লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা

🚫🚫
কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।
🚫🚫
দিনাজপুরের পার্বতিপুর শহরের হাইওয়েতে নেমে এল এক অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্যোগের ভয়াবহ মর্মন্তুদ দৃশ্য। সিলিন্ডারের বোঝাই বিশাল এক ট্রাকের অকস্মাৎ মহাবিস্ফোরণ কেঁপে উঠল গোটা রোড। লেলিহান শিখায় প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠল ধূলিধূসরিত প্রকৃতি, অগ্নিদাহে পরিণত হলো জনমানব। এক মুহূর্তের তাপে গলিত লোহা হয়ে রাস্তাজুড়ে বিচ্ছুরিত হতে লাগল ক্রন্দনধ্বনি।
টেলিভিশনের পর্দাজুড়ে এই সংবাদ প্রবলভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, প্রতিটি চ্যানেল এ সংবাদকে প্রচার করছে, বেদনার কালো শঙ্খধ্বনি বাতাসে ঘুরে ঘুরে এক অভিশপ্ত গাথা বয়ে চলেছে।
ধ্বংসস্তূপে পরিণত, বুকে জ্বলন্ত অগ্নিশিখায় পুড়ে ছাই হলো মানবতার করুণ দৃশ্যপট। বিশাল বিস্ফোরণের বিভীষিকায় ছিন্নভিন্ন হলো অজস্র প্রাণ, চিরস্থায়ী দগ্ধ দেহের অনির্বাণ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা মৃ'ত ও অর্ধমৃ'ত মানবশরীর। অগ্নিদগ্ধ মাং'সের গন্ধ বাতাসে সঞ্চারিত হয়ে বিষণ্ণতার বিষাদ রচনা করছে চারিদিকে, যেন মৃতদের আত্মা ধ্বনিত করছে এক অদৃশ্য আর্তনাদ।
র'ক্তপথে পড়ে থাকা সাত বছরের ছোট্ট পথিক শিশুর নিথর দেহ পায়ে পি'ষে যাচ্ছে দৌড়ে পালাতে চাওয়া আতঙ্কিত জনতা; জীবন-মৃ'ত্যুর মাঝে ক্ষণিকের বিচ্ছেদে সকল সহানুভূতি মুছে গেছে, কেবল রয়ে গেছে প্রাণপণ ছুটে চলার সংগ্রাম। এম্বুলেন্সের কর্কশ সাইরেনে হাসপাতালগুলোর প্রাঙ্গণ ভরে উঠছে পরাভূত মানুষের হাহাকারে। রুগ্ন ও আর্তনাদময় এ দৃশ্যপট তামসিক এক রূপকথা।
হাসপাতালের দ্বারে স্তূপাকারে শায়িত দেহগুলোর মধ্য থেকে, এক মায়ের হৃদয়বিদারক আর্তনাদ ওঠে,
———"আ-আমার মে-মেয়েটার মাথা কই? আল্লাহ! আমার নিষ্পাপ ফুলটাকে তুমি কোথায় নিয়ে গেলে?"
মাত্র দশ টাকা নিয়ে ক্ষুদ্র চাওয়ার আনন্দে দোকানে পা বাড়ানো সেই শিশু আর ফেরেনি; বিস্ফোরণের অগ্নিকুণ্ডে তার ছোট্ট শরীরের টুকরোগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে র'ক্তস্নাত পথজুড়ে, যে দৃশ্য বর্ণনাতীত বেদনার প্রতীক হয়ে বিরাজ করছে।
পুলিশ এসে সর্বতোভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু কোনো নিয়মের শাসন আর কার্যকর নয় এই ত্রাসের আবর্তে। হাসপাতালের চিকিৎসকরা জীবনের শেষ সীমায় পৌঁছে প্রাণপণ সেবা দিতে ব্যস্ত!
______
হাসপাতালের অশ্রুত কোলাহলে মুগ্ধের অন্তরাত্মা দহনজ্বালা অনুভব করছে। রাগে তার চক্ষু প্রায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নিক্ষেপ করছে যেন। তপ্ত শীতলতার প্রেক্ষাপটেও তার শরীর ঘামে জড়িয়ে গেছে। কপাল বেয়ে ঘাম বিন্দু বিন্দু গড়িয়ে পড়ছে; গাত্রের নিপুণ কায়া তীব্র ক্ষোভের উত্তাপে আরও দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। পাশে দাঁড়ানো রুদ্রও শীতলতার মাঝেও অশান্ত, উৎকণ্ঠায় ছটফট করছে। ক্রমাগত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেদনার মর্মবেদনা আড়াল করার বৃথা চেষ্টা করছে। আর মহুয়া? মাথা নিচু করে নীরবতার গাম্ভীর্যে দাঁড়িয়ে আছে।
মুগ্ধ চিৎকারে প্রকম্পিত হলো, দৃষ্টিতে বজ্রশাসন,
——— "যে করেই হোক! যেভাবেই হোক! তাকে বাঁচাতে হবে! She is a dangerous criminal! তার থেকে আমাদিগের অজানিত তথ্য উদ্ধার করা এখন জরুরি!"
চিকিৎসকের মুখশ্রীতেও তখন আতঙ্কের ছাপ। কাঁপা কণ্ঠে তিনি উত্তর দিলেন,
——— "স্যার, রোগিণীর অবস্থা সঙ্কটজনক! আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি।"
——— "আমারা কোনো বাহানা শুনতে চাই না!"
