লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা


কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।


~~~~ বর্তমান ~~~~
——— " I'm, I'm sorry! আমি একটু তাড়ায় ছিলাম তো!! "
ত্বরিত পায়ে ছুটে যেতে গিয়ে হঠাৎই কারো সঙ্গে ধাক্কা খেল আদিত্য। নিজেকে সামলে নিতেই অপরপক্ষ মৃদু হাসি দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল, বলল,
——— "আরাফ!"
আদিত্যও পাল্টা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
——— "আদিত্য!"
হাত মেলানোর পরপরই আরাফ তার কাঁধে হাত রেখে রহস্যময় ভঙ্গিতে বলল,
——— "বেস্ট অফ লাক!"
আদিত্য হতবুদ্ধি হয়ে অবাক নয়নে তাঁর মুখপানে তাকিয়ে। এটা বলার অর্থ কী? ইতিমধ্যে আরাফ, পকেটে হাত গুজে , ঠোঁটের প্রান্তে রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে, চলে গেলো। আদিত্যর চিত্তগর্ভে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল সেই সকল কথার সুর; এটাই তো সেই ক্ষণ, যেই ক্ষণে তার জীবনের এক নূতন অধ্যায় উন্মোচিত হতে চলছে। আলোর সহিত তার বিবাহ-প্রস্তাব ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। গত এক মাস ধরে, ক্রমশঃ তার চিত্ত আলোর প্রেমে নিমগ্ন। না, হয়তো গত চার বৎসর হতেই!
এখন, শেষতঃ তার অন্তরের গুপ্ত অভিলাষসমূহ প্রকাশ করেছে। যৌবনে উপনীত হয়ে হাটুর বয়সি মেয়েটার সম্মুখে আত্মসমর্পণ করেছে আদিত্য । আলোও আর তার মর্মে জমা ব্যথা গোপন করতে পরে নি । অন্তঃস্থলে ডাক্তার বাবুর প্রতি তার ভালোবাসা দানা বেধেছে। প্রথম অনুভূতির কাঁপন! জীবনযাত্রার প্রথম প্রেম! সমাজের নানান জনে নানান কথা বলেছে। কেও কটুক্তি করেছে! কেও আলোর চরিত্র নিয়েও তিরস্কার করেছে। তথাপি, আদিত্য প্রথম দিনের মতোই কারো উক্তিকে তিলমাত্র তোয়াক্কা করে নি। আলোর স্মৃতিভ্রম হয়েছে বলে তার নিজস্ব কল্পনার জগতে বিরাজ করছিল, কেবল নিজ নাম ব্যতীত কিছুই মনে করতে পারছিল না। কিন্তু, দুই দিবস পূর্বে, যখন তাঁদের প্রণয় ও বিবাহের বাগদান উৎসব মহাসমারোহে পালিত হল, আকস্মাৎ আলো বলে বসল, তার পরিবারের সকল স্মৃতিই মনে এসে পরেছে । কেবল তার পরিবার কোথায় থাকে, এটাও স্পষ্ট তার মনে। তবে যখন আদিত্য আলোকে তার পরিবারের বিষয় জিজ্ঞাসা করল, আলো উত্তরে জানাল যে সঠিক সময়ে সবার সহিত পরিচয় করিয়ে দিবে।
আদিত্য সদ্বুদ্ধিসম্পন্ন যুবক বুঝতে পারল যে, হয়তো আলোর মনের মধ্যে ভয় আছে। তার পরিবার হয়তো আলোকে আর গ্রহণ করবে না। আলোকে পরিবারের কথা জিজ্ঞাসা করলে তার বিষণ্ণতা ঘনীভূত হতে পারে, তাই আদিত্য আর সেই প্রসঙ্গে জোরাজুরি করে নি। কিছুদিনের মধ্যে আদিত্য সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করে আলোকে তার পরিবারের কাছে নিয়ে যাবে। তার পদপাতে পরিবারের সদস্যদের নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করবে, এতদিন তাদের কন্যাকে ফিরিয়ে না দেওয়ার জন্য।
