Ad Code

শ্যামকন্যার মায়াবী চোখ - পর্ব ৯

 লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা

🚫🚫
কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।
🚫🚫
**************
চারিপাশে এক অশান্তি, প্রকম্পন বিরাজিত হচ্ছে, হইচইয়ের ঝঞ্ঝাবাতাসে চারদিক উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছে। মানবসমুদ্রের উত্তাল ঢেউ যেন ধাবমান, সবাই একমুখী অগ্রসরতায় অভিন্ন হয়ে গিয়েছে । অবিচলিত নারীসমাজ হায়-হুতাশ করে চিৎকাররতভাবে অশ্রু বি'সর্জন দিয়ে যেন চারদিক কম্পমান করছে, ভগ্ন হৃদয়ে দৌড়াচ্ছে যেন কোনও ভ'য়ঙ্কর বিপর্যয় অথবা অপ্রত্যাশিত দু'র্ঘটনার সংবাদ পেয়েছে । উন্মত্ত জনতা যে দিকে দৌড়াচ্ছে, তার কারণ রহস্যমণ্ডিত ও অজ্ঞাত রইলেও তাদের মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তি ও চক্ষুদ্বয়ের প্রগাঢ় বিভীষিকাময় দৃষ্টিতে স্পষ্ট প্রতিফলিত হচ্ছে যে, কিছু অপার শোক ও বেদনাদায়ক ঘটনা এর অন্তর্নিহিত রয়েছে। প্রত্যেকের হৃদয় ভারাক্রান্ত, যেন কোনও অকল্পনীয় ভয়াবহতা তাদের গ্রাস করেছে, অথচ কোনোমতে তারা তার স্বরূপ প্রকাশ করতে পারছে না। এক অলক্ষ্য বিভীষিকার আভাসে সমগ্র পরিবেশ ভারী ও পী'ড়াদায়ক হয়ে উঠেছে, যেন এই মুহূর্তে প্রকৃতি নিজেও কান্নায় ভেঙে পড়ছে।
অর্ধেক জন হাহাকাররতভাবে শাহারিয়াজ ভবনের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। শাহারিয়াজ ভবনে আপ্যায়ন সমাপ্তির পর, ভবনটি ক্রমে শূন্য হতে চলছে। শিকদার পরিবারের সদস্যগণ এখন বি'রক্তি সহকারে উপবেশন করে আছে, বাধ্য হয়েই প্রত্যেকে অধিষ্ঠিত রয়েছে। মোশারফ সাহেব বলেছেন, সমগ্র পরিবারের সহিত কিছু গুরুতর বিষয় আলোচনা করতে চান তিনি। অতএব, সকলেই উক্ত বিরক্তি নিয়ে ক্রুদ্ধভাবে উপবেশন করেছে। ইকরাম আলী, কুদ্দুস আলী, আজগর আলী রোষে ফুঁসছে। এমনিতেই এখানে আসতে হয়েছে, তার উপর বসিয়ে রেখে কোথায় অন্তর্ধান করলেন কে জানে!
