Ad Code

শ্যামকন্যার মায়াবী চোখ - পর্ব ৩৮

 লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা

🚫🚫
কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।
🚫🚫
*
*
মধ্যবর্তী দিনগুলি পঞ্চম গোধূলির আলোয় বিলীন! তদন্তের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম উপকরণের সন্ধানে প্রয়াস নিরবিচ্ছিন্ন, প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র চিহ্ন এবং স্থান অবধি উন্মুক্ত রেখেছে অনুসন্ধানকারীদের পদচিহ্ন! এই অন্তহীন দৌড়ঝাঁপের মাঝে রুদ্র অপ্রত্যাশিতভাবে এক রেস্তোরাঁয় বিরাম নিচ্ছে, কারণ চাচির অনুরোধে সে এসেছে—যদিও তার হৃদয় জানে, চাচির উদ্দেশ্য সম্পূর্ণত অন্যতর। প্রিয়ার সান্নিধ্যে কিছু মধুর মুহূর্ত কাটুক রুদ্রের, এটাই তো চাচির অভিলাষ! তবুও রুদ্রের মন বিরক্তিতে আবদ্ধ, এভাবে সময় কাটাতে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।
রুদ্র বসে ছিল অনমনীয় মনোভাব নিয়ে, আচমকাই উঠে দাঁড়াল। ঊর্মিলা বেগম মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন,
——— “কোথায় যাচ্ছিস, বাবা?”
——— “ওয়াশরুমে যাচ্ছি, চাচি!”
এ যেন কপটতার এক অলিখিত প্রদর্শনী! আসলে এখানে সে থাকতে চায় না, বিশেষত যেখানে প্রিয়া উপস্থিত। বিরক্তির অন্ত নেই; মেয়েটি আবার শাড়ি পরেছে! রুদ্র এক পা দুই পা করে পথ মাড়িয়ে এগিয়ে চলল, এমন সময় সম্মুখে দেখা দিলো মহুয়া! মেয়েটির মুখমণ্ডল ক্রোধের প্রাবল্যে লাল হয়ে আছে, তার দৃষ্টিতে অগ্নিশিখার ঝলকানি! বিস্ময়ে অভিভূত রুদ্র প্রশ্নবিদ্ধ হলো; মহুয়া এই সময়ে এখানে কেন, আর এই ক্রুদ্ধ দৃপ্ততা কেন?
মহুয়া কণ্ঠের কঠিনতায় বলল,
——— “এটাই তোমার ‘জরুরি কাজ’?”
রুদ্রের মনে ঝলসে উঠল স্মৃতি—আজ মহুয়া তাকে ব্যক্তিগত সাক্ষাতের নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল, যা সে উপেক্ষা করেছে পারিবারিক কারণে! মহুয়ার উপস্থিতিতে তার মনে এক অস্বস্তিকর সংকোচ জাগল। মেয়েটি কি শুধু এই কারণে এতটা ক্রুদ্ধ হয়েছে? রুদ্র বলল,
——— “আমি আমার পরিবারকে নিয়ে এসেছি।”
মহুয়া দাঁত চেপে প্রশ্ন করল,
——— “ওই মেয়েটা কে?”
রুদ্র তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো প্রিয়ার দিকে; প্রিয়া আগুনে দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে, আর রুদ্র পড়ল কঠিন সংশয়ের জালে। কেন এই উগ্র অভিব্যক্তি? সে সংক্ষেপে বলল,
——— “বাহিরে এসো!”
——— “কেন? ও দেখছে বলে কি সমস্যা হচ্ছে?”
রুদ্রের চোখের পাতা সংকুচিত হলো। মহুয়া কি আসলেই সীমা লঙ্ঘন করছে না? তবে সে আর বিতর্ক বাড়াল না। রেস্তোরাঁর প্রবেশপথে পৌঁছে শেষবারের মতো বলল,
——— “ইচ্ছা করলে এসো, না চাইলে নয়!”
মহুয়া ক্রোধে রুদ্রের পিছু নিলো, তাদের এই দৃশ্য প্রিয়ার দৃষ্টিতে এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো প্রজ্বলিত হলো। পাশ থেকে ঊর্মিলা বেগম ব্যাখ্যায় বললেন,
——— “ওই মেয়েটা তো রুদ্রের সাথেই সিআইডিতে কাজ করে! চিন্তা করিস না! ”
তবুও প্রিয়ার ঈর্ষায় অন্তঃকরণ দহনে দগ্ধ হলো;কী অপরূপা এই নারী, রুদ্রের প্রতিদিনের সহকর্মী?
নিস্তব্ধ রাত্রির গভীরে ল্যাম্পপোস্টগুলো সুশৃঙ্খল বিন্যাসে দাঁড়িয়ে, স্নিগ্ধ আলোয় মিশে গেছে পথের ধূসরতায়। রুদ্রের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ মহুয়ার ক্রুদ্ধ মুখশ্রীর দিকে, যেমনি তার অধরার বাঁকে বিরাজিত অমোঘ প্রতীক্ষা। রুক্ষ কণ্ঠে মহুয়া বলল,
——— “বললে না তো, ওই মেয়েটা কে?”
——— “আমার বাড়িতে কাজ করে।”
মহুয়ার হৃদয় তীরবিদ্ধ হলো! এতো সুদীপ্তা বৈবাহিক বয়সসীমায় পা রাখা নারী সে রুদ্রের গৃহস্থলীতে সেবিকা? ক্রুদ্ধ কণ্ঠে মহুয়া পুনঃপ্রশ্ন করল,
——— “ও থাকে কই?”
——— “আমার বাড়িতে।”
মহুয়ার অন্তঃস্থলে যেন প্রচণ্ড আঘাত হানল এই উত্তরে। এ কি সম্ভাবনা যে সেই রূপসী প্রতিনিয়ত রুদ্রের গৃহের আঙিনায় বিচরণ করে? রুদ্র ক্লান্ত ত্বকে ফেরে, তারই সামনে ফিরতে রুদ্র ক্লান্ত পথ অতিক্রম করে? এ চিন্তায় মহুয়ার অন্তরে দহন, চোখের কোণে ভারী বেদনার ছায়া। নির্লজ্জ মন তার অধিকার দাবি করে বসেছে! রুদ্র লক্ষ্য করল মহুয়ার চোখের অব্যক্ত যন্ত্রণায় নিমগ্ন জলকণা।
——— “কি হয়েছে মহুয়া? চোখে জল কেন?”
——— “আমার ইচ্ছে তোমার কি?”
রুদ্র থমকে দাঁড়াল, এমন বালখিল্যতায় মোড়ানো এই মেয়ে, কে বলবে এ সিআইডি অফিসার! রুদ্র মুচকি হাসল, আরেকটু কাছে এল, যেন পরখ করছে চোখের ভাষা।
——— “আমার আশপাশে অন্য নারীর উপস্থিতি সহ্য করতে কি তোমার আপত্তি?”
মহুয়া যেন অভিমানের বন্যায় ভেসে যায়! এত অনুধাবনের অপার্হতায় ক্রোধে ফেটে পড়ল,
——— “আমার কিছু না! তুমি থাকো, আমি যাচ্ছি! তোমার ওই মেয়ের কাছে যাও!”
মহুয়া ঘুরতেই রুদ্র মৃদু অথচ দৃঢ়ভাবে তার হাত ধরে ফেলল। স্পর্শে শিহরণে তার অন্তর্সত্তা সিক্ত হলো, চোখের পাতাগুলি আচ্ছন্ন হয়ে বুজে এলো। মুহূর্তে রুদ্র যেন ভ্রম ভুলে গেল; এ যে এক জনপথ! অপরিচিত দৃষ্টি, অবাঞ্ছিত কৌতূহল ভর করেছে আশপাশের মানুষদের চোখে; কেউ বা পরিহাস করছে, কেউবা নিরবে নিন্দা করছে। রুদ্র গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
——— “তোমার এত ক্রোধের কারণটা বলো।”
মহুয়া বিরক্তিতে অভিমানে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল! এই লোক যে কিনা অপরাধীর মনের গভীরে প্রবেশ করে শেকড় বের করে ফেলতে পারে, সেই কি না মহুয়ার চোখের ভাষা বুঝতে অক্ষম!
——— “রুদ্র?”
পেছন হতে প্রিয়া এক তপ্ত কণ্ঠে সম্বোধন করল। এসে দাঁড়ালো রুদ্রর সামনে, মহুয়ার দিকে এক হিমশীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
——— “মায়ের শরীর খারাপ করছে, বাড়ি ফিরে চলো।”
তার কণ্ঠে সুকৌশলে গুপ্ত এক দাবির নিঃশব্দ ভাষা—সম্ভাবনাময় প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছায়া যেন মহুয়ার উপর ভাসছে! মহুয়ার মনের তপ্ত ক্ষোভে, সে প্রিয়ার রূপ-অভিজাত্যের সৌন্দর্য দেখে ক্রোধে ফুঁসছে; এ কি শাড়ির মোহিনী রূপ! এই দেখে সে আরো তীব্র রোষে উন্মত্ত হয়ে উঠল!
রুদ্র বলল,
——— “তোমরা বাড়ি যাও, আমি পরে আসছি।”
প্রিয়ার ক্রোধ যেন প্রশান্ত হতে অস্বীকার করে; তার দেহে ঈর্ষার অগ্নিশিখা যেন আরো প্রবল হয়, রুদ্রের এই নির্লিপ্ততার কারাগারে সে বন্দী। রুদ্র কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ফোন বের করে জয়নাল সাহেবকে জানাল,
——— “চাচা, চাচিকে নিয়ে বাড়ি চলে যাও। আমার জরুরি কাজ রয়েছে।”
ফোন কেটে, রুদ্র মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
——— “চলো, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই।”
মহুয়ার মনে সে যেন এক অমূল্য রত্নলাভের অনুভূতি নিয়ে উঠল। বিজয়ের এক অদৃশ্য দীপ্তি তার মুখে খেলে গেল; প্রিয়ার তপ্ত ক্রোধের সামনে সে এক বিজয়ীর হাসি রেখে উঠল বাইকে, হাত রাখল রুদ্রের কাঁধে, যেন স্পর্শের নীরব ভাষায় হৃদয়ের শিহরণ ছড়িয়ে পড়ল দেহে! প্রিয়ার চোখের সামনে দিয়ে ধোঁয়ার মেঘে মিশে বাইক ছুটে চলে গেল, আর প্রিয়া কাঁপতে কাঁপতে ক্রোধে ফিরে গেল ঊর্মিলা বেগমের কাছে, প্রতিটি পদক্ষেপে তার দহন তাকে আরও ক্ষতবিক্ষত করে তুলছে।
রাতের স্তব্ধতা ভেঙে প্রিয়া ঘরে প্রবেশ করতেই এক অদ্ভুত উন্মাদনা তাকে গ্রাস করল। নিজের কক্ষে ঢুকেই সমস্ত দুঃখ, হতাশা উন্মোচিত হলো তার সামনে। ক্লান্ত হৃদয়ে ব্যথা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। মহুয়ার প্রতি তীব্র ক্রোধে উন্মত্ত সে; মনে হয় যেন তাকেই শেষ করে দেয়!
আলমারির গহীন কোণ থেকে সাবধানে তুলে নিল সেই শার্ট; রুদ্রের শার্ট, যেটি সে নিঃশব্দে চুরি করেছে। শার্টটিতে এখনও রুদ্রের স্পর্শ, তার দেহের নিঃশ্বাস, তার ঘামের গন্ধ, সমস্তকিছুই যেন প্রিয়ার অনুভূতিতে লেপ্টে আছে। তা বুকে চেপে ধরে, চোখ বুজে গভীর শ্বাসে টেনে নিল সেই পরিচিত গন্ধটিকে, নিঃশ্বাসে শুষে নিতে চাইছে রুদ্রের অস্তিত্বের প্রতিটি কণাকে।
ধীরে ধীরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে, রাগের শিখায় উত্তপ্ত হাতে শাড়িটা ছিন্নভিন্ন করে নামিয়ে ফেলল। পূর্ণনগ্ন হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে এক অদ্ভুত আত্মরতি খেলে গেল। আয়নায় নিজেকে দেখে এক মুহূর্তে উপলব্ধি করল তার রূপের তীব্রতাকে, তার সৌন্দর্যের উন্মত্ত আকর্ষণকে। কাতর স্বরে বলল,
——— " এত এত পরিবর্তন এনেছি শুধু তোর জন্য! অথচ তুই একবারও আমাকে ছুঁয়ে দেখা তো দূর ফিরেও তাকাস না!"
তারপর এক অদ্ভুত বক্র হাসিতে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
——— “আমি সেই, যাকে তুই কল্পনাতেও আনতে পারবি না। তোর কল্পনারও অনেক ঊর্ধ্বে আমি, রুদ্র!”
এ কথা বলে প্রিয়া নিজেই আপন মনে হাসল। এক নিঃশব্দ, তীব্র হাসি যেন তাকে আবারও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ করল,
——— "তোকে পাওয়ার জন্য আমি কোনো সীমা মানিনি, কোনো বাধা আমাকে থামাতে পারেনি। এই জগতে নিকৃষ্টতম কাজের ঊর্ধ্বসীমা ছুঁয়েছি। তোকে এত সহজে ত্যাগ করার সাধ্যি আছে আমার?"
___________
অন্ধকার অফিসঘরে তীব্র মদের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে, টেবিলের ওপর অর্ধভর্তি বোতল, দু’জনে বুদ হয়ে বসে মদের নেশায়। চোখে ম্লান হাসির ছায়া নিয়ে কুদ্দুস আলী চুমুক দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বললেন,
——— "মেয়েটাকে শুধু শুধু বাঁচিয়ে রেখেছিস, আজগর! একেও সরিয়ে ফেললে হতো।"
আজগর আলী মুচকি হেসে তার চুমুক শেষ করে বিরক্তির সুরে বললেন,
——— "ধুর, তুমিও যে কী বলো! ওকে মে'রে ফেললে, চোখের জলের নীরব আর্তনাদটা দেখবে কে? সেই কষ্টই তো আমার উপভোগ!"
আজগরের ঠোঁটে হিংস্র হাসির ছায়া, ভেতরের বিকৃত আনন্দই উগরে দিচ্ছে। আর ওর এ হাসি দেখে কুদ্দুসের চোখে তীব্র ঘৃ'ণা খেলে গেল। মনে মনে বললেন,
——— "একটা বাঁধা তো সরেছে, এবার তুই বাকি। সময়মতো তোকেও সরিয়ে ফেলব!"
অন্যদিকে, আজগর আলীর মনের অন্ধকার গহীনে অন্য খেলা। হাসি মিশ্রিত কৌতুক ভরে মনে মনে বললেন,
——— "বাড়ির ছেলে হয়ে থেকেছিস, বাপের দয়া নিয়ে! আর এখন এত বড় সাহস, সম্পত্তি চাইছিস!
______
মধ্যরাতের নিঃসীম নিস্তব্ধতায় ঘরে ফিরলেন আজগর আলী, আর তারই সঙ্গী হয়ে নীরবে অপেক্ষমাণ রোকেয়া বেগম দরজা বন্ধ করলেন যেন প্রতিটি ক্ষণ এই মুহূর্তটিরই প্রহরায় কাটিয়েছে। তার দৃষ্টির ধার এতটাই শীতল যে, কোনো কথা বলার আগেই অন্ধকার রুদ্ধ হয়ে উঠলো। চিরারক্ত কণ্ঠে তিনি নিবেদন করলেন তাঁর তীক্ষ্ম অভিযোগ,
——— “বড় ভাইকে তুমি মে'রেছো, তাই না?”
আজগর আলী চোখের কোণে এক তৃপ্তির হাসির রেখা টেনে তুলে বললেন,
——— “হায়রে! বড় ভাইয়ের প্রস্থান যেন তোমার বুকে শোকের ঢেউ তুলেছে! এমন উদার সহানুভূতির উৎস তবে কী?”
রোকেয়া বেগম প্রতীক্ষায় থেকেও দৃঢ় গলায় বললেন,
——— “সোজাসুজি বলো! সত্য থেকে অব্যাহতি নেই।
——— ঘাতক যেই হোক, কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত, তবে! অন্তত এক পাপ হালকা হলো। রীতিমতো পেরেশানি কমেছে আমার।
রোকেয়া বেগম তীব্র ধিক্কারের স্বরে বিদ্রুপ করে বলল,
——— নিশ্চয়ই কমবেই! ভাবি তো একা, অরক্ষিত এখন; তোমার সেই গোপন বাসনার ঝাঁক ধরেছে আজও! আমার তো সন্দেহ হয়, সত্যি করে বলতো শান্ত আর পূর্বিকা কি তবে তোমাদের সেই অঘোষিত সম্পর্কের ফল?
আজগর আলী হেসে একটি তিক্ত বিদ্রূপের সুরে বলল,
——— অপমান?, তবে বেশ জমলো! প্রথম দেখায় তার জন্য বুদ হয়ে আছি! ভাবিকে কি আজও দেখোনি? বয়সের গহনিতে আগুন যেন প্রজ্বলিত! আজও তার রূপসৌন্দর্যে ঝলসে যাওয়ার ক্ষমতা রয়েছে; বিশ্বাস করো, সুযোগ পেলে তোমার পাশে রুদ্ধ হয়ে ভাবির কাছে চলে যেতাম নির্দ্বিধায়। তবে ভাগ্যের খেলা; পূরণ হয়নি সে বাসনা!
শেষের কথাটি হতাসার সুরে বললেন আজগর আলী! রোকেয়া বেগমের সারা দেহ যেন আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলতে শুরু, চোখে র'ক্তবর্ণ ক্রোধ আর তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ! কোনো স্ত্রী তার স্বামীর মুখে অপর নারীর কথা শুনে নিশ্চুপ থাকতে পারে না,
———" এত নারী পেয়েও এখনো যা অধরা, তার দিকেই চোখ তোমার আটকে থাকে! অপূর্ণ বাসনার ক্ষুধা শেষ হয় না, আজগর?"
আজগর আলী তার হাস্যরসের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে বললেন,
——— "হায়, জীবনের দুই নারীকে তৃষ্ণার্ত চিত্তে চেয়েছি, পাগলের মতো চেয়েছি, তবু ভাগ্যচক্রে পেলাম না কাওকেই। আফসোস! এ দুঃখের বোঝা নিয়েই জীবন কাটাবো। শুধু ভাগ্যে জুটল তুচ্ছ এক নারী! ধুরর!
ফুঁসে উঠলেন রোকেয়া বেগমের ক্ষোভ তিনি তৎক্ষণাৎ শুয়ে থাকা আজগর আলীর কলার চেপে ধরে ফুঁসে উঠলেন,
——— "কাপুরুষের মতো কথা বলিস আজগর! সামান্য এক মেয়ের প্রাণও নিতে পারিস নি, অথচ আমাকে তুচ্ছ করার দুঃসাহস করিস!"
এমন তীক্ষ্ণ অবমাননা সহ্য করা কি সহজ? আজগর আলীর ক্রোধ যেন ভিসুভিয়াসের উদ্গীরণ! তার মুখে রাগের রেখা তীব্র হয়ে উঠল। কেমন দুঃসাহস! নারীর স্থান যে পায়ের তলায়, তা সে ভুলে গেছে? নারীরা তো ভো'গের বস্তু, মনোরঞ্জনের জন্য, রান্নাঘরে তাদের স্থান; এই উপদেশ জন্ম থেকেই তার মনে গেঁথে আছে। এমন বিদ্রূপ আর অসম্মান তার পুরুষত্বে আঘাত দিলো।
তিনি রোকেয়া বেগমের মুখের দিকে হিং'স্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে শক্ত হাতে একটি কষিয়ে চ'ড় মারলেন, তারপর থু'তু ছুঁড়ে অবজ্ঞার সুরে বললেন,
——— "তুই আমার থু'তুরও যোগ্য নস! তোর মতো মেয়ে সংসারের গণ্ডিতে আছে এটাই তো তোর বাপের ভাগ্যের কথা, নইলে তোকে তো পশুর মতো রাস্তায় ফেলে আসতাম!"
এরপর উঠে নিজেকে যেন হিংস্র পশুতে রূপান্তরিত করেছেন। রোকেয়া বেগমকে হিংস্র হাতে ধরে খাটের উপর ছুড়ে দিলেন, তার চোখে তখন অবজ্ঞা আর প্রবল ঘৃণার ছায়া।
——— "তোকে জীবিত রাখা আমার মহাপাপ! তোর সঙ্গে সেই দুর্ভাগা মেয়েটাকেও, যার অস্তিত্বের চিহ্নটুকু মুছে ফেলতে পারলে আমিও হয়তো শ্বেতপদ্মের মতো প্রশান্তিতে ভাসতে পারতাম।"
আজগর আলী ক্রোধে বিপন্ন, ঘৃণায় বিস্ফারিত চোখে রোকেয়ার প্রতি এক ভয়াল চাহনি ছুড়লো। ধীরে ধীরে তার দিকে অগ্রসর হলো যেন এক অশুভ দানব। নিঃশব্দে হাসতে হাসতে বলল,
——— "তুই আমাকে কাপুরুষ বলিস? দেখাচ্ছি তোকে পুরুষত্বের আসল রূপ কেমন!"
সে এক টানে শরীর থেকে শার্টটি ছুঁড়ে ফেলে দিলো, নিষ্ঠুর ইঙ্গিতসহ প্যান্টের চেইন খোলা শুরু করল। কণ্ঠে নি'র্ল'জ্জ, জ'ঘ'ন্য হাসি ফুটিয়ে বলল,
——— "আর সেই মেয়েটার কথা বলছিস? চাইলে বহু আগেই ওকে মে'রে ফেলতাম। কিন্তু ওর কষ্টে ডুবে থাকা রূপই তো আমার আনন্দের উৎস। আমার সেই অগ্নিসুন্দরী ভাবি আর তার র'ক্তপিপাসু সন্তান ওকে যে প্রতিনিয়ত অপমানিত করে, আমার কাজ তো তারাই সেরে দেয়! দিনের তিন প্রহর ধরে ওর কান্নার সুর আমার শান্তির মূর্ছনা! কেবল সেই যন্ত্রণাগুলো না থাকলে আমি অনেক আগেই ওকে মৃ'ত্যুর কোলে শুইয়ে দিতাম। "
বাক্যে বিষের তীব্রতা মিশিয়ে বলল,
——— " নাটক হয়তো ক্লান্ত করে ফেলেছে তোকে। কিন্তু তবু, তোর আর কিছুই করার নেই! যতই হোক ও তো আমাদেরই মেয়ে তাই না বল?? কিন্তু মা হয়ে মেয়ের মৃ'ত্যুকামনা করতে পারিস? ছিঃ! তোর মতো মায়ের মুখে ক'লঙ্ক। "
এ কথা বলেই এক শয়তানি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে আজগর আলী ন'রপিশাচের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল রোকেয়া বেগমের উপর, যেন সে এক অন্ধকারের ভ্রুকুটি, যেখানে আলো কখনও প্রবেশ করেনি।
______________
পরদিন প্রত্যুষে মহুয়া ও রুদ্র ইতিমধ্যেই সকলের সান্নিধ্যে পরিচিত হয়েছে। তাদের লক্ষ্য—শিকদার বাড়ির যাবতীয় ব্যাবসায়িক কার্যাবলী, তার গহীনে লুকিয়ে থাকা রহস্য একে একে উদ্ঘাটন করা। যাত্রাপথে হঠাৎ রুদ্র মুগ্ধকে গাড়ি থামাতে অনুরোধ করে। মুগ্ধ সৃষ্টিশীল ভ্রু কুঞ্চন করে কঠিনভাবে প্রশ্ন করে,
———" কী হলো?"
রুদ্রের মুখে এক অপ্রতিরোধ্য হাসি, বলল,
——— "স্যার, আপনারা এগিয়ে যান। আমি ফিরছি অল্প সময়েই।"
——— "আমরা ভ্রমণে যাচ্ছি না, রুদ্র!"
মুগ্ধর স্বরে তীক্ষ্ণতার আভাস, তবু রুদ্র যেন নাছোড়। দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করে,
——— "স্যার, এই প্রস্থানও তদন্তের অঙ্গ।"
মুগ্ধ কিছু বলল না। মহুয়ার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রুদ্রের অদ্ভুত অন্যমনস্কতার কারণ অনুসন্ধান করতে চাচ্ছে। অত:পর রুদ্রকে সেখানেই রেখে মুগ্ধ পুনরায় গাড়ি চালায়; তাদের অগম্য গন্তব্যে, শিকদার বাড়ির ব্যবসা, তার গূঢ় রহস্য, এবং লুকানো বাস্তবতাগুলো পর্যবেক্ষণ।
রুদ্রের অধরে হাসির রেখা খেলে গেল। নীরবে দোকান হতে একটি শীতল মেঘবৎ আইসক্রিম সংগ্রহ করে সে পা বাড়ায় আঁখির কলেজের দিকে। এই মুহূর্তেই উপযুক্ত অবসর, কেননা পরবর্তী সময়ে সারাদিনই ঘিরে আছে কর্মব্যস্ততার ছায়ায়। শিকদার বাড়ির কনিষ্ঠ কন্যাটির প্রতি রুদ্রের বক্ষপটের গভীরে অজ্ঞাত এক অন্তর্নিহিত আকর্ষণ জন্ম নিয়েছে; প্রথম দেখাতেই হৃদয় বিদীর্ণ করা রহস্যে নিমজ্জিত হয়েছে সে। মেয়েটি বর্তমানে কলেজে, এবং তার কাছে শুধু একটি আইসক্রিম তুলে দিয়েই ফিরবে সে; এই পরিকল্পনা হৃদয়ে সুপ্ত হয়ে আছে।
তবে অদ্ভুত ব্যাপার; মেয়েটি যেন তার নিকট হতে কেবল ছায়ার মতো পালিয়ে বেড়ায়। সেদিন রুদ্র তার নাম জানতে চাইলে, কণ্ঠে কাঁপুনির স্পন্দন মিশিয়ে আঁখি উত্তর দিলো,
——— "আঁখি।"
এই একটি নাম শুনে যেন রুদ্রের অন্তরস্থিত তন্ত্রীতে নতুন চাঞ্চল্য জাগরিত হলো; বিস্ময়াবিষ্ট দৃষ্টিতে সে আরও নিবিড়ভাবে মেয়েটির বিষণ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আঁখির ম্লান মুখশ্রীতে দুঃখের এক অজানা ছাপ, কান্নার জলধারায় রঞ্জিত দুই নয়ন।
ঠিক তখনই, পেছন হতে মুগ্ধ এসে দাঁড়িয়ে, রুদ্রকে কঠোর কণ্ঠে বলল,
——— "এখানে কি গল্পগুজব করার জন্য আসা?
রুদ্র মৃদু তীক্ষ্ণতায় মাথা তুলে তাকালো মুগ্ধের দিকে, আর মুগ্ধের দৃষ্টিতে আঁখির দিকে অবজ্ঞার একটি তীব্র রেখা। অন্তর বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল মুগ্ধর; অনুভব করল, আঁখির মায়াময় দৃপ্তদৃষ্টি তার অন্তরে এক অজানা অগ্নিসঞ্চার করেছে।
রুদ্র ধীরগতিতে উঠে দাঁড়ায়, নিজের ভাবনা সংযত করে মুখে এক ক্ষীণ হাসি এনে বলে,
——— না স্যার, মেয়েটি ফ্লোরে পড়েছিল, তাই একটু জানতে চাচ্ছিলাম!
মহুয়া আঁখিকে ভ্রান্ত-সম্বরণ দিয়ে ফ্লোর থেকে তুলে নেয়, আর মুগ্ধর কণ্ঠ বজ্রসম কঠোরতায় রুদ্রের কানে বেজে ওঠে,
——— “সৃষ্টিকর্তা মানবকে পা দিয়েছেন, চলার জন্য! বারংবার লুটিয়ে পড়ার কি প্রয়োজন? তবে, কেন এই পায়ের অস্তিত্ব? কৃপণতা না করে, কে'টে ফেলানো হোক!”
আঁখি নীরবে বোঝে, এই তিরস্কারের মূল লক্ষ্য কেবল সে। তদন্ত পর্ব শেষে বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে রুদ্র-মুগ্ধ-মহুয়া, কিন্তু রুদ্রের চোখ তখনও পর্দার আড়াল থেকে আঁখির চোরের মতো দৃষ্টি নিয়ে। রুদ্রের হৃদয়ের গভীরে এক অস্থির তরঙ্গ খেলে যায়। সে একটু সামনে এগিয়ে ঝুঁকে গম্ভীরস্বরে বলে,
——— "কিছু বলতে চাও?"
আঁখি সঙ্কোচে মাথা নাড়িয়ে তড়িত গতিতে দৌড়ে পালায়, আর রুদ্রের ঠোঁটে মৃদু হাসি লুকিয়ে থাকে। তবে মুগ্ধর আচরণে যেন অজানা অস্থিরতা, সে আঁখির পিছু নিতে থাকে অবচেতনেই। দৃশ্যটি দেখে নাঈমের অন্তর জ্বলে ওঠে, ক্রোধে ফুটন্ত সে মুগ্ধর পেছনে ধাবিত হয়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে উচ্চারণ করে,
——— "থাম তুই!"
মুগ্ধ এক পলক ঘাড় ঘুরিয়ে, তার চোখে অবজ্ঞার জ্বলন্ত স্ফুলিঙ্গ; আর নাঈম তীব্র ক্রোধে গিজগিজ করতে করতে বলে,
——— "বিশ্বাসঘাতক কোথাকার!"
মুগ্ধ কটাক্ষভরা মৃদু হাসির সঙ্গে পাল্টা ছুঁড়ে দেয়,
——— "কেন, তুই কি খু'নি যে তোর বিশ্বাসে আ'ঘাত লাগল?
নাঈম দাঁত চেপে ক্ষিপ্ত স্বরে বলে,
——— "ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস? তোর কাজ শেষ! এখান থেকে চলে যা এখনই!"
মুগ্ধের চোখে তুষারপাতের কণ্ঠ, নিঃশব্দে ভয়ানক হুমকির মতো উচ্চারিত হয়,
——— "আমার কাজ এখনো শেষ হয়নি! কেবল সূচনা, আর যদি আমার পথে বিঘ্ন ঘটাতে চাস, তবে পরিণাম হবে মহাসংকটের।"
মুগ্ধ নাঈমকে অবজ্ঞাভরে পেছনে ফেলে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল। নাঈমের অন্তরে ক্রোধের আগুন যেন হু হু করে প্রজ্জ্বলিত হলো; তারই বাড়িতে এসে তার ওপর দাপট দেখানোর দুঃসাহস! তদুপরি, তার ছোট বোন আঁখির পিছু নেওয়ার স্পর্ধা? অন্যদিকে আঁখি নিরুপায় দৌড়ে বাড়ির এক সুনসান কোণে এসে থামল, নিঃশব্দে ফ্লোরে বসে হাঁটুতে মাথা রেখে অজানা শঙ্কা ও হতাশায় চোখ মুদল। অন্তরে ঝড়ো বাতাসের ঘূর্ণাবর্ত, নিদারুণ এক বেদনা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। হঠাৎ অনুভব করল, তার সামনে এক অবিচল ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে চোখ মেলে দেখল, সেই পরিচিত কঠোর মুখ—মুগ্ধ!
তার অবস্থান দেখে আঁখি বিস্ময়ে অভিভূত হলো। এই লোক কি করে এখানে? তাদের কাজ তো শেষ! তবু, মুগ্ধ তার সামনে নতজানু হয়ে বসে, গাম্ভীর্য যেন হঠাৎ এক প্রশান্তির আবরণে ঢাকা পড়ে গেল। শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে সে বলল,
——— "কে মে'রেছে?
আঁখি বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে, মুগ্ধর প্রশ্নে সে চমকিত—কে করেছে মানে? মুগ্ধের চোখে অব্যক্ত ব্যথা আর দৃঢ় সংকল্পের ছাপ; পুনরায় তার কণ্ঠে অনুরণিত হলো,
——— "তার নাম বলো।"
——— "অতীব মায়া কেন? অন্তিমে তো আপনিও বিনাশ ঘটাবেন!"
আঁখি হেসে উক্তি করল। মুগ্ধর মুখে এক বিন্দু ভাবের উদয় ঘটলো না। শুষ্ক ও নির্লিপ্ত স্বরে জবাব দিল,
——— "হ্যাঁ, সেটা না বললেও করবো। তবে কেবল আমি। অন্য কেউ নয়।"
——— "আমায় কি আপনার স্বীয় সম্পত্তি বলে বোধ হয়?"
——— "এতসব বুঝি না আমি, যা বলেছি সেখানেই দাঁড়ি টানলাম।"
——— "আপনি যেখানে শেষ করবেন, আমি সেখান থেকেই আরম্ভ করবো।"
——— "আমার যথেষ্ট অবকাশ নেই তোমার সাথে তুচ্ছ বিতণ্ডায় লিপ্ত হওয়ার। সরলভাবে নামটা বলবে কি?"
———" না, এখন মনের ক্যানভাসে একটাই নাম ফুটে উঠছে—ষাঁড় মহাশয়! কারণ তারই মতো এক প্রাণী এখন আমার সামনেই বসে।"
মুগ্ধর চোয়াল কঠিন হয়ে উঠলো। কঠোর স্বরে বলল,
——— "ষাঁড়ের প্রগল্ভতা এখনো প্রদর্শন করিনি!"
———" নিষেধ করেছে কে? করুন, পাগলা উন্মত্ত ষাঁড়ের সঙ্গেও পাল্লা দিতে আমিও সদা প্রস্তুত!"
মুগ্ধ নীরব। স্নিগ্ধ নয়নে কঠোর দৃষ্টিপাত করল। চঞ্চলা মেয়ে ক্ষীণ হাসি হেসে তাকিয়ে রইল। মুগ্ধ উঠে দাঁড়াল। কঠোর স্বরে বলল,
——— "আমার ঝুলিতে আরও কৌশল আছে।"
পদক্ষেপ করল প্রস্থানপথে। হঠাৎ থেমে পুনরায় পেছনে ফিরে যেন ভুলে গেলো! কিছুটা কাতর সুরে বলে উঠলো,
——— "আমি নিঃশেষ না করা পর্যন্ত নিজেকে সামলে রেখো! অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে নিঃশেষিত হয়ে যেও না!"
এ কথা বলেই দৃপ্ত পদক্ষেপে চলে গেলো মুগ্ধ।তাৎক্ষণিকই সেই কঠোর অভিব্যক্তি ছদ্মবেশ ধারণ করল মুগ্ধর চেহারায়। নির্জন চরণে নিষ্ক্রমণ করল সেখান থেকে। নিবৃত্ত হলো গৃহ থেকে। শান্ত কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অনুসরণ করল মুগ্ধর গমনপথ—আজকের অপমান কুর্নিশ করবে না এই হৃদয়! মুগ্ধকে চিরকাল অমর্যাদার স্বরূপেই স্মরণ করবে! কেননা জিজ্ঞাসাবাদের ছলে অপমানটাই করেছে এই অহং'কারী বে'য়াদব মুগ্ধ!
বাহিরে এসে মুগ্ধ দেখল রুদ্র ও মহুয়া প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। সোজা গিয়ে ড্রাইভিং সিটে আসীন হলো সে। তারা দুজনও দ্রুত আসনে বসল। পা চেপে ধরে ভীষণ বেগে গাড়ি স্টার্ট দিল মুগ্ধ! সামনের দূরত্বে দৃষ্টিপাত করেই হঠাৎ কঠোর কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
——— "সবার চোখের জল মুছিয়ে দেবার কোনো দায় নেই! যাক কিছু অশ্রু অবাধে ঝরে; অশ্রুরও অধিকার রয়েছে দৃশ্য থেকে গড়িয়ে নিঃশেষিত হবার!"
রুদ্রের মনে অজান্তেই এক ক্ষীণ প্রশ্ন উদয় হয়েছিল, সেই তীক্ষ্ণ উক্তি কি তার উদ্দেশ্যে ছিল? তবে সে ভাবনাকে দূরেই সরিয়ে, পথ পেরিয়ে আঁখির কলেজের প্রাঙ্গণে উপস্থিত হলো। এক অর্ধসমাপ্ত ভবনের সম্মুখে দাঁড়িয়ে, দৃঢ় পদক্ষেপে এগোলো তিনতলার দিকে। পূর্বেই সে নিখুঁতভাবে জেনে নিয়েছিল, আঁখির বিভাগের কোন ভবনের কততম তলায় তার আসন!
অবশেষে ক্লাসরুমের দ্বারে নিঃশব্দে দাঁড়াল রুদ্র। শ্রেণিকক্ষে ক্লাস পরিচালনায় ব্যস্ত আরাফের দৃষ্টি রুদ্রের দিকে পড়তেই এক মুহূর্তে এগিয়ে এসে করমর্দন করল। ধীর অথচ অনুসন্ধিৎসু কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
——— "কিছু প্রয়োজন ছিল?"
রুদ্র ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি এঁকে স্নিগ্ধ গাম্ভীর্যে জবাব দিল,
——— "হ্যাঁ। আঁখিকে দয়া করে তাঁকে ডাকবেন।"
আরাফ শুনেই খানিকক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে, সন্দেহমিশ্রিত দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করল রুদ্রকে। এই সিআইডি অফিসার তার ছোট পাখিকে কেন ডাকার প্রয়াস করল? যদিও ডাকতে পারে, কারণ তার পরিবারে খু'ন হয়েছে! অনেক সময় বিশেষ আলাপের প্রয়োজন হয়। কিন্তু রুদ্র একা কেন? তার ভাই কোথায়? রুদ্র দুহাত পেছনে বেধে রেখেছে! এ কারণেই আইসক্রিম তার দৃষ্টিতে ধরা দিলো না!
গভীর ভাবনায় নিমগ্ন হয়ে আরাফ ধীরে ধীরে পা বাড়ালো ক্লাসের শেষ সারির দিকে। আঁখি সেখানে সংকুচিত হয়ে নিঃশব্দে বসে রয়েছে, কারণ সে ইতিমধ্যেই রুদ্রকে দেখে ফেলেছে। আরাফ স্নিগ্ধ হাস্যে বলল,
——— "ম্যাডাম, চলুন। ভয়ের কারণ নেই। আপনার সাথে কথা বলতে এসেছে; আমি এখানেই আছি।"
আরাফ কথাটা বলেতো দিলেও তার অন্তরে সন্দেহের অশান্ত ঢেউ আছড়ে পড়ছে। আঁখির সাথে পৃথক আলাপের কোনো প্রয়োজন সে দেখতে পায় না। এমন কী কথা, যা তাকে কলেজে আসতে বাধ্য করেছে, তাও আবার ক্লাস চলাকালীন? তবে দায়িত্বের সীমা অতিক্রম করে সে তো আর বিরোধিতা করতে পারবে না! আঁখি কোনো সাড়া না দিলে, আছিয়া কনুইয়ের গুতোয় তাকে তাগিদ দিল,
——— "কিরে, যা?"
ওদিকে রুদ্র শ্রেণিকক্ষ থেকে কিছু দূরত্বে সরে গিয়ে অপেক্ষারত। হালকা হাস্যোজ্জ্বল মুখে পেছনে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। আঁখির বুকের ভেতর অদৃশ্য এক অজানা শিহরণ সৃষ্টি হলো। তার দৃষ্টি গিয়ে ঠেকল রুদ্রের হাতে ধরা আইস্ক্রিমের দিকে। রুদ্র কোমল হাসিতে আইস্ক্রিম বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
——— "নাও, তোমার জন্য।"
আঁখি এক মুহূর্তে দ্বিধায় পড়ে বলল,
——— "আমি আইস্ক্রিম খাই না।"
রুদ্রের হাসির রেখায় তখনই যেন ম্লানতার ছায়া নেমে এলো। কিছুটা বিষণ্ণ হাসি হেসে বলল,
——— "আচ্ছা, আচ্ছা! অন্য কিছু খাবে? কী খেতে ভালোবাসো তুমি? সেটাই এনে দিই?"
——— "ধন্যবাদ! কিন্তু আমার কিছুই লাগবে না।"
মুহূর্তের ভেতরেই রুদ্রর মুখশ্রীতে নেমে এলো এক অব্যক্ত মলিনতা। দীর্ঘশ্বাসে মুখে এক অপূর্ব হাসি ফুটিয়ে বলল,
——— "আচ্ছা আচ্ছা, সমস্যা নেই! আবার দেখা হবে!"
এমতবস্থায় প্রস্থান করতে উদ্যত হলে, আঁখির কণ্ঠে ধ্বনিত হলো এক তীক্ষ্ণ উচ্চারণ,
———" শুনুন স্যার?"
রুদ্র স্থির হয়ে পেছনে ফিরে বলল,
———" বলো?"
আঁখি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে চোখ খিচে বদ্ধ করে হাত বাড়িয়ে বলল,
——— "দিন…!"
রুদ্রর মুখমণ্ডলে চিরচেনা কাঞ্চন রৌদ্রের দীপ্তি উঁকি দিলো; অন্তরে প্রোথিত আনন্দ প্রবল হর্ষে সঞ্চারিত হলো, তবু সে নিশ্চিত হতে জিজ্ঞাসা করল,
——— "তুমি না বলেছিলে তুমি খাও না?"
——— "এই মুহূর্তে খেতে ইচ্ছা করছে! দিবেন কি?"
——— "কেন, দিব না কেন?"
এমতাবস্থায় সে আইসক্রিম বাড়িয়ে দিলো আঁখির হাতে। আঁখির মুখমণ্ডল লাল হয়ে এলো, অথচ সেই নিঃশব্দ অস্ফুট আবেগের ঢেউ সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেল। তবুও রুদ্রর আর এক মুহূর্ত সেখানে থাকার সামর্থ্য রইল না, মুগ্ধ স্যার জানলে ক্রোধে ফেটে পড়বে। আঁখি চারদিকে চুপিসারে তাকিয়ে বলল,
——— "আপনি কি শুধুই আইসক্রিম দিতে এসেছেন? কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করবেন না স্যার?"
———" আমাকে স্যার বলার দরকার নেই! ভাইয়া বললেই চলবে, বুঝেছো? আর হ্যাঁ, তোমাকে জিজ্ঞেসই তো করলাম!"
আঁখি ভ্রু কুচকে তাকালো। রুদ্র নিঃশব্দ হাসিতে প্রতিউত্তর করল,
——— "এই যে কারো মনোতৃপ্তির তরে কিছু করো কি না জানতে এলাম।"
তারপর বলল,
——— "এটা গলে যাবে, দ্রুত শেষ করে নিও, আচ্ছা?"
আঁখি বিনয়ের প্রতীক হয়ে মাথা উপর নিচ দুলিয়ে সম্মতির ইঙ্গিত দিলো। রুদ্র মুচকি হেস ঝড়ের বেগে অদৃশ্য হলো স্থান হতে, যেন শূন্য আকাশে খসে পড়া এক তারকা!
কলেজের সন্নিকটে দাঁড়িয়ে আছে জীবন। মুখমণ্ডলে প্রগাঢ় গম্ভীরতার ছায়া। পকেট থেকে মোবাইলটি বের করে কাঙ্ক্ষিত নম্বরে সংযোগ স্থাপন করল সে। ওপাশ থেকে কণ্ঠস্বর শোনা মাত্রই জীবন বলল,
——— "আপনি যা অনুমান করেছিলেন, ঠিক সেটাই স্যার!"
এরপরই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে আবার ধীরস্থির পদক্ষেপে পথ চলা ধরল, যেন নিছক সামান্য কর্মের আড়ালে অনন্য এক অভিনয় চলছে। দোকানে কাজ করাটা তো সবার চোখে ধুলো দেবার জন্য মাত্র। প্রকৃতপক্ষে জীবনের প্রকৃত কাজ সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার মোবাইলের স্ক্রিনে আছিয়ার ছবি উজ্জ্বল, সেই প্রতিচ্ছবির দিকে চোখ রেখে ক্ষীণ হাসল জীবন। এই কিশোরী তার মনস্তলের এক গভীর কোণে অনেক আগেই আশ্রয় নিয়েছে।
গতবছর আছিয়া প্রথমবারের মতো জীবনকে দেখেছিল। জীবনের পিতা ভুলবশত ফোনটি শাহারিয়াজ বাড়িতে রেখে আসেন, আর আছিয়া তা হাতে নিয়ে দৌড়ে আসে তাদের বাড়িতে। সেদিন কাজের ফাঁকে জীবনের কানে ভেসে আসে অজানা এক কিশোরীর হাসির নির্মল ধ্বনি। বাইরে এসে সে দেখল, এক অনন্য সৌন্দর্যের কিশোরী হাসিতে ঝলমল করছে। কতক্ষণ যে তার দিকে তাকিয়ে ছিল জীবন, সে অজানাই রয়ে গেল। অবশেষে কিশোরী আছিয়া নজর ফিরিয়ে গলা খাকারি দিলো, আর তাতে জীবনের দৃষ্টিতে মুগ্ধতা ধরা পড়ে। ক্ষণিকের জন্য কিশোরী আছিয়াও থমকে গিয়েছিল, এক লুঙ্গিপরা, সাদা গেঞ্জি পরিহিত শ্যামবর্ণ পুরুষ জীবনের অপার বিষণ্ণ রূপে।
তবে সেদিন জীবনের অনুভূতি স্পষ্ট না হলেও, কালে কালে আছিয়ার দৃষ্টি তার পথ অনুসরণ করতে শুরু করলো। সর্বত্র তার পিছু নেওয়া, অদৃশ্য অভিসারে জীবনের হৃদয়ে প্রোথিত করল এক নিবিড় আকর্ষণ। জীবন অবশেষে উপলব্ধি করল, শুধু এই মেয়েটি একার নয় তার মননেও নিবিড় স্থান করে নিয়েছে মেয়েটা।
তবে কি ইচ্ছা করলেই জীবনের সকল তৃষ্ণা মিটে যায়? সামাজিক বিধি-নিষেধের অবিচল প্রাচীর, নিয়তির অকাট্য সংবিধান—এ সবকিছুই তো অনাকাঙ্ক্ষিত সীমারেখা। আছিয়া ধনী বংশের কন্যা, আর জীবন এক নিম্নবিত্ত ঘরের সন্তান; এখানে বিত্ত ও রক্তের ব্যবধান যোজন যোজন দূর। জীবন সেই সন্তান, যে এসেছে তার পিতা-মাতার জীবনে এক দীর্ঘ সাত বছরের অন্তরালে, এক প্রার্থনার পূর্ণতায়। অথচ এই জন্মের আনন্দও নিরানন্দের কালো ছায়ায় ঢেকে যায় তার অসুস্থ পিতা-মাতার নিত্যরোগী জীবনের করুণ চিত্রে।
শৈশব থেকেই সে শিক্ষার পাশাপাশি পিতার ভারগ্রস্ত জীবনযাত্রার একটি অংশ নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিল, ছিল তার প্রয়াস পিতার পাশে থাকার। মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরুনোর পর থেকেই জীবন নিজেও হারিয়ে ফেলে সেই শিক্ষা অব্যাহত রাখার সম্ভাবনা। তার শৈশবের সোনালি স্বপ্ন রিক্ত হয়ে যায় এক নিষ্ঠুর বাস্তবতায়, যেখানে শ্রম আর সংগ্রাম তার অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী।
জীবনের প্রতিটি অধ্যায় যেন দুঃখের বিষাদের গভীর অন্ধকারে ডুবে গেছে। সবকিছু ছন্নছাড়া হয়ে গেছে সম্পূর্ণরূপে। মাতা দুরারোগ্য ব্যাধিতে ক্লিষ্ট, আর পিতার শরীরও বয়সের ভারে জীর্ণ-শীর্ণ। পরিশ্রমে অপারগ, রোগশোকে ক্লান্ত, তাদের অভাবের সংসার জীবনের কাঁধে ভার হয়ে নেমে আসে। অতএব, জীবনের শিক্ষা-অভিযাত্রার ইতি ঘটে; বিদ্যা-অর্জনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর পিতামাতার মুখে প্রশান্তির হাসি ফোটাবার স্বপ্ন বিলীন হয়ে যায়। অথচ সেই স্বপ্ন পূরণে প্রয়োজন ছিল সুস্থ দেহের, কিন্তু সেই সুস্থতা তার বাবা মায়ের জীবনে অধরা।
তবে এই কঠিন সময়ে যে নামটি স্মরণ না করলেই যেন অকৃতজ্ঞতা হয়, সে নাম মুগ্ধ। বন্ধুত্বের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে মুগ্ধই জীবনের সর্বদা পাশে থেকেছে। যখনই জীবনের মা হাসপাতালে শয্যাশায়ী, তখন তার যাবতীয় চিকিৎসার ভার নীরবে কাঁধে তুলে নিয়েছে মুগ্ধ। বিপদের মুহূর্তে সাহচর্যের জন্য পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে আত্মীয়-স্বজন পরিহাসেরূপে নীরব হলেও মুগ্ধ ছিল এক অনন্য আশ্রয়। জীবনের প্রতিটি বিপন্নতায়, কেবল মুগ্ধই একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রতিরূপ হিসেবে অগ্রবর্তী।
জীবনের জন্য মুগ্ধ কেবল একজন বন্ধু নয়, বরং এক সহৃদয় বড় ভাইয়ের স্নেহচ্ছায়া। এই মানুষটির সহজাত অভ্যাস মনের গহন কথাটি ওষ্ঠে না আনা, তবে জীবনের পক্ষে সেই অনুভূতির অনুধাবন করা আর অনন্য নয়। অথচ মুগ্ধের প্রিয়তম বোনের প্রতি জীবনের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা, এই বন্ধনের শৃঙ্খলকে ছিন্ন করে দেওয়ার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসে। তবু এই আকাঙ্ক্ষাকে দমিত রাখতে বাধ্য সে, নতুবা তা হবে অকৃতজ্ঞতার কালিমায় মুগ্ধের আস্থা ও বিশ্বাসের উপর এক নির্মম আঘাত। তাই তো আজ মুগ্ধের বিশ্বাসী সংবাদবাহক হয়ে জীবনের প্রত্যয়।
কিন্তু, দারিদ্র্যের পৃথিবীতে ভালোবাসার স্থান কোথায়? এ যেন বিলাসিতার অতীত এক মরীচিকা। আছিয়া, এই শৈশবকালের মুগ্ধ কিশোরী, যখন বৃহৎ জীবনের রূঢ় বাস্তবতায় প্রবেশ করবে, তখন সে উপলব্ধি করবে, এই দরিদ্রের সংসারে ভালোবাসা কেবল এক অলীক কল্পনা, জানালার ফাঁক গলে পালিয়ে যায়। দারিদ্র্যের আবদ্ধ গণ্ডিতে ভালোবাসা নয়, বরং সংগ্রামের অ'ভিশপ্ত বৃত্তেই যেন তার ভবিতব্য নির্ধারিত।
জীবনের অন্তঃস্থলে সঞ্চিত দীর্ঘশ্বাস যেন নিঃশব্দে নক্ষত্রপতনের ন্যায় ঝরে পড়ে, এক অব্যক্ত শূন্যতার আধারে। হয়তো আছিয়া, ভিন্ন কোথাও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে, ভুলে যেতে পারবে তাকে। জীবন এ-ই চায়—আছিয়ার স্মৃতিতে সে যেন রিক্ত, নিরাভরণ হয়ে থাকে, বিস্মৃতির সুধায় বিলীন। কারণ, জীবন জানে তার বোধের প্রাচীরে এ সম্পর্ক অনধিকার; বিধাতা লিখেছেন ভিন্ন শর্তাবলীর সন্ন্যাসে।
কিশোরী আছিয়ার জন্য জীবনের এই নিবিড় ত্যাগপ্রবণতা, এক অতল গহ্বরের নিষ্ঠুর বিনিয়োগ—সে যেন সুখী হয়, ব্যথামুক্ত থাকে। অথচ এ নিষ্ঠুর বাস্তবতায় জীবনের অভ্যন্তরীণ উপলব্ধি অবশ হয়ে রয়েছে; এক অসীম নির্জনতার নিঃশ্বাসে গুমরে গুমরে ওঠা হাহাকার। পিতা-মাতার ক্ষীণকায় শরীর আর জীর্ণ বয়সের ভারে এই অন্তিম বাসনা যে, পুত্র যেন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তাদের তৃষ্ণার চিহ্নটুকু মুছে ফেলে, তাদের জীবনের রিক্ততা পূর্ণ করে। তবে জীবন অবিচল; এ বন্ধনের আবাহনকে সে নীরবে অস্বীকার করেছে। কারণ, কারও চোখের জল কেবল তার জন্য ঝরবে, আর সে নির্বিকার হয়ে অন্য কোথাও সুখসঙ্গীতে নিমগ্ন হবে; এতো প্রকৃতির বিধান নয়।
অতএব, জীবন কামনা করে, আছিয়া যেন তাকে স্মৃতির স্তব্ধতায় নিক্ষেপ করে নিজেকে সম্পূর্ণে আবৃত্ত করে নেয় নতুন জীবনের জালে। সে যেন চলে যায় দূরবর্তী অভিসন্ধানে, সংসারের স্বর্গে খুঁজে পায় এক নব আনন্দের ভূমি। জীবন তার অন্তর্গত বেদনাবোধকে আড়াল করে, অনুভূতির বিশাল মরুভূমিতে এক নিঃসঙ্গ কাফেলারূপে নিভৃতে বিচরণ করবে। আছিয়া এখনো তার কাছে এক অনন্যসাধারণ স্মৃতি, মায়াবী অতীতের গভীরতম অনুশ্চিততায় নিবিষ্ট।
সবচেয়ে বড় কথা তার ভাই মুগ্ধের হৃদয়, অগ্নিগর্ভে অবস্থিত অচঞ্চল শিলাখণ্ড, যার ভেতরেও সুপ্ত জ্বলন্ত লাভার মতো প্রেমের তীব্র যন্ত্রণা প্রবাহিত হয়। নিঃশব্দে, আড়ালে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে নিজের অন্তরকে ছাইতে রূপান্তরিত করে। মুগ্ধ, যে ব্যক্তি সংযমের পরম নিদর্শন, তার হৃদয়ও যদি ভালোবাসার বিষাদে দগ্ধ হয়ে নিঃশব্দে ছাই হয়ে যেতে পারে, তবে জীবনের দুঃখ সেই বিরাট মহাকাব্যের এক ক্ষুদ্র অধ্যায়।
মুগ্ধ যদি তার অন্তরে প্রতিদিন ভালোবাসার অগ্নি নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে, অনন্ত যন্ত্রণার বেদনায় নিজেকে জ্বালাতে পারে, তবে জীবনের জন্য এ কষ্ট তুচ্ছমাত্র। জীবনও পারবে সেই বেদনার প্রতিটি বন্য ঢেউ সহ্য করে নিজের অনুভূতির মহাসমুদ্রকে শান্ত রাখার সাহস অর্জন করতে।
আছিয়ার হাসিমুখ মোবাইলের স্ক্রীনে এক অপূর্ব জ্যোৎস্নাপ্লাবিত চিত্রপট, যেখানে তার প্রতিটি হাসির রেখায় অমৃতমাখা মায়া। সেই ছবির উপরে জীবন আঙুল বুলিয়ে নির্ভার অথচ গভীর কণ্ঠে বলে উঠল,
——— "ভুলে যাও, প্রিয়তমা, তোমার জীবনের এই কালো অধ্যায়; জীবন নামক ছায়ামানুষটিকে। চোখের জল ফেলে আমাকে আর দহন করো না! এই অনির্বাণ আগুনে নিজেকে আর পোড়িও না! তোমার জীবনের আকাশে মুক্তির আলো জ্বলুক, এই আঁধারকে পেছনে ফেলে তুমি মুক্ত হও, সুখের আলোকপথে পা বাড়াও।"


Post a Comment

0 Comments

Close Menu