এবার মুগ্ধের চৈতন্যের রোষ থেমে থাকলো না। মনোসংযোগ ছিন্ন হলো না, বিরক্তিতে প্রক্ষিপ্ত হলো পরিবেশ। প্রাঙ্গণের কোণে কোণে ভেসে আসছে র'ক্তরঞ্জিত স্বজনদের হাহাকার, দুর্ঘটনাপ্রাপ্তদের বিলাপ। এই দুর্ভাগ্যের দৃশ্যপটের ভিতর দিয়ে একটি অপরাধীর প্রাণরক্ষা; ভাবলেই তার হৃদয় আরো রুষ্ট হয়। চিকিৎসক বিস্ময়ে অস্থির হয়ে অপারেশন থিয়েটারে দ্রুত অদৃশ্য হলেন।
চিকিৎসক প্রস্থান করার পরপরই মহুয়া কাঁচুমাচু ভঙ্গিমায় মুগ্ধের কাছে এলো, অপার্থিব ভয়ে আমতা আমতা করে বলল,
——— "স... স্যার! আমি সত্যিই বুঝতে পারি নি!"
মুগ্ধের কণ্ঠ বজ্র, কঠোর দৃষ্টি আর তীব্রতায় পরিপূর্ণ; রাগমিশ্রিত বিরক্তির সূরে ধমক দিলো,
——— "Shut up... Idiot! একজন অপরাধীকে ধরে রাখতে পারো না! সিআইডিতে জয়েন করার সাহস দেখিয়েছিলে কেনো? বাইরে যাও!"
মহুয়া শিউরে উঠলো, দৃষ্টিতে আতঙ্কের ছায়া। শরীর নিঃশব্দে কেঁপে উঠলো, তবে ভয়ে কোনো শব্দ করল না। মৃদু কণ্ঠে শুধুমাত্র একটি ক্ষীণ শব্দ উচ্চারণ করলো,
——— "স্যার..."
——— "Out...!"
দাঁতে দাঁত চেপে মুগ্ধ সোজাসুজি আদেশ করল। নিরুপায় মহুয়া সরে গিয়ে রুদ্রের পেছনে দাঁড়িয়ে গেলো। রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুগ্ধকে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জানাল,
——— "স্যার, তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেছি। তারা আসছে, জানিয়েছে।”
মুগ্ধ কপালের ঘাম মুছে, দৃঢ় কণ্ঠে নির্দেশ করল,
——— "হুম! এ বিষয়ে নিশ্চিত হও, যেনো পুলিশের কঠোর পাহারা চব্বিশ ঘন্টা থাকে!"
~ কিছুক্ষণ আগের ঘটনা ~
——— “স্যার, গাড়ি কেন বদলালেন?”
রুদ্রের কণ্ঠে জিজ্ঞাসার ছাপ, যদিও তা ছিল বিস্ময়ের এক সূক্ষ্ম সুরে বিন্যস্ত। মুগ্ধ কোনো উত্তর না দিয়ে অন্য এক গাড়ির চালকের আসনে নিজেকে স্থাপন করল, স্থিরপ্রতিজ্ঞ নিয়তির কুশীলব। রুদ্রও নিরব সম্মতিতে তাঁর পাশের আসনে গমন করল।
পিছনের সিটে মহুয়া বসে আছে, ভয়ে সজাগ এক বিপন্ন চিত্রলেখা। তার গাঢ় শ্বাসপ্রশ্বাস ভাঙা বৃষ্টিধারার নৈঃশব্দ। আফিয়া বেগমের কণ্ঠরুদ্ধ হাসি ও বক্র ঠোঁটের রেখায় ছলনায় মাখা বিদ্রুপ। তাঁর হাতে শোভা পাচ্ছে হ্যান্ডকাফ, যা ন্যায়ের শৃঙ্খলে এক তুচ্ছ শিকলমাত্র। মুগ্ধ হিমগম্ভীর কণ্ঠে গাড়ির ইঞ্জিনে প্রাণ সঞ্চার করল!
——— “এত বড় অপরাধী কখনো একক নয়। তার প্রতিটি পদচিহ্নে সহযোগীর ছায়া। তারা তাকে রক্ষা করতে উঠেপড়ে লাগবে। তাই আমাদের পথও হতে হবে অপ্রত্যাশিত।”
রুদ্র তখন মুগ্ধের কৌশলের গভীরতা অনুধাবন করে দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করল। চোখে ফুটে উঠল প্রশান্তি। কণ্ঠে স্বস্তির প্রলেপ মেখে বলল,
——— “তবে স্যার, রাস্তাও বদলাতে হবে।”
মুগ্ধের কণ্ঠস্বর তখন শিলার মতো কঠিন, শীতল এবং অসীম আস্থায় গাঁথা,
——— “সে বিষয়ে সংশয়হীন থাকো।”
এরপর নিঃশব্দে গতি নিল গাড়ি। অন্ধকার শহরের অন্য এক পথ বেয়ে তারা ছুটে চলল। গন্তব্য—বিউরো।
মহুয়া, এক অসহায় পলাতকা শিকার যেনো, থরথর কম্পমান, তার সমস্ত অস্তিত্ব আতঙ্কে বন্দি। আর আফিয়া বেগম, চুপচাপ বসে থাকা সেই ধূর্ত নারী, যার প্রতিটি হাসি বিষাদে মেশানো ষড়যন্ত্রের বিমূর্ত রূপ। চোখের গভীরে অন্য মহাযুদ্ধের সংকেত।
ধূলি ও ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছড়িয়ে উদ্দাম গতিতে ছুটে চলেছে গাড়ি, অদৃশ্য অভিশাপ তাড়া করছে। এ যাত্রা উল্টোপথের বিধি ভাঙায় দুর্বার, সিআইডি বিউরোর দিকে ধাবমান, সময়ের সাথে অসম লড়াই। ব্যস্ত শহরের কোলাহলে এখন বিউরোর নিকটবর্তী হয়ে এসেছে। গাড়ির অন্তঃস্থলে বসে থাকা আফিয়া বেগম স্থিত, নিস্তরঙ্গ মহাসমুদ্রের মতো শান্ত।
অচানক, তিনি মহুয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তার ঠোঁটের কোণে এক শয়তানি হাসি, অপূর্ণ ষড়যন্ত্রের প্রতিচ্ছবি। নিঃশব্দে, গভীর কণ্ঠে, মহুয়ার কানে তিনি শুধুমাত্র একটি বাক্য উচ্চারণ করলেন, যা মহাকালের স্তব্ধতায় প্রতিধ্বনিত হলো,
———"খেলা এখনো শেষ হয়নি।"
এই ঘোষণা অনিবার্য প্রলয়ের সূচনা। মুহূর্তের মধ্যেই তিনি মহুয়ার দিকে সমস্ত শক্তিতে আঘাত হেনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন, হাত থেকে হ্যান্ডকাফ খুলে দিলেন। ছিটকে গেলো মহুয়া! এ ঘটনায় ভীতবিহ্বল মহুয়া কিছু বুঝে ওঠার আগেই, আফিয়া বেগম চলন্ত গাড়ির দরজা হাট করে খুলে ঝাঁপ দিলেন!