আফিয়া বেগম, কানিজ বেগম, রোকেয়া বেগম তাদের স্বামীদের পাশেই ম্লান মুখে উপবেশন কর আছে। শাহারিয়াজ বাড়ির মহিলা সদস্য তাদের নানান ভাবে বৃথা চেষ্টায় আপ্যায়ন করে যাচ্ছে যেন তারা বিরক্ত না হন। আলো পূর্বিকার এক হাত ধরে চকলেট ভক্ষণে ব্যস্ত। শান্ত ক্রোধে প্রজ্বলিত, মুগ্ধকে শান্তর পূর্ব হতেই অপছন্দ। সর্বদাই শান্ত মুগ্ধকে দেখে ঈর্ষা অনুভব করত। আজও তার মধ্যে পরিবর্তন আসে নি; বরং কালের প্রবাহে ঈর্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুণ বেগে। শান্ত বুঝতে পারে না, মুগ্ধের মধ্যে কী এমন আছে যে সকলে তার জন্য পাগল। শান্ত নিজেও তো সুদর্শন, তথাপি তাকে নিয়ে তো কেও এমন পাগলামি করে না! সে ইচ্ছে করে আসতে চায় নি, ইকরাম আলী স্পষ্টভাবে আদেশ দিয়েছেন যেতেই হবে, এই জন্য বাধ্য হয়েই আসতে হয়েছে। মনে মনে বিরক্তির প্রকাশ ঘটাচ্ছে ক্রমাগত ।
অন্যদিকে নাঈম তার নিজ গ্রহে অবস্থান করছে, এয়ারপডে সঙ্গীত শুনে এক ভিন্ন জগতে গেম খেলছে মনোযোগ সহকারে, যেন এই পৃথিবীর কোনও কিছুই তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারছে না। বাকিদের মতো সে এ বাড়ির সদস্যদের শ'ত্রু মনে করে না। আর মুগ্ধকে তো না-ই। যথাযথ সম্মান করে নাঈম মুগ্ধকে করে, কারণ মুগ্ধ এটার যোগ্যতা রাখে।
আঁখি অবশেষে তাহার বান্ধবীদের দর্শন লাভ করেছে। মিলি, আছিয়া, রূপা—তারা তিনজনেই একত্রেই ছিল, কেবল আঁখি বাদে। তাদের পেয়ে আঁখির হৃদয় যেন তৃষ্ণা হইতে তৃপ্তিতে উপনীত হয়েছে। এখন চারিজনই একত্রে আছে । তথাপি আঁখির মস্তিষ্কে সেই বয়োবৃদ্ধ লোকগুলোর কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। আঁখিকে এভাবে মগ্ন দেখে আছিয়া বলল,
-"কি রে, কি ভাবতছিস এত? সেই কখন থেকে দেখছি কিছু একটা ভাবছিস, কিছু কি হয়েছে?"
আঁখি আছিয়ার কথার মাধ্যমে চিন্তার জাল হতে বের হয়ে আমতা-আমতা করে বলল,
- "না না, কিছু না।"
সেই মুহূর্তেই মিলি গালে হাত রেখে উচ্ছ্বাস সহকারে বলল,
-"যা বলিস না কেন, মুগ্ধ ভাইকে দেখেছিস? আহা! আমি সম্পূর্ণরূপে মুগ্ধ!"
রূপা মিলির মস্তকে আঘাত করে বলল,
- "মু'টকি, তুই প্রথমে আয়নায় নিজেকে দেখিস।"
রূপার উক্তিতে আঁখি ও আছিয়া উচ্চস্বরে হাসতে লাগল। মিলি মুখ ফুলাইয়া থাকল। আঁখি হাসতে হাসতে তখন মুগ্ধের আচরণের কথা স্মরণ করল। কী বিচিত্র পুরুষ! আঁখি স্পষ্ট শুনেছিল, মুগ্ধ ইংরেজিতে তাদের "ছেড়ে দিতে" বলেছিল বয়োবৃদ্ধ লোকদের। হ্যাঁ, এত ইংরেজি ভালো না জানলেও এটুকু বুঝতে পেরেছে।
পরিশেষে আঁখি দৃষ্টি মিটমিট করে মনে মনে বলল,
-"সে যা ইচ্ছা তাই করুক, আমি বুঝে কী করব! আমি তো নিজেকেই বুঝতে পারি না, অন্যকে কীভাবে বুঝব!"
--
- "তুমি কি সত্যিই ওই বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করতে চাচ্ছ মুগ্ধ?"