তবে আদিত্য, আলোর চালচলন দেখে বুঝতে পেরেছে যে, সে ভালো পরিবারের মেয়ে তা নিশ্চিত। কিন্তু যা-ই হউক, আলোকে তার চাই! আলো এখন তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। যদি আলোর পরিবার তাকে গ্রহণ না করে, তা হলে আদিত্য যা কিছু প্রয়োজন হউক না কেন, তার ভালবাসা ভিক্ষা করে আলোকে নিজের করে নিবে। বহুদিন পরে নিজেদের মেয়েটিকে ফেরত পাবার জন্য তার প্রতি তাদের ক্ষোভ সঙ্গত। হয়তো তারা ভাবছে, আলো মা'রা গিয়েছে। শোকও হয়তো পালন করছে।
আদিত্যর মনে ল'জ্জার উদ্রেক হলেও, নিজের মনের গুহায় আত্মসমর্পণ করে, সে আলোকে এই চারটি বৎসর নিজের নিকটে রেখেছে, যেন আলো কখনও তাকে ত্যাগ করতে না পারে। এখন আলোও তার অন্তরের সকল অনুভূতি আদিত্যকে সমর্পণ করেছে। অতএব, আদিত্য নিশ্চিন্ত মনে, নিঃশঙ্কচিত্তে, আলোর পরিবারের সম্মুখে দাঁড়াবে। মাথা পেতে গ্রহণ করবে সমস্ত শাস্তি।
এই ভাবনায় মগ্ন হয়ে, আদিত্য মুখে হাসির রেখা একে গাড়ির দরজা খুলে সোজা গৃহাভিমুখে যাত্রা করল।বাড়ি পৌঁছে গাড়ি পার্ক করে, সরলপথে গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করল। আলোর স্থিতি তার বোন নীলীমার সহিত, হাসি মুখে গল্পে মগ্ন। অন্যদিকে আদিত্যর ভাগ্নে রাফি মোবাইলে গেম খেলায় আত্মলীন। আদিত্যকে দেখেই নিলীমা বলল,
——— "কিরে, টিকিট কেটেছিস?"
——— "এখনো না, কিছুদিন পরে যাব।"
——— "কেন? কী হলো?"
——— "হসপিটালে জরুরি কিছু কাজ আছে, কয়েকদিনের মধ্যেই যাব।"
এসময় সোহেল সাহেব ধীরপায়ে এগিয়ে এসে বললেন,
——— "কাজ তো থাকবেই, কিন্তু বিয়ের সময় যেন কাজের অজুহাত না শুনি!"
আদিত্য হালকা হাসল, চশমার ভেতর দিয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে বলল,
——— "বিয়ের জন্য আমি তিন মাস ছুটি নেব, শুধু বউয়ের সঙ্গেই সময় কাটাব। এর জন্যই তো এখন এত কাজের চাপ নিচ্ছি!"
আলো নতনয়নে মুখ নিচু করে রইল, গালের পৃষ্ঠে লজ্জার লালিমা মৃদু কম্পিত হতে লাগল। আদিত্যের মধুর উক্তি যেন পরিবেশে এক অপার্থিব মায়াবী মোহের সঞ্চার করল।
সোহেল সাহেব অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন। প্রথম পর্যায়ে আলোকে তাহার বিশেষ প্রীতিকর বলে মনে হয় নি। কিন্তু মেয়েটার সৌজন্যবোধ, নম্রতা, এবং অনিন্দ্য আচরণ ক্রমশঃ তাঁকে অভিভূত করেছে। ধীরে ধীরে এই মেয়েটা তার পিতৃহৃদয়ের প্রতিটি কোণ অধিকার করে নিয়েছে। এখন রাজ আলোর, কিছুমাত্র ঘটলে কিংবা ঔষধ সময় মতো গ্রহণ না করলে বকা খেতে হয় সোহেল সাহেবের!
আদিত্য রুমের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পেছনে তাকিয়ে হালকা গলায় বলল,
——— "আমার তোমার সঙ্গে কথা আছে!"
