লেখিকাঃ তাবাসসুম কথা
"আমি আপনাকে বিয়ে করার জন্য রাজি।"
ব্যালকনির রেলিং এর কার্নিশ ঘেসে দাঁড়িয়ে আছে তুর্য। এক হাতে কফি মগ, আর এক হাত দিয়ে কপালে স্লাইড করতে করতে একটু পর পর কফিতে চুমুক দিচ্ছে। এটা তুর্যর প্রতিদিনের রুটিন।
কফিতে চুমুক দিতে দিতে ব্যালকনি থেকে বাইরের দৃশ্য দেখতে অজানা এক তৃপ্তি পায় সে
হঠাৎ হীর এর মুখ থেকে এমন কথা শুনে বেশ অবাক হলো সে।
" আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি। কাল রাতের ঘটনার পর এখন মনে হচ্ছে এটা করাই ঠিক হবে " -- হীর।
--- ওই প্রস্তাবের মেয়াদ শেষ।
--- মানে।
--- মানে হলো এই, কাল যখন তোকে আমি প্রস্তাব দিয়াছিলাম তখন তো মানা করে দিয়েছিলি তাই এখন আমি মানা করে দিচ্ছি।
--- এটা কি খেলা চলছে?
--- খেলা চলছে না, তুই তোর ইগোর জন্য মানা করেছিস ইগো আমারো আছে।
--- আপনি সত্যিই একটা পাগল। এটা তাফসির জীবন মরণ এর প্রশ্ন আর আপনি পরে আছেন আপনার ইগো নিয়ে। কী মানুষ রে বাবা!
-- তুর্য চৌধুরীর তোর জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। ঘন্টা দুয়েক পর কালকের জায়গায় পৌঁছে গেলেই হবে।
তুর্য অপর দিকে ফিরে পুনরায় কফি তে মনোযোগ দিলো। হীরের মাথায় উদ্ভট সব চিন্তা ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে।
-- আচ্ছা সত্যিকারে বিয়ে না করে মিছে মিছে বিয়ের নাটক করলে হবে না!
তুর্য ভ্রুঁ কুচকে হীর কে দেখছে।
-- ওভাবে কি দেখছেন?
-- দেখছি তুই পাগলাগারদ থেকে পালানোর পর থেকে একটু বুদ্ধিমতি হয়ে গিয়েছিস।
হীর এই কথার আগা মাথা কিছুই বুঝলো না। কিন্তু মনে হচ্ছে তুর্য তাকে উপহাস করেছে।
-- হয়েছে হয়েছে! এতো ঢঙ দেখানোর কি আছে! আইডিয়া পছন্দ হয় নি বললেই হতো! আসবো আমি হুহ!
হীর চলে গেলে তুর্য আবার কফিতে চুমুক বসায়। দিনের শুরুটা হীর কে দেখে হলে দিনটা বেশ ভালো যায় তার।।
পার্পল কালারের একটা চুড়িদার পরে কাজী অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে হীর। মিনিট পাঁচেক আগেই এসেছে সে। হাতে দুই-চার জোড়া চুরি আর খোলা চুল। এতোটা সাধারণ সাজে কোনো কনে কে সচরাচর দেখা যায় না।
তুর্য এখনও আসে নি। এই প্রথম তুর্য কোনো জায়গায় লেইট। "এমনিতে এতো পাংচুয়াল কিন্তু আজ লেইট!" ভাবতে থাকে হীর। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হয় তুর্য আসবে না। হীর এর বুকটা আচমকা ছ্যাঁত করে উঠে। সত্যি যদি তুর্য না আসে! তুর্য তাকে না ভালোবাসলেও তুর্যর প্রতি তার ভালোবাসায় কোনো খাঁদ নেই। এই সাজানো বিয়ের মাধ্যমে হলেও সে খানিকটা সময় পাবে তুর্যর পাশে থাকার। কিন্তু সে যদি মত পাল্টে ফেলে!
হীর এর ভাবনায় ছেদ পরলো গাড়ির ব্রেকের শব্দে। তুর্য এসেছে। না চাইতেও হীর এর মুখে প্রশান্তির ছাপ ফুটে উঠেছে।
তুর্যর পরনে একটা সাদা শার্ট, হাতা দুটো ফোল্ড করে কুনুই পর্যন্ত উঠানো। গাড়ির সামনে থেকে হীর এর কাছ অব্দি আসা পর্যন্ত হীর একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। চোখের সানগ্লাস টা খুলে হাতে নিয়ে হীর এর হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিলো সে।
-- এতে কি আছে?
-- শাড়ি আর কিছু এক্সেসরিজ।
-- কিন্তু কেনো? কার এগুলা?
-- ঐ যে পাশে বেঞ্চিতে যেই আঙ্কেল বসে আছেন! দেখতে পাচ্ছিস?
-- হ্যাঁ হ্যাঁ!
-- এটা তাকে দিয়ে বল তুর্য পাঠিয়েছে,, এটা পরে বউ সেজে আসুন দ্রুত,, আজ আপনার আর তুর্যর বিয়ে। তুর্য অপেক্ষা করছে!
তুর্যর কথার অর্থ খুব ভালোই বুঝতে পারছে হীর। ভয়ে বড়সড় একটা ঢোক গিলে ব্যাগটা হাতে নিয়ে কেটে পরলো।
"না মানে সত্যি! সবসময় এমন ভয় দেখানো কি খুব প্রয়োজন? আমার মতো একটা ইনোসেন্ট পিচ্ছিকে এভাবে টর্চার করে কেনো যমরাজ টা! যমরাজ! হ্যাঁ যমরাজ! আস্ত একটা পচা। ভাগ্যিস কাজী অফিসে ওয়াশরুম ছিল নয়তো নির্ঘাত আমি মারা পরতাম।"
বিরবির করতে করতে কিছু সময় পর তৈরি হয়ে গেলো হীর।
লাল শিফন শাড়িটা বেশ পছন্দ হয়েছে তার। সেই সাথে কিছু ব্যাঙ্গলস্ আর এক জোড়া জরোয়া ঝুমকো। এক্সট্রা লাল ওড়না টা মাথায় পরে নিজেকে একবার আয়নায় দেখলো হীর। সম্পূর্ণ না হলেও অনেক টা নতুন বউয়ের মতো লাগছে তাকে। এই দিনটার স্বপ্ন ছোট থেকে দেখে এসেছে সে। আজ হয়তো পূর্ণতা পেতে চলেছে তার স্বপ্ন!
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে হীর এর চোখ কপালে। ইয়া বিশাল লাইন ওয়াশরুমের বাইরে। লেডিস ওয়াশরুম হওয়ায় সব মহিলা রা দাঁড়িয়ে আছে। সবাই রাগী চোখে দেখছে হীর কে। প্রায় ৩০ মিনিট সময় ধরে সে ভিতরে ছিল। নিজের আটাশ খানা দাঁত প্রদর্শনী করে সেখান থেকে ছুটলো সে।
-- খুব জোর বেঁচেছি বাবা!
-- এতো দেরি করে কেউ! আধা ঘন্টা যাবত দাঁড়িয়ে আ...
হীর কে দেখে আর কোনো শব্দ তুর্যর মুখ থেকে বের হলো না। তুর্য চেয়েছিল খুব করে বকে দিতে। কিন্তু এখানে সে নিজেই বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। লোকে বলে, "একটা মেয়েকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর তার বিয়ের সাজে লাগে।" কথাটা হয়তো হীরের জন্যই বলা হয়েছিল। আহামরি কোনো সাজ না থাকার পরেও কোনো অপ্সরীর থেকে কম লাগছে না তাকে। তুর্যর ইচ্ছে করছে এই অপ্সরী কে দুনিয়া থেকে লুকিয়ে নিজের মনের স্বর্গে রাখতে। তুর্য অপলক তাকিয়ে আছে হীর এর কাজল কালো চোখের দিকে। তুর্যর এভাবে তাকিয়ে থাকা হীর কে বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে।
.
বড় আম্মু, বড় আব্বু আর তাফসির সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। আমার পাশে তুর্য দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে লাল শাড়িতে, তাও আবার তুর্যর সাথে দেখে, বড় আম্মুর চোখ দুটো মনে হচ্ছে কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে এখুনি।সবাই প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। আসলে কিভাবে রিয়েক্ট করা উচিত সেটা তারা বুঝতে পারছে না। পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে পুরো বাড়ি জুড়ে। মনে হচ্ছে ঝড়ের পূর্বের শান্ত আবহাওয়া এটা।
"আমি আর হীর বিয়ে করে নিয়েছি।"-
নীরবতা ভেঙে শীতল গলায় বললেন তুর্য।
তুর্যর কথাটা শুনে মনে হলো বোমা ফাটানো হয়েছে। এখনি এর আফ্টার এফেক্ট দেখা দেবে।
-- তোমরা কিছু বলছো না যে!(তুর্য)
তমা বেগম অবিশ্বাসের সুরে এগিয়ে এলেন তুর্যর দিকে।
-- তুই এটা করতে পারিস না তুর্য। বল তুই মজা করছিস!
-- আমি মজা করছি না আম্মু। আর যতোদূর বুঝি এটা মজা করার মতো বিষয় নয়।
-- আমি এটা মানতেই পারছি না। শেষমেশ তুইও! একটা কাজের মেয়ে কে বিয়ে করে নিয়ে এলি!
-- আম্মু হীর কাজের মেয়ে না। আমাদের মতোই এই বাড়ির একজন সদস্য সে। আব্বু হীর কে মেয়ে বানিয়েই এনেছিল এ বাড়িতে। তাই ওকে কাজের লোক বলাটা তোমার ভুল হচ্ছে।
-- ঠিক আছে মানছি হীর কাজের লোক নয় কিন্তু রায়ানের সাথে যে মুখে কলঙ্ক মিশিয়েছে সেটাও কি অস্বীকার করবি?
-- ওসব কিছু মিথ্যে আম্মু। হীর আর রায়ানের কোনো সম্পর্ক নেই। যা কিছু হয়েছে সব রায়ানের সাজানো।
-- তুই এতো শিউর হয়ে কিভাবে বলছিস!
-- কারণ হীর এর সম্পর্ক আমার সাথে! হীর আমাকে ভালোবাসে! আর আমি হীর কে।
তুর্যর কথা শুনে আমি নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছি না। তুর্য কিভাবে জানলেন আমি তাকে ভালোবাসি? আচ্ছা সত্যি কি তুর্য আমাকে ভালোবাসে!
-- তুই মিথ্যে বলছিস। এই মেয়েটার কুকীর্তি লুকানোর জন্য এসব বলছিস। তোর থেকে আমি এটা কখনও আশা করি নি তুর্য। তুই আমার গর্ব ছিলি,, আর সেই তুই কি না আমার সব আশায় পানি ঢেলে দিলি।
-- আম্মু, আমি জানি তুমি কষ্ট পেয়েছো এভাবে বিয়ে করাতে কিন্তু বিশ্বাস করো আমি যা করেছি ভেবে চিন্তেই করেছি। আর তার থেকে বড় কথা হীর তোমাদের সবার পরিচিত।
তুর্য কে বলে কোনো লাভ না হলে তমা বেগম হীরের কাছে গিয়ে তার দুই বাহু কে গিয়ে চেপে ধরে।
-- কি জাদু করেছিস আমার ছেলেকে? এতোকিছু নিজের চোখে দেখার পরও তোর কথাতেই বিশ্বাস করলো! আমার ছেলের জীবন নষ্ট করার আগে একবারও ভাবলি না! তুই নিজে তো একটা নষ্ট। আমার মেয়ের জীবনের সব সুখ খেয়েছিস এখন আমার ছেলেকে ধরেছিস। এটা বোধহয় তোর বড় আব্বুর পাপের ফল,, যেই পাপ সে তোকে আমাদের পরিবারে এনে করেছিল।
বড় আম্মুর কথাগুলো আমার বুকে তীরের মতো বিঁধে যাচ্ছে। সত্যি বোধহয় অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি বিয়ে টা করে!
0 Comments