প্রান্তর বদ্ধ প্রাচীরের অন্তরালে দণ্ডায়মান মোশারফ সাহেব, সাজ্জাদ সাহেব, ও মুগ্ধের সম্মুখে প্রশ্নের উত্তপ্ত মীমাংসা চলছে। সুনিপুণ এক কঠোর প্রস্তর প্রতিমূর্তির ন্যায়, মুগ্ধ বৈষ্ণব ধারায় শান্ত-স্থির হয়ে বসে আছে, যেন তার মনে কোন আবেগের চলাচল নেই। অন্যদিকে, মোশারফ সাহেব ও সাজ্জাদ সাহেব ক্রো'ধের প্রাবল্যে প্রবাহিত হচ্ছেন, যেন তপ্ত আগুনের শিখার ন্যায় তাদের অন্তরে প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠেছে।
মুগ্ধ আসার পূর্বেই জানিয়ে দিয়েছিল,
-" যদি শিকদার পরিবারকে নিমন্ত্রণ না জানানো হয়, আই উইল নট পার্টিসিপ্যাট ইন দ্য ইভেন্ট ! "
মুগ্ধের ঐকান্তিক প্রত্যয়ের প্রতিফলন তারা পূর্ব থেকেই জানতেন; একবার সে যে কথা বলে, তা পালনে তার দৃঢ়তা অবিচল। এমন সিদ্ধান্তের পিছনে তার কোন গূঢ় কারণ রয়েছে কিনা, তা প্রথমে অনুধাবন করতে না পারলেও, শেষে বাধ্য হয়েই শিকদার পরিবারকে আমন্ত্রণ জানাতে হয়েছে। কারণ মোশারফ সাহেব ম'রে গেলেও কখনও তাদেরকে তার গৃহে প্রবেশের অনুমতি দিতেন না।
পরিবেশ যখন এক অশান্তি ও জিজ্ঞাসার মাধুর্যে অধীর ছিল, তখনই মুগ্ধ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে তার বাবাকে বলল, শিকদার পরিবারের সবাইকে বসতে বলার জন্য, কারণ তার নিকট তাদের উদ্দেশ্যে এক বিশেষ বার্তা রয়েছে। মুগ্ধের এই কৌতূহলপূর্ণ আচরণে মোশারফ সাহেব ভীষণভাবে বিস্মিত হলেন, কারণ তার কল্পনাতীতও ছিল না যে, তার পুত্র এমন আপাত দৃষ্টিতে অসম্ভব কিছু করার অভিপ্রায়ে আবদ্ধ হয়েছে।
কিন্তু যখন মুগ্ধ তার শান্ত কণ্ঠে জানালো,
- "আই ওয়ান্ট টু ম্যারি দ্য ইলডেস্ট ডটার অফ দ্য শিকদার ফ্যামিলি! "
তখন যেন সেই নিরুপায় পরিবেশে একটি অশান্তির ঢেউ আছড়ে পড়ল। মুগ্ধের এমন সিদ্ধান্ত যেন মোশারফ সাহেবের মনে একটি জ্বালাময়ী অগ্নিকুণ্ডের সমাহার ঘটালো। কিভাবে শ'ত্রুর কন্যার সাথে তার পুত্রের বিবাহ সম্ভব? এ যেন সম্পূর্ণভাবে অসম্ভব এবং নৈতিকতার বিরুদ্ধ। মুগ্ধ তবু সেই শান্ত নির্লিপ্ততায় অবিচল রইল।
মোশারফ সাহেব তাঁর ক্রো'ধাভিভূত কণ্ঠে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,
-"তুমি কি সত্যিই ওই বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করতে চাচ্ছ মুগ্ধ?"
মুগ্ধ তার বাবার দৃষ্টির প্রতি সযত্নে তাকিয়ে, এক গভীর নিঃশ্বাস ফেলে দৃঢ় স্বরে বলল,
-"হ্যাঁ।"
মোশারফ সাহেব বললেন,
- "তাহলে এটা সম্ভব নয়। তুমি যদি ভাবো যে তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে, তবে তোমার এই ভুল ধারণা ভেঙে দিতে হবে। আমি জীবিত থাকতে ওই বাড়ির মেয়ের সাথে তোমার বিয়ে কখনোই হতে দেব না।"
মুগ্ধ শান্ত কণ্ঠে এক অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে সে বলল,
- "তুমি জীবিতও থাকবে, অ্যান্ড ইউ উইল স্টিল অ্যারেঞ্জ ফর মি টু ম্যারি দ্য গার্ল ফ্রম দ্যাট হাউস।"
মোশারফ সাহেব ক্রু'দ্ধস্বরে প্রতিহত করলেন,
-"মুগ্ধ! তুমি কি জান না ওই বাড়ির সাথে আমাদের দীর্ঘ দিনের শ'ত্রুতা আছে?"