আলো কিছুটা থমকে গিয়ে নিঃশব্দে পিছু পিছু চলতে লাগলো। চেহারায় অজানা শঙ্কার ছায়া, কিন্তু সে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে।
এদিকে সোহেল সাহেব মেয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন, চোখেমুখে গভীর চিন্তার ছাপ। তার নরম গলায় প্রশ্ন ধ্বনিত হলো,
——— "তোর কী মনে হয়, আদিত্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে?"
নিলীমা, সহসা কোনো দ্বিধা ছাড়াই জবাব দিল,
——— "একদম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে! আলোর মতো মেয়ে লাখে একটা!"
সোহেল সাহেব একটু থমকে থেকে বললেন,
——— "আমার মনে হয়, মেয়েটা অনাথ।"
নিলীমা কটা'ক্ষ করে বলল,
——— "তাতে কি আসে যায়? ও তো সুন্দর মনের অধিকারী! আমার ভাইকে ভালোবাসলেই হলো!"
সোহেল সাহেব এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে অস্থির হৃদয়ে যেন এক অদৃশ্য ভার অনুভব করলেন। বুকের গভীরে এক চাপা ব্যথা খেলা করতে লাগল। তার বড় আদরের মেয়ে নীলীমা, স্বামীর অকালমৃত্যুর পর হতে যেন জীবনের সমস্ত রঙ হারিয়েছে। একাধিক উত্তম সম্বন্ধও তার সামনে উপস্থিত করা হয়েছে, কিন্তু নীলীমা দ্বিতীয়বারের জন্য বিবাহের প্রস্তাব বরাবরই প্রত্যাখ্যান করে আসছে। তার চোখের তলায় বিষাদরেখার গাঢ় ছায়া প্রতিনিয়ত বয়।
কিন্তু আলোর আগমন তার জীবনে যেন এক আশ্চর্য পরিবর্তনের সূত্রপাত করেছে। নীলীমা যেন ধীরে ধীরে আবারও প্রাণ ফিরে পেয়েছে, মুখে ক্ষীণ হাসির মৃদুমন্দ আলোড়ন দেখা যায় এখন।
------------
তৎসময়ে, আদিত্য আপন কক্ষে বিছানায় শায়িত । আলো, ধীর পদক্ষেপে তার সম্মুখে এসে দাঁড়াল, কোমল কণ্ঠে বলল...
——— কি বলবেন বলুন.??
আদিত্য শয়নক্লিষ্ট দেহে আঙুলের ইশারায় আলোকে কাছে আসার ইশারা করল। আলো, এক অপ্রকাশ্য সঙ্কোচে ঢোক গিলে, ধীরে পায়ে আদিত্যর পাশে ধপ করে বসল। মুহূর্তমাত্র অতিবাহিত না হতেই আদিত্য এক আকস্মিক টানে আলোকে নিজের প্রশস্ত বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো । আলো হতচকিত হয়ে ছটফট করতে করতে বলল,
——— "ছাড়ুন ! কি করছেন টা কি? কেও দেখে ফেলবে!"
——— "শশশ! দেখুক আমার বউকেই তো ধরেছি! "
——— "আপনার ল'জ্জা না থাকলেও আমার আছে!!"
-——- "তুমি চাইলে আমি তোমার সব ল'জ্জা ভেঙে দিতে পারি। "
——— "ইশশ মুখে কিছু আটকায় না আপনার!?"
——— "নাহ!!"
আদিত্য আলোকে বুকে নিয়েই জিজ্ঞেস করল,
——— "তুমি এবার খুশিতো.?"
——— "কি নিয়ে??"
——— "তোমার পরিবারের কাছে নিয়ে যাবো!"
আলোর মুখ শুকিয়ে গেলো! চুপ করে রইলো! আদিত্য বুঝতে পেরে বলল,
——— "আমি আছি তোমার চিন্তা নেই!!"
——— "একটা কথা বলি?"
——— "হুম?"
