লেখিকাঃ আবিদা সুলতানা


কঠোরভাবে কপি করা নিষিদ্ধ। যাদের অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প পছন্দ, তাদের জন্য এই গল্প নয়। অনুগ্রহ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। পুরো গল্প জুড়ে থাকবে ধোঁয়াশা, যা উদঘাটন করতে সত্যিকারের ধৈর্য প্রয়োজন। শুধুমাত্র রহস্যভেদে আগ্রহী পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত।


**********Facebook
গভীর রজনীর অন্তর্গত গ্রীষ্মের অতলান্ত উষ্ণতা পেরিয়ে যখন বর্ষার আগমন ঘটল, তখন ধরণীতে নেমে এলো প্রকৃতির ভয়াল তাণ্ডব। বায়ুপ্রবাহ হঠাৎ করেই পাগলপ্রায় হতে শুরু করেছে, প্রত্যেক ঝটিকা যেন ভয়ংকর মহাকালকে আগত করবার সংকেত বহন করছে। বিদ্যুৎপাতে আকাশমণ্ডল ভেদ করে মহাসম্ভাব্য গর্জন ধরণী প্রান্তে প্রতিধ্বনিত হলো, সেই রৌদ্ররাত্রি ক্রমেই অধিকতর ভীষণতর হতে লাগল। এই প্রলয়ঙ্কর রাতে প্রতিটি মুহূর্তে প্রকৃতি যেন রুদ্ররোষে, তার সমস্ত শক্তি প্রদর্শন করছে, যেন সর্বনাশী রাত সমস্ত কিছু গ্রাস করার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছে।
তুলকালাম ঝড়ের তাণ্ডবের মাঝে, র'ক্তমাখা দেহে বৃষ্টির ধারায় ভিজতে ভিজতে এক লোক মাটিতে লু'টিয়ে পড়ল। তার শরীর ভীষণভাবে ক্ষ'তবিক্ষ'ত, প্রতিটি আ'ঘাত থেকে র'ক্তধারা বইছে, যা বৃষ্টির সঙ্গে মিশে জমিনে লাল আঁকিবুঁকি কাটছে । তার চোখে আ'তঙ্কের ছাপ, পুরো দেহ কাঁপছে ভয়ে আর য'ন্ত্রণায়। প্রতিটি শ্বাস যেন আরও গভীর যন্ত্রণার স্রোত বইয়ে আনে, আর ঠোঁটের কোণে চাপা কান্না ও আর্তনাদ মিলে মিশে প্রকৃতির রুদ্রতায় হারিয়ে যাচ্ছে। র'ক্তাক্ত দেহের সম্মুখে দাঁড়িয়ে, এক আগন্তুক বক্র হাসি প্রকাশ করল এবং বলল,
- "তুই জানিস, র'ক্তের গন্ধ কীভাবে আমার র'ক্তপিপাসু আত্মাকে তৃষ্ণার্ত করে তোলে?? তোর র'ক্তে স্নান করিবার আর্তি এখন আমাকে আরও অস্থির করে তুলছে; আর প্রতীক্ষা করতে পারছি না!! "
তাঁর কণ্ঠস্বর যেন ম'রণোন্মুখ নিস্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করে দিচ্ছে, আর সেই ক্ষণেই প্রকৃতির প্রলয়কারীর সাথে মিলে গেল তার নিষ্ঠুর অভিব্যক্তি। করকোপ ধারালো অ'স্ত্রের আ'ঘাতে, শীঘ্রই পুরুষালী গো'পন অঙ্গে আঘাত হানার পর, র'ক্তের স্রোত অজস্রভাবে প্রবাহিত হতে লাগল। গগনবিদারী চিৎকারে আর্তনাদ করে উঠল লোকটি, য'ন্ত্রণার তীব্রতায় তার আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হলো আকাশে-বাতাসে। খু'নির চোখে তীব্র পৈশাচিক আনন্দের ঝলক, যেন তার প্রতিটি ব্য'থাতুর চিৎকারের মধ্যে খু'নি এক ধরনের বিকৃত তৃপ্তির সন্ধান পায়। খুনির মুখে ফুটে ওঠে এক অ'শুভ হাসি, যা এই নৃ'শংসতাকে আরও নি'র্মম করে তোলছে।
___________________________
দীপ্রহর চলমান, গ্রীষ্মের দাবদাহ বিদায় নিয়ে ধরিত্রীর বুকে নেমে এসেছে বর্ষা। প্রকৃতি যেন অন্তর্নিহিত অবসন্নতা বিস'র্জন দিয়ে নবপ্রবর্তনে সজ্জিত হয়েছে। তপ্ত দিনের শেষে অরণির উরঃপ্রদেশে সঞ্চরিত শুভ্র বাষ্পগুচ্ছো ক্রমশ বিকশিত হচ্ছে তমসাচ্ছন্ন মেঘে। আর সেই মেঘাচ্ছন্নতা থেকে সূচনায় সুক্রমে, পরবর্তীতে প্রবলভাবে আছড়ে পরছে নীরবর্ষণ। পৃষ্ঠভূমি জলস্পর্শে সিক্ত হয়ে উঠেছে, যেন দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর কাঙ্ক্ষিত স্নেহের পরশ পেয়েছে। তরুর পত্রবৃন্দ থেকে সঞ্চিত ধূলিকণা ধুয়ে গিয়ে একেবারে সতেজ সবুজে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। পবনে প্লাবিত হচ্ছে সজীবতার আবহ মৃত্তিকার সুবাস, প্লাবনের সুরভি । সর্বত্র এক ধরনের শীতলতা, এক ধরনের প্রশান্তি নিমজ্জিত হয়েছে।
