Ad Code

সেই তুমি (সিজন - ৩) পর্ব - ১৫

 লেখিকাঃ তাবাসসুম কথা

"আপনি নিচে কিছু না বলেই চলে এলেন কেনো?"

টাওয়াল হাতে ওয়াশরুমের সামনে দাঁড়িয়ে তুর্য। মাত্রই পরনের শার্ট টা খুলেছিলেন শাওয়ারে জন্য।
তুর্যর উত্তর না পেয়ে আবার প্রশ্ন করলাম।
-- কেনো কিছু বললেন না। তাফসি যেটা করতে চলেছে সেটা ভুল। কেনো আপনি তাকে ফেরালেন না?
তুর্য খুবই শান্ত গলায় বললেন,
-- তুমি এখনও ক্লাসের জন্য যাও নি? সময় হয়ে গিয়েছে। ড্রাইভার নিচে ওয়েট করছে তোমার।
-- একদম কথা ঘুরাবেন না। ক্লাসের থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এটা।
-- কারো পারসোনাল ম্যাটারে নাক গলানো ব্যাড ম্যানার। সো নিজের চরকায় তেল দাও।
-- তাফসি আমার বোনের মতো। আমি বেঁচে থাকতে ওর জীবন নষ্ট হতে দিতে পারি না। সো আমি নাক গলাবোই।
-- সবকিছু তাফসির চোখের সামনে। তবুও যদি সে অন্ধের মতো রায়ানকে বিশ্বাস করে তবে আমার ই বা কি করার আছে।
-- আছে অনেক কিছু আছে। এতো সহজে হার মানা ঠিক না। তাফসির ভালোর জন্য যেখানে আমরা একটা অকাম্য বিয়ের সম্পর্কে জরিয়েছি সেখানে আরেকটু চেষ্টা করতে ক্ষতি কি!
হীর এর মুখ থেকে 'অকাম্য বিয়ে' শব্দটা শুনে তুর্যর বুকটা মুচড়ে উঠে। সত্যি তো এই বিয়েটা তো হীর তাকে ভালোবেসে করে নি। দায়ে পরে জোর করে তার গলায় এই বিয়ে নামক ফাঁস ঝোলানো হয়েছে। তুর্যর প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর নিজে থেকেই তার সামনে চলে এসেছে। শুধুমাত্র দায়িত্বের খাতিরে যেই সম্পর্ক তৈরি হয়েছে সেখানে ভালোবাসা আশা করা টা তুর্যর ই বোকামি হয়েছে।
"তুমি কি সত্যি শুধু তাফসির জন্য বিয়ে টা করেছিলে?"
নিজের মনকে অনেকটা মিথ্যে আশা দিয়ে হীর কে প্রশ্ন টা করে তুর্য।
"হ্যাঁ। আর কি কারণ থাকতে পারে বলুন!"
হীর কোনোকিছু না ভেবেই উত্তর দিয়ে দেয়।
হীর এর উত্তরে তুর্যর হৃদয় ভেঙে হাজার টুকরো হয়ে যায়। এতোদিন তার মনে হতো হয়তো হীর ও তাকে ভালোবাসে কিন্তু আজ তার বিশ্বাস হয়ে গিয়েছে হীর তাকে ভালোবাসে না। কখনই ভালোবাসে নি।
-- এতো কি ভাবছেন! কিছু তো বলুন! তাফসিকে আপনি বোঝান। বড় আব্বুও বাসায় নেই। এই সুযোগ টাই নিচ্ছে রায়ান।
-- মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। গেট মি অ্যা কফি।
এতোক্ষণ পর্যন্ত বকবক করেও কোনো লাভ হলো না। তুর্যর এতো উদাসীন ভাব তাও আবার তাফসির প্রতি! কিছুতেই মানতে পারছি না। কেনো কিছু করছেন না উনি!
.
শাওয়ারের নিচে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুর্য। চোখ বন্ধ করে পানির প্রতিটি ফোঁটা কে নিজের বুকে জমে থাকা কষ্টের সমুদ্রে মিশিয়ে নিচ্ছে। আজ এই ঝর্ণার ঠান্ডা পানিও তার মনকে শান্ত করতে পারছে না। বুকের বা পাশটায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। কোনো কিছুই ভাবতে পারছে না সে। হয়তো হীর কখনই তাকে ভালোবাসতে পারবে না। হয়তো তাকে সারাটা জীবন এভাবেই হীর এর অচেনা হয়ে থাকতে হবে। এমনও হতে পারে তাফসির জীবনে সব ঠিক হয়ে যাওয়ার পর হীর তুর্য কে ছেড়ে চলে যাবে! না, তুর্য সেটা হতে দিতে পারে না। হীর কে হারিয়ে যে সে নিজের অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু কোন অধিকারে সে হীর কে নিজের করে রাখবে!
এসব ভাবতে ভাবতে তুর্যর দুচোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু কণারা ঝরে যাচ্ছে। চোখের পানি আর ঝর্ণার পানি একসাথে মিশে নিচে পরছে। দুটো পানি আলাদা করা না গেলেও হয়তো চোখের পানির পরিমাণ ই সেখানে বেশি।
.
সারাদিনে তুর্য আর হীর এর সাথে তেমন কথা বলে নি। হয়তো কিছু বলতে গেলে তার কষ্টগুলো কান্নার রূপ নিয়ে বেরিয়ে আসতো।
হাজার চেষ্টা করেও তাফসিকে কিছুই বোঝাতে পারি নি। আমার কোনো কথাই শোনার জন্য প্রস্তুত না সে। এদিকে তুর্যও আমার সাথে কথা বলেন নি সারাদিনে। কার মুখ দেখে যে ঘুম থেকে উঠেছিলাম! পুরো দিনটাই খারাপ গেলো। আচ্ছা কাল রাতের জন্য তুর্য আমার উপর রাগ হয়ে আছেন কি? এই কারণে কি কথা বলেন নি। কাল রাতে বাসায় থেকে যাওয়ার আগের ঘটনার জন্যেই হয়তো এখনও রাগ করে আছেন। কিন্তু এখানে রাগ করার অধিকার টা আমার। ওই জেসিকার সাথে লুতুপুতু করেতে পেরেছেন অথচ আমি রাগ করতে পারবো না।
হীর কে রুমের দিকে আসতে দেখে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার টা তুলে তুর্য ব্যালকনিতে চলে যায়। হীর এর সাথে চোখ মেলাতে চায় না সে। কিন্তু প্রতিদিন বাড়ির বাইরে থাকা সম্ভব নয় তাই এই উপায় বের করেছে সে। হীর রুমের ভিতর কাউচে হেলান দিয়ে তুর্যর ভিতরে আসার অপেক্ষা করছে। কাল রাতের জন্য তুর্য এখনও রেগে আছে কি না সেটা জানতে চায়।
একটা সিগারেট জ্বালিয়ে দুই আঙ্গুলের ভাঁজে নিয়ে চেয়ারটায় গা এলিয়ে দেয় তুর্য। সিগারেট টা যতো পুড়ছে তার থেকেও বহুগুণ জ্বালা পোড়া করছে তুর্যর হৃদয়। সিগারেটের ধোঁয়া কুণ্ডলী গুলো যেনো তুর্যর পোড়া হৃদয়ের অবস্থার প্রতীকী।
আমার ভালোবাসার মূল্য তো অনেক দূরেই থাক আমার কোনো কথার মূল্যও এই মানুষটার কাছে নেই।আমার মানা করার পরেও দিব্বি স্মোক করে যাচ্ছেন। আমার মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও হয়তো আমার শেষ কথাটা রাখবেন না উনি।
তুর্যর রুমে আসার অপেক্ষা করতে করতে এক পর্যায়ে হীর ঘুমিয়ে পড়ে। অনেক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও হীর এর সামনে যাওয়ার সাহস পায় না তুর্য। কেন যেন তার ভীষণ ভয় করছে যদি হীর বলে দেয় যে সে তাকে ভালোবাসে না! হীর এর মুখ থেকে এই সত্যি টা সে কিভাবে সহ্য করবে! তাই রাতটা সে ব্যালকোনিতেই কাটিয়ে দেয়।
পরদিন ভোর থেকেই চৌধুরী মেনশনে রায়ান আর তাফসির বিয়ের আয়োজন শুরু হয়ে যায়। আফজাল সাহেবের ফিরে আসার পূর্বে তমা বেগম বিয়ের কাজটা সম্পন্ন করতে চান। তাফসির মতো তিনিও বিশ্বাস করেন যা কিছু হয়েছে তাতে রায়ানের কোনো দোষ নেই। তাফসির ইচ্ছা অনুযায়ী ছোট করে একটা হলুদের ফাংশনেরও আয়োজন করেছেন তমা বেগম। তবে বিয়েতে রায়ানের বাবা মা কেউ রাজি নয়। আফজাল সাহেবের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করে রায়ান আবার সেই আফজাল সাহেবের মেয়েকেই বিয়ে করতে যাচ্ছে। এতে তারা মোটেও খুশি নন। তাই তাফসির ইচ্ছায় বিয়ের পর রায়ান কে চৌধুরী মেনশনেই রাখবেন তমা বেগম। এতে অবশ্য রায়ান এর সুবিধা হবে হির এর থেকে তার ইনসাল্ট এর প্রতিশোধ নিতে। আফটার অল হীর রায়ানের ইগো হার্ট করছে।
ঘুম থেকে উঠে তুর্য কে রুমে কোথাও পেলাম না। আজকে অনেক বেলা করেই ঘুম ভেঙেছে। এদিকে রাত এ কিছুই খাওয়া হয় নি। ভীষন খিদে পেয়েছে। কিছু খাওয়ার জন্য নিছে নামতেই আমার চোখ ছানা বরা। পুরো বাড়িকে বউ এর মতো সাজানো হয়েছে। প্রথমে কারণ টা বুঝতে না পারলেও কিছুখন পর মনে পরলো কালকে তাফসি আর রায়ান এর বিয়ে। কাল বিয়ে অথচ আমি কিছুই করতে পারলাম না আমি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিচেনে চলে গেলাম। এত খিদে পেয়েছে মনে হচ্ছে এখন পুরো বাংলাদেশের খাবার আমি একা খেতে পারব।
খাওয়া দাওয়া শেষে রুম এসে বসে আছি অনেকক্ষন। কিন্তু তুর্য এখনও ফিরে আসেন নি। এদিকে ক্লাসে যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। কাল যাওয়া হয় নি। আজ না গেলেই না। আরও কিছুক্ষন অপেক্ষা করেও তুর্য না ফিরলে আমি ক্লাসের জন্য বেরিয়ে পরলাম।
আজ সারাদিনে একবারও তুর্য আমাকে কল করেন নি। এমনকি ক্লাস শেষে নিতেও আসেন নি। কি এমন অপরাধ করে ফেলেছি আমি যার কারণে তুর্য আমাকে এভাবে অ্যাভোইড করছেন! সেদিন রাতের জন্যই কি এমন করছেন? ভারাক্রান্ত মনে বাসায় ফিরে এলাম। এক্সট্রা ক্লাস থাকায় বাসায় ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা গড়িয়ে গিয়েছে। আজ নিশ্চয়ই তুর্য আমার জন্য চিন্তা করছিলেন! সেদিন যখন ওই লোকগুলো আমার পিছু নিয়েছিল তুর্য আমার জন্য কতোটা হাইপার হয়ে গিয়েছিলেন। তুর্য সত্যি আমার অনেক চিন্তা করেন। তাহলে আজ একটা ফোনও কেনো করলেন না! আমিও না ওভার থিংকিং করি। হয়তো বিজি ছিলেন। আর জরুরি তো নয় যে সবসময় চিন্তা আর ভালোবাসার প্রদর্শনী করতে হবে!
যতোটা আশা নিয়ে বাসায় ফিরেছিলাম, ততোটাই হতাশ হতে হলো আমাকে। তুর্য বাসায় নেই। আমি যাওয়ার পর অফিসে গিয়েছেন এখনও ফিরেন নি সেখান থেকে।
রুমে ঢুকার কিছুক্ষণ পরেই বড় আম্মু রুমে এলেন।
-- এই ব্যাগ টা ধর।
-- এটাতে কি আছে বড় আম্মু?
-- তোকে আমি আমার ছেলের বউ মানি না। আর কখনও মানবোও না। কিন্তু যেহেতু তুর্য তোকে বিয়ে করেই নিয়েছে তাই তুই এই বাড়ির বউ।
আমি কিছু বলছি না। মাথা নীচু করে সব শুনছি।
-- আমি চাই না চৌধুরী বাড়ির মান সম্মানে আরও দাগ লাগুক। এই ব্যাগে একটা কয়েক টা শাড়ি আর কিছু গয়না আছে। তাফসির বিয়েতে এগুলো পরবি।
-- বিয়েতে আমার থাকাটা কি জরুরি?
-- তুর্যর ওয়াইফ হিসেবে হলেও থাকাটা জরুরি। ছোট একটা ফাংশন হবে। কিন্তু তবুও চৌধুরী বাড়ির বউকে পারফেক্ট হতেই হবে।
বড় আম্মুর মুখের উপর আর কিছু না বলে চুপচাপ ব্যাগ টা নিয়ে নিলাম। যদিও আমি এই বিয়ের বিপক্ষে কিন্তু আমার যে আর কিছুই করার নেই, চুপচাপ থাকা ছাড়া।
বড় আম্মু চলে গেলে ব্যাগ খুলে হলুদ রঙের শিফনের শাড়ি টা বের করে নিলাম। বুকের বা পাশে চিন চিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। তুর্যর সাথে কথা হয় না আজ দুই দিন পার হয়ে গিয়েছে। কেনো তুর্য আমার মনের অবস্থা বুঝেন না? তাকে ছাড়া আমার একটাদিনও যেনো এক দশক এর মতো কাটে। তুর্য কি এখনও জেসিকাকেই চায়? আমি কি তাদের পথিমধ্যে আসছি!
.
হলুদ একটা শাড়ি আর কাঁচা ফুলের গয়নায় সেজে বসে আছে তাফসি। হলুদের সাজে তাকে ঠিক রূপকথার কোনো হলুদ পরীর মতোই লাগছে। তাফসি তার সাজ শেষ করে আয়নায় নিজেকে দেখছে। অতঃপর তার স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। তার জীবনের কাল বৈশাখী ঝড়ের যেনো অবসান ঘটেছে। এতো ঝড় ঝাপটার পর অবশেষে তার ভালোবাসা পূর্ণতা পেতে চলেছে। আজ সে মহাখুশী। তার এই খুশির তুলনা পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুখ দিয়েও হবে না।
তমা বেগম তাফসি তৈরি হয়েছে কি না দেখতে এলে মেয়ের হাসি মুখটা দেখে তার অন্তর জুরিয়ে যায়। আজ কতোদিন পর তাফসির মুখে হাসি দেখছে সে। সে যেনো এক যুগ পেরিয়ে গিয়েছে। তমা বেগম আড়াল থেকেই মেয়েকে দেখে চলে যান। কেনো যেনো তার ইচ্ছা করছিল না তাফসির হাসি থামতে দিতে।
তুর্যর বাড়ি ফেরার আগেই তাফসির হলুদের প্রোগ্রাম শুরু হয়ে যায়। তুর্য বাড়ি ফিরলে সবার আগে তমা বেগমের সাথে তার দেখা হয়।
-- কোথায় ছিলি তুই তুর্য? আজকে তাফসির হলুদ ভুলে গেছিস তুই?
-- প্লিজ আম্মু আমাকে এই ড্রামায় ইনভল্ভ্ড্ করো না। তাফসি ইচ্ছা করে কুয়োয় ঝাপ দিচ্ছে আর তুমি তাকে এগিয়ে দিচ্ছো।
-- তুর্য! তুই শুধু আমাদের ভুলটা দেখছিস। তুই একবারও তাফসির খুশি টা দেখছিস না। আর কেউ না জানুক তুই জানিস তাফসি রায়ানকে কতোটা ভালোবাসে। আমারমেয়ের সুখের জন্য আমি সব করতে পারি। তুই কি তোর বোনের জন্য এতোটুকু করতে পারবি না?
তুর্য তমা বেগমের কথার উত্তর না দিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। আজকাল বাড়ির মানুষগুলোর সাথে তেমন কথা বাড়ায় না সে। কে কি করলো এই দিকে খুব কমই খেয়াল করে সে। সময় যতো এগোচ্ছে তার মধ্যেকার উদাসীন ভাবটা যেনো আরও বেড়ে যাচ্ছে।
হলুদ শাড়ি টা কোনো রকম গায়ে জড়িয়ে নিলাম। বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তাফসির হলুদের প্রোগ্রামে যাওয়ার। কিন্তু তাফসি আজ ভীষণ খুশি। দ্বিতীয় বার তার সুখ মাটি করতে চাই না। চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে হালকা কিছু গয়নায় নিজেকে সাজালাম। জানি না কেমন লাগছে আমাকে। আসলে সাজগোজের হাত একদমই কাঁচা আমার।
দরজায় চোখ পরতেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠে আমার। তুর্য দরজায় দাঁড়িয়ে। পুরোপুরি ভাবে একদিন পার হয়ে গেছে তাকে আমি দেখি নি। কতো কথা জমে আছে আমার। কতো অভিযোগ বাকি আছে তাকে করা হয় নি!!


Post a Comment

0 Comments

Close Menu