মুগ্ধ সংক্ষিপ্তভাবে উত্তর দিল,
-"আমার এসব জানার দরকার নেই। আমি যদি বিয়ে করি, তবে ওখানেই করব। আদারওয়াইজ আই উইল লিভ হেয়ার ফরেভার অ্যান্ড নেভার রিটার্ন।"
মোশারফ সাহেব তীব্র কন্ঠে প্রতিউত্তরে বললেন,
- "তুমি কি আমাকে ভ'য় দেখাচ্ছো? তবে যাও এখান থেকে! তোমার মতো অকৃতজ্ঞ সন্তানের প্রয়োজন নেই আমার!"
মুগ্ধ যেন এক মুহূর্তের মধ্যে তার মুখমণ্ডল কঠিন পাথরে পরিণত হলো, তার হাতের মুঠি শক্ত হয়ে উঠল। তার চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি খেলে গেল, যা কাঠিন্যতা ফুটে ওঠেছে সমগ্র মুখশ্রী জুরে। পরিস্থিতি সামলাতে সাজ্জাদ সাহেব দ্রুত মোশারফ সাহেবের কাছে এগিয়ে এসে শান্ত করতে বললেন,
-"আহ ভাই, রাগ করো না। ইকরামের মেয়েটো দেখতে শুনতে সুন্দরী, হয়তো তাই দেখে মুগ্ধ পছন্দ করে ফেলেছে। পরে আমরা আরো সুন্দরী মেয়ে দেখে মুগ্ধর সাথে বিয়ে দিব, তখন মুগ্ধর এসব কথা মনে থাকবে না। এখন চলো তো, আগে ওই আপদগুলো বাড়ি থেকে বিদায় করি।"
মুগ্ধ দৃঢ়তার সাথে তার সিদ্ধান্তের পুনরাবৃত্তি করল,
- "আমি বিয়ে করলে ও বাড়ির মেয়ের সাথেই করব।"
তার গম্ভীর কণ্ঠে যেন প্রত্যয় ও দৃঢ়তা মিশ্রিত ছিল। মোশারফ সাহেব রাগে ফুঁসে উঠলেন, কিন্তু সাজ্জাদ সাহেব তাকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,
-"ওর কথা বাদ দাও ভাই, তুমি চলো তো!"
মুগ্ধ র'ক্তচক্ষু করে তার পিতার প্রস্থান লক্ষ্য করছিল, আর এসব কিছু দরজার আড়াল থেকে আরাফ কথোপকথন শুনেছে। আজ সারাদিন পরিশ্রমের ব্যস্ততায় এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্রাম পায়নি। সকালের বৃষ্টিপাত যখন দেখেছিল, মনটা অশান্ত হয়ে গিয়েছিলো। তাই আকস্মিকভাবে দৌড়ে চলে গিয়েছিল আঁখির কলেজের দিকে। কিন্তু সেখানে গিয়েও করেছিল এক ধরনের মূর্খতা, সেও ছাতা নিয়ে যায়নি। সৌভাগ্যক্রমে মিনহাজের সাথে রাস্তায় দেখা, মিনহাজ ছাতা মাথায় ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো। মুগ্ধ মিনহাজকে কিছু না বলে তার হাত থেকে ছাতা ছিনিয়ে নিয়ে দিলো দৌড়। মিনহাজ তখন হতবুদ্ধি হয়ে পথের মাঝেই বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে পড়ল।
