Ad Code

শ্যামকন্যার মায়াবী চোখ - পর্ব ৩৬

 লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা

🚫🚫
কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।
🚫🚫
⛔
ভায়োলেন্স যুক্ত পর্ব! প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত
⛔
*
*
শিকদার বাড়ির প্রাচীর ভেদ করে বহুদূর পর্যন্ত কান্না আর হৃদয়বিদারী আহাজারির সুর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সকলের সম্মুখে এক অন্তহীন শোকের সমুদ্র প্রবাহিত, সেখানে এক এক করে আত্মীয়-স্বজনের সমাবেশ ঘটছে—মানুষের ঢল নামছে নিঃশেষিত শোকবাহী স্রোতে! আফিয়া বেগম ভগ্নপ্রায় শরীরে মাটিতে লুটিয়ে কাঁদছেন, ক্ষ'ত-বি'ক্ষ'ত হৃদয়ের গহ্বরে আর্তনাদের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। কানিজ বেগম আর রোকেয়া বেগম, সাথে রিতু—তিনজনে মিলেও সামলাতে ব্যর্থ। আফিয়া বেগমের ক্রন্দন অসীম বেদনার স্তবক হয়ে ছিন্ন হয়ে পড়ছে। তিনি আর্তনাদ করছেন,
——— “আল্লাহ ! আমার মেয়েটাকে কে এমন করল! কে এত বড় সর্বনাশ ঘটাল! আমার সোনার টুকরো মেয়ে, পূরু রে!”
অশ্রুর প্রবল বাঁধ যেন এই অসীম শোকের তীর বিদীর্ণ করে প্রবাহিত হচ্ছে, কারোই আর চোখের জলে বাধা নেই। শান্ত ও নাঈম, দুই নিস্তব্ধ প্রতিমার মতো, জাগ্রত যন্ত্রণার তপ্ত স্রোতে ডুবে গিয়ে পাথুরে মেঝেতে স্থির হয়ে বসে আছে। তাদের লালচে চোখে অনুশোচনার অনল জ্বলে, বুকের অন্তঃস্থলে অপরাধবোধের এক বিষাক্ত শিকড় বেঁধে আছে। আজ তারা নিজেদের সেই জঘন্য, নীচ, কুৎসিত ভাই বলে উপলব্ধি করছে, যারা বোনের প্রাণধর্মকে রক্ষা করতে পারেনি, অথচ দু’জনের অস্তিত্ব ছিল এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে!
নিজগৃহের নিরাপত্তা আর পরিচিত দেওয়ালের আড়ালেও কেউ তাদের বোনের প্রতি এমন জঘন্যতম হস্তক্ষেপ করেছে—এই ভাবনাই তাদের হৃদয়কে ছিন্নভিন্ন করে, কলিজাকে পিষ্ট করে কাতরাচ্ছে। তাদের এই অপরাধবোধ ও অসম্ভব বেদনা এক তীক্ষ্ণ শূলে প্রতিনিয়ত তাদের আত্মাকে বিদ্ধ করছে, আর তারা নির্বাক হয়ে সেই অমোচনীয় লজ্জা, সেই ব্যর্থতার দহন অনুভব করছে।
-----
মহুয়ার তীক্ষ্ণ নজর পূর্বিকার ঘরে সর্বত্র অনুসন্ধান চালাচ্ছে; প্রতিটি খুঁটিনাটি তার অনুরণিত দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। একইসময়ে, রুদ্র সেই বৃদ্ধ ব্যক্তির দেহ যেখানে পাওয়া গিয়েছিল, সেই স্থানটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং সম্ভাব্য প্রত্যক্ষদর্শীদের কঠোর জিজ্ঞাসাবাদে নিয়োজিত। অন্যদিকে, মুগ্ধ শিকদার প্রাসাদের পেছনে বিস্তীর্ণ জমির প্রতিটি ইঞ্চি গভীর মনোযোগে পরীক্ষা করছে, যেখানে ইকরাম আলীর নিথর দেহ পড়েছিল।
ইতিমধ্যে, সকলের সামনেই মুগ্ধর পরিচয়ের আবরণ খুলে গিয়েছে; জানা গিয়েছে সে আসলে একজন সিআইডি অফিসার! স্বাভাবিক সময়ে হলে এই প্রাসঙ্গিক চমক সবাইকে আনন্দ, বিস্ময় ও প্রশ্নবাণে আচ্ছন্ন করতো। তবে আজকের পরিস্থিতি অন্য মাত্রার, যেখানে আবেগকে শৃঙ্খলিত রেখেছে ভীতিকর বাস্তবতা ও সংকটের গভীরতা।
পূর্বিকা, ইকরাম আলী এবং সেই বৃদ্ধ ব্যক্তির নিথর দেহ ইতোমধ্যে ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছে, অন্ধকার রহস্য উদ্ঘাটনের প্রতীক্ষায়। মুগ্ধ তীক্ষ্ণ অনুসন্ধান সমাপ্ত করে দাঁড়িয়ে থাকা আজগর আলী ও কুদ্দুস আলীর দিকে সন্দেহভরা দৃষ্টিতে তাকায়। তার চোখে গভীর প্রশ্নের ছায়া নেমে আসে, যা তাদের অন্তরের আতঙ্ককে বাড়িয়ে তোলে। সেই শীতল কণ্ঠে সে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
——— "গতকাল রাতে আপনারা কোথায় ছিলেন?"
কুদ্দুস আলী গলা খাঁকারি দিয়ে আমতা আমতা করে জবাব দেয়,
——— "ক-কোথায় আবার? রুমেই তো ঘুমাচ্ছিলাম!"
আজগর আলীও একই কথা পুনরাবৃত্তি করে, তবে তার কণ্ঠে উদ্বেগের সুর স্পষ্ট। তাদের অনিশ্চিত চোখে অস্থিরতার ঝিলিক দেখে মুগ্ধ ঠোঁটের কোণে এক তীক্ষ্ণ, ব্যঙ্গাত্মক হাসি ফুটিয়ে বলে,
——— "হুম, তাহলে সম্পত্তির ভাগটা এবার নিশ্চয়ই বেশিই হয়ে গেলো?"
মুগ্ধর কথায় চমকে উঠে দুইজন; আজগর আর কুদ্দুস। তারা এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে মুগ্ধর কঠোর, সন্দিহান চোখের দিকে, যেখানে প্রতিটি প্রশ্নের শাণিত ধার প্রতিফলিত হচ্ছে। তাদের পলায়নপর চোখ আর নড়চড় করা ঠোঁট ভেতরের অস্থিরতার নিঃশব্দ ভাষায় সাক্ষ্য দিচ্ছে। এরপর মুগ্ধের দৃষ্টি গভীর তীক্ষ্ণতায় বিঁধে রইল মোশারফ সাহেবের উপর, যে এখনো অটল নিষ্কম্প দাঁড়িয়ে। গাম্ভীর্যের অবগুণ্ঠনে আবৃত মোশারফ সাহেবকে লক্ষ্য করে মুগ্ধ তীব্র শীতল স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
——— "গতরাতে তুমি কোথায় ছিলে?"
মোশারফ সাহেব বিস্ময়ে পলক ফেললেন, নিজের পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ইতস্তত হয়ে উঠল তার অবয়ব; বোধহয় কখনো কল্পনাতেও আনতে পারেননি, তার সেই উচ্ছৃঙ্খল দুরন্ত পুত্র তলে তলে সিআইডির পানি খেয়েছে! এক সময় যার অনুপস্থিতি নিয়ে নিত্য নিঃসঙ্গতা ও বিষাদের অ'ভিশাপ বর্ষণ করেছেন তিনি! আজ তার বুঝতে বাকি নেই কেন মুগ্ধ এত আগ্রহ নিয়ে পূর্বিকাকে বরণ করে নিতে চেয়েছিল; যদি সে আগে এই অন্তর্নিহিত কারণ অবগত হতো, হয়তো বিবাহের বাঁধনে আবদ্ধ করিয়েই দিত। কিন্তু এখন তো শূন্যতায় বিধুর হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই! তবে মুগ্ধ এখন তার দিকে এমন ভাবে চেয়ে রয়েছে, যেন তার মস্তকেই অপরাধের মূল উৎসস্থল ধরে নিয়েছে!
মোশারফ সাহেব কণ্ঠ পরিষ্কার করলেন এবং কিঞ্চিৎ কাঁপা স্বরে বললেন,
——— "আমি কোথায় থাকব? রাতে সকলেই ঘুমায়, আমিও ছিলাম নিদ্রামগ্ন। দরকার পরলে তোমার মাকে জিজ্ঞাসা করো!"
এই বলে তিনি সুহানা বেগমের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন, যার চোখ দু'টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল তৃপ্তির অশ্রুজলে; কারণ তিনি জানেন, তার পুত্র কখনো অসার কোনো পদক্ষেপে প্রণালিবদ্ধ হয় না।
মুগ্ধের কণ্ঠ কঠোর ও নির্দয় হয়ে উঠল,
——— "যতটুকু জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, ততটুকু উত্তর দাও! কাকে প্রশ্ন করতে হবে, সেটা আমি জানি। আর হ্যাঁ, এখানে তুমি একজন সিআইডি অফিসারের মুখোমুখি, তোমার সন্তানের নয়! এখানে কেবল আমি সত্যের অনুসন্ধানকারী, এবং সকলেই আমার দৃষ্টিতে কেবল সন্দেহভাজন!"
সাজ্জাদ সাহেব মনে মনে মৃদু হাসলেন; তার বড় ভাই এবার সত্যিকারের ফাঁদে পড়েছেন! এতদিন ধরে ছেলেকে নানাভাবে কথা শুনিয়েছেন, আর আজ সেই ছেলে তার শাস্তির প্রতিদান চেয়েছে। আরাফও মনে মনে তৃপ্তি অনুভব করল; সে জানত তার ভাই কখনো কোনো অন্যায় কাজে লিপ্ত ছিল না।
মোশারফ সাহেবের মুখে ভাষা হারিয়ে গেল। নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন তিনি। কপালের ঘাম মুছে ইদিক-সেদিক তাকালেন, দৃষ্টির আড়ালে নিজেকে লুকাতে চান। মুগ্ধ নির্লিপ্ত কণ্ঠে ফের বলল,
——— "অন্য কাউকে দিয়ে যে নিজের শত্রুর র'ক্তে প্রতিশোধের অর্ঘ্য সাজাওনি, তার কি প্রমাণ দিতে পারো? তুমি নিজ হাতে হত্যা করতে আসবে, এ আশা করা বাতুলতা; গ্যারান্টি আছে কি ছায়ার আড়ালে থেকে শিকার করনি?? "
মুগ্ধর এহেন কথায় মোশারফ সাহেবের চক্ষু বিস্ফারিত হয়ে উঠল। মুগ্ধের তীক্ষ্ণ ছোট ছোট চোখ তার ভেতরের সমস্ত ভয় উন্মোচিত করছে। মোশারফ সাহেব আড়ষ্টভাবে ফের এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন, চারপাশের শূন্যতা তাকে আবৃত করে ফেলছে। বললেন,
——— "ওর আমার মাঝে ঝামেলা আছে ঠিকই তাই বলে আমি কখনো ওর মৃ'ত্যু চাই নি! হ্যাঁ ওকে শিক্ষা দিতে চেয়েছি, শাস্তি দিতে চেয়েছি তবে প্রাণে মে'রে ফেলতে চাই নি!"
——— "শুনেছি উনাদের জন্যই নাকি তোমার বাবার মৃ'ত্যু হয়েছিল?"
কঠোর কন্ঠে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল মুগ্ধ! মোশারফ সাহেব বাকহীনতায় ভুগলেন! এমন ঠান্ডার হাওয়াতেও তার শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে এক নিঃশব্দ শীতল আতঙ্ক তার অস্তিত্বকে গ্রাস করছে।
____________
রুদ্র, জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে বুঝেছে, এই বৃদ্ধ লোকটি কোনো বৈরী সম্পর্ক ছাড়াই ভিক্ষে করেই দিন গুজরান করতো। তার জীবনে এমন কোনো শত্রুর অস্তিত্ব নেই বলে মনে হলেও, রুদ্রের তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক কোনো কারণে চুপ করে থাকতে নারাজ। তার অন্তর্দৃষ্টি বলছে, এই বৃদ্ধ হয়তো এমন কোনো গোপন সত্য জেনে ফেলেছিল যা তার নিজের মৃ'ত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হয়তো এমন কোনো হিং'স্র শিকারী ছিল, যার কাছে এই বৃদ্ধ লোকটি একটি অনাহুত বাধা হয়ে উঠেছিল।
____
মহুয়া বহুক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছে, পূর্বিকার কক্ষের দরজার সামনে নিশ্চল, নিবিষ্ট বসে আছে আঁখি। ভিতরে প্রবেশের অনুমতি নেই, তাই সে কেবল বাহির থেকেই একনিষ্ঠ দৃষ্টিতে ছাদের ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে—যেখানে তার বড় আপুর নিষ্প্রাণ অর্ধনগ্ন দেহটি ঝুলে ছিল। মহুয়ার কপালে গভীর চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে; তার চোখ আঁখির গালমুখের পঁচি আঙুলের চিহ্নে স্থির হয়ে আছে। সেই কালচে আঘাতের দাগটি শ্যামলা গালে বিষণ্ণতার ছায়া এঁকে দিয়েছে, যেটা কোনো নি'র্ম'ম হাতের প্রমাণ।
তবে আশ্চর্যের বিষয়, মেয়েটি একফোঁটা অশ্রুও ফেলছে না। তার র'ক্তাভ দৃষ্টিতে বিদ্রোহী যন্ত্রণার ঝিলিক, টকটকে লালচে চোখ কোনো অন্তর্গত অগ্নির প্রতীক। যখন চারদিকে আর্তনাদ আর অশ্রুর বিসর্জনে বাতাস ভারাক্রান্ত, তখন সে নির্বিকার, অনড়। মহুয়ার অন্তরে এক অদ্ভুত সন্দেহের স্রোত উথলে উঠছে—এই ক্ষুদ্র মেয়েটির উপর হয়তো ক্রমাগত অবর্ণনীয় নির্যাতন চালানো হয়েছে। এতটুকু বয়সেই এত কঠোরতা, এত অনুভূতিহীনতা এমনি এমনি জন্ম নেয় না।
মহুয়া গ্লাভস খুলে নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। হাঁটু গেড়ে আঁখির সামনে বসে তার গালের ওপরে আলতো করে হাত রাখল। আঁখির ভাসা ভাসা ডাগর র'ক্তিম চোখের দিকে চেয়ে কোমল কণ্ঠে বলল,
——— "কেও তোমায় আ'ঘা'ত করেছে?"
আঁখি চুপ করে কিছুক্ষণ স্থির থাকল,! মহুয়ার ভ্রু কুঁচকে গেল,স্নেহমাখা হাতটি আঁখির গালে বুলিয়ে আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
——— "ভয় পেয়ো না! তোমার সাথে খারাপ কিছু হলে আমাকে বলতে পারো। আমি তোমার বড় বোনের মত!"
আঁখি মহুয়ার পানে অপলক তাকিয়ে রইল। তার শুভ্র মুখাবয়বে এক অমোঘ মায়াবী ছায়া খেলা করছে। "বড় বোন" শব্দটি শুনেই আঁখির অন্তর্গত স্মৃতিপটে জাগ্রত হলো পূর্বিকার মলিন মুখাবয়ব; যে বড় বোনকে আঁখি হারিয়েছে। বুকের গভীরে যেন হঠাৎ এক তীব্র ব্যথার ঢেউ বইতে লাগল, সেই মর্মান্তিক স্মৃতির আঘাতে তার অস্তিত্ব মুহূর্তে নড়ে উঠল। চোখের কোণে জমতে থাকা অশ্রুর স্রোত অবশেষে বেরিয়ে পড়ল, তার গাল বেয়ে নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ল সে অশ্রুকণা। কণ্ঠে নিস্তেজতার স্পর্শে ভাঙা কন্ঠে আঁখি বলল,
——— "গা-গালে মশা বসেছিল, সে-সেটা মা'রতেই এই দা-দাগ।"
মহুয়া অবাক হলো আঁখির এমন যুক্তিহীন কথায়, যা তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাকে বিভ্রান্ত করতে পারল না। একজন সিআইডি হিসেবে মহুয়া খুব ভালো করেই জানে, কোন দাগ চড়ের এবং কোনটি মশা মা'রার চিহ্ন। তবুও সে কথা এড়িয়ে কোমল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
——— “তুমি কি কিছু জানো? তোমার আপুর সাথে এমন কে করেছে কিংবা কেউ কেন করতে পারে?”
আঁখি নীরবে মাথা নেড়ে না জানার ইঙ্গিত দিলো। মহুয়া স্নেহভরা এক অন্তিম দৃষ্টি আঁখির অশ্রুভরা মুখে নিবদ্ধ করে তার গাল থেকে অশ্রুবিন্দু মুছে দিল। অতঃপর নিঃশব্দে উঠে দাঁড়িয়ে আঁখিকে সেখানেই রেখে চলে গেল!
সঙ্গে সঙ্গে মহুয়ার মুখের দৃঢ়তা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। এক মুহূর্তের মধ্যেই তার চোয়ালে কঠোরতার শীতল রেখা ফুটে উঠল। সকলের সামনে এসে, কণ্ঠ বরফশীতল ধ্বনিতে ভারী হয়ে উঠল, প্রত্যেকের উদ্দেশ্যে বলল,
——— "এ বাড়িতে যত পুরুষ সদস্য আছেন—বাড়ির কর্তা, ছেলে থেকে শুরু করে সকল কাজের লোক—তাদের সবাইকে ডেকে পাঠান।"
___________
আফ্রিদির মুখমণ্ডলে বিদ্রোহী র'ক্তাভ আভা; তার চোখে অ'গ্নিস্ফুলিঙ্গ আর বুকে জমে থাকা দগ্ধ ক্ষ'তের করুণ প্রতিচ্ছবি। হাতে বি'ষের বোতল, যা সে নির্বিকার চক্ষে নির্নিমেষে দেখছে, কোনো নিষ্ঠুর প্রলাপের প্রতীক। তার অশ্রুবিন্দুগুলো কেবলমাত্র দৃষ্টির ধারাকে সিক্ত করছে না, বরং তার অন্তর্গত বিষাদের এক কঠিন অভিঘাতে প্রতিটি বিন্দু নীরব হাহাকারে পরিণত হচ্ছে। বক্ষে ভীষণ ঘৃণা ও লজ্জার ভার, নিজেকে এক কাপুরুষ বলে অভিহিত করে তার অপরাধবোধ কষাঘাত করে যাচ্ছে তার অন্তর্নিহিত বেদনায়।
তার পূর্বি, তার অন্তরের গভীরতম আরাধ্য, তাকে ছেড়ে অনন্তের পথে পাড়ি দিয়েছে। প্রতিদিন ঘুম ভেঙে তার কানে ভেসে আসা মধুর স্বর আজ অবান্তর বেদনায় রূপ নিয়েছে। সে কখনোই চায়নি এমন পরিণতি; তার ইচ্ছা ছিল পূর্বিকে নিজের অস্তিত্বে জড়িয়ে রাখার, তার প্রিয়তমারূপে। তবে কেন, কেন পূর্বি তাকে একা ফেলে গেল? কেন মৃ'ত্যুর নিষ্ঠুর বন্ধনে বাঁধা পড়ল?
মাটিতে লুটিয়ে, মাথার চুল পাগলের ন্যায় ছিঁড়ে, চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বিষের বোতলের দিকে চেয়ে বলল,
——— "আমি তো তাকে মা'রতে চাইনি! আমি তো তাকে কেবল আমার করেই পেতে চেয়েছিলাম, শুধুই আমার! তবে কেন সে আমাকে ত্যাগ করল? কেন সে আমার হাত ছেড়ে জীবনের অন্য প্রান্তে হারিয়ে গেল?"
__________
ফরেনসিক ল্যাবের নিঃসঙ্গ, গম্ভীর পরিবেশে ডক্টর উজ্জ্বল নিবিষ্ট চিত্তে কাজ করে চলেছেন। পাশে তার সহকারী মিথিলা নানা কাজে সাহায্য করে চলেছে, সাবধানী ও পদ্ধতিগতভাবে। সামনে শায়িত তিনটি নিথর দেহ—পূর্বিকা, ইকরাম আলী, এবং এক বৃদ্ধ—সাদা কাপড়ে আচ্ছাদিত। পোস্টমর্টেমের আনুষ্ঠানিকতা সমাপ্ত হয়েছে!
ঠিক তখনই মুগ্ধ, রুদ্র, এবং মহুয়া ল্যাবে প্রবেশ করল। মুগ্ধকে দেখে মিথিলা তৎক্ষণাৎ নিজের চুল, পোশাক সামলে নিলো; মুগ্ধের সামনে নিজেকে আরও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে হবে; এ যেন তার মনের অবচেতন প্রস্তুতি। ডক্টর উজ্জ্বল তাদের দেখেই হালকা হাসলেন। মুগ্ধ, নিজের দৃঢ় কণ্ঠে সরাসরি প্রশ্ন করল,
——— "কী জানতে পারলেন, ডক্টর?"
ডক্টর উজ্জ্বল তাদের দিকে তাকিয়ে পেশাদারিত্বপূর্ণ গলায় বললেন,
——— "এই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে ম্যানুয়াল এসফিক্সিয়ার কারণে, অর্থাৎ তাকে শ্বাসরোধের মাধ্যমে হ'ত্যা করা হয়েছে।"
তিনি বৃদ্ধটির নিথর দেহের কাছে গিয়ে গ্লাভস পরা হাতে গলার অংশটি সরিয়ে ধরলেন, যেখানে গাঢ় নীলচে কালো দাগগুলো স্পষ্ট। ডক্টর উজ্জ্বল ব্যাখ্যা করলেন,
——— "এই দাগগুলো দেখ, শ্বাসনালী এবং কারোটিড ধমনীর উপর শক্ত চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে, যার ফলে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং এসফিক্সিয়ার মাধ্যমে মৃ'ত্যু ঘটে।"
তিনি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আরও বললেন,
——— "শ্বাসরোধের পর, মৃ'তদেহে বারবার অহেতুক আঘাত করা হয়েছে। মরণোত্তর এই ট্রমাগুলো দেখে বোঝা যায়, এটি শুধু হত্যাই নয়, বরং হত্যাকারীর স্যাডিস্টিক মানসিকতার প্রতিফলন। অর্থাৎ কু'পা'নোর কারণ নিজের আনন্দ !
মহুয়ার কণ্ঠে তীব্র ক্রো'ধ ঝরে পড়ল,
——— "মানুষ কতটা অমানুষ হলে এমন নির্ম'ম কাজ করতে পারে!"
ডক্টর উজ্জ্বল এবার ধীর পদক্ষেপে ইকরাম আলীর নিথর দেহের কাছে গেলেন। তার শরীরে অসংখ্য কো'পের চিহ্ন বিদ্যমান। উজ্জ্বল সাহেবের চোখে গাঢ় গাম্ভীর্য তার কণ্ঠে চাপা শীতলতা,
——— “ডিকেডেন্ট আঘাতগুলোর উপস্থিতি নির্দেশ করে যে এই মৃ'ত ব্যক্তি মৃ'ত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত যথেষ্ট শারীরিক প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলেন। তার শরীরে মাল্টিপল ইনসিশনস পাওয়া গেছে, আ'ঘাতগুলো ধা'রা'লো অ'স্ত্র দ্বারা করা হয়েছে এবং আ'ক্র'ম'ণের সময় অপ্রতিরোধ যোগ্য শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে।”
তিনি মৃ'তদেহের হাতের ওপরের গভীর ক্ষতগুলোর দিকে ইঙ্গিত করলেন এবং বললেন,
——— “প্রথমিক পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, রিস্ট ও অ্যাঙ্কেল এলাকায় দৃষ্টিগোচর লিগেচার মার্কস রয়েছে, অর্থাৎ তাকে জোরপূর্বক বাধা অবস্থায় রাখা হয়েছিল। জ ব্রিজ বা ম্যান্ডিবল এরিয়ায় রেস্ট্রেইনিং চিহ্ন পাওয়া গেছে, যা স্পষ্টতই ভিকটিমের আওয়াজ বন্ধ রাখতে করা হয়েছিল। এটা নিশ্চিতভাবেই একটি প্রি-মেডিটেটেড আ'ক্র'মণ।”
তিনি এক নিমেষ থেমে আবার বললেন:
——— "সমস্ত শরীরে অসংখ্য কো'পের চিহ্ন, যা প্রতিটি জায়গায় গভীর কে'টে গেছে—যেমনটা মাংস কু'পিয়ে কেটে টুকরো করা হয়। শুধু এটাই নয়, প্রতিটি কো'পের পর দেহে লাল মরিচ ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে, এটা থেকে স্পষ্ট খু'নির মনে তার জন্য বেশ আক্রোশ ছিল!
উজ্জ্বল সাহেব গভীর দৃষ্টিতে ইকরাম আলীর বুজে থাকা চোখ খুলে চোখের দিকে ইশারা করে বললেন,
——— "এমনকি উনার চোখের মণি পি'নের তীক্ষ্ণ তল দ্বারা গলিয়ে ফেলা হয়েছে, এরপর সেখানে লাল মরিচের ছিটা দেওয়া হয়েছে! আর এই যে এগুলো দেখছো এগুলো রান্নার জন্য ব্যবহৃত গুড়ো মরিচ! খু'নি নিশ্চয়ই রাধুনির সাথে সম্পর্কিত!
ইকরাম আলীর ভয়াবহ, থেতলে যাওয়া চোখ দেখে মহুয়া অসহ্য যন্ত্রণায় তার চোখ বন্ধ করে নিল। মুগ্ধ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
——— " আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে কি?"
উজ্জ্বল সাহেব বললেন,
——— "খুনি অত্যন্ত চালাক। এই প্রভাবশালী ব্যক্তিকে হ'ত্যার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে আ'ঘাত করেছে!"
ডক্টর উজ্জ্বল গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে বললেন,
——— “তোমার কী মনে হচ্ছে, এই প্রভাবশালী ব্যক্তির হত্যাকারী কে হতে পারে, তাও আবার নিজের জমিতে ফেলে গেলো?”
মুগ্ধ দৃঢ়ভাবে উত্তর দিল,
——— “এ ধরনের প্রভাবশালী ব্যক্তির শ'ত্রুর অভাব নেই; হাজারও প্রতিদ্বন্দ্বী থাকে, আর সম্পত্তির লোভে ঘরের ভেতরেও মুখোশের আড়ালে অনেকেই অপেক্ষায় থাকে। হ'ত্যা'কারীর পরিচয় বের করা তদন্তের কাজ, তবে এতটুকু স্পষ্ট, এ কাজ বাইরের কারো নয়।”
মিথিলা মৃদু হাসিতে মাথা দুলিয়ে বলল,
——— "হুম, হুম, তুমি একদম সঠিক বলছ।"
মুগ্ধ সরু চোখে তাকালো মিথিলার দিকে, এরপর উজ্জ্বল সাহেবের দিকে ফিরে বলল,
——— "পূর্বিকার বিষয়ে কি জানতে পেরেছেন?"
উজ্জ্বল সাহেব ধীরে ধীরে পূর্বিকার লা'শের দিকে এগোলেন, যেখানে সাদা কাপড়ে বুক পর্যন্ত ঢাকা দেহ শুয়ে আছে। পূর্বিকাকে দেখেই মহুয়া পুনরায় বলল,
——— "এটা ওর বাড়ির কারো কাজ!"
উজ্জ্বল সাহেব বললেন,
——— "বাড়ির কারো কাজ কিনা সেটা তোমরা বের করবে, তবে বাড়ির ভেতরে এটি ঘটেনি!"
রুদ্র বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
———" মানে?"
উজ্জ্বল সাহেব পূর্বিকার হাত ধরে নখের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন,
——— "এই দেখো, এর নখগুলোতে মাটি ও ঘাস লেগে রয়েছে। যখন মেয়েটাকে ধ'র্ষ'ণ করা হয়েছে, তখন সে আত্মরক্ষার জন্য খামচে ধরেছিল, আর এই যে চামড়া উঠে এসেছে, সেটি সেই ধ'র্ষ'ক ব্যক্তির!
ক্ষুদ্র চামড়াটির টুকরো দেখিয়ে বললেন উজ্জ্বল সাহেব! এরপর বললে,
——— "যখন মেয়েটা অসহায় হয়ে পড়েছিল, তখন মাটি খামচে ধরেছিল!"
মুগ্ধর কণ্ঠে রাগ জাগিয়ে উঠল। হতবাক হয়ে বলল,
——— "তাহলে আপনি নিশ্চিত এটা বাহিরেই ঘটেছে?"
——— "হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত যে এই জ'ঘন্য ঘটনা বাহিরে হয়েছে। আর এই মাটিটি দেখো, এই মাটি এবং ঘাসগুলো ঝোপঝাড়ে জন্মায়। শুধু এটুকুই নয়! এই যে কা'ম'ড়া'নোর চিহ্ন গালে দেখছো, শুধু গালে নয়, পুরো শরীরে রয়েছে। এবং এখানে ম'দের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। স্পষ্টতই, নি'ষ্ঠু'রতা ও মদ্যপ অবস্থায় ধ'র্ষ'ণ করা হয়েছে।"
এই ভয়াবহ তথ্যাবলী শুনে মহুয়ার শরীরে ঘিন ঘিন ধরে গেলো। মুগ্ধ ও রুদ্র পরবর্তী প্রশ্নাবলী উত্থাপন করে চলল, যা তাদের তদন্তের ক্ষেত্রে অপরিহার্য। এরপর তিনজনই সেখানে থেকে প্রস্থান করলে গাড়িতে প্রবেশ করে তারা সোজা আগের দিকে যাত্রা শুরু করল। রুদ্র বিস্ময় জাগানিয়া কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
——— "স্যার, এখন আমরা কোথায় যাচ্ছি?"
মুগ্ধের গাঢ় রাগী স্বরে উত্তর এল,
——— "আফ্রিদির বাড়ি!"
——— "আফ্রিদি কে স্যার?"
মহুয়া পেছন থেকে কৌতূহলী স্বরে প্রশ্ন করল,
——— "পূর্বিকার প্রেমিক!"
মুগ্ধের সোজাসাপটা উত্তর স্বরবৃত্তে। গাড়িটি ফুলস্পিডে এসে থামল আফ্রিদির বাড়ির সামনে। মুগ্ধ দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে হনহনিয়ে বাড়ির দিকে অগ্রসর হলো। বাড়ির উঠোনে প্রবেশ করতেই নজরে পড়লো আফ্রিদির মা, যিনি আলস্যে বসে উঠোনে সবজি কাটছেন। হঠাৎ মুগ্ধকে দেখে আফ্রিদির মায়ের ভ্রু কুচকে উঠল, অস্বস্তির একটি রেখা তার চেহারায় স্পষ্ট হলো। তিনি বললেন,
——— "কিরে বাপ, তুই এখানে কেন?"
মুগ্ধ, দ্রুততার সঙ্গে, কর্কশ গলায় উত্তর দিল,
——— "আফ্রিদি কোথায়, চাচি?"
মুগ্ধের কণ্ঠস্বর যেন বজ্রের রণন, ক্রোধের চাপে রক্তিম হয়ে উঠেছে। আফ্রিদির মায়ের চোখে কষ্টের অশ্রু জমা হতে লাগল,,
——— "ওর সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না, বাপ! কখন কোথায় থাকে, তার কোনো ঠিক নেই। গতকাল সেই যে বিয়ের বাড়ি থেকে অকস্মাৎ উধাও হয়ে গেছে। এরপর রাতের অন্ধকারে বাড়িতে ফিরে এসেছে কিনা, তা আমার অজ্ঞাত। সকালে তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখেছিলাম, কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেবের মেয়ের মৃ'ত্যুর খবর শুনে পাগলের মতো দৌড়ে কোথায় যে গেল, এখনও সে ফিরে আসেনি!"
আফ্রিদির মায়ের কণ্ঠে কষ্টের সুর, যা মুগ্ধের হৃদয়ের ক্রো'ধকে আরও জ্বালিয়ে দিল। সংযত করতে চেষ্টা করলেও, মনের ভিতরে আগুন জ্বলে উঠল। কিছু না বলে ঘরের গহীনে প্রবেশ করল, প্রতিটি কক্ষ পরীক্ষা করতে লাগল—সত্যিই সে এখানে আছে কি নাকি নেই। রুদ্র ও মহুয়া উঠোনে উপস্থিত হয়ে অপেক্ষমাণ । মুগ্ধ ঘর থেকে বের হয়ে আসল, চোখে ক্ষো'ভের আ'গুন। রুদ্র জিজ্ঞেস করল,
——— "পেয়েছেন?"
——— "পালিয়েছে! ওকে ধরতে হবে!"
ত্বরিত পদক্ষেপে স্থান ত্যাগের প্রাক্কালে মুগ্ধর অন্তর্লীন যন্ত্র সশব্দে মর্মরিত হলো! সজাগে পকেট থেকে মুঠোফোন উদ্গম করে, তা শ্রবণপথে স্থাপনমাত্র এক রহস্যময় কণ্ঠের ক্ষীণ প্রতিধ্বনি শোনায়, অর্থটি যেন অস্পষ্ট রইল! তবু মুগ্ধের পদক্ষেপ অকস্মাৎ থমকে গেল। মুগ্ধের এই অভাবনীয় স্থবিরতা লক্ষ করে রুদ্র চমকিত চোখে জিজ্ঞাসা করল,
——— “স্যার কিছু হয়েছে কি?”
মুগ্ধ মৃদু এক নিঃশ্বাস ফেলে, ফোনটি পুনরায় পকেটে সংরক্ষিত করল। অতঃপর নিরাসক্ত দৃষ্টিতে রুদ্রের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এক অশীতল কণ্ঠে নির্দেশ দিল,
——— “থানায় চলো!”
আর একমুহূর্ত বিলম্ব না করে হাওয়ার বেগে গাড়ি নিয়ে
দ্রুত থানার দুয়ার অতিক্রম করল তারা। প্রবেশমুহূর্তেই মুগ্ধ থেমে দাঁড়াল; তার অগ্নিময় দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো থানার আসন-মগ্ন আফ্রিদির দিকে, যে মাথা নিচু করে নিঃশব্দে বসে আছে। ইন্সপেক্টর নিয়াজ নীরবতা ভঙ্গ করলেন সম্মান জানিয়ে, সালামের পর বিনীত কণ্ঠে বললেন,
——— “এই ছেলেটি বলছে, সে খু'ন সম্পর্কে কিছু জানে।"
কিন্তু মুগ্ধর কণ্ঠ বা দৃষ্টি, দুটিই অবিচল রইল; তার সমগ্র সত্তা যেন আবদ্ধ হলো আফ্রিদির উদ্ভ্রান্ত মূর্তিতে। আফ্রিদির বিবর্ণ মুখ, বিক্ষিপ্ত চুল, এবং চোখের উন্মত্ত র'ক্তিমতা যেন তার অন্তর্দহন প্রকাশ করছে। আসীন অবস্থায়, সে যেন এক ক্লান্ত পরিত্যক্ত পথিক—নিশ্চুপ ও ম্রিয়মাণ।
কোনো প্রকার পূর্বাভাস ছাড়াই মুগ্ধ এক অগ্নিবাণীর ন্যায় স্ফূর্তি নিয়ে আফ্রিদির নিকট গমন করল। দুঃসহ ক্রোধে বিদীর্ণ হয়ে তার শার্টের কলার টেনে তুলল, সমগ্র দম্ভ ও অবজ্ঞার ভাষা তার হস্তস্পর্শে প্রকাশ পেল।
সুদর্শন শ্যামবর্ণ পুরুষের করুণ পরিণতি! তার দেহে ব্যথার চিহ্ন সুস্পষ্ট, তবুও আফ্রিদি নির্বিকার, কোনো প্রতিবাদ উচ্চারণে তার মুখে সামান্যও স্পন্দন নেই। টকটকে র'ক্তিম নীলাভ নয়নে সে মুগ্ধের দিকে নিষ্প্রাণভাবে চেয়ে রইল। মুগ্ধ, তার ক্রোধে আরও তীব্রতর হয়ে, সকলের সামনে আকস্মিক ভাবে আফ্রিদির শার্ট ছিন্ন করল! অনাবৃত হলো তার সুঠাম দেহ, এবং প্রকাশ পেল বুকে, পিঠে, ঘাড়ে অসংখ্য গভীর নখের আঁচড়—স্পষ্টতই নির্দয়তার চিহ্ন, যা অন্য কারো স্পর্শে আঁকা।
এই দৃশ্য সকলের চোখে বিষ্ময়ের রেখা এঁকে গেল; থমকে গেলো সকলে, বাকরুদ্ধ ও বিমূঢ়! আফ্রিদি তবু নির্বাক; তার র'ক্তা'ভ নয়নে ক্লান্তির গভীর ছাপ, ঠোঁটে বিদীর্ণতার চিহ্ন, এবং সমস্ত মুখে লজ্জা ও আত্মগ্লানির এক নিঃশব্দ ভাষা। অতিরিক্ত ক্রো'ধে সৃষ্ট বিভ্রান্তি, প্রিয়জনকে হারানোর য'ন্ত্র'ণার প্রতিফলন, এক লজ্জাকর পরাজয়ের ক্ষ'তচিহ্ন হয়ে ফুটে উঠেছে তার মুখে। চোখের ভাষা যেন বলে দিচ্ছে সেই অজানা কথা যা মুখে উচ্চারিত হয় না; মিথ্যা লুকোতে পারে মুখের ভাষা, কিন্তু নয়নের ভাষা সর্বদা নির্ভুল।
মুগ্ধ আরও ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে আফ্রিদির গালে প্রচণ্ড এক চ'ড় বসিয়ে দিলো। আফ্রিদি ছিটকে গিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল, তবুও নেই কোনো প্রতিবাদ। মুগ্ধ ক্রো'ধে জ্বলন্ত চোখে নতজানু হয়ে তার গলাটা কঠোর ভাবে চেপে ধরল, আর দন্তাগ্র চেপে বলল,
——— "কেন এমন করলি? বল! যাকে ভালোবাসিস, তাকে কাপুরুষের মতো নোং'রা ভাবে স্পর্শ করতে ; তার সম্ভ্রম ন'ষ্ট করতে লজ্জা হয়নি তোর? আত্মা কাঁপে নি?? তার এই মৃ'ত্যু'র একমাত্র কারণ তুই! তুই-ই ওর স'র্ব'না'শের মূল!"


Post a Comment

0 Comments

Close Menu