Ad Code

সেই তুমি (সিজন - ২) পর্ব - ১০

লেখিকাঃ তাবাসসুম কথা

 রাত ৩ টা বাজে,, হসপিটালের করিডোরে এক প্রকার মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে হীরের পুরো পরিবার। হসপিটালে এডমিট করা হয়েছে হীরকে। সবাই চুপচাপ বসে আছে, কারো মুখে কোনো কথা নেই। পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে সবার মাঝে। হীরের সাথে এসব ঘটার পর কার কিভাবে রিয়েক্ট করা উচিত কেউই বুঝতে পারছে না।

রাস্তায় এক ভদ্রলোক হীরকে অবচেতন অবস্থায় দেখে হসপিটালে নিয়ে আসে। হসপিটাল থেকে থানায় ফোন করলে সাব ইন্সপেক্টর সাদিক হীরকে দেখে কনফার্ম হয়ে তুর্যকে জানায়। কেস ফাইল করা হয় থানায় ধর্ষণের। হীরের এখনও জ্ঞান ফিরে নি। সবাই অপেক্ষা করছে হীরের জ্ঞান ফেরার।
তুর্য এক দৃষ্টিতে কাঁচের ভিতর দিয়ে তার হীরকে দেখে যাচ্ছে। আজ তাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। পরশু রাতেও তারা একসাথে সারাজীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখেছিল। কয়েক ঘন্টার পরেই তারা একে অপরের হয়ে যেতো। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তাদের জীবনে এতোবড় একটা ঝড় এসে যাবে এটা তো স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি সে।
না না এসব সে কি ভাবছে! ছিঃ! তুর্য নিজেকেই নিজে ধিক্কার দিচ্ছে। এতোটা নিচু মেন্টালিটির সে কিভাবে হতে পারে। শরীরটাই কি সব!! ভালোবাসা তো শরীর দিয়ে হয় না। ভালোবাসার স্তর আরো অনেক উঁচু, আরো অনেক মহৎ। সময়ের সাথে ক্ষীয়মাণ একটা জিনিস কখনই ভালোবাসার উর্ধ্বে হতে পারে না। সে তো হীরকে ভালোবেসেছে তাহলে তার মনে এতো তুচ্ছ চিন্তা ভাবনা কি করে আসতে পারে!! ভালোবাসা মহৎ, যে ভালোবাসে সে কোনো মহাপুরুষের চেয়ে কম উদার হতে পারে না। তাহলে কেনো আজ তার মনে এতো সংকীর্ণ চিন্তা ভাবনা এলো!!
এই সময় টাতে হীরকে সামলানোর দায়িত্ব তার। সে নিজেই যদি এসব ভেবে পিছু হটে যায় তাহলে তার কলিজাকে কে সামলাবে! কে বুঝতে হীরের কষ্ট টা!! সমাজের মানুষতো মেয়েটাকেই কথা শোনাবে। সব দোষ তো মেয়েটারই হবে। ধর্ষকরা মাথা উঁচু করে সম্মানের সাথে বুক ফুলিয়ে হাটবে। আর কিছু কিছু মানুষ তো তার হীরকেই কথা শোনাবে। না না সে ভেঙে পরবে না। কিছুতেই ভেঙে পরবে না। তার হীরের জন্য হলেও তাকে স্ট্রং থাকতে হবে।
তুর্য সবাইকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। যদিও সে জানে পরিবারের কেউই এখন স্বাভাবিক মস্তিষ্কে নেই। তবুও তুর্য হাল ছাড়ে নি। সে হাল ছাড়বে না। তার হীরকে সে কখনই একা ছাড়বে না। সারারাত তুর্য হীরের মাথার কাছে বসে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হীরের গালে চড়ের দাগগুলো কালচে পরে গেছে। তুর্য দাগ গুলোতে হাত ছুইয়ে দিতেই ঘুমের মধ্যে কেঁপে উঠে হীর। হীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বারবার চোখ ভিজে আসছে তুর্য। না জানি কতোটা কষ্ট পেয়েছে তার কলিজা টা। ধীরে ধীরে হীরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে তুর্য।