——— "আপনি আমাকে যেখানে পেয়েছেন যদি সেখানেই পুলিশের খবর দিতেন তাহলে আমার পরিচয় জানতে আপনার অসুবিধা হতো না!"
আদিত্য গভীরভাবে আলোর চোখে তাকিয়ে রইলো, যেন তার পুরো আত্মাটাই ছুঁয়ে ফেলতে চাইছে। তার কণ্ঠ এক গভীর আবেগে ভারী হয়ে উঠলো, চোখেমুখে তীব্র ভালোবাসার ছায়া। আলোর গাঢ় নীরবতার মাঝেও আদিত্য তার হৃদয়ের গভীর থেকে কথা বলতে শুরু করলো,
———" জানো, যখন প্রথম তোমাকে দেখেছিলাম, সেই মুহূর্তেই আমার ভেতরে কিছু বদলে গিয়েছিল। তুমি ছিলে এক রহস্যময় আলো, যার কাছে পৌঁছানোর আগেই ভেবেছিলাম আমি হারিয়ে যাব। তোমার পরিচয় জানার ইচ্ছে ছিল ঠিকই, কিন্তু মনে হচ্ছিলো যদি সব জানতে পারি, হয়তো তুমি আমার থেকে অনেক দূরে চলে যাবে, এক অচেনা দূরত্বে। তাই তখনই পুলিশে খবর দেইনি। আমার নিজের মধ্যেই এক ভয় ছিল, যদি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাও, যদি আমি তোমাকে হারাই! আমি সেই মুহূর্তে বুঝেছিলাম, তোমার পরিচয় আমার কাছে তুচ্ছ। তুমি যে কেউ হতে পারো—অপরিচিতা, প'রিত্য'ক্তা, অনাথ—তাতে কিছুই যায় আসে না আমার জন্য।"
আদিত্য এবার আলোর হাত ধরে শক্ত করে চেপে ধরে কপালে ভালোবাসার পরশ একে বলল,
——— "তুমি জানো না, আমি তোমাকে অপরিচিতা হিসেবেই ভালোবেসেছি। কারণ আমি জানি, তোমার চোখে আমি যা দেখেছি, তা কোনো পরিচয়ের চেয়ে অনেক বেশি। আমার কাছে তুমি শুধুই "তুমি," আর এর চেয়ে বেশি কিছু আমার দরকার নেই। তোমার অতীত, পরিচয়; এসব আমার কাছে অর্থহীন। আমার হৃদয়ে তুমি সেই অপরিচিতা, যাকে প্রথম দেখেই ভালোবেসে ফেলেছি, কারণ তোমার মধ্যে আমি পেয়েছি আমার সবটুকু।"
আদিত্যর কণ্ঠে এমন এক গভীরতর ভালোবাসার ছোঁয়া , যা আলোর সমস্ত সন্দেহ, ভয় আর সংকোচকে মুছে দিতে বাধ্য হলো। আলো আদিত্যকে ভালোবেসেছে—অত্যন্ত গভীরভাবে, কিন্তু সেই ভালোবাসার ভারে সে ক্রমশই ভেঙে পড়ছে। এতদিন নিজেকে আটকিয়ে রেখেছে, কিছু বলে নি। ভেবেছিলো, যদি সত্যটা প্রকাশ করে, তাহলে আদিত্য হয়তো তাকে ফিরিয়ে দেবে, তার এই স্বপ্নময় জীবন চুরমার হয়ে যাবে। তবে একদিকে মন বলছিল, আদিত্যকে এইভাবে ঠকানো ঠিক হবে না। ভালোবাসার সম্পর্ক মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। তাই তো সে অবশেষে নিজের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দিলো, যেন আর পালিয়ে থাকতে না হয়।
আলো জানে, সেই দিন আসবে, যেদিন আদিত্য তার সবটুকু জানতে পারবে। হয়তো সেই দিন তার জীবনের সবকিছু বদলে যাবে, হয়তো তখন আদিত্য তাকে আর গ্রহণ করবে না। কিন্তু সে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারছে না। তার মনে বারবার প্রতিধ্বনি উঠছে, ‘সত্য প্রকাশ করতেই হবে।’ সে এখন প্রতীক্ষা করছে সেই দিনের, যখন আদিত্য সত্যিটা জানতে পারবে, যখন তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রশ্নের উত্তর সে পাবে—আদিত্য কি তাকে তবুও ভালোবাসবে?