অমনি ভাগ্যের নিষ্ঠুর খেয়ালে, তার শরীর সজোরে আঘাত করল এক বেপরোয়া চলন্ত ট্রাকের ধাতব দেহে। আঘাতের তীব্রতায় তিনি ছিটকে পড়লেন সামনের একটি দ্রুত চলমান আসতে থাকা মাইক্রোবাসের ওপর, আর সেখান থেকে সড়কের বুকে আছড়ে পড়লেন, বিধাতার নির্মম এক চিত্রকল্প। র'ক্তস্রোতে সিক্ত, তার দেহটি কাতরাতে লাগল, এক বিভীষিকাময় দৃশ্য রচনা করে।
আকষ্মিক সমগ্র ঘটনা এতটাই ক্ষিপ্রতায় ঘটল যে, মুগ্ধ তিব্র বিষ্ময়ে করা ব্রেক চাপল, গাড়ির চাকা রাস্তার ওপর দীর্ঘ একটি কালো দাগ রেখে থমকে দাঁড়াল। পিছনে ফিরে তাকিয়ে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,
———"ওহ শিট!"
তৎক্ষণাৎ, হন্তদন্ত হয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল মুগ্ধ। রুদ্র ও মহুয়া পেছনে পেছনে ছুটে আসল। রাস্তার ব্যস্ততা থেমে গেছে, চারপাশে মানুষের ভিড় জমে উঠেছে।
র'ক্তের বন্যায় ভাসতে থাকা আফিয়া বেগমের ঠোঁটে একটি নিঃশেষিত হাসি। সেই হাসির অন্তরালে লুকিয়ে আছে শতাব্দীর গোপন রহস্য! হাসতে হাসতেই চোখ দুটি বুজে ফেললেন তিনি!
ঠিক তখনই মুগ্ধর ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে এসিপি মুযহাবের নাম জ্বলজ্বল করছে। তৎক্ষণাৎ ফোনটি কাঁপা হাতে রিসিভ করল মুগ্ধ। ফোনের ওপাশে মুযহাবের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ ভেসে এলো,
——— “মুগ্ধ? তোমরা ঠিক আছো তো? হাইওয়েতে সিলিন্ডারবাহী ট্রাক বিস্ফোরণে প্রচণ্ড ক্ষতি হয়েছে! বহু মানুষ আহত-নিহত হয়েছে। সেই পথেই তো আসার কথা ছিল তোমাদের! কোথায় তোমরা?”
_____________
——— "ও বাবা গো, বাবাজান!
কষা ধরছে প্রাণ?
টয়লেটে বসে বসে
করছ কি ধ্যান?
ডেডি গো, ডেডি আমার
হাঁপাচ্ছ কেন এত?
কষার টানে নাকি গো
বেঁকে গেছে পেট?
ও বাবা, শুনি শুনি
করছ কি "আঃ আঃ"?
বাইরে এসে দেখি না
হয়েছে কি "হাঃ হাঃ"!
ওরে বাবা, বাবাজান
এত কষ্ট কেন?
পেটের ভিতর নাকি গো
চলছে রণরণ?
খুলো খুলো দরজাটা
দেখি কেমন হাল!
কষার টানে নাকি গো
ফিকে হল গাল?
ডেডি গো, ডেডি আমার
থাকছ কেন চুপ?
কষার সাথে যুদ্ধেতে
হারলে নাকি খুব?
এই যে আমি দাঁড়িয়ে
দরজার কাছেতে,
তোমার কষ্ট দেখে যে
পারছি না থাকতে!
দরজা খুলে বাইরে এসো
হবে সব ঠিক,
নাকি গো এখন তুমি
"বিজি" তে "ক্রিটিক"?"
দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে রোহান ফের বলল,
——— "ওয়াহ ওয়াহ! দেখেছো আমি কি শায়েরি টা বললাম! আমার ডেডির প'টি ক'ষা নিয়ে! হিহিহিহি! "
রোহান ক্রমাগত রুদ্ধশ্বাসে ওয়াশরুমের দরজায় আঘাত হেনে যাচ্ছে, কণ্ঠস্বরে অধীরতার এক নির্মম আর্তি। অন্তর্গত সেই দরজার ওপারে বন্দি তার পিতা। দশ মিনিট পেরিয়ে গেছে, রোহানের চিৎকারে সমগ্র বাড়ির বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। অপর প্রান্তে, ড্রয়িং রুমে বসে রোহানের মা মিথিলা বেগম উদাসীনভাবে টেলিভিশনের পর্দায় সংবাদমালা পর্যবেক্ষণ করছেন, যেন বাড়ির কোলাহল তার মনোযোগের গন্ডি স্পর্শ করতে ব্যর্থ।
রোহান আবার আঘাত করে, এবার কণ্ঠস্বর আরও তীক্ষ্ণ,
——— “ডেডি! তোমার প'টির কাজ শেষ হয়নি এখনো? তুমি কি আসলেই ভেতরে আছো, নাকি পালিয়ে গেছো?”
বিস্ময়কর তৎপরতায় ওয়াশরুমের দরজা খুলে যায়। রোহানের বাবার মুখে জ্বলন্ত ক্রোধের ছায়া, দৃষ্টিতে বজ্রপাতের সম্ভাবনা। তিনি রোহানের ঘাড় চেপে ধরে মৃদু কিন্তু সুতীক্ষ্ণ স্বরে বলেন,
——— “ জুতো চিনিস.? বেয়াদব ছেলে! তোর এই নৈতিক অধঃপতন আর সীমালঙ্ঘন দেখে আমার র'ক্তে আগুন লাগে! মানুষ টয়লেটেও শান্তি পাবে না?”
রাগের ঝাঁঝ নিয়ে তিনি হাঁটতে শুরু করেন। রোহান পিছনে খিলখিল হাসিতে মত্ত। ইয়াকুব আলী গর্জে উঠে রোহানের মা'কে উদ্দেশ্য করে বলেন,
——— “এই তোমার বেয়াদব ছেলেকে সামলাও! কপাল খারাপ হলে যা হয়, টয়লেটেও এখন মানুষ নির্বিঘ্ন থাকতে পারে না! ঘরেও শান্তি নেই! টয়লেটেও নেই! "
মিথিলা বেগম একটিবার চোখ তোলে তাকাননি। আপেলের প্রতিটি কামড়ে যেন তিনি মহাজাগতিক ধ্যানমগ্নতায় নিমগ্ন। আর রোহান? সে তো পিতার পিছু পিছু উচ্ছল প্রাণবন্ততায় এগিয়ে যায়। ড্রয়িং রুমে পৌঁছে, রোহানের বাবার ধৈর্য শেষ হয়ে এলো। এবার তিনি রোহানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন,
——— “বল তো, কী চরম পাগলামি করতে চাইছিস এবার?”
রোহান তার বাবার কানের কাছে মুখ এনে মৃদু কৌতুকমিশ্রিত স্বরে ফিসফিস করে বলে,
——— “তোমার পকেটে সিগারেট পেয়েছি, বাবু। এখনি হাজার টাকা দাও, নাহলে মায়ের কাছে সব ফাঁস করে দেব! তারপর বুঝবে জীবন কীভাবে বিপন্ন হয়! ঝাটাপেটা করে বের করবে তোমায়! হু হাহ হা!"
কথা শেষ করে সে লাফ দিয়ে মায়ের পাশে সোফায় বসে পড়ে। ইয়াকুব আলী হতবাক, তার মুখে এমন এক বিস্ময়ের রেখা খেলে যায় যেন তিনি পৃথিবীর সমস্ত রহস্যের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। স্ত্রী যদি জানে, তাহলে বাড়ি থেকে বের করে দিতে বাকি রাখবে না। আর এই ছেলে! অস'ভ্য দুষ্টতার পাগল রাজপুত্র।
রোহান এবার মায়ের কোলে মাথা রেখে বলে,
——— “মা! জানো, বাবা তোমাকে নিয়ে একটা কথা বলছিল...”
ইয়াকুব আলীর হৃৎপিণ্ড থেমে যাওয়ার উপক্রম। তিনি তৎক্ষণাৎ টেলিভিশনের সামনে দাঁড়িয়ে বলে ওঠেন,
——— “এই! থাম,, থাম! আর কিছু বলার দরকার নেই!”
মিথিলা বেগম, দৃপ্ত দৃষ্টিতে কপালে ক্রোধের রেখা স্পষ্ট করে বললেন,
——— “উহ, সরে যাও তো বুড়ো! তোমার ভুড়ি দেখব না, খবর দেখব, সরো!”
ইয়াকুব আলী অনিচ্ছায় একপাশে সরে গিয়ে রোহানের দিকে তীব্র দৃষ্টিপাতে বিদ্ধ করলেন। সেই দৃষ্টিতে অজস্র তিরস্কারের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। মিথিলা বেগম তখন টেলিভিশনের পর্দায় দৃশ্যমান সড়ক দুর্ঘটনার খবর দেখে বিষণ্ণ স্বরে বললেন,
——— “দেখলে! আবারও এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। কি যে হচ্ছে চারদিকে! এই চালকেরা কি কখনও শৃঙ্খলায় আসবে না?”
রোহান মায়ের কোলে শুয়েই দুরন্ত হাসির আভাসে বাবার দিকে ভেংচি কাটল। তারপর কৌতুকমিশ্রিত এক নাটকীয় সুরে বলল,
——— “আজ আমাদের বাড়িতেও একটা এক্সিডেন্ট ঘটবে, জানো? আর একজনকে হাসপাতালে যেতেই হবে!”