তবে এর সাথে শাহারিয়াজ ভবনে আজ উল্লাসের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। গোটা গ্রাম যেন উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা। শাহারিয়াজ পরিবারের বড় ছেলে আরবিন শাহারিয়াজ মুগ্ধ বিদেশ থেকে ফিরে আসছে—একটা দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর। মুগ্ধের আগমনের খুশিতে ভবনটি সাজানো হয়েছে অভিজাতভাবে। প্রধান ফটক থেকে শুরু করে প্রতিটি রুম আলোকমালায় সজ্জিত। প্রতিটি কোণায় কোণায় ঝলমল করছে লাইটের ঝাঁপটায়।
শাহারিয়াজ পরিবার খুশিতে দাওয়াত দিয়েছে গোটা গ্রামকে—ফকির, মিসকিন থেকে শুরু করে ধনী, দরিদ্র, কেউই বাদ যায়নি। এমনকি তারা নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বি পরিবারকেও নিমন্ত্রণ করেছেন । যেন মুগ্ধের আগমনের উল্লাসকে সবার সাথে সমভাবে ভাগ করে নিতে আগ্রহী। ভবনের সম্মুখে জনসমাগম, সকলের মুখাবয়বের অভিব্যক্তিতে এক ধরনের কৌতূহল, প্রফুল্ল আর উদ্দীপনা।
----TikTok
এত উৎসব মুখর দিনেও শিকদার বাড়ির সকলেই চিন্তিত বেশ। এটি কি শুধুমাত্র আমন্ত্রণ পাওয়ার জন্য,নাকি মুগ্ধর আগমনের জন্য, তা পরিষ্কার অনুধাবন করা যাচ্ছে না। প্রত্যেক সদস্যবৃন্দরা ড্রয়িংরুমে, মুখমন্ডলের অঅভিব্যক্তি কঠোর করে নির্বিকারে বসে আছে। ইকরাম আলীর ললাটে চিন্তার সুক্ষ্ম ছাপ! পাশেই কুদ্দুস আলী এবং আজগর আলী বসে আছেন। পূর্বিকা, শান্ত, নাঈম, আলো সবাই বৈঠক স্থলে বিরক্তি সহিত বসে আছে । আঁখি এখনো কলেজ থেকে ফিরে নি। উক্ত দিনের পরবর্তী সময়ে মাঝখানে অতিবাহিত হয়েছে আরও তিন দিন। গৃহস্থ মহিলা সদস্যবৃন্দ স্থিত রয়েছেন কিছু শোনার প্রত্যাশায়। কুদ্দুস আলী রেগে উত্তেজনাপূর্ন কন্ঠে বলতে লাগলেন,
- "এবার ওরা বেশি বেশি করছে, আমরা কেওই ওই বাড়িতে যাবো না! এইসব কিছু ওই মোশারফের চাল!"
আজগর আলী সম্মতি জানিয়ে গম্ভীর গলায় বলেন,
- "হ্যাঁ,, আমাদের পরিবারের কেওই ওই বাড়িতে যাবে না! আমাদের খাওয়ার অভাব পরেছে? যে ওই শত্রুর বাড়ি গিয়ে খেতে হবে? "
শান্ত গলা মিলিয়ে বলে,
- "আমিও ওই বাড়ির মুখ দর্শন করতে চাই না! আর ওই মুগ্ধের তো আরো আগে না! "
এদের এসব কথাবার্তা শুনে নাঈম বেশ বিরক্ত। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফায় অস্বস্তিতে বসে, মাথা সামান্য উঁচু করে চোখ বুজে মনে মনে বলল,
- "ধুরর!! যত্তসব হাউসফুল ড্রামা! মনে হচ্ছে মলম বিক্রেতারা কম্পিটিশন করছে - এই আমার মলম নেন, এই আমার টা ভালো!! ওহহ গড!! মাথাটা ধরে গেলো!! বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে নয়ত, এই স্টার জলসার ড্রামা দেখার কোনো শখ নেই আমার উফফফ! "
তখনই ইকরাম আলী শান্ত গলায় গম্ভীরমুখে বলেন এক অপ্রত্যাশিত কথা,
-" না,, আমাদের বাড়ির প্রত্যেকেই যাবে!! "
ইকরাম আলীর কথা শুনে সবাই বিস্ময়ের সর্বোচ্চ সীমায়। প্রত্যেকের মাথায় যেনো বজ্রপাত ঘটে । সবাই চকিত দৃষ্টিতে তাকায় ইকরাম আলীর দিকে। এদিকে নাঈম একথা শুনে চোখ খুলে বড় বড় করে তাকায়। এরপর আবারো মনে মনে বাজনা বাজিয়ে সুর তুলে,
- "ধুমতানা ধুমতানা, দেরেনা দেরানা, ধুমতানা ধুমতানা, দেরেনা দেরেনা, আআয়ায়ায়া!! "
এরপর হেসে মনে মনে বলে,
- "এই মুহুর্তে এই বাজনাটা একদম প্রত্যেকের সাথে মিলে গিয়েছে, ওয়াহ জোসস!! "
আজগর আলী ইকরাম আলী কে বলেন,
- "কিন্তু ভাই,,,"
- "উহুম,, কোনো কিন্তু না! কুদ্দুস, তুই বলছিলি না, এটা ওর চাল? একদম ঠিক বলেছিস! ও ভেবেছে, আমরা হয়তো যাবো না এবং গ্রামবাসীর মধ্যে আমাদের সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি করবে। কিন্তু আমি তো এই গ্রামের চেয়ারম্যান। আমার দায়িত্ব হল সব দিক বিবেচনা করা। পারিবারিক শত্রুতার জন্য গ্রামের মানুষের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতে দেওয়া যাবে না। তাই, আমরা প্রত্যেকেই যাবো!”
