকটে স্থাপন করে গিয়েছে । রুপার বাবার নাক মুখ কা'ম'রে ছি'ড়ে ছি'ড়ে ফেলে দিচ্ছে সেই কু'কুর, যাকে রুপা অপছন্দ করত। পুলিশ কু'কু'র'টিকে বারি মেরে তাড়িয়ে দিলে ঘে'ও ঘে'ও করতে থাকে, কিন্তু সেই দৃশ্য এতটাই ঘৃ'ণ্য ও গা-গো'লানো ছিল যে অনেকের মতো পুলিশেরও ব'মি আসার জো।
আঁখি তবু নির্বিকার, ভোলার হাত ধরেই পিছাতে লাগল! না ভ'য়, না শো'ক। সে অজান্তেই কোথায় চলে যাচ্ছে। এই শূন্যতা ভোলার মধ্যে এক অদ্ভুত আ'ত'ঙ্ক সঞ্চার করল। এতখানি শান্ত, এতখানি স্বাভাবিকভাবে আঁখি কিরূপে থাকতে পারে? ভোলা অবশেষে ভ'য়েই আঁখির হাত ছাড়িয়ে দ্রুত তার দাদির নিকট দৌড়ে গেল।
কিন্তু আঁখি যেন আত্মচেতনাহীনভাবে, হাত-পা ছাড়া ছাড়া ভাবে, অস্থিরতার মাঝেও এক পা'গ'লের ন্যায় পশ্চাদপসরণ করছে। যেন নিজস্ব ইন্দ্রিয়হীনতায় তাড়িত । আশেপাশে কারও নজর আঁখির দিকে ছিল না। সকলেই মগ্ন ছিল রুপার পিতার ভ'য়া'বহ হ'ত্যা'র নিন্দা করতে, সেইসঙ্গে ঘৃ'ণা প্রকাশ করতে, যে শ'য়'তা'ন এই ভ'য়ং'ক'র কাজ সম্পন্ন করেছে।
এখনো একদিনও পূর্ণ হয় নি রুপার মৃ'ত্যু'র, শোক এখনো নিঃশেষিত হয় নি, অথচ তার অসহায় পিতাও নি'র্ম'ম পরিণতির শিকার । কে এমন নিদারুণ নি'ষ্ঠু'র'তায় উন্মত্ত হয়ে পিতার শি'র'চ্ছেদ করে কন্যার কবরের নিকট রেখে যেতে পারে? মানুষ এতটা জ'ঘ'ন্য হতে পারে কি? অর্ধেক পু'লিশ রুপার বাড়ি অবস্থান করছে, রুপার বাবার অ'ঙ্গ'চ্ছিন্ন দেহটি সেখানেই নিথরভাবে পড়ে আছে! কী নৃ'শং'স ও পৈ'শা'চিক ভাবে তাকে হ'ত্যা করেছে ! এটা কোনো স্বাভাবিক মানুষের কর্ম হতে পারে না! নিশ্চয়ই কেবল ন'র'পি'শা'চ শ'য়'তানে'রই এমন কাজ সাধ্য! গ্রামবাসীগণ এহেন কঠোর কর্মের ভ'য়া'বহ তা নিয়ে আলোচনায় নিমগ্ন । দুদিনের মধ্যে এই দুই সদস্যের পরিবারকে নিঃশে'ষ করে দিলো কোনো অজ্ঞাত আততায়ী।
আঁখি ক্রমাগত পশ্চাদপসরণ করছে, এমন সময় হঠাৎই গম্ভীর এক পুরুষকণ্ঠ ধ্বনিত হলো,
——— "এর থেকে বেশি পিছিও না!"