রোহানের মা হঠাৎ চমকে উঠলেন। তার অভিজ্ঞ চোখে উৎকণ্ঠার সুর। তিনি ভ্রু কুঁচকে সন্তানের শরীর-মন সব দিক থেকে পরীক্ষা শুরু করলেন। ভয়-আতঙ্কে কম্পিত হয়ে প্রশ্ন করলেন,
——— “এক্সিডেন্ট মানে কী? তোর শরীর ঠিক আছে তো, আব্বা? তুই ঠিক আছিস?”
রোহান সমস্ত আদুরে কপটতা নিয়ে নিজেকে সরিয়ে নিল, যেন এক নিষ্পাপ প্রহসনের চরিত্র। তারপর বাবাকে লক্ষ্য করে হালকা হেসে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
——— “আমি তো পুরো ঠিক আছি, আম্মা। তবে আরেকজন যে বেঁচে ফিরবে কিনা, সে তো তারই সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। যদি সে যা চাওয়া হয়েছে, তা দিয়ে দেয়, তবেই তার প্রাণ রক্ষা পেতে পারে!”
এই কথায় ইয়াকুব আলীর মুখ পাংশু হয়ে উঠল। একদিকে সন্তানের বুদ্ধিদীপ্ত দস্যিপনা, অন্যদিকে স্ত্রীর ক্রুদ্ধ নজর, এ দুইয়ের সম্মিলিত দংশন তাকে জীবন্ত শোলে পরিণত করেছে।
মনে মনে তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, "কক্ষনো, আর কক্ষনো সিগারেটের নামও নেব না। এই দুষ্ট ছেলের কাছে আরও একবার পিষ্ট হব, তার আগেই এ অভ্যাস ছেড়ে দেব।" তবু আজকের পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পেতে হবে।
গলা খাঁকারি দিয়ে তিনি স্ত্রীকে মিষ্টি স্বরে বললেন,
——— “শুনলে? তোমার জন্য একটা ছোট্ট চমক আছে। ঘরে গিয়ে দেখো, সাদার উপর নীল নকশার যে শাড়িটা চেয়েছিলে, সেটা নিয়ে এসেছি। আর সঙ্গে একজোড়া নূপুরও আছে, তোমার পছন্দের। যাও তো, গিয়ে দেখো।”
মিথিলা বেগমের চোখে একরকম অদ্ভুত দীপ্তি খেলে গেল। বয়সের পরিসীমা যতই অনন্তের দিকে গড়াক না কেন, হৃদয়ের সেই অমলিন যৌবন যেন এখনও স্বপ্নের মতো টিকে আছে। তার স্বামী আর পুত্র, এই দুই পুরুষ, তাকে আজও নববধূর পুতুলের মতোই সাজিয়ে মাথায় তুলে রাখে!। এমন এক অপরিসীম আনন্দের অনুভূতিতে তিনি নিমজ্জিত, যা শব্দে প্রকাশের অতীত। তবে এই আনন্দের মাঝেও তার আবদারের অন্ত নেই। স্বামীর কাছে চাওয়া-পাওয়া, তার মনোযোগের নান্দনিক শৈল্পিকতা, সবসময় তাকে এক পরম স্বাচ্ছন্দ্যে ঘিরে রেখেছে।
তিনি এক পলক স্বামীর দিকে চাইলেন। মুখে লুকানো একটি ক্ষুদ্র ভেংচি, আধো মজা, আধো রাগের ইঙ্গিত বললেন,
——— “একটা শাড়ি চেয়েছি পুরো এক সপ্তাহ আগে, আর এখন এনেছে! ইচ্ছা করলেই না কি বুড়োদের মাথা খাওয়া যায়!”
তবু, এই কথার তলায় সযত্নে লুকানো অকৃত্রিম ভালোবাসা। এই মানুষটাই তো তাকে এতগুলো বছর ধরে তিলে তিলে আগলে রেখেছে। আর ছেলে রোহান? তার তো সবটুকুই রঙ্গ-রসিকতায় মোড়া। মনে মনে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। "ইশ, এই ছেলেটা যদি একটা বিয়ে করত! কোনো মেয়ে যদি আসত ঘরে! দুজনে মিলে এই বুড়োকে খোঁচানোর এক নতুন অধ্যায় শুরু করতাম।"
কল্পনায় তার চোখে ভেসে উঠল সেই অজানা পুত্রবধূর মুখ। সেই হাসি-ঠাট্টার মুহূর্ত। কিন্তু বাস্তবতা টেনে নামাল তাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিলেন তিনি। আজকের মুহূর্তটাকে উপভোগ করাই শ্রেয়।
আনন্দের আতিশয্যে তিনি দৌড়ে ঘরের দিকে ছুটলেন। মনে মনে উচ্ছ্বাস। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে পাওয়া সেই শাড়ি। তার পছন্দের সাদার উপর নীল নকশা। আর নূপুর! কানের কাছে অলীক শব্দ ভেসে এলো, ছন ছন ছন ছন!
পিছনে স্বামী ও পুত্রের দিকে একবার তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন,
——— “দেখো, এখন আমি কিন্তু সুন্দরী হয়ে যাচ্ছি। তোমরা কিন্তু আমার কাছে হেরে যাবে!”
