লেখিকাঃ তাহিনা আইরাত ইরা
“আমার বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই একটা গলি। গলিটা খুব ছোট। তার উপর রাস্তার পাশে একটা বড় ময়লার স্তুপ ছিল। কাল রাতে আমি আমার টিউশনি শেষ করে ওই গলি দিয়েই বাড়ি ফিরছিলাম। গলি টা নির্জন ছিল। আমি আমার সাথে অন্য কারো অস্তিত্ব অনুভব করছিলাম। প্রথমে ব্যাপার টা মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দি আমি। কিন্তু আমি যত এগুচ্ছিলাম তত আমার মনে হচ্ছিল আমার পিছনে কেউ আছে। আমাকে ফলো করছে। শেষে আমি যেমনি পিছনে ঘুরি তেমনি আমার মুখে কেউ একজন রুমাল চেপে ধরে।”
কথাগুলো বলেই ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে মোহ। এতোক্ষণ হতভম্ব হয়ে মোহ'র কথাগুলো শুনছিলো প্রভা। মোহ'র সাথে এমন কে করবে? কে আছে এমন? চোখ বড় বড় করে প্রভা মোহ'র উদ্দেশ্যে সুধায়,
“তুমি কি তাকে চেনো মোহ?”
মোহ মাথা নিচু করে উত্তর দেয়,
“না, তার মুখে কাপড় বাধা ছিল।”
প্রভা কপাল কুঁচকায়। এমন কে হতে পারে? সে আবারো মোহ কে জিজ্ঞেস করে,
“তারপর কী হয়েছিল মোহ? তোমার কী কিছু মনে আছে?”
মুহুর্তেই মোহ'র আদলে আতঙ্ক ভর করে। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক বার্তা দেয় সে। প্রভা তা দেখে বলে ওঠে,
“মোহ, তুমি যা জানো তার সবই আমায় বলো। প্লিজ।”
মোহ প্রভার কথা শুনে বড় করে শ্বাস নেয়। তারপর বলা শুরু করে,
“আমার জ্ঞান ফিরে আসার পর আমি নিজেকে একটা বদ্ধ ঘরে আবিষ্কার করি। ঘরটির কোনো জানালা ছিল না। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ ছিল। মাথার উপর শুধু একটা সিলিং ফ্যান ও ঘরের এককোণে একটা লাইট ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আমার হাত, পা ও মুখ বাধা ছিল। চিৎকার করতে পারছিলাম না। বেশ কিছুক্ষন মুচড়ামুচড়ি করার পর হঠাৎ আমি দরজা খোলার শব্দ পাই। ভেবেছিলাম কেউ হয়তো আমাকে সাহায্য করতে এসেছে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। ওরা সংখ্যায় অনেক ছিল। প্রায় ৯-১০ জন। সবার মুখেই কাপড় বাধা ছিল। ওরা আমাকে...
থেমে যায় মোহ। আগের চেয়ে বেশি ব্যতিক্রম লাগছে তাকে। শরীর ঘামছে। একটা শুকনো ঢোক গিলে মোহ। তারপর আবার বলতে থাকে,
“ওরা হকিস্টিক দিয়ে আমাকে জখম করে। খুব মারে আমাকে ওরা। ততক্ষন পর্যন্ত মারে যতক্ষন না আমি দ্বিতীয় বার অজ্ঞান না হই। ওরা আমাকে অনেক বাজে কথাও বলছিল। গালিগালাজ করছিল। আমার কষ্ট হলেও কিছু করার ছিল না। মুখ বাধা থাকায় একটু চিৎকারও করতে পারিনি আমি। আমি ঘৃনা করি ওদের। আমার জীবনের একটা খারাপ অতীত থাকবে এটা।”
কেঁদে ফেলে মোহ। সবটা শুনে প্রভার চোখেও পানি চলে আসে। সে যতটা না বেশি অবাক হয়েছে তারচেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছে। মোহ'র সাথে যা হয়েছে তা ঠিক হয় নি। প্রভা মোহ'র মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মোহ'র চোখের পানি মুছে দেয়।
“মোহ, তাহলে তুমি ওই স্তুপের কাছে কীভাবে পৌঁছালে?”