আঁখির গতি থামল, সে দ্রুত পশ্চাৎ ফিরল। সম্মুখে দাঁড়িয়ে সুঠাম, দৈত্যাকার পুরুষ, যার বলিষ্ঠ দেহ তৃপ্তিযুক্ত দৃঢ়তায় ভরপুর। উচ্চতা এমন যে, আঁখিকে তার মুখের দিকে তাকাতে মস্তক উত্তোলন করতে হলো। একটুর জন্যই তার প্রশস্ত বক্ষে ধাক্কা লাগে নি! আঁখি দ্রুত ছিটকে দূরে সরল। মুগ্ধ পকেটে হাত গুঁজে নিশ্চুপভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে! পাশেই রোহান চোখ বড় বড় করে আঁখির দিকে তাকিয়ে! মুগ্ধর মুখমণ্ডল তার নীরব কঠোরতায় আচ্ছন্ন। অত:পর গভীর কণ্ঠে, স্থির অথচ আদেশমূলকভাবে উচ্চারণ করল,
——— "নিজেকে সামলাও! "
আঁখি স্থবির, নির্বাক। নীরবে দাঁড়িয়ে.! মুগ্ধ এক পলক তাকালো আঁখির দিকে । রাত্রির দুঃ'সহ ঘটনার ছাপ আঁখির দেহভঙ্গিতে স্পষ্ট। একবার চোখ বুলিয়ে চারপাশ সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করল, নারী সংখ্যা স্বল্প! পুরুষের গিজগিজ! মুগ্ধ তপ্ত শ্বাস ফেলে সামনের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
——— "এখানে তোমার কোনো কাজ নেই, বাড়ি ফিরে যাও!"
আঁখি মুগ্ধের পাশ কাটিয়ে চলতে লাগল। কিন্তু হঠাৎ মুগ্ধের কঠোর কণ্ঠ পুনরায় ঝঙ্কৃত হলো,
———" থামো!"
আঁখি দাঁড়াল, দৃঢ়তার সহিত মুগ্ধের দিকে দৃষ্টিপাত করল। মুগ্ধ এবার ধীরে আঁখির দিকে ফিরল, বেশখানেক আঁখির দিকে ঝুকে কানে ফিসফিস করে বলল,
———" আমি সব কিছু জানি! "
আঁখির বিস্মিত । মুগ্ধ এক বাঁকা হাসি ছুড়ে বলল,
——— "আমার কাছে ফাকি দেওয়া সম্ভব নয় প্র..."
কথাটি ঠোঁটের উপরেই থেমে গেল। মুগ্ধর চোয়াল কঠিন হয়ে আসল, চোখদ্বয় বন্ধ করে মুষ্ঠি দৃঢ়ভাবে বদ্ধ হলো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আঁখি কে ধমকে বলল,
———" যাও এখান থেকে!! "
আঁখি র'ক্তি'মা চোখে এক পলক তাকিয়ে কিছু না বলেই, ত্বরিতপদে দৌড়ে চলে যেতে লাগলো! মুগ্ধ সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে আঁখির দৌড়ে যাওয়া পথের দিকে নীরব, অটলভাবে তাকিয়ে রইল। মুখে কঠোরতার ছাপ স্পষ্ট, এক দৃঢ় সংকল্প যেন তার চেহারায় প্রকাশিত। এদিকে রোহান স্তম্ভিত দৃষ্টিতে মুগ্ধের দিকে তাকিয়ে। চোখ দু'টি একবার ঘষে নিলো সে! মুগ্ধ এমন ভাবে কথা বলছে, তাও শিকদার পরিবারের কনিষ্ঠ কন্যার সহিত? পরক্ষণেই ভাবল, হয়তো শা'লি হিসেবেই বলেছে! রোহান মুগ্ধের পৃষ্ঠদেশে হাত দিতেই, তৎক্ষণাৎ হাত সরিয়ে চোখ বিস্ফারিত করে বলল,
——— "তোর শরীরে তো এখনো জ্বর!
——— "তো ?"
——— " তুই কাল রাতে কোথা থেকে ভিজে এসেছিস হুঁ? দুই দিন আগেই তো হাসপাতালে গেলি! এখন আবার ভিজেছিস; তোর কোনো কাজ নাই? না থাকলে বল, আমার দোকানে প্রচুর কাজ, লাগায়ে দিই তোকে!
মুগ্ধ দৃঢ়ভাবে রোহানের গ্রীবা আঁকড়ে বলল,
——— " নিয়তি হয়তো চায়, আমি বারংবার বৃষ্টিতে ভিজি! "
রোহান মুখ বিকৃত করে গ্রীবা ছাড়িয়ে বলল,
——— "হুঁহ! নিয়তি চায়, না তুই চাস? যেখানে তোর বি'পদ, সমস্যা; সেখানে কেন বারবার ছুটে যাস তুই?"
——— " কিছু টান তো আছে, বি'প'দের সেই ধ্বং'স'সী'মায়, আমি যেন নিজেকে খুঁজে পাই। কেন জানি না, কিন্তু সেই অনিবার্য টান আমাকে বারবার টানে, দূরে সরতেও পারি না।"
রোহান ফোস করে নিশ্বাস ফেলল, বুঝল যে মুগ্ধের সহিত বাকবিতণ্ডায় যোজনফল লাভ নেই। হঠাৎ আফ্রিদির কথা মনে আসতেই জিজ্ঞাসা করল,
——— " আফ্রিদিকে কই? শা'লায় কোথায় গায়েব হইল? গতকালও দেখলাম না!
——— "তুই আর আমি এক জায়গায়!"
উভয়ে পথচলা শুরু করল। রোহান হতাশ কণ্ঠে বলতে লাগল,
——— "কী হতে কি হলো বল! রূপার মতো বাচ্চা মেয়েটা,, ইশ্, ভাবলেই রা'গে শরীর জ্বলে! এখন আবার ওর বাবাকেও...। মানুষ এত নিচে কিভাবে নামতে পারে!! যে এই কাজ করেছে তাকে পেলে যে কি করতাম!! "
মুগ্ধ নীরবেই শুনতে লাগল। রোহান পুনরায় বলতে লাগল,
——— "তোর বোনটাও তো অসুস্থ হয়ে গিয়েছে! আহা রে! আর তোর শা'লিটা...মেয়েটা একদম পাথর হয়ে গিয়েছে! কত সুন্দর মেয়ে..."
বাক্যটি শেষ হবার পূর্বেই মুগ্ধের শক্ত মুষ্টি রোহানের চোয়াল বরাবর আ'ঘা'ত করলো! সঙ্গে সঙ্গে রোহানের ঠোঁট ফে'টে র'ক্ত'ধারা প্রবাহিত হলো! বিস্ময়ের পরাকাষ্ঠায় দাঁড়িয়ে রোহান চিৎকার করে বলল,,
——— "শা'লায়ায়া ! তুই আমাকে মা'র'লি কেননন??"
মুগ্ধ চোয়াল শক্ত করে রোহানের গলা শক্ত করে চেপে রুষ্ট কণ্ঠে রা'গে ফোসফাস করতে করতে বলল,
——— "আমার সামনে লাগামছাড়া কথা বললে এর থেকেও অবস্থা খা'রাপ হবে!"
রোহান কে ছিটকে ছেড়ে দিয়ে হনহনিয়ে মুগ্ধ চলে গেলো। এদিকে রোহান গালে হাত রেখে স্তব্ধচিত্তে দাঁড়িয়ে চেচিয়ে বলল,
——— "আমি আবার কি লাগামছাড়া কথা বললাম!?!"
--YouTube
দূর হতে গম্ভীর দৃষ্টিতে সকল ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছিল আরাফ। আঁখি যখন মুগ্ধের বক্ষস্থলে প্রায় ধাক্কা খাবার উপক্রম , ঠিক সেই মুহূর্তেই আরাফের অন্তর বিদীর্ণ । কিন্তু আঁখি হঠাৎ সরে যাবার দৃশ্য দেখেই থমকিল সে। কী এমন কথা বলছিল আঁখি মুগ্ধের সাথে? আর মুগ্ধ, যে কারো প্রতি কখনোই তেমন আগ্রহ প্রদর্শন করে না, সে আঁখিকে কি বলছিল? আঁখির প্রস্থানকালে মুগ্ধ পুনরায় ডেকে ওভাবে কানে কানে কি বলল? আরাফের অ'স্থি'রতা ক্র'মশ বৃদ্ধি পেতে লাগল। তারপর নিজ মনকে প্রবোধ দিল, ‘এ তো কেবল দু'র্ঘ'টনা মাত্র!’ তথাপি বুকের গভীরে এক অজানা সং'শ'য় ক্রমাগত পুঞ্জীভূত হতে লাগল।
শেষমেশ আরাফ মুগ্ধের নিকট এগিয়ে সোজা বিনা দ্বিধায় জিজ্ঞাসা করল,
——— " তুমি এখানে কেন এসেছো? "
——— " তোকে জানিয়ে আসতে হবে?"
——— "না, মানে তোমার তো জ্বর!"
——— " তো ?"
——— "বড়মা তো চিন্তা করবে তাই!"
——— " মুগ্ধ মানেই দু'শ্চিন্তা "
আরাফ কিছু বলার পূর্বেই, পেছন হতে আরো একদল লোক হাহাকার করতে করতে দূর হতেই এদিকে ধাবিত হচ্ছে! উপস্থিত প্রত্যেকে, সঙ্গে পু'লিশসহ, চমকিত হয়ে তাকালো। লোকদের আগমনে পরিবেশ শীতল হয়ে উঠল। তাদের মধ্যে ইকরাম আলী ও মোশারফ সাহেব উদ্বিগ্নভাবে একত্রে প্রশ্ন করলেন,
——— "কি হয়েছে? তোমরা এভাবে দৌড়াচ্ছো কেন?"
এটা তো আঁখির কলেজের দারোয়ানসহ গ্রামের অন্যান্য মানুষ! দারোয়ান হন্তদন্ত হয়ে শ্বাসকষ্টে ভ'য়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
——— "হামার কলেজত লা'শ! র...রাসেল স্যারের ল...লা'শ!"
———————
পুলিশ এখন আঁখির কলেজের মাঠে অবস্থান করছে। সমগ্র মাঠ জনতার কোলাহলে পরিপূর্ণ, কলেজের প্রত্যেক শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক সেখানে উপস্থিত। পুলিশ জরুরি অবস্থার জন্য একটি কাপড় আনার নির্দেশ প্রদান করেছে।
এক মহিলা রাসেল স্যারের লা'শ দর্শন করেই চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। সাথে সাথে পাড়া প্রতিবেশীরা তাঁকে তুলে বাড়ির দিকে নিতে লাগল। পুলিশ শিশুদের এখানে আসতে নিষেধ করেছেন, এবং নারীসহ, হার্টের রোগীদেরকে বারবার সতর্ক করা হচ্ছে যেন তারা এই দিকে প্রবেশ না করে।
মাঠের মাঝখানে বি'ভ'ৎ'স'ভাবে উ'ল'ঙ্গ রাসেল স্যারের লা'শ পড়ে রয়েছে। প্রতিটি অঙ্গের ভাজে ভাজে কু'পা'নোর চিহ্ন, কোন অংশ বাদ যায়নি। র'ক্তে ভিজে লাল, রাসেল স্যারের চেহারা এতটাই থে'তলে গিয়েছে যে, তাঁকে চেনা সম্ভব নয়।
পুলিশ পুরো কলেজ ঘিরে রেখেছে, কাওকেও আসতে দেওয়া হচ্ছে না, যেন প্রমাণ নষ্ট না হয়। আ'তঙ্ক এবং শোকের বাতাবরণ সকলকে গ্রাস করছে, যেন মৃ'ত্যুর হিমশীতল ছায়া এই পুরো গ্রাম জুরে ছড়িয়ে পরেছে!
রাসেল সাহেবের পত্নী ও কন্যাগণ চিৎকারে কান্না করছে, তাদের আ'র্তনাদ যেন আকাশের নিঃসঙ্গতা ভেদ করে যাত্রা করছে। এইভাবে মেয়েগুলি অনাথ হয়ে পড়ল, পত্নী বিধবা বরণ করল। ইতিমধ্যে রাসেল সাহেবের পরিবারে সকলেই উপস্থিত হয়ে কান্নাকাটি করছে। পুলিশ জানতে পারল, হাসপাতাল হতে কিছুকাল আগে ফিরেছিলেন রাসেল সাহেব; কিন্তু গত রাত্রি বাহিরে কখন বেরিয়েছেন , তা সম্বন্ধে তার স্ত্রী কিছুই অবগত নন।
তৎক্ষণাৎ, এক কনস্টেবল দৌড়ে এসে বলল,
——— "স্যার, এদিকে আসুন!"
দৌড়ে গিয়ে সে নিচতলার ক্লাস রুমে আবিষ্কার করল রাসেল সাহেবের পোষাক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, সঙ্গে ক'ন'ড'মে'র একটি প্যাকেট।
দাড়োয়ান ভ'য়ে ভ'য়ে কাপছে, যেন ভ'য়াবহতার চিহ্ন তাঁর শরীরের প্রতিটি স্নায়ুতে ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিশ দ্রুত এসে দাড়োয়ানকে রা'গা'ন্বিত গলায় প্রশ্ন করল,
——— "তুমি কলেজ গেইটের চাবি কোথায় রেখেছিলে?"
——— "স্যার প্রত্যেক টিচারের কাছেই একটা করি চাবি থাকে! "
———" তুমি কখন এসব দেখেছো? "
——— "স্যার, মুই কিছু জানু না! মুইতো ৩০ বছর ধরি কাম করছু! প্রতিদিনের মতো আইজও কলেজত আইছিনু। তখন দেখলাম, গেইটত তালা নাই! পরে কলেজত ঢুকি দেখুনু লা'শ..."
পুলিশের মাথায় তখন ক্রু'দ্ধ'তা ও হতাশার সমাহার। একদিকে মোবারকের খু'নি'কে ধরতে না পারার হতাশা, অন্যদিকে একের পর এক তিনটি খু'নে'র ঘটনার আবির্ভাব। পুলিশের কর্মকর্তার রা'গ আরো বেড়ে গেল,
——— "এটা কলেজেরই কারো কাজ!"
এমনকী প্রত্যেক শিক্ষক, প্রিন্সিপালসহ সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হলো। এই পরিস্থিতিতে কলেজ বন্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো অনির্দিষ্টকালের জন্য।
—————
পুলিশ স্টেশনে নিয়াজ সাহেব গভীর চিন্তায় ডুবে আছেন। তার মাথায় হাজারো চিন্তা কিলবিল করছে। হঠাৎ, শব্দ করে ফোন বেজে ওঠে—ডিআইজির ফোন। বিরক্ত হয়ে তিনি ফোন রিসিভ করেন। অপর প্রান্ত থেকে ডিআইজি ক্ষু'ব্ধ স্বরে বললেন,
——— "তোমরা কি করছ, হ্যাঁ? চার চারটি খু'ন হয়ে গেছে, আর এখনও খু'নি কে ধরতে পারছো না কেন?"
——— "স্যার, আমরা চেষ্টা করছি!"
——— "আমি কোনো চেষ্টার কথা শুনতে চাই না! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খু'নি'কে ধরো! জনগণের মাঝে আমাদের ভাবমূর্তি রক্ষা করতে হবে!"
——————
শিকদার বাড়িতে চিন্তিত সকলেই। ইকরাম আলীর মুখাবয়বে চিন্তার ভাজ স্পষ্ট। আশেপাশের সকলের মধ্যে উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠার পরিবেশ বিরাজমান। হঠাৎ, আজগর আলী জিজ্ঞেস করলেন,
——— "আমাদের গ্রামে কার কু'দৃষ্টি পড়েছে! প্রথমে মোবারক, এরপর রুপা, তার বাবা, আর এখন আঁখির কলেজের স্যার! তোমার কি মনে হয়, ভাই, এটা মোশারফ করতে পারে?"
ইকরাম আলী গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলেন,
——— "না! যখন মোবারক খু'ন হলো, তখন সন্দেহ ওদিকে গেলেও সবগুলো খু'ন যে সে করিয়েছে, তা বলা যায় না। রুপার সাথে যা হয়েছে, এটা মোশারফের পক্ষে করা সম্ভব নয়। আমি তাকে বেশ ভালোভাবে চিনি। তার বাবা তো গরিব, তাকে কে মা'র'তে পারে? আর রাসেল স্যার তো একজন শিক্ষক। তাকেই বা কে খু'ন করল? একজনকে সন্দেহ করা যাবে না। খু'নি যে কেউ হতে পারে!"
———————
শাহারিয়াজ ভবনে মোশারফ সাহেব গম্ভীর মুখে বসে আছেন, সঙ্গে সাজ্জাদ সাহেব। চাপা উদ্বেগে মোশারফ সাহেব সাজ্জাদকে জিজ্ঞেস করলেন,
——— "আছিয়া কই?"
——— "জানি না, অনেকক্ষণ ধরে দেখছি না!"
——— "আহ, রুপার কথাটা ভাবতেই কলিজাটা ছিঁ'ড়ে যায়! ওইটুকু একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে! ছিহ! আল্লাহ এর শা'স্তি দিবেই। আল্লাহ সবকিছুর হিসাব নেবেন!"
——— "ভাই, তোমার কি মনে হয় খু'নগুলো কি একজনই করছে?"
——— "তা তো বলা যাবে না! প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা, কারো সাথে কারো কোনো মিল নেই.!
——————
ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিমজ্জিত, একাকী, ভেজা-স্যাতস্যাতে পরিবেশে এক পরিত্যক্ত ঘরে এক্সিকিউটিভ লেদার চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে এক আগন্তুক! সমগ্র দেহ কালো আচ্ছাদনে আবৃত; মাথায় কালো টুপি, টুপির মধ্যে সাদা গোলাকৃতির রহস্যময় এক চিহ্ন। হাতে কাঁচের গ্লাসে র'ক্তে পূর্ণ, সেই র'ক্তে'র ঘ্রাণ নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা দুই ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে বাকা হেসে বলল,
0 Comments