এখন কাজ শেষ করে হাঁটছিলো আরাফ, আশায় ছিল আঁখির সাথে সাক্ষাৎ পাবার। ঠিক সেই মুহূর্তেই মোশারফ সাহেবের কণ্ঠস্বরের উত্থান শোনে, যেখানে তিনি বিবাহের কথা বলছিলেন। কৌতুহলবশত থেমে গেল আরাফ, আর শুনলো মুগ্ধ শিকদার বাড়ির বড় মেয়েকে বিবাহ করতে চাচ্ছে। এই শুনে আরাফের সারাদিনের ক্লান্তি যেন মুহূর্তেই উবে গেল, মুখে ফুটে উঠলো এক চিলতে হাসি। যদি সত্যিই মুগ্ধ বিবাহ করে, তবে তার জন্য বিষয়টি আরও সহজ হয়ে যাবে। তার এত দিনের অপেক্ষার অবশেষে হয়তো পরিসমাপ্তি ঘটবে। কারণ মুগ্ধ যখন বলেছে সে বিবাহ করবে, তখন পৃথিবী উলটে গেলেও সে তার কথা রক্ষা করে। এই আত্মবিশ্বাসের সাথে, আরাফ আর দেরি না করে কক্ষে প্রবেশ করলো। হাস্যমুখে মুগ্ধকে বলল,
- "ভাই, তুই যা করছিস, একদম ঠিক করছিস। আমি তোর সাথে আছি।"
মুগ্ধ রাগের মাঝেও ব্রাউন ঠোঁটে এক বাঁকা হাসি এনে বলল,
-" আরবিন শাহারিয়াজ মুগ্ধ যা করে, সবসময় ঠিকই করে।"
আরাফের মনে তখন আনন্দের ঢেউ বয়ে যাচ্ছিলো, মনে হচ্ছিলো এখন সবকিছু সঠিক পথে চলবে।
তখন মুগ্ধ এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
- "অল্পতেই খুশি হওয়া উচিত নয়, যেমন একটি পাতা ঝড়ের তালে নৃত্য করে কিছু সময়ের জন্য আনন্দিত হয়, কিন্তু পরে সেই ঝড়েরই তাণ্ডবে পড়ে নিঃশ্বেসিত হয়।"
মুগ্ধ কথাটি বলে নিজ স্থান ত্যাগ করে চলে যায়। আরাফ মুগ্ধের কথার বাস্তবতা কিছুই বুঝলো না; সে শুধু তার আনন্দের জগতে বিভোর। মোশারফ সাহেব এবং সাজ্জাদ সাহেব যখন ইকরাম আলীর কাছে পৌঁছালেন, তখন ইকরাম আলী রা'গে ফুঁসতে ফুঁসতে মোশারফ সাহেবকে তার ক্ষো'ভ প্রকাশ করতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। কিন্তু তার মুখ খোলার পূর্বেই, বাইরে থেকে উত্তেজনাপূর্ণ চে'চামেচির শব্দ আসতে লাগলো। অবাক চোখে ইকরাম আলী এবং মোশারফ সাহেব একে অপরের দিকে তাকালেন। অতঃপর, কোন প্রকার দেরি না করে, তারা সবাই বাহিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং বাড়ির ভিতরের সবাই তাদের সঙ্গে গেলেন।
মুগ্ধ তখন বাহিরে এসে দাঁড়িয়েছিল। তার বন্ধু আফ্রিদি সেদিকে ছুটে এসে বললো,
- "এই, তুই কোথায় ছিলি? আমি তোকে কতক্ষণ ধরে খুঁজছি।"
মুগ্ধ তার নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো,
- "নিজের বিয়ে ঠিক করছিলাম।"
মুগ্ধের নির্ভেজাল কথায় আফ্রিদি খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
- "কি বলছিস? আসতে না আসতেই একেবারে বিয়ে! হুম হুম! কে সেই ভাগ্যবতী মেয়ে?"