ঘুমের ঘোরে চোখ দিয়ে পানি পরছে হীরের। হয়তো সেই ভয়ংকর দৃশ্যগুলো মনে পরছে তার। একপর্যায়ে ঘুমের মাঝেই আধো আধো বুলিতে চিত্কার শুরু করে হীর।
"আমাকে ছেড়ে দাও! বাঁচাও আমাকে! ছেড়ে দাও প্লিজ তোমাদের পায়ে পরছি আমি, ছেড়ে দাও!!"
তুর্য হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার কলিজার দিকে। কতোটা কষ্ট পেয়েছে হীর সে ধারণাও করতে পারছে না। ঘুমন্ত হীরকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো তুর্য। তাতেও হীরের অস্থিরতা না কমায় ডক্টর এসে কিছু একটা মেডিসিন দিলে হীর শান্ত হয়ে যায়। বাইরে থেকে নিজেকে যতোই স্ট্রং দেখাক তুর্য কিন্তু ভিতর থেকে হীরের এই অবস্থা টা সে মেনে নিতে পারছে না।
খুব কষ্ট হচ্ছে তুর্যর, হীরকে কিভাবে সামলাবে সে!! কতোটা কষ্ট, কতোটা যন্ত্রনা সহ্য করতে হয়েছে তার হীরকে!!
পরদিন দুপুরের পর দিয়ে হীরের জ্ঞান ফিরে আসে। তুর্য ধারণা করেছিল হয়তো হীর কান্নাকাটি করবে। কিন্তু তাকে আশ্চর্য করে দিয়ে হীর একবারের জন্যও কাঁদে নি। বরং একদম স্বাভাবিক বিহেভ করেছে। যদিও তার ব্যবহার একদম পাল্টে গেছে। কারো সাথে কথা না বলা, তুর্যর সাথে দেখা না করা এগুলোই করছে হীর। তুর্য জানে হীরের সাথে যা হয়েছে তা ভুলে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু হীরকে এভাবে মেনে নিতে তুর্যর ভিতর টা পুড়ে যাচ্ছে। তুর্য অনেকবার চেষ্টা করেও হীরের সাথে কথা বলতে পারে নি।
"
"
পুলিশ রেপিষ্টদের খুঁজে বের করে হীরের সহযোগিতায়। আইনি ভাবে তাদের শাস্তির ব্যবস্থার জন্য উঠে পরে লেগেছে তুর্য। এতোকিছুর মাঝে বেশ কয়েকদিন কেটে যায়। হীরের ধর্ষনের খবর বিদ্যুৎ গতিতে সবার কানে কানে ছড়িয়ে পরে। আর সেই আগের নিয়মে হীরকেই সবাই দোষারোপ করতে থাকে। এতে হীরের বাবা-মা লজ্জায় মাথা উঁচু করতে না পারলেও হীর যেনো গায়ে মাখছে না কিছুই। হসপিটাল থেকে আসার পরে আর নিজের ঘর থেকে বেরিয়েছে বলে মনে পরছে না। সারাদিন নিজেকে ঘর বন্দী করে রাখে হীর। তুর্যর সাথে হয়তো ভুলেও দেখা করে নি একদিনের মধ্যে একবারও। প্রতিদিন তুর্য হীরদের বাসায় এসে রাত পর্যন্ত বসে থেকে চলে যায় কিন্তু একবারের জন্যও হীর দেখা করে নি।
হসপিটাল থেকে আসার পর থেকে হাফসা বেগম হীরের সাথে কোনো কথাই বলেন নি। এবারো মানুষের অপমানের জন্য মেয়েকে দায়ী করেছেন সে। হীরের একটা বোকামির জন্য আজ তার জীবনের এই দশা। মেয়ের কষ্ট হাফসা বেগম বুঝতে পারছেন। মায়ের মন তো সন্তানের জন্য কাঁদবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু হীরের ছেলেমানুষির এতো চড়া দাম দিতে হবে সে এখনও মেনে নিতে পারছা না।