এই মৃদু হাসির পেছনে জড়িয়ে রইল এক পৃথিবী উষ্ণতা। এই মানুষগুলোই তার পৃথিবী, আর তিনি এই পৃথিবীর প্রিয়তমা নায়িকা।
রোহান মৃদু মৃদু হাসি হেসে বলল,
——— "আমার মা-ই পৃথিবীর পরম সুন্দরতম নারী।"
তবে সামনে তাকাতেই চোখে পড়ল ইয়াকুব আলীর লালিমা কঠোর মুখাবয়ব, দৃষ্টিতে শাসনের বজ্রধ্বনি।
রোহান সঙ্গে সঙ্গে ভঙ্গি পাল্টে বলল,
——— "বউকে সামলাও, বুড়ো ডেডি। সাবধান থেকো, কেউ তুলে নিয়ে যেন না যায়।"
ইয়াকুবের চেহারায় ক্রোধের রেখা আরো গাঢ় হলো। কি বেয়াদব ছেলে! বাবার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় এখনো শিখেনি দামড়া ছেলেটা! কণ্ঠ গম্ভীর, ধমকে বললেন,
——— "চ'রিয়ে দাঁত ফেলে দিব এক্ষুণি! বাবার সঙ্গে এভাবে কথা বলিস? অ'স'ভ্য, লাগামহীন ছেলে কোথাকার!"
রোহান দন্ত বিকশিত করে খিলখিলিয়ে বলল,
——— "টাকা দাও, ওহে বুড়ো পুরুষ। টাকা দাও, নইলে আমার অতুলনীয়া মাকে সব বলে দেব।"
এইতো! এই এক স্থানেই তিনি নিরুপায়! অসহায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইয়াকুব পকেট থেকে বের করলেন চকচকে এক হাজার টাকার নোট। রোহান তৎক্ষণাৎ সেই নোট হাতিয়ে নিয়ে উচ্চস্বরে বলল,
——— "দেখো, বউয়ের জন্য শাড়ি এনেছো! অথচ আমি পোলাও-মুরগি খেতে চেয়েছিলাম, তা আনোনি। শাস্তি ভোগ তো করতেই হবে!"
বলেই লুঙ্গির প্রান্ত ধরে ছুটে পালাল রোহান।
রোহান দিগন্তে মিলিয়ে যেতে যেতে ইয়াকুবের মুখে ফুটে উঠল এক রাশ নীরব হাসি। এই পাগল ছেলেটাই তো ঘরটাকে জীবন্ত রাখে। দিনের পর দিন বাইরে কর্মব্যস্ততায় ক্লান্ত দেহটায় জীবনের সঞ্জীবনী সুধা ঢেলে দেয় তার এই উদ্ভট আচরণ। রোহানের মায়ের হৃদরোগ আছে। তাকে হাসিখুশি রাখা ছেলের নিত্যকার কর্তব্য। স্ত্রীর সকল ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে তিনি নিজেও পরিণত হয়েছেন অবিচল এক সেবকে।
তবু, এক বুক ভারী শ্বাস ফেলে ইয়াকুব মনে মনে বললেন,
——— "কিন্তু ছেলের অন্তরের শূন্যতা, সেই অতল কষ্ট আমি মুছতে পারলাম না। যে মেয়েটিকে ভালোবেসেছিল, তাকে এনে দিতে পারলাম না!"
ধীরে পা বাড়িয়ে ঘরে ঢুকে দেখলেন, মিথিলা বেগম সদ্যপ্রাপ্ত শাড়িটির ভাঁজ খুলে দেখতে ব্যস্ত। মৃদু হাসিতে তার চোখের কোণে জমল সুখের রেখা। ইয়াকুব আলী শান্তভাবে বললেন,
——— "আমার জীবনে বুঝি আর শান্তি রইল না!"
কিন্তু হৃদয়ের এক কোণে জমে থাকা ভালোবাসার স্রোত বলল,
———" এই দুষ্টু ছেলে, এই রাগী বউ আর এই উদ্ভট সংসারই তো আমার পরম শান্তি।"
_____________________
রাতের গভীরতা নিকষ কালো মেঘের অন্তর্গত মর্মরধ্বনি। কনকনে হাওয়ার শিহরণে জাগ্রত সিআইডি বিউরোর স্থবিরতায়, প্রত্যেক মুখের রেখায় গম্ভীরতার ছায়াপাত। এসিপি মুযহাব, দৃঢ় অথচ গভীর চিন্তায় নিমজ্জিত, ধীর স্বরে উচ্চারণ করলেন,
——— “এই আফিয়া বেগম কেন বা কী কারণে নিজের জীবনের প্রদীপ নিবিয়ে দিতে চাইলেন? এর অন্তর্গত অর্থ কী, মুগ্ধ?”
মুগ্ধ, স্বাভাবিকতাকে ছাপিয়ে অভিজ্ঞানী, তার কথায় গভীর স্থিরতা ও নিপুণ বিচারবুদ্ধির পরিচয় মিলল,
——— “স্যার, উনি একজন অপরাধী; তবুও জীবন বিসর্জনের প্রচেষ্টা কি ইঙ্গিত দেয় না এমন কোনো সত্যের, যা প্রকাশ পেলে কোনো শক্তিশালী পাণ্ডার মুখোশ খসে পড়বে? উনি হয়তো সেই ভার বহন করতে নারাজ। একথা উপেক্ষা করার কোনো পথ নেই।”
রুদ্র, তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণের সূক্ষ্ম প্রজ্ঞা নিয়ে, কথার পাথরে আঘাত হেনে বলল,
——— “স্যার, আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই সড়ক দুর্ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত। তদন্তে জানা গেছে ড্রাইভার নেশাগ্রস্ত ছিল। কিন্তু কোনো পেশাদার চালক, বিশেষত সিলিন্ডার বোঝাই ট্রাকের চালক, এমন ঝুঁকি নিয়ে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কেন গাড়ি চালাবে? এ কেবলই দুর্ঘটনা নয়, এর মূলে গভীর ষড়যন্ত্রের ছায়া আছে।”
মুগ্ধ এক পলক থেমে সায় জানিয়ে বলল,
——— “হুম! প্রথমে আমাদের আফিয়া বেগমকে সুস্থ অবস্থায় আনতে হবে। তাঁর কাছ থেকেই আমরা এই জটিল গূঢ় সত্যের খোঁজ পাব।”
মুযহাব সাহেব, তাঁর মুখের গম্ভীর রেখা স্পষ্টতর করে, গালে হাত রেখে চিন্তায় মগ্ন হলেন। এরপর ধীর অথচ দৃঢ় স্বরে বললেন,
——— “আফিয়া বেগমের পেছনে নিঃসন্দেহে এক দক্ষ ষড়যন্ত্রী আছে। সেই ব্যক্তি হয়তো তাঁকে সরিয়ে ফেলার মাধ্যমে আমাদের থেকে সত্যকে দূরে রাখতে চেয়েছে!”