মোহ চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে,
“হয়তো ওই জানোয়ার গুলোই ফেলে এসেছিল।”
প্রভা হাসে। মেয়েটা ভারী শক্ত। এতো ভয়ানক ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার পরও কত মনোবল। প্রভার ভাবনার মাঝেই কেবিনের বাইরে থেকে প্রহরের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে,
“প্রভা, আমাদের বাড়িতে ফিরতে হবে। মা চিন্তা করবে।”
কেঁপে ওঠে মোহ। প্রহরের কণ্ঠস্বর। এই কণ্ঠস্বর শোনার জন্য একটা সময় কত পাগল ছিল সে। যৌবনের প্রথম প্রেম, ভালোবাসা। মোহ'র চোখে অশ্রুদের ভীড় জমে। প্রভার অগচরেই সে অশ্রুকণা গুলো চোখ থেকে ঝেড়ে ফেলে।
প্রভা ডাকে প্রহর কে। প্রহর নাকচ করে তবে প্রভা শোনে না। বাইরে গিয়ে প্রহরের হাত ধরে কেবিনে নিয়ে আসে। প্রহর অপরাধী দৃষ্টিতে মোহ'র পানে তাকায়। মোহ ও তাকায়। চোখাচোখি হয় দু'জনার। প্রহর চোখ সরিয়ে নেয়। মোহ'র সমুদ্রের ন্যায় গভীর চোখের দিকে তাকানোর সাহস নেই তার। প্রভা হেসে মোহ'কে বলে,
“মোহ, তোমাকে আমার ভাই এর কথা বলেছিলাম না? এইযে আমার ভাই, প্রহর শাহরিয়ার।”
মোহ প্রহরের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি দেয়। প্রভা আবারো প্রহর কে বলে,
“ভাই, এইযে আমার সেই বান্ধবী। ওর নাম মোহ, তোর্সা আহিন মোহ।”
প্রহর ও মোহ'র দিকে তাকিয়ে হাসে। যদিও সে হাসি বেশিক্ষন স্থায়ী হয় না। সেখানে শাওন ও উষ্ণও উপস্থিত হয়। দু'জনই প্রহর কে এখানে দেখে ইতস্তত বোধ করে। প্রভা ও প্রহর ও উষ্ণ কে এখানে দেখে অবাক হয়। শাওন মেকি হেসে ওদের কে বলে,
“ও আমার বন্ধু। রাস্তায় দেখা হলো তাই মোহ'র সাথে দেখা করাতে নিয়ে এলাম। মোহ'র ও এতো মানুষ দেখে ভালো লাগবে তাই।”
প্রভা শাওনের কথা শুনে হাসে। কেন জানি ছেলেটাকে ভীষণ ভালোলাগে তার। তার সবকিছুই প্রভার মনে ধরে। কিন্তু প্রহরের কাছে শাওন ছেলেটাকে ভালো লাগে না। ওকে দেখলে কেমন যেন অস্বস্তি হয়। প্রহর উষ্ণ কে জিজ্ঞাসা করে,
“নাম কী তোমার?”
উষ্ণ হেসে উত্তর দেয়, “উষ্ণ।”
প্রহর কপাল কুঁচকে উষ্ণের দিকে তাকায়।
“পুরো নাম?”
উষ্ণ এবারো অকপটে জবাব দেয়,
“তাহরিব উষ্ণ।”
প্রহর কিয়ৎক্ষন উষ্ণের পানে তাকিয়ে থাকে। তারপর একবার শাওনের দিকে তাকায়। আবারো উষ্ণের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
“বংশপরিচয়?”
উষ্ণের মুখের ভঙ্গিমা এবার বদলে যায়। কঠোর হয়ে যায় তার আদল। প্রহরের চোখের দিকে দৃষ্টিপাত করে জবাব দেয় সে,
“দুঃখিত, আমি আমার কোনো ব্যক্তিগত তথ্য কাউকে দিতে রাজি না। আর এখানে বংপরিচয় কী কাজে লাগবে?”
প্রহর কিছুটা ইতস্তত করে। অতপর উষ্ণের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়,
“কিছুনা, এমনি জিজ্ঞাসা করছিলাম।”
এতক্ষণ এসব চুপচাপ দেখছিল মোহ। এবার সে প্রশ্ন তোলে,
“আমি কী বাড়িতে যেতে পারি?”
প্রভা মোহ'র দিকে তাকিয়ে বলে,
“না। তোমাকে এই অবস্থায় একা বাড়িতে থাকা লাগবে না। তুমি এখন আমাদের সাথে আমাদের বাড়িতে যাবে।”
0 Comments