কুদ্দুস আলী বলেন,
- "কিন্তু ভাই,, ওই বাড়ির বড় ছেলে আসছে! ব্যাপারটা আমাদের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে! "
ইকরাম আলী কিছুমাত্র উচ্চারণ করলেন না; কেবলমাত্র কপট হাসি ঝুলিয়ে, মনের গহীনে বললেন,
-"কালপ্রবাহ বয়ে যাক, যথাযথ সময়ে সবকিছু পরিস্ফুট করব।"
---------Instagram
কলেজের গেটের সম্মুখে এক গভীর অম্লান মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আঁখি। অবিরত কপাল চাপড়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে, যেন কপাল চাপড়ানোতেই তার দুঃখের অবসান ঘটবে। আজ ভাইয়ের আগমনের আনন্দে আছিয়া কলেজে উপস্থিত হয়নি। মিলি যাত্রার পূর্বে আঁখিকে বলেছিল, “বৃষ্টি আসতে পারে, চল একসাথে যাই।” অথচ আঁখির বইয়ের তালিকা এখনো সংগ্রহ করা হয়নি। এতদিন এসব প্রাপ্য বিষয় থেকে মন সরে গিয়েছিল। যখন স্যার ক্লাসে বইয়ের তালিকা ঘোষণা করেছিলেন, তখন তার চিন্তা ছিল নিজের জীবনের অযাচিত সমস্যা নিয়ে।
মিলিকে বিদায় দিয়ে নিজেই বইয়ের তালিকা লিখতে লাগলো। তখন আকাশে কালো মেঘের হালকা প্রলেপ, ঠান্ডা বাতাস পরিবেশকে শান্তিময় করে তুলেছিল। বৃষ্টির পূর্ব মুহূর্তের সৌন্দর্য ছিল প্রকৃতির অপরূপ শিল্পকর্ম। তবুও আঁখি পরিবেশের প্রতি এতটাই মুগ্ধ ছিল যে, মাঠের মাঝে একা বসে থাকল, প্রকৃতির সেই অপূর্ব অনুভূতি নিঃশ্বাসে শ্বাসে গ্রহণ করতে।
তবে হঠাৎই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো। ছাতা না নিয়ে বেরিয়েছে সে। বর্ষাকালে বৃষ্টি হবে এটাই তো স্বাভাবিক। বৃষ্টির পূর্বাভাসও ছিল। তবুও, অজ্ঞতার কারণে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে গিয়ে পরিবেশের সাথে অপর্যাপ্ত হয়ে পড়ল। এখন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে, ক্যানটিনে ছেলেরা আড্ডা দিচ্ছে, ক্লাসরুমগুলো তালাবদ্ধ। অনেক দেরি হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে আজ ভিজেই যেতে হবে।
ঠিক সেই মুহূর্তে, সামনে পা বাড়াতে গিয়ে আঁখি অনুভব করল, কেউ তার মাথার উপরে ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কে সেই মহানুভব ব্যক্তি?
আঁখি চক্ষু ঘূর্ণন করে সে ব্যক্তির প্রতি নজর নিবদ্ধ করলো, যে সত্তা সামনাসামনি তার প্রতি নিবদ্ধ হয়ে রয়েছে। তবে এই ক্ষণে যাকে সে অভ্যস্ত নয়, সেখানকার পরিচয় পরিলক্ষিত হলো। অগ্রে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরাফ, আধা ভেজা অবস্থায় ছাতা প্রসারিত করে তার দিকে প্রসারিত করেছে।
আরাফের দীর্ঘাঙ্গী গঠনের সুন্দর মুখমণ্ডলে অপ্রত্যাশিত হাসির এক টুকরো আলোর রেখা স্পষ্ট, তার ভেজা কেশ কপালের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে। নীল রঙের শার্টটি ভিজে তার শরীরের সাথে মিলিত হয়ে তার বলিষ্ঠ দেহের চরিত্র প্রতিফলিত করছে। আঁখির ক্ষুদ্রাকৃতির সামনে, আরাফ এক প্রকার স্তম্ভ সদৃশ বিশালতা ধারণ করছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আরাফের উপস্থিতি আঁখিকে বিশেষভাবে বিভ্রান্ত ও অপ্রস্তুত করে তুললো।
কিন্তু সভ্যতার সম্মান রক্ষার্থে সৌজন্যপূর্ণ হাসি অর্পণ করলো আঁখি। আরাফ এখনো তার ওপর ছাতা ধরে রেখে এক স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। সে কিছুই উচ্চারণ করছে না, ফলে আঁখি আরো বেশি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। অতঃপর নিজে থেকেই প্রশ্ন করলো,
- "ভাইয়া আপনি?? "
প্রত্যুত্তরে, আরাফ চিত্তচাঞ্চল্য ও সংকোচের সুরে বলল,
-"আমি আসলে আছিয়াকে নিতে এসেছিলাম। "
আঁখি তিরস্কারসূচক ভ্রু কুচকে বলল,
-" আছিয়া তো আজ কলেজে উপস্থিতিই হয়নি।"
আরাফ কিছুটা লুকানো কৌশলের চেষ্টায় বিব্রত হয়ে বললো,
-"ওহ, আমি তো বাড়িতে ছিলাম না, তাই জানি না। মনে করেছিলাম আছিয়া হয়তো এসেছে। ওর আবার ছাতা নেওয়ার কথা মনে থাকে না। আমি একজায়গায় গিয়েছিলাম সাথে ছাতাও ছিল তাই বাড়ি না গিয়ে সোজা এখানেই আসা। "
আঁখি যুক্তিসংগত মন্তব্যে দ্বিধান্বিত হলে আরাফ বললো,
- "তাহলে তুমি চলো, তোমাকে নিয়ে যাই। তুমিও তো ছাতা আনো নি । আমি না আসলে তুমি বৃষ্টিতে ভিজে যেতে। চলো, নিয়ে যাই।"
আঁখি আরাফের প্রস্তাবে বাধা দিয়ে সৌজন্যের হাসি দিয়ে কোমল কণ্ঠে বললো,
- "ধন্যবাদ ভাইয়া, কিন্তু আমার প্রয়োজন নেই। আমি ভিজেই যেতে পারব। আসি ভাইয়া।"
কথাটি বলেই এক মুহূর্তও অবসর না নিয়ে আঁখি তুমুল বর্ষণে ভিজেই চলে যেতে শুরু করলো। আরাফ আঁখির যাওয়ায় দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তার মনে যে আরও গভীর, অবর্ণনীয় ঝড় বয়ে চলেছে, তা কি কারো জানা আছে? এমন এক পরিস্থিতিতে মনে হয় দূর থেকে যেন কোনো অম্বরালি সুর ভেসে আসছে, সম্ভবত কোনো পথের বা সন্নিহিত প্রান্তরে। সেই সুরের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে,
~"হতে পারে কোনো রাস্তায়
কোনো hood তোলা এক রিকশায়
আমি নীল ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে, তুমি দেখলে না
রোদে পোড়া এ রোমিও চেহারা
তুমি বুঝলে না আমার ইশারা
মন বলে যদি থামতে, তুমি থামলে না………
……লোকে পাগল বলুক, মাতাল বলুক
আমি তোমার পিছু ছাড়ব না……"
অবিরতভাবে তাকিয়ে থাকতেই আঁখির অস্তিত্ব চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল। তার ছায়াও এখন অদৃশ্য। আরাফ ছাতাটি বন্ধ করে নিজেও বৃষ্টির জল সাগরে ভিজতে লাগলো। চলে যাওয়া রাস্তার দিকে এক নজর রেখে, অস্ফুটভাবে বলল,
-"যদি কখনও তুমি উপলব্ধি করতে পারতে, আমার অন্তরের অবধি গভীরতার সমুদ্রের প্রতি তরঙ্গের প্রতিটি ধ্বনি তোমার নামেই নিবদ্ধ। যদি তুমি হৃদয়ের সঙ্গীতযন্ত্রের প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলা দংশন বুঝতে পারতে। যদি তোমার আমার প্রয়োজন না-ও হয়, তবুও আমার তোমাকে অন্তহীন আকাশের মতো অপরিসীম প্রয়োজন। তোমার আমার প্রতি অপ্রয়োজনীয়তা হয়তো আমার তোমাকে জোরালোভাবে চাওয়ার মূল কারণ; হয়তো তা নয়, সঠিক কারণ আমি জানি না। তবে চন্দ্র, সূর্য, নভোলোক, বায়ু, এবং অন্যান্য স্বতঃসিদ্ধ বাস্তবতার মতো, এটি নিরপেক্ষ সত্য যে, তোমাকে আমার প্রয়োজন। "
- "যে হৃদয় বৃষ্টির সুরে স্নিগ্ধ, তার জন্য ছাতা নিষ্ফল।"
পেছন থেকে পুরুষালি কণ্ঠ শুনে আরাফ পেছনে ঘুরে তাকালো। বৃষ্টিতে সিক্ত হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা তার প্রিয় বন্ধু মিনহাজকে দেখে অবাক হলো না। আরাফ মৃদু হেসে মিনহাজের কাধে হাত রেখে বলল,
- "যদি সে বৃষ্টির সান্নিধ্যকে ভালোবাসে, তবে আমি সেই বৃষ্টির অন্তর্গত হয়ে তার সঙ্গের আবাহন হবো।"
-----YouTube
আঁখি বাড়িতে আসতেই আফিয়া বেগম তেলে বেগুনে জলে গিয়েছেন। তাঁর তীক্ষ্ণ ভাষার আক্রমণে বিষণ্ন কণ্ঠে তিনি অবিরত বলেই যাচ্ছেন, যেন বৃষ্টি ধোয়া কপালে গাঢ় মেঘ জমেছে। ভেজা শরীরে মেয়েলি দেহের ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আফিয়া বেগম চিৎকার করে রাগের আতিশয্যে বললেন,
-"এই! নিজের রূপ দেখিয়ে মন ভোলাতে পারিস না, তাই কি এখন শরীর প্রদর্শন করতে চাইছিস? তুই কি জানিস না, এখন বর্ষাকাল চলছে? ছাতা না নিয়ে গিয়েছিস কেন? এজন্যই তো আমি বলেছিলাম, বেশি পড়াশোনা করলে মেয়েরা অন্য কিছু হয়ে যাবে!"
বাড়ির সকল সদস্যের মন শত্রুপক্ষের আমন্ত্রণে প্রবলভাবে ম্লান হয়েছে। তাদের সম্মান ও মর্যাদার চিন্তায় তাঁরা এমন এক অবস্থায় পড়েছে যে, এমন দিন যেন শত্রুপক্ষেরও না আসে, কারণ তারা কখনো তাদের শত্রুকে আমন্ত্রণ দিতে প্রস্তুত নয় । প্রত্যেকের মন ভারি বর্ষণের মতো বিপর্যস্ত, শুধুমাত্র নাঈম ছাড়া, যে সম্পূর্ণ চিল মুডে রয়েছে।
এদিকে, আঁখি বাড়ি ফিরে আসতে বিলম্ব করায় রোকেয়া বেগম চিন্তিত হয়ে রিতু খালাকে কলেজে পাঠান ছাতা নিয়ে মেয়েটিকে ফিরিয়ে আনার জন্য। মেয়েটাকে বারবার বলেছিলেন ছাতা নিয়ে যেতে, নিশ্চিত নিয়ে যায় নি। রোকেয়া বেগম নিজের কক্ষে চলে গেলে, রিতু খালা দুটো ছাতা নিয়ে বের হবেন, এমন সময় ভিজে চুপচুপে হয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে আঁখি। এটি দেখে আফিয়া বেগম আরো ক্ষুব্ধ হন। আঁখি এখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, তার কোন বক্তব্যই নেই, কারণ দোষ তো নিজেরই। আফিয়া বেগম স্ফুলিঙ্গবৎ কঠোরস্বরে আদেশ প্রদান করলেন,
- "যা, গিয়ে রেডি হ, আমরা শাহারিয়াজ ভবনে যাব।"
এই কথা শুনে আঁখি অভূতপূর্ব বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়ল। নিজের কানে বিশ্বাস করতে পারছে না—এটা কি সম্ভব? বাড়ির সদস্যরা কি সত্যিই শত্রুর অভ্যর্থনায় যাবেন? মনে হচ্ছে এ ঘটনা ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী হবে। আঁখি আকাশকুসুম ভেবে রোবটের ন্যায় স্থীর দাঁড়িয়ে রইল। তা দেখে আফিয়া বেগম পুনরায় ধমক দিলে আঁখি দ্রুত পদক্ষেপে নিজের ঘরের দিকে চলে চলে যেতে লাগলো । তার শরীরের জল মেঝেতে ধীরে ধীরে প্রবাহিত হচ্ছে, যা দেখে আফিয়া বেগম বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন,
- " অকর্মণ্য মেয়ে কোথাকার! রিতু এই জায়গাটা দ্রুত পরিষ্কার করো। পানি ছড়িয়ে একদম স্যাঁতসেঁতে করে ফেলেছে।"
---TikTok
অবশেষে আঁখি ভেজা শরীরে কক্ষে প্রবেশ করতে উদ্যত হলো, কিন্তু শান্ত দরজার সম্মুখে নিজের বাহু দ্বারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করল। আঁখি তৎক্ষণাৎ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। শান্ত চোয়ালের পেশী শক্ত করে স্থির অবস্থায় দাঁড়িয়ে পড়ে। আঁখি শান্তর প্রতি বিরক্তির অভিব্যক্তি প্রকাশ করে উচ্চস্বরে বলল,
-"পথ আটকালে কেন? আমাকে যেতে দাও।"
শান্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আঁখির পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যালোচনা করল। যদিও আঁখি নিজেকে ওরনার দ্বারা আড়াল করেছে, তবুও তার কিশোরী নারীর শারীরিক আকার সুস্পষ্ট। শান্তের এভাবে পর্যবেক্ষণ করা আঁখির মর্মে বিরক্তির সঞ্চার করল। শান্তকে পাশ কাটিয়ে আঁখি এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে, শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
-"ভেজা শরীর কার কাছে প্রদর্শনের জন্য গিয়েছিলি? কলেজে কি এই আচরণ অনুমোদিত?"
এমন মন্তব্যে শান্ত তার মায়ের চরিত্রের সাদৃশ্যের সংকেত প্রদান করল, সঠিকভাবে প্রতিফলিত করে প্রবাদটি, ‘যেমন মা, তেমন পুত্র।’
এই উক্তি শুনে আঁখি তার ক্রোধ আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না। শ্যামবর্ণ মুখাবয়বে তার রাগের প্রকাশ স্পষ্ট হয়ে উঠল, তার মায়াবী চোখের জ্যোতি রাগের অনুপ্রেরণা সূচিত করে বলল,
- " আমার ব্যাক্তিগত ব্যাপারে তোমাকে কিছু বলতে আমি বাধ্য নই ভাইয়া। তুমি কি কখনও ভেবে দেখেছো যে, আমার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে তোমার মন্তব্য করা উচিত নয়? বড় ভাই হবার নাম করে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার তুমার নেই। "
কথাটি উচ্চারণ করেই আঁখি শান্তর পাশ কেটে কক্ষে প্রবেশ করে রাগে ধম করে শান্তর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল।আঁখির সাহস দেখে শান্ত রাগে তীব্রভাবে ঝালিয়ে উঠল। মনে হচ্ছিল, আঁখিকে এক থাপ্পর মেরে তার তুচ্ছ রাগ মাটিতে পুতে দেবে। তৎক্ষনাৎ শান্ত দরজার দিকে দৃষ্টি দিয়ে পৈশাচিক হাসি মুখে বিছিয়ে, রাগমিশ্রিত কণ্ঠে বলল:
- "ব্যক্তিগত? সেই দিনকার মেয়ে আজ আমায় ব্যক্তিগত শিক্ষা দিতে এলো? বড় হয়ে গেছিস, তাই না? বহুদূর গিয়েছিস?? আজ আমার সাথে তর্কে করা? এই অপমানের মূল্য তোকে চোকাতে হবে, আঁখি।"
-----Threads
বর্ষা এখন সাময়িক বিশ্রাম গ্রহণ করেছে, ফলে ধরিত্রীপুরের আকাশ হতে বৃষ্টির ধারাবাহিক প্রবাহ ক্ষণিকের জন্য থেমে আছে। শিকদার পরিবারের অগ্রণীরা নানা বর্ণিল গাড়ির সমারোহ নিয়ে প্রবেশ করলেন শাহারিয়াজ ভবনের সম্মুখে। একে একে গাড়ির দ্বার উন্মুক্ত করে তারা ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে লাগলেন। তাদের মুখে জড়িয়ে আছে এক ধরনের কৃত্রিম হাসি, যেন মনে হচ্ছে অনিচ্ছাকৃত প্রহাসের প্রয়াসে তারা প্রবলভাবে পরিশ্রম করছে।
শাহারিয়াজ ভবন আজ অপরূপ আভায় সজ্জিত। জাক-জমক সজ্জিত হয়ে ভরে উঠেছে আশেপাশের প্রতিটি কোণ, বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে সুগন্ধি সুবাস।
এই বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্যে মোশারফ সাহেব সাদরে এগিয়ে এসে শিকদার পরিবারকে সঙ্গ দেয়ার অভিপ্রায়ে হাসিমুখে স্বাগত জানান। ইকরাম আলী তার পরিবারের সকলকে ভেতরে গিয়ে বসতে বললেন এবং জানালেন, তিনি কিছুক্ষণ পরে আসবেন। আঁখির মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া স্পষ্ট—শাহারিয়াজ ভবনে আসার জন্য নয়, বরং তার জীবনের নানাবিধ সঙ্কটের জন্য। আলো আঁখির হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে, তাদের জন্য নির্দিষ্ট একটি জায়গায় আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে। আঁখির চোখ খুঁজে ফিরছে আছিয়াকে, ভাবছে মেয়েটা কোথায় আছে, ভাইয়ের আগমনে যেন বান্ধবীর কথা ভুলে গিয়েছে। চারদিকে মানুষের ভিড়, কোথাও পা ফেলার জায়গা নেই।
ইকরাম আলী, মোশারফ সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে বাঁকা হাসি ছড়িয়ে বলেন,
- "তুই কি ভাবলি আমি আসব না? তুই গ্রামের মানুষের সামনে আমার বদনাম করার সুযোগ পাবি? না, তোর সে আশায় গুড়ে বালি।"
মোশারফ সাহেব কৌতুক করে বলেন,
-"হাহাহাহা, সব জায়গায় রাজনীতি টেনে আনিস কেন?"
ইকরাম আলী রুক্ষভাবে উত্তর দেন,
- "আমাদের জীবনটাই তো রাজনীতিতে বাঁধা।"
মোশারফ সাহেব আজ ক্রুদ্ধ হয়ে চান না, তাই হাসি মুখেই বলেন,
- "আমার ছেলে ফিরে এসেছে, সেই আনন্দেই সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। আর তুই তো এ গ্রামের সদ্য নির্বাচিত চেয়ারম্যান, তোকে ছাড়া কীভাবে অনুষ্ঠান জমে?"
ইকরাম আলী মুখে হাসি রেখে কিন্তু ধীর গম্ভীর সুরে বলেন,
- "এর পেছনে যে তোর অন্য কোনো অভিসন্ধি রয়েছে, তা আমি জানি। আমায় এত সহজে বোকা বানাতে পারবি না!"
মোশারফ সাহেব কিছুটা অপ্রস্তুত হলেন। কিছু একটা লোকানোর প্রয়াসে মিথ্যে হাসি দিয়ে বলেন,
-"অতি চালাকের গলায় দড়ি, ইকরাম, তাই বেশি চালাক হতে যাস না।"
তারা দু’জনই মুখে হাসি রেখে একে অপরকে নিচু করে কথা বলছে, যেন দুই মেরুর সংঘর্ষ ঘটছে। কিছুক্ষণ এইভাবে চলে, এরই মাঝে সাজ্জাদ সাহেব দ্রুততার সাথে এসে মোশারফ সাহেবকে ডাকলেন। মোশারফ সাহেব যাওয়ার পূর্বে তার সহকারী মুহাম্মদ আরিফকে আদেশ করলেন,
-" গ্রামের চেয়ারম্যান ইকরাম আলীকে যথাযথ সম্মানের সাথে ভেতরে নিয়ে যাও।"
-----WhatsApp
আঁখি বাড়ির অভ্যন্তর থেকে বাহিরে এসে দাঁড়িয়েছে। পেছন দিকটায় কিছুটা নির্জনতা, লোকের আনাগোনা অপেক্ষাকৃত কম। অথচ পুরো বাড়িটা যেনো কোলাহলে পরিপূর্ণ, মেঘের গর্জনের মতোই সব কিছু ভাসিয়ে দিচ্ছে তাদের উপস্থিতি। এমন এক অমিতব্যয়ী আয়োজন, বিয়ের বাড়ির উৎসবও যেন এর তুলনায় ম্লান হয়ে যায়। মনে হয়, এই বাড়ির লোকেরা বিয়ে করলে নিশ্চয়ই দেশের বাইরে গিয়েই করবে।
আঁখির পেটে কিছুই নামেনি আজ, একেবারে মুখ শুকিয়ে আছে। উপরন্তু, শান্তর চোখে এমন হিংস্র দৃষ্টি, যেন আঁখিকে সুযোগ পেলেই গিলে খাবে। ওফফ, এসব কাণ্ডে আঁখির মাথা একেবারে গরম হয়ে যাচ্ছে, কিছুই ভালো লাগছে না। এরমাঝে প্রথমবার বান্ধবীর বাড়িতে এল, অথচ তার কোনো খোঁজখবর নেই। এত মানুষের মধ্যে কোথায় খুঁজবে ওকে? ভিড়ে ঠাসা এই প্রাঙ্গণে আঁখির মনটা ভার হয়ে আছে। তবে এই পেছনের দিকে একফালি বাতাসের প্রবাহ, মনটা হালকা করছে একটু।
আঁখি যখন মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিচ্ছিল, হঠাৎ করেই একটি রুক্ষ হাত ওর হাতটি শক্ত করে ধরলো। এই আকস্মিক স্পর্শে আঁখি যেনো দিশেহারা হয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ চোখ ঘুরিয়ে দেখে, চার-পাঁচজন বয়স্ক নারী-পুরুষ ওকে ঘিরে ধরেছে। তাদের চাহনি ভীষণ উদ্ভট, যেনো আঁখিকে পিষে ফেলতে এসেছে। আঁখির হাত এক বৃদ্ধা মহিলার মুঠোয়, তিনি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। এরপর পাশে থাকা আরেক বৃদ্ধা ওর হাত টেনে আপনদিকে ঘুরিয়ে নিলেন। আঁখির চোখে জল আসার উপক্রম, ভয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
-"কা… কারা আ… আপনারা?"
পাশের বৃদ্ধ পুরুষ আঞ্চলিক ভাষায় বলে উঠলেন,
-"তুই শাফায়াতের বেটি না বাহে?"
পাশের বৃদ্ধা তখন সম্মতি দিয়ে জোরে বলেন,
-"হ্যাঁ, হ্যাঁ, এইখান শাফায়াতের বেটি !"
আঁখি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, বুঝতেই পারে না এই লোকগুলো আসলে কারা আর এমন কথা তার উদ্দেশ্যে কেন বলছে। চারপাশের পরিবেশে একটা ভয়ের আবহ বিরাজ করছে, যেন সবকিছু আঁধারে ঢেকে যাচ্ছে। তার মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন জেগে ওঠে—এই অচেনা বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা তাকে শাফায়াতের মেয়ে বলে ডাকছে কেন? কী সম্পর্ক তাদের সঙ্গে? তারা কেন এমন জোর করে তার হাত ধরে রেখেছে?
আঁখির মাথা যেন শূন্য হয়ে যাচ্ছে, কেবল তাদের চোখের ভয়ের সেই ছায়া দেখতে পাচ্ছে, আর অনুভব করছে তাদের চেপে ধরা হাতের শক্তি, যা তাকে ঘিরে ধরে রেখেছে। ভয়ে তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, আর সে কিছুই বলতে পারছে না। পরিস্থিতির আকস্মিকতায় আঁখি পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
এই ঘটনা যেনো আঁখির হৃদয়ের সমস্ত সাহস চূর্ণ করে দিয়ে গেলো। আঁখি ভয়ে যেন কুঁকড়ে যায়, তার সারা দেহ ভয়ে কাঁপতে থাকে। তাদের প্রত্যেকের চেহারায় এক ভয়ংকর রূপ ধরা পড়ে, যেন আঁখির দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আঁখি আকুতি করে তাদের বলে,
-"আ... মায় ছছছেড়ে দিন... আপনাদের ভুল হচ্ছে।"
তবে সেই আকুতি যেন কোনো কাজে আসে না। আঁখির কোমল, চিকন হাত ধরে থাকা বৃদ্ধটি কঠোর ধমক দিয়ে রেগে গর্জন করে উঠে,
-"মিছা কথা কবু না বাহে! সেই চোখ, সেই নাক, সেই মুখখানা—আমরা ভুল করি নাই বাহে। তুইই শাফায়াতের বেটি!"
বৃদ্ধের কণ্ঠে এক অমোঘ দৃঢ়তা, যেনো তার দাবি সত্য ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। আঁখির মনটা একেবারে সংকুচিত হয়ে আসে, কী করবে বুঝে উঠতে পারে না।
- "ওয়াট আর ইউ অল ডুয়িং? লিভ দ্য লিটল গার্ল অ্যালোন।"
পেছন থেকে এক গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠ ইংরেজি মিশ্রিত বাণী প্রদান করলো। সেই বাণীর উৎস সন্ধানে আঁখি ও সকলের দৃষ্টি ঘুরে গেল পেছনের দিকে।
দেখলো, এক অতি শ্বেতাঙ্গ সুন্দর পুরুষ ধূসর শার্টে আবৃত, কালো আচ্ছাদিত জিন্সের পকেটে দুই কর্ণমুদ্রা হস্ত স্থাপন করে, ভাবলেশহীন দাঁড়িয়ে আছে। তার বলিষ্ঠ, শক্তপোক্ত দেহরূপ এমন, যেন তদীয় বস্ত্রের সীমা ভেদ করে বাহিরে প্রকাশ পেতে চায়। আঁখি মনে ভাবল—এ কি তবে এই ভবনের প্রধানপুত্র? উনিই কি সেই মুগ্ধ? সত্যিই তো, নামের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের সামঞ্জস্য কত নিবিড়! যে কেও প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হওয়ার বাধ্য। এই মুহূর্তে যেন চারিপাশ মুগ্ধতায় আবিষ্ট হয়ে উঠেছে।
আঁখির চিত্তে প্রশ্ন জাগল, এক পুরুষ কীভাবে এত অতুলনীয় রূপে আবিষ্ট হতে পারে? পূর্বেও সে বহু সুদর্শন পুরুষ দেখেছে, কিন্তু মুগ্ধের মাঝে যেন এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান, যাহা তাকে অন্য সকলের হতে আলাদা করে তুলেছে।
বৃদ্ধ ব্যক্তিগণ হয়তো তাঁর ইংরেজি কথার অর্থ উপলব্ধি করতে পারলেন না। মুগ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
- "আপনারা ওদিকে যান, সেখানে আপনাদের জন্য খাবার ব্যবস্থার আয়োজন করা হয়েছে।"
খাদ্যের নাম শুনেই উপস্থিত সকলের পেটে যেন ক্ষুধার্ত ইদুরেরা চিচি করে তোলপাড় শুরু করল। আঁখির হাত ছেড়ে তাঁরা আঁখির দিকে একবার দৃষ্টি মেলে, এরপর মুগ্ধ কর্তৃক নির্দেশিত স্থানে খাবার গ্রহণের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলেন।
আঁখি কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে মুগ্ধের দিকে তাকিয়ে আছে। মুগ্ধ কোন কথাই না বলে ঘুরে যেতে লাগলে, আঁখি পেছন থেকে ডেকে বলল,
- "ভাইয়া?"
মুগ্ধ আঁখির কথা কর্ণধার না করে পকেটে হাত গুঁজে যেতে লাগল । আবারও আঁখি ডাক দিল,
- "ভাইয়া?"
এবার মুগ্ধ দাঁড়িয়ে পেছনে না ফিরে, গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
- "What?"
মুগ্ধের কন্ঠ শুনে মনে হলো সে বিরক্ত তবে সেদিকে খেয়াল না দিয়ে আঁখি খুশি মুখে বলল,
- "আপনার জন্য আমি ওই অচেনা বৃদ্ধদের হাত থেকে বাঁচলাম । আপনি না থাকলে এতক্ষণে আমার কি যে হতো, আমিতো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।
মুগ্ধ আঁখির দিকে সোজা ঘুরে দাঁড়িয়ে একপলক আঁখির দিকে তাকিয়ে, মুখ গম্ভীর রেখে এক ভ্রু উচিয়ে বলল,
-"তোমাকে কে বলেছে যে আমি তোমাকে বাঁচাতে এসেছি? আমি তো দরিদ্রদের খাদ্য গ্রহণের জন্য জানাতে এসেছিলাম।"
আঁখি বিমূঢ় হয়ে যায়। মুগ্ধের বিশাল ছয় ফুট উচ্চতার সুদৃঢ় দেহ তার জন্য যেন একটি বিশাল খাম্বারূপে পরিনত হয়েছে, যেখানে টেনেটুনে পাঁচ ফুটের কোমল আঁখির ক্ষুদ্রদেহ মুগ্ধের কাছে পিপড়া সমতুল্য মনে হচ্ছে। যার সাথে কথা বলতে আকাশের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হচ্ছে বলে মনে হলো আঁখির। মুগ্ধর ঢেউ খেলানো চুলগুলি স্নিগ্ধ বাতাসে অপূর্বভাবে সজীবভাবে উড়ছে। মুগ্ধ তাচ্ছিল্যের চোখে কাচুমাচু করা আঁখির দিকে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করে যেখানে শ্যামবর্ণের গোলগাল মায়াবী মুখমণ্ডলে লজ্জার একটি আভাস প্রকট। ঘন পাপড়ি যুক্ত মায়াবী অক্ষিপট উপরের দিকে তুলে তার দিকে তাকাচ্ছে, আর ডান চোখের নিচে একটি ছোট্ট কালো তিলকে প্রথমে নজর পড়ছে। নাসিকা সরু কিন্তু বোচা, চিকন কোমল হালকা গোলাপি উষ্ঠদয় কামরে ধরে আছে মেয়েটা। সাদামাটা শুভ্র থ্রি-পিস পরিহিত আঁখির মাথার ওরনা দিয়ে ঘন কালো লম্বা কেশ মুগ্ধের দৃষ্টির আড়ালে রয়ে গেছে। আঁখি কিছু বলতে আমতা আমতা করছে, কিন্তু মুগ্ধ তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বিরক্তি নিয়ে চলে যায়। আঁখি মুগ্ধর যাওয়ার পানে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করে,
-"কি অদ্ভুত মানুষ রে বাবা!"
0 Comments