একা আবদ্ধ ঘরে বসে থাকা যেনো এখন হীরের নিত্য দিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সে খুব ভালো করেই জানে তার সাথে যা কিছু হয়েছে তার জন্য প্রধান কারণ সে নিজে। বিয়ের দিন এভাবে না বের হলে হয়তো আজকে এসব হতো না।তার নিজের বোকামির জন্য এসবের সূচনা হয়েছে। আচ্ছা সে মেনে নিয়েছে তার বোকামি ছিল, কিন্তু এটাতো সে চায় নি। কোনো মেয়েই চাইবে না তার সাথে এমনটা হোক। সে তো অনেক মিনতি করেছিল। সেই মিনতিগুলো তো কেউ শুনে নি। তারপরও সেই চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী তার জীবন থমকে গেছে। এখন সে কি করবে? তার কি উচিত ছিল অন্য সবার মতো লজ্জায় ভয়ে আত্মহত্যা করা?
অনেক স্বার্থপর হয়ে গেছে হীর। কিছুদিন আগেও যেই মানুষটার জন্য মরতে গিয়েছিল এখন সেই মানুষটাকে নিজের কাছে থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। সবটাই নিজের স্বার্থে করেছে সে। এটা স্বার্থ না হলে আর কি!
নিজের ভুলের জন্য অন্য কাউকে সে দোষারোপ করে নি। সম্পূর্ণটা নিজেই সয়ে যাচ্ছে। বন্ধ দরজার আড়ালে তার কষ্ট গুলো আর্তচিত্কার গুলো নিজেরধ্যেই দাফন করে নিয়েছে।কাউকে এই কষ্টের ভাগ দেওয়া যাবে না। প্রতি মুহূর্তের দুঃস্বপ্নগুলো কাউকে জানানো যাবে না। সবটা নিজে নিজেই সইতে হবে।
হঠাত বাইরে খুব চেচামেচি শুনে ধ্যান ভাঙে হীরের। চোখের পানি হাত দিয়ে মুছে নিয়ে নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই তুর্য পাঁজাকোলে উঠিয়ে নিয়ে হাটা ধরে। আচমকা সবকিছু হয়ে যাওয়াতে হীর কিছু করতে পারে না। ছাদে নিয়ে এসে হীরকে কোল থেকে নামায় তুর্য। নামিয়ে দিতেই চলে যেতে থাকে হীর। হীরের হাত পিছন থেকে টেনে ধরলে হীর একনজর তুর্যর দিকে তাকায়। তুর্যর দুচোখ টলমল করছে। যেকোনো সময় অশ্রুরাশি বাঁধ ভেঙে বয়ে যাবে। তুর্যর মুখটাও কেমন শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালো দাগ পরে গেছে। বোঝাই যাচ্ছে না জানি কতোরাত ঘুমোয় না। তুর্যকে এভাবে দেখতে পারছে না হীর। চোখ সরিয়ে নিলো।
-- এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিস না। আমি তোকে ছাড়া আর পারছি না। এভাবে আমাকে ফিরিয়ে দিস না। আমি মরে যাবো হীর।
-- হাত টা ছাড়ুন। আর কখনও আমার সামনে আসবেন না।
-- প্লিজ এভাবে বলিস না। তোকে ছাড়া আমি অস্তিত্বহীন। আমার অস্তিত্ব, আমার বেঁচে থাকার কারণ আমাকে ফিরিয়ে দে।
-- এসব বলে আর কোনো লাভ নেই। আমাকে ভুলে নতুন ভাবে জীবন শুরু করুন।
-- তোকে ভুলে যাবো!! নিজেকে ভুলে থাকতে পারলেও তোকে ভুলে কিভাবে থাকবো আমার জানা নেই।
-- শিখে নিন। আমি আর আপনি কখনও এক হতে পারবো না। তাই যতো তাড়াতাড়ি আমাকে ভুলে যাবেন ততোই ভালো।
-- যতোটা সহজে কথা গুলো বলছিস ততোটা সহজে আমার জীবনটাও নিয়ে নে নিজ হাতে! তোকে না পেলে যে মৃত্যুও আমাকে আপন করে নেবে না।
-- এসব কি বলছেন আপনি! থামুন প্লিজ! আমি শুনতে পারছি না এসব। কেনো জোর করছেন? আপনি কি বুঝতে পারছেন না আমি আর আপনার যোগ্য নই। আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আর কিছু বাকি নেই আমার। আমি আপনার জীবনে এসে আপনার জীবন নষ্ট করতে পারবো না।
-- শরীর ই কি সব হীর? আমার কাছে যদি শরীর টাই সব হতো তাহলে একটা ১০ বছরের মেয়ে কে ভালোবেসে ঘর ছাড়তাম না। আমার জন্য আগেও তুই যেমন ছিলি এখনও তেমনি আছিস।
-- না না আমি আগের মতো নেই। কেনো বুঝতে চাইছেন না আপনি আমি আগের হীর নেই। একটা মেয়ের অহংকার তার সতীত্ব। আমার সেই অহংকারটাই শেষ। আপনি পরিপূর্ণ। আমি অপূর্ণ। আমার অপূর্ণতাকে নিজের কাল বানাবেন না দয়া করে। ভুলে যান আমাকে, আমাদের ভালোবাসাকে। সবকিছু ভুলে যান।
কান্না করতে করতে ধপ করে নিচে বসে পরলো হীর। হীরের কান্নায় যেনো আকাশ কেঁপে উঠছে। এতোদিনের জমানো কষ্টগুলো আজ কান্নার শব্দের মাধ্যমে বের হচ্ছে। তুর্য চোখে পানি নিয়ে তার হীরের কান্না দেখছে। অন্যসময় হলে হয়তো হীরকে থামানোর জন্য পাগল হয়ে যেতো। কিন্তু আজ সেও চায় হীর কান্না করুক। এই কান্নার মাধ্যমে যেনো সে তার হীরকে ফিরে পায়। অনেকক্ষণ পর হীরের কান্নার মাত্রা একটু কমে এলে তুর্য হীরকে বুকে জরিয়ে নেয়।
-- আমার পূর্ণতা #সেই_তুমি টা কে নিয়ে।আমার জীবনের অর্ধেক অংশ ছাড়া আমার জীবনের কোনো মানে নেই। সেই অর্ধেক অংশ তুমি। আমার #সেই_তুমি।তোমাকে ছাড়া কোনো পূর্ণতা আমার চাই না। আমার পূর্ণতা দিয়ে নাহয় তোমাকেও পূর্ণ করে দেবো।
-- এ হয় না তুর্য। আমি তোমার জীবন নষ্ট করতে পারবো না। একজন ধর্ষিতাকে বিয়ে করে সারাজীবন পস্তাতে হবে তোমায়। সেটা আমি চাই না। আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম নিজেকে শেষ করে দেবো। এই কলঙ্কিত মুখ আর কাউকে দেখাবো না। কিন্তু আমি পারি নি।
-- হুশ!! তুমি আজও আমার কাছে সেই ৭ বছর আগের হীরের মতোই পবিত্র। আমি জানি আমার কথাগুলো তোমার বিশ্বাস করতে ভীষণ কষ্ট হবে। কিন্তু বিশ্বাস করো, আর কখনও তোমাকে কষ্ট পেতে দেবো না। এটা আমার ব্যর্থতা ছিল আমি তোমাকে প্রটেক্ট করতে পারি নি।
-- আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ। আমি বুঝতে পারি নি একটা বোকামির এতো বড় খেসারত দিতে হবে আমাকে। আমি তোমার জন্য,,
-- আমি সব জানি। আর কিছু বলতে হবে না। তোমার কোনো ভুল নেই। কখন কার সাথে কি হবে এটা কেউ বলতে পারে না। একটা দুঃস্বপ্নের মতো এটা ভাগ্যে ছিল। তাই হয়ে গেছে। অপরাধীরা তাদের কৃতকর্মের সর্বোচ্চ শাস্তি পাবে। আমি তো আছি।
-- আপনি চলে যান তুর্য। আমাকে ভুলে নতুন করে জীবন গড়ুন। আমি আপনার যোগ্য নই। এই সমাজ আমাকে কখনও মেনে নেবে না। চাচি আমার মতো একটা মেয়েকে তার ছেলের বউ কখনই করবেন না। সব ভুলে যান তুর্য।
কথাগুলো বলে হীর সেখান থেকে পালিয়ে নিচে এসে পরে। তুর্য বারবার ডাকলেও আর সাড়া দেয় না।


Post a Comment

0 Comments

Close Menu