——----------
ছাদের প্রান্তে থাকা সেই ক্ষুদ্র, অপ্রকাশিত স্টোররুমটি, যেখানে আরাফ আরিয়ার প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে, অন্ধকারে রহস্যময় এক স্বপ্নপুরীর আভাস দেয়। ঘরের সব কোণেই আধো আলো ছড়িয়ে, যেন ইচ্ছাকৃতভাবে হৃদয়হরণীর পদচিহ্নে মিশে রয়েছে । প্রতিটি দেয়ালে, প্রতিটি কোণে সেই অজ্ঞাত, অধরা নারীর নীরব উপস্থিতি বিরাজমান। রকিং চেয়ারে নিস্তব্ধে বসে আরাফ, ধীরে ধীরে সিগারেট ফুকতে ফুকতে তাঁর সেই মায়াবী চাহনির দিকে তাকিয়ে; যা দেয়াল জুড়ে তাঁকে একাগ্র দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে।
কিন্তু এই রহস্যের ঘরে কে জানত, আরাফের ভালবাসার এই নিভৃত উপাসনালয়ে কেবল সেই নারীরই শাসন চলছে? যখন কাজের বুয়া সেদিন ভেবেছিল, ঘরটি দামী কিছুর জন্য তালাবদ্ধ , সেই ভ্রান্তিবশত সে তালা ভেঙ্গে প্রবেশ করেছিল, এবং সেই সূত্রে আরিয়াও প্রবেশ করেছিল। কিন্তু বুয়া কি জানত, এই অশ্রুত, অদেখা ভালোবাসার বিন্দুগুলি যা আরাফের মনোজগতকে গড়ে তুলেছে, সেটা তার সম্মুখে আসবে? দেখে যখন বুঝল, বিরক্ত হয়ে ক্ষোভে তখনই সপাটে পালিয়ে বিদায় নিলো।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। অন্য প্রান্তে নারীকণ্ঠে শ্রুত হল,
——— "তুই আর কতদিন আলোর থেকে লুকিয়ে থাকবি?"
——— "আমার লুকানোর কিছু নেই!"
——— "মেয়েটা জানেও না তুই এই শহরেই আছিস। আর আমি যতদূর শুনছি, আলোর সব মনে পরে গিয়েছে , কিছুদিনের মধ্যেই গ্রামে যাবে! "
——— "আমি জানি।"
——— "কিভাবে জানিস?"
——— "যেভাবেই হোক।"
——— "আচ্ছা, সেসব কথা বাদ দে! তুই এত বছরেও নিজের পরিচয় কেন দিস নাই?"
———" ইচ্ছা হয় নি"
——— "তোর সাথে কথা বলে লাভ নেই!"
——— "বলিস না!"
——— "শুধুমাত্র তুই আমার বন্ধু বলেই এতদিন হসপিটালের নিয়ম ভেঙে খবর দিচ্ছি, না হলে একবার আদিত্য স্যার জানলে আমার চাকরিটাই খেয়ে ফেলত! "
———" আর কিছু বলিবি?"
——— "সব কথা বাদ, সব বাদ!! তুই আর কতদিন এভাবে থাকবি চুপ থাকবি? আরিয়াকে নিয়ে তো ভাবিস?? আরিয়ার জন্য হলেও অন্তত ওর সাথে সবকিছু ঠিক করে নে!"
আরাফ হেসে বলল,
——— "আরিয়ার নামটা ও রেখেছে, জানিস?"
অপর প্রান্তে ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। আয়শা দন্তপেষে বলল,
——— "কথা কেন ঘুরাচ্ছিস? যা বলছি, তাই কর। আর কতদিন দূরে থাকবি? দেখ, আমি কিন্তু সব জানি..."