মুগ্ধ, নিজের আত্মবিশ্বাস আর অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে বলল,
——— “পুলিশি পাহারা নিশ্চিতভাবেই ২৪ ঘণ্টা চলছে, স্যার। যতক্ষণ না পর্যন্ত আফিয়া বেগমের চেতনা ফিরে আসে এবং আমরা তাঁর মুখ থেকে রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারি, ততক্ষণ এই কেস কোনোভাবেই বন্ধ হবে না।”
ভারী আবহে এক অস্বস্তিকর মুহূর্তে সিআইডি বিউরোর দরজা খুলে মাথা নিচু করে কাচুমাচু ভঙ্গিতে প্রবেশ করল মহুয়া। তার মুখের অসহায়তা দেখে মুহূর্তে ঘরে জমাট রাগের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল। এসিপি মুযহাবের কঠোর চোখে আগুনের ঝিলিক, আর মুগ্ধর গভীর ক্রোধ নীরব অগ্নিকুণ্ডে পরিণত। ওদের চোয়ালে জড়তার কোনো স্থান ছিল না। মহুয়ার দোষেই এত বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে।
রুদ্র, যাকে পরিস্থিতি চিরকাল অটল থাকতে শিখিয়েছে, সেই রুদ্রও আজ ভারাক্রান্ত। তার হৃদয়ে দ্বিধা আর প্রেমের টানাপড়েন স্পষ্ট। নিজের প্রেমিকার এই করুণ দশা দেখে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কিন্তু তার অভিব্যক্তি দৃঢ়।
মহুয়া, মাথা আরও নিচু করে, প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল,
——— “স্যার, ডেকেছেন?”
মুযহাব সাহেবের গম্ভীর স্বর যেন বজ্রপাত,
——— “হ্যাঁ, ডেকেছি। আর যেন দ্বিতীয়বার ডাকতে না হয়, মহুয়া!”
মহুয়া বিস্মিত দৃষ্টিতে মাথা তুলল,
——— “মানে?”
মুযহাব কঠোরতায় কোনো ছাড় না দিয়ে বজ্রকঠিন স্বরে বললেন,
——— “তোমাকে তিন দিনের জন্য বরখাস্ত করা হলো। আর তোমার মুখটাও যেন না দেখি। এখনি বেরিয়ে যাও!”
মহুয়ার চোখে জমে উঠল ব্যর্থতার টলমল জল। তার ঠোঁট কাঁপতে লাগল, আর সরে আসা গলার স্বরে সে বলল,
——— “স্যার, ভুল হয়ে গিয়েছে। আমি কথা দিচ্ছি, আর এমন কখনো হবে না।”
এসিপির চোখে মমতার বিন্দুমাত্রও দেখা গেল না। তাঁর কণ্ঠ আরও তীক্ষ্ণ হলো,
——— “তুমি যদি এখনই না বের হও, তবে বরখাস্ত স্থায়ী করে দেব!”
মহুয়া, এক অসহায় আর লাঞ্ছিত হৃদয়ের প্রতীক হয়ে, চোখের জল মুছে একবার রুদ্রের দিকে তাকাল। রুদ্র, যার দৃষ্টি সবসময় সজাগ, আজ তার চোখে শুধু প্রতিশ্রুতি। এক অনুচ্চারিত আশ্বাস মহুয়ার ভাঙা মনকে সামান্য শক্তি দিল।
কিন্তু এ মুহূর্তে তার থাকার অধিকার নেই। মহুয়া মাথা নিচু করে, থমকে থাকা পায়ে, বেরিয়ে গেল সেই রুদ্ধদ্বার কক্ষ থেকে।
মুযহাব সাহেব, যার ভেতরে চাপা আগ্নেয়গিরির মত ক্রোধ জ্বলছিল, এক ঝটকায় বললেন,
——— “এই মেয়েকে আমি প্রথম থেকেই অপছন্দ করি। এর কাজ সবসময় অগোছালো। আজ সেই হেয়ালিপনার মাশুল আমরা দিচ্ছি। কত বড় অপরাধী
আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেল ওর জন্য!”
তবে মুগ্ধের ভেতরে তপ্ত লাভা উথলে উঠছে। কোনো কথা আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। সে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
——— “আমি হাসপাতালে যাচ্ছি!”
