Ad Code

শ্যামকন্যার মায়াবী চোখ - পর্ব ৩৫

 লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা

🚫🚫
কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।
🚫🚫
ফজরের অশ্রান্ত আলোকরশ্মি তখনও আকাশের গভীরে জড়িয়ে, প্রভাতের আলোয় পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত হয়নি প্রকৃতি। সেই আবছা আলোয়, সরু কঙ্কর-বিচ্ছিন্ন পথ ধরে অনমনীয় পদক্ষেপে অগ্রসর হচ্ছিলেন এক পথিক; প্রকৃতির গহন নিস্তব্ধতায় তিনি মগ্ন এক সুরের মায়াজালে জড়িত। চারপাশে নিবিড় বাতাসের ক্ষীণ সুরে তিনি আপনমনে কিছু সুর মেলাচ্ছিলেন।
হঠাৎ তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হল পাশের ঘন ঝোপঝাড়ে। দৃষ্টি কুঞ্চিত করে কিছু বুঝবার চেষ্টা করলেন; কৌতূহলে তিনি সামনের দিকে পদার্পণ করতেই স্থাণু হয়ে গেলেন। তার সম্মুখে উদ্ভাসিত হলো এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য—ঝোপের আড়ালে ভাসমান এক জোড়া নির্জীব, শীর্ণ পা, পায়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মৃ'ত্যুর শীতল ছোঁয়া। সেই পায়ের ছাপের সঙ্গে আবির্ভূত হলো র'ক্তমাখা শরীরের একাংশ, যার চোখ অন্ধকারের গভীরে স্থবির; মুখ হা করে চিরন্তন নীরব আর্তি প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে।
পথিকের মুখ হতে এক গগনবিদারী চিৎকার বেরিয়ে এলো, যেন সেই চিৎকার প্রকৃতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রতিধ্বনি হয়ে আকাশ ভেদ করে ধ্বনিত হল।
--
প্রহরীর প্রতীক্ষায় চৌহদ্দি ঘিরে দাঁড়িয়ে পুলিশ। একি সেই অশীতিপর, যিনি মিলির বিয়েতে আঁখির হাত ধরেছিলেন, কিছু বলার প্রয়াস করেছিলেন যেন! সেই বৃদ্ধকে নৃ'শংসভাবে কে যেন কু'পিয়ে খু'ন করেছে! ভোরের আবছায়ায় র'ক্তের রং বুকে ক্ষরণ তুলছে।
এ সংবাদ যেন বজ্রধ্বনির মতোই আঁচড়ে পড়েছে চেয়ারম্যানের উঠোনে। গ্রামবাসী, দলবদ্ধ পায়ে, একের পর এক প্রবেশ করেছে প্রাসাদের প্রাঙ্গণে। বাড়ির নারী সদস্যরা রান্নাঘরে ছিলেন—কেবলমাত্র দিনের পূর্ব প্রস্তুতি শেষ করেছেন, আর সেই মুহূর্তে এমন কোলাহল দেখে বিস্ময়ে স্থবির হয়ে গেল প্রত্যেকে।
রিতুকে কাজ বুঝিয়ে আফিয়া বেগম সবেই রুমে ঢুকেছেন! দরজায় করা নেড়ে আজগর আলী আফিয়া বেগমকে বললেন,
——— "ভাবি, ভাইকে ডেকে পাঠাও! আরেকটি লা'শ খুঁজে পাওয়া গেছে বলে শুনছি!"
আফিয়া বেগমের অবাক বি'স্ময়ে জড়ানো কণ্ঠস্বর যেন মৃদু ঝড়ে চাবুকের মতো আছড়ে পড়ল,
——— "লা'শ পাওয়া গিয়েছে? কিন্তু তোমার ভাই তো গতরাত্রে বাড়িতেই ফিরলেন না!"
এ কথা শুনে কুদ্দুস আলী, মনের মধ্যে উদ্বেগের ছায়া নিয়ে, সংকুচিত কণ্ঠে বললেন,
——— "বাড়ি ফেরেননি মানে? গতরাতে তো ভাই আমাদের আগেই বাড়ির পথ ধরেছিলেন!"
আফিয়া বেগমের চোখে অবাকের চিহ্ন যেন বিশ্বাস হচ্ছে না তার! তিনি বিষণ্ন অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বললেন,
——— "আমি তো ভেবেছি তোমরা জানো, ভেবেছি কাজের জন্য কোথাও ব্যস্ত হয়ে গেছেন!"
আফিয়া বেগমের এমন কথা শুনে আজগর আলী আর কুদ্দুস আলীর মধ্যে উদ্বেগের শিহরণ ধেয়ে এলো, যেন এক অজ্ঞাত বিপদের সম্মুখীন হওয়ার শঙ্কা গ্রাস করল তাঁদের। ইকরাম আলী, যিনি কাল রাতে তাদের আগে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছেন বলে ধরে নিয়েছিল সকলেই, তিনি কি তবে কোথাও অজানায় বিলীন হলেন?
এখন সমগ্র বাড়ি যেন আতঙ্কের ঘোরে তাড়িত; একে অপরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে, ছায়াময় বেদনায় আপ্লুত হয়ে ফোনের পর ফোন করে দিগ্বিদিকের সকল জায়গায় খবর পৌঁছে দিতে লাগল। ইতোমধ্যেই লোক পাঠানো হয়েছে খুঁজতে, অথচ নিঃশব্দ শূন্যতা ছাড়া আর কোনো উত্তর নেই। হঠাৎ, নিখোঁজ হলেন কোথায়?
__
আঁখি নামাজ শেষ করে কোরআনের তেলাওয়াতের মিষ্টি সুরে মনটিকে প্রশান্ত করে ধীর পায়ে ছাদে রেলিংয়ের কাছে এসে দাঁড়াল। নিচে দৃষ্টি ফেলতেই চক্ষু বিস্ফারিত হলো, জনতার বহর তাদের বাড়ির সন্নিকটে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কপালের কোণে ভ্রুকুটি জমল; সকালের এই প্রশান্তিতে এত মানুষের সমাবেশ কেন? এক অজানা কৌতূহলে আঁখি ছাদ থেকে নেমে যেতে লাগল।
অন্যদিকে, শান্ত চোখের পাতা মাত্রই এক ফোঁটা ঘুমে ঢুলছিল। প্রতিদিনের মতোই রাত্রির গভীরে বাড়ি ফিরেছে সে। কিন্তু আশেপাশের কোলাহলে বিশ্রামের নিদ্রা অধরাই রইল। বিরক্তির কাঁটায় দাঁত চেপে ক্ষণিকের অনিচ্ছাসহকারে চোখ মেলে দিল শান্ত। বেরিয়ে গেলো রুম থেকে!
নাঈম অপুষ্ট নিদ্রার ভঙ্গিমায় চোখ মুছতে মুছতে প্রবেশ করল। রাগে কাঁপতে কাঁপতে সে উচ্চারণ করল,
——— "এই কি রে, এ কি মৎস্যবাজারে ভুল করে পদার্পণ করেছি? এমন কলরোলের বন্যা কেন?"
উক্তি শেষ করে সে শান্তর পার্শ্বে স্থির হয়ে দাঁড়াল। কুদ্দুস আলীর দৃষ্টির তাপ যেন অ'গ্নিশিখার ন্যায় নাঈমের দিকে নিবদ্ধ হল। নাঈম হাই তুলে স্থিরচক্ষে একবার চেয়ে নিলো। সমগ্র পরিবেশে এক নৈঃশব্দ্যের ভার ছড়িয়ে পড়েছে। এমন সময় শান্ত একপ্রকার মৃদুহাস্যে বলল,
——— "ভালোই হয়েছে উধাও হয়েছে; যেন আর কখনো ফিরে না আসে। আমি এখন ঘুমাতে যাচ্ছি, হৈচৈ যা করবার, বাইরে গিয়ে করো তোমরা। যত্তসব!"
শেষাংশের কথা মিশ্রিত তির্যক বিরক্তিতে। শান্ত প্রস্থান করতে উদ্যত হলে সিঁড়ি বেয়ে আঁখির অবতরণ দৃশ্যমান হল। শান্ত দৃপ্তপদে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে আঁখির হাতটি দৃঢ়তায় শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
——— "ওদিকে কি তোর চেহারা দেখাতে যাচ্ছিস?? আমার ঘরে কাপর পরে আছে, ওগুলো ধুয়ে দিবি চল!"
এ কথা বলেই শান্ত আঁখিকে টেনে হিঁচড়ে নিজের কক্ষে নিয়ে গেল। সকলের মাঝে বিরক্তির সঞ্চার হল শান্তর এই অসংযত ব্যবহারে। কেবল বাইরের থেকে শোনা গেল এক বিকট চপেটাঘাতের শব্দ! এবং শান্তর কর্কশ কণ্ঠে হুংকার,
——— "গতবারের পোশাক সঠিকভাবে পরিষ্কার করিস নি ! এবার যদি ভুল করিস, তবে তোর হাতের শিরা কে'টে দিবো!"
নাঈম ক্রো'ধে দগ্ধ হয়ে শান্তর কক্ষে প্রবেশ করল এবং প্রবল তর্কের ঝড় উঠল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই তর্ক রূপ নিলো হিং'সাত্মক সংঘর্ষে; ঘরের প্রতিটি কোণ যেন প্রচণ্ডতা আর আক্রোশে কাঁপছে। এইসব সংঘাত এ বাড়ির নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আজগর আলী বিরক্তির চূড়ান্তে পৌঁছে কুদ্দুস আলীর দিকে চেয়ে বললেন,
——— " বাদ দাও এসব! আগে বড় ভাইকে খুঁজে বের করি।"
রোকেয়া বেগমের মনে জাগল প্রচণ্ড ক্ষো'ভ। এত কাজের লোক থাকতে কেন তার ছোট্ট মেয়েটা এসব করবে? আর কথায় কথায় গায়ে হাত তোলার সাহস কেন দেখাবে? শান্তর কক্ষে প্রবেশ করেই দেখলেন, শান্ত ও নাঈম মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে একে অপরকে আ'ক্র'মণ করছে, আর আঁখি নিরুপায়ে তাদের থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। রোকেয়া বেগম রাগে আঁখির হাত ধরে তাকে বাইরে টেনে নিয়ে এলেন। আঁখির গালে পাঁচ আঙুলের দাগ স্পষ্ট। রোকেয়া বেগম
ব্যথায় ও করুণায় গলা ভিজিয়ে বললেন,
——— "তোকে আবারও মেরেছে? কষ্ট হচ্ছে না তোর?"
ভেতরে আঁখি প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসল। মনে মনে ভাবল,
——— "নাটকের মাত্রা বোধহয় কম হল; আরও একটু হলে মন্দ হতো না!"
তবে মুখে অসহায়তায় ভেজা কণ্ঠে বলল,
——— "এটাই আমার ভাগ্য মা। এমনটিই ঘটার কথা ছিলো আমার জীবনে।"
এই বলে আঁখি দ্রুত নিজের ঘরের দিকে ছুটে পালিয়ে গেল।
মারামারির অবসানে শান্ত ও নাঈম অবশেষে ক্লান্ত হয়ে মেঝেতে নিস্তেজভাবে শুয়ে পড়ল। দুজনের মুখে-চোখে রা'গের লালচে ছাপ, ঠোঁট থেকে র'ক্তের ক্ষীণ ধারা গড়াচ্ছে। গভীর শ্বাসে বক্ষ ওঠানামা করছে, যেন শরীরের প্রতিটি পেশিতে যু'দ্ধের ক্লান্তি জমেছে। নাঈম কাতরাচ্ছিলেও তির্যক হেসে বলল,
——— "শা'লা, মে'রেছিস যখন আরেকটু জোরে মা'রতে পারলি না? শব্দ তো কম এসেছে!"
শান্তও একইভাবে বাঁকা হাসি হেসে চাপা কণ্ঠে উত্তর দিলো,
——— "আর তুই এই ভালো থাকার নাটক একটু কম করিস বুঝেছিস??"
এই বলে দুজনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাত মিলিয়ে হেসে উঠল!
___
প্রহরের কাঁটা এগারোতে পৌঁছালেও ইকরাম আলীর কোন হদিস মিলছে না। প্রতিটি কোণ, গলি, এবং সম্ভাব্য স্থানসমূহে খোঁজ নিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেও তার অস্তিত্বের বিন্দুমাত্র চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে না। ইকরাম আলী এমন নন যে, আজগর আলী কিংবা কুদ্দুস আলীকে কিছু না জানিয়ে কোথাও অজ্ঞাতসারে চলে যাবেন। তবে কি এমন অজানা কারণ রয়েছে যে তাকে গোপনে প্রস্থান করতে হলো?
এদিকে, অন্য আরেকটি ভয়াবহ সংবাদ যেন গোটা পরিস্থিতিকে আরও ঘনীভূত করে তুলেছে। এক দরিদ্র বৃদ্ধ, যিনি ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করতেন, তার র'ক্তা'ক্ত নিথর দেহ আবিষ্কৃত হয়েছে গ্রামসংলগ্ন এলাকায়। দূরদূরান্তে কোনো বিরোধ বা শ'ত্রুতার ইঙ্গিত নেই তাঁর জীবনে, তবুও কে বা কারা তার জীবনের শেষ অধ্যায়টিকে এমন হিং'স্র রূপে লিখল? বৃদ্ধের নিরীহ জীবন আর দারিদ্র্যের মাঝে এমন বর্বর আ'ক্রমণের উৎস কী, সে প্রশ্ন যেন সকলের মনেই উদিত হচ্ছে, কিন্তু উত্তর মেলে না।
শিকদার বাড়ির পেছনে সরু পথটি শিকদার জমির বিস্তৃত ভূমির দিকে নিয়ে যায়, যেখানে প্রান্তর জুড়ে ফলন্ত ফসলের সারি যেন বিস্ময়ে মেলে ধরেছে আপন শস্যমালা। পটল, মরিচ, এবং আরও নানা সবজি যেন সবুজের বুনটে মিশে সিক্ত মাটিতে প্রাণ সঞ্চার করেছে। এই বিরাট শস্যভূমি নির্জন, জনচঞ্চলতা প্রায় অনুপস্থিত; এখানে কেবল কর্মরত শ্রমিকদের পদচারণায় সজীবতা দেখা যায়। শ্রমজীবী কৃষকেরা তাঁদের কাঁধে কীটনাশক বোঝাই পানি স্প্রেয়ার নিয়ে ধীর পদক্ষেপে জমির অলিগলি ধরে অগ্রসর হচ্ছেন, একমনে শস্যের উপর সুরক্ষামূলক জল ছিটিয়ে দিচ্ছেন। এই নিষ্ঠা আর পরিশ্রমের সমারোহ যেন প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অদৃশ্য চুক্তির এক নিঃশব্দ সাক্ষী।
কৃষক হঠাৎ থেমে গেলেন, যেন চোখের সামনে ভয়াবহ কোনো দুঃস্বপ্ন ভেসে উঠল। শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠল তার, জমির মাঝে পড়ে আছে শিকদার ইকরাম আলীর র'ক্তমাখা মৃ'তদেহ। পরনের সাদা পাঞ্জাবি লাল র'ক্তে ভিজে জ্বলজ্বল করছে, এক অসম্ভব বিভীষিকাময় দৃশ্য যেন তার দৃষ্টি স্তব্ধ করে দিলো। প্রকৃতির নীরবতা যেন মুহূর্তে ভেঙে গিয়ে আশেপাশে এক অশুভ উপস্থিতি ছড়িয়ে দিলো, কৃষকের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে শসব্দে চিৎকার করে উঠলেন,
——— “মালিক...!”
তার এই হৃৎকম্পকারী চিৎকারে আশপাশের সমস্ত কৃষক সজাগ হয়ে দৌড়ে এলেন। একে একে জমির মাঝে জড়ো হতে লাগলেন সবাই, ভয়ে আচ্ছন্ন তাদের মুখ, চোখে বিস্ময় ও আতঙ্কের ছাপ। শিকদার ইকরাম আলীর নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে এক চিলতে নীরবতা ছেয়ে গেল চারদিকে। মাঠের বাতাসে শোক ও আশঙ্কা যেন মিশে গিয়ে গভীরতর হয়ে উঠল, এবং তাদের মুখে কোনো শব্দ না থাকলেও, চোখের ভাষায় সকলেই বুঝতে পারল—এ এক ভয়ংকর রহস্যের শুরু।
_______________Instagram
মর্মান্তিক এই হ'ত্যার পর গ্রামজুড়ে সৃষ্ট নিস্তব্ধ আতঙ্কে সবাই যেন বাকরুদ্ধ। কেসটি পুলিশের অধিকার থেকে স্থানান্তরিত হয়ে সিআইডির কঠিন তদন্তের হাতে এসে পৌঁছেছে, কারণ এ পর্যন্ত ছয়টি নৃ'শংস হ'ত্যাকাণ্ডেও খু'নির ছায়াটুকু খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রতিটি মৃ'ত্যু যেন এক অমোঘ রহস্যের কুয়াশায় মোড়া, আর ইকরাম আলীর হ'ত্যাকাণ্ডে সেই রহস্য গভীরতর এক জটিলতার আবরণে আবদ্ধ। তিনি, যিনি এই জনপদের সম্মানীয় চেয়ারম্যান, তাঁর শরীরকে নি'ষ্ঠুরভাবে বিদীর্ণ করে ফসলের ক্ষেত্রেই র'ক্তমাখা দেহ ফেলে গিয়েছে কেউ।
এখন জনপদের প্রতিটি হৃদয়ে ভয় জড়িত হয়ে গেছে, যেন এক বিষাদগ্রস্ত প্রতিধ্বনি, যার শব্দ রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে প্রবাহিত। ইকরাম আলীর মতো একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি যখন নিরাপত্তার অভাবে তার নিজস্ব ভূমিতেই প্রথিত, তবে সাধারণ মানুষের ঘরের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কে দেবে? এক গোপন আতঙ্কে মানুষ এখন একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখছে, যেন এই বিপন্ন রাতের নিস্তব্ধতার আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে অদেখা এক অন্ধকার মৃ'ত্যুর প্রতীক্ষা, যার অঙ্গুলি নির্দেশ যেন অনিশ্চয়তার দিকে।
____
ইকরাম আলীর নিথর দেহের সন্নিকটে কারো প্রবেশাধিকার নেই; অর্ধেক পুলিশ দল পাহারায় তৎপর সেখানে, আর বাকি অর্ধেক সতর্ক প্রহরায় বৃদ্ধের মৃ'তদেহের আশেপাশে। সিআইডির অভ্যাগত আগমনের প্রতীক্ষায় তীব্র উদ্বেগে প্রতিটি মুহূর্ত ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। চারদিকে কান্নার সুরে যেন শোকের এক গাঢ় সুর মিশে যাচ্ছে, আজগর আলী ও কুদ্দুস আলী সেই গভীর শোকে নিস্তব্ধ; তাদের মস্তিষ্ক এই নি'র্মম সত্যটি এখনো বিশ্বাসে গ্রহণ করতে অক্ষম। শান্ত ও নাঈমের থমথমে মুখে তাকিয়ে, আর রোকেয়া বেগমের অবিন্যস্ত আচল ভিজে গেছে চোখের জলে।
অন্যদিকে, আফিয়া বেগম মাটির উপর বসে স্বামীর নিথর দেহের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন, তাঁর চোখের পলক পর্যন্ত আর নড়ছে না; তাঁর র'ক্তবর্ণ চোখে জল স্থির হয়ে আছে এক গভীর বেদনা, যা ভাষায় প্রকাশের অতীত। এই শোকার্ত পরিবেশে উপস্থিত হয়েছে বহু মান্যগণ্য ব্যক্তিবর্গ। এমনকি বহুদিনের শ'ত্রুপক্ষ, শাহারিয়াজ বাড়ির লোকজনও এখানে এসেছে। মোশারফ সাহেব চেয়েছিলেন প্রতিশোধ নিতে তবে এমন কিছু তিনি কখনো চান নি! অনেক কথা ছিল, হিসেব ছিল, কিছু জানার ছিল; সবকিছুই অসমাপ্ত রয়ে গেলো! এক সময়ের বন্ধুত্ব, যার প্রতিটি আভাসেই ছিল গভীর সখ্যতা, আজ এই ভগ্নাংশ সময়ে স্মৃতির অতলে হাহাকারে রূপান্তরিত হচ্ছে। এই অস্তিত্ব যেন দগ্ধ দীর্ঘশ্বাসের মতো বুকে বয়ে নিয়ে চলছে, শূন্যতা আর বিস্মৃতির এক অসীম পথে।
_____________________WhatsApp
সিআইডি দপ্তরের নিবিড় স্তব্ধতায় এসিপি মুযহাবের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র ও মহুয়া। মুযহাব সাহেবের চাহনিতে যেন মহাকাব্যিক গাম্ভীর্যের ছায়া, ভারী কণ্ঠে তিনি উচ্চারণ করলেন,
——— "এতকাল তোমাদের স্থান ছিল পরিমিত সহগামিতার। কিন্তু এ যাত্রা সম্পূর্ণ ভিন্নতর— জটিলতা এই কেসের মহিমায় মহীরুহের ন্যায় স্থিত। পুলিশ আমাদের নিকট হস্তান্তর করেছে এ কেস; এই মর্মান্তিক ছয়টি হ'ত্যা! কেসটি আমি সম্পূর্ণরূপে তোমাদের অধীনে অর্পণ করছি।
রুদ্রও যেন তার তীক্ষ্ণ সংকল্পের সুস্পষ্ট প্রকাশে দৃঢ়স্বরে বলল,
——— "কেস যতই দুর্বোধ্য হোক, এই রহস্যের মূলে পৌঁছাতে আমরা কিছুমাত্র ত্রুটি করব না, স্যার।"
তারপর রুদ্র পাশে দাঁড়ানো মহুয়ার দিকে এক মনোযোগী দৃষ্টিপাত করল। মহুয়া আঙ্গুলে চুল ঘুরাচ্ছিল, হঠাৎ তড়িৎ গতিতে দাঁড়িয়ে সে সালাম ঠুকল। বোকা হাসিতে তার অধরা আত্মবিশ্বাস যেন ফুটে উঠল। একই ভাবাবেগে সে বলল,
———" ইয়েস স্যার! আমরা আমাদের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করব!"
——— "আমার অভিধানে ‘চেষ্টা’ শব্দটির কোনো স্থান নেই । এখানে করা হবে, হতেই হবে! You have to do it! No matter what!"
পেছন থেকে গুরুগম্ভীর এক পুরুষকণ্ঠ ধীর অথচ দৃপ্তস্বরে ভেসে এলো। ধীরে ধীরে সামনে এসে দাঁড়ালেন এক সুঠাম, বলিষ্ঠ পুরুষ, শিরায় শিরায় কঠোর অনমনীয়তা প্রতিফলিত। দৃঢ় মুখাবয়ব, পকেটে হাত গুঁজে সে তাদের সামনে নীরব মহিমায় দাঁড়ালো । রুদ্র আর মহুয়া পেছন ফিরে তাকাল; এই লোকটির মাঝে যেন এক অদ্ভুত অতিমানবীয় ভাবমূর্তি বিদ্যমান। এসিপি মুযহাব সাহেবের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির ছাপ, তিনি এগিয়ে গিয়ে ওই গাম্ভীর্যে মোড়া পুরুষের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন,
——— " তোমাদের সম্মানিত সিনিয়র ইন্সপেক্টর আরবিন শাহারিয়াজ মুগ্ধ! আজ পর্যন্ত কোনো কেস তার মেধার সীমা ভেদ করে মুক্তি লাভ করেনি। প্রতিটি ছায়াচ্ছন্ন পথ, প্রতিটি সূক্ষ্ম কোণ তার চেনা। এই কেসে মুগ্ধ তোমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থাকবে। তবে সতর্ক থাকো! মুগ্ধ আমার চেয়েও কঠোর; তার কথার আগে হাতে রুদ্রতাণ্ডব প্রকাশিত হয়!"
এই বলে মুগ্ধের দিকে এক অন্তর্লীন হাসি ছুঁড়ে দিলেন মুযহাব সাহেব। মুগ্ধও কিঞ্চিত বাঁকা হাসিতে প্রতিউত্তর দিল। গাম্ভীর্যের কঠোর আবরণে সে বলল,
——— "কঠোর হবো নাকি কোমল, তা নির্ভর করবে সামনের ব্যক্তির কর্মের প্রতি তার একনিষ্ঠতার ওপর।"
রুদ্র এক ঝিলিক হাসিতে বলল,
——— "সে তো অবশ্যই, স্যার! আপনার সুনাম বহুবার শুনেছি। আপনার সাথে কাজ করে ভালো লাগবে!"
মহুয়া চোখ ছোট করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এসিপি মুযহাবের দিকে তাকিয়ে রইল। এই কু'টিল বুড়োটা সবসময় তার সাথে কর্কশ কণ্ঠে ধমকে ওঠে, অথচ মুগ্ধ আসার পর যেন একেবারে অন্য রূপ ধারণ করেছে! কেমন করে হাসি ফোটাচ্ছে! মহুয়ার ইচ্ছে হয় এই টাক মাথার উপর একখানা ইট ছুড়ে মারে! তবে মানতেই হয়, মুগ্ধর মধ্যে এমন কিছু আছে যা উপস্থিত সবাইকে এক অপার্থিব মোহে আবদ্ধ করে ফেলে।
তবে এই লোকটা কি কখনও হাসতে জানে? চিরকাল মুখ গোমড়া করে যেন পৃথিবীর সব ভার তার কাঁধেই! এসব ভেবে ভেবে ভেতরে ভেতরে এক মুচকি ভেংচি দিল মহুয়া। তবু বাহ্যিক ভদ্রতার খোলস ধরে রেখে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
——— "আমিও ভীষণ খুশি, স্যার।"
তাদের মাঝে প্রবেশ করল ইন্সপেক্টর ইনান, চাহনিতে এক অসামান্য প্রখরতা। এসিপি মুযহাবের সাথে তদন্ত সম্বন্ধে আলাপের আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট; তবে মুগ্ধকে দর্শন করতেই দ্রুত এগিয়ে এসে তার দিকে বন্ধুত্বপূর্ণ হাত বাড়িয়ে হাসিমুখে বলল,
——— "ভাই, তোমাকে ধন্যবাদ! তোমার জন্যই গতরাতে সেই দুর্ধর্ষ খু'নিটাকে ধরে ফেলতে পেরেছি! তুমি না থাকলে তো প্রায় পালিয়েই যাচ্ছিল!"
হাত মিলিয়ে মুগ্ধও অতি সংক্ষিপ্ত, তবে দৃঢ় হাসি দিয়ে বলল,
——— "No need to thank me; it’s all part of the job!"
ইনান সহাস্যে মাথা নেড়ে বলল,
——— "তোমার কর্তব্যের প্রতি এই অপরিসীম নিষ্ঠা আমার অজানা নয়! মাসব্যাপী মিশনের পর ছুটিতে ছিলে, তাও তোমাকে বিরক্ত করতে হলো।"
মুগ্ধের মুখে বিনয়ের এক ছায়া খেলে গেল; তবু সে স্থির চাহনিতে রুদ্র ও মহুয়ার দিকে একবার তাকিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
——— "Let’s go!"
এই শব্দের প্রতিধ্বনি নতুন অনুসন্ধানের অঙ্গীকার হয়ে তাদের চারপাশে বেজে উঠল। মুগ্ধের দৃপ্ত পদক্ষেপে তারা সকলেই রহস্যের কুয়াশা ভেদ করে নতুন পথের দিকে অগ্রসর হলো, অনাগত সত্য উদ্ঘাটনের শপথে।
মুগ্ধ বাংলাদেশে ফিরেছে তিন বছর পূর্বে, আর তার সাথেই শুরু হয়েছে সিআইডি জীবনের নতুন অধ্যায়। তার তীক্ষ্ণ, গভীর বুদ্ধিমত্তা ও নিখুঁত বিচক্ষণতার জন্য সিআইডির মধ্যে অচিরেই প্রিয় হয়ে ওঠে সে, বিশেষত কঠোর অথচ প্রকৃতিদর্শী এসিপি মুযহাব সাহেবের কাছে। মুযহাব সাহেবের কঠোরতার আড়ালে রয়েছে এক গভীর স্নেহ, যা মুগ্ধকে ছেলের মতোই আলিঙ্গন করে রেখেছে। এই গাম্ভীর্যে মোড়া সম্পর্কের অন্তরালে বিরাজ করে এক নিরাবেগ তবু নিভৃত আবেগ।
সিআইডিতে যোগদানের পর মুগ্ধ কখনোই পরিবার, বন্ধু কিংবা আত্মীয়দের কিছু জানায়নি—শুধু প্রয়োজনীয় মনে করেনি বলেই নয়, বরং এর পেছনে লুকিয়ে অজানা কিছু কারণ। তিন বছরের সাফল্যমণ্ডিত কর্মযাত্রার পর মাসখানেক পূর্বে আবার কানাডা ফিরে গিয়েছিল, যেখানে একটি পালিয়ে যাওয়া সন্ত্রাসী তার তদন্তে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কানাডা যাত্রা আসলে তার সিআইডি কর্মকর্তাদের আদেশে একটি গোপন মিশনের অংশ ছিল। তার মতো বিচক্ষণ একজনকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল!
ভাগ্যের পরিহাস, যাদের সাথে তার কানাডার শিক্ষাজীবনের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল—ম্যাক্স ও কনি—তারা আসলে ছিল এক ভিন্ন অন্ধকার দুনিয়ার মানুষ, সেই স'ন্ত্রাসী ড্রা'গ ডিলার এবং সিরিয়াল কি'লারের গোপন সহযোগী। মুগ্ধ কৌশলে তাদের সাথে কিছুদিন কাটায়, তাদের বুঝিয়ে দেয় সে আরও জানতে, বুঝতে, আর শিখতে চায়। সেই আড়ালে, সে তাদের পরিকল্পনার সূক্ষ্মতায় প্রবেশ করে এবং কৌশলে ফাঁদে ফেলে ধরার পরিকল্পনা করে। মুগ্ধ তাদের সঙ্গের অভিজ্ঞতা থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে এবং দেশে ফিরে আসে সফলতার গৌরব নিয়ে।
দেশে ফেরার পর তার পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনেরা জানত, সে কানাডায় পড়াশোনা শেষ করে ফিরে এসেছে। নিজেকে সেভাবেই উপস্থাপন করে, আর সবাই তাতেই বিশ্বাস করল।
অন্যদিকে, জীবন—মুগ্ধের বিশ্বস্ত ইনফরমার, যার মাধ্যমে মুগ্ধের নিকট পৌঁছে আসে সমস্ত ঘটনার অব্যাহত স্রোত। সিআইডির অধীনে থাকা সত্ত্বেও তাদের সম্পর্ক আরও গভীর, আরও নিবিড়। প্রকৃতপক্ষে, জীবনকে মুগ্ধ নিজের ছোট ভাইয়ের মতোই দেখে। সেই স্নেহ কঠোরতার আড়ালে নীরবভাবে বাস করে; কখনো মুখে প্রকাশ পায় না, তবে প্রতিটি কাজে, প্রতিটি মুহূর্তে সেই স্নেহের অব্যক্ত ছায়া ফুটে ওঠে।
---
ফুল স্পিডে ছুটছে গাড়ি, স্টিয়ারিংয়ে মুগ্ধ, পাশে রুদ্র; দুজনের মুখে গাঢ়, কঠোরতা আঁকা নীরবতা। পেছনে বসে মহুয়া জানালার বাইরে তাকিয়ে বিরক্তির ভারে গুমরে উঠছে; চারপাশ যেন নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন, কেউ একটিও শব্দ উচ্চারণ করছে না।
অবশেষে সেই নিঃস্তব্ধতা ভেঙে, মহুয়া প্রশ্ন ছুঁড়ল,
——— "স্যার, শুনেছি ওটা আপনার গ্রাম??"
মুগ্ধের ঠোঁটে শীতলতার স্পর্শ, কণ্ঠে তীব্র নির্লিপ্তি, উত্তর এলো,
——— "গ্রামটা কারো বাপের সম্পত্তি নয়। ওটা সবার, কারো একার নয়!"
মুগ্ধের এমন থমথমে জবাবে মহুয়ার মুখে নীরবতা নেমে এলো। রুদ্র একপাশে হাসল, আর সেই নীরবতা ভাঙার প্রয়াসে বলল,
——— "এতগুলো খু'ন হচ্ছে, আপনি নিশ্চয়ই তদন্ত করেছেন, যদিও আপনি অন্য কেইসে ছিলেন।"
মুগ্ধের দৃষ্টি সামনের পথচলমান, তীক্ষ্ণ, দৃঢ়। এক মুহূর্ত থেমে কণ্ঠে চাপা বিদ্রুপ নিয়ে বলল,
———" কি মনে হয়, বসে ছিলাম?"
———" একদমই না!"
মুগ্ধের ঠোঁটে বাঁকা হাসির আভাস, প্রতিটি শব্দে সংকল্পের রুদ্ধস্রোত বইছে,
———" এই কেস আমাকে খুঁজে নেয়নি, আমিই এই কেসকে বেছে নিয়েছি! "
_______________
আলো বড় বাবার নিথর দেহ দেখে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ধীরে ধীরে অচেতন হয়ে পড়েছে। মৃ'তের উপস্থিতি তার কোমল হৃদয়ের সহ্য সীমা ভেদ করে গেছে, ব্রেনে সে প্রচণ্ড আঘাতও পেয়েছে ! কেননা এসব মৃ'তদেহ সে দেখতে পারে না! আঁখি আর কানিজ বেগম দুজন মিলে তাকে ঘরের ভেতর টেনে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আঁখির চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুবিন্দুগুলি বৃষ্টির মতো ঝরতে শুরু করেছে; আর কানিজ বেগমের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁন্না যেন অন্তহীন হাহাকার নিয়ে আছড়ে পড়ছে। এই অন্ধকার ঝড়ই বা তাদের জীবনে এলো কেন? আলোকে সোফায় শুইয়ে দেয় দুজনেই, তবুও শান্তির নিশ্বাস নিতে পারে না। আঁখির মনে হঠাৎ করেই প্রবল বিস্মৃতির মাঝে জেগে ওঠে পূর্বিকার কথা! কোথায় সে? তার কি জানা আছে, তার পিতাকে এমন নৃ'শংস কায়দায় পৃথিবী থেকে মুছে ফেলা হয়েছে?
আঁখি জীর্ণ কণ্ঠে কানিজ বেগমের দিকে তাকিয়ে করুণ ধ্বনিতে বলল,
——— "পূরু আপু কোথায়, ছোট মা?"
আঁখির কণ্ঠে করুণ প্রশ্নটি ভেসে উঠতেই যেন কানিজ বেগমের মনের গভীরে অজানা এক আশঙ্কা দোলা দিয়ে উঠল। এতক্ষণ কীভাবে এড়িয়ে গিয়েছিল তাঁর চোখ! সকাল গড়িয়ে দুপুরে পা দিচ্ছে; চারদিকে এই কান্না আর হাহাকারের সুরে সমস্ত পরিবেশ বিষাদময় হয়ে উঠেছে, অথচ পূর্বিকার কোনো সাড়া নেই! কোথায় সে? কি এমন গভীর নিদ্রা তাকে আবৃত করেছে যে, এই হাহাকার তার কানে পৌঁছায়নি?
আঁখির মনের কোণে সংশয়ের কালো মেঘ যেন আরো ঘন হয়ে এল— পূর্বিকার আবার অসুস্থ হয়ে পড়েনি তো?
আঁখি তড়িঘড়ি করে পূর্বিকার কক্ষে ছুটে গেল, পেছনে ছুটলেন কানিজ বেগমও। কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ! আঁখি ভাঙা গলায় প্রবল বেদনায় দরজায় আঘাত করতে করতে বলতে লাগল,
——— "আপু! শুনছিস আপু? দরজা খুলে দে! আপু??
কিন্তু ভেতরের নীরবতা যেন আরও বেশি গভীর হয়ে উঠল, কোন ধ্বনি প্রবাহ সেখানে প্রবেশ করতে পারছে না। হতাশা আর উদ্বেগে কানিজ বেগমও দরজায় বারবার আঘাত করতে করতে চিৎকার করে উঠলেন,
———" মা রে! দরজা খোল! শুনছিস? দেখ কী বিভীষিকা নেমে এলো! তোর বাবা আর নেই! তাকে নি'র্মমভাবে হ'ত্যা করেছে! দরজা খুলে দে মা রে!"
বারংবার, অবিরত আঘাত করেও যখন বন্ধ দরজা রহস্যের মতো স্তব্ধ রইল, তখন আঁখি ও কানিজ বেগমের অন্তরে অজানা আতঙ্কের কাঁপুনি ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়ল। বাইরে ইকরাম আলীর মৃ'তদেহের শীতল উপস্থিতি এবং এদিকে পূর্বিকার নির্জনতা; দুজনের মানসপটে যেন এক অশুভ ছায়া নেমে এলো। এক অমোঘ অসহায়ত্ব তাদের বৃত্তবন্দি করে ফেলল; কেমন যেন অদ্ভুত পাগলামি গ্রাস করতে চাইছে তাদের মন। আঁখির চোখে আর্তিতে পূর্ণ জল ঝরছে, কানিজ বেগমের হৃদয় যেন এক রুদ্ধ কাঁপন। অবশেষে চোখের জল মোছার ব্যর্থ প্রয়াসে আঁখির দিকে চেয়ে ভাঙা কণ্ঠে বললেন,
——— "তুই তোর ভাইদের ডেকে আন, মা..."
কানিজ বেগমের কথার সাথে সাথে আঁখি যেনো স্বতঃস্ফূর্ত পাগলের ন্যায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে লাগল। মাথায় অন্ধকারের ঘনঘটা নেমে এলো, আর চিন্তার কালো মেঘ তার অন্তর মনকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে লাগল। ছুটতে ছুটতে পৌঁছে গেলো ইকরাম আলীর লাশের কাছে, যেখানে শোকার্ত জনতার ঢল আর তীব্র হাহাকার চারিদিকে বিদ্যমান। হুড়মুড় করে ঠেলে ঠুলে সে ভিড়ের বুক চিরে শান্তর কাছে পৌঁছল।
আঁখি শান্তর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার হাত আঁকড়ে ধরে, কাঁপা কণ্ঠে অশ্রুসিক্ত নয়নে ফিসফিসিয়ে বলতে লাগল,
——— "পূরু আপু... পূরু আপু দরজা খুলছে না!"
আঁখির কথার স্পষ্টতায় শান্তর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একরাশ উদ্বেগ ছায়া ফেলল। কুঞ্চিত ভ্রূকুটি নিয়ে সে প্রশ্ন করল,
——— “দরজা খুলছে না মানে কী?”
——— “তুমি এসো… আপু দরজা খুলছে না! ন... নাঈম ভাইকে তলব করো!”
শান্ত তৎক্ষণাৎ চারপাশে নাঈমের অন্বেষণ শুরু করল। এখানেই তো ছিল সে! কোথায় হারিয়ে গেল হঠাৎ? অবশেষে নজরে পড়ল; নাঈম নীরব, গম্ভীরভাবে আফিয়া বেগমের পাশেই বৃত্তাকারে বসে আছে। শান্তর ডাকে নাঈম ধীরপদে উঠে এলো, মুখমণ্ডলে অদ্ভুত তুষার-প্রতিম স্থবিরতা। তিনজনে মিলিত হয়ে জনতার ঢল বিদীর্ণ করতে করতে এগোতে লাগল পূর্বিকার অভিসারিত কক্ষপথে।
আঁখির শরীর যেন বন্যাভাবে অবশ হয়ে এলো, পা ভারাক্রান্ত। তবু ভগ্নচিত্তে দুই ভাইয়ের পশ্চাতে ছুটছে, প্রতিটি পদক্ষেপে তার হৃদয়ের অন্তঃস্থলে গভীর অশুভ স্রোত উথাল-পাথাল বেগে আছড়ে পড়ছে।
দ্বারপ্রান্তে পদার্পণ করতেই শান্ত ক্ষিপ্র গতিতে দ্বারকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কাতে শুরু করল, আর চিৎকার করে বলল,
——— "এই পূরু দরজা খোল! এখন তামাশার করার সময় নেই!"
নাঈমও নিমেষে শ্লেষবদ্ধ কণ্ঠে ডাক দিল,
——— " কিরে পূরু?? তুই দরজা কেন খুলছিস না?"
বার আহ্বান জানাতে থাকলেও যখন দ্বার বিভেদের লক্ষ্যে ব্যর্থ হল, তারা অদম্য ইচ্ছায় স্থির করল দরজা ভেঙে ফেলবে। দুজনে একযোগে অটুট সংকল্পে প্রলম্বিত ধাক্কা দিতে শুরু করল, তাদের ধৈর্য ও সাহসের প্রতিফলন এটি।
কিছুক্ষণের মধ্যে একটি তীব্র শব্দে দ্বার খুলে গেল। হন্তদন্ত হয়ে তারা ঘরে প্রবেশ করতেই অ’রব্ধ বিস্ময়লোলিত হয়ে গেল। একসঙ্গে চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে কাঁধে মুখ ফিরে গুঁজে নিল নাঈম এবং শান্ত!
পেছন থেকে আঁখি এবং কানিজ বেগম অতিশীঘ্র ঘরে ঢুকে পরলো । ঘরে প্রবেশ করতেই আঁখির বক্ষের অন্তঃকরণে এক প্রবল প্রচন্ড আঘাত অনুভূত হলো; সেকেণ্ডের মধ্যে পায়ের গতির আবহেলা, যেন অবশ হয়ে গেল। অসংকোচে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে পলকহীন অস্বাভাবিকতায় তাকিয়ে রইল।
কানিজ বেগম আকস্মিকভাবে মাথা উপরে তোলে, মুখে আচল গুঁজে আতঙ্কে গগনবিদারী চিৎকার করে ধাম করে বসে পড়লেন।
পাখার সাথে জড়ানো অবস্থায় ঝুলে পূর্বিকার নিথর দেহ। পড়নের শাড়ির কাপড় ব্যবহৃত সেই ফাঁসে! অর্ধচন্দ্রের মত বিদীর্ণ বক্ষ উন্মুক্ত, ফিনফিনে কাপড়ের ছিন্ন সীমানায় বক্ষাবরণহীন অবস্থায় ধ্বং'সের চিহ্নাবলী দৃশ্যমান। শ্বেতাঙ্গ পেটে অদ্ভুত রঙের দং'শ'নচিহ্নগুলো বয়ে চলেছে ক্রো'ধের গল্প, এবং সেই দং'শ'নের র'ক্তি'ম রেখাপথ তার পায়ের তলায় লালিমায় বন্যা বোধ করাচ্ছে, নি'ষ্ঠু'রতার অক্ষয় স্মারক।
র'ক্তধারা চুয়ে তার পায়ের আঙুলে গিয়ে স্থিত! প্রতিটি আ'ঘা'তের রেখায় বিধৃত পৈ'শাচি'কতার অপূর্ব নি'র্ম'ম'তা।


Post a Comment

0 Comments

Close Menu