——— "কিচ্ছু জানিস না.."
ফোন কেটে দিল আরাফ। এসব কথাবার্তা শুনবার মুডে নেই সে । আরাফ সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে মৃদু হাসল। আয়শার কথা শুনে তার চোখে একধরনের নিস্তেজ আলো ফুটে উঠল। সেই পুরোনো পাতা, সেই গোপন ইতিহাস... যা কেবল তার অন্তরেই লুকানো, কেউ জানে না। ঠোঁটের কোণে একটা তির্যক হাসি, সে ভাড়ি কন্ঠে সামনে দেয়ালে তার দিকে তাকিয়ে থাকা সেই একান্ত নারীর চোখে তাকিয়ে বলল,
——— "কেও কিছু জানে না, কী হয়েছে কেও জানে না। জানার মতো কিচ্ছু নেই। জানতে হলে ফিরে যেতে হবে সেই পুরোনো পাতায়। সেখানে লেখা আছে এমন কিছু, যা কেউ পড়ে দেখেনি, কেউ চোখে দেখেনি। কত হৃদয় ভেঙেছে, কত প্রতিশ্রুতি মিথ্যা হয়ে গেছে। শুধু জানার জন্য যেতে হবে অনেক গভীরে। সেই পুরোনো পৃষ্ঠাগুলোতে লেখা আছে কিছু র'ক্তের দাগ, কিন্তু তার রঙ লাল নয়... সেখানে আছে নিরবতায় বোনা এক অমোঘ রহস্য, যা আর কেউ পড়েনি, কেউ জানেনি।"
আরাফের কল্পনায় ভাসছে সেই মুখ, যা একদিন আলোয় ঝলমল করত। মায়াবিনী ... যার নিঃশ্বাস, যার হাসি, সবকিছুই তাকে বেঁধে ফেলেছিল। কিন্তু এখন? সে কি সত্যিই হারিয়ে গেছে, নাকি সে কোথাও লুকিয়ে আছে, নিজের অজানা জীবনে? রহস্যের পরতগুলো খুলে দেখলেও কেউ কখনো বুঝতে পারবে না। আরাফ ফের বলল,
———" পুরোনো পাতা?। পুরোনো পাতা যদি খুলতে হয়, তবে অনেক হৃদয়ের গল্প, অনেক কষ্টের আ'ঘা'ত জানতে হবে। কিন্তু কেউ কি সেই সত্য জানতে প্রস্তুত?"
———————— ফ্লাসবেক —————————
——— “প্রণীতা... তুমি আমার অন্তিম বি'না'শে'র একমাত্র কারণ। তুমি নিষিদ্ধ র'ক্তের ঐশ্বরিক শপথ, যা আমার অন্তঃস্থলে গহন আ'গু'নের শিখায় নিজেই দগ্ধমান। তুমি সেই বিরোধিনী, যাকে আমি চিরকাল লালন করেছি হৃদয়ে, যাকে স্পর্শের অধিকার আমার কোনোদিনও মেলে নি। তুমি সেই অপার বিধিনিষেধ, যা আমার হৃদয়ের নিবিড়তম গহ্বরে গভীর শিকড় গেঁথেছে, প্রতিনিয়ত আমার আত্মার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চূ'র্ণ-বি'চূ'র্ণ করে ধ্বং'সের পঙ্কে নিক্ষিপ্ত করছে।
তোমাকে ছোঁয়ার অধিকার আমার নেই, তোমাকে ত্যাগ করার শক্তিও আমি ধারণ করি না... অথচ তোমার উপস্থিতি থেকে পলায়নও আমার জন্য এক অসাধ্য কর্ম। তুমি নিষিদ্ধা, প্রণীতা... আমার জন্য, আমার র'ক্তে'র প্রতিটি কণার অন্তস্থলে তুমি অনিবার্য, এক দ'গ্ধ'কাতর পী'ড়া'র সঞ্জীবনী, যাকে আমি পুষে রেখেছি চিরন্তন অ'ভি'শা'পে।
0 Comments