তার শব্দের ওজন এমন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের গাঢ় মুদ্রা তাতে স্পষ্ট। কোনো অপেক্ষা না করে, হনহনিয়ে বেরিয়ে এলো। পেছনে রুদ্রকে স্পষ্ট আদেশ দিয়ে গেল,
——— “তুমি বাড়ি ফিরে যাও।”
অত:পর মুগ্ধ বেরিয়ে গাড়িতে উঠে দরজা সজোরে বন্ধ করে, ইগনিশনে চাবি ঘোরাল। মুহূর্তে ইঞ্জিনের গর্জনে রাতের স্তব্ধতা খানখান হলো। ফুল স্পিডে ছুটে চলল তার গাড়ি। মুগ্ধের দৃপ্ত হাত স্টিয়ারিংয়ে শক্ত হয়ে চেপে রয়েছে। চোখ সময়মাপার মতো ঘড়ির কাঁটায় পড়ল, রাত ১১টা।
বাইরে অন্ধকার আকাশের নীচে শীতল বাতাস শ্বাসরুদ্ধ করার মতো কড়া, কিন্তু মুগ্ধর মন তাতে নত নয়। তার অন্তরে শুধু একটাই লক্ষ্য, হাসপাতালে পৌঁছাতে হবে। ঠিক তখনই ব্লুটুথের কানে এক মৃদু শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো। ফোনে কল এসেছে। সে এক ঝটকায় রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো চেনা আর গভীর এক কণ্ঠস্বর,
——— “বাবা, বাড়ি কখন ফিরবি?”
মুগ্ধের চোখে অদৃশ্য এক মমতার আভাস ছড়িয়ে পড়ল, কিন্তু কণ্ঠ ছিল সংযত,
——— “মা, দেরি হবে।”
সুহানা বেগমের গলায় শঙ্কা আর উদ্বেগের চিহ্ন স্পষ্ট।
——— “নিজের খেয়াল রাখিস, বাপ! আজকে আমার কলিজাটা ভয়ে ছিঁড়ে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করিস।”
মুগ্ধ, যার হৃদয় কঠিন দায়িত্বের জালে জড়িয়ে আছে, নরম অথচ দৃঢ় সুরে বলল,
——— “মা, চিন্তা কোরো না। নিশ্চয়ই খাও নি? আর একটি কথাও নয়, তুমি খেয়ে ঔষধ নিয়ে শুয়ে পড়ো। সময় হলে আমি চলে আসব।”
তারপর আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে কল কেটে দিল। এই মুহূর্তে তার কাছে অনুভূতির জায়গা ক্ষীণ, কর্তব্যের দাবিই অগ্রগণ্য।
গাড়ি ছুটে চলল অন্ধকারের বুক চিরে। রাস্তার বাতিগুলো তার অস্থিরতাকে আরও তীব্র করে তুলছে। প্রতিটি মুহূর্তে মুগ্ধর চোখে হাসপাতালের করিডরের একান্ত দৃশ্য ভেসে উঠছে। তার মনে, কিছু অজানা সত্যের গূঢ় সুর। সে জানে, সময় আর ইস্পাত কঠোর মনোযোগ ছাড়া এই লড়াইয়ে জয় আসবে না।
তবে গাড়ির ইঞ্জিনের গর্জনের নিচে চাপা পড়ে যাওয়া মুগ্ধর চিন্তার স্রোত থামছিল না। স্টিয়ারিংয়ের দৃঢ় স্পর্শে তার মনের গভীরে এক শব্দের প্রতিধ্বনি চলছিল, “মা”। এই শব্দ এক মহিমান্বিত অনুভূতির প্রতীক। ভাবনার পরতে পরতে সে অনুভব করছিল মায়ের ভালোবাসা, তার ত্যাগ, তার মমতা।
"মা" শব্দটির গভীরতর মর্মার্থ। মায়ের অন্তরে নিহিত যে মমতার অতলস্পর্শী স্রোত, তার তুলনা এ জগতে অপ্রাপ্য। মা, যিনি নিজের শিরায় বয়ে নিয়ে যান সন্তানের প্রতিটি অস্থিরতা, যিনি সন্তানের রোগযন্ত্রণায় নিজেকে নিঃশেষ করেন, তাঁর মহত্ত্ব ভাষার সীমাকে অতিক্রম করে। অথচ, আজকের এই অবক্ষয়িত প্রজন্মে কত নির্মমতায় সন্তান মায়ের প্রাণহরণে লিপ্ত হয়! ল'জ্জা, তি'ক্ত ঘৃণা, আর অভিশাপ এদের জন্য যথেষ্ট নয়। আল্লাহ তাদের অন্তরে হেদায়াতের আলো প্রজ্বলিত করুন!
অত:পর মুগ্ধ নিজেকে সামলে চোখ ফেরাল। সামনে হাসপাতালের সাদা আলোর দৃষ্টিকাড়া জ্যোতি। গাড়ির ব্রেক টেনে সে থামল। নিস্তব্ধ অথচ দৃপ্ত ভঙ্গিতে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। মুখে কোনো কথা, চোখে কোনো প্রশ্ন নেই।
হাসপাতালের ভেতর পা ফেলল মুগ্ধ। করিডরের সাদা দেয়ালগুলো তার আত্মাকে আরও তীক্ষ্ণ করে তুলল। প্রতিটি ধাপ তাকে আরো গভীর সত্যের দিকে ঠেলে দিল। সে আফিয়া বেগমের কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াল। সেখানে নিষেধাজ্ঞার ছায়া। কারও প্রবেশাধিকার নেই। কারণ, আফিয়া বেগম এখনো অচেতন এবং একজন ভয়ানক অপরাধী! আর কীভাবেই বা জ্ঞান ফিরে পাবে? যে ভয়ংকর ট্রাক আর মাইক্রোর টানা সংঘর্ষ তাকে মৃ'ত্যু আর জীবনের সীমানায় ছুঁড়ে দিয়েছে।
কেবিনের দরজার সামনে বসে সশস্ত্র পুলিশ। তাদের চোখে সতর্কতার ছায়া। মুগ্ধ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।
ভেতরের ঢুকতেই তাকে থমকে দিল। পা জোড়া এক মুহূর্তের জন্য যেন আটকে গেল। মুহুর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো!