লেখিকাঃ সাবিহা জান্নাত
পর্বঃ ১১
~ সে এখন আমার দায়িত্ব। সে আমার অর্ধাঙ্গিনী। তার সমস্ত কিছুতে কল্যাণ এবং তার সবকিছুর প্রতি খেয়াল রাখা আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য। শ্রুতি আমার প্রথম অগ্রাধিকার।
সে এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছে। আপনার কোনো অধিকার নেই আমার স্ত্রীর গাঁয়ে হাত তোলার।তাকে অপমান করার কোনো অধিকার আপনার নেই। তাকে বাড়ির বউয়ের যথাযথ মর্যাদা দিতে শিখুন।
নাহলে আমি আপনাকে ছেড়ে কথা বলবো না । আশা করি আপনি আমার কথাটা বুঝতে পারছেন। আপনাকে আর দ্বিতীয় বার কথাটা বুঝিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
বিভোরের কথায় তার খালামুনি রেগেমেগে বিভোরের আম্মুর কাছে চলে যায়।
~ বড় আপা কি হচ্ছে কি এসব।তুমি ইরাকে ছেঁড়ে এর মতো একটা মেয়েকে ছেলের বউ করেছো- ( বিভোরের খালা মুনি )
~ এই বাড়িতে কি নাটক চলছে কেউ কি আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবে। আমার মেয়েকে বউ বানানোর স্বপ্ন দেখিয়ে আবার ছেলেকে অন্য জায়গায় বিয়ে করিয়ে দিয়েছো। ( ইরার বাবা )
~ আমার মেয়েটা বিভোরকে কত ভালোবাসতো। আমার মেয়েটা ওকে ছাড়া অন্য কোনো জায়গায় বিয়ে করার কথা ভাবতেও পারবে না। আমার মেয়ে টা বিভোর কে ছাড়া বাঁচবে না ( ইরার আম্মু )
~ আমি এসব কিচ্ছু জানি না। আমি শুধু এই বিয়েটা মানি না ব্যস। যেভাবেই হোক বিয়েটা ভেঙ্গে দিবে।
ইরার বাবা মায়ের কথায় বাসার সবাই রাগান্বিত হয়ে যায়। আবার ইরার বাবার শেষের কথাটা কানে আসতেই বিভোরের কাকী মুনি রেগে গিয়ে ইরার বাবার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,,,
~ এখন তাদের এই বিয়েটা হয়ে গেছে। এখন আর কেউ এইটা আটকাতে পারে না।
বিভোরের কাকী মুনির কথায় ইরার আম্মু বলে উঠে,,,,
~ না এই বিয়েটা ভাঙ্গতেও পারে। বড় আপা যেভাবেই হোক এই বিয়েটা ভেঙ্গে দাও। তাদের দিভোর্স এর ব্যবস্থা করো চটজলদি। তিনি শ্রুতি দিকে এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরে টেনে কথাটা বলে উঠে।
এতোক্ষণে সবার কথা শুনে শ্রুতির হাত পা বরফের ন্যায় শিতল হয়ে গেছে। ভয়ে তার চোখ মুখ চুপসে গেছে। চোখের কোণে পানি জমে নিরব হয়ে সবটা দেখছে সে।
~ কি পাগলামো করছো। সরো এখানে থেকে বলেই বিভোরের আম্মু বিথী চৌধুরী ইরার আম্মু কে তিথির থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
~ ও আমার ছেলের বউ। এই বাড়ির বড় ছেলের বউ। ওকে সম্মান দিয়ে কথা বলো।
বিভোরের আম্মু তার ছোট বোনের কথা শুনে রেগে যান। আর যাই হোক পরিবারের উপর আঙ্গুল উঁচিয়ে কেউ কথা বলুক এটা তিনি মোটেও পছন্দ করেন না।
~ ছেলের বউ, সমস্যা। দেখছো সোহেল ( ইরার বাবা ), এরা দু টাকার মেয়েটার জন্য আমাদের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে। ভুলে গেলে তুমি ইরাকে।এক মুহুর্তের মধ্যে।
নিজের বোনের কথায় বিভোরের আম্মু চেঁচিয়ে বলে উঠে,,,
~ তুমি বোঝার চেষ্টা করছো না কেন রামেয়া ( ইরার আম্মু )। এই বিয়েটা ছেলেটার অমতে জোরপূর্বক দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম আমরা। তোমার জোড়াজুড়ি তে আমি ছেলের বাবাকে রাজি করিয়েছিলাম বিয়ের জন্য। কিন্তু ছেলের ইচ্ছেটার কথা জানতেই ভুলে গিয়েছিলাম।
আমার ছেলের জন্য ওই মেয়েটাই পারফেক্ট। প্রথমে আমার ও মত ছিল না ওদের বিয়েতে কিন্তু আমার পরিবারের সুখের জন্য সবকিছু করতে রাজী আমি। আমার ছেলের জন্য যাকে ঠিক করা হয়েছে তার সাথেই সে জোড়ি বেঁধেছে।
নিয়তিকে কেউ এড়াতে পারে না। যা ভাগ্যে লেখা ছিল তা তো হয়েই ছাড়বে ।আর যা কিছু হয়েছে তা তো হওয়ারই ছিল।
বিভোরের বাবা গিয়ে ইরার বাবাকে বোঝাতে থাকে,,,
~ দেখুন আমারা ইরাকে ছেলের বউ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু নিয়তি হয়তো অন্যটা চায়। আপনারা এসব কিছু ভুলে যান।আপনারা আমাদের আত্মীয়। সেই সম্পর্ক টা বজায় রাখতে পারেন।
বিভোরের বাবা কথাটা বলা মাত্রই ইরার আম্মু বলে উঠে,,
~ সোহেল, ইরা চলো এখানে থেকে।এমনিতেই অনেক অপমানিত হয়েছি আমরা। আর কিছু বাকী নেই।
আর আপনাদের এই কাজের জন্য অনেক দাম দিতে হবে।বলেই ওরা সবাই বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।
সবার চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ। সুন্দর একটা মুহুর্তকে তারা নষ্ট করে দিল।তবে বাসার সবাই অবাক হয়েছে বিভোরের আম্মুর এমন আচরণে।যে কিনা শ্রুতিকে একদমই পছন্দ করতো না অথচ আজ তার ই পক্ষ হয়ে কথা বলছে।
শ্রুতি সেখানে আর দেরী না করে নিজের ঘরে চলে যায়। আজ তার গলাটা ভারী হয়ে আসছে কান্নায়। সে সবার সামনে সেটা প্রকাশ না করে সোজা ঘরে চলে যায়।
বিভোর ও তার পিছু পিছু চলে যায়। শ্রুতির মনটা যে বেশ ভারী হয়ে গেছে শ্রুতি সেটা প্রকাশ না করলেও বাসার সবাই সেটা বুঝতে পারছে।
তারা চলে যাওয়া মাত্রই সবাই মিলে বিভোরের আম্মু কে তার এমন আচরণের কারন টা জিজ্ঞেস করে। বিশেষ করে বিভোর এর কাকী মুনি বেশ আগ্রহ নিয়ে কথাটা জানতে চায়।তার জবাবে বিথী চৌধুরী ছোট করে জবাব দেয়,,
~ সংসার টা কোনো খেলনার জিনিস নয়। আজ বউমার প্রতি রাগ , ঘৃনা নিয়ে থাকলে আমার প্রতি ও তার রাগ , ঘৃনা জন্মাবে। আমার মেয়ে সারাজীবন আমার কাছে থাকবে না কিন্তু বউমা সারাজীবন আমার পাশে থাকবে। হয়তো সে আমার বউমা হবে তবে আমি তাকে এখন থেকে মেয়ের মর্যাদা দিবো।
আমি আর আমার শাশুড়ি মা যেমন ছিলাম আমরা শাশুড়ি বউমাও তেমন সম্পর্ক তৈরি করবো। আমি তাকে যেমন শেখাবো সেও তেমন শিখবে। প্রত্যেক টা মেয়ের হাতেখড়ি তার মায়ের কাছেই হয় , আমার বউমার ও তাই হবে।
কিভাবে সংসারে শান্তি বিরাজ করবে তার সবটাই তোমার বাবার থেকে শেখা। আর এই ঘটনাটিও তার ব্যাতিক্রম নয় । ছোট্ট ছোট্ট বিষয়গুলো তোমার বাবা আমাকে কাল থেকে বুঝিয়েছেন।
আমি যতোই রাগারাগি, হিংসা, বিদ্বেষ করি না কেন তোমার বাবার কথায় কখনো অবাধ্য হয়না। আর তিনিও আমাকে কখনো খারাপ উপদেশ দিবেন না। আমি সব সময় তোমার বাবার উপদেশ মেনেছি , আর বাকীটা জীবন ও সেভাবেই কাটাতে চাই ।
আমার ছেলের বিয়েটা আবার শ্রুতির সাথেই হবে। পুরো শহর জানতে পারবে। গান বাজনা সবকিছুর আয়োজন হবে। নতুন করে এই বাড়িতে আবারো বউমার প্রবেশ হবে ।তোমরা শিঘ্রই সবকিছুর আয়োজন করো।
স্ত্রীর কথা গুলো মুগ্ধ হয়ে শুনেন সারাফ চৌধুরী।আর যাই হোক তার স্ত্রী তাকে মনে প্রাণে মেনে চলে। তিনি তার স্ত্রী কে যথাযথ মর্যাদা দিতে পেরেছেন। এবং বাকি সবাই ও অনেক খুশি হয়ে যায় তার আম্মুর এমন পরিবর্তনে।
বিভোরের আম্মু এমনিতেই খুব খারাপ আচরণ করেন না কারো সাথে। শুধু একটু আধটু শ্রুতির আম্মু এবং কাকী মুনি কে ঘৃনা করতেন। তবে আজ যেন তা ধোঁয়াশাই মিলিয়ে গেছে।
~ শ্রুতি বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। তার সবকিছুই বিরক্ত লাগছে। এই বাড়ি, বিভোর সবটার প্রতি সে সহ্য হীন হয়ে পড়ছে। তার উপর দরজা থেকে বিভোরের ক্রমাগত ডাক পড়ছে।
সে দরজা লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছে তার বিভোর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তার দরজা খোলার অপেক্ষায়। সে ক্রমাগত ডাক দিয়েই যাচ্ছে।
মেয়েটা ঘরে একা একা থেকে উল্টা পাল্টা কিছু করে না বসে।এই মেয়ের যে রাগ নিমিষেই সে সবকিছু উলোট পালট করে ফেলবে। তারে নিয়েই বিভোরের যত ভয়।
অবশেষে শ্রুতি বিরক্ত হয়ে দরজা টা খুলে দেয়।
~ এই আপনার সমস্যা কি হ্যা। বিরক্ত করছেন কেন।একটুও কি চুপ করে থাকতে পারেন না । সব সময় বককব বকবক করতে থাকেন। এতোক্ষণ ধরে দরজা ধাক্কাচ্ছেন কেন।কি বলবেন বলেন।
শ্রুতির এমন গড় গড়িয়ে কথা বলায় বিভোর একটু থতমত খেয়ে যায়।
~ আরে আমার রুম এটা। আমি দরজা ধাক্কাবো না কে ধাক্কাবে তাহলে। আমার রুমটায় একটুতো জায়গা দাও। নতুন নতুন বউ হয়েছো কোথায় একটু আদর যত্ন করবে, সেইটা না শুধু শুধু রুম থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দাও।
বিভোরের কথায় শ্রুতি দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,,,
~ কি বললেন আপনি , আমি সব সময় আপনাকে হুমকি দেই। আপনার ধারনা অনুযায়ী আমি ভালো মেয়ে না । আপনাকে সব সময় তটস্থ করে রাখি। আপনি আমার ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকেন।
আমি আপনার জীবন টা ভাজি ভাজি করে খাই । এটাই বলতে চাচ্ছিলেন না আপনি ।
আরে তওবা তওবা আমি কখন এই কথা বললাম। আমি তো এখন চুপচাপ ই ছিলাম।আর কি সব বলছো তুমি রাগের মাথায়।
বিভোরের কথায় শ্রুতি আবারো বলে উঠে,,,
~ আমি তো সব সময় ভুল কথায় বলি। আপনি মনে করে দেখুন আপনি কথাগুলো কবে বলেছিলেন। আমি আপনার জীবনটা ভাজা ভাজা করে ফেলি এই কথা আপনার ফ্রেন্ডদের কে বলেন নি হ্যাঁ।
শ্রুতির কথায় বিভোর জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলে উঠে,,
~ আরে তিন বছর আগের কথা এখন বলছো কেন। তিন বছর আগের রাগ এখন ঝাড়ছো আমার উপর।
~ তিন বছর পর কেন তিন যুগ পরেও আমি সব মনে করিয়ে দিবো।
~ কি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঝগড়া করতে পারে মেয়েরে বাবা। তিন বছর আগের কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মনে রেখেছে।আরো কত যুগ যে সে খোটা শুনতে হবে ।বিভোর কথাটা বিরবির করে বলে উঠে যা শ্রুতির কান পর্যন্ত পৌঁছায় না।
সময় কাটছিল স্বাভাবিক।মাঝে মাঝে শ্রুতির আম্মু আর ভাইয়ের কথা মনে পড়ছিল। এভাবেই দিনটা শেষ হয়ে রাতের শুরু হয়।
আজকে আমায় একটু বিছানায় নাও।আমার খুব কষ্ট হয় সোফায় ঘুমাতে। আমার পুচির আম্মু আমাকে বিছানায় একটু জায়গা দাও শুধু।
বিভোরের কথায় শ্রুতি চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। একদম না ।আপনি ভুলেও বিছানায় আসার চেষ্টা করবেন না। আপনার সঙ্গে ঘুমাবো না আমি।
~ পুচির আম্মু প্লিজ।
বিভোরের কথায় শ্রুতি না জবাব দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। তার স্ট্রেট জবাব। বিভোর সেটা মানুতে বাধ্য। তা সে বাধ্য ছেলের মতো সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ে।
0 Comments