মুগ্ধ শান্ত কণ্ঠে বললো,
- "শিকদার বাড়ির বড় মেয়ে।"
এ কথা বলে মুগ্ধ পকেটে হাত গুজে বাহিরের দিকে যেতে শুরু করলো চে'চামেচির উৎসের দিকে। কিন্তু আফ্রিদি এক স্থির অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলো। তার মাথায় যেন বজ্রপাত ঘটলো, রোবটের ন্যায় স্থির দাঁড়িয়ে থাকলো। বুকটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে—এমন এক দুঃস্বপ্নের বোধে ভরে গেল। সে ভাবছে এটি শোনার আগে যদি মৃ'ত্যু এসে যেত, তবে ভালো হতো।
------
বৃষ্টি দ্বারা লেপে দেয়া শীতল মাটির উপর মৃ'ত মোবারকের ছিপছিপে দেহ গড়িয়ে পড়ে আছে, যেখানে র'ক্তের প্রবাহ এবং মাটির কাদার মিশ্রণে এক ভয়'ঙ্কর দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। তার নিথর দেহ প্রাকৃতিক নিঃসঙ্গতার প্রতীক হয়ে, নি'ষ্ঠুরতার প্রকৃত ছবি তুলে ধরেছে । মোবারকের দুটি নয়ন কে যেন নি'ষ্ঠুরতার শিখরে পৌঁছে হরণ করেছে। তার সারা দেহ, র'ক্ত ও কর্দমে সিক্ত, যেন প্রতিটি আঘাত ক্ষো'ভের এক গভীর বহিঃপ্রকাশ। এ কেমন অমানবিকতা! কে এমন নির্ম'মভাবে তার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিল? এ দৃশ্য কোনো সাধারণ মানব হৃদয় সহ্য করতে পারবে না। কেউ হয়তো শক্তিহীন হয়ে পড়বে, কেউ উদ্গিরণ করবে বেদনার স্রোতে, আবার কেউ হয়তো প্রতিটি নিশীথে ত্রাসের বিভীষিকা দেখে জেগে উঠবে।ইতিমধ্যেই মৃ'তদেহ থেকে র'ক্তের সড়সড়ি গ'ন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। পরিবেশ এতটাই ভারাক্রান্ত যে এক মুহূর্তও স্থির থাকা অসম্ভব। যেন এই মুহূর্তেই বমি এসে পড়বে। মোবারকের পরিবারে যেন আকাশ বিদীর্ণ হয়ে পড়েছে, তাদের কাতর আর্তনাদ সবকিছুকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর বিমূঢ়তা পাথরের মতো স্থির হয়ে গেছে, সে বিশ্বাস করতে পারছে না যে তার স্বামী আর এই দুনিয়ায় নেই।
গ্রামের লোকজন ভীড় জমিয়েছে, পুলিশ তদন্তের জন্য এক সুরক্ষা বলয় সৃষ্টি করেছে, মৃতদেহের চারপাশে কোনও অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক নাগালের অনুমতি দেওয়া হয়নি। মোবারকের মা, দুই মহিলা কনস্টেবলের দ্বারা আটকিত, ছেলের মৃ'তদেহের দিকে যাওয়া প্রবৃত্তি থেকে বিরত থাকতে পারছেন না। তার কণ্ঠস্বরের চিৎকার এবং অশ্রুসিক্ত বেদনা মর্মাহত করে তোলছে।
ইকরাম আলী, মোশারফ সাহেব, এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা গভীর চিন্তায় নিমজ্জিত হয়ে, এই নি'র্মম হ'ত্যার ভয়াবহতার দিকে লক্ষ্য করছে। এটি যেন এক অভি'শাপের প্রতিফলন, যেখানে প্রতিটি র'ক্তপ্লাবিত দাগ, প্রতিটি কাদামাখা দানা এক ভয়'ঙ্কর শা'স্তির চিহ্ন, যা তাদের সমস্ত রাগ এবং কষ্টের প্রতি'শোধ পরিণত করেছে।
ইকরাম আলী এবং মোশারফ সাহেব তাঁদের পরিবারকুলের নারীগণকে গৃহাভ্যন্তরে প্রেরণ করেছেন, বিশেষত আলোকে, যার শরীর অতি সংবেদনশীল। আলো যদিও দৃঢ়ভাবে অবস্থানে থাকার জন্য জিদ করছিল, তথাপি তাকে তদ্রূপ অনুমোদন প্রদান করা হয় নি, কারণ এমন ভ'য়াবহ দৃশ্য দর্শনে তার দেহে বিপর্যয় নেমে আসে, দুঃস্বপ্নের তাড়না এবং জ্বরগ্রস্ততা তাকে ভোগায়। এখন শিকদার পরিবারের পুরুষজনেরা, তথা পরিবারীয় পরিমণ্ডল হতে নাঈম ও শান্ত, উপস্থিত রয়েছেন। অন্যদিকে, শাহারিয়াজ ভবনে মোশারফ সাহেবের পরিবারের পুরুষগণ, মুগ্ধ এবং আরাফসহ, উপস্থিত আছে। এত ক্রন্দনে, শোকের মাঝারে এক বৃদ্ধা নারীর হাস্যরসের তীব্র ধ্বনি গোপন হলো আচলের আড়ালে; সে হলো ভোলার দাদি। যেন একটি শান্তির সামান্য নিশ্বাস পেয়েছে সে। পাশেই ছোট ভোলা তাকে আঁকড়ে ধরে আছে।
মুগ্ধর কিঞ্চিৎ নিকটে দাঁড়িয়ে থাকা আফ্রিদি ধীরে কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
- “তুই তো এখনও বললি না, কাল রাতে কোথায় ছিলি?"
মুগ্ধের ঠোঁটের কোণে এক বিদ্রূপাত্মক হাসি খেলে গেল। সে আফ্রিদির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইল, যেন তার দৃষ্টিতে অগণিত অর্থের গভীরতা লুক্কায়িত।
-"সব কথা জানতে নেই"
মুগ্ধ মৃদু কণ্ঠে বলল, কিন্তু তার বাক্যে ছিল কঠিন ধ্বনির প্রতিধ্বনি। আফ্রিদি কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে রইল, মুগ্ধের কথার মর্মার্থ খুঁজে বেড়াতে লাগল, যেন মুগ্ধের এই সরল বাক্যটি এক গভীরতর রহস্যের শিকলে বাঁধা ছিল।
আফ্রিদি ভ্রু কুঁচকে কৌতূহলভরা দৃষ্টিতে মুগ্ধের দিকে তাকিয়ে বলল,
-"সব জানতে নেই মানে? আমি তোর ছোটবেলার বন্ধু, আমি তোকে সব বলি, তুইও আমায় সব বলবি।"
-" তুই সত্যিই আমাকে সব বলিস??"
মুগ্ধের কণ্টকাকীর্ণ কণ্ঠে নিক্ষিপ্ত বাক্য আফ্রিদির চেতনায় যেন বাজ হানল। জিহ্বা যেন গিলে ফেলল বাকশক্তি। যেইমাত্র কিছু বলতে উদ্যত হলো, মুগ্ধ রুদ্রদৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে তির্যক হাসি মুখে রেখে বলল,
- "নহি সকল গোপন বচন উন্মুক্ত হবার যোগ্য, যেমন করিয়া তুমিও নাহি উন্মোচন কর প্রতি কথার গভীর রহস্য।"
মুগ্ধের নয়নযুগলে তীক্ষ্ণ শীতলতা, যেন অতল গহবরে লুকায়িত কোনো গভীর অজানা সত্যের আভাস। কথাটি বলে মুগ্ধ জায়গা ত্যাগ করল। তবে মুগ্ধের ইংরেজি ভাষাভঙ্গির মাঝে হঠাৎ বাংলা ভাষায় এমন গভীর কথা শুনে আফ্রিদি বিস্ময়ের চরম সীমানায় পৌঁছালো। কানাডা থেকে আগত যুবকটি এত সুন্দরভাবে বাংলায় কথা বলছে দেখে সে অবাক হলো। মুগ্ধের গম্ভীর কণ্ঠ যেন ধাঁধার মতো অনুভূতি সৃষ্টি করল।
মুগ্ধ দেশে আবির্ভূত হয়েছে পূর্বাহ্নের নিশীথে, তবে এই গ্রামে প্রবেশ করেছে আজ দিবা কালে। এই গোপন ঘটনা কেবল আফ্রিদিরই জানা; অন্য কেও এ সম্পর্কে অবহিত নয়। কিন্তু, রাতের অন্ধকারে মুগ্ধ কোথায় অবস্থান করেছে, কী কার্যক্রমে নিয়োজিত ছিল, কেন রাতেই ফিরল আর ফিরল যখন বাড়িতে না গিয়েই কোথায় গমন করেছিল, এই প্রশ্নসমূহ আফ্রিদির মনের গভীরে প্রবল উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করছে। আফ্রিদি একবার মোবারকের মৃ'তদেহের দিকে চোখ মেলে কিছু চিন্তা করতে থাকে, তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে ত্রাণ দিয়ে বলে,
- "না, না, আমি কী ভাবছি? মুগ্ধ কেন এসব করতে যাবে?? এটা অসম্ভব !! তাছাড়া, মুগ্ধ তো মোবারককে চেনেও না।"
বৃষ্টির মহাকালিক বিশ্রাম সমাপ্তির পর, আকাশ গভীর অন্ধকারের চাদরে আবৃত হয়েছে। চারপাশে কল্পনার অমৃতছায়ায় এক কালো আধারের স্তর ছড়িয়ে পড়েছে, যা ধীরে ধীরে আকাশের অক্ষুণ্ণ বর্ণকে স্তব্ধ করে দিচ্ছে। বাতাসের উদ্দীপনা এক অভূতপূর্ব তাণ্ডবের মতো প্রতিটি ক্ষুদ্র কণা ও ধূলিকণাকে তীব্র গতি ও কোলাহলে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যেন তা দিগন্তের গহিনতার সঙ্গে মিলিত হচ্ছে। বাতাসের অমিত প্রবাহে প্রকৃতি নিজেই যেন এক অন্তর্গত অশান্তি ও প্রবল অভ্যুত্থানের পূর্বাভাস দিচ্ছে।
মেঘের গর্জন ও বিদ্যুৎ উজ্জ্বলতা যেন প্রকৃতির গর্ভগমন ও শোকাতুর মনোভাব প্রকাশ করছে। এমন মুহুর্তে আঁখি চোখ মুখ খিচে দ্রুত পদক্ষেপে দৌড়াচ্ছে, দৌড়ানোর সময়, মাথার ওপর থেকে ওড়নার সরে যাওয়া অনুভব করতেই পারে নি। ঘন কালো লম্বা চুলগুলি বাধনহীনভাবে বেগবান হয়ে তার তীব্র দৌড়ের ফলে বাতাসে উড়ছে। চুলের ফাঁকে ফাঁকে বারি পড়ছে মুখে। শ্যামবর্ণের রূপ যেন কল্পনালব্ধ রূপকথার রাজ্যের মতো প্রতিভাত হচ্ছে। তখন মাটিতে পড়ে থাকা লাশের ভীতিকর দৃশ্য থেকে মিলির দুঃসহ অবস্থা, যেখানে সে বমি করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তার ভারসাম্য সামলাতে আঁখি সহ রুপা, আছিয়া সামলাতে দূরে খোলা জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলো৷ আর এতেই দেরি হয়ে গিয়েছে। এখন সে কোনো মূল্যে ভিজতে ইচ্ছুক নয়। আজ দুপুরে সে ইতিমধ্যে বৃষ্টির স্পর্শ পেয়েছে; একদিনে দুবার বৃষ্টিতে ভিজলে তার রক্ষা শূন্যে পরিণত হবে।
বৃক্ষের পাতা, বাতাসের ঝাঁকুনিতে অস্থির হয়ে উঠছে, আর তীব্র বিক্ষুব্ধ আকাশের অভ্যন্তরে অশ্রু ঝরানোর আহ্বান করছে। বৃষ্টির প্রাক্কালীন রূপের মাধ্যমে, প্রকৃতির বিচ্ছিন্নতা যেন বেদনাময় বাস্তবতা প্রকাশ করছে। সন্ধ্যার আগমনে, অন্ধকারের পর্দা উন্মোচিত হচ্ছে, আর এই অবস্থা প্রকৃতির দুইটি মুখের পরিবর্তনকেও উপস্থাপন করছে।
অস্থিরচিত্তে দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ করে কারো শক্তিশালী বাহুর সাথে সংঘর্ষ ঘটে, আর ফলস্বরূপ আঁখি ক্ষুদ্র পাথরের উপর ধাম করে মাটিতে পতিত হলো। মনে হলো যেন এক অবলম্বনহীন পাথরের সাথে সংঘর্ষ ঘটল! পরে গিয়ে পা মোচকে গিয়েছে বোধহয়। কে সেই কঠিন দেহের অধিকারী? সামনে দুইটি স্থির পদ দৃষ্টিগোচর হল। তার উৎস অনুসন্ধান করতে মুখ উঁচিয়ে লোকটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আঁখি, তাকাতেই বিস্ময়ে অক্ষিদয় বড় বড় হয়ে গেল আঁখির।


Post a Comment

0 Comments

Close Menu