লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা


কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।


শীতের কনকনে বিকেলের শৈত্যমণ্ডিত আবহে, আঁখি চাদরের উষ্ণ পরশে নিজেকে মুড়িয়ে, ধীরলয়ে পদক্ষেপ ফেলছে সেই আঁকাবাঁকা পথ ধরে। তার পাশে, শান্ত নিরাসক্ত বিষণ্ণতায় নিমগ্ন, বিরক্তিসিক্ত চাহনি মেলে সে এগিয়ে চলেছে, প্রতি পদক্ষেপে আরও ভারী হয়ে উঠছে তার অবিচল স্থৈর্য। আজ সকালে ভোলাকে পড়াতে যেতে পারেনি আঁখি, তাই এখন বিকেলের শীতলতায় সেই পথ ধরতে হয়েছে। আজ নাঈম অনুপস্থিত; ব্যস্ততায় আসতে অপারগ। তাই শান্তকে বাধ্য হয়েই আঁখির সঙ্গী হতে হয়েছে। শান্ত, সদ্যঘুমের গাঢ় প্রশান্তির কোমলতা উপভোগ করছিল, সেই মুহূর্তে যেন জীবনের সকল ক্লান্তি বালিশে মাথা রেখে উড়ে গিয়েছিল তার।
কিন্তু এই মেয়েটির জন্য সমস্ত আরামের রূপরেখা ভেঙে গেছে, সবটাই কল্পনাহীন এক পাঞ্চারের মতো ছিন্নভিন্ন। চোখেমুখে তিক্ততার ছাপ ফেলে চলছে, মাঝে মাঝেই ক্ষোভের ঝলক, মেঘের গর্জনে বিদ্যুতের ক্ষণিক আলো এক অস্পষ্ট বিদ্রুপ! শান্তর ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ জমছে; একটু পরই গলা চড়াল শান্ত, ঝাঁঝালো স্বরে বলল,
——— "কি, তোর জীবনে আর কোন কাজকর্ম নেই? ওই অ'স'ভ্যের বাচ্চাটাকে পড়াতে যাওয়ার এমন কি দরকার? আরাম করে কম্বলের তলে শুয়ে ঘুমাচ্ছিলাম! সবকিছু তছনছ করে দিলি তুই!"
আঁখি মৃদু হাসিতে তার কণ্ঠে অনুরণন তুলে বলল,
——— "ওরাই তো আমার প্রকৃত পরিবার, ভাইয়া! তাদের মাঝেই আমার শান্তির ঠিকানা। এ সত্যটা তুমি জানো না কি?"
শান্ত বিরক্তি ভরে মুখ কুঁচকে উত্তর দিলো,
——— "হ্যাঁ হ্যাঁ, ওসব নিচুস্তরের মানুষের সাথে মিশতে মিশতে তোর চিন্তা-চেতনায়ও ভাঁটা পড়েছে!"
আঁখি শান্তর এই কঠোর মন্তব্য শুনে শুধু হাসলো; কোনো প্রতিবাদ করল না। শান্ত আঁখির এই নির্বিকার হাসি দেখে উষ্মায় বলে উঠল,
——— "গাধার মতো হেসে চলছিস কেন? মাইরের ভয় ভুলে গেছিস নাকি? আরেকটু ঠাসিয়ে মনে করিয়ে দিতে হবে?"
আঁখি নিশ্চুপ রইল! শান্ত চলতে চলতে গভীর সুরে বলল,
——— "আমি আগেই বলেছিলাম, অতিমাত্রায় মেলামেশা করিস না। দিনশেষে দেখলি তো, ভাই ছাড়া আর কে রইল? বান্ধবীর তো তোর প্রতি বিন্দুমাত্র মমতা নেই! তোকে আঘাত করেই গেলো! কেমন লাগছে এখন? সময়ের সাথেই বুঝলি, আমার কথাই সত্যি! তার জন্য খাবার-ঘুম সব বিসর্জন দিয়েছিস! কেন ভুলে যাস, তুই তো ওদের মতো নোস; তোর জীবন ভিন্ন! এসব ক্ষুদ্র বিষয়ে তোর মনোজগত আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া উচিৎ নয়, আঁখি।"
আঁখি ম্লান মুখে বলে উঠল,
———" কী করব ভাইয়া? ওরাই তো আমার জীবনের আনন্দের উপকরণ ছিল! শৈশবের শুরু থেকেই ওরা পাশে ছিল। ভালোবেসেছে, আগলে রেখেছে। অথচ আজ এক দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনার পর আমায় ভুল বুঝল, বন্ধুত্বের মর্মবাক্যকে ভেঙে ফেলে চলে গেল! বলো, এই নিঃসঙ্গতায় আমি কেমন করে থাকি?
শান্ত চোখে রাগের দীপ্তি ছড়িয়ে বলল,
——— "ছাই দিয়ে সে সব ঝেড়ে ফেলাই শ্রেয়! নাঈমের সঙ্গে মিশতে মিশতে তার মতো গাধা হয়েছিস। সে তো আবার গাধার মতো প্রেম করে আরও গাধা হচ্ছে! আর এখন তুই এই ভঙ্গুর বন্ধুত্বের জালে ফেঁসে বোকামি করছিস! এইসব তুচ্ছ বিষয়ে মন খারাপ করতে দেখলে চাবুকের আঘাত মনে আছে তো? এবার দুই চাবুক দিয়ে মন এবং শরীর দুটোই খারাপ করিয়ে দেব?"
আঁখি নিরুচ্চারে মুচকি হাসির আড়ালে হারিয়ে গেল। কনকনে শীতল বিকেলের কোমল বাতাসে নির্জন পথে ধীর গতিতে পা ফেলে চলতে লাগল। শান্ত, বিরক্তির ভার বয়ে তার পাশে হাঁটছে। এ পথ এত সংকীর্ণ যে সেখানে চারচাকা গাড়ির প্রবেশ দুরাশা, কেবল বাইকের সঞ্চরণ হয়তো সম্ভব। অথচ এই মূর্খ কন্যা তার পায়ে হেঁটে পথ অতিক্রম করতে অভ্যস্ত! কি অসংগতিময় রুচি তার! শান্তর এ যেন ক্লেশসিক্ত তিক্ততার এক অন্তর্গত সংগ্রাম! বিশাল এ দূরত্ব হেঁটে যাওয়ার অভিপ্রায় বোধগম্য নয়, অথচ কখনো কখনো নিয়তির শৃঙ্খলে মানব হৃদয় বাধ্য হয় বিরুদ্ধ ইচ্ছার পথে হাঁটতে! শান্তও সেই অভ্যন্তরীণ সংগ্রামের বশবর্তী হয়ে এই ক্লান্তিকর যাত্রায় সঙ্গ দিয়েছে। কি মহৎ ত্যাগ, তার আত্মমর্যাদার এক মহান আত্মোৎসর্গ!
__________________
রোহান চায়ের কাপটা নামিয়ে সবে উঠতে উদ্যত, ঠিক সেই মুহূর্তে মিষ্টির মৃদু কণ্ঠস্বর ভেসে এলো দোকান থেকে। সে থমকে দাঁড়ালো; বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা যেন নতুন করে জাগ্রত হলো। মিষ্টি দোকান থেকে বেরিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়াল, আর রোহান কঠোর স্বরে বলল,
——— "কিছু বলবি?"
মিষ্টি শান্ত কণ্ঠে জানাল,
——— "কাল থেকে আমি আর দোকানে বসব না। আর কষ্ট করে আসার প্রয়োজন নেই । আমার স্বামীর রোজগার এখন বেশ ভালো, তাই আমাকে এখানে বসার জন্য নিষেধ করা হয়েছে।"
মিষ্টির কথা শুনে রোহানের মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ল। বুকের গভীর প্রদেশে অন্তহীন শূন্যতা ছড়িয়ে পড়ছে। এই ক্ষুদ্র আশ্রয়টুকুতে অন্তত মেয়েটির স্নেহের একটুকরো স্পর্শ সে অনুভব করতে পারত। এই জীবনে তো তাকে অধিকার করার স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল, আর যেটুকু বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ছিল, সেই ক্ষুদ্র আশাটুকুও ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে!
রোহান মৃদু হাসিতে মুখ রাঙিয়ে বলল,
--- "কি অদ্ভুত কল্পনা তোর, মিষ্টি! কেনইবা আমার কাছে বলছিস এসব? আমি তো কেবল এক পেয়ালা চায়ের জন্যই আসি, নাকি তোকে দেখতে! এমন অবাস্তব চিন্তায় মগ্ন হবার মানে নেই। সংসার সাজা, স্বামীর সাথে সুখে থাক!"
মিষ্টি নিঃশব্দে উত্তর দিল, তার মুখে অদ্ভুত রহস্যের আভাস,
——— "তোর মনস্তত্ত্ব আমার অজ্ঞাত নয়, রোহান! তুই কেন আসিস, সে কথা আমি জানি।"
এরপর আর কিছুই বলল না মিষ্টি। নির্বিকার মুখে দোকানের অভ্যন্তরে চলে গেলো, আর ততক্ষণে রোহানের মনে ঝড় উঠলো। ব্যথায় বিদীর্ণ হচ্ছে হৃদয়! চোখের পলকগুলো পাথর হয়ে গেছে, মস্তিষ্ক ফেটে যাচ্ছে। আবারও সে নিজেকে সামলে ফিরে গিয়ে বলল,
——— "চিনি ছাড়া আরেক পেয়ালা দে!"
ব্রেঞ্চিতে ধপ করে বসে পড়ল রোহান। মুখে বিষণ্ণ হাসি, অন্তর্লীন বেদনায় আঁকা। মিষ্টির মুখে কোনো দুঃখের ছাপ নেই; নির্বিকার ভঙ্গিমায় সে এক পেয়ালা রঙ চা এগিয়ে দিল। রোহান ধীরে ধীরে চুমুক দিলো, চোখ রক্তাভ। বুকে অসহনীয় ভারী অনুভূতি জমে উঠছে, গলার শব্দ আটকে আসছে। চায়ের শেষ চুমুক শেষ করে কাপটি রেখে, ধীরে বয়ামের উপর টাকা রেখে বলল,
——— "চিনি ছাড়া চায়ের স্বাদ তোকে স্মরণ করাবে, আমার না হওয়া প্রিয় চা ফুল! ভালো থাকিস।"
চোখের কোণে জল জমে উঠলেও সে আর থামলো না, দীর্ঘশ্বাস গিলে হনহনিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো রোহান।
রোহান সরে যেতেই মিষ্টি মুখ আঁচলে ঢেকে রুদ্ধশ্বাসে কেঁদে উঠল। কত স্মৃতি, কত গোপন যাতনা হৃদয়ের গহীনে জমা! নিজেকে প্রবোধ দিতে চেয়েও ভুলতে পারেনি অতীতের সেই দিনগুলি। কেবল এই এক পুরুষের প্রতিই সে একনিষ্ঠ ছিল, হৃদয় দিয়েছিল নিবেদন। সেই বালিকা বয়সে, যখন পড়াশোনার সঙ্গী ছিল, নিঃশব্দে তার শিশুকুমারী মন আচ্ছন্ন হয়েছিল এই হাস্যরসে মোড়া ছেলেটির প্রতি। কিন্তু সহসা বিয়ে এসে সবকিছু ধূলিসাৎ করে দিলো।
মিষ্টির বুকে চাপা দীর্ঘশ্বাস জমে আছে; রোহান জানেও না, তার প্রতিও মিষ্টি নিভৃত প্রণয়কাতর ছিল। জানে না, কেমন তীব্র সংগ্রাম করেছে মিষ্টি, কী অদৃশ্য শিকল টেনে ধরেছে তাকে। কিন্তু বাবার মৃত্যুর হুমকি সামনে এনে তাকে বাধ্য করা হলো। এই সংসার জীবনে সাথী স্বামী, যে অর্ধেক উপার্জন জুয়ার টেবিলে ঢেলে ফেলে নির্বিকার। অথচ ছোট্ট দু'বছরের কন্যাটি তার, যার অস্তিত্ব পর্যন্ত যেন স্বামীর কাছে গুরুত্বহীন।
তাই তো, এই চায়ের দোকানের ধূলায় বসে থাকে সে; দিনশেষে এই নির্বিকার চায়ের কাপ তার সঙ্গী। দীর্ঘশ্বাসে বুক বিদীর্ণ হয়, মন বলে, এ জীবন তো এমন হওয়া উচিত ছিল না, তাই না?
______________________
——— "এক দীপ্তিমান তরুণ যদি নারীর মতো অনুভূতির আবেগে আন্দোলিত হয়, আর এক কুমারী যদি পুরুষের মতো সংবেদন ধারণ করে, তবে এ কোন অজ্ঞাত রোগের প্রতিচ্ছবি, বল তো?"
রাতের স্তব্ধতা ভেদ করে ফরেনসিক ল্যাব হতে প্রস্থানরত ডক্টর উজ্জ্বল সাহেব হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন এসিপি মুযহাব সাহেবের অপ্রত্যাশিত কণ্ঠস্বর শুনে। আজকের সূচনার লগ্নে বিউরোতে এসেই রুদ্রের প্রশ্ন ছিল এই বিষয়ে; প্রস্থানের মুহূর্তে আবারও পুনরাবৃত্তি। দৃঢ় দৃষ্টি আর বিরূপ কপোলের ভাঁজে তাকিয়ে আছেন তিনি। ইতোমধ্যে বিদিত হয়েছে যে, রুদ্রের বন্ধু প্রান্ত নিজের সত্তার পরিবর্তন ঘটিয়ে কিশোর থেকে কুমারীতে পরিণত হয়েছে। তথাপি, ডক্টর উজ্জ্বল ব্যঙ্গভরে বললেন,
-——— "আহা! ভাবীর এখন কি দশা হবে?"
মুযহাব সাহেব তীব্র কপোল কুঞ্চনে প্রশ্ন করলেন,
——— "দশা বলছিস কেন? এমন কী ঘটেছে?"
——— "আল্লাহ! এই বয়সে তোর ভেতরে নারীর মতো ভাবনা জাগে?"
উজ্জ্বল হাস্যাবৃত ঠোঁট চাপলেন, আর মুযহাব সাহেব তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
——— "এই যে! আমার সঙ্গে মজা করিস? আমি গম্ভীর বিষয় আলোচনা করছি! ফাজলামো বাদ দিয়ে সঠিক ব্যাখ্যা কর!"
উজ্জ্বল সাহেব মুখে গাঢ় হতাশার রেখা ফুটিয়ে বললেন,
——— "আর কি বলব তোকে! এইসব বিকৃত চিন্তা ভাবলেই যেন আত্মা অবশ হয়ে আসে, মনে হয় কেবল এদেরই জন্য সমাজের এই অধঃপতন!"
মুযহাব সাহেব ধৈর্যচ্যুত হয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন,
——— "হ্যাঁ হ্যাঁ! এইসব মলিন বক্তব্য এখন বাদ দে, আসল কথাটা বল।"
উজ্জ্বল সাহেব একটু ভেংচি কেটে গম্ভীর কণ্ঠে, প্রফেশনাল অভিব্যক্তি নিয়ে বললেন,
——— "এই ধরনের অবস্থাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে জেন্ডার ডিসফোরিয়া বলা হয়। এটি এক বিশেষ মানসিক অবস্থা, যেখানে ব্যক্তি নিজের জৈবিক লিঙ্গের সাথে তার অভ্যন্তরীণ লিঙ্গ পরিচয়কে সাংঘর্ষিক বলে অনুভব করে।"
মুযহাব সাহেব কপালে দু'আঙুল ঠেকিয়ে বলে উঠলেন,
——— "এ সকল বিকৃতির কোনো প্রতিকার নেই কি?"
উজ্জ্বল সাহেব গভীর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তর দিলেন,
———" জেন্ডার ডিসফোরিয়ার নিরাময় অবশ্যই বিদ্যমান, তবে তা নিছক শারীরিক চিকিৎসায় সীমাবদ্ধ নয়; মনের অন্তর্লীন প্রান্তিকতায় প্রবেশ করতে হয়, এক অনুশীলন যার জন্য প্রয়োজন সঠিক মানসিক সমর্থন। এই পথের অনুসরণে দীর্ঘমেয়াদী কাউন্সেলিং ব্যবহৃত হয় যেখানে একজন দক্ষ মনোবিজ্ঞানীর সহায়তায় ব্যক্তি নিজের অনুভূতি ও সত্ত্বার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করতে সক্ষম হয়। প্রয়োজনে হরমোন থেরাপি ও শল্যচিকিৎসার সহায়তা নেওয়া যেতে পারে, যদিও এটি সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তির ইচ্ছাশক্তির প্রতি নির্ভরশীল।"
মুযহাব সাহেব ক্রোধে জ্বলে উঠলেন,
———" চুপ কর! এ সকল ট্রান্সজেন্ডারের মতো লজ্জাকর আচরণ আর কিছু নেই!"
———" তাই তো, তবে তাদের অন্তরের গভীরে প্রবেশ করে কে বোঝাবে?"
——— "এদের ধরে বেঁধে তোর ল্যাবে পাঠিয়ে দেব!"
———" না ভাই! আমি মৃগয়া মৃতের সঙ্গে যথেষ্ট শান্তিতে আছি; এ বিকৃত মানুষদের প্রয়োজন নেই আমার ল্যাবে।"
——— "আচ্ছা, তবে এসব বাদ দে। আমাদের সাধারণ মানুষের কী কর্তব্য? এ সকল বিকৃতির করাল গ্রাস থেকে দূরে থাকতে?"
উজ্জ্বল সাহেব কিছুক্ষণ নীরব থেকে অবিচল সুরে বললেন,
——— "দেখ, সাধারণ মানুষের জন্য প্রথম কর্তব্য হলো এ সকল বিষয়ে যথার্থ জ্ঞান লাভ। লিঙ্গ বৈচিত্র্যের আসল মর্মার্থ বোঝা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, কারণ মনুষ্যচেতনার অন্ধকার কোণ হতে ভ্রান্ত ধারণা আর ভীতিরই উৎপত্তি। সমাজে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে শিক্ষা বিস্তারই একমাত্র পথ, যাতে সহমর্মিতা ও সমানুভূতির পবিত্র বোধ বজায় থাকে।
দ্বিতীয়ত, পরিবারের ভূমিকা নিতান্তই গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই মানবিক মূল্যবোধ ও সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেওয়া উচিত, যেন তারা সকল শ্রেণির মানুষকে আত্মার সহিষ্ণুতা দিয়ে গ্রহণ করতে শেখে। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসিকতার সেই মূল উন্নতি সাধিত হওয়া প্রয়োজন, যেন পরবর্তী প্রজন্ম কোন ভ্রান্ত ধারণা কিংবা অবজ্ঞা দ্বারা দগ্ধ না হয়। এ সকল বোধের চর্চা না হলে পরিবারই শেষত বীজতলায় বিভ্রান্তির ঘুণ লাগায়।"
উজ্জ্বল সাহেব থেমে আরো বললেন,
--- "তবে আমার ব্যক্তিগত মতামত, এ-ধরনের কাজে পরিবারের দোষ সবচে বেশি! "
মুযহাব সাহেব তীব্র দৃষ্টি মেলে প্রশ্ন করলেন,
——— "কেমন করেই বা?"
উজ্জ্বল সাহেব গভীর তত্ববোধের ভাষায় বললেন,
——— "মানবের অন্তর্নিহিত তমসায় সুপ্ত সেই প্রাচীন পাপের শেকড় যেখানে শুদ্ধতার অভাব আর সহমর্মিতার নির্জনতা, সেখান থেকেই অপূর্ণতার এক বিষবৃক্ষ জন্ম নেয়; পরিবার সেই মাটিই, যে স্থলে সুদূর ভবিষ্যতের আদর্শ রোপণ হওয়া উচিৎ, না হয় সেখান থেকেই সমাজে বিভেদ ও সংকীর্ণতার বিষবাষ্প ছড়ায়।"
মুযহাব সাহেব গভীর কণ্ঠে বললেন,
——— "হুম! তা ঠিক!"
উজ্জ্বল সাহেব আরও একগাল বিষণ্নতার ছাপ রেখে বললেন,
————" দেখ, যখন শিশুরা নিজেদের অস্তিত্বের সত্তায় বিকশিত হতে থাকে, তখন অনেক মা ও বোনেরা কৌতুকবশত বা আকস্মিক খেয়ালের বশে ছেলে সন্তানদের নারীসুলভ বেশে সজ্জিত করেন, তাঁদের রূপময় বস্ত্র আর অলংকারে আবৃত করেন। এই নির্দোষ প্রয়াসের অন্তরালে যে বিষাক্ত প্রভাব সেই কোমল মনে ক্রিয়াশীল হয়, তা তারা কল্পনাও করতে পারেন না। সে সকল ছেলে শিশু, তাদের মনে অপ্রত্যাশিতভাবে কল্পনা দানা বাঁধে যে, তারাও বুঝি রমণীর সমরূপ। অনুরূপ পরিস্থিতি কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রেও ঘটে থাকে; তাদের পুরুষসুলভ পরিধানে আবৃত করে, পারিবারিক কর্তারা প্রকারান্তরে সন্তানদের নিজস্ব সত্তা হতে বিচ্যুত করে ফেলেন। ধর্মের প্রকৃত জ্ঞান ব্যতীত এই অবিমৃশ্যকারিতা আরও অধিকতর বিভ্রান্তি আনয়ন করে।
পিতৃ-মাতৃ সহ পুরো পরিবারের সকল সদস্যদের কর্তব্যের মূল রূপরেখা হল, সন্তানদের ধর্মীয় বিধি ও শৃঙ্খলাবদ্ধতায় দীক্ষিত করা, যাতে তাদের চেতনায় সেই নিষেধের দৃঢ়তা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। কারণ ধর্মের নির্দেশনায় আমাদের কঠোর বাধা প্রদান করা হয়েছে, যেন সন্তানদের মন-মননে তাদের যথাযথ লিঙ্গের রূপ ও বৈশিষ্ট্যের মধ্যে উন্নয়ন সম্ভব হয়। তবেই এই বিকৃতির করাল ছায়া হতে তাদের শৈশব রক্ষিত হবে। এমনকি এই সামান্য শৈশব খেলার ছলে বালককে রমণীর সাজে বা বালিকাকে পুরুষের রূপে পরিচিত করানো আদতে যে কত গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে, তা অভিভাবকবর্গ অনুভবও করতে পারেন না।
তাহাদের বোধগম্য হওয়া উচিত যে, এ সকল তুচ্ছ প্রয়াস আসলেই কতখানি ভয়াবহতার সূচনা করে; সন্তানের সত্ত্বা, ধর্মের সংহতিতে বলীয়ান করে, যাতে অচেতন বাল্যকালের বিভ্রান্তির কুহকে পতিত না হয়, সেভাবে শিশুদের লালন-পালন করাই পিতামাতার পরম দায়িত্ব।"
উজ্জ্বল সাহেব গভীর শ্বাস নিয়ে বললেন,
——— "জানিস, অনেক সময় ব্যক্তির তিক্ত অতীত একটি দুর্দমনীয় মানসিক কুপ্রভাব সৃষ্টি করে, নিরন্তর তাকে গ্রাস করে। যেমন ধর, কোনো কন্যাশিশু যদি তার শৈশবে কোন অধম পুরুষের দ্বারা নির্যাতিত হয়, এক ঘৃ'ণ্য স্পর্শের অভিশাপে তার কোমল চেতনায় পুরুষজাতির প্রতি এক ভয়ানক অবিশ্বাস এবং ঘৃণার বীজ জন্মায়। পরিণামে, সে এমন মনোভাব লালন করতে পারে, যাতে পুরুষের পরিবর্তে নারীর সান্নিধ্যেই স্বস্তি খুঁজে। অনুরূপভাবে, কোনো পুত্র যদি নারীজাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয় বা কোনো হৃদয়বিদারক ঘটনার সম্মুখীন হয়, তবে তার মনও একসময় নারীকে উপেক্ষা করে অন্য পুরুষের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে পারে।
এভাবেই কুসংস্কারের করালগ্রাসে নারী-নারীর সম্পর্ক কিংবা পুরুষ-পুরুষের সম্পর্কের নিকৃষ্ট এবং অশ্লীল মনোবৃত্তির বীজ অঙ্কুরিত হয়, এক অভিশপ্ত সামাজিক ব্যাধির আকারে। এই অপথে, তথাকথিত সমকামী সম্পর্কের উন্মেষ ঘটে। এসব লজ্জা এবং কুৎসিত বোধে আমার মন বিষন্ন হয়, ভাবতেই যেন হৃদয়ে অশান্তির ঝড় উঠে।"
এসিপি মুযহাব সাহেব এক গভীর দীর্ঘশ্বাসে বললেন,
——— "মোটকথা হলো, নিজেকে আগে স্থিত ও সুস্থ রাখা আবশ্যক। তাহলেই তো পরকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারব!"
উজ্জ্বল সাহেব সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বললেন,
———" ঠিক বলেছিস! এখন সর বাড়ি যেতে দে।"
——— "তুই সর! আমাকে আগে যেতে দে! "
এই বাক্য শেষ করে উভয়ে একই তালে বিউরোর দরজা পার হলেন। উজ্জ্বল সাহেব এবং মুযহাব সাহেব দুইজনেই একে অপরের ছায়াস্বরূপ, পরম বন্ধু। তাদের পরিচয়ের সূত্র সেই প্রাচীন দিনে, যখন সিআইডিতে একসাথে প্রথম যোগদান করেছিলেন। বহু বছর একত্রে কাজ করবার মধ্য দিয়েই এই বন্ধুত্বের মূল ভিত্তি রচিত হয়। সময়ের প্রবাহে দায়িত্বের ভার যতই কঠোর হোক, তাদের আন্তরিক হাস্যকৌতুক ও খুনসুটি আজও অবিচল। মুযহাব সাহেব যিনি সাধারণের কাছে এক কঠোর ব্যক্তিত্বের প্রতীক, বন্ধুর সান্নিধ্যে সেই গম্ভীর আবরণ ছিন্ন করতেই স্বস্তি পান। নানা জটিল বিষয়েও আলোচনা এবং চিন্তাভাবনার অবারিত ক্ষেত্র তার বন্ধুত্বের পরিসরে অবারিত থাকে।
________________________
রুদ্র হিমেল শীতের দংশনে শিরা-উপশিরায় হিমস্রোত বইতে থাকা করিডোরে নিশ্চল বসে, এক দৃষ্টিপ্রভায় জড়ানো পাথুরে মূর্তি। মহুয়া তার সিক্ত অস্তিত্বে রুদ্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধতে চাইছে, ভাঙনের হাহাকারকে মুঠোতে ধরার ব্যর্থ প্রয়াস। প্রান্তকে বাঁচানোর কোনো পথ ছিল না; নিজের গলায় ক্ষুর চালিয়ে সে অনিবার্য মৃ'ত্যুর আলিঙ্গনে বিলীন হয়েছে। তার রক্তস্রোত ঊর্মিলা বেগমের হৃদয়ভূমি নিঃশেষ করেছে, সন্তানের এই অপারাগম্য পরিণতির ভারে তিনি মানসিক বিপর্যয়ে আচ্ছন্ন হয়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে ঢলে পড়েন।
অন্যদিকে জয়নাল সাহেব, যিনি জন্মদাতা, পিতৃত্বের সমস্ত দায় অস্বীকারে শীতল নির্মমতায় মৃ'ত সন্তানের মুখ দেখতেও অক্ষম; বরং তার অন্তরে ঘৃ'ণার বিষাক্ত স্রোত প্রবাহিত। কী করে দেখবেন! যে মুখ ছিল একদা পুত্রের, তা আজ কন্যার পরিচয়ে প্রতিস্থাপিত, তাঁর কাছে এ প্রকৃতির নিয়মের চূড়ান্ত উপহাস। প্রান্ত, যে তাঁর সত্তার সীমানা ভেঙে নিজেকে পুরুষ থেকে নারী রূপে রূপান্তরিত করেছে, পিতার কাছে এক বিষাদ-স্মৃতি মাত্র।
রুদ্র, দিনভর ক্লান্তির গভীরতর স্তরে নিমজ্জিত হয়ে, তবু তার চাচি ঊর্মিলা বেগমকে একবার দেখার তাড়নায় হাসপাতালের করিডোরে এসে পৌঁছেছে। সেখানে , চাচি গভীর নেশার ঘোরে নিথর, চিকিৎসকের নির্দেশে ঘুমের ওষুধে শান্ত। করিডোরের প্রতিটি ধুলিকণা রুদ্রের বুকের ভেতর বিষাক্ত প্রশ্নবাণ হয়ে বিঁধছে, এ মৃত্যুগুলো, এ বিভেদগুলো, এ বেদনার রূপান্তর, কীসের অভিশাপ বহন করে?
ঊর্মিলা বেগমকে আপাতত হাসপাতালে কয়েকদিন নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে। জয়নাল সাহেব, যিনি সারাদিন স্ত্রীর শিয়রে বসে সময় কাটিয়েছেন, কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি ফিরেছেন। হাসপাতালের নির্বিকার শূন্যতা, বিষাদমাখা গন্ধ, আর অসহায়তার ক্রমাগত চাপ তাঁর শরীর ও মনে এমন ভার রেখেছে যে, তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। একসঙ্গে দুজন অসুস্থ হলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কেউ থাকবে না, এই যুক্তিতেই রুদ্র তাঁকে জোর করেই বাড়ি পাঠিয়েছে, প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে সে নিজেই রাতে হাসপাতালে থেকে দেখাশোনা করবে।
মুগ্ধ এবং মহুয়া দুপুরেই নিজেদের দায়িত্ব পালনে ফিরে গেছে। তারা সিআইডি অফিসার, রাষ্ট্রের জটিল প্রশ্নগুলো তাদের হাতেই মীমাংসিত হতে হয়। ব্যক্তিগত শোক কিংবা দুর্যোগ তাদের কর্তব্যের পথে বাধা হতে পারে না। তবে মুগ্ধ, রুদ্রের বর্তমান মানসিক অবস্থা গভীরভাবে বুঝতে পারে, শুধুমাত্র আজকের দিনটির জন্য রুদ্রকে তার কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেছে। রুদ্রের ভাঙাচোরা আত্মার উপর দিয়ে যে ঝড় বইছে, তার ভার তাকে একদিনের জন্য হলেও তীব্র বাস্তবতার বাইরে রাখার প্রয়াস ছিল মুগ্ধর।
রাত্রির নিঃসঙ্গতা যখন সিক্ত আঁধারে আচ্ছন্ন, তখন মহুয়া আর মুগ্ধ কাজ শেষে হাসপাতালে উপস্থিত। মুগ্ধ, নির্বাক এক সহচর, বাহিরে নিঃশব্দে সিগারেটের ধোঁয়ায় নিজের অতীতের গভীর ক্ষতচিহ্ন উড়িয়ে দেওয়ার বৃথা প্রয়াসে মগ্ন। চোখের দৃষ্টি ধোঁয়ার আড়ালে হারিয়ে যায়, বেদনার কোনো এক সুদূর শূন্যতার গভীরে তাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, মহুয়া এখন রুদ্রর ভগ্ন হৃদয়ের প্রতিরূপে আশ্রয় হয়ে উঠেছে। সে রুদ্রকে গভীর স্নেহে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে তার ক্লান্ত আত্মাকে সান্ত্বনা দিতে চায়। রুদ্রর কপালে এক অপার্থিব চুম্বন এঁকে মহুয়া বলল,
——— "সব ঠিক হয়ে যাবে! চিন্তা করো না।"
রুদ্রর হৃদয় ব্যথার ভারে দগ্ধ, মহুয়াকে আরো নিবিড়ভাবে বুকে জড়িয়ে ধরে তার দুঃখ-যন্ত্রণার সমস্ত ভার সেই আলিঙ্গনে বিলীন করতে চায়। তার কপালে নিজের অধরের স্নেহমাখা ছোঁয়া রেখে একমাত্র শব্দে প্রতিক্রিয়া দিল,
——— "হুম।"
মহুয়া আবার দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
——— "হুম না! মন খারাপ করে থেকো না। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে, তার ভার তুমি কেন বহন করবে? এখানে তোমার কোনো দোষ নেই। বুঝেছো?"
রুদ্র কোনো শব্দ করল না। সে শুধু মহুয়াকে আরো শক্ত করে নিজের বুকে টেনে নিল, এই নির্জনতার বিশাল মহাকাশে একমাত্র এ আলিঙ্গনই তার শান্তি। জীবনের সমস্ত কষ্টের অন্ধকারে এই মুহূর্তটাই তার একমাত্র আলোকচ্ছটা। এটাই তার প্রাপ্তি, তার স্বর্গীয় শান্তির ক্ষণিক আশ্রয়।
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতায় মহুয়াকে নিজের বুকে রেখে, সমস্ত ব্যথা আর অশান্তি সেই মুহূর্তে বিলীন করতে চেয়েছিল রুদ্র। তারপর এক নিঃশ্বাসে তাকে আলগা করে বলল,
——— "স্যার কোথায়?"
——— "বাইরে।"
আর কোনো দেরি নয়। রুদ্র দ্রুত পা চালিয়ে হাসপাতালের বাইরে পা রাখল, পেছনে মহুয়া তার ছায়ার মতো এগোল। নির্জন রাত্রির আধো আলো-অন্ধকারে হাসপাতালের পাশে ছোট্ট স্টলের বিবর্ণ আলোতে ব্রাঞ্চে বসে মুগ্ধ যেন এক দগ্ধ উন্মাদ, সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে নিজের বিক্ষুব্ধ আত্মা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। রুদ্র এগিয়ে গিয়ে নিম্ন কণ্ঠে বলল,
——— "স্যার? আপনি ঠিক আছেন?"
মুগ্ধর চোখ রক্তাভ, দুঃখের শিখায় দীপ্ত। লাল চোখমুখে এক বিষণ্ন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তুলে সে বলল,
——— "আমার কথা ছাড়ো! তুমি ঠিক আছো?"
——— "হুম, স্যার।"
রুদ্রর কথার ভারসাম্য ঠিক থাকলেও তার দৃষ্টি মুগ্ধর পায়ের কাছে জমে থাকা ধূসর মাটির উপর নিবদ্ধ। সেখানে অগণিত সিগারেটের অবশিষ্টাংশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সেখানেই তার মনের কষ্টের অমোঘ প্রমাণ লুকিয়ে। মুগ্ধ রাতের আঁধারে নিজের যন্ত্রণার অগ্নি জ্বালিয়েছে। কয়টি প্যাকেট ফুরিয়েছে, আল্লাহ মালুম। এমন উদাসীন আত্মধ্বংস কি কেও এমনি এমনি করে?
রুদ্র কিছুক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে এক পা এগিয়ে বলল,
——— "স্যার, একটা কথা বলব?"
মুগ্ধ দৃষ্টির আগুন এখনো নির্বাপিত হয়নি, সিগারেটের শেষ টান দিয়ে ধীর পায়ে উঠে দাঁড়াল। নিজের হাত রুদ্রর কাঁধে রেখে গভীর কণ্ঠে বলল,
——— "বলো।"
কণ্ঠে যেন কোনো ক্লান্ত মহাকাব্যের গাথা লুকিয়ে, রুদ্রর কথার অপেক্ষায় স্থির।
মহুয়া পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে, রুদ্র গভীর দৃষ্টি নিয়ে বলল,
——— "আপনার মনের গহীনে কোনো ব্যথা বা উদ্বেগ বাসা বেঁধে থাকলে বলুন, স্যার। আপনিই তো বলেছেন আমরা এক পরিবার। আজ আপনি যেভাবে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, সেভাবেই আমিও আপনার পাশে থাকতে চাই।"
রুদ্র আর মহুয়া মুগ্ধের মুখপানে চেয়ে রইল, গভীর কৌতূহলে। মুগ্ধ সামান্য হাসল, কপালের উপর ছায়া ফেলা এলোমেলো চুল সরিয়ে বলল,
———" তুমি এক প্রিয়জনকে হারানোর বেদনাকে বুকের গভীরে ধারণ করেছো, আর সেই হারানো জনের যন্ত্রণায় অন্য প্রিয়জনকে বুকে টেনে নেওয়ার স্পর্শে শোকের অগ্নিবাণীকে শান্ত করেছো। জানো, রুদ্র! আমিও একসময় এক আপনকে হারিয়েছিলাম! গভীর বাসনায় চেয়েছিলাম, তার অনুপস্থিতির বিষাদকে দূরে ঠেলে আরেক প্রিয়জনের সান্নিধ্যে মনের তৃষ্ণা মিটিয়ে নেবো। হৃদয়ের অমোচনীয় ক্ষতগুলো উন্মুক্ত করে তাকে জানিয়ে দেব, মন হালকা করবো। কিন্তু, অদৃষ্টের নির্মম পরিহাসে সে সাধ পূর্ণ হয়নি! হৃদয়ের প্রগাঢ় অব্যক্ত কষ্টগুলো বুকের গভীরতম প্রান্তে চাপা দিয়েছি, নীরব স্বরে নিজেকে বোঝানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছি, সেই বেদনাই আমার একান্ত আপন হয়।"
মহুয়ার চোখে অনির্বচনীয় কৌতূহল, সে নিবৃত্তির পরেও প্রশ্ন করল,
——— "আপনি কাকে হারিয়েছেন? এবং সেই অপর যার প্রতি এমন আকাঙ্ক্ষা ছিল, তিনি কেন আপনাকে বুকের আশ্রয়ে রাখলেন না?"
মুগ্ধ ক্ষণিকের জন্য স্থির দাঁড়িয়ে ঘড়ির দিকে চোখ বুলালো, সময়ের নিঃশব্দ সাক্ষী রাত দশের কাঁটায় স্থির হতে চায়। তারপর গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
——— "যে-জন আমার অন্তরের মণিকোঠায় চিরস্থায়ী ভূমি তৈরি করেছিল, সে-ই আজ নিঃসঙ্গতার আঁধারে হারিয়েছে। রেখে গেছে শূন্যতায় ভরা এক আকাশ!"
রুদ্র খানিকটা থমকে গিয়ে বলল,
——— "আর দ্বিতীয়জন? তার কী পরিণতি?"
মুগ্ধের ঠোঁটে বিদ্রুপমাখা এক হাসির রেখা খেলে গেল, অন্তর্গত ব্যথার রক্তিম চিহ্ন। মাথায় প্রবল যন্ত্রণার হানা আর বুকের অতল বেদনার চাপ নিয়ে ধীরে ধীরে গাড়ির দিকে পা বাড়ালো। মহুয়া আর রুদ্র তার সঙ্গেই পা মেলালো। অদ্ভুত বিষণ্ণতায় ডুবে মুগ্ধ বলতে লাগলো,
——— "সে এসেছিল ক্ষণস্থায়ী এক স্বপ্নের মতো, হঠাৎ করেই! মনের গভীরতম কোণে আলোড়ন তুলে সে আমার হৃদয়কে বিষাদময় এক বাণী শোনালো! আমার চেতনার কেন্দ্রে তার চরণের ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়ে, সে আমার সর্বস্ব কেড়ে নিলো। অস্তিত্বের নেশায় আচ্ছন্ন করে, সেই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রস্থান আমাকে মৃত্যুর করাল ছায়ায় ছেড়ে গেলো! বিধাতার কঠিন বিধান, এক নিমেষে সমস্ত অস্তিত্ব আমার ভেঙে চুরমার করে দিয়ে, সেই চলে গেলো!"
——— "কারা সেই অজ্ঞাত সত্ত্বা?"
মহুয়ার দৃষ্টি অন্ধকারের অন্তঃস্থলে প্রবেশ করল; তার চোখে শিহরণ, কৌতূহলের ছায়ায় আবৃত।
মুগ্ধ গাম্ভীর্যে মুখরিত কণ্ঠস্বর উচ্চারণ করল,
——— "থাকুক সেই অধ্যায় অজানা!! ছিড়ে ফেলেছি সে পৃষ্ঠা! "
মহুয়া ও রুদ্র মুগ্ধের আখ্যানে অভিভূত হলেও বোধের সীমায় তা অধরা রয়ে গেল। শুধু এক অজ্ঞাত বিষাদের ধ্বনি তাদের অন্তরে প্রতিধ্বনিত হলো, যেন কেউ জীবনের অন্তিম সীমায় এসে দুটি হারানো আত্মার গল্প শুনিয়ে গেল। দুজনেই বুঝলো, একজন মৃ'ত্যুর বিধানে মুগ্ধের জীবন থেকে চিরতরে বিলীন, আর অপরজন তাকে নির্দয় প্রান্তরে একা রেখে গিয়েছে। এতটা অভেদ্য, কঠোর মননেও যে নিঃশব্দ বেদনার এমন সূক্ষ্ম নিঃসরণ।
মুগ্ধ দৃঢ়তায় গাড়ির আসনে বসে পাথরের ন্যায় নির্লিপ্ত চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকল। মহুয়া প্রস্থানের আগে লোকলজ্জার তোয়াক্কা না করে রুদ্রের কপালে নিঃশব্দ সান্ত্বনার চুম্বন এঁকে দিয়ে বলল,
——— "সময় সকল ব্যথার মলম, সব ঠিক হয়ে যাবে!"
রুদ্র মহুয়ার মাথায় স্নেহস্পর্শে হাত বুলিয়ে দিলো, তার ভালোবাসার স্পর্শে মৌন আশ্বাসের সুর বাজলো। তখনই মুগ্ধ কঠিন কণ্ঠে ধীর অথচ নিঃশব্দে রুদ্রকে আদেশ দিলো,
——— "কাল থেকে কাজ শুরু করতে হবে! পেশার গণ্ডি ও ব্যক্তিজীবনের সীমানা যেন কখনও মিলেমিশে না যায়!"
রুদ্র গভীর সম্মতির এক মৃদু হাসি হাসলো। মহুয়াকে মুগ্ধই বাড়ি পৌছে দিবে তাই গাড়িতে তার পাশে আসন গ্রহণ করল। রুদ্রকে বিদায় জানিয়ে গাড়ি ছুটে চলল, রাতের বুকে ছায়াময় নিস্তব্ধতায় কিছু না বলা গল্প ছড়িয়ে দিয়ে পথ পাড়ি দিচ্ছে।
মধ্যপথে গাড়ি থামিয়ে মুগ্ধ গম্ভীর স্বরে বলল,
——— "চলো, শপিংমল!"
মহুয়া সম্মতির সূক্ষ্ম মাথা নাড়ে বলল,
-——— "স্যার, আপনি নিশ্চিত? এতে কি রুদ্রের মন সত্যিই ভালো হবে?"
——— "হুম,"
মুগ্ধের কণ্ঠে নিঃসংশয়তার দৃঢ়তা।
কথাগুলি বলেই মুগ্ধ গাড়ির গতি বদলে শপিংমলের দিকে নিয়ে চলল। মহুয়া অবাক হয়ে এক পলক মুগ্ধের দিকে তাকিয়ে থাকল, এই কঠিন, দৃঢ়চিত্তের মানুষ, যার বাইরে থেকে অজেয় পাথরের প্রতিমূর্তি, তিনিই এখন রুদ্রের মন ভালো করার জন্য এমন সাহসী উদ্যোগ নিচ্ছেন! মহুয়া নিজে প্রেমিকা হয়েও সন্দিহান, এই চেষ্টা রুদ্রের মনে প্রশান্তি এনে দেবে কিনা; অথচ মুগ্ধ, রুদ্রের সিনিয়র ইন্সপেক্টর, সেই কঠোর মানুষটিই আজ নিশ্চিত!
মহুয়ার মনে অভাবনীয় মুগ্ধতা ছড়িয়ে গেল, মুগ্ধের অন্তরের কোমলতা তার দৃঢ়তার পাথরচাদরের নিচে লুকানো। কঠোরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সহানুভূতির এই স্পর্শ মুগ্ধকে আরও গভীর করে তুলল মহুয়ার চোখে। কঠিন চেহারার আড়ালে মানুষটি হয়তো এতটা কঠিন নয়; নাহলে জুনিয়রের মন ভালো করতে এমন ঝুঁকি নেওয়ার পরিকল্পনা কি করতেন?
সহকর্মীর আনন্দ-বেদনা, মনোকষ্টের অদৃশ্য আঁধার উপলব্ধি করে পাশে দাঁড়ানোই মানবিক দায়িত্বের চূড়ান্ত প্রতিফলন। যেমন মুগ্ধ, যার কঠোরতা, আপাত নিষ্ঠুরতা, ও অনমনীয়তার খোলসের আড়ালে লুকিয়ে আছে দুঃসহ অতীতের কালিমালিপ্ত অধ্যায়; অন্তরালে জড়িয়ে থাকা অজ্ঞাত কষ্টের শিকল। অভিশপ্ত সেই গ্লানিময় স্মৃতির ভার বহন করেও রুদ্রের জন্য তার অন্তরের অশ্রান্ত তাগিদ, মুগ্ধ আজ স্থিরপ্রতিজ্ঞ, সেই জড়তা পেরিয়ে তার হৃদয় প্রশান্তির ছোঁয়ায় আলোকিত করবে।
এতসব ক্ষুদ্রতর আবেগ, দুর্বিষহ উপলব্ধির বাঁধ ভেঙেই তো প্রকৃত সাহচর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যায়; একে অপরের পাশে নির্দ্বিধায় দাঁড়িয়ে অব্যক্ত বেদনার মলিনতা মুছিয়ে দেওয়াতেই মনুষ্যত্বর প্রকৃত পূর্ণতা।
__________________________
——— " হযরত লুত (আ.) এর জাতি সমকামিতার মতো ঘৃ'ণ্য কাজে লিপ্ত ছিল। তাদের সংশোধনের জন্য আল্লাহ তায়ালা হযরত লুত (আ.) কে প্রেরণ করেন। তিনি হযরত ইবরাহিম (আ.) এর ভাইপো এবং ইরাক থেকে ইব্রাহিম (আ.) এর সাথে বের হয়ে সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও মিশরে দাওয়াতের কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। পরবর্তীতে ট্রান্স জর্ডান এলাকায় এ পথভ্রষ্ট জাতির সংশোধনে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এ জাতির বসতি মৃত সাগরের আশপাশে ছিল, তবে তারা পাপাচারে এতটাই ডুবে গিয়েছিল যে, আল্লাহ তায়ালা তাদের ধ্বং'স করেন এবং এখন মৃ'ত সাগরই তাদের একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে টিকে আছে। আল কুরআনে তাদের অপরাধের বিবরণ উল্লেখ আছে।"
বসে বসে গভীর রাতে না ঘুমিয়ে বিদ্ধস্ত মনে ইসলামি বই পড়ছেন জয়নাল সাহেব। চোখে জল টলমল করছে! তিনি আবারও কুরআনের সেই আয়াত পাঠ করলেন, যেখানে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্টভাবে বলেছেন,
——— 'আর লুতকে আমি পয়গম্বর করে পাঠাই। তারপর স্মরণ করো, যখন সে নিজের সম্প্রদায়ের লোকদের বললো: তোমরা কি এতই নিলর্জ্জ হয়ে গেলে যে, দুনিয়ার ইতিপূর্বে কেউ কখনো করেনি এমন অশ্লীল কাজ করে চলেছো। তোমরা মেয়েদের বাদ দিয়ে পুরুষদের দ্বারা কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করছো? প্রকৃতপক্ষে তোমরা একেবারেই সীমালংঘনকারী গোষ্ঠী। কিন্তু তার সম্প্রদায়ের জওয়াব এ ছাড়া আর কিছুই ছিল না যে, এদেরকে তোমাদের জনপদ থেকে বের করে দাও। এরা বড়ই পবিত্রতার ধ্বজাধারী হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আমি লুতের স্ত্রীকে ছাড়া যে পেছনে অবস্থানকারীদের অনুসারী ছিল তাকে ও তার পরিবার পরিবারবর্গকে উদ্ধার করে নিয়ে আসি। এবং এ সম্প্রদায়ের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করি। তারপর সেই অপরাধীদের কী পরিণতি হয়েছিল দেখো।' (সুরা আরাফ: ৮০-৮৪)।"
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জয়নাল সাহেব! বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে এলো দহনময় হাহাকার। তবে দোষ কার? ছেলের, নাকি তারই? যিনি কখনো ইসলামি প্রজ্ঞার আলোকিত প্রদীপ হাতে তুলে দিতে পারেননি তার সন্তানের মাঝে। সন্তান ছিল মাতৃস্নেহের কোমল স্পর্শে, যাকে রাখা হয়েছিল তুলতুলে কোমলতায়, বালিকার মতো আবেষ্টিত! মাতৃত্বের ছায়ায় আচ্ছাদিত সেই শিশুর মনে ধীরে ধীরে বিকশিত হলো কন্যাসুলভ অনুভূতির প্রতিচ্ছবি। বুকে অগ্নির লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে। পিতার আসনে বসে তিনি নিজেই লজ্জার অন্তরালে আড়াল হতে চান। এ কি তারই ব্যর্থতা, না কি সমাজের সেই ক্ষুদ্র দৃষ্টিভঙ্গির উপহাস, যা সন্তানকে করেছে এমন ভিন্নমুখী অনুভূতির শিকার? পিতৃত্বের অহংকারের আকাশে রক্তিম লজ্জার রক্তবিন্দু ফুটে উঠেছে।
__YouTube
সমকামিতার বিষবাষ্পে আচ্ছাদিত আজ আমাদের সমাজ, আর সেই কলুষিত প্রবাহ যেন অবলীলায় মিশে যাচ্ছে প্রজন্মের ধমনীতে। কোথায় সেই আত্ম-সংবরণ? কোথায় সেই সামাজিক জাগ্রত বিবেক? যেথায় একদা হযরত লুত (আ.) নবি হয়েও নিজের প্রিয়তম সঙ্গিনীকে এ অমার্জনীয় অধঃপতনের কালো মেঘের হাত থেকে বাঁচাতে পারেননি! স্বয়ং নবির স্ত্রীর মতো একজনও রক্ষা পায়নি তার লেলিহান শাস্তির দৃষ্টান্ত থেকে তাহলে আজ আমরা কেমন করে এমন পঙ্কিলতা আমাদের চেতনায় আশ্রয় দিতে পারি?
আজকের তরুণ-তরুণীরা কি জানে এই অশ্লীলতার ফল কী? না, তাদের অধিকাংশই জানে না! তাদের জানা নেই লুত নবির সময়ের নিষ্ঠুর অভিশাপ টুকুর কথা, জানা নেই তার সেই সততার ইতিহাস, যার নির্মম অবমাননা যুগকে ধ্বংসের কোলাহলে ভাসিয়ে দিয়েছিল। আজ তারা যেভাবে মত্ত রয়েছে, ভোগসর্বস্বতা ও বিভ্রান্ত সেলিব্রিটির জীবনচর্চায়, তাতে তাদের জন্য ঐতিহ্য বা ধর্মীয় শৃঙ্খলা কেবলই অন্তঃসারশূন্য শব্দমালা।
তাহলে দোষ কার? কাদের দায়ে এ জাতি এতটা অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো? পিতামাতা? পরিবার? সমাজ? নাকি দেশ? দোষ আমার, হ্যাঁ, এই দায় আমি এড়াবো না। নিজেকে শুদ্ধ না করতে পারলে, সত্য ও ন্যায়াচরণের আলোকে নিজেকে না সাজালে, প্রান্তর মতো আরেকটি নিষ্পাপ প্রাণ ভুল পথে হাঁটবে; তারা নারীত্বের ছদ্মরূপে পরিণত হয়ে প্রিয়া নাম ধারণ করবে। হে সমাজ, হে আত্মা, অভ্যন্তরে রয়ে যাওয়া অন্ধকারের মূল উৎপাটিত করো, নতুবা এ অন্ধকারে প্রতিটি বিবেকের প্রদীপ একদিন নিভে যাবে।
_____________________
শীতের মধ্যরাত্রির নিকষ আঁধারে যখন সকল প্রাণী উষ্ণতার নীড়ে অবগাহিত, গভীর নিদ্রার প্রশান্তিতে ঢলে পড়েছে, তখন শিকদার বাড়ির পেছনের একান্ত নিস্তব্ধতায়, সেই পরিত্যক্ত বাগানবাড়ির আনাচে নাঈম ও শান্ত জাগ্রত। কাঠকুটো পোড়ার সুনসান শিহরণে আগুনের শিখা তাদের শরীরে কিছুক্ষণ উষ্ণতা ছড়িয়ে দিচ্ছে, আর ম'দের গ্লাসে চুমুকের নীরব মাদকতায় তারা রাত্রিকে সাক্ষী রেখে নিভৃত আসরে নিমগ্ন। কনকনে ঠান্ডার বুকে গলিত আগুনের রসে তারা তাদের ভেতরের শীতকে ধীরে ধীরে বিলীন করছে।
তবে নাঈম এই রাত্রির অন্তরালে প্রেয়সী হাওয়ার সাথে টাইপিংয়ের গূঢ় খেলায় মত্ত। প্রতিটি মেসেজ তার মুখে অনির্বচনীয় মৃদু হাসির অনুরণন ছড়িয়ে দিচ্ছে; এ যেন তার অস্তিত্বের এক প্রগাঢ় উষ্ণতার স্পর্শ।
এদিকে শান্ত ক্রমাগত বিরক্ত হচ্ছে নাঈমের এই প্রেমালাপে; এমন সুন্দর রাতের নীরবতা ভঙ্গ করে প্রেমে লিপ্ত হওয়া যেন তার কাছে অশোভন।
শান্তের ক্রমাগত বিরক্তি একসময়ে উদ্দাম হয়ে উঠল; নাঈমের হাত থেকে ফোনটি কেড়ে নিয়ে সে ক্রুদ্ধ অন্ধকারের ঝোপে ছুঁড়ে দিলো, রাত্রির নিষ্ঠুরতা কোনো প্রতিবন্ধকতাহীন কালো ধোঁয়ার মধ্যে এক নতুন স্রোত আনল। বিস্মিত নাঈমের দৃষ্টি তৎক্ষণাৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠল; ধিক্কার প্রকাশ্যে চিৎকার করে বলল,
——— "তুই আমার ফোন ছুঁড়ে ফেললি কেন? দেখিস না কাজে লিপ্ত ছিলাম!"
শান্ত ততোধিক বিরক্তির ভারে ঠোঁট কোঁচকালো, এক চুমুকে মদের গ্লাস খালি করে উচ্চারণ করল,
———" দেখছি তো, কী অকর্মণ্যতা নিয়ে মত্ত হয়ে আছিস!"
নাঈম বিরক্তি সংযত করে, কাঠে প্রজ্জ্বলিত শিখাটি হাতে তুলে অন্ধকার ঝোপের গভীরে প্রবেশ করল। ছায়ার কোল ঘেঁষে ফোনটি খুঁজে পেল, আলতো হাতে তুলে নিলো। প্রেয়সী হাওয়াকে নিদ্রার জন্য নির্দেশ দিয়ে ফোনটি পকেটে স্থাপন করল সে।
পুনরায় শান্তর পাশে বসে, জলন্ত কাঠটি নিঃশব্দে আগুনের আবরণে স্থাপন করল; নিজের ক্রোধের শিখাকে সেই আগুনে সমর্পণ করল, নিশীথ রাতের গহনে নিজের অনুভূতি নির্লিপ্ত ও নির্বাক করে রেখে।
শান্ত তীব্র বিদ্রূপের হাসি হেসে বলল,
——— "কী রে, তোর কি কোনোদিন শিক্ষা হবে না? একবার সেই শঠতায় ক্ষতবিক্ষত হলি, তবু আবার মায়ার জালে আচ্ছন্ন হয়ে প্রেমে নিমজ্জিত হয়েছিস তো ঠিক আছে তবে এত বিশ্বাস করছিস কেন?"
নাঈম কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
——— "চুপ কর! হাওয়া আমার বিশ্বাস নিয়ে কখনো ছলনা করবে না! তুই কীভাবে তার তুলনা সেই প্রতারকের সাথে করতে পারিস?"
শান্ত বিদ্রূপমাখা স্বরে বলল,
———" আহা, ভাই! প্রেমে এমন অন্ধ হয়ে পড়েছিস যে বুদ্ধির আলোকও ক্ষীণ হয়েছে তোর। সময়ের ব্যবধান কিছুই মাত্র; আজ হোক আর কাল, হাওয়াও তোর বিশ্বাসকে এমনভাবে ভাঙবে যেন তা কখনো ছিলই না।"
-———"এই চুপ কর তো!"
নাঈম ক্ষোভে বলল। শান্ত হাসির ঢেউয়ে ভেসে বলল, "
--——— "হাহাহা! আমি কি ভুলেছি কেমন করে সেই ছলনায় মগ্ন এক ছায়ামূর্তি তোর সবকিছু কেড়ে নিয়ে তোকে আমার বিরুদ্ধেই উসকে দিয়েছিল? তখন তুই আমার প্রতি যে অবিশ্বাসের শিলাস্তূপ ফেলেছিলি, সেই স্মৃতি আমার মনে এখনও অম্লান। ভাই নামে কলঙ্ক তুই!"
নাঈম ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,
———"শোন, তুই এমন সব কাজ করেছিলি, যা আমার রাগের আগুনকেই আরো প্রজ্জ্বলিত করেছে! সেই অন্ধকারময় মুহূর্তে আগুনে ঘি ঢেলে আমার কানে বিষ ঢেলে আমায় তোর বিরুদ্ধে বিষিয়ে তুলেছিল, বোকা বানিয়েছিল!"
শান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
——— "কী করেছিলাম?"
নাঈম বিরক্তি মিশ্রিত উত্তেজনায় বলল,
——— "আবার জিজ্ঞেস করছিস? আঁখির হাতে মৌমাছির হুল ফোটানোর সেই নির্মম ছলনা, তার ঘরে পুতুল রেখে তাতে কৌশলে ক্যামেরা স্থাপন করেছিলি! তুই কি আমাকে এসব জানিয়েছিলি? কেন করেছিলি এমন গোপনে?"
শান্ত এক তীব্র বিদ্রূপের হাসি হেসে বলল,
———"আহা, মূর্খ! মৌমাছির সেই আক্রমণ তো আমার ওই বাপের জন্য ছিল। আর ক্যামেরা? তা তো ইচ্ছাকৃতই ছিল। আমার সন্দেহের ছায়া ঘনিয়ে উঠেছিল দু'জনের উপর, এক তুই, আরেক সেই চাতুর্যপূর্ণ ইয়াসিন। তাই এক দুর্দান্ত কৌশলে আমি এ ফাঁদ পেতেছিলাম! পরবর্তীতে যা দেখি, তুই আর ইয়াসিন দুজনেই সেই অন্ধকার ষড়যন্ত্রে, সেই প্রবঞ্চকের সাথে আমার পিঠ পেছনে ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছিস! কী ভেবেছিলি, আমি কখনো জানতে পারব না?"
শান্ত তীক্ষ্ণ হাসির আভায় বলল,
——— "সেই পুতুলটিও তুই নিজেই সরিয়েছিস! আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে গেলাম যখন আঁখি জানাল যে সে ওই পুতুলটির কোনো খবরই জানে না!"
নাঈম ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,
——— "কী করতাম?!"
শান্ত গভীর বিদ্রূপে মাথা নেড়ে বলল,
——— "আমি যা করতাম, তুইও ঠিক তা-ই করেছিস! এমন ছলনার জন্য কি আমাকেই পেলি তুই? অন্তত একবার তো আমার সঙ্গে কথাটা বলা উচিত ছিল তোর! এখন বুঝলি তো, জীবনে ভুলের মাশুল কীভাবে দিতে হয়? যা, ভাইয়ের পিঠে ছুরি মেরে যা খুশি কর, আরো আমায় ফেলে অন্যকে বিশ্বাস করে বোকা হ!"
বলেই ফিক করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল শান্ত। নাঈম ক্রুদ্ধ সুরে বলল,
——— "চুপ কর! আমি আগেই এই সব ঝামেলা তোর সাথে মিটমাট করে নিয়েছি, আর এ নিয়ে আর কথা শোনা আমার সহ্য হয় না! বিরক্ত লাগে তো!"
শান্ত কৌতুকমাখা কণ্ঠে বলল,
———— "কেন, এবার সুযোগ দিচ্ছিস না নাকি আঁখির সাথে কথোপকথনের?"
নাঈম দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
————" জীবনে না! ওকে বিশ্বাস করতে পারি না আমি! ওকে আমার ঠিক লাগে না! "
শান্ত বিদ্রূপের স্বরে বলল,
———— "কেন? সিআইডি বলে? আচ্ছা, ধরলাম, সে তার পরিচয়ের একখণ্ড লুকিয়েছে। তবে তার বলা প্রতিটি বাক্যই কি মিথ্যে ছিল?"
নাঈম কিছুটা স্থির হয়ে, গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে বলল,
———— "না, শুধু সিআইডি পরিচয়ই গোপন করেছে সে... বাকিসব....তার অনুভূতির প্রতিটি কণিকায় মিথ্যার ছায়া খুঁজে পাইনি। তবুও, কেন সে তা জানালো না? কেন লুকালো? হুঁ!"
শান্ত বিরক্তি মাখা কণ্ঠে বলল,
——— "এহ, হয়েছে! বাদ দে তো এখন ওর কথা! কিন্তু ওর সাথে আমার হিসেব এখনও বাকি! যেভাবে সে আমায় অপদস্ত করেছে, প্রতিশোধ ছাড়া সেই ঋণ শোধ হবে না!"
নাঈম নিঃস্পৃহভাবে উত্তর দিল,
——— "তুই করবিই বা কী? সে তো সিআইডির ছায়ায় ঢাকা!"
শান্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
——— " চুপ কর! সুযোগের অপেক্ষায় আছি কেবল। একবার তাকে হাতে পাই, তখনই বুঝে যাবে, শান্তর সাথে সংঘাতের পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে!"
ক্রোধে ঠোঁট কামড়ে, শক্ত হাতে মদের কাঁচের গ্লাসটি মাটিতে আছড়ে ভাঙল শান্ত, যেন সেই গ্লাসের টুকরোই তার তীব্র প্রতিশোধের অভিব্যক্তি।
--
শীতের নিস্তব্ধ রাতে, কনকনে হিমে আচ্ছন্ন শিকদার বাড়ির বিস্তৃত ছাদে এক কালো ছায়ার প্রতিমূর্তি হয়ে বসে আছে আঁখি, কালো সিল্কের গাউন শরীরে, নিস্পৃহ ভঙ্গিতে মোটা রেলিঙে পা ঝুলিয়ে। শিরা-উপশিরায় ভয় তার অস্তিত্ব থেকে মুছে গেছে। জ্যোৎস্নায় উদ্ভাসিত তার শ্যামল জোড়া চোখ, গহীন অন্ধকারে এক অশরীরী দৃষ্টির প্রজ্জ্বলন!
তার বাজ পাখির মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ঝাঁপিয়ে পড়েছে দূরবর্তী বাগানবাড়ির দিকে, যেখানে তার দুই ভাই শান্ত ও নাঈম আগুনের তাপ নিচ্ছে, আগুনের ক্ষীণ শিখায় জীবনের উষ্ণতা খুঁজে পাচ্ছে। কিন্তু আঁখির উচ্চতম অবস্থান থেকে, ভগ্ন আলোয় তাদের অবয়ব অস্পষ্ট, কেবল নিকষ আঁধারে ক্ষীণ আলোর স্পন্দনটুকুই চোখে পড়ছে। ঝোপ-ঝাড়ের ফাঁকে সেই আগুনের আলো রহস্যময় আভাস দেয়, অথচ কাছের নয়, এ এক অজ্ঞাত রহস্যের স্রোত, যেখানে আঁখি ছায়ামূর্তির মতো বসে পরিকল্পনায় নিঃশব্দে নিজের ভাগ্যের মোড়লেখার অপেক্ষায়।
হঠাৎ করেই ছাদের মোটা রেলিঙের উপর নীরব পদক্ষেপে শুয়ে পড়ল আঁখি, মৃ'ত্যুর চূড়ান্ত প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে ঝুঁকে আছে এক আকস্মিক অথচ অদম্য ইচ্ছায়। সামান্য এদিক-ওদিক হলেই মহাশূন্যে ধাবিত হবে তার শূন্য দেহ, যেখানে শুধু নিশ্বাসের শেষ আওয়াজটুকু তার সঙ্গী। কালো সিল্কের গাউনটির প্রান্ত রেলিঙের ধার বেয়ে ঢেউ খেলছে, বোধহয় কোনো অলৌকিক আত্মার আবির্ভাব ঘটছে সেই আঁধারে। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ আকাশের সীমাহীন অতলে, এক বিদ্রূপাত্মক হাসির আভাস তার ঠোঁটের কোণে খেলে যাচ্ছে,
——— "বাবা!"
স্বর গভীর নৈঃশব্দ্যে প্রতিধ্বনিত হয়, মহাবিশ্বের আদি সুরে লিপ্ত এক নিবেদন,
———"তোমার মেয়ের বুকে চাপা রয়েছে অনেক ব্যথা, অনেক গল্প। একদিন তোমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে সব বলব, সবটুকু শুনাবো!"
0 Comments