লেখিকাঃ তাবাসসুম কথা
"এনাফ আম্মু। তোমার রাগ আমি মানছি কিন্তু তুমি হীরকে এভাবে অপমান করতে পারো না।"
তমা বেগম কে উদ্দেশ্য করে তুর্য কথাটা বললে থমকে যায় তমা বেগম। কলিজার টুকরা ছেলের মুখ থেকে এই কথা শুনতে হবে কখনও এটা তার কল্পনার বাইরে ছিল।
-- তুই এই মেয়েটার জন্য তোর মা কে অপমান করছিস!
-- আমি তোমাকে অপমান করছি না আম্মু। শুধু হীর কে তার প্রাপ্য সম্মান টুকু দিচ্ছি। হীর আমার বিবাহিতা স্ত্রী। এই চৌধুরী বংশের একমাত্র পুত্রবধূ। এ বাড়িতে তোমার যতোটা সম্মান আছে আজকের পর থেকে হীর ও সেই একই সম্মানের অধিকারী।
তমা বেগম আর কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে নিজের ঘরে চলে গেলেন। তুর্যর সাথে আর কথা বলে কোনো লাভ হবে না সেটা সে ভালোই বুঝতে পারছে। আফজাল সাহেবের এই বিয়ে তে কোনো আপত্তি নেই। হীর কে সে নিজের মেয়ের মতোই দেখেন। পারিপার্শিক পরিস্থিতি যেমনি হোক না কেন সম্পর্ক এতো দ্রুত রূপ বদলায় না!
তবে এই পুরো ঘটনার একমাত্র নিরব দর্শক ছিল তাফসি। এতোটাই শান্ত চোখে সে এসব দেখছিল যেনো মনে হচ্ছে সে আগে থেকেই সবটা জানে!
"যাকে দেখানোর জন্য এতোকিছু করলাম সে তো কোনো রিয়েক্ট ই করলো না! ধূর ছাই! যা ই করি উল্টোই হয়!"
কথাগুলো বির বির করছিলাম হঠাত্ তুর্য পিছন থেকে মাথায় চাঁটি মারলেন।
-- তোর কি সত্যি মাথায় সমস্যা আছে?
-- অ্যা?
-- আবার বলে অ্যা!
-- মানে?
-- একা একা বিরবির করছিস কেনো?
-- কোই না তো!
তুর্য ল্যাপটপ নিয়ে বসে তার কাজে মনোযোগ দিলেন। এদিকে আমি ভাবছি অন্য কথা। বিয়ে তো হলো, এখন যদি তুর্য তার স্বামীর অধিকার চেয়ে বসে! না, না! এটা কিছুতেই হবে না। আমি হতেই দেবো না ওসব। কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কি?
তুর্য ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে হীর কে দেখছে। রুমের একদিক থেকে অন্য দিকে পায়চারি করছে। শাড়ির কুঁচি হাটু অব্দি তুলে ধরে রেখেছে। মাথায় দেওয়া এক্সট্রা ওড়না টা খুলে কাঁধে পরে রয়েছে। গভীর চিন্তায় মগ্ন আছে সে, সে তুর্যর আর বুঝতে বাকি নেই।
-- হোয়াট আর ইউ ডুয়িং? স্টপ দিস। ইউ আর ইরিটেটিং মি নাও।
শাড়ির কুঁচি ছেড়ে দিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পরলাম। প্রশ্ন টা করা প্রয়োজন কিন্তু সাহস পাচ্ছি না।
আমার মৌনতা দেখে তুর্য নিজেই প্রশ্ন শুরু করলেন।
-- কি ভাবছিস এতো!
-- কিছু না। আপনি কাজ করুন।
-- বাই এনি চান্স, তুই বাসর পালন করতে চাস না তো! যেটা লজ্জায় বলতে পারছিস না?
তুর্যর কথা শুনে আমার চোখ কপালে। কি বলছে লোকটা!
-- বাসর! তাও আবার আমি! হা হা হা। নাইস জোক।
তুর্য ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। উনার দৃষ্টি আমাকে আরও বিব্রত করে তুলছে।
-- ওভাবে কি দেখছেন? আরেহ বাবা আমি কেনো বাসর করতে চাইবো? আপনি বারবার বললেই তো আর আমি পাগল হয়ে যাবো না। তাই না! কোনো পাগলই আপনার সাথে বাসর করতে চাইবে।
তুর্য ল্যাপটপ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। উনি এক পা এক পা করে এগোচ্ছেন আর আমি এক পা এক পা পিছাচ্ছি। পিছুতে পিছুতে আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে কিন্তু তুর্য আমার দিকেই আসছেন। হঠাত্ করেই আমার হৃত্স্পন্দন বাড়তে শুরু করেছে। এতো দ্রুত হার্টবিট উঠা নামা করছে যে সেই শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি। তুর্য একদম আমার মুখ বরাবর এসে পরেছেন। এখন আর উনাকে ভয় করছে না। এখন ভয় হচ্ছে যদি আমার হৃত্স্পন্দন এর তীব্র শব্দ তুর্য শুনে ফেলে! আমি আর তার চোখে দেখতে পারবো না... বাম হাতে বুকের পাশটা জোরে চেপে ধরে আছি, যেনো সে শব্দ শুনতে না পারে।
-- এতো অ্যাবনর্মাল বিহেভ করছিস কেনো?
-- কোথায় অ্যাবনর্মাল বিহেভ করছি? আমি ঠিক আছি।
-- ইয়া রাইট। সেটা তোকে দেখেই বুঝতে পারছি।
তুর্য ধীরে ধীরে আমার আরও কাছে আসছেন। এদিকে আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। এসি রুম তবুও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। হাত পা ও কাঁপছে। কি মুশকিল! একবার মাত্র তুর্য আমার কাছে আসছেন তাই আমার এই অবস্থা,, আর এখন থেকে তো রোজই আমার উনার সাথে থাকতে হবে! তখন আমার কি হবে! তুর্যর ঠোঁট জোড়া আমার ঠোঁটের ঠিক সামনে। সর্বোচ্চ এক ইঞ্চি দুরত্ব রয়েছে আমাদের মাঝে। উনার উষ্ণ নিশ্বাস আমার চোখে মুখে আছড়ে পরছে। নিজেকে কেমন মাতাল মাতাল লাগছে। আমার কিছু বুঝে উঠার আগেই তুর্য তার ঠোঁটদ্বয় আমার ঠোঁটে চেপে ধরলেন। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। ঠিক সেটাই হলো যেটার ভয় আমি পাচ্ছিলাম।
তুর্য আমাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে মনের সুখে নিজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বুঝে উঠতে পারছি না কি করবো। কিছু না ভেবেই নিজের সব শক্তি দিয়ে তুর্য কে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দিলাম। ধাক্কা টা মনে হয় বেশ জোরে হয়ে গেছে।
টাল সামলাতে না পেরে তুর্য মেঝেতে পরে যায়।এবার আর রক্ষে নেই। নির্ঘাত মারা পরবো।তুর্য রক্ত চক্ষু নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে আজকে আমাকে পুরিয়ে মারবেন। ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছি। কিন্তু না। ভয় পেলে আরও ভয় দেখাবেন। আমাকে শক্ত থাকতে হবে।
-- হোয়াটস্ রঙ ওইথ ইউ? আর ইউ ম্যাড অর হোয়াট?
-- আপনি আমাকে এইভাবে স্পর্শ করতে পারেন না। ভুলে যাবেন না এই বিয়ের শর্ত। আপনার আর আমার মধ্যে কোনো ভালোবাসার সম্পর্ক নেই যে আপনি স্বামী হওয়ার অধিকার নিতে আসবেন। এই ঘরে আপনি আপনার মতো থাকবেন আর আমি আমার মতো। কেউ কারো ওপর অধিকার ফলাতে যাবো না। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।
তুর্যর স্বাভাবিক চেহারা ক্রমশ শক্ত হতে থাকে। মুহূর্তেই রাগে লাল হয়ে যায় সে। বোঝাই যাচ্ছে সে বেজায় রেগে আছে। দু হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে সে। তুর্যর জীবনে রিজেকশন সে খুব কমই ফেস করেছে। কিন্তু আজ কাছের মানুষের থেকে পাওয়া রিজেকশন মানা তার পক্ষে ভীষণ কঠিন। সে হীর কে ইচ্ছে করে কষ্ট দিতে চায় না কিন্তু তার আত্মসম্মান টাও তার কাছে অনেক বড় কিছু। চোখ দুটো নিচে নামিয়ে নেয় তুর্য। সে তার ভালোবাসার মানুষটিকে তার এই অমানবিক রাগ দেখাতে চায় না।
আলমিরা থেকে কাপড় বের করে ওয়াশরুমে চলে যায় সে।
'তুর্য কিছু না বলেই চলে গেলেন! আমি বেঁচে গেছি! নিশ্চয়ই তুর্য আমাকে ভয় পেয়েছেন! আমিও শক্তিশালী হয়ে গেছি!'
হীর একটা বিজয়ী হাসি দিয়ে বেডের এক কোনায় শুয়ে পরে। ভীষণ ক্লান্ত থাকায় কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে পড়ে।
.
ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছে আমি হাওয়ায় ভাসছি। এই ধরনের স্বপ্ন আমি প্রায়ই দেখি। কিন্তু আজকের টা একটু ভিন্ন ধরনের। মনে হচ্ছে কেউ আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরছে। হঠাত্ কেউ নিচে ফেলে দিলে ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠলাম। এবার ঘুম পুরোপুরি ছুটে গেছে। স্বপ্ন নয় বাস্তবেই আমাকে কোল থেকে নিচে ফেলে দিয়েছেন তুর্য!
-- আপনি কেমন মানুষ হ্যাঁ? একটা ঘুমন্ত বাচ্চা কে কেউ এভাবে উঠিয়ে ফেলে দেয়?
-- ওয়েট আ মিনিট! এখানে বাচ্চা কে?
-- আমি!
-- নাইস জোক। বাই দ্য ওয়ে ওটা কাউচ। এখানে পরে এমনও কোনো আহামরি ব্যথা পাবে না।
ভালো মতো লক্ষ্য করে দেখলাম, সত্যি কাউচে ফেলেছেন।
-- কোথায় ফেলেছেন এটা প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হলো কেনো ফেলেছেন? আমি ঘুমিয়েছিলাম!
-- আমার বেডে তুমি শোবে না। যেহেতু আমাদের মধ্যে স্বামী স্ত্রীর কোনো সম্পর্ক নেই সেহেতু আমার সাথে এক বিছানায় তুমি শুতে পারবে না।
রাগে আমার নিজের চুল নিজরই ছিড়তে ইচ্ছে করছে। আস্ত একটা যমরাজ এই লোকটা। কিন্তু আমার ঘুম আমি এই লোকের জন্য নষ্ট করবো না।
হীর বালিশ নিয়ে উল্টো দিক ফিরে আবার ঘুমিয়ে পরলো। তুর্য বিছানায় বসে এক দৃষ্টিতে হীর কে দেখছে। অনেক কথা জমে আছে তার মনে। ইচ্ছে ছিল আজ রাতটা তার মনের সব কথা হীর কে বলে পার করবে। কিন্তু হীর যে তাকে সহ্য করতে পারে না এটা তার ধারণার বাইরে ছিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিলো তুর্য। পাশেই গিটার টা পরে আছে। বহুদিন হয়ে যায় গিটারে কোনো সুর তোলা হয় না।
সিগারেট জ্বালিয়ে এক টান দিতেই হীর এর দিকে ফিরে তাকায় তুর্য। তবে এবার সিগারেট টা না ফেলে অ্যাশট্রে তে রেখে গিটার কাঁধে নেয়। হীর ঘুমিয়ে আছে। ব্যালকনির কাচ খোলা থাকায় বাতাস এসে হীরের চুল গুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে। এই সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য প্রতিনিয়ত ছটফট করেছে সে। কিন্তু আজ কেমন তিক্ত লাগছে সব। অপর দিকে ফিরে সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে আগের স্থানে রেখে দিলো সিগারেট টা।
.....
এই চেনা শহর, চেনা সময়
সময় গড়ালে অচেনাও হয়
এই তোমায় নিয়ে আমি ভাবি
তোমায় অনেক চিনে ফেলেছি
আসলে কি করেছি?
তোমায় আমি চিনি না, আবার বোধ হয় চিনি
তোমায় আমি চিনি না, আবার বোধ হয় চিনি..
....
তুর্যর গানের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। তুর্য কে এর আগে কখনও গান গাইতে শুনি নি। তার গাওয়া গানটা আগেও শুনেছি তবে তার কন্ঠে গানটা যেনো জীবন পেয়েছে। প্রতিটা কথা আমার বুকে এসে বিধছে।
....
এই ভালোবাসা দিলাম তোমায়
কিন্তু একটা কিন্তু থেকেই যায়
যখন দূরে দূরে থাকো তুমি
তখন অনেক ভালোবেসে ফেলি, হায়!
আসলে কি বেসেছি?
তোমায় ভালোবাসি না, আবার বোধ হয় বাসি
তোমায় ভালোবাসি না, আবার বোধ হয় বাসি
তোমায় ভালোবাসি না, আবার বোধ হয় বাসি
তোমায় ভালোবাসি না, আবার বোধ হয় বাসি!!!
....Facebook
গিটারের প্রতিটা সুর যেনো আমার বুকে রক্ত ঝরাচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে গানের কথাগুলো তুর্যর মুখ থেকে শুনতে। আচ্ছা আমার মনের যেই অবস্থা তুর্যরও কি সেই একই অবস